ময়ূরী মিত্র
পর্ব : এক
উত্তরবঙ্গ আসার পথে ভোরে বৃষ্টি নামল ৷ বেশ চমৎকার বৃষ্টি ৷ বড়ো বড়ো ফোঁটায় সারবাঁধা ভুট্টাগাছের ওপর পড়ছে ৷ ট্রেনের সাথীদের মধ্যে এবার প্রচুর বাচ্চা ৷ কাল রাত থেকেই একটি ছেলেকে আলাদাভাবে দেখছিলাম ৷ একটুও মোবাইল দেখছে না ৷ মা বাবাকেও দেখতে দিচ্ছে না ৷ কাচের জানলায় নাক ঠেকিয়ে কেবল গাছ দেখে যাবে ! তার মা বললে “রাতের বেলা গাছ কেউ দেখে ! অন্ধকারে গাছ দেখা যায়?”
ছেলে বলল “আমরা না দেখতে না পেলেও গাছগুলো তো আছে ! লুকোচুরি খেলতে পারব না তাহলে ! আমায় না দেখা না গেলেও আমি তো তখনো খেলছি !” এইসব শিশুর ঈশ্বরবাক্য অবশ করে ! ভোরে ঘুম ভেঙে দেখি, সে আগেই উঠেছে ৷ জানলায় তার নাকও বসে গেছে ৷ চারদিক ঝাপসা ! ট্রেনটা তখন গুঞ্জরিয়া স্টেশনের পাশ দিয়ে দৌড়োচ্ছে ! গুঞ্জরিয়া গুঞ্জরিয়া বলতে বলতে দুলছে ছেলে ৷ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল “রবীন্দ্রনাথ”৷ আত্মমগ্ন শিশু ! একটিমাত্র শব্দে কবিকে দেখতে পায় !
এন জে পি তে নেমে বৃষ্টির মধ্যে লাফাতে লাফাতে মাকে বলল, ” মা এই পিসি আর আমি সকালে একটা কবির স্টেশন বানিয়ে নিয়েছি ৷” কী জানি ! শিশুর কাছে প্রথমবার কিছু দেখা মানে হয়ত , যা সে দেখছে তার সদ্য নির্মাণ বা সূত্রপাত ! আমার এক বিশেষক্ষমতাসম্পন্ন ছাত্রী প্রথমবার নদী দেখে তার মাকে বলেছিল ” মা ও মা ওই দ্যাখো নদী হয়ে গেল ৷” আবার ধরুন , স্কুল গ্রামের দিকে বেড়াতে নিয়ে গেছি বাচ্চাদের ৷ রাতেও থাকা সেখানে ৷ বৃষ্টি কমছে আর চাঁদের অল্প আলো দেখা যাচ্ছে ! বাচ্চা বলে উঠেছে ” বৃষ্টি একটা নতুন চাঁদকে চান করিয়ে দিয়ে গেল ৷ ” জিজ্ঞেস করেছি ‘কখন হল নতুন চাঁদ ?’ বলেছে “ঐতো যখন আমি দেখলাম ৷”
শিশু perception -এর স্রষ্টা !! নাকি সে স্রষ্টার মতো প্রত্যক্ষ করতে পারে !
অজানা … এখন যেখানে আছি ,পাশেই সরকারি প্রাইমারি স্কুল ৷ ভর্তি ৷ পাহাড়ের শিশুদের কচিপাঠ শুনতে পাই ৷ আর এক পাশে ফুল দিয়ে সাজানো পাহাড়ি বস্তি ৷ খাওয়া শোওয়া নয় , এদের প্রথম কর্ম বোধহয় ফুলের গাছে জল দেওয়া ৷ সুষমা গুরুং এমন করে ফুলের গাছে হাত বোলাচ্ছেন ! মনে হল ফুলগুলো সংসারেরই কেউ ৷ এখানে এলে বোঝা যায় বস্তি অর্থ বসতি ৷
পর্ব : দুই
বৃষ্টি শেষ ৷ পাহাড়ের আকাশে ঝকঝকে তারা ৷ বৃষ্টি পাহাড়কে এত এত ঝাপসা করে ! শেষ হলে মনে হয় ‘বাবা আঁধার ! তুই এত উজল !’
ধাপে ধাপে গ্রাম ৷ গ্রামের ঝুঁটিতে কিছু তারা ৷ প্রতি গাঁয়ে কি আলাদা তারার ভুবন ! পৃথিবীর মতো আকাশেরও একটা ভুবন আছে গো ! রাতের কালে দুই ভুবন বরবউ হয় ৷ ঘরে ঘরে আলো জ্বলছে ৷ তারা আর মানুষের তৈরি আলো দুইয়ের মিশ্রণে তৃতীয় কোনো আলোসূত্র তৈরি হয়েছে ! রুটি ভাজির আগুনে রান্নার দিদির যুবতী মুখের টসটসে বিউটি গায়েব ! বদলে এক কর্মী মানুষের দুটো চোখ ফুটে উঠছে ! একভাবে বেলছে আর
ভাজছে ৷ ক্যাসারোল ভর্তি ভাজা শস্য ৷
উঁচু তলায় দাঁড়িয়ে পথের মানুষ দেখিনি কোনোদিন ৷ ইচ্ছেই হয়নি ৷ পাহাড়ে মানুষ দেখার হিসেব আলাদা ৷ নীচের গ্রামগুলোকেও বুকের অংশই মনে হয় ৷ আসলে মানুষে মানুষে ফারাক তো অর্থই করে ৷ এখানে সবাই একই আর্থিক পরিমণ্ডলে ৷ ফলে কে কোন উচ্চতায় সংসার পেতেছে ভেবে মরি কেন !
রান্নার দিদি আমাদের রাতের খাবার খাইয়ে কুড়ি মিনিট হেঁটে বাড়ি পৌঁছোবেন ৷ এখান থেকে দু গাঁ টপকে তাঁর “একলা বাড়ি !” মেয়ে নিয়ে সেখানে একা থাকেন ৷ এঁরা নারী স্বাধীনতা বোঝেন না ৷ নারীর স্বাধীনতা যে আলাদাভাবে পালন করতে হয় সেটাই জানেন না ৷ সারাদিন নিষ্ঠা ও সততা নিয়ে কাজ করে যান ৷ কেউ চিকেন খাচ্ছেন না হয়ত ৷ তাঁর ওমলেটে ঠিকঠাক বিটনুন পড়েছে কিনা সেটাও যত্ন করে দেখেন ৷ শ্রম যাঁদের বেশি তাঁদের কি ক্ষোভও কম হয় !
প্রবল সৌন্দর্যে ঈশ্বরের অনুভূতি জন্মায় ! অথচ মস্তিষ্কের অর্ধভাগ বলে ” ওহে মানুষের ওপরে কোনো সত্য নেই !” এ মুহূর্তে দুইই সত্য ! চিরকালীন যুক্তিবাদও সত্য আবার পাহাড়ের মায়ায় আমার আচ্ছন্নতাও সত্য ! সুন্দর দেখে যে অনুভূতি আসে , তাকে মিছে করতে পারে সুন্দরতর ৷
মৃত্যু অব্দি মানুষ সুন্দরতরের অভিযানে ৷ আমার বন্ধুকবি সুনন্দ ( অধিকারী ) বলেন ” সুন্দরতর হয় না ৷এক সুন্দরের বিকল্পও অন্য সুন্দর হয় না!” ওঁর কথা সত্যি হলে আজকের রাত বিকল্পহীন ৷ যুবতী রাঁধুনির আঁধার পথ হেঁটে আপন ঘরে দীপ জ্বালাও সত্যের সৌন্দর্য্যায়ন !
বাসন ঝকঝকে করে দিদি চলে যাচ্ছেন ৷ ভোরের আলোয় এঁটো বাসন মাজতে তাঁর ভীষণ আপত্তি ৷
পাহাড়ের পথে স্ট্রিট লাইট নেই ৷
বিন্দুরা নড়ে ৷ প্রতিভাস ম্যাগাজিন
খুব ভালো লাগলো। এমন সুন্দর যাপন, দর্শন, আহরণ ! একটি স্বচ্ছ নির্মল গদ্য।
চমৎকার লাগলো। বাচ্চারা অনেক কিছু অনুভব করতে পারে যা আমরা পারি না। কন্ডিশনিঙ্? তবে বড়োরাও যে পারেন তার উদাহরণ লেখিকা স্বয়ং এবং সুষমা গুরুঙ্।
বাঃ 👌❤️🙏
অনবদ্য লেখাগুলোর মধ্যে দিয়ে পাহাড়ের নিজেরাই আচ্ছন্ন যাচ্ছি। আর লেখিকা তো চক্ষু কর্ণের দ্বারা তার স্বাদ,মায়া সবটাই উপলব্ধি করেছেন। মানুষ যেখানে সুন্দরতর হয়ে ওঠে সেকি মানুষ হয়ে থাকে সে তো ঈশ্বর। সেই ঈশ্বরের আনাগোনা প্রকৃতির মাঝে। আর বাকি রইলো মানুষের সত্যতা। সেটাও বোধকরি ঐ ঈশ্বর সৃষ্টি করে রেখেছিলেন। শুধু বর্তমানে তেমন মানুষের সন্ধান খুব কম পাই। নাহলে -“সবার উপরে মানুষ সত্য ,তাহার উপর নাই।” মানুষ যখন সত্য তখন সেই সততার উৎকর্ষতা ঈশ্বরের তৈরী মানব সৃষ্টির কালেই সবচেয়ে উন্নত মাত্রা। তাকে ছুঁয়ে পেতে গেলে মানুষের মাঝে গিয়ে দাঁড়াতে হয়। লেখাটা পড়ে খুব ভালো লাগলো। লেখিকা কে অনেক শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা জানাই।
বাচ্চারাই বোধহয় সবচেয়ে বড়ো দার্শনিক। অসাধারণ লাগলো।
মানুষ দেখার কথা – ঝিরিঝিরি নেমে আসা পাহাড়ি নদীর মতো লেখা যা আবিষ্ট করে।