কৃষ্ণেন্দু পালিত
সকাল দশটা নাগাদ ফোনটা এল। পূর্বাশা তখন মনিশের ব্যাগ গোছাচ্ছে। সোয়া দশটায় মনিশ বেরোবে। এগারোটার মধ্যে স্কুল। দিনের সবচেয়ে ব্যস্ততার সময় এটা। সকালে উঠে রান্না , সময়ে খেতে দেওয়া, ব্যাগ গুছিয়ে দেওয়া, জামা – প্যান্ট – রুমাল হাতের কাছে এগিয়ে দেওয়া – সব মিলিয়ে ঘণ্টা তিনেকের একটা সাইক্লোন।
মোবাইলটার দিকে এক বার আড়চোখে তাকিয়ে কাজে মন দিল পূর্বাশা । বাজতে লাগুক । মনিশ বেরিয়ে গেলে রিং ব্যাক করবে , তখন তার অখন্ড অবসর । সেই পাঁচটা অবধি । ধীরে সুস্থে সংসারের কাজ গুছিয়ে, মা কিংবা আত্মীয় – বন্ধুদের সাথে ফোনে গল্প করেও সময় কাটতে চায় না । আগে দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর ঘন্টা দুই ঘুমিয়ে নিত। মোটা হয়ে যাচ্ছে বলে এখন সেটাও বন্ধ করেছে । এপাড়ায় তারা নতুন। প্রতিবেশীদের সাথে ততটা দহরম মহরম হয়নি যে খোশগল্প করে সময় কাটবে। আজকাল সংসার নিয়ে সবাই ব্যস্ত, তত সময় বা মানসিকতা কারও নেই। রাস্তায় দেখা হলে দেতো হাসি কিংবা ‘কেমন আছেন’- এর বেশি এগোয় না। একমাত্র কোন অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে এক জায়গায় হলে যা একটু কথাবার্তা হয়। যত দিন যাচ্ছে একাকীত্বের প্রহরগুলো আরও ভারি হয়ে উঠছে পূর্বাশার কাছে। মাঝে মাঝে মনে হয় এভাবে থাকতে থাকতে একদিন হয়তো সে সত্যিই পাগল হয়ে যাবে। মনিশ অবশ্য চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না। গত দু’বছর সমানে ছোটাছুটি করছে। এখনও কিছু সুরাহা করতে পারেনি।
ফোনটা অনেক আগেই কেটে গেছে। হাতের কাজ শেষ করে পূর্বাশা কল লিস্ট চেক করল। পল্লবী। তার ছোট বোন। দুর্গাপুরে থাকে। বাচ্চা দুটো খুব দুরন্ত। সারাদিন ওদের নিয়ে নাস্তানাবুদ হয়। ওরা টু- ইন। একেবারে একরকম দেখতে। পূর্বাশা এখনও ভুল করে মাঝেমাঝে। ওরাও বোকা বানায় তাকে। মাত্র চার বছর বয়সেই খুব পাকা হয়েছে দুটোতে।
-একা একা দাড়িয়ে হাসছ যে, কে ফোন করেছিল।
মনিশ কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে খোয়াল করেনি। বলল, তোমার ছোট শ্যালিকা।
– কী বলছে?
-কথা হয়নি। ধরার আগেই কেটে গেল। জানো তো, ওর ছেলে দুটোর কথা হটাৎ মনে পড়ে গেল। সেবার কীভাবে তোমাকে বোকা বানিয়েছিল মনে আছে ?
– সে কথা ভেবেই বুঝি হাসছ?
পূর্বাশা উত্তর দেওযার আগেই ফোনটা আবার বেজে উঠল। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে অবাক হল সে। পল্লবী । সাধারণত এসময় পরিচিত কেউ ফোন করে না। সবাই তার ব্যস্ততার কথা জানে। পল্লবীতো ভালো করেই জানে। তাহলে কী সিরিয়াস কিছু ? একটু ভয়ে ভয়ে ফোনটা ধরল এবার।
– সুসংবাদ আছে দিদি , মস্ত বড় সুসংবাদ। উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছে পল্লবী। তুই ভাবতেও পারবিনা ।
– পূর্বাশা বিরক্ত হল, এটা তোর সুসংবাদ দেওয়ার সময়, তাড়াতাড়ি বল, তোর জামাইবাবু বেরোবে।
– বারন কর। বারন কর। আজ আর স্কুল যেতে হবে না। যত তাড়াতাড়ি পারিস আমার বাড়ি চলে আয় ।
– চলে আয় মানে! এটা কী পাড়া বেড়ানো নাকি । কোথায় মধ্যমগ্রাম আর কোথায় দুর্গাপুর । মাথাটা এক্কেবারে গেছে তোর।
– তা যা বলছিস । আমি এখনই দেখে আসলাম । কী ফুটফুটে মেয়েটা। দেখেলেই তোর মায়া পরে যাবে । ঠিক যেনো তোর মতো দেখতে। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং কী জানিস, ওদের ডিমান্ড । তুই কল্পনাও করতে পারবি না । মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকা।
পূর্বাশার শরীর অবশ হয়ে আসে। নিজের কানকেই যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না । অবশ্য এরকম অনুভুতি তার আগেও হয়েছে। ফোনটা কানে চেপে ধরে বসে পড়ে সে । পল্লবী তখনও বলে চলেছে, আমাদের উল্টো দিকে যে বস্তিটা, ওখানেই, বুঝলি। তবে ওরা অবাঙালি । এখানে থাকতে থাকতে বাংলা শিখে গেছে। তোদের আপত্তি নেই তো?
পূর্বাশা কোনরকম উচ্চারণ করে, না।
– আমাদের বাড়িতে যে মেয়েটা কাজ করে, ওরা ওই বস্তিতেই থাকে । সকালে ওই খবরটা এনেছে । চার মেয়ের পর আবার মেয়ে। ওই জন্যই বিক্রি কর দেবে। আগেরটাও নাকি বিক্রি করে দিয়েছে। আমাকে বলতেই বললাম, এখনই চল, আজ তোকে কাজ করতে হবে না। খবরটা সত্যিই বুঝলি। সেখান থেকে ফিরেই ফোন করছি। কথা বলছিস না কেন? আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস ?
– হুঁ।
– জামাইবাবু কোথায়, জামাইবাবুকে দে ।
মনিশ পাশেই ছিল, কিছু একটা আঁচ করে। নইলে এতক্ষন তার বেরিয়ে যাওয়ার কথা। পূর্বাশা ফোনটা মনিশের হাতে দেয়।
এরপর টানা দশ মিনিট । দু- একটা কয়ারি ছাড়া মনিশ চুপচাপ শুনে যায়। পূর্বাশা খেয়াল করছিল, শুনতে শুনতে মনীশের চোখ-মুখ কীভাবে বদলে যাচ্ছে। পল্লবীর কথায় যে সে ভরসা পাচ্ছে, বিশ্বাস করছে ৷ কথা শেষ হলে বলল, এখনই বেরতে হবে, গুছিয়ে নাও। আমি দেখি একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারি কিনা । কেসটা পজেটিভ হতে পারে।
কথা শেষ করেই মনিশ বেরিয়ে যায় । ব্যাগ, টিফিন বাক্স যেখানে ছিল সেখানেই পড়ে থাকে। পূর্বাশা দু হাত কপালে ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে ।
২
বাড়ী থেকে বেরোতে বারোটা বাজলো । কম করে হলেও ঘণ্টা চারেকের রাস্তা। জামে আটকালে আরও বেশি । সন্ধ্যার আগে কোন ভাবেই পৌঁছাতে পারবে না।
পূর্বাশা বিশেষ কথাবার্তা বলছেনা। ভেতর ভেতর তার যেমন উত্তেজনা হচ্ছে, ভয়ও হচ্ছে। আসলে ঘরপোড়া গরু তো। বহরমপুরের ঘটনাটা মনে পড়ছে। অনিশের বড় পিসিমা খবরটা দিয়েছিল। সেটিও মেয়ে ছিল, মাস ছয়েক বয়স । সত্তর হাজার টাকায় রফা হয়েছিল । টাকা পয়সা নিয়ে নির্দিষ্ট দিনে হাজির হয়েছিল তারা । বাচ্চাটার জন্যে নতুন জামাকাপড় , প্রয়োজনীয় অন্যান্য টুকিটাকি জিনিস আর বাড়ির সকলের জন্যে মিষ্টি নিয়েছিল সঙ্গে। এমন একটা আনন্দের দিনে সকলকে মিষ্টিমুখ করানোই উদ্দেশ্য ছিল মনিশের। ভুলটা বোধহয় ওখানেই করেছিল। মনিশের বুঝতে ভুল হয়েছিল, তারা সন্তান পাচ্ছে , তাদের কাছে ব্যাপারটা আনন্দের হলেও, যে মা অভাবের তাড়নায় তাদের সন্তান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে, তার কাছে মোটেও আনন্দের নয়। বউটির বয়স খুব বেশি হলে পঁয়ত্রিশ , পূর্বশার বয়সিই হবে । ইতিমধ্যে পাঁচ সন্তানের জননী । স্বামী রিক্সা চালায় । অভাবের সংসার । পূর্বাশা নিজের চোখে দেখেছে অপুষ্টিতে ভোগা ছেলেমেয়ে গুলোর অবস্থা । বউটির হাতে মিষ্টির হাড়ি তুলে দিতেই হামলে পড়েছিল ওরা। বউটি বাধা দেয়নি। কিন্তু পূর্বাশা লক্ষ্য করেছিলো মুহূর্তে কেমন বদলে গিয়েছিল তার মুখটা। চোখদুটো চিকচিক করে উঠেছিল।
নতুন এক সেট জামা বউটির হাতে দিয়ে পরিয়ে দিতে বলেছিল বাচ্চাটিকে। যন্ত্রচালিতের মতোই হুকুম তামিল করেছিল বউটি, টান করে চুল আঁচড়ে রাবার ব্যান্ড লাগিয়ে দিয়েছিল, কাজল পড়িয়েছিল। এমনকি নজর টিপ পরাতেও ভোলেননি।
বউটির স্বামী ততক্ষনে সত্তর হাজার টাকা গুনে নিয়েছে। শাশুড়ি তাড়া লাগাচ্ছে, দাও, ওদের বাচ্চা ওদের হাতে তুলে দাও। অনেক দুরে যাবে ওরা –
কথাগুলোর মধে একরকম নির্দেশ ছিল। বিনাবাক্যে চোখের জল ফেলতে ফেলতে পূর্বাশার কোলে বাচ্চাটাকে তুলে দিয়েছিল সে। কেন জানে না , পুর্বাশার মনে হয়েছিল , বউটি নিজের অমতে বাধ্য হচ্ছে সন্তান বিক্রি করতে। তার অনুমান যে মিথ্যে নয়, কিছুক্ষনের মধ্যেই টের পেল । বাচ্চাটিকে নিয়ে তারা যখন বেরিয়ে আসছিল, তখনও বাড়ির উঠোন পেরোয়নি, বউটি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল । বাড়ির অন্যরা চিৎকার করে উঠেছিল । থমকে দাঁড়িয়েছিলো তারা । বাচ্চাটিকে মনিশের হাতে দিয়ে পূর্বাশা ছুটে এসেছিল, বউটির শুশ্রুসায় হাত লাগিয়েছিল। জ্ঞান ফিরতে কেমন একটা অসহায় শূন্য দৃষ্টিতে বিপাশার দিকে তাকিয়েছিল কিছুক্ষন। যে দৃষ্টির সামনে অপরাধি মনে হচ্ছিল নিজেকে। ভেতর ভেতর কুকড়ে যাচ্ছিল । অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছিলো, ক্রমশ সে দৃষ্টি ঘৃণায় বদলে যাচ্ছে। শেষপর্যন্ত নিজের অসহায়তার কথা অনুভব করে চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল, ওরে আমার সোনারে, তোরে শুধু জন্ম দিলাম , মা হতি পারলাম না –
বাড়ির অন্যরা তাকে যত বোঝানোর চেষ্টা করে তত যেন কান্নার বেগ বাড়ে। সেই সাথে আছাড়িপিছাড়ি। পূর্বাশা তখনই সিদ্ধান্ত নেয় । এ বাচ্চা সে নেবে না। মনিশ অখুশি হলে হবে। কাউকে কাঁদিয়ে সে মা হতে চায় না। বউটিকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, আপনি না চাইলে এ বাচ্চা আমি নেব না। আপনার বাচ্চা আপনারই থাকবে-
পূর্বাশার কথায় বউটি বিশেষ আস্থা পেল বলে মনে হল না। বরং তার বিলাপ, সেইসাথে আছাড়িপিছাড়ি আরও বাড়তে থাকলো। চিৎকারে দু’এক জন প্রতিবেশী ততক্ষনে ছুটে এসেছে। একে একে আরও আসবে হয়তো। অবৈধ ভাবে বাচ্চা কেনাবেচার খবরে তারা যে মারমুখি হয়ে উঠবে না, কে বলতে পারে। ভয়ে কেবল যে বিপাশাদের মুখ শুকিয়ে গেল এমন নয়, শাশুড়ি বুড়ির মুখটাও রক্তশূন্য । স্বামী মানুষটাও বাধ্য হয়ে বলল, চুপ যা বউ । তোর যখন মত নাই, ও বাচ্চা আমি কাউরে দেব না ।
ছেলের কথার জের টেনে শাশুড়িবুড়ি বলল, অ বউ, তোর মত নিয়েই তো অগো সাথে কথা বলিলাম। এখন আমাগো দোষ দিলি হবে কেন। অ মনিরুল, ওনাগো টাকা ফেরত দে– আমি বাবা এসবের মধ্যি নাই। আমারে যেন দোষের ভাগী না হতে হয়।
বাচ্চাটিকে পূর্বাশা ততক্ষন বউটির কোলে তুলে দিয়েছে।
মনিরুল অর্থাৎ বুড়ির ছেলে, বাচ্চাটির জন্মদাতা, কথা না বাড়িয়ে ঘর থেকে টাকার বান্ডিলটা এনে মনিশের হাতে দিয়ে বলে, মাফ করুন বাবু , আপনাদের অনেক কষ্ট দিলাম।
-না না,কষ্ট কিসের, বরং আমরাই তোমাদের কষ্ট দিতে এসেছিলাম। বিশ্বাস করো শত অভাবের মধ্যেও একজন মা যে কেমন হতে পারে, নিজে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না। আজ আমদের দেবী দর্শন হল।
এরকম আরও অনেক ভালো ভালো কথা বলে এবং বাচ্চাটার জন্যে আনা বাকি জামাগুলো, দামি দামি খেলনা সব মনিরুলের বউয়ের হাতে তুলে দিয়ে খালি হাতে সেদিন ফিরে এসেছিল। তিনমাসের ব্যবধানে দ্বিতীয় খবরটা এলো পল্লবীর কাছ থেকে। কে জানে এবার কী আছে কপালে। এ জীবনে বাঁজা অপবাদ ঘোচাতে পারবে না জানে । অন্তত মা ডাকটুকু যদি শুনতে পারে…ভগবানের কাছে এই টুকুই তার প্রার্থনা।
দুঃসহ অপমানের সেই দিনগুলো, একা থাকার মুহূর্তে আরও বেশি করে মনে পড়ে ,তাকে তাড়া করে বেড়ায়। এখনও ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে একবুক তৃষ্ণা নিয়ে জেগে ওঠে। বারো বছর হল বিয়ে হয়েছে। দুই ভাই এবং এক বোনের মধ্যে মনিশ সবচেয়ে ছোট এবং মায়ের প্রিয়পাত্র। শ্যামবাজারের মতো জায়গায় সে আমলের দুতলা বাড়ি। বনেদি পরিবার। দেখাশোনা করেই বিয়ে হয়েছিল তাদের। শাশুড়িমা নিজে পছন্দ করে নিয়ে এসেছিলেন। পূর্বাশাকে ভালোও বাসতেন। ছোটছেলের সুন্দরী শিক্ষিতা বউয়ের জন্যে প্রকাশ্যেই গর্ব করতেন। বড় ভাসুর প্রেম করে বিয়ে করেছেন। বড়দিকে দেখতে খারাপ না হলেও গায়ের রং চাপা, তারপর বারো ক্লাস পাশ। শাশুড়িমা বিশেষ পছন্দ করতেন না। বাজার- ঘাটে, আত্মীয়-স্বজন বা উৎসব-অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় পূর্বাশাকে সঙ্গে নিতেই পছন্দ করতেন। পূর্বাশারও যে খারাপ লাগত, এমন নয়। বরং উপভোগ করত। তার মানে এই নয় যে, বড়দির সাথে সম্ভাব ছিল না। এখনও আছে। নিয়মিত ফোনে কথা হয়।
সে সুখ বেশি দিন সইল না।
বছর দুই না যেতেই শাশুড়ীমা খোঁচাতে শুরু করল, আর কেন বউমা, অনেকদিন তো হল। আনন্দ – ফুর্তি অনেক করেছ। আর কোল খালি রাখা মানায় না –
– আমাকে বলে কী লাভ, আপনার ছেলেকে বলুন।
প্রথম প্রথম লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিলেও পরের দিকে সে এই উত্তর দিত। কারণ, মনিশের ইচ্ছে নয় পাঁচ বছরের আগে সে বাবা হয়। মায়ের কথা বললেও বিশেষ পাত্তা দিত না। পরে আর মায়ের অজুহাত নয়, সরাসরি বলত, আমারও কিন্তু ইচ্ছা এবার-
– তা হলে আর কী, আজ রাত থেকেই মাঠে নেমে পড়ব।
– যাঃ, অসভ্য কোথাকার। মুখে কিছু আটকায় না ।
-এই দেখ, আমার কী দোষ।তুমিই তো বললে।
-বলেছি বেশ করেছি।
সমস্যটা এর পরেই নজরে আসে। বছর খানিক পরেও যখন কনসিভ করতে পারল না, গোপনে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করেছিল। সমস্যাটা পূর্বাশার। ডাক্তারবাবু আশা না দিলেও পুরোপুরি হতাশ করলেন না। বললেন, চিকিৎসার মধ্যে থাকুন। দেখুন কী হয় –
গোপনে চিকিৎসা চলতে থাকল। যদিও বেশিদিন গোপন থাকল না খবরটা । একসময় শাশুড়িমাও জানতে পারলেন। তারপর মধুর সম্পর্ক বিষিযে উঠতে বেশিদিন সময় লাগেনি ৷ দিনে দিনে চক্ষুশূল হয়ে উঠল পূর্বাশা ৷ উঠতে বসতে দুর্ব্যবহার ‘বাঁজা’ অপবাদ।
জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল। তবে মনিশ সবসময় তার পাশে থেকেছে। একটা দিনের জন্যেও কোনও অভিযোগ করেনি। বরং সাহস জুগিয়েছে ।
ছোট বউমার সাথে ছোট ছেলেও অপছন্দের তালিকায় চলে গেল কিছুদিনের মধ্যে। অপরাধ বউয়ের হয়ে কথা বলা। আলাদা বাড়ি করে পৃথক হয়ে যাওয়ার ভাবনাটা তখন থেকেই । মনিশের যুক্তি, এছাড়া মার অত্যাচার থেকে বাঁচবার আর কোন পথ নেই।
বছর খানিকের মধ্যে মধ্যমগ্রামের এই বাড়িটি কিনে উঠে এসেছে তারা। ততদিনে ডাক্তারও জবাব দিয়ে দিয়েছে। মনিশ যেন মানসিক ভাবে প্রস্তুতই ছিল । একটুও আপসেট হল না। পূর্বশাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, চিন্তা কোরো না। আমরা অ্যাডপ করব।অবশ্য তোমার আপত্তি না থাকলে –
পূর্বাশা আপত্তি করেনি। দুজনে মিলে হোমে নাম লিখিয়ে এসেছে। সেও দু ‘ বছর হতে চলল। গত দুই বছরে অসংখ্যবার খবর নিয়েছে ।নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারেনি তারা । দুই বছরও লাগতে পারে আবার দশ বছরও লাগতে পারে।আপনাদের আগেও অনেকে নাম লিখিয়ে গেছে। আমরা সিরিয়াল মেনটেন করি।
– হোমের ভরসায় থাকলে আমরা বুড়ো হয়ে যাবো।অন্যপথ দেখতে হবে দেখছি।
মনিশ অধৈর্য্য হয়ে পড়েছিল । বিপাশাও। তারপর থেকেই তাদের বিকল্প পথের সন্ধান। বন্ধু-বান্ধব,আত্মীয়-স্বজনকে বলে রেখেছে, তেমন কোন সন্ধান থাকলে …..
তো, এটা নিয়ে দ্বিতীয়বার এমন সংবাদ এলো।
৩
পঞ্চাশ হাজার টাকায় রফা হলেও সঙ্গে বেশি করেই টাকা নিয়েছে মনিশ । বলা যায় না, তাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে শেষমুহূর্তে ডিমান্ড আরও বাড়িয়ে দিল। টাকার জন্যে এত বড় একটা সুযোগ হাতছাড়া করার অর্থ হয় না। প্রয়োজনে লাখ টাকাও দিতে রাজি সে ।
দুর্গাপুর পৌঁছতে পাঁচটা বাজল। পল্লবী তখনই একবার বাচ্চাটাকে দেখে আসতে বলেছিল। মনিশ রাজি হয়নি। রাস্তার ধকলের চেয়েও বড় কথা,হুটপাট কিছু করা উচিত হবে না। কাজের মাসীকে ডাকিয়ে ভালো করে আরও একবার খোঁজখবর নিল। চার মেয়ের পর আবার মেয়ে। আর্থিক অবস্থাও খারাপ। দিনমজুর পরিবার। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই কাজ করে। এখন অবশ্য বউটা কাজে বেরতে পারছে না। ছেলের আশায় থেকে থেকে এতগুলো মেয়ে। তবে মেয়ে হলে যে তাকে রাখবে না, সে সীদ্ধান্ত আগেই নেওয়া ছিল। আগের মেয়েটাকেও তারা বিক্রি করে দিয়েছে। মাত্র কুড়ি হাজার টাকায়।
মনিশ অনেকটাই নিশ্চিন্ত বোধ করল। তার মন বলছে, এখান থেকে খালি হাতে ফিরতে হবে না।
তবু সাবধানের মার নেই। রাতে বউ-শালিকে নিয়ে বাজারে গেল। বাড়ির সকলের সম্পর্কে
পল্লবীর কাজের মেয়েটার কাছে ভালো করে খোঁজ – খবর নিয়েছে। সকলের জন্যে নতুন জামা-কাপড়,মেয়ে তিনটির জন্য খেলনা আর বাচ্চার জন্যে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিছু কিনল । কিনল না শুধু মিষ্টি। বহরমপুরের ঘটনাটা এখনও তারা ভোলেনি।
পরদিন সকাল ন’টা নাগাদ কাজের মেয়ে প্রতিমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল তারা। বাস্তিটা পল্লবীদের ফ্ল্যাটের ঠিক পেছনে হলেও অনেকটা ঘুরে যেতে হয়। ইচ্ছে করেই গাড়ি নিল না। বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়াতে দেখে ভিড় জমে যেতে পারে। এক এক জন এক এক রকম মানসিকতার, এক এক রকম মন্তব্য করবে। কে বলতে পারে তাদের কথাবার্তায় ওদের মন বদলে যাবে না। তাছাড়া গাড়ি দেখলে মালদার পার্টি ভেবে ডিমাণ্ডটা যদি কয়েকগুন বাড়িয়ে দেয়। শুভ কাজে কোনরকম ব্যাঘাত সে চায় না।
দুটো রিক্সা নিয়েছে। একটাতে সে আর পূর্বাশা, অন্যটিতে পল্লবী আর প্রতীমা। অসংখ্য অলিগলি আর বাঁক পেরিয়ে বস্তিটার প্রায় পাকস্থলিতে পৌঁছে পলেস্তারাহীন একটি বাড়ির সামনে এসে থামল। পাঁচ ইঞ্চি সুরকির গাথুনি, খাপবার চাল, সামনে একফালি বারান্দা।
বারান্দার একপাশে চট দিয়ে ঘেরা, সম্ভবত রান্নার জায়গা। অন্য দিকে একটা চৌকি খাট। সামনে ছোট একফালি ফাকা জায়গা, একে উঠোন বলা চলে কিনা মনিশ বুঝতে পারল না। চৌকির উপর একজন বয়স্ক মহিলা শুয়ে আছে, পাশে বসে পাঁচ-সাত বছর বয়সের একটা মেয়ে উকুন বাছছে। উঠোনে এক্কাদোক্কা খেলছে বাকি দুটো ।যাদের একজনের বয়স খুব বেশি হলে চার, অন্যজনের তিন ।বাড়ির সামনে রিক্সা থামতেই খেলা থেমে গেল মেয়ে দুটির। উকুন বাছা ভুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো বড় মেয়েটা।
– কিরে ঝুমকি, খেলছিস? প্রতিমা জিজ্ঞাসা করল ।
মেয়ে দুটির কেউ উত্তর করল না। যেমন তাকিয়ে ছিল, তেমনই থাকল। উত্তর পাওয়ার কোন অভিপ্রায়ও প্রতিমার ছিল না। কথা বলতে বলতে সে ভেতরে ঢুকে পড়ল। বলল, মাসিমা দেখুন কাদের এনেছি।
প্রতিমার গলা পেয়ে উঠে বসল বৃদ্ধা। বয়স আনুমানিক সত্তরের কাছাকাছি। মাথার চুল সাদা। পরনে সিল্কের ছাপা শাড়ি, জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। আঁচলের কাছে এক জায়গায় গিট দেওয়া রয়েছে। সর্বাঙ্গে যেমন দারিদ্রের ছাপ, তেমন অপরিচ্ছন্ন। অনুমানে বুঝল, ভদ্রমহিলা বাচ্চাগুলো ঠাকুমা। প্রতিমার পেছন পেছন তারাও ঢুকেছিল। পূর্বাশা সকলকে চমকে
দিয়ে ভদ্রমহিলার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলা।
বুড়ি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বলল, আরে আরে , করো কী….
বাংলায় বললেও হিন্দুস্থানী টান। চেহারা দেখে বিহার বা ঝাড়খণ্ডের মানুষ বলেও মনে হয় না। কে জানে কোন প্রদেশের মানুষ। প্রতিমা শুধু বলেছিল, বাঙালি নয় ।
বুড়ির সংকোচ দেখে মনিশ বলল, আপনি আমাদের মায়ের মতো। গুরুজন। বলতে বলতে সেও একটা প্রণাম ঠুকে দিল। আপনাদের কৃপায় আমাদের মতো অভাগার মুখে হাসি ফুটতে চলেছে, ও মা হচ্ছে। যে দায়িত্ব ঈশ্বরের নেওয়া উচিত ছিল, সেই কাজ আপনারা করছেন। আপনারাই আমাদের ঈশ্বর। নিন এগুলো ধরুন।
জামা-কাপড়ের প্যাকেটগুলো চৌকির উপর রেখে বলল, বাচ্চাদের জন্যে কিছু জামাকাপড় আর খেলনা আছে । আপনার আর বৌদির জন্য কাপড় । দেখুন তো পছন্দ হয় কিনা৷
-তা বেশ করেছ বাবা। ও বউ দেখ কারা এসেছে।
বুড়ির বউমাটি এতক্ষন দরজায় দাড়িয়ে দেখছিল৷ বুড়ি ডাকতেই বেরিয়ে এল। খুব বেশি হলে ছাব্বিশ সাতাশ বছর বয়স। আটোসাটো চেহারা । দেখে বোঝার উপায় নেই চার সন্তানের মা ।গায়ের রংটাও বেশ ফরসা।
মেয়ে তিনটি ততক্ষণে উপহারের ব্যাগগুলো নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করেছে। বউটি তাদের হাত থেকে ব্যাগগুলো কেড়ে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। ফিরে এলো একটু পরেই।
মনিশের চোখ তখন খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই শিশু কন্যাটিকে। কিছুক্ষনের মধ্যেই যে তাদের জীবনের সাথে জুড়ে যাবে। তাদের অন্ধকার জীবনে আলো আনবে। তাকে বাবা বলে ডাকবে, পূর্বাশাকে মা। ছোট ছোট পায়ে দাপিয়ে বেড়াতে সারা বাড়ি।
বউটি কতগুলো প্লাস্টিকের চেয়ার এনে পেতে দিল বাড়ির সামনে ফাকা জায়গাটায়। বলল, বসুন। আপনাদের জন্যে চা করি।
-না না, তার দরকার নেই। এই মাত্র খেয়ে এলাম, আপনি বরং আমাদের মেয়েকে একটু দেখান।
-টাকা এনেছেন তো?
-এনেছি। সে নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না।
– পঞ্চাশ হাজারই লাগবে কিন্তু। কম বললে হবে না।
-পঞ্চাশ হাজারই এনেছি।
-মনিশ পাঁচশো টাকার বান্ডিলটা বের করে বউটির হাতে দিতে প্রায় ছোঁ মেরে কেড়ে নিল ।
জিভে আঙুলের ডগা ভিজিয়ে গুনতে বসল
দাওয়ায়। গোনার ভঙ্গিটা ভারি অদ্ভুত লাগল তার কাছে। এইমহিলার মেয়ে তো!
-আপনার স্বামীকে দেখছি না।
-কাজে বেরিয়েছে।
– তার কোন আপত্তি নেই তো।
ওমা আপত্তি থাকবে কেন! মুহূর্তে গোনা থামিয়ে উত্তর দিল বউটি। তারপর আবার গুনতে শুরু করল। দু’-চারটে নোট গোনার পর আবার প্রথম থেকে গুণতে শুরু করল। মাঝখানে কথা বলতে গিয়ে গোলমাল হয়ে গেছে।
বউটির কথার জের টেনে এবার বুড়ি বলল , তার কোন আপত্তি নেই৷ তার কথাতেই তো….
-তবু সামানাসামনি তার মতটা জানতে পারলে ভালো হত। তাছাড়া তার একটা সইও দরকার। কাগজপত্র রেডি করে এনেছি। তাকে কী একবার খবর দেওয়া যায় ?
-সে যায়। পাশেই তো কাজ করছে। যা তো ঝুমকি,বাবাকে ডেকে আন।
ঝুমকি ছুটে গেল সঙ্গে সঙ্গে। সঙ্গে ছোট বোনটাও ।
কাগজপত্র বলতে একশো টাকার একটা স্ট্যাম্প পেপার। যদিও মনিশ জানে এসবের কোন মূল্য নেই। পুরো কাজটাই হচ্ছে অবৈধ ভাবে । স্ট্যাম্প পেপারে এখনও কিছু লেখা হয়নি। সাদা কাগজে সই করিয়ে নেবে। পরে কোন ভালো উকিলের সাথে কথা বলে দেখবে, সত্যিই আইনগত ভাবে বিষয়টিকে পোক্ত করা
যায় কিনা। আপাতত এদের মনের উপর চাপ তৈরি করাই তার উদ্দেশ্য। যাতে করে বিশ্বাস দৃঢ় হয়। মেয়ের উপর আর কোন অধিকার রইল না।ভবিষ্যতে ঝামেলা পাকানোর কথা না ভাবে ।
ঝামেলা পাকাতে চাইলেও বা পাচ্ছে কোথায়৷ তারা তাদের আসল পরিচয় জানায়নি।এমনকি ঠিকানাও। পরিচয় দিয়েছে পল্লবীর বান্ধবী হিসাবে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েদুটো তাদের বাবাকে ডেকে আনল । রোগা , লম্বা , পাকানো চেহারা , দেখেই বোঝা যায় নিয়মিত নেশা করেন ।একমাথা রুক্ষ চুল, চোখ দুটো গর্তের মধ্যে। বেশ ধৃর্ত চোখের চাহনি । বাড়ি ঢুকেই বউকে উদ্দেশ্য করে হাক পাড়ল, ডাকছিস কেন?
– বাবুরা বলতিছেন, কাগজে সই করতি হবে।
– আমরা ইমানদার মানুষ। আমাদের জবানই শেষ কথা। এদিক ওদিক কিছু হবে না। এই সব সইটইয়ের কোন দরকার নেই ।
– তবু বুঝতেই পারছেন, মনিশ বোঝানোর চেষ্টা করে। ভবিষ্যতে যদি কোন আইনি সমস্যা হয়।
–কোথায়, কাগজ কোথায় ?
মনিশ স্ট্যাম্প পেপারটা এগিয়ে দেয়। একেবারে নিচে, ডান দিকের একটা জায়গা দেখিয়ে সই করতে বলে।
লোকটি সই করে দেয়৷
৪
টাকা গুনে নেওয়ার পর বাচ্চাটিকে বের করে আনে বউটি। বেশ ফুটফুটে চেহারা। রং ফরসা। চোখদুটোও টানাটানা। দেখে বোঝার উপায় নেই গুজরাটি না বাঙালি। সব শিশুকেই বোধ হয় কমবেশি একরকম দেখতে হয়। অন্তত এই উপমহাদেশের। বাচ্চাটিকে মনিশ নির্ভেজাল বাঙালি হিসাবেই মানুষ করবে। আচার-আচরণ, রুচি-মানসিকতায় কোথাও জন্মপরিচয়ের ছাপ রাখবে না। তবেই না তারা সার্থক পিতা-মাতা হয়ে উঠবে৷
বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে পরিপাটি করে এনেছে বাচ্চাটিকে। চোখে কাজল, কপালে কাজলের টিপ। যত্নে আঁচড়ানো চুল। তাদেরই আনা জামাকাপড় পরিয়েছে। একনজর দেখেই মায়া পড়ে যায়।
বাচ্চাটিকে নিজে হাতে পূর্বার কোলে তুলে দিল সে। পূর্বাশা অপলক তাকিয়ে আছে মেয়ের মুখের দিকে। সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। চোখদুটো চিকচিক করছে। মনিশের মধ্যেও অদ্ভুত এক শিহরন। দীর্ঘ যুদ্ধের পর এবার হয়তো জয়ের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে।, এখন শুধু এখান থেকে বোরোনোর অপেক্ষা। এত সহজে যে সবকিছু মিটে যাবে সে কল্পনা করেনি।
পল্লবী তাড়া লাগাল, এবার চল। কত দূর যেতে হবে তোদের সে খেয়াল আছে? আর সময় নষ্ট করিস না।
— হ্যাঁ, ঠিকই। মনিশ সম্বিৎ ফিরে পায়। পূর্বাশাকে বলে, তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে।
আসলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে বেরোনোর জন্যই তাড়া লাগাচ্ছে পল্লবী। পূর্বের অভিজ্ঞতা তারা কেউ ভোলেনি।
— যাই মাসিমা, বউদি যাই। ভালো থাকবেন। আপনাদের মেয়ে আমাদের কাছে ভালোই থাকবে, চিন্তা করবেন না।
তারা বেরিয়ে পড়ে। আগে আগে পল্লবী আর পূর্বাশা, পেছনে প্রতিমা আর মনিশ। গলির মুখ পর্যন্ত হেঁটে গেলে তবে রিকশা মিলবে।
— একটু শুনুন। বউটি পিছু ডাকে।
সকলেই প্রায় চমকে উঠল। আবার পিছু ডাকে কেন! তবে কী…
ঘর পোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ দেখলে তো ডরাবেই। সকলের পা গুলোই থেমে যায় সম্ভাব্য বিপদের আশঙ্কায়। পেছন ফিরে তাকায় বউটির দিকে। তেমন কোনো ভাবান্তর চোখে পড়ে না। তবে? উৎকণ্ঠায় তাদের বুকের মধ্যে ধুকপুক শুরু হয়েছে।
পল্লবী মনিশকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ঘাবড়িয় না। যতই হোক মা তো। নাড়ি ছেড়া ধন। কষ্ট একটু হবেই। হয়তো শেষবারের মতো একবার দেখতে চায়।
পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে বউটি। পূর্বাশা নয়, মনিশের মুখোমুখি দাঁড়ায়। সে ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসির ঝিলিক। বলে , আজ আপনাদের
আনন্দের দিন। মা-বাবা হলেন আপনারা। তাই বলছিলাম –
বউটি থেমে ঢোক গেলে ৷ ইতস্তত বোধ করছে কথাটা বলতে ।
মনিশ অভয় দিয়ে বলল, বলুন কী বলছিলেন?
– যদি কিছু মনে না করেন –
-না না, মনে করার কী আছে! আপনি বলুন।
বউটি এবার বাচ্চাটির দিকে তাকায় ৷ একনজর। তার পর পূর্বাশার দিকে। খুব অল্পক্ষনের জন্যই। তারপর মনিশের দিকে তাকিয়ে কোনরকম সংকোচ ছাড়াই বলে ওঠে, আপনাদের, এই আনন্দের দিনে মিষ্টি খাওয়ার জন্যে পাঁচশো টাকা অন্তত দিয়ে যান।