মানবেন্দ্র সাহা
“হুম”! শব্দটার মধ্যে একটা ভাবনা আছে, নাকি তাচ্ছিল্য? যাই থাক না কেন, ওই ছোট্ট শব্দটা বেশ ব্যাঞ্জনামূলক। কত কত কথার পৃষ্ঠে এমন একটা “হুম” দিলে অনেক কিছু হয়তো লুকানো যায় বা অনেক কিছু বলাও হয়ে যায়।
তালেবর দুজন সাহিত্যিক মুখোমুখি বসে আছেন। একজন অভিরূপ সেন, ছোট শহরের বড় সাহিত্যিক। বড় সাহিত্যিক এই কারণে নয় যে তার লেখাপত্রের প্রচুর পাঠক আছে অথবা প্রচুর বই বাজারে বিক্রি হয়। তেমনটা না হলেও সে নিজে ও অন্যরা মনে করে অভিরূপ সেনই এ শহরের বড় সাহিত্যিক। তার বিশিষ্টতা হল তিনি নিয়মিত সাহিত্য সভাগুলো পৌরহিত্য করেন, কিছু বক্তব্য রাখেন আর সযত্নে একটা অনুগামী বাহিনী তৈরি করেছেন। তারাই তার ঢোল পেটায়। তার কৃৃতিত্বের মধ্যে মাঝে মাঝে স্থানীয় সংবাদপত্রে এটা সেটা নিয়ে ব্যক্তিগত গদ্য লেখেন। এক সময় প্রবন্ধ লেখা দিয়ে সাহিত্যে নেমেছিলেন। পরে কবিতা থেকে স্থানান্তরিত হয়ে এখন গদ্য লেখক হিসাবে পরিচিত হতে চাইছেন। প্রবন্ধ না পড়েই নাকি সবাই বাহ বাহ করে, এটা জেনে কিছুতেই সহ্য করতে পারেন না। আর কবিতা লেখা ছাড়ার পেছনে আসল কারণ এত কম্পিটিশন তিনি পছন্দ করেন না। ফেসবুকের যুগে প্রতিদিন নাকি দু চারজন করে কবি হয়ে উঠছেন। এত কবির ভিড়ে তিনি নিজেকে রাখতে চান না বলে একটু কষ্টসাধ্য গদ্য লেখার দিকে ঝুঁকছেন । আর তাছাড়া এ লাইনে প্রতিযোগিতা বেশি নয় বলে গল্পকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন বেশ কিছুকাল আগে। পনের বছরের চেষ্টায় গোটা পনের গল্প লিখে উঠতে পেরেছেন। ইতিমধ্যে তার থেকে বাছাই করা দশটা গল্প নিয়ে একটা গল্প সংকলন “ফিরে এসো রাধা” প্রকাশ করেছেন । তার বছর দুয়েক পরে সেই ফিরে এসো রাধার ইংরেজি অনুবাদ “কাম ব্যাক রাধা” প্রকাশ করেছেন। দুষ্টুজনেরা অবশ্য বলেন এবার নাকি এর উর্দু সংস্করণও প্রকাশিত হবে। অভিরূপ সেন বড় সাহিত্যিক এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই , না হলে মাসে মাসে এখান থেকে ওখান থেকে নানান সাহিত্য পুরস্কার পাবেন কেন? তার ঘরে যত না বই আছে তার থেকে বেশি আছে নানান পুরস্কার আর মানপত্র। সেসব সুন্দর করে সাজানো আছে। নিয়মিত নরম কাপড় দিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখেন।
অপরদিকে মিহির দাস শর্মা প্রায় অভিরূপ সেনেরই সমবয়স্ক একজন লেখক। দু চারজন লোকজনের তার লেখাপত্রের সঙ্গে পরিচয় আছে। জীবনের প্রান্ত বেলায় এসে মনে হয় এতদিন লেখালেখি করে কী হল ? বরং অর্থ রোজগারের মন দিলে বেশ কিছু টাকাকড়ি করতে পারতেন, যার প্রয়োজন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন এখন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা থেকে অবসর গ্রহণ করে গোনাগুনতি যে কটা টাকা হাতে পান পেনশন বাবদ — তা দিয়ে ডাল ভাত হয়, কিন্তু নামি কোম্পানির ওষুধপত্র দিয়ে আধি-ব্যাধির চিকিৎসা করাতে পারেন না। মিহির বাবুর স্ত্রী অনুরাধার মুখ থেকে নানান গঞ্জনা শুনতে হয়। এত এত লেখা লিখলেন সারা জীবন ধরে, তার একটা স্বীকৃতি পেলে বউয়ের মুখের সামনে তুলে ধরে বলতে পারতেন, দ্যাখো দ্যাখো আমি কি এতই ফেলনা ? সে আর হল কোথায়? তাই তার সমস্যার কথা সবটা খুলে জানালেন অভিরূপ সেনকে। খুব মন দিয়ে শুনলেন অভিরূপবাবু । তারপর সেই মোক্ষম শব্দটা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলেন, ” হুম”!
মিহিরবাবু মনে মনে বিরক্ত হন। এত বড় সমস্যার মাত্র এটুকু উত্তর। তাই বলতে বাধ্য হলেন, মশাই একটা পরামর্শ দিন যাতে শেষ বেলায় একটা স্বীকৃতি পাই।
অভিরূপ বাবু সিলিং এর দিকে তাকিয়ে কী একটা ভেবে নিয়ে মুচকি হেসে বললেন, বড্ড দেরি করে ফেলেছেন । মার্কেটে টিকতে গেলে মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি নিজেকেই আবিষ্কার করতে হবে, না হলে এই যুগে কেউ টিকবে না।
মিহির বাবু আঁতকে ওঠেন , কী বলছেন ? একি আলু পটল না স্নো পাউডার যে রে রে করে মার্কেটিংয়ে বেরিয়ে পড়ব!
অভিরূপ সেন হাসলেন । ভেতর থেকে কেউ একজন চা দিয়ে গেলে তিনি বললেন , নিন চা খান — মাথা ঠান্ডা করুন, একটা ব্যবস্থার জন্য যখন এসেছেন তখন তা হবেই। তাই ভাববার একটু সময় দিন।
মিহির বাবু ভাবেন কী আর হবে? আমি বাবা ওইসব অসভ্য লোকগুলোর পেছনে তৈল মর্দন করতে পারব না। আর দোরে দোরে গিয়েও বলতে পারবো না আমাকে একটু অনুগ্রহ করুন।
অভিরূপ বাবুর মুখের হাসিটা প্রলম্বিত হয়ে উঠল, আপনি অনেকটা জীবনানন্দের মতন। কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন না, কোথাও লেখা নিজের থেকে পাঠান না । সোশ্যাল মিডিয়াতে থাকবেন না, তবে কীভাবে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাবেন? “কবন্ধ”-র মতো গল্প যে লিখতে পারে তারও যে এমন দুর্গতি হবে কে জানত !
মিহিরবাবু উৎসাহিত হয়ে বললেন, কবন্ধ পড়েছেন? সে কোন কালে লেখা? ওটা লিখে আমার খুব আনন্দ হয়েছিল।
অভিরূপ বাবু বললেন, বললাম তো এই যুগে যে-কাউকে টিকতে গেলে মার্কেটিং স্ট্রাটেজি ঠিক করতে হবে। আপনি যে ভালো লেখেন সে তো আমি জানি, এরকম অনেকেই ভালো লেখেন তাই বলে কি সবারই সাহিত্যিক সুখ্যাতি হবে ? আপনি যখন এ ধরাধামে থাকবেন না তখন দু একজন গবেষক আপনার সম্বন্ধে খোঁড়াখুঁড়ি করে জানতে চাইবে আপনি কেমন লেখক ছিলেন। চাই কি বাংলা সাহিত্যের দুই একজন অধ্যাপক তার ছাত্রদের জন্য আপনাকে বেছে নেবে পিএইচডি করানোর জন্য । আর বেঁচে থাকতে পিএইচডি করাতে গেলে কিছু ক্যাচ রাখতে হয়। এই যেমন আমার লেখালেখি নিয়ে এমফিল ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। একজন অধ্যাপক আমাকে কথা দিয়েছেন আর দু চারটে লেখা লিখে ফেলতে পারলেই আমার লেখা নিয়েও পিএইচডি হবে। তবুও তো আপনার কপাল ভালো কোন চেষ্টা চরিত্র না করেই কলকাতার কোন একজন প্রাবন্ধিক আপনার গল্প কবন্ধ, কাচের জামা, বাঘের ঘাম, মুশুরি ডালের বড়ি, বাতিল কনডম , ঘাসেরা কথা শোনে না নিয়ে এক পত্রিকায় বেশ বড়সড় প্রবন্ধ লিখেছেন। লোকটা মানে ওই প্রাবন্ধিকের নামটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।
মিহির বাবুর মুখে রং লাগে, তাই নাকি– এসব কথা তো কোনদিন শুনিনি ।
অভিরূপ আমায়িক হেসে বলেন, শুনবেন কোত্থেকে ? আপনি যা অহংকারী আর সবাইকে গন্ডমূর্খ ভাবেন তাই আপনার কথা কাউকে বলতে সবার বয়ে গেছে।
মিহির বাবু হো হো করে হেসে ওঠেন , আমি যে তা পারি না। তাই তো লজ্জার মাথা খেয়ে আপনার কাছে ছুটে এলাম।
–সে তো ভালই। সবাই কি সবকিছু পারে?
–এই বৃদ্ধ বয়সে বউয়ের গঞ্জনা শুনতে শুনতে আমার মাথাটা গেছে । তাই তো ছুটে আসা! যাক গে আমাকে খুব লোভী ভাববেন না, শুধু গৃহ শান্তির জন্য মানুষ কত কিছুই না করে– আমি না হয় হাত পেতে একটু ফেবার চাইতে এসেছি। যদিও বিষয়টা খুবই লজ্জার –এটা আবার পাঁচ কান করবেন না যেন।
— এই গঞ্জনা অনেক সাহিত্যিককেই শুনতে হয়েছে । জীবনানন্দের এ ব্যাপারে কম দুঃখ ছিল ? তার স্ত্রী সব সময় অনুযোগ করতেন তার লেখা থেকে কেন রোজগার হয় না ? প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখে টাকা পান, তার গল্প নিয়ে সিনেমা হয়। এসব তো শুনতেই হত। আর জীবনানন্দকে এজন্য লজ্জায় মরে যেতে হতো। আর এজন্যই তো ট্রামের নিচের পরে তিনি মরলেন। তারপরে না তার এত সুখ্যাতি হল। যিনি জীবন দিয়ে বুঝিয়ে ছিলেন যে কঠিন সিদ্ধান্তে ভালো ফল পাওয়া যায়। যাক গে আমি একটু ভাবি আপনার জন্য কি করা যায়? আপনিও ভাবুন।
অভিরূপ বাবুর কথাগুলো মন দিয়ে শুনলেন মিহিরবাবু। বেশ একটা ভাবনা উদ্রেককারী বক্তব্য। নিজের বুঝ নিজেই ষোল আনা বুঝে নিতে হবে , কিন্তু কী করবেন সেই বিষয়ে কোন ধারনা মাথায় এলো না। তিনি মনে মনে হাসলেন কী আর করবেন, যা মনে মনে অনেকদিন ভেবেছেন তাই হয়তো একদিন করে বসবেন।
দুই
আশ্চর্য ঘটনাটা মনে হয় ঘটে গেছে, জঞ্জালের স্তুপের ভেতর থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করল একটা সুদৃশ্য প্যাকেট যা কিনা কর্দমাক্ত ও বিবর্ণ । কিন্তু প্যাকেটের বিশেষ সৌন্দর্যে নজর কাড়ে, বাবুলাল এক হ্যঁচকায় প্যাকেটের বহিরাবরণ ছিঁড়ে ফেললে পেয়ে যায় একগুচ্ছ নানা রঙের কনডম। সেগুলো থেকে একটা বেগুনি রংয়ের ছোট্ট প্যাকেট খুলে নিয়ে বিশুর মুখের সামনে দোলাতে দোলাতে বলল, কোন শালা হারামির বাচ্চা বেলুনগুলো ফেলে দিয়ে গেছে। হি হি করে হাসে বাবুলাল। মুখ খিস্তি করতে ওস্তাদ ও। ফলে ওর স্টকে যা যা আছে সব বলে নিয়ে লাস্টে বলল, শালা বেজন্মা কোথাকার?
বিশু বলল , এই সকাল সকাল গালি দিবি না কয়ে রাখলাম, আমার কিন্তু মটকা গরম হয়ে যাবে । বেজন্মা কথাটা শুনলেই বিশুর খুব রাগ হয়। ছোটবেলায় বাবা রাগ হলেই ওকে বেজন্মা বলে গালি দিত । যখন এর মানে বুঝতে পারত না তখন একরকম, যখন মানে বুঝতে শিখল তখন বিশু অনেক চিন্তা ভাবনা করে বুঝল ওর মায়ের একটা নাগর ছিল যাকে ও নরেশ কাকা বলে ডাকত। একবার লোকটা ওকে একটা বাইসাইকেল কিনে দিয়েছিল। সেটা চালিয়ে পাড়াময় দাপিয়ে বেড়াত। একদিন সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরে দেখে মা বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদছে । জ্ঞান হওয়ার পর থেকে মাকে কখনো কাঁদতে দেখেনি। বাবা বাড়িতে ছিল না। দিন সাতেকের জন্য গ্যাংটক গেছে । গ্যাংটকের রাজবাড়িতে বাবার কাজ আছে। বিশুর বাবা ভালো কাঠমিস্ত্রি। বেশ নামডাক আছে এ তল্লাটে । তাই রাজা-উজিরের বাড়ি থেকে ডাক পড়লে বাবা সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে চলে যেত। নরেশ কাকাও বাবার এমনি একজন বিশ্বস্ত সঙ্গী ছিল। পরে কাজ শিখে নরেশ কাকা বাবার সঙ্গ ছেড়ে দেয়। এতে নরেশ কাকার উপর বাবার প্রচন্ড রাগ জন্মায়। সুযোগ পেলেই নানা রকম গালিগালাজ করে। সেই নরেশ কাকা নাকি রাতে কাজ থেকে ফেরার পথে ট্রেন কাটা পড়ে মারা গেছে।
অনেকদিন পর বিশুর মনে হল এই কনডমের ব্যবহার সম্বন্ধে মানুষ সচেতন হলে আজ ওকে এত কষ্ট পোহাতে হতো না। বিশু জঞ্জালের গাড়ি স্টার্ট দিলে , বাবুলাল বেলচা নিয়ে লাফ দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল। বাবুলাল দাঁত বের করে হেসে বলল, বিশুদা বেলুনগুলো মনার জন্মদিনে ঘরে সাজিয়ে দেব। সবই নতুন আছে ।
বিশু বলল, তুই একটা গান্ডু ।
–কেন গান্ডু কেন ?
–বুঝিস না !
–বাহ এত সুন্দর সব রংবেরঙের বেলুনগুলো ফেলে দেবো কেন ?
বিশু এবার কিছু বলে না । চুপচাপ ভাবতে থাকে। কত বেজন্মা যে পৃথিবীতে এসেছে তার কি ঠিক আছে। ও নাইন পাস টেন ফেল ছেলে এর থেকে আর বেশি ভাবতে পারে না । শেষে বিশু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পেছনে হর্ন দিতে থাকা একটি চারচাকাকে সাইড দেয় অভ্যাসবশত ।
হঠাৎ বাবুলাল বলে ওঠে, তাহলে বলছ বেলুনগুলো মনার জন্মদিনে সাজিয়ে দেব না?
বিশু বলল, আরে ওটা ঘরে সাজানো জিনিস নয় । ওটা যেখানকার জিনিস সেখানেই ভালো মানায়। বিশু বলতে পারত বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে । কিন্তু টেন ফেল বিশুর পক্ষে এসব কথা বলা সম্ভব নয়।
বাবুলাল দাঁত বের করে বলল , তোমার লাগবে কটা।
নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বিশু বলল, দিস কটা। তারপর বিড়বিড় করে বলল , আমি বাবা বেজন্মা বানাতে চাই না।
মিহির বাবু নাম – ঠিক – না – করা গল্পের এটুকুন লিখে ভাবলেন কী হবে আর এগিয়ে নিয়ে গিয়ে। হয়তো আর একটা জঞ্জালই তৈরি হবে । অভ্যাসবশত মিহির বাবু সকাল সকাল কিছু লিখে ফেলেছিলেন, পরে মনে হল এ পৃথিবীকে আর কুৎসিত করে কী লাভ? তার চেয়ে বরং মনে মনে ভাবা বিষয়টা করে ফেলাই ভালো। মিহির বাবু নিজেই ভেবে একটা পথ বের করেছেন। তার ঘরের মধ্যে যত সব লেখার ফাইলপত্র, তিল তিল করে জড়ো করা নানান বইপত্র রাস্তার পাশে এনে ফেললেন। আশেপাশের বাড়ির লোকজন প্রথমে ভেবেছিলেন পুরনো বইপত্র হয়তো কেজি দরে বিক্রি করে দেবেন। কিন্তু অচিরেই সবার ভুল ভাঙল । তিনি প্রথমে কিছু ঝুরো কাগজে আগুন ধরালেন । দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। তিনি রোগা মোটা বইগুলো সেই আগুনের উপর ছড়িয়ে দিতে লাগলেন । আগুনের লেলিহান শিখা উপরের দিকে উঠতে লাগল। যারা এতক্ষণ মজা দেখছিল , তারা হতচকিত হয়ে যায় । তাদের কেউ একজন বলল, মাস্টারমশাই একি করছেন ? আপনার লেখাপত্র সব পুড়িয়ে দিচ্ছেন ? মিহির বাবু নির্বিকার। কোনো কোনো অতি উৎসাহী লোক মোবাইলে সেই অগ্নুৎসবের ভিডিও তুলে রাখছে । আগুনের শিখা মাঝ রাস্তায় চলে এসেছে । রাস্তার দুদিকে পরপর সার দিয়ে কিছু গাড়ি বাইক সাইকেল দাঁড়িয়ে পড়েছে । চালাকরাও এই বই পোড়নো উৎসব দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। যাদের বই পড়তে ভালো লাগত না তারা বেশ মজা পাচ্ছে । একজন হিন্দিভাষী লোক মুচকি হেসে বলল, শালা কিতাব বহুৎ বুঢ়ী কিসিম কী চিজ হ্যায় ! ইয়ে মাস্টার সাহেব কো মাথা বিগাঢ় দিয়া।
এরই মধ্যে পাড়ার একজন ভ্লগার ফেসবুক লাইভ করতে শুরু করেছে । “এই যে দেখছেন — মাস্টারমশাই শ্রী মিহির দাস শর্মা তার নিজের সৃষ্টি সাহিত্য ও সংগ্রহের বইতে আগুন দিয়েছেন। তিনি বুঝেছেন এইসব রেখে দিয়ে কোন লাভ নেই। এই কবন্ধ সমাজে আর সাহিত্যের দরকার আছে বলে তিনি মনে করেন না । তিনি চল্লিশ বছর আগে লেখালেখি জগতে ঢুকেছিলেন । তিনি আমার প্রাইমারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। সেই সুবাদে স্যারকে আমি চিনি এবং জানি । স্যারের মতো দার্শনিক পৃথিবীতে ক’জন আছেন? সন্তানসম তার সৃষ্টিগুলোকে নিজের হাতেই শেষ করে দিয়ে যেতে চান। এটা ঠিক এই কলুষিত পৃথিবীতে কেইবা চায় তার সন্তানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের গর্ভে রেখে যেতে।” ক্যামেরা ঘুরে ঘুরে সব ছবি তুলে নিচ্ছে অলোক । মিহির বাবুর বসবার ঘরে বেজে চলেছে , আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে– অদ্ভুত একটা সুন্দর পরিবেশ তৈরি হয়েছে । একদিকে আগুনের পরশমণি বইয়ের পাতাগুলোকে লেলিয়ান শিখায় পরিণত করছে। পুলিশের গাড়ি এসে পৌঁছেছে। তার পিছে পিছে দমকল চলে এসেছে। উৎকট চিৎকার চেঁচামেচির মধ্যে দমকলের লোকেরা মোটা পাইপের সাহায্যে আগুন নেভাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এসব ছবি আর মিহির বাবুর সাহসী পদক্ষেপ মুহূর্তেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই এই ভাইরাল ছবি স্থানীয়, রাজ্য ও জাতীয় স্তরের সব টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হতে থাকে। এরকম অভূতপূর্ব ঘটনায় মিহির বাবু বিখ্যাত হয়ে যান। সরকারের পক্ষের লোকজন চলে আসেন । তারা অনুযোগ করে বলেন তিনি কেন আগেভাগে তার মনবেদনার কথা বলেন নি । কতজনকেই তারা পুরস্কার দেয়, আর একটা না হয় মিহির বাবুকে দেওয়াই যেত। এসব করে যে রাজ্যটার বদনাম করে দিলেন মিহিরবাবু সেই সম্বন্ধে সরকারপক্ষের লোকেরা বেশ করে বোঝালেন । কোন এক প্রকাশক রাতে যোগাযোগ করেছেন তার ছোট গল্প সমগ্র প্রকাশ করবেন। দিন সাতেকের মধ্যে প্রকাশিত হলে হাজার দশের কপি বিক্রি করে ফেলতে পারবেন । এতটাই আশাবাদী প্রকাশক সংস্থা যে এ বছর বইমেলার সময় তার রচনা সমগ্র প্রথম খন্ড প্রকাশিত করবে । এসবই সম্ভব হত না যদি তার বউ অনুরাধা ওই হট্টগোলের মধ্যে মিহির বাবুর লেখার ফাইলগুলো না সরিয়ে রাখতেন।
তিন
দুদিন পরে অভিরূপবাবু মিহির বাবুর বাড়িতে এলেন । বললেন , আপনি তো মশাই কামাল করে দিয়েছেন। আপনি যে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন। আমি তো এর লেজ ধরে ওর পা চেটে ওকে তেল মেরে কি পেলাম? স্পষ্টই দুঃখিত দেখায় অভিরূপ সেনকে।
ইতিমধ্যে কয়েকজন মানুষ এসে পড়েছেন। তারা আলো ক্যামেরা বুম ঠিক করে বলল, স্যার আসুন– সব রেডি।
বিখ্যাত সংবাদ চ্যানেলের সঞ্চালিকা আলোকপর্ণা মিষ্টি হেসে বলল, স্যার আপনার ইন্টারভিউটা সরাসরি প্রচারিত হবে তাই আপনি কোনো অসাংবিধানিক কথাবার্তা বলবেন না — তাতে আবার আমাদের বিপদ । যাই হোক বেস্ট অফ লাক। এরকম ঘটনা তো ভারতবর্ষে বিশেষ ঘটেনি, এই খবরটার একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে। দেখুন, আপনার জন্য আর কী কী অপেক্ষা করছে ?
মিহির বাবুর খুব লজ্জা করছিল পাশের ঘরে অভিরূপ সেনকে বসিয়ে রেখেছেন। মনে মনে ভাবলেন কি আর করা! মিহির বাবু মনে মনে “হুম” শব্দটার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। অভিরূপ বাবু পাশের ঘরে একটা চেয়ারে বসে ভাবতে লাগলেন মিহির বাবুকে কেন যে স্ট্যাটাজির কথাটা বলতে গেলাম! এজন্য লোকে বলে না, আইডিয়া কখনো শেয়ার করতে নেই।