অরিত্রী দে

পঞ্চদশ পর্ব

ইকোফেমিনিজম : পর্ব দুই

ইকোফেমিনিস্ট পরিচয়

১৯৭৭ সালে প্রফেসর ওয়াংগারি মাথাই-এর নেতৃত্বে কেনিয়ার ‘গ্রিন বেল্ট’ আন্দোলনে নারীরা একত্রিত হয়েছিল, উদ্দেশ্য বৃক্ষ রোপণ এবং ক্ষয়প্রাপ্ত জমি পুনরুজ্জীবিত করা। ভারতের উত্তরাখণ্ডে চিপকো আন্দোলনে স্থানীয় গ্রামবাসীরা তাদের অরণ্যসম্পদ রক্ষা করেছিল অসাধু ব্যবসায়ীদের নীতি বর্জিত ব্যবসার হাত থেকে। কানাডিয়ান মহিলারা তাদের শহরের কাছাকাছি এলাকায় ইউরেনিয়াম প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট থাকার বিরুদ্ধে প্রচার ও প্রতিবাদ চালায়। এঁরা সকলেই ‘ইকোফেমিনিস্ট’, আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গৃহিণীরা বিপজ্জনক বর্জ্য স্থানগুলি পরিষ্কার করে ‘ইকোফেমিনিস্ট’ হিসেবে পরিচিত হন। কারণ উল্লেখিত নারীরা পৃথিবীতে জীবনচক্রের ধারাবাহিকতাকে সুস্থ রাখার জন্য নিবেদিত। যখনই নারীরা পরিবেশগত অবনমন, পারমাণবিক ধ্বংস, জৈবপ্রযুক্তি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং প্রজনন প্রযুক্তির উন্নয়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে, তারা ক্ষমতার আধিপত্যজনিত লালসা এবং নারীর (প্রকৃতির) প্রতি সহিংসক মানসিকতার মধ্যে সংযোগ আবিষ্কার করেছে। ‘Ecofeminism at the crossroads in India’ বইতে লেখিকা মনীষা রাও লিখেছেন- “they discovered the connections between patriarchal domination and violence against women, the colonized non-western, non-White peoples and nature. It led to the realization that the liberation of women cannot be achieved in isolation from the larger struggle for preserving nature and life on earth.”

প্রসঙ্গক্রমে বলা জরুরি যে নিসর্গ-নারীবাদের মতাদর্শে বিশ্বাসী পুরুষও একজন ‘ইকোফেমিনিস্ট’ বিবেচিত হতে পারেন। রাজস্থানের শ্যাম সুন্দর পালিওয়াল ‘নিসর্গ-নারীবাদের জনক’ নামে পরিচিত। ২০০৬ সালে জলের অভাবে কন্যাসন্তান হারান, কারণ তাঁর গ্রামে ভূগর্ভস্থ জলের স্তর সাতশো মিটারেরও নিচে নেমেছিল। এরপর থেকে গ্রামে প্রতিবার মেয়ে শিশুর জন্ম হলে গাছের চারা রোপণ করেন তিনি। 

ভেনেসা নাকাতে উগান্ডার ‘ক্লাইমেট জাস্টিস্ এক্টিভিস্ট’। উগান্ডায় হঠাৎই তাপমাত্রার মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধির কারণে ভেনেসা পরিবেশ বিষয়ক আন্দোলন সক্রিয়ভাবে শুরু করে ২০১৮ সালে। পরিবেশবাদী কর্মী গ্রেটা থুনবার্গের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ভেনেসা, জলবায়ু সংক্রান্ত সমস্যায় রাষ্ট্রের তথা সরকারের কোনো ভূমিকা না নেওয়ার বিরুদ্ধে পার্লামেন্ট গেটের বাইরে সরব হয় জানুয়ারি ২০১৯-এ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সে সমবয়সীদের কঙ্গোলিয়ান রেইন ফরেস্টের দুর্দশার দিকে দৃষ্টি ফেরানোর আর্জি জানিয়েছে। সে ‘ইয়ুথ ফর ফিউচার আফ্রিকা’ ও ‘রাইজ আপ মুভমেন্ট’ প্রতিষ্ঠা করে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের কুড়ি জন যুব জলবায়ু কর্মীদের সাথে যোগ দেয় ও ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’- এর সদস্যদের উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি লেখে ব্যাঙ্ক, সরকারকে জীবাশ্ম জ্বালানির ভর্তুকি বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে। অক্টোবর, ২০২০ সালে আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে ভেনেসা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্কটকে মেয়েদের প্রতি সংঘাত, সহিংসতার সাথে সম্পর্কিত করে চিহ্নিত করে। তার বক্তব্য ছিল যে জলবায়ু পরিবর্তন এক দুঃস্বপ্ন যা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেএকে প্রভাবিত করে, এই সংকটের দিকে না তাকিয়ে কি ভাবে আমরা দারিদ্র্য বিমোচন করতে পারি? কি করে আমরা ‘শূন্য ক্ষুধার্তে’র লক্ষ্যসীমায় পৌঁছাতে পারি যখন জলবায়ু পরিবর্তন লক্ষ মানুষকে না খাইয়ে রাখছে! সে ‘গ্রিন স্কুল প্রকল্প’ শুরু করে, যা নবীকরণযোগ্য জ্বালানির উদ্যোগ নেয়। এর লক্ষ্য উগান্ডার স্কুলে সৌরশক্তির ব্যবহার ও পরিবেশ বান্ধব চুলা বসানো।

সুইডেনের পরিবেশবাদী আন্দোলনকারী গ্রেটা থুনবার্গের সক্রিয়তার শুরু তার পরিবারবর্গের জীবনশৈলীগত কিছু পরিবর্তনমূলক পছন্দের মাধ্যমে। তারা ব্যক্তিগত জীবনশৈলীর জন্য ‘কার্বন ফুট প্রিন্টে’ গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণের পরিমাণ কমাতে উদ্যোগী হয়। ২০১৮, আগস্ট মাসে ১৫ বছর বয়সী গ্রেটা জলবায়ুর জন্য স্কুল ধর্মঘট করে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সুইডেনের সংসদের বাইরে স্কুলের দিনগুলো কাটাতে শুরু করে। এরই অনুকরণে ‘ফ্রাইডে ফর ফিউচার’ নামে স্কুল জলবায়ু ধর্মঘট আন্দোলন আকারে শুরু হয়। ‘ইউনাইটেড নেশন ক্লাইমেট চেঞ্জ কনফারেন্স’, ২০১৮-তে বক্তৃতার পরে বিশ্বের কোন না কোন জায়গায় প্রতি সপ্তাহে ছাত্র ধর্মঘট হতে থাকে। আমেরিকান পরিবেশবাদী কর্মী মার্টিনেজ ‘আর্থ গার্ডিয়ান’ (১৯৯২)  নামক পরিবেশ সংরক্ষণমূলক সংগঠনের কর্মী এবং ডিরেক্টর৷ আদিবাসী ও অন্যান্য প্রান্তিক সম্প্রদায়ের উপর জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে মার্টিনেজ স্বর তুলেছে। মিচিগানের সক্রিয় পরিবেশ আন্দোলনকারী আমেরিয়ানা কোপেনি জল সংকটের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে।   

ভারতীয় পরিসরে পরিবেশ চর্চা ও গবেষণার কেন্দ্র ‘সেন্টার ফর সায়েন্স এন্ড এনভারমেন্ট’-এর পরিচালক সুনীতা নারাইন। তিনি দিল্লিতে পরিবেশবাদী পত্রিকা চালানোর পাশাপাশি ‘সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্টাল কমিউনিকেশনে’র প্রবর্তক। পরিবেশ নারীবাদের অন্যতম প্রবক্তা, বিশ্বায়ন বিরোধী লেখিকা এবং আন্দোলনকারী বন্দনা শিবা (১৯৫২)  কৃষিক্ষেত্রে বীজের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি, শস্য বৈচিত্র‍্য বৃদ্ধি, পুষ্টি বৃদ্ধি ও কৃষকের অধিকার নিয়ে কাজ করেন। তাঁর মতে সবুজ বিপ্লবের ফলে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগে বীজের প্রাকৃতিক উৎপাদন ক্ষমতা, শস্যের প্রাকৃতিক পুষ্টি উভয়ই নষ্ট হয়েছে। এমন কি শস্যের মধ্যে থাকা বিবিধ কীটনাশক খাদ্যের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে বিপুল ক্ষতি করতে পারে, এই বিষয়েও সচেতনতা তৈরি করেন। জলবায়ু নিরাপত্তার স্বার্থে তিনি ‘ওয়ার্ল্ড ফিউচার কাউন্সিল’ তৈরি করেছেন। ‘ইকোফেমিনিস্ট’ বন্দনা শিবা ও মারিয়া মায়েজ উভয়েই উপনিবেশবাদ, পুঁজিবাদ সহায়ক বিজ্ঞানের সমালোচনা করেছেন। সভ্যতা ‘আধুনিকতা’র বৈশিষ্ট্যকে যত আত্তীকরণ করেছে, বৈশ্বিক প্রকৃতির সবকিছুকে দেখার বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হয়েছে। এমনকি ‘ক্ষমতা’ সুবিধা মতো আধুনিক বিজ্ঞান ও তার যুক্তিকে স্বার্থপূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। বন্দনা শিবার মতে- “we name ‘science’ what is mechanistic and reductionist”

দশোলি গ্রামের চন্ডীপ্রসাদ ভাট (১৯৩৪), সুন্দরলাল বহুগুণা (১৯২৭), তাঁর স্ত্রী বিমলা বহুগণা পরিবেশবাদে বিশ্বাসীদের পরিচিত মুখ। সুন্দরলাল হিমালয়ের বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ, তেহরি ড্যাম মুভমেন্টে যুক্ত ছিলেন। কেরালার ইকোফেমিনিস্ট সুগাথা কুমারী, ঝাড়খণ্ডের দয়ামনি বাড়লা প্রমুখ প্রকৃতি আর প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার জন্য নীতিগত লড়াই লড়ে গেছেন। আসামের মাজুলি দ্বীপের বাসিন্দা যাদব পায়েঙ (১৯৬৩) তো ভারতের জঙ্গল মানব নামে পরিচিত। ইনি ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে প্রায় ১৩৬০ একর জায়গা জুড়ে প্রচুর গাছ লাগিয়ে অরণ্য সৃজন করেন। মনে করব পাঞ্জাবের ভগৎ পূরণ সিং-এর কথা, যিনি পুনর্বব্যবহারযোগ্য কাগজে পরিবেশ সমস্যা নিয়ে গণসচেতনতা বর্ধক বিভিন্ন বিষয়ে প্যাম্ফলেট লিখতেন। 

ইকোফেমিনিস্টরা কার্যত এমন কিছু পরিবেশগত নীতির পক্ষে কথা বলেন যা নারী ও প্রকৃতির উপর যুগপৎ আধিপত্য, নিপীড়নের মোকাবিলা করে যত্ন এবং লালন-পালনের নৈতিকতাকে আশ্রয় করে। এই নীতি নারীরা অর্জন করে তাদের সাংস্কৃতিকভাবে নির্মিত অভিজ্ঞতা (Culturally constructed experience) থেকে। দার্শনিক কারেন ওয়ারেন যেমন ধারণা করেছেন- “An ecofeminist ethic is both a critique of male domination of both women and nature and an attempt to frame an ethic free of male-gender bias about women and nature. It not only recognizes the multiple voices of women, located differently by race, class, age, [and] ethnic considerations, it centralizes those voices.” এই আদর্শে বিশ্বাস করা হয় ‘সমতা’র ভাবনায়। কোনোরকম আধিপত্যবাদী ক্ষমতার সম্পর্কের বিন্যাস ব্যতিরেকে লিঙ্গ, জাতি, শ্রেণি নির্বিশেষে মানুষ স্থান-সময়-যত্নের পারস্পরিক বিনিময় ঘটাবে। তেমনি মানুষ আর প্রকৃতির সহাবস্থান জরুরি, যেখানে প্রকৃতিও একইভাবে স্থান-সময় আর যথাযথ পরিচর্যায় বিকশিত হতে পারে ও পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *