শরদিন্দু সাহা
লেখক পরিচিতি
বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।
বিষয় পরিচিতি
(রেভারেন্ড জেমস্ লঙ যে লক্ষ্য স্থির রেখে জীবনকে চালনা করেছেন তা শুধুমাত্র ঘটনাক্রম দিয়ে ধরা যায় না। তাঁর কর্মজীবনের পরিক্রমায় যে অন্তর্নিহিত শক্তি ও প্রভাব রয়েছে তাকে কোনও এক শিল্প মাধ্যম দিয়ে উপলব্ধি করা যায় না। কারণ কোনো সরলরেখায় তিনি তাঁর কাজকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, নানা উত্থান পতন ঘাত প্রতিঘাত তাকে পীড়িত করেছিল, বিপর্যস্ত করেছিল। তিনি প্রবল আত্মশক্তিতে তার মোকাবেলা করেছিলেন এবং কর্তব্যকর্মে অটুট ছিলেন। তাঁর কাজের পরিধি ও ব্যাপ্তি একজন শিক্ষকের, সমাজসেবকের, মানবপ্রেমির যা মূলত শাসক ও শোষিতর মাঝখানে একজন প্রতিবাদীর, সত্যবাদীর, বলা যায় একজন দ্বান্দ্বিক ব্যক্তিত্বের। যার না-বলা কথা, জানা-অজানার কল্পনা ও বাস্তবের মিলন নিয়ে উপন্যাস লেখা সম্ভব অসম্ভবের দোলাচল মাত্র, তবুও শব্দের মায়ায় ধরার সামান্য প্রচেষ্টা। কোথায় তার অন্ত হবে প্রকৃত অর্থে বলা খুব কঠিন। এই মহান মানুষটির শৈল্পিক জীবনকে ছুঁয়ে যাওয়া আর কি।)
ঘরকে বলি বেঘর হতে
চার্চ মিশনারি সোসাইটি, লন্ডনের ইসলিঙটন কলেজের ছবিটা দিনে দিনে ছায়া হয়ে আমার সঙ্গেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাশিয়া যাত্রার যৌবনের মুহূর্ত গুলো আমাকে মাঝে মাঝেই ধাক্কা মারে। এ যেন অন্য একটা আমি আমার উপর চেপে বসেছে। এমন অবস্থা হয়েছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে কল্পনাপ্রসূত পদক্ষেপ গুলো। কিন্তু প্রতিদিনের ভাবনা চিন্তাগুলো পাশাপাশি যেন সমানতালে চলছে। কোন কথাটা আগে বলবো। কৃষ্ণমোহন বলে চলে, ‘সব কিছুরই একটা ধারাবাহিকতা আছে, তবুও বলছি যা কিছু মনের ঘরে বাসা বেঁধে আছে, লাটাইয়ের সুতো ছাড়ার মতোই আকাশে উড়িয়ে দাও। পতপত করে যখন উড়বে, রংটা চিনে নিয়ে ঠিক সময়ে সুতো ছাড়ো, তাহলেই কাজের কাজ হবে।’ বুঝলাম ওর হিসেবটা একান্তই নিজের মতো, এর সঙ্গে অন্য কিছুর মিল অমিল দুটোই হতে পারে। তবুও ও তো নিজের মতো করেই গায়ে ধুলো মুখে নিজেই শুষে নেয়। শুরুতে আশ্চর্য মনে হলেও উদ্বিগ্ন হই নি। মানুষের অহরহ পরিবর্তন হয়, কখনও নিজেকে চেনে, কখনও চিনেও যেন ভুল করে চেনে। মানুষের এই জয়যাত্রা চিরকালের, একে উষ্কে দিতে পারলেই কার্যসিদ্ধি হয়। এই শহরটা নিজস্ব ঢঙে ডানা মেলছে, যা এখানে, কাল একটু দূরে, পরশু আর একটু দূরে, আরও দূরে পা বাড়াতে গেলে একটু একটু করে মিলিয়ে যেতে চায় কখনও ঘন আঁধারে, কখনও আলোর রোশনাইয়ে। এতদিন যাবৎ যা কিছু শিখেছি জীবন আমার হলেও নিজের নয়, অন্যের, এক সময় নিজের করে নিতে চাইলেও পর হয়ে যায়। জীবনের এই হিসেব কষার আমি কে! সকলকে জড়িয়ে নিয়েই তো অন্য অর্থ দাঁড়ায়। মানুষ বড় কাঁদছে, কেন কাঁদছে, কাঁদার রকম-সকম কী! মানুষকে নিয়ে মানুষের কাড়াকাড়ি টানাটানি ফেলে আসা দিনগুলোর, চলমান হা-হুতাশের, না-পাওয়ার যন্ত্রণার। মানুষের দরবারে হাজির করতেই হবে, তাইতো আমার অন্তরাত্মা জেগে ওঠে। প্রাচীনতা, পুরাতত্ত্ব, ভাষা আমার চিন্তার খোরাক জোগায়, প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে। কলকাতার মানুষ ও ঘরবাড়ি, ত্রিপুরার ঐতিহাসিক বিবরণ, প্রাচীন সময়ের কাশ্মীর, ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম ও আরও নানা বিষয় নিয়ে এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল, ক্যালকাটা রিভিউতে আমি নিবন্ধে উল্লেখ করেছি আমার চিন্তা ও চেতনা। বলার কথা তো এত তাড়াতাড়ি ফুরোয় না। কত কথাই না আমার বলতে হবে, বলাতে হবে। নতুন কথা না শোনালে বুঝবে কেমন করে খ্রীষ্ট ধর্মের খুঁটিনাটি। আমার মনে হলো একটা বাঙলা মাসিক পত্রিকা জরুরি। মাতৃভাষা ছাড়া আর কোন ভাষায় সারমর্ম বুঝে উঠতে পারবে? আর জ্ঞানের আলো না ছড়ালে যে অন্ধকারে ওরা পড়েছিল, অন্ধকারেই ডুবে যাবে। ‘সত্যার্ণব’ আত্মপ্রকাশ করে – মানুষের কথা বলতে হবে, মানুষের কথা মানুষকেই শোনাতে হবে, এখানে কোনো আপোষ আমি পছন্দ করি না। জাতিভেদ ভুলতে হবে, মানুষের কথা বলতে হবে।
আমি ক্রমশ বুঝতে পারছি মিশনারি হলেও, আমার নিজের পথ নিজেকেই বেছে নিতে হবে। আমি কী চাক্ষুষ করছি ওরা আমাকে ফাদার লঙ ও পুরোহিত লঙ এর থেকেও সাহেব-ভাই, সাহেব-বাবা সম্বোধন করতে বেশি পছন্দ করে। পুঁথিগত বিদ্যা মিশনারি কাজে জাহির করা অনুচিত কাজ হবে। দ্বন্দ্ব-জিজ্ঞাসা নিরসনের জন্য, মনকে শান্ত ও স্থিতধীর জন্য পুঁথিগত বিদ্যা কাজে আসতে পারে কিন্তু মিশনারি হওয়ার কাজে জীবনের শিক্ষাই কাজে আসে। প্রাতিষ্ঠানিক রীতি ও প্রথা নয়, মানুষকে শর্ত নিরপেক্ষ ভালোবাসাই আসল কথা। প্রথমদিকে আমার এই বিশ্বাসও জন্মেছিল এবং চার্চ মিশনারি সোসাইটির সেক্রেটারিকে লিখেছিলাম – ইংরেজি শিক্ষার আলোয় এ দেশ থেকে হিন্দুধর্মের কুসংস্কারগুলি ঝেঁটিয়ে বিদায় করা যাবে। হিন্দুধর্মের সঙ্গে লড়াইয়ে খ্রিস্টধর্মের জয় হবে। কলকাতা হবে ইংরেজদের দ্বিতীয় ওয়াটারলু যেখানে খ্রিস্টধর্মের জয় ঘোষিত হবে। হয়তো আমার এই ধারণা কোনও কার্যকরি ধারণা ছিল না কিম্বা কোনও সমাজের খোলস দেখে মন্তব্য সঠিক ছিল না, এর অন্তর্জগৎকেও বুঝে নেওয়া জরুরি হয়ে পড়ে। এতদিনের তিল তিল করা গড়ে তোলা এই প্রাচীন সভ্যতার অন্তরালে ফল্গুধারার মতো বয়ে চলেছে নির্জন স্রোত, তাকে জানা বোঝা জরুরি। আমাদের দেশের লোকেরা ব্যবসায় হাত পাকিয়ে বাহুবলে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে তৎপর হয়েছে বটে কিন্তু একদিন জবাবদিহি করতে হবে বইকি। দেশ শাসনে ধর্মবিস্তার শেষ কথা নয়, মানুষের প্রতিদিনের যাপন, দুঃখ কষ্টের হিসাব রাখতে হবে। দেশের আপামর জনসাধারণ কোন পথ দিয়ে হাঁটছে, আসলে কী চায় ওরা, শরীর ও মনের খোরাক ওদের একজন হয়ে বুঝতে হবে। এমনিতেই ইংরেজদের চালচলন, ভাবভঙ্গি ও শিক্ষদিক্ষা গাঁ-গঞ্জের গরীব মানুষ থেকে শত যোজন দূরে, কবে ঘুচবে কে আর জানে। টেকচাঁদ ঠাকুর, অর্থাৎ প্যারীচাঁদ মিত্রকে কথায় কথায় বললাম, মিত্র মশাই আপনার ‘আলালের ঘরের দুলাল’ পড়লাম। কী লিখেছেন মশাই, বাংলার মানুষকে এমন করে আগে তো দেখিনি, দিনরাত হরেক মানুষের সঙ্গে মিশি, আপনার চোখ দুটো আমায় ধার দেবেন তো কিছুদিনের জন্য। আপনি তো ‘বাংলার ডিকেন্স’। ঠাকুর কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, ‘এটা কী সঠিক মূল্যায়ন হলো, কোথায় বটবৃক্ষ আর কোথায় লতানো পত্রী, বাংলার সামান্য একজন লেখককে বিব্রত না করলেই চলছিল না।’ ঠিক আছে নিজেকে আর ছোটো করবেন না, বাংলার মানুষ জানে আপনি একটা রত্ন। কৃষ্ণনগর যাচ্ছি মিশনের কাজে, চলুন ঘুরে আসি। ‘শুনুন লঙ সাহেব, আপনি তো এত লোকের প্রশংসা করে বেড়ান। নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখেছেন। এই কয় বছরের মধ্যেই কেমন ঝরঝরে বাংলা শিখে ফেলেছেন, বলতে পারেন, লিখতে পারেন। এত বিদ্যা রপ্ত করলেন কেমন করে!’ উত্তরটা আমার জানাই ছিল, কিন্তু দিতে পারলাম আর কই। কত কাজের পাহাড়, কোনটা ফেলে কোনটা রাখি।
সমস্যা তো একরকমের নয়, নানারকমের। মনটাকে আমি কিছুতেই নিজের বশে আনতে পারছি না কলকাতায় আসার আগে আলেকজান্ডার ডাফ সাহেবের ‘ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইন্ডিয়া মিশন’ বইটা খুব মনোযোগ দিয়েই পড়েছিলাম। কিন্তু এখানে এসে যত দেখছি কিছুতেই যেন কিছুই মিল খুঁজে পাচ্ছি না। তবে কি ডাফ্ সাহেবের দেখাটা সঠিক ছিল না? কত কিছুই তো এই দুনিয়াতে ভুল ব্যাখ্যা হয়। ভুলের উপর আর এক ভুল চেপে বসে, দুনিয়াটা এইভাবেই চলে, তারপরে একদিন ভেঙেচুরে সব শেষ হয়ে যায়। দেশ আর দেশ থাকে না। শাসক আর জনগণের মাঝখানে একটা ফাটল ধরে। রিখটার স্কেলে যেমন ভূমিকম্পের পরিমাপ হয়, দেশের সীমানায় তো সেই সুযোগ থাকে না। কত তো তার অভিমুখ, একদিকে মেরামত করলেও অন্যদিকে হেলতে থাকে। এই হেলে যাওয়াটা বড় আজব বস্তু, মানুষের মনের সঙ্গে সংযোগ থাকে কিনা। উশৃঙ্খলতা আবার নানা ভাষায় কথা বলে, নানা রূপে এসে বিস্ফোরণ ঘটায়, ঘটা করে তার আড়ম্বরপূর্ণতা প্রদর্শন করে। কেউই এগিয়ে আসে না তার সমাধান করতে। সময়টা বড় বেসামাল, অন্যদিকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন গোঁড়া অন্ধ হিন্দু সমাজ, দুয়ের সাঁড়াশি আক্রমণে সমাজের বাইরের চেহারা যেমন ভেঙে চুরে চুর হয়েছে, অন্তরের কোনো সৌন্দর্যই অবশিষ্ট নেই। এই অবস্থায় আমার মনে হয়েছে ধর্ম ধর্ম না করে মানুষ করার হাতিয়ার হতে পারে শিক্ষা। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দের ১১ ডিসেম্বর মেডিক্যাল কলেজ থিয়েটারে প্রতিষ্ঠিত ‘বেথুন সোসাইটি’র প্রথম সভাতেই সদস্য হলাম। সাহিত্য ও বিজ্ঞান সেখানে মুখ্য বিষয় হয়েছিল, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্যারীচাঁদ মিত্রও ছিলেন, ডাফ্ সাহেব ধর্ম আলোচনা নিষেধ থাকায় সভ্য ছিলেন না। কৃষ্ণমোহন বন্ধ্যেপাধ্যায় বললেন, ‘ রেভারেন্ড ডাফ্ -এর শিক্ষার উপরে ধর্মকে প্রাধান্য দেওয়া আমি মানতে পারব না।’ আমি এখানে আট বছর মিশনারি হিসাবে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। এখন মনে হচ্ছে ইউরোপীয়ানরা এই দেশের ভাষা সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকায় এমন ধারণা পোষণ করেছে তাঁরাই একমাত্র সভ্যতার উত্তরাধিকারী। কিন্তু আমি যত হিন্দুদের সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হচ্ছি, আমার সেই ভুল ভেঙে যাচ্ছে।
এক ছাত্র বলল, ‘ফাদার, ইদানীং আপনাকে একটু অন্যমনস্ক দেখছি, একটু আনমনা হয়ে থাকেন, কোনো বিষয় নিয়ে ভাবছেন বুঝি।’
বললাম, না না, কোন নতুন বিষয় নিয়ে কাজ করতে গেলে একটু দ্বন্দ্ব তো আসবেই, তাছাড়া সময় কি সবসময় একরকম চলে, নানা পরিবর্তনের ঢেউ এসে ধাক্কা তো মারবেই, মেনে নিতে হবে। এইটাই জীবনের ধর্ম, অত ভাবলে চলে না। শুধু পড়াশোনা করলে চলবে না, সমাজকে শোধন করার চেষ্টা করতে হবে। বিজ্ঞান ভাবনা আর যুক্তিবাদী মন তৈরি না হলে সমাজের ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করা তো যাবে না। শুধু সাফাই অভিযান করা তো কাজের কথা নয়, ঝকঝকে তকতকে না হলে লোকের কাছে মুখ দেখাবে কেমন করে। আবার আলো ছড়ানোর কায়দাটা তো জানা চাই। আলোর তেজে ঝলসে যাবে না, একথা তো হলফ করে বলা যায় না। কত ভাবনাই তো মনের কোনায় উঁকি মারে। ধর্ম ধর্ম করে গোটা সমাজটাই না উচ্ছন্নে চলে যায়। পাড়ায় পাড়ায় মানুষের সংশ্রবে আসার আগে এই দেশ নিয়ে আমার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আবেগ আর পুঁথিগত বিদ্যা একটা নির্দিষ্ট গণ্ডিতে বেঁধে রেখে ভেবেছিলাম আমার চোখের আলোয় জগৎ দেখব কিন্তু এতগুলো চোখের নিষ্পলক দৃষ্টি আমার জীবন ও যৌবনকে অন্য খাতে বইয়ে দিতে শুরু করল। ওদের কথাগুলো তো ফেলনার নয় – ‘ ফাদার, ক্ষিদের জ্বালায় পেট চোঁ চোঁ করে, ধর্মের বুলি বড় তেতো লাগে। ধর্ম পাল্টালেও দেশটা তো পাল্টে যাবে না, ঘরও পাল্টাবে না। বরঞ্চ যার জায়গায় সেই থাকুক, এমন কথা বলুন, যা আমরা আগে কখনও শুনিনি।’ এরা তো মন্দ কথা বলে নি, ধন্দেই পড়ে গেলাম, এদের মনের ভেতরের কথা উদ্ধার করব, এমন সাধ্য কী আমার আছে! ওরা আমাকে ভালো করেই বুঝিয়ে দিল, ওদের মন বুঝতে হবে, ওদের জীবন চর্চাকে বুঝতে হবে, না হয় সময়টা ফুরিয়ে যাবে, ফুটো কলসিতে জল ঢেলে কোনও লাভ হবে না, কলসি কোনোদিন আর ভরাট হবে না। ফাদার ডাফ্ আর পাদ্রীরা গোড়াতেই এই ভুলটা করে বসেন নি তো? এর জবাব তো আমার কাছে নেই, নাকি অন্য এমন কোনো রাস্তা খোলা আছে, যার হদিস আমি পাচ্ছি না। আমার সতীর্থরা আমার কথাগুলো হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছে, ‘নেটিভরা এসবের কি বোঝে, বেশির ভাগই তো পড়ালেখা কিছুই জানে না। দেখবেন শেষে আমাদের শেখানো বিদ্যায় আমাদেরই না খেয়ে ফেলে, মূর্খ মূর্খই থাক, আমাদের দলে ভিড়বে ঠিক কথা, বিশেষ কিছু সুবিধা করতে পারবে না।’ ওদের কথায় আমার খটকা লাগল, আয়ারল্যান্ডের আর্থিক দূর্দশার সঙ্গে একই সারিতে ফেলে কিছুক্ষণ মাপজোক করে বুঝলাম আসলে তফাৎটা কোথায়। পরক্ষণেই মনে হলো মানুষের অধিকার কতটা তা মানুষকে জানিয়ে দিতে হবে, না হলে কাজের কাজ কিছুই হবে না, ওরা যেই তিমিরেই আছে, চিরকাল সেই তিমিরেই থেকে যাবে।
এই মানসিক টানাপোড়েনে ডেভিড হেয়ারকে মাথায় তুলে নিলাম। ইংরেজিতে শিক্ষা দিলেও মাতৃভাষায় শিক্ষাদানে আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতাম। যেই দুবছর আমি হেয়ার সাহেবের সান্নিধ্য পেয়েছি মনে হয়েছে এই মানুষটির নির্দেশিত পথেই রয়েছে সমাজের খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার চাবিকাঠি। প্রয়োজন হলেই নির্দ্বিধায় কাউকে তোয়াক্কা না করে যে কোনো দরজায় কড়া নেড়েছেন। আমি প্রখ্যাত চিকিৎসক সূর্যকুমার গুডিভ চক্রবর্তীকে চিঠিতে লিখেছি – এদেশের দরিদ্র মানুষ যে কজন শিশুসন্তানকে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয় বা যে কজন বিধবাকে স্বামীর চিতার আগুনে পুড়িয়ে মারে তার থেকে অনেক অনেক গুণ অসহায় দরিদ্র মানুষ বাংলার গ্রামে গঞ্জে কোনো চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে কুসংস্কার আর অশিক্ষার বলি হচ্ছে। আমি মনে করি সমাজ পুনর্গঠনের কাজকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ঊর্ধ্বে প্রাধান্য দিয়ে মানবকল্যাণকেই নিজের ধর্ম বলে বেছে নেওয়া উচিত। আমি চাই মাতৃভাষায় শিক্ষাবিস্তার, স্ত্রী-শিক্ষার প্রসার, সংস্কৃত পাঠের গুরুত্ব, বাংলাভাষার উন্নতিসাধন, চাষের উন্নতি এসব সামাজিক কাজই হওয়া উচিত প্রধান কর্তব্য। আমি এও জানি অন্যান্য আমার সতীর্থ মিশনারিরা আমাকে মিশনারি হিসেবে অনুপযুক্ত মনে করেন, আমার আচরণকে মিশনারি স্বার্থের পরিপন্থী বলেন। তাতে আর যাই হোক আমার লক্ষ্য থেকে আমাকে বিচ্যুত করতে কেউ পারবে না। আমি গ্রামের মানুষের কাছ থেকে আপনজনের মতো ব্যবহার পেয়েছি। তাঁরা বিধর্মী বলে আমাকে অপমান করেনি। ওরা যখন আমাকে বঙ্গবান্ধব বলে সম্বোধন করে তখন মনে হয় দেশ থেকে অত দূরে থেকেও আমি নিজেকে কখনোই একলা মনে করি না। মেকলে সাহেবের বক্তব্য আমি স্বীকার করতে পারিনি। কারন তিনি বিশ্বাস করতেন ‘মূর্তি পূজার অবসানের অর্থ হিন্দু ধর্মের বিলুপ্তি অর্থাৎ শিক্ষাবিস্তারের পশ্চাৎ-উদ্দেশ্য খ্রিস্টধর্মের প্রতিষ্ঠা; আর ফিল্ট্রেশন পদ্ধতিতে শিক্ষার বিস্তার।’ আমি মনে করি কবে এক শ্রেণি শিক্ষিত হয়ে নিচুস্তরে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেবে, এভাবে অপেক্ষা করে থাকলে শিক্ষার প্রসার হবে না। এ যেন নদী তীরে গালে হাত দিয়ে বসে অপেক্ষা করা কবে নদীর জল শুকোবে তবে নদী পার হব। আমি আ্যডমস্ রিপোর্ট অন্ ভার্নাকুলার এডুকেশনকে সম্পূর্ণ সমর্থন করে দেশজ বিদ্যালয়গুলির উন্নতির জন্য এবং মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। আমি গ্রামে গ্রামে স্কুলে ঘুরে ঘুরে দেখেছি কিভাবে ওখানকার গুরু মশাইরা দরিদ্র মানুষদের পড়তে লিখতে সুযোগ করে দিচ্ছেন আর এটাই হল দরিদ্র দেশের শিক্ষাবিস্তারের স্তম্ভ। পাঁচ বৎসরের চেষ্টায় প্রকাশিত হয়েছে ‘এ হেন্ড বুক অফ বেঙ্গল মিশন’ আমার দেওয়া তথ্যাদি সরকার ও অন্যান্যদের কাজে আসে। দেশীয় সমাজ জীবন ও সাহিত্য ব্যাপারে এশিয়াটিক সোসাইটি আমাকে জে.পি.ওয়াইজ সংগৃহীত ‘রাজমালা’ সম্পাদনা করার দায়িত্ব অর্পণ করেন। সোসাইটি জার্নালে’এনালাইসিস অফ দ্য বেঙ্গলি পয়েম ‘রাজমালা’ অর দ্য ক্রনিকল ‘ প্রকাশিত হয়।
আমি হাঁটছি তো হাঁটছি। হাঁটার কোনও বিরাম নেই। স্কুলের জীর্ণদশা দেখে আমার অন্তরটা কেঁদে ওঠে। স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে ছাত্রদের পড়াশোনার মান আমাকে ব্যথিত করে। শিক্ষার প্রসারে আরও অনেক স্কুল স্থাপন যে জরুরি কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন না হলে সাধারণরা অশিক্ষার ফলে জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত হবে। ওরা হাত জোড় করে প্রার্থনা করে – ফাদার, আমাদের বই পুস্তক নেই, কালি কলম নেই, ঘরের চাল নেই, পেটে ভাত জোটে না। সরকার কৃষি খাতে আর স্কুলের জন্য যা বরাদ্দ করে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। যদি আমার কাছে সম্পদ থাকতো এঁদের সকল দুঃখ দুর্দশার একটা না একটা সুরাহা করতাম, এমন যে অবস্থা আর চোখে দেখা যায় না। এমন সরকারের থাকার প্রয়োজন কী যারা চাষী মুটে মজুরদের দুঃখ দুর্দশার অবসান ঘটাতে পারে না। শহরের বাবুরা যারা ইংরেজ সাহেবদের তাবেদারি করে তাদের এই নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। সকল সুখ স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে ওরা তো দুধে ভাতে আছে। আমি রোজ আমার ঘরে ফিরে আসি আর মানসিক যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাই। ঘরের পাশের গাছটার মিষ্টি বাতাস এসে আমার সারা শরীরকে জুড়িয়ে দেয়। এই দেশ, এই দেশের মানুষের অভাব অনটন কেমন করে মিটানো যাবে, ভেবে কোনো কুল পাই না। শরীর ও মনের অস্বস্তি আমাকে কলম ধরতে বাধ্য করে। প্রশ্ন জাগে তবে কী অত্যাচারী ও টাকাসর্বস্ব বণিক ইংরেজরা আলাদা কোনও জাতের মানুষ যারা মানুষের দুঃখ কষ্ট দেখেও মুখ ফিরিয়ে নেয়, কেবল শোষণ করতেই যারা আনন্দে ডগমগ হয়। গ্ৰামের মানুষদের তাই তো অভিযোগের অন্ত নেই।
সঙ্কট যখন চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে যেন টুকরো টুকরো অন্ধকার নিজের মতোই জমাট বাঁধছে, একসময় সকল আলোকে শুষে নিয়ে চম্পট দেবে। যত কিছুই পরিকল্পনা মগজে ঘোরাফেরা করে, কোথাও ফুটো কলসীর মতো শূন্য হয়ে যাচ্ছে। মির্জাপুর ইংরেজি স্কুলটার বাঁধন আলগা হচ্ছে। মতিলাল শীল ও জেসুইটরা দুইটি স্কুল স্থাপন করলে এই স্কুলটির ভবিষ্যত নড়বড়ে হয়ে যায়। কেরানিগিরি তো শিক্ষার মূল লক্ষ্য হতে পারে না। সার্বিক মঙ্গল সাধন করতে হলে দরিদ্র জনগনের মানসিক উন্নতির বিধান আবশ্যক। দিনরাত শুধু এই ভাবনাই চেপে বসে এই দেশীয়দের মগজ কীভাবে আধুনিক শিক্ষার মোড়কে মুড়িয়ে দেওয়া যায়, হোক না আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান, হোক না আধ্যাত্মিকতা, কোনোটাকে বাদ দিয়ে কোনোটা নয়। প্রথম শ্রেণিতে নল দময়ন্তী ও বেতাল পঞ্চবিংশতি, দ্বিতীয় শ্রেণীতে স্ত্রী শিক্ষা। বাঙালি যদি বাঙলা ভাষার উৎপত্তি ও প্রাকৃতিক ইতিহাস নিয়ে না জানলো, শিক্ষা তো তাহলে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এই কথা ভুলি কেমন করে ছাত্র শিক্ষকদের ভালোবাসা আমার মানসিক জগতকেই পাল্টে দিয়েছে একটু একটু করে। ১৮৪২ সালে ইউরোপ যাত্রা করার সময় ওরা দেশীয় কারিগরের তৈরি দোয়াত ও মানপত্র দিয়েছিল, সঙ্গে দুর্ভিক্ষ কবলিত আয়ারল্যান্ডবাসীদের সাহায্যের জন্য এই স্কুল, আলিপুর ও আগরপাড়ার চার্চের পক্ষ থেকে ১১০ টাকা চাঁদা তুলে দিয়েছিল। কোথায় যাবো, কেমন করে যাবো ভাবতে গিয়েই কে যেন আমাকে বারবার ভেতরে নাড়িয়ে দিয়ে বলছে, আগে তো সকল মানুষ নিজেকে জানতে বুঝতে শিখুক, তফাত যত খুঁজবে, তত বেড়ে যাবে দূরত্ব। আমাকে অনেকদূর যেতে হবে, মানুষের ভিড়ে মিশে যেতে হবে। মানুষের কান্নার শব্দ আমার বুকে বড় বাজে। পরাধীনতার শিকল আমার দেশের মানুষও গলায় পড়ে আছে। সেই শেকল ভাঙার গান ওরাও মনে মনে গাইছে। দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে আমেরিকায়। এই যন্ত্রণা গেঁথে আছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নিজেকে তাই কি উজাড় করে দিতে চাই, খুঁজে পেতে চাই এই হতদরিদ্র মানুষের দুঃখ কষ্ট বেদনায়। এমিলি ওরমেকে হারাই আমি ত্রিশ বৎসর বয়সে ১৮৪৭ সনে, লন্ডন থেকে কলকাতা ফেরার পথে সামুদ্রিক রোগে সে মারা গেছে শুনে আমার মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ল। বুঝলাম, নিয়তি যতই আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে খেলা করুক, তাকে জবাব দেবার মতো নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হবে। জমি জলা বুজিয়ে মাটির বাড়ি থেকেই চলবে আমি যা কিছু করা জরুরি মনে করছি। আমি যখন পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে বেড়াই কে কোথায় কেমন আছে, কী কী আমাকে করে ফেলতে হবে, কত প্রশ্নই তো মনের ভেতর উড়ে এসে জুড়ে বসে। তবে এটা বুঝলাম মানুষের অজ্ঞতাই মানুষকে কুসংস্কারের বন্ধনে জড়িয়ে রেখেছে। তবে কিনা ওদের অভিজ্ঞতার বহর আর অর্জিত জ্ঞানের মধ্যেই রয়েছে এমন মণিমুক্তা যা ইউরোপীয়দের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় শুধু নিয়ম নিষ্ঠার মধ্যে মিশিয়ে দিতে হবে। কতটুকু প্রাপ্তি কতটুকু অপ্রাপ্তি সে কথা না হয় পরে ভাবা যাবে। এখানে এসে যখন দেখলাম মহামারি গ্ৰাম থেকে গ্ৰাম উজাড় করে দিচ্ছে, চিকিৎসক নেই, ঔষধ নেই, উপায় জানানোর মানুষ নেই। মনে হলো মানুষ গুলোর কী হবে। সরকার তো চোখে পট্টি পড়ে আছে। এদের চেনা বিষয়ই জানার দরজাগুলো এক এক করে খুলে দেবে। মানুষগুলোকে আত্মীয়তার বন্ধনে জড়িয়ে ফেলতে হবে, না হলে এক এক করে রাস্তাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে, অন্ধকারে পথ চলতে চলতে কখন যে হোঁচট খাবে কে জানে। নতুন কিছু গ্ৰহণের মধ্যে বাহাদুরি আছে, সমঝোতা চলে না। সরকারের বাহাদুরের ইচ্ছে আছে কিন্তু অভিসন্ধি কম আছে, একথা কেমন করে বলি। এদেশীয়দের সাধারণেরা গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে, ঢাকঢোল পিটিয়ে জাগিয়ে তুলতে হবে। আমার ভাবনা চিন্তাগুলো আসে আর যায়, কিন্তু কেমন ভাবে ধরলে এরা কমপক্ষে এটা ভাববে না, আমি ওদের শত্রুপক্ষের লোক নই। ঝড়ঝঞ্জায় মাথার উপর টালির ছাদখানা ভেঙেচুরে যায়, দুবেলা দুমুঠো ভাত জোটে না, মহাজনের কাছে দেনার দায়ে গলা পর্যন্ত ডুবে আছে, কন্যাদায়গ্ৰস্ত পিতার যে জ্বালা, সমাজ কর্তাদের সমূহ নিদানে মাথা তুলে দাঁড়ানোর মাটি আলগা হয়ে আছে, ওদের কেমন করে বলি আমার ডাকে সাড়া দাও। নিজেকে ভিন্ন সারিতে বসালে মনে হয় ফাঁকিটা এড়ানো তো যাবেই না, বরঞ্চ দিনে দিনে ওরা আরও দূরে সরে যাবে।
মির্জাপুর স্কুল নিয়ে জড়িয়ে থাকলে এই দেশের মানুষদের খোঁজ পাওয়া সহজ হবে না। মানুষের মুখগুলো যেখানে আড়ালে পড়ে আছে, তাঁদের খুঁজে পেতে সামনে এনে হাজির করতে হবে। ওদের কুড়েঘরের অন্দরে ঢুকে জানতে হবে মনের কথা। আমি এটা বুঝতে পারি কী সাহেবসুবোরা কী এদেশীয় বাবুরা নিজেদের মৌজমস্তিতেই এমন মেতে আছে, ফিরে যে তাকাবে সেই দায় দায়িত্ব কোনোটাই নেই। অথচ আমার যে প্রাণ কাঁদে এটা কিন্তু মিথ্যা নয়। দু-একজন যারা খ্রিস্টান হয়েছে চাষাভুষা লোক ওরা মনের আনন্দে আমার কাজ করে দেয়, সুখঃদুখের অংশীদার হয় আত্মীয়র মতো। ওদের কোন ঘরদোরে আমার পা পড়লে ধন্য ধন্য করে। বলে, ‘বাবু গরীবের ঘরে আপনার মতো গুণী লোকের পা পড়েছে, আমাদের জাতের বড়বাবুরা তো ফিরেও তাকায় না, উঁচু জাতের মানুষরা ছুঁয়ে ফেললে বলে, ‘তোদের শরীরে ছোটো জাতের গায়ের গন্ধ, তফাত যা।’ কথাটা যে ফেলনার নয়, নিজের দেশের লোকেদের জীবন থেকেই টের পাই। ওদের কথার ভঙ্গিতে কত যে চালচলনের ভাবসাব ফুটে বের হয়, বলার কেউ নেই, ধরার কেউ নেই, খালি নিন্দে মন্দ, খুঁত খুঁজে বেড়ানো, সময় সুযোগ পেলে গাঁ ছাড়া করে জমিজমা কেড়ে নিতে পারলে মনের সুখ। ওদের ফাটাফুটা শুকনো মুখগুলো কবে তরতাজা হবে, কেউ জানে না, অস্তিত্ব আছে কি নেই, চিন্তাতেও ঠাঁই হয় না। ওরা মাথা নিচু করে দয়ার পাত্র হয়ে দোরে দোরে ঘুরে মরে। ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দুমুঠো জোগাড় করতে পারলে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়, আর না হয় আধপেটা খেয়ে অপেক্ষায় থাকে কখন সকাল হবে, সকলের লাথিঝাঁটা কপালে জুটবে। আমি ভাবি, ওরা কি নিজেকেও নিজে একবারের জন্য প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে না, কেন ওদের এমন দশা হলো, কেমন করে হলো, কাদের জন্য এমন পরিণতি – কে দেবে এর উত্তর? আমি পাদ্রী লঙ এদেশের মাটিতে পা রেখেছি, এখানকার ধুলো-বালি-ছাই গায়ে মাখছি, এই সবের পেছনে আছে কোনও ইঙ্গিত না কি সবটাই নিছক ঘটনাক্রম? প্রশ্ন আমার আছে, হাজারো প্রশ্ন। প্রশ্ন জাগে আমার এখন কি করা কর্তব্য, মানুষগুলোর ধর্মবিশ্বাস ও আচার নিষ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করব, নাকি ওদের ইচ্ছা অনিচ্ছা গুলো নিয়ে কাটাছেঁড়া করব। এই এক অদ্ভুত পৃথিবী! বিচ্ছিন্ন দ্বীপে কারা যেন ঘুমিয়ে আছে, চোখের কোলে শত শত বছরের ঘুমের ঘোরে অল্পস্বল্প আলোর মায়া এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে এক এক করে, হয়তো কোনোদিন মিলে যাবে, না হয় নিজের কথাগুলো নিজেরাই বলে থেমে যাবে, কেউ শুনলো কি শুনলো না কী আসবে যাবে!
কথা আসবে, কথা থেমে যাবে, কথার প্রতিধ্বনি হয়ে ভেসে বেড়াবে দূর থেকে আরও দূরে, একদিন পৌঁছে যাবে অন্য কারও কানে, নিজেরা পুষ্ট হবে, অন্যদেরও চিনিয়ে দেবে কেমন করে পৃথিবীর দায়ভার বয়ে বেড়াতে হয়। আমার কাছে ওরা যখন জানতে চাইল, আমার পথ কী? কোন পথ দিয়ে হাঁটলে আমরা আমাদের বাড়ির দরজায় পৌঁছে যাব, বলতে পারবেন কী? নিশ্চুপ ছিলাম, নিশ্চিন্ত হয়ে বলতে চাইলাম আমিও এই পথ খুঁজব বলেই অত সমুদ্রের জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেছি। ওরা আমার কথা বিশ্বাস করলে কি করল না, এই দায়ভার আমার নয়, শুধু উচ্চারণই করতে পারি আমি। রোগা, শুকনো, প্যাকাটে মানুষগুলো ইতস্তত এপাশ থেকে ওপাশে ঘুরে বেড়ায়, মাঝে মাঝে এসে চণ্ডীমন্ডপের দাওয়ায় এসে খোশ গপ্প করে। এরা আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকায়, টিপ্পনী কাটে, যা মনে খুশি পায়, তাই বলে – কী সাহেব-বাবা, আমাদের দেখে কেমন লাগছে? তোমার দেশের লোক আর আমাদের লোকের তফাতটা কী কিছু বুঝতে পারলে? বললাম, এ-ও বুঝলে না, এত সহজে কী কেউ ধরা দেয়! ‘আচ্ছা, আমাদেরকে জানা-বোঝার তোমাদের এত সাধ কেন? কালাপানি পার করে এয়েছ দেশের লোকের ধম্ম পাল্টাতে। ধন্য বাপু তোমাদেরকে, চেষ্টা-চরিত্র করে দেখ দলে ভেড়াতে পার কিনা।’ এটা বুঝতে অসুবিধে হলো না, মানুষগুলোর কথাগুলো ফেলনার নয়, একটা গভীর মর্মকথা আর ব্যথা দুটোই যেন গুমড়ে মরছে। কলিকাতার শহরের বাবুলোকেরা শেকস্পিয়র ও বেকন নিয়ে তর্জমা করে বটে, কিন্তু এদের অস্থিমজ্জায় বয়ে চলেছে কথার পরে কথায় হাজার হাজার বছরের অভিজ্ঞতার ফসল। এদেরকে এইভাবে মেলাতে চাইলে সে-ও এক বড় রকমের মূর্খামি, বরঞ্চ বেশি ভালো হয় যদি কোনও কারিকুরিতে এদের ভাব-ভাবনাগুলো নিজেদের সঙ্গে একই পাল্লায় দাঁড় করানো যায়। ওরা কী বুঝল না, বুঝলাম না। ওদের অট্টহাসিতে ঘরবাড়ি গাছপালা সবকিছু যেন কথা বলে উঠল – সাহেব-বাবা কেমন জব্দ হলো! নিজেকে এমন দশায় দেখব কস্মিনকালেও তো ভাবিনি। এই দেশটাকে আমি আজব দেশ বলি কী করে, তবে এমন এক অদ্ভুত দেশ, যে দেশের মানুষ নিজেকে নিয়ে কেমন উদাসীন থেকেছে, কে এল আর কে গেল এই নিয়েই মাথা গলায় নি। কেউ এদেরকে চিনেও নি, চিনতেও চায় নি। ওই মুহূর্তে আমার এতকালের শিক্ষা বিদ্যে বুদ্ধি যেন ধুলোয় মিশে যেতে চাইল। বুঝতে চেষ্টা করলাম এই বঙ্গদেশের আকাশে বাতাসে এমন কী জাদু আছে, যেই এই দেশে আসে, খালি মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে দেখে কোথাও সোনা হিরে জহরত মিলে কিনা। ওরা তো বলেই খালাস ‘কী সাহেব-বাবা পেলে কিছু, পাবেও না, কোনও কালেও পাবে না, এমনিতে পাওয়া যায় না, আর একটু ডুব দাও, তাল পুকুরের জল গায়ে লাগুক, সব কালিঝুলি ধুয়ে মুছে যাবে, তবে যদি দেখা মেলে।’
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)