নির্বাক
আমি আমাকে ততটাই ভালোবাসি যতটা না বাসলে আমার অস্তিত্বসংকট ঘটে যেতে পারে। এমনিতেই আমি বিপন্ন প্রজাতিভুক্ত জন্মলগ্ন থেকে এবং পরবর্তী সময়ে আমার কার্যকলাপ আমার ললাটে এই তকমা সেঁটে দিয়েছে। আমি সেই আতঙ্কের তাড়নায় বা স্বাভাবিক কারণে আমার বংশবিস্তার ঘটিয়ে চলেছি বিপুল পরিমাণে যদিও তবুও আমার ভাগ্য থেকে ওই নিষ্ঠুর তকমা ঘুচে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না।
আমি দায়ী করব কাকে? শত্রুপক্ষ আছে আমার অনেক। তারা দৃশ্য বা অদৃশ্য। তারা সতত আমাকে আক্রমণে উদ্যত। কিন্তু তাদের তরফ থেকে এমনই আঘাত আসা বিচিত্র নয় যা আমাকে বিলুপ্ত করে দিতে পারে। তারা আমার সম্মুখে বা নাগাল বহির্ভূত। দুর্ভাগ্যক্রমে তাদের অনেককে নিয়ন্ত্রণ করার কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না। আবার কিছু অন্তত আমার সাময়িক বশীভূত হয়ে থাকলেও কবে যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে আমাকে ভয়ানক আঘাত হানবে তা নিজেও জানিনা। এইসব বিষয়গুলি অনেকে আমারই বাসভূমিতে সহাবস্থানে বিদ্যমান আবার অনেকেই বহিরাগত শক্তি এবং তারা দূরে কোথায় থাকে বা কী তাদের কাজকর্ম আমার গোচরীভূত নয়। এইসব বিষয়গুলিকে এক কথায় বাহ্যিক শক্তি বলা যেতে পারে। তাদের কার্যকলাপ কিছু আমার গবেষণায় ধরা পড়লেও অধিকাংশই অজ্ঞাত।
বাহ্যিক ও বহিরাগত শব্দ দুটি তাৎপর্যপূর্ণ। আমার শত্রুপক্ষ দুটি শ্রেণীতে চিহ্নিত হতে পারে যাদের এক সঙ্গে বাহ্যিক বলা যায়। এদের একটি শ্রেণি আমার স্বভূমিতেই থাকে এবং দ্বিতীয় শ্রেণীটি তার বাইরে অন্য কোথাও যাকে আমি বলেছি বহিরাগত। সামগ্রিকভাবে দুটি শ্রেণীকে আমি বলেছি বাহ্যিক।
নিজেকে ভালোবাসাই কি আমার কাল হতে চলেছে? নিজেকে ভালোবাসা অপরাধ নয়। তাহলে এমন হবে কেন? হতে পারে যদি ভালোবাসাটা অত্যধিক হয়। তাই কি? নিজেকে অত্যাধিক ভালোবাসাই কি আমাকে সংকটে ফেলতে যাচ্ছে? ব্যাপারটা আমার কাছেও দুর্বোধ্য। নিজেকেই নিজে বুঝে উঠতে পারি না আমি সর্বক্ষণ।
নিজেকে ভালবাসতে গিয়ে নিজের অস্তিত্ব সংকটের কথা ভেবে এমনই কাজ অহরহ করে চলেছি যে আমি এবং আমার ভবিষ্যৎ আরও বিপদগ্রস্ত হয়ে চলেছে। আমার মধ্যেই আমি দেখতে পাচ্ছি বিরুদ্ধশক্তিগুলির সহাবস্থান ও দাপট। তারা প্রত্যেকেই আমাকে বাঁচাবার জন্য এতটাই ব্যস্ত, এতটাই আমাকে ভালবাসে যে আমার নিজের কার্যকলাপই সবসময় পরস্পর বিরোধী হয়ে যায়, আর এমনিধারা পরস্পরবিরোধী মানসিকতা ও কাজকর্ম নিজের অনিবার্য ধ্বংসকে যে ত্বরান্বিত করে তুলছে বুঝতে পারলেও নিজেকে নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। এ কেমন বোকামি বা অসহায়ত্ব দেখে নিজেই থই পাই না।
নিজেকে অত্যধিক ভালোবেসে নিজেকে বাঁচাতে নিজের বাসভূমিতে আমি অন্য উপস্থিতি অপছন্দ করি। তাদের হটিয়ে দিতে বা বিলুপ্ত করতে এমন সব পন্থা অবলম্বন করি যা পরে বুমেরাং হয়ে আমাকে আঘাত করতে থাকে। এটা আমি দেখতে পাই না, এমনই অন্ধ হয়ে যাই। আমার যা চারিত্রিক গুণাবলী যা আমার সম্পদ এবং যেসব সযত্নে পরিচর্যা করলে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হওয়ার সম্ভাবনা, আমার মধ্যে লুকিয়ে থাকা কোন এক অশুভ শক্তি সেগুলিকে অদ্ভুতভাবে আমার চোখে বিপদজনক হিসেবে প্রতিপন্ন করে তোলে আর আমি তাদের প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হয়ে নিজের সেইসব দুর্মূল্য সম্পদ সমূহকে বর্জন করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাই ও শেষপর্যন্ত ধ্বংস করে শান্তি পাই। এতটাই নিজেকে ভালোবাসি ও বাঁচাবার জন্য ব্যস্ত থাকি যে বিচারবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে নিজের কাছে নিজেকেই শত্রু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করি।
যেকোন মূল্যে নিজেকে বাঁচাতে হবে, এই ভাবনা সর্বক্ষণ আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। সেই অনিবার্য তারনায় আমি সমরায়োজন সাজাই। এমন সব বিধ্বংসী অস্ত্রভান্ডার গড়ে তুলি যাদের প্রয়োগ নিজেকেই বিলুপ্ত করে দিতে পারে। আমি তা ভুলে যাই, ভুলে থাকি, আর আমি সেইসব অস্ত্র প্রয়োগ করে ফেলি। কার বিরুদ্ধে কে জানে! ভাবি যে তাতে শত্রুপক্ষ ধ্বংস হয়ে আমার জীবন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করবে। প্রত্যেকবারই প্রমাণ পাই যে আমার সেইসব চিন্তা-ভাবনা কতটাই অসাড়। অস্ত্রের ব্যবহার কোন্ শত্রুকে ধ্বংস করল দেখতে পাই না, বরং দেখি সেইসব অস্ত্রের মারণযজ্ঞ কোন্ অলিখিত নিয়মে আমারই বিপক্ষে চলে গেছে।
আমার বেঁচে থাকার অবিরাম আকাঙ্ক্ষা আমাকে ধর্মাচরণে বাধ্য করে আমি। এক নির্দিষ্ট মতাদর্শে এতটাই মোহাচ্ছন্ন হয়ে যাই যে ভুলে থাকি জীবনধারণের জন্য ধর্মাচরণ অনিবার্য নয়, যেমন খাওয়া, ঘুম, চিকিৎসা, বাসস্থান, শিক্ষা। ওই ধর্মচরণ আমাকে এমনই অজ্ঞ করে তোলে যে আমি শিক্ষাকে বর্জন করি, বিজ্ঞানকে ভুলে থাকি। ধর্মাচরণ ও অন্ধবিশ্বাস আমাকে এতটাই মূর্খ ও গোঁড়া বানিয়ে তোলে যে আমি একসময় আমার মূল উদ্দেশ্যটাই ভুলে যাই। নিজেকে ভালোবেসে বেঁচে থাকার যে অদম্য ইচ্ছেতে আমার এই ধর্মাচরণ দেখি কোন এক অজ্ঞাত শক্তির কলকাঠি সঞ্চালনে অহেতুক ও অসাড় হয়ে আমাকেই বিপদে ফেলে দেয়, আমি বুঝেও বুঝিনা। ধর্মাচরণের জন্য বেঁচে থাকাটাকেও আমি বাজি রাখতে পারি। নিজেও বুঝিনা কেন আমার এই পরস্পর বিরোধী আচরণ। আমার যে কী উদ্দেশ্য সেটাই আমার কাছে অস্পষ্ট হয়ে পড়ে। আমার মধ্যে কার যে বসবাস, কে যে আমাকে চালায় ও কাজকর্ম করায় সেটাই বুঝতে পারি না। কী যে আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা ও মতাদর্শ নিজের কাছেই তা পরিষ্কার নয়।
আমাকে ভালোবেসে আমাকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যেই আমি নিবেদিতপ্রাণ ও সেই উদ্দেশ্যেই আমার সমস্ত কার্যকলাপ, উদ্যোগ ও উদ্যম। সেই কারণেই আমি কখনো শাসক, কখনো শাসিত, কখনো বিচারক, কখনো বিশেষজ্ঞ, কখনো সাহিত্যিক, কখনো ক্রীড়াবিদ, কখনো বিজ্ঞানী, কখনো দার্শনিক, কখনো নেতা, কখনো সমাজবিদ, কখনো পর্যটক, কখনো শিল্পী, কখনো রাজনীতিবিদ। আমার মধ্যে অবিরাম দেখতে পাই এমন ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের সমাহার। সেই অনুসারে আমার কার্যকলাপ এবং আচার-আচরণ নানা পর্যায়ের। সবসময় তাই আমি বিচিত্রগামী। আমি কোন কিছুতেই বিশ্বাস করি না আবার সবকিছুকেই বিশ্বাস করি। কোন কিছুতেই আস্থা স্থাপন আমার স্বভাববিরুদ্ধ হয়ে ওঠে। আমার মধ্যে দেখতে পাই ভিন্ন ভিন্ন বহুমতের অবস্থান, তারা আবার পরস্পর বিবাদে লিপ্ত থাকে। আমি সদাসর্বদা ব্যস্ত থাকি নানারকম কূটনীতি ও কূটকৌশলের অনুশীলনে। আমি তারপর দেখি নিজেকে আত্মপ্রচারক হিসেবে। কোনো প্রতিবাদ বা কোন বিরুদ্ধ বক্তব্য সহ্য করতে পারি না, অসহিষ্ণু ও অত্যাচারী হয়ে উঠি। আমার পক্ষে সমস্ত প্রচার কখন যে আমারই বিপক্ষে অপপ্রচার হয়ে ওঠে নিজেই তার হদিস পাই না। আমার দমনপীড়ণ নীতি দেখি আমার ওপর প্রয়োগ হতে থাকে, কিভাবে তা আমি অনুমান করতে অক্ষম হই। আমার রাজনৈতিক কলাকৌশল যে পরোক্ষে আমারই অজান্তে আমার জন্যই নেওয়া হয়ে যায় তা আমি বুঝেও দেখতে জানি না। আমার সমস্ত বিদ্বেষ, সমস্ত হিংসা, সমস্ত প্রতিশোধস্পৃহা, সমস্ত অন্যায়, সমস্ত প্রতিহিংসা ও জিঘাংসার শিকার হিসেবে প্রতিপন্ন হই আমি নিজেই। কিভাবে এমন ঘটে তা বোঝার কোন বুদ্ধি বা চেষ্টা আমার নেই। আমি অন্ধ ও অজ্ঞ থাকি, থাকতে ভালোবাসি এবং থেকে আনন্দ পাই। পাগলের গোবধে আনন্দের মতো ব্যাপার।
নিজেরই রচনা করা নিয়ম-কানুন নিজেই অস্বীকার করি। আমার অভিপ্রায় আমার কাছে অচেনা ও অজানা হয়ে যায়। আমি শাসন-শোষণ ও দমনপীড়ণ এমন পর্যায়ে ও উচ্চতায় নিয়ে যাই যে তা আমারই আত্মদহনের কারণ ঘটাতে থাকে। এমনই আমার অন্ধত্ব ও মূর্খতা যে আমি তা উপলব্ধি করতে পারি না। অথচ কী আশ্চর্য, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই আমার এত এত প্রচেষ্টা! কেন তাহলে কোন্ গোপন অশুভ শক্তির চালনায় আমি এমন কাজ করে চলেছি যা নিজেরই পরিণতিকে বিপদজনক করে তুলছে? কেন আমি নিজেকে ভালবাসতে গিয়ে নিজেরই শত্রু হয়ে যাচ্ছি? নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টাতে নিজের মৃত্যু ত্বরান্বিত করে তুলছি?
আমি যে কী জীব বা কী বস্তু নিজেই হিসেব পাই না। পরিশেষে দেখি সে সম্পর্কে আমার নিজেরই কোন চেতনা নেই। আমার আচরিত সমস্ত কার্যকলাপ, যা আমাকে ভালোবেসে আমি করি নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তা সর্বসময় আমাকেই বিপদে ফেলে দেয়, আমারই ধ্বংসের কারণ ঘটায়। আমি সেসব বুঝেও বুঝতে পারি না।
আমি তাই নিজের কাছেই নিজে এক বিস্ময় ও হাহাকার।