সুতপন চট্টোপাধ্যায়
হিমেল
বাড়িতে যে মেয়েটি ফুল দিতে আসে রোজ সকালে, তার মুখটি খুব মায়া মাখানো। বয়স কত? বারো কি তেরো হবে। রোগা, লম্বা বিনুনি, গভীর চোখ আর সহাস্য মুখ । বেল বাজিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। দরজা খুললে বলে, ফুল। কথাটা জানা তবু ও বলে। আর বললেই তার এক মুখ সরল হাসির ছটায় দিনটা প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। গালে একটা ছোট্টো টোল পরে । মুখটা প্রতিমার মত দেখায়।
নাম তার হিমেল। প্রথন দিন তার নাম বলতে আমি চমকে উঠে ছিলাম। হিমেল কারো নাম হয় নাকি? শুনিনি তো? তোর ভালো নাম কী?
-হিমেল। একটা’ ই নাম।
-কে রেখেছে?
-মা কোথায়?
আকাশের দিকে আঁঙ্গুল তুলে দেখাল। ওই হোথায়। আমার জন্মের দু বছর বাদেই ওপরে চলে গেছে।
ওহো। মুখ দিয়ে কথাটা বেরিয়ে এসেছিল ।
হিমেলের বসার জায়গা আমাদের আবাসনের উল্টো দিকের একটা ধাপিতে। দূর বড় কাছারি থেকে সে ভোরবেলা ফুল এনে বসে । এ তার নিত্য দিনের দোকান। কোন দিন সঙ্গে বাবা আসে, কোনদিন তাও আসে না। বার বছরের হিমেল রাস্তার উল্টো দিকে সাজিয়ে বসে ফুলের সঙ্গে তুলসীপাতা, বেল পাতা, জবা,গাঁদা ফুলের মালা আর দুর্বা ।
প্রথমে যাদের রোজের অর্ডার তাদের আলাদা করে তবেই সওদাগিরি। দোকান শেষে বাড়ি বাড়ি তার ফুল দেওয়া। এই হিমেল একদিন আর এলো না। সকালে বেল বাজায় আটটায় । সেদিন আটাটা বেজে গেছে । নয়টা ছুঁই ছুঁই । তাও হিমেলের দেখা নেই। সুমনা বলল, কী হল বলত, কী দিয়ে পূজো করব! মেয়েটার কী যে আক্কেল ?
আমি বললাম, দেখ, হয়ত শরীর খারাপ হয়েছে। ওদের কী শরীর নয়? খারাপ হতে পারে না? আমি গিয়ে ফুল নিয়ে এলে পুজো হল। তার আর দেখা নেই এক সপ্তাহ। খুব চিন্তায় পড়লাম আমি। ফুলের জন্য না। কেমন আছে মেয়েটা? সুমনা বলল, তুমি খবর নিলে না? কেউ কী খবর জানে না? এ কেমন কথা। ওর সঙ্গে কেউ না কেউ এখনের বাজার আসে। তারা জানে না?
কী উত্তর দিই? কিছু তো খবর পাচ্ছি না। আবাসনে অন্য ফুল ওয়ালা ঢুকে গেছে। তাদের কাছেও কোন খবর নেই। আর থাকলেও তারা বলবে না। উলটে বলল, ও নেই তো কী হয়েছে? আমরা তো আছি?
যে প্রান্তিক গ্রাম থেকে হিমেল আসত সে গ্রাম কেমন তার প্রকৃত ধারণা করা মুশকিল। রাস্তায় গাড়িতে বা বাসে যেতে যেতে দু পাশে যে গ্রাম পড়ে সেইসব গ্রামের ভিতরে গ্রাম থাকে, যাদের দেখা যায় না। ঘরের মধ্যে যেমন ঘর থাকে, গ্রামের মধ্যেও গ্রামের চেহারা যে সব সময় শান্ত, সরল , শান্তি ঘেরা তা কিন্তু নয়। গ্রাম উত্তাল হলে তার চেহারা আলাদা, হিংসে, মারামারির গোপন চোরা স্রোত চলতেই থাকে। পরবের সময় ফুরফুরে থাকে গ্রাম । এইটুকু জানা কিন্তু অনেক কিছু অজানা, গ্রামের মানুষই জানে। সেখানে তার কিছু হল না তো?
সুমনা একদিন বলল, হিমেলটা কোথায় যে গেল? মেয়েটা খুব মায়া কাড়া। থাকলে আমাদের সঙ্গে দিল্লি নিয়ে যেতাম। আমাদের সঙ্গে থাকতো, টুকটাক বাড়ির কাজ করতো, ফুল নিয়ে আসতো। আমি বললাম, সে আমাদের সঙ্গে সব ছেড়ে ছুড়ে যাবে কেন? ওর বাবা আছে। আর তাছাড়া তার বাড়িতে কে আছে তাই তো জানি না। নাবালক মেয়ে নিয়ে যাওয়া সাধারণ ব্যাপার নয়। গ্রামের অনেক জটিলতা আছে। গ্রাম পঞ্চায়েত আছে। কিছু হলে কে দিল্লি থেকে আসবে এই সব ঝামেলা সামলাতে?
গোপন ইচ্ছে অনেক সময় ফুল ফোটার মত ফলে যায়। তাই হল। হিমেল একদিন এসে হাজির হল।মা নেই জানতাম। বাবাও যে নেই সেটা বলল। সুমনা জিজ্ঞেস করেছিল, কোথায় ছিলি? সে হাসতে হাসতে বলল, মাসির বাড়ি বসিরহাট।
-তোর দোকান কী হবে?
-কাল থেকে আনব। তাই তো তোমাদের মন বুঝতে এসেছি। আমার কাছ থেকে নেবে তো?
সেই সুযোগে সুমনা কথাটা ঠিক বলে বসল। হিমেল বলল, একটু সময় দাও। কাকিকে একবার জিজ্ঞেস করতে হবে। ওরাই আমাকে দেখে।
হিমেল আর আসে নি। আমার ট্রান্সফারের অর্ডার বেড়িয়ে গেছে । যাবো যাবো করেও এক মাস ঠেকিয়ে রেখেছিলাম। তারপর? আর তো রোখা গেল না। চলে গেলাম দিল্লি। দিল্লির জীবন কলকাতার থেকে অনেক আলাদা। প্রথম প্রথম খুব একা লাগত। মানুষ কেবল কাজের পিছনে দৌড়য়। সারা দিন নিস্তার নেই। একজনের একটি চাকরি করে জীবন চলে না। দুজনকেই কাজ করতে হয়। দিনের শেষে অবসন্ন হয়ে বাড়ি ফেরা। প্রতিটি মানুষ সবের মধ্যে ফায়দা খোঁজে। এই ফায়দা খোঁজার অভ্যাসটা আমাদের ছিল না। সুমনা তো কোন দিন চাকরি করেনি। দিল্লিতে সেও কোন উপায় না দেখে চাকরিতেই যোগ দিয়ে নিজেকে স্রোতের মধ্যে ভাসিয়ে দিল। এতে সুমনার লাভ হল অনেক। বিভিন্ন প্রদেশের মানুষের সঙ্গে মিশতে মিশতে কখন আমারা হিমেলের কথা ভুলেই গেলাম।
অবসর নেবার পর দিল্লিতে কয়েক বছর কাটিয়ে ফিরে এলাম কলকাতায়। নিজেদের ফ্ল্যাটে ফিরে আসার প্রবল আকুতিতে দিল্লিতে বাড়ি করি নি। আপামর বাঙ্গালীর মত অবসরে দেশের মাটিতে ফিরে আসার গোপন ইচ্ছা চিরকালই জাগ্রত ছিল প্রবাসে। ফিরে এসে আবার নতুন করে বসবাস আমাদের আবাসনে। আমুল বদলে গেছে আবাসন। অনেকে চলে গেছে ওপারে। নতুন ভাড়াটে এসে ভর্তি করেছে শূন্যস্থান। প্রবীণ নাগরিকরা হয় ছেলে বা মেয়ের কাছে হাদ্রায়বাদ, পুনে গুরগাঁও বা বিদেশে গিয়ে স্থিতু হয়েছে। তারা আর আসবে বলে মনে হয় না। আমার ফ্ল্যাটের পাশেই তো তিন দিকে নতুন পরিবার। তাদের কাউকে চিনি না। ফ্ল্যাট কিনে তারা আবসিক। আমি যে জগৎটা ছেড়ে গিয়েছিলাম সেই জগৎটার আর কোন অস্তিত্ব নেই।
এক দিন সকালে বাজারের রাস্তায় অখিলের সঙ্গে দেখা। আমাদের আবাসনের পাশেই সাতগ্রামে সে অনেক দিন আগে জমি কিনে নিজের বাড়ি করেছিল লোন নিয়ে। আমাকেও বলে ছিল। করি নি। অখিলের নতুন বাড়ির গৃহ প্রবেশে নেমতন্ন খেয়েছিলাম। মনে আছে। অখিল আমাকে দেখেই বলল,
-আরে তুই? কবে এলি?
-এই তো? মাস খানেক।
-পাকাপাকি?
-অবসর, আর কি? পাকাপাকিই বলতে পারিস। কোথায় আর যাব?
– আরে দূর, এলি কেন দিল্লি ছেড়ে? কেউ গেলে তো আর ফিরতে চায় না। এখানে কেউ ফিরে আসে?
-সবাই তা নয়। বলে হেসে উঠি। অখিল ও হেসে বলে, আবার এতদিন পরে বৃত্তে ফিরে আসা।
এক বিকেলে অখিলের বাড়িতে গেছি। বাড়ির প্রবেশের দ্বারে একটি ছোট্টো মন্দির। ভিতরে বিগ্রহ। দেখে মনে হয় পুজো হয় নিয়ম করে। ভিতরে বসার ঘরে বসাল অখিলের স্ত্রী। বলল, আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে আপনার বন্ধু খুব খুশি। বসুন, আপনার জন্য গরম সিঁঙ্গাড়া আনতে গেছে।
বলতে বলতেই অখিল এসে হাজির। ঘরের ভতরে যেতে যেতে বলল, বস বস, আজ জমিয়ে আড্ডা মারা যাবে।
আমরা দুজনে গল্প করছি। আমাদের অতীতের গল্প, কলেজের, ভারসিটির, চাকরির। মাঝে মধ্যে সহপাঠী, বান্ধবী সব’ই উঁকি দিচ্ছিল। হঠাৎ পরদা সরিয়ে একজন এগিয়ে এসে চা আর সিঁঙ্গাড়া রাখল টেবিলে। অখিল বলল, আমার মেয়ে হিমেল।
হিমেল শব্দটা কেমন আশ্চর্যের সপ্তম তারে বেজে উঠল। হিমেল? আমি তার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখছি। অখিল বলল, এবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ ডি করছে। বটানি নিয়ে।
বাহ বাহ দারুণ খবর। পুর্ণ যৌবনা টগবগে সুন্দরী একটি মেয়ে। বিজ্ঞানে বিদুষী । কি অদ্ভুত মিল? মনে হতেই দেখি সেই রোগা পাতলা মেয়েটির মুখের আদল।
ভিতরে চলে গেল হিমেল।
অখিল বলল, আমাদের তো সন্তান হয় নি তাই ও আমাদের দত্তক মেয়ে। খুব মেধাবী। এতো ভালো হবে আমরা কল্পনাই করিনি। ভালই কেটে গেছে ওকে নিয়ে। কিন্তু এখন একটাই সমস্যা।
আমি জিজ্ঞাসা করি, কী সমস্যা তোর?
আরে, এবার ওকে বিয়ে করতে বলছি। কিছুতেই করবে না। বলে আমাদের কে দেখবে? আমি বলি আমাদের তো বয়স হচ্ছে। আমরা তো থাকব না।
আমি বললাম , দুজনেই তো দু দিক থেকে ঠিক।
-তুই একটু বুঝিয়ে বল না। তোর কথা শুনতেও পারে।
-আমার কথা? আমার কথা সে শুনবে কেন? ওতো আমাকে চেনে না। আজ ই আলাপ।
পর্দা সরিয়ে হিমেল ঘরে ঢোকে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, আপনি নির্মল এপার্টমেন্টেরর এগারো তলায় থাকেন না?
আমার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। আমি দেখতে পাই হিমেল দাঁড়িয়ে আছে আমারই দরজার সামনে। হাতে ফুল আর বেলপাতা। ঠিকই তো ওর বটানির ছাত্রী হওয়ারই কথা!
সজল মামা
আমাদের বড়িতে মধ্য রাতে কেউ কোনদিন আসে নি। আমরা দেখিনি। তাই আমাদের বাড়ির দরজা ভিতর থেকে হুড়কো দিয়ে আটকান থাকে। বাবা রোজ সকালে খোলে এবং রাতে বন্ধ করে। সে দিন এমনি রাত। দরজা বন্ধ।
মধ্য রাত। ধুপ করে শব্দ হল বাইরে। বাইরে না ভিতরে ঘরের ভিতর থেকে বোঝা দায়। মা’র ঘুম পাতলা, রাতে শব্দ আরো জোরে বাজে। মা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে আমাকে বলল, দেখ তো নারকোল গাছ থেকে কে যেন লাফিয়ে বাড়িতে ঢুকেছে। চোর হবে। বাবাকে ডাক। বাবা ততক্ষনে উঠে পড়েছে।
কোনদিন চোর পড়েনি, ডাকাত তো কল্পনার অতীত। ভয়ে গা ছম ছম করছে। বাবা চৌকীর নিচ থেকে বাঁশের লাঠি নিয়ে বারান্দার দরজা খোলার তোরজোর করছে। বাইরে থেকে চাপা গলা, ভয় নেই আমি চোর নই। আমি সজল। বাড়ির দেওয়াল টোপকে বাড়িতে ঢুকেছিল সজল মামা। সেদিন রাতে আমাদের বাড়িতে এক চাপা উত্তেজনা। সজল মামা আমাদের বাড়িতে মধ্যরাতে? রহস্যের বেড়াজালে মোড়া হয়েছিল আমাদের বাড়ি। কে প্রথম জানবে সজল মামার আসার কারণ টা কী?
সজল মামা বাড়ির ভিতরে একটা টুলের উপর বসল। মা, জল এনে মাথায় একটু ছিটিয়ে দিল। সজল মামা মায়ের ছোট ভাই। তিন বোনের পর দুই ভাই। কমলমামা থেকে বর্ধমানে। সজল মামা বাঁকুড়ায় ডাক্তারি পড়ে। ছোট ভাই সবার আদরের । তার একটা প্রধান কারণ সে মাধ্যমিকে জেলার প্রথম হয়েছিল বলে বোনেরা গর্বে বিভোর । মাকেও মাঝে মাঝে আমাকে বলতে শুনেছি, ছোট মামার মত হতে হবে। এই আপ্ত বাক্যটা মনের মধ্যে ঘড়ির কাঁটার মত টিক টিক করে নড়ত। সেদিন রাতে কেন যেন তার ছিঁড়ে গেল। মনে মনে ভাবলাম সজল মামা এমন চোরের মত রাতে আমাদের বাড়িতে কেন? কিছু কী অন্যায় করেছে তাই পালিয়ে এসেছে? কী হতে পারে? মারামারি, চুরি, শুনেছিলাম সে হোস্টেলে থাকত। সে কী হোস্টেলে কিছু করেছে?
কে জিজ্ঞেস করবে? দেখি বাবা মাকে বলছে। তুমি জিজ্ঞাসা কর। মা বলছে, আমায় বলবে না,তোমায় শ্রদ্ধা করে, ভয় ও খায়, তোমাকেই বলবে। এর মাঝেই সজল মামা বাথরুম থেকে চোখে মুখে জল দিয়ে মাকে বলল, কিছু খেতে দে দিদি, দুপুর থেকে খাই নি।
মা সব ছেড়ে রান্না ঘরে চলে গেলে বাবা সজল মামাকে বলল, কী ব্যাপার বলত সজল, এত রাতে তুমি কোথা থেকে? কী করেই বা এলে। বাস তো রাত দশটায় বন্ধ হয়ে যায়?
সজল মামা একবার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক বলেছেন। আমি বাসে আসে নি। একজন আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেছে বাইকে।
কেন এলে তা তো বললে না। সজল মামা বলল, সেটা পরে বলব। এখানে ক’ দিন থাকব জামাই বাবু।
বাবা বলল, সে তুমি যত দিন থাকতে চাও থাক। তোমারই তো দিদির বাড়ি।
সজল মামা অনেক দিন ছিল আমাদের বাড়িতে। গ্রামের বাড়িতে এতোদিন থাকাটা কেউ আপত্তি করে নি। কলেজে পড়তে পড়তে এক বিপ্লবী রাজনৈতিক দলে ভিড়ে গিয়েছিল সজল মামা। তাদের কলেজে একটা খুন হয়েছিল সে কারণে পুলিশ খুঁজছিল তাকে। সে আমাদের বাড়িতে লুকিয়ে থেকে আমাকে অঙ্ক ও ইংরাজী পড়াত । সজলমামা যে খুব মেধাবী ও তুখোড় তা তাঁর পড়ানো দেখলেই বোঝা যেত। অনেক অনেক দিন পর কলেজে ফিরে গিয়েছিল সজল মামা। আর আসে নি।
সেই সজল মামা ডাক্তার হয়ে অনেক কাল ইংল্যান্ডে। আমাদের দেশ থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে সেই দেশে । কয়েক বছর দেশে আসে নি। ছেলে মেয়ে বড় হতে তবেই আসা আরম্ভ করেছে। বিদেশী বউ, দুই ছেলে নিয়ে এবার কোলকাতায় আসছে সজল মামা। আমাদের বড়িতে থাকবে দু দিন তার পর একদিন হোটেলে থেকে রাজস্থান বেড়াতে যাবে। সেই মত আমি বিমান বন্দরে আনতে গেছি। বাবা নেই, মাও শয্যাশায়ী। তবু বিদেশ থেকে কৃতী ভাই আসছে শুনে বেশ চাঙ্গা। দু দিন থেকে ঘর বার করছে, কুঁজো হয়ে এক হাঁটুতে হাত রেখে। চুল সব সাদা। মাঝে মাঝে বলছে, সজলটা আমাকে দেখে খুব দুঃখ পাবে, এত শরীর খারাপ, চুল সব সাদা। চিনতে পারলে হয়। খুব ইচ্ছে ছিল তালের ফুলুড়ি বানাবো। সজল খুব খেতে ভালোবাসে। কিন্তু তাল মারার লোকই নেই!
ঠিক সময় বি্মানবন্দরে আমি হাজির। সপরিবারে সজল মামা এক্সিট দিয়ে বেরিয়ে এসেই চিৎকার করে উঠল, বিলটু? আমারা এখানে। বলে এগিয়ে এসে সকলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল আমার। আমি একটা বড় গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম। সবাই ফিরে এলাম বাড়িতে।
মায়ের কোথায় যেন একা দ্বিধা ছিল। আমাদের মত ছোট্ট বাড়িতে সজল মামার পরিবার থাকতে পারবে তো? বাড়ি পৌছনোর পর অব্দি সেই ধন্দ কমে নি। তাই বাড়িটা দেখিয়ে মা সজলমামাকে বলল, হাঁরে, আমার বাড়িতে থাকতে অসুবিধা হবে না তো তোদের?
বিদেশিনী মামিমা বলল, না না একবারিই নয়।
আমরা সবাই চমকে গেছি তার বাংলায় কথা বলা দেখে। ভেবেছিলাম মামিমার ও ছেলেদের সঙ্গে আমদের ইংরাজি তেই কথা বলতে হবে। মামিমার কথা শুনে মা অবাক হয়ে বলল, ওমা তুমি তো ভালো বাংলা বলতে পার?
মামিমা বলল, আপনার ভাই শিখিয়েছে। আমি পড়তেও পারি।
আমাদের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।
মামিমা আবার বলল, বিয়ের পর হাসপাতাল থেকে ফিরে আমাকে বাংলা শেখাত।
শুনে আমাদের কি আনন্দ। মামিমা কে যেন তিন গুন ভালবেসে ফেললাম। মামিমা ও ডাক্তার তবে মামার মত সার্জেন নয়। ডারমাটোলজিস্ট । দুই ছেলে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমাদের বাড়িতে সেদিন উৎসবের আবহাওয়া। মামা বাবার লুঙ্গি পড়ে সোফায় বসে টেলিভিসন দেখছে। মামিমা মায়ের সঙ্গে রান্না ঘরে খাবার তদারকি করার চেষ্ঠা করছে। মা কিছুতেই করতে দিচ্ছে না। মাঝে মাঝেই পছন্দের খাবার করে নিয়ে আসছে। মা আর সজল মামার গল্পের শেষ নেই। তাদের ছোট বেলা, দেশের বাড়ি, দাদার কথা, অন্য বোনেদের কথা নিয়ে মশগুল । এর মধ্যে আমি বাজার করে ফিরেছি। নানা রকম বাজার করে এনেছি । মা লিস্ট করে দিয়েছে। সজলমামা কী কী খেতে ভালো বাসত তার লিস্ট ধরে। চন্দনা সেগুল ধুয়ে, মুছে সব একে একে সাজিয়ে রাখছে ফ্রিজে। মায়ের আদেশ মত সে ব্যবহার করবে।
এমন সময় দুই জমজ ভাই ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল মামিমার কোলে। কে বড় কে ছোট বোঝা মুশকিল। মামিমার কোলে মুখ ঘসে এবার আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, চল আমরা বাইরে ঘুড়ে আসি।
দু জনেই এক কথায় রাজি। মা দুজনকে আদর করে জিজ্ঞাসা করল, তোমরা বড় হয়ে কী হতে চাও?
দু জনেই এক স্বরে বলল, ডাক্তার।
মা অবাক হয়ে বলল, ওমা ওরাও বাংলা বলতে পারে! মামিমা বলল, ওই সব শিখিয়েছে।
মা অশ্রুসিক্ত চোখে বলল, সজল, এটা দেখে মা যে কী খুশি হত। খুব খুশি হত। তুই এতো বড় ডাক্তার হয়েছিস, কিন্তু মাতৃভাষা ভুলিস নি।
অতসী
সেদিন সকালে আকাশ কালো করে এসেছিল। ক’দিন গুমোট গেছে, বাইরে বেরলেই ঘামে পোষাক ভিজে সপসপে। মনে হচ্ছিল বৃষ্টি যে কোন সময় আসতে পারে। তারই আয়োজন এই সাত সকালে। চারিদিক অন্ধকার করে এসেছে। সুর্যের আলো তাকে ভেদ করে বাইরে আসতে পারছে না দেখে মাথায় টোকা নিয়ে মাঠের দিকে বেড়িয়ে গেল অতসী। তাল পাতার টোকা, বৃষ্টিতে মাথাটা না ভিজলেও, শরীর তো ঝাপটায়য় ভিজে যাবে। ছাতায় আটকায় না। টোকা ঝড়ে ওড়ে না, ছাতা উলটে যায়। এ সব অনেক দিনের অভিজ্ঞতা। এখন মাঠে যাবার সময়। সময় নষ্ট করার সময় কোথায়?
ইছামতী নদীর পাড় দিয়ে লম্বা রাস্তা চলে গেছে গোলপাতা ম্যানগ্রোভের দিকে। ম্যানগ্রোভের মধ্যে রাস্তা দু দিকে ভাগ হয়ে ইছামতী নদীতে পড়েছে। একটি রাস্তা গোলপাতা জঙ্গল পেরিয়ে, ইছামতী অনেক সরু হয়ে বইছে। গোলপাতা নামটি এসেছে গোলপাতা ফলের আকার থেকে। গাছটা নারকোল গাছের পাতা যেন মাটি থেকে লম্বা দাঁড়ানো। জঙ্গলে এই গাছ ছাড়া আরও অনেক গাছের আধিক্য। তারই এক দিকে চাষের খেত,। প্রধানত পাট ও ধান। মাঝে মাঝে অন্য সবজি এখানে সেখানে চোখে পড়ে। অতসী বিয়ে হয়ে আসা ইস্তক এই গ্রামে অনেক বছর। আগে সে গুরুপদর সঙ্গে যেত। গুরুপদ কয়েক বছর হল ছেড়ে গেছে তাকে। ঠিক ছেড়ে যায় নি। এমনি সাপের ছোবল যে তাকে দু মিনিট দেয় নি। টাকী হাস্পাতালে নিয়ে যেতে যেতেই সে ইছামতীর ওপারে চলে গেছে। সেই থেকে অতসী একা। একা ঠিক নয়। শিখা, তাঁর এক মাত্র মেয়ে। পঞ্চম শ্রেনীতে পড়ে গাঁয়ের ইস্কুলে। শিখা কে নিয়ে অতসীর একটা গোপন ইচ্ছে আছে। তা সে মনের গোপনেই লুকিয়ে রাখে।
গুরুপদ খুব খরচে ছিল না। চাষের রোজগার থেকেই সে একটা কোটা ঘর করেছিল। বাড়ির পাঁচিলে পাট শুকোতে দিত। সব পাট চোখের সামনে থাকত। না হলে চুরি চামারি তো লেগেই থাকে । গুরুপদ মারা যাবার কিছুদিন আগে একটা স্কুটি কিনেছিল টাকী শহরে যাবার নামে। সব সময় শহরে যেত না। গুরুপদর পিছনে বসে অতসী নদীর ধার দিয়ে চলে যেত সোনার বাংলা রিসর্টের দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে তিন জনে আইস্ক্রিম খেত ইছামতীর দিকে তাকিয়ে। উল্টো পাড়েই বাংলা দেশ। দূরে তাদেরি মত বাংলা দেশের সাতক্ষীরা গ্রামের টিম টিমে আলো দেখা যেত । রাতের অন্ধকারে বর্ষায় নদীর জল চোখে পড়ে না। মনে হয় হেঁটেই চলে যাওয়া যায় বাংলা দেশ। সে সব কেমন সিনেমা সিনেমা মনে হয় অতসীর।
গুরুপদর মৃত্যুর পর অতসী স্কুটি চলান শিখেছিল । এখানের রাস্তা খুব চওড়া নয়। রাস্তার দু ধারে অনেক গেস্ট হাউসে ছেয়ে গেছে। ভ্রমন পিপাসু মানুষের ভীড়। প্রচুর টোটো চলে । হোটেলের সামনে অনেক টোটো। হাত খুলে চালানোর অনেক অসুবিধা। তাতেও অল্প সময় সে শিখে ছিল।
বাড়ি থেকে বাইরে বেড়োতেই শিখার গলা। মা, আজ আমার ক্লাস আছে। মনে আছে তো?
অতসী বলল , মনে আছে। আমি মাঠ থেকে আগেই চলে আসব।
যদিও বর্ষা কাল, কালো মেঘ অনেকটাই ইছামতী পেরিয়ে বাংলাদেশের দিকে চলে গেছে। তবু আবার ভেসে আসতে পারে। এমনি তে দুই বাংলায় এই মেঘের আনাগনা লেগেই থাকে। ওখানে তো তারের বেড়া নেই! মাথা উঁচু করে একবার তাকাল আকাশের দিকে। না, তেমন জোরে আসবে না, ঝির ঝিরে তো চলবেই। জঙ্গল, নদী ও সবুজ শস্য ক্ষেত্র, এখানে বর্ষার রূপ ক্ষনে ক্ষনে বদলে যায়। অতসী দেখেছে। আর গুরুপদর সঙ্গে মাঠের আলে ঘুরতে ঘুরতে সে আকশটাও পড়তে শিখে গেছে। ধানের শিষে এই ঝির ঝিরে বৃষ্টি খুব উপকারী। বীজতলা থেকে কালো পালের ছেলে বলল, কী গো দিদি আজ এতো সকাল সকাল?
হাঁ, বিকেলে কাজ আছে।
-শুনেছ, আমাদের গ্রামে পুজোয় এবার জমিদার বাড়িতে তিন দিন ধরে নানান খেলার ব্যবস্থা করছে। জমিদার বাবু সপরিবারে আসছে। এবার তাদের চারশ পাঁচ বছরের পুজো গো।
অতসী বলল, তাই নাকি? তা কী কী খেলা হবে?
আমাদের গ্রামে ঘরে যা হয় আর কী? চু কিত্ কিত্, হা ডু ডু, এমনি সব।
মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে গেল অতসীর। মনে মনে ঠিক করল আজই টাকী তে গিয়ে প্রস্তাবটা দিতে হবে। একবার যদি শিখা জিততে পারে সে বিখ্যাত হয়ে যাবে এই অঞ্চলে। তার সপ্তাহে সপ্তাহে শহরে নিয়ে যাওয়া সফল হবে। বর্তমান জমিদারের জমিদারি নেই। আছে আট মহলা একটা জমিদার বাড়ি। আর জমিদার সেনাবাহিনীর অবসর প্রাপ্ত। পুজোর সময় প্রতি বছর আসেন। বাকি সময় কোলকাতায়। তার হাত থেকে পুরস্কার তো স্বপ্নের মত।
-কোন কোন দিন হবে জানো?
-সপ্তমী, অষ্ঠমী ও নবমী।
দুপুর বারটায় বেশ জোরে নামল বৃষ্টি। টোকায় কী আর শরীর বাঁচে? সারা শরীর ভিজে গেলে মাঠ থেকে উঠে এল অতসী। টিপ কলে মাথায় জল ঢেলে হাল্কা করে ঝেরে নিল সে। তারপর, হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরে দেখল শিখা চৌকিতে বসে পড়ছে। মা না এলে সে ছুটির দিনে খেতে বসে না। অতসী কে দেখে সে রান্না ঘরে থালা ও রান্না নামাল মেঝেতে।
ঠিক বিকেল চারটে নাগাদ মেয়েকে পিছনে বসিয়ে রওনা দিল টাকীর উদ্দেশ্যে। আজ রবিবার, রাস্তার গেস্ট হাউস গুলির মুখে মুখে টোটোর ভীড়। তার সঙ্গে গাড়ি, অটো আর সাইকেল। অতসী এসে পৌঁছল ক্যারাটে ট্রেনিং সেন্টারে। স্কুটি থেকে নেমে শিখা চলে গেল নিজের ক্লাসে।
বেশ কিছু দিন হল গাঁয়ে বলেছে সে মেয়েকে টিউসান দিতে নিয়ে আসে শহরে। গ্রামে তেমন শিক্ষক নেই। তাই লোকের বুঝতে অসুবিধা নেই। শুধু পাশের বাড়ির সর্বমঙ্গলা চিমটি কেটে বলেছিল, কী হবে গো তোমার মেয়ে? ডাক্তার না উকিল।
উত্তর দেয় নি অতসী।
ক্লাসে ভর্তি করেছিল বছর খানেক আগে। গুরুপদর মৃতুর পরে পরেই। এটা তাঁর অনুভবের তারণায়। মনে হয়ে ছিল, নিজেকে বাঁচাতে হলে এমন একটা জিনিস শিখতে হবে যাতে কেউ আঘাত করতে এলে প্রথমেই রুখে দেওয়া যায়।ইস্কুলের ননী মাস্টার ্পরামর্শ দিয়ে ছিল। অতসী আর দেরি করে নি। গ্রামে ঘরে এক মেয়ে নিয়ে বিধবা, বিপদ যে কোন দিন যে কোন দিকে থাকে আসতে পারে। কী দিয়ে ঠেকাবে তাকে?
তাই শিখা কে সে ভর্তি করেছিল এখানে। সে মাকে না বাঁচাতে পারলেও নিজেকে তো বাঁচাতে পারবে? যে ভাবে মেয়েদের বিপদ বাড়ছে বাইরের জগতে? আর বেঁচে থাকলে তো বাইরে বেরোতে হবেই। সে অপেক্ষা করে রইল শিখার ক্যারাটে ক্লাস শেষের জন্য। ফিরতে ফিরতে ঠিক করল, জমিদার বাবু কে বলতে হবে পুজোয় ক্যারাটের প্রতিযোগিতা যেন এক দিন করে।
বোকেন
হাট বসন্তপুরে রাজরাজেশ্বরী পুজোর ধুমধামই আলাদা। গ্রামের দুর্গা পুজোর আকর্ষণের চেয়ে এই পুজোর দিকে তাকিয়ে থাকে সবাই সারা বছর । এটা তো পুজো নয়, মেলা, নানান খেলা আর জিলিপী ও জিভে গজার চার দিনের মহোৎসব। কে না আসে? দশ মাইল দূর থেকে গ্রামের মানুষজন কে দেখতে পাওয়া যায় এই মেলায়। এখানে হিন্দু মুসলমানের কোন ভেদাভেদ নেই। এক কোনে খাসির মাংসের দোকান দেয় হোসেন। কী বিক্রি তার দোকানের। দিনে তিন চারটে ছাগল সাবার করে দেয়। এক সময় সমরেশ মুখুজ্জের পুর্ব পুরুষ জমিদার, এখন সে কোলকাতায় থাকে। সপরিবারে এই পূজোর সময় তাদের আসা নিয়ম মাফিক। তাদেরি বাড়িতে এই সময় আসে তাঁর ছেলে, ছেলের বউরা ও চাকরবাকর। তারাই দিনের বেলায় বারবার মেলাতলায় গিয়ে খবর নিয়ে জানায় সমরেশ মুকুজ্জে কে। । পুজোর ফল নৈবেদ্য যায় সমরেশ মুকুজ্জের বাড়ি থেকে। তাই তাদের বাড়িতেও এক উৎসবের ঘনঘটা। জমিদারি নেই। কিন্তু তার ঠাট বাট আছে। শীতের শেষে মাঘ মাসের প্রথমে রাজ রাজেশ্বরীর পুজো। লোকে বলে এটি মা দুর্গার ষোড়শী রূপ। এই পুজো জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতিরক্ষা প্রার্থনার পুজো।
এই মেলায় আমার সঙ্গে দেখা হয় সমরেশ মুকুজ্জের ছেলে বোকেনের। বোকেনের গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, গায়ের রঙ ফর্সা,সাদা পাঞ্জাবি ও পায়জামা পরে সে পুজো তলায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আমাকে দেখে কাছে এসে বলল, এবার তেলে ভাজার দোকান দেখছি না তো?
-আছে তো। বিকেলে বসবে। সকালে আর গরম গরম পাঁপড় কে খাবে?
-আমি আজ জিবে গজা খাব, পাঁপড় খাব, ডালের ফুলুড়ি খাব। তুমি কিন্তু কাউকে বলবে না। বাবা শুনলে রক্ষে রাখবে না।
-ঠিক আছে। বলে আমরা দু জনে মেলায় ঘুরে বেড়াছি। এমন সময় সনাতন বলল, দাদাবাবু তোমায় খুঁজছে। আর তুমি এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছো। তাড়াতাড়ি যাও। না হলে বকুনি খাবে। অনেকক্ষণ ধরে তোমায় খুঁজছে। বলে সনাতন চলে গেলে বোকেন বলল, জানো তো আমার হার্টে একটা ফুটো আছে। আমি খুব বেশী দিন বাঁচবো না। খুব জোর মেরে কেটে আর দশ বছর। তারপর পটল তুলব।
কী করে জানলে?
-ডাক্তারকে বলতে শুনেছি। ওরা ভাবে আমি জানি না। জানি সব জানি। সব জানি তাই সব খাবার টেস্ট করে নিতে চাই।
আমি অবাক হয়ে বোকেনকে দেখি। নিজের মৃত্যু সম্বন্ধে এতটা জেনেও সে নিজেকে নিয়ে রসিকতা করছে?
-কী অবাক হচ্ছো? বোকেন প্রশ্ন করল।
-আমি কোন উত্তর দিচ্ছি না দেখে বোকেন বলল, ওই হার্টের ফুটোটা সেলাই করার অনেক চেষ্ঠা হয়েছে। কিন্তু করা যায় নি। কবে হবে কেউ জানে না। হঠাৎই একদিন আমি আর নিশ্বাস নিতে পারব না।
আমি কী বলব ভেবে পাচ্ছি না। বোকেন বাড়ি যেতে যেতে বলল, বিকেলে এসো কিন্তু। দুজনে পাঁপড় খাব।
সেদিন বোকেন আর আসে নি। হয়ত শরীর খারাপ হয়েছে। পরের দিন বিকেলে দেখি একটি মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর মেয়েটি আপন মনে বাঁশী বাজাচ্ছে। একটু পরে সে কিছুটা দূরে বসে চোখ বুঝে বাঁশী শুনছে। আমার ডাকে ধ্যান ভাঙল । তকিয়ে বলল, কী দারুন বাজায় মেয়েটি। শুনেছ কখনো?
-শুনেছি। ভগবানের দেওয়া গুন। খুব ছোটবেলা থেকে বাজায়। এবার মেলায় এসেছে।
কী নাম মেয়েটির?
নাহিদা।
নাহিদার সামনে একটা কাপড় পাতা, সেখানেই যে যার মত করে পয়সা ফেলছে। বোকেন পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট দিয়ে বলল, তুমি রোজ আসো?
নাহিদা মাথা নেড়ে বলল, আসি। বিকেলের দিকে।
সকালে আসতে পারে না নাহিদা। বুড়ো বাবার খাবার করতে হয়, তাকে চান করিয়ে দিতে হয়, গোয়ালে জাবনা দিতে হয়, মুরগিগুলোকে খোল দিতে হয়। এমনি সব কাজ সারা সকাল । তারপর তার ভিতর ভর করে সুর। সে একমনে বাজাতে থাকে পুকুর পাড়ে বসে। কখন জমির আলে বসে। পেয়ারা গাছের ডালে বসে। আমি অনেক দিন দেখেছি।
কেউ তাকে বাঁশী শেখানোর নেই। হাটবসন্তপুরের প্রবেশের মুখে এক ছোট জনপদে নাহিদাদের ক’ ঘর বাস । তাদের লোকের জমি ভাগে চাষ করে দিন যায়। দু’বেলা পেটের ভাত জোটে,। তাদের মধ্যে এই বাঁশী বাজানো কেউই ভালো চোখে দেখে না। পাড়ার মোড়লরা অনেক বার তার বাবা কে বলেছে, মেয়েকে এই সব না করে ঘর কন্নায় মন দিতে বল। বাবা শামসের ও অনেক বুঝিয়েছে নাহিদা কে। বোঝেনি সে। সে কেবল লোকের কথা শুনেছে। কোন কথার উত্তর দেয় নি। মা মারা গেছে সে অনেক কাল। তাই তার পৃথিবীটা সে নিজের মত করে সাজিয়ে নিয়েছে বলেই বাঁশী তার নিত্য সঙ্গি। সে যেখানেই যায়, বাঁশী তাঁর সঙ্গে থাকে। কোনদিন সে পয়সার জন্য বাঁশী বাজায়নি। এবার করেছে, কারণ শামসেরের চিকিৎসার খরচ বাড়ছে। হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে শামসের কে ডাক্তার দেখানোর সময় টের পেয়েছে নাহিদা। অনেক ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়।
দশ টাকা দেখে ডাগর চোখে তাকাল নাহিদা। দু হাত জুড়ে নমস্কার করল। তারপর বলল, আপনি জমিদারবাবুর ছেলে?
বোকেন বলল, হাঁ। কেন বলত?
-না। এত টাকা দিলেন। সহজে তো কেউ এত টাকা দেয় না। আপনার ভালো হবে। বলে আবার বাঁশী তে ফুঁ দিল নাহিদা। বোকেন আমার দিকে তাকাল একবার। কথা বলল না। আমি বুঝতে পারি বোকেনের এই কথাটা পরিহাসের মত ঠেকেছে। আমরা মেলায় ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে তেলেভাজার দোকানে এসে দাঁড়ালাম।
তেলেভাজার দোকানের বিশেষ আকর্ষণ আলুর চপ। চপের মধ্যে এক ফলা নারকোলের ছিলা চপ কে এত মুখোরোচক করে যে থালায় পড়তে পারে না। একটা উনুনে ভেজে শেষ করতে পারে না পবন। বোকেন কে দেখে পবন বলল, দাদাবাবু এবার তোমার জন্য ডবল ডিমের চপ করেছি। আগের বারে বলেছিলে না? ডিমের ডেভিল খাবে?
বোকেন বলল, বলেছিলাম নাকি? হবে বা। তা তাতে কি আছে?
খেয়েই দেখ না দাদাবাবু। রোজ খেতে ইচ্ছে করবে।
আমি বললাম,তুমি চপ খেলে রাতে আর কিচ্ছু খেতে পারবে না। এক একটা চপ বোমার মত। তোমার আবার শরীর খারাপ না?
-তা ঠিক। তবে কত দিন আর বাঁচব? খেয়ে নিই। না খেয়ে মরার কোন মানেই হয় না।
কথাটা ভালো লাগল না আমার। বললাম, আরে কী আজে বাজে বকছো? আচ্ছা খেতে চাইলে খাও। আমি একটু ঘুরে আসি।
ফিরে এসে দেখি বোকেন সেখানে নেই। পবন বলল, দুটো চপ নিয়ে নাহিদার কাছে গেছে।
নাহিদার কাছে?
আমি দুর থেকে দেখলাম নাহিদার কাছে বোকেন দাঁড়িয়ে । নাহিদা কে সাধাসাধি করছে চপ খেতে। নাহিদা খাচ্ছে না। আমি গিয়ে পৌঁছতেই নাহিদা বলল, দাদাবাবুকে বোঝাও তো। আমি চপ খেলে বাঁশী বাজাতে পারব না। আমার কাজ তো এখন বাঁশী বাজান। না বাজালে কে পয়সা দেবে?
আমি একটু পাশে ডেকে বোকেন কে বোঝালাম। বললাম, এখন নাই বা খাওয়ালে?
বিষন্ন হল বোকেন। তারপর বলল আমি বলেছি ওকে, ওর বাঁশী বাজানো এত সুন্দর, আমি ওকে কলকাতায় নিয়ে যাব। আমার গানের মাস্টার রেডিওতে গান করে। ওখানে অডিশন দেওয়াব। ও খুব বড় শিল্পী হবে।ওকে ভিক্ষে করতে হবে না।
সব বুঝলাম। কিন্তু সে তো একদিনের কথা নয়। রাজ রাজেশ্বরী পুজোটা শেষ হোক। তারপর ওকে ডেকে কথা বলা যাবে। বলে আমি কিছুটা সান্তনা দিলাম বোকেন কে।
বোকেন মাথা নাড়ল। মুখে কিছু বলল না। আমরা সে দিন মেলায় অনেক রাত অব্দি ঘুরেছি, নানান মুখোরোচক খাবার খেয়েছি। রাতে সিরাজদুৌল্লা যাত্রা দেখেছি। সিরাজের কিশোর বয়সের চরিত্রটা তেমন ফুটিয়ে তুলতে পারে নি পরেশ। তাই বোকেন বাড়ি যাবার সময় বলল, পরের বার এমন রোল থাকলে আমি করব। বলে রেখো গ্রামের যাত্রা পাটিকে।
রাজ রাজেশ্বরী পুজো শেষ । এবার যে যার গন্তবে ফেরার পালা। সমরেশ মুকুজ্জে সপরিবারে ফিরে যাবে কলকাতা। আমি যাবার আগের দিন বোকেনের বাড়িতে ঢোকার সময় কানে এল ভিতরে তুমুল চ্যাঁচামেচি। সমরেশ মুকুজ্জে বলছে, না, তুমি যেটা চাইবে, তা হবে না।
বোকেনের গলা। কেন হবে না? আমি তো কোন অন্যায় কথা বলছি না।
-তুমি যেটা বলছ সেটা সম্ভব নয়।
-কেন সম্ভব নয়? যার প্রতিভা আছে সে কেন পরে থাকবে এই গন্ডগ্রামে?
-এটা গন্ডগ্রাম নয়। এখানে মেয়েটার অনেক দায়িত্ব আছে। সে একা গিয়ে থাকতে পারবে না। ওর বাবা আছে। আবার ফিরিয়ে দিয়ে যেতে হবে। কে নেবে সেই সব ঝামেলা?
বোকেনের মায়ের গলা, ছেলে হলে কথা ছিল, মেয়ে । কোথায় কী হয়ে যায়। ওর বাবাকে কে দেখবে?
-সে ব্যবস্থা করে তবেই নিয়ে যাব। বোকেনের ঝাঁঝাল গলা।
বোকেনের মার এবার নীচু গলা, আমাদের বাড়িতে রাখা যাবে কী করে? ওর তো ধর্ম আলাদা।
এবার বোকেন বলল, মা, ও যেটা বাজায় সেটা সুর। তার সঙ্গে ধর্মের কোন যোগ নেই।
এবার আমার বুঝতে অসুবিধা হল না, মেয়েটি নাহিদা।
কিন্তু তাকে নিয়ে বোকেনের ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানাতে নাহিদা এক কথায় নাকচ করে বলল, না। আব্বাকে ফেলে যেতে পারব না। দাদা।
জবা
কী নাম তোর?
জবা।
কে আছে বাড়িতে?
মা, বাবা আর ভাই।
এই দুপুরে তুই এখানে কী করিস?
শামুক কুড়ুই।
শামুক নিয়ে কী করিস?
দ্বারবাসিনির হাটে বিক্রি করি। বলে জবা হরিণের মত ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল, তা তোমার এত জানার কী আছে? তুমি কে?
আমি কে সেটা তোর না জানলেও চলবে। তুই একা একা দুপুর রোদে ক্যানেলের পাড়ে শামুক খুঁজে বেড়াস, বাড়িতে কিছু বলে না?
সে জেনে তোমার কী?
এবার উঠে দাঁড়াল জবা। গাছ কোমর করে আঁচলটা বেঁধে এগিয়ে এল মনিকান্তর দিকে। হাতে হেঁসোর মত একটা যন্ত্র। সেই দিয়ে সে ক্যানেলের গায়ে আঁচড় কেটে শামুক খোঁজে।
শামুকের গায়ে লাগলে টক করে শব্দ হয়। তারপর শামুকের চারপাশের মাটি সরিয়ে আস্ত শামুককে বের করে জবা। বড় শামুক তিন চারটে হলেই সপ্তাহের হাটের খরচাটা উঠে আসে। তাই এখানে সে কাউকে ঢুকতে দেয় না। গ্রামের উত্তর দিকের ক্যানেলের পাড় তার। এখানে কাউকে দেখলে রক্তে আগুন নেচে ওঠে। বর্ষার পর ক্যানেল শুকিয়ে গেলে শামুকরা পাড়ের মাটিতে লুকিয়ে পড়ে। জবা শীত কাল অব্দি শামুক খোঁড়ে। এবার জিজ্ঞেস করল, কী নাম তোমার?
-রাজীব।
-কোন বাড়ি?
-মুকুজ্জে বাড়ি।
-বেড়াতে এয়েছো?
-না। আমি কলকাতায় থাকি। ছুটিতে এসেছি। আমাদের জমি দেখতে এসেছি।
-হুম। তুমাদের তো অনেক জমি?
-ক্যানেলের যেখানে তুমি শামুক খুঁড়ছো তার পারেই তো আমাদের টানা পাঁচটা কলমা ধানের জমি।
-জানি। এত জমি কি করবে?
-মানে? মানে আর কী? বলছি এত জমি নিয়ে কী করবে? চাষ তো ঠিক থাক করতি পার না।
প্রসঙ্গ বদলে রাজীব জিজ্ঞেস করে, তুমি ইস্কুল যাও না কেন?
-যেতে তো চাই। কিন্তু সেটা অনেক দূরে। রাস্তার দু’পাশে ঘন জঙ্গল, বাঁশ বন, বিলের ধারের খাড়ি। যাওয়া খুব সুবিধের নয়। ভয় হয়।
ধীরে ধীরে ক্যানালের রাস্তা ধরে এগিয়ে যায় রাজীব। এখানে কথা না বাড়ানো ভাল। কী কথা থেকে কী কথা বেড়িয়ে পড়বে। কে জানে? গ্রামের হাওয়াতেও প্রতি নিয়ত কথা চালচালি হয়।
পরের দু দিন রাজীব আর ওই মাঠের দিকে পা বাড়াল না। জবা লক্ষ রেখেছে। দেখা হলেই কথা সে বলবেই। ক্যানেলের জল কম। বর্ষায় জল থাকে কানায় কানায়। বাঁধ থেকে জল ছেড়ে দু কুল ভাসিয়ে দেয়। তখন এই উত্তরের মাঠ জলে তক তক করে। মাঠে মঠে চাষের সময়। জলের ভিতর গাছের চারা বসিয়ে দিয়ে কোমড় ফেটে যায় দিনের শেষে। বুড়ো মা কে সে বলে কোমড়ে মালিশ করে দে মা। ব্যাথা টা চাগাড় দিছে ।
কদিন পর রাজীব কে দেখতে পেল জবা। মাঠের পারে এসে অনেকক্ষণ তাকিয়ে আছে । একবার জবার দিকে তাকাতেই জবা বলল, এত দিন কোথায় ছিলে?
রাজীবের মনে হল মেয়েটা কী বেহায়া, যেচে যেচে কথা বলছে। আবার বোধ হয় কিছু একটা বলে বসবে । ভালো লাগবে না তার। সে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রইল। জবা এবার বলল, তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা ছিল। শুনবে?
রাজীব মুখ ঘুড়িয়ে বলল, কী?
তুমাদের জায়গাটায় আমাদের মেয়েদের একটা ইস্কুল করে দাও না। তুমাদের তো অনেক জমি। এ গায়ে মেয়েদের ইস্কুল লাই।
অবাক হয়ে তাকাল রাজীব। বলল, কী আবল তাবল বলছ?
আবল তাবল বলব কেন গো? আমাদের গায়ে মেয়েদের ইস্কুল লাই তুমি জান না? অনেকে ইস্কুলে যেতে চায় কিন্তু অনেক বিপদ।
এখানে ইস্কুল করলে কী সুবিধা শুনি।
জবা যেন আশ্বাসের সুর শুনতে পেল । উৎসাহিত হয়ে বলল, এই দেখ ক্যানেল চলে গেছে উত্তরে, দক্ষিনে, পুবে। প্রতিটি গ্রামের পাশ দিয়ে গেছে এই ক্যানেল। ক্যানেলের পার দিয়ে পায়ে হাঁটা রাস্তা সারা বছর ঠিক থাকে। চারিদিকের গ্রামের মেয়েরা এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসবে। কিছু হলে কেউ না কেউ দেখতে পাবে। কোথাও কোন আড়াল নেই। কেউ আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে না। আমার খুব ইস্কুলে যেতে ইচ্ছে করে।
বলে ক্যানেলের পাড়ের মাটিতে সে কোপ বসায়। কোথায় যেন কট করে শব্দ হয়। মনে হয় আছে শামুক আছে। তার চার পাশ থেকে চাগাড় দিলে ঠিক বেরিয়ে আসবে। আসলে খোঁজাটাই আসল। তার পর খোলা থেকে শামুক এমনি বেড়িয়ে আসবে। পড়ে থাকবে খোলা।
রাজীব তাকিয়ে থাকে জবার দিকে। মেয়েদের জন্য এমনি উন্মুক্ত ইস্কুলের রাস্তা যদি সারা পৃথিবী তে হতো তাহলে মেয়েরা কত নিরাপদ থাকত । প্রতিদিন মেয়েদের উপর নানা নির্যাতন হয়ত জবা জানে না, সে খবরের কাগজ পড়তে পারে না, তাদের বাড়িতে টেলিভিসন নেই। রেডিও হয়ত গ্রামে কদাচিত বাজে। লোক মুখের কথাতেই তাদের ভরসা। তার বাড়িতে কে আছে রাজীব জানে না তবে জবা যে সাহসী, প্রান্তিক গ্রামের দরিদ্র পরিবারের এক কায়িক শ্রমিক, তাতে তার সন্ধেহ নেই । এমন একজন শামুক কুড়ানীর মাথায় একটি উন্মুক্ত ইস্কুলের পরিকল্পনা কী ভাবে আসে তাই সে নির্ণয় করতে পারে না। জবাকে দেবার মত কোন উত্তর মাথায় আসে না রাজীবের।
পলাশ
মাদ্রাজের কোডাম্বাক্কম এলাকায় ফতিমা কনভেন্টের উল্টোদিকের আকাশ এপার্ট্মেন্টে আমার বাড়ির একটু দূরে সে একটি ঘর নিয়ে থাকে। আমার সঙ্গে একদিন হঠাৎই আলাপ। ভিতরের রাস্তায় মুদির দোকানে সে চাল কিনছিল। তার ইংরাজী শুনে তার দিকে তাকাতেই জিজ্ঞাসা করলাম, বাঙ্গালী নাকি?
-হ্যাঁ, আমি পলাশ।
-ওদিকে কোথায় বাড়ি?
-দক্ষিনেশ্বরে। মাদ্রাজের এই পাড়ায় প্রায় চার বছর। আপনি?
-সবে এসেছি। বছর খানেক হল।
-পড়তে এসেছো?
-না। আমি চেলো বাজাই। ইল্লাইয়া রাজার নাম শুনেছেন?
– ওনার নাম কে না জানে? বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক।
-আমি ওনার টিমে চেলো বাজাই। ওনার মিউজিসিয়ান। আর কিছু করি না। তাতেই দিন শেষ।
-মানে? চাকরি কর না?
-না। ওনার গান তো তিন শিফটে রেকর্ডিং হয়। আমি কোন দিন মর্নিং আর ইভনিং শিফট করি। আবার কখনো দুপর ও রাতে কাজ করি।
তুমি চেলো শিখলে কী করে?
-কোলকাতায় শিখেছি। আপনার কলকাতায় কোথায় বাড়ি?
-গড়িয়ায়।
আলাাপ করে খুব ভালো লাগল। বলে পলাশ চলে গেল।
পলাশকে দেখে কে বলবে সে কোলকাতা থেকে ইল্লাইয়া রাজার সঙ্গে কাজ করে? সপ্রতিভ, গোল মুখ মন্ডল, কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, গায়ের রঙ কালো। চিবুকে একটা হালকা কাটা দাগ আছে যেটা মুখের সৌন্দর্য্য অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। বেশ লাগল। তারপর থেকে আমার সংগে তার মাঝে মাঝে দেখা হয়।
বছর পাঁচেক আগে সুদূর মাদ্রাজ থেকে এক দম্পতি এসেছিলেন দক্ষিনেশ্বরের কালী মন্দির দর্শনে। তারা যে বাড়িতে দিন পনেরো ছিলেন তাদের পাশেই পলাশদের দু’কামড়ার বাড়ি। একদিন পলাশের চেলো শুনে তিনি পলাশের বাবার সঙ্গে দেখা করেন। বলেন, আপনি ছেলেকে মাদ্রাজ পাঠান। আমার পরিচিত এক সঙ্গিত পরিচালক আছে। সেখানে বাজাবে। রোজগারও হবে আর থাকতেও পারবে। ভবিষ্যত তৈরী হয় যাবে। পলাশের বাবা ও মা রাজী হন নি। বলেছিলেন আমাদের দু সন্তান। মেয়ে বড়, বিয়ে হয়ে যাবে। তারপর ছেলে । পলাশ শোনেনি। সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে চলে এসেছিল । তিনি পলাশ কে নিয়ে গিয়েছিলেন ইল্লাইয়া রাজার কাছে। সারা দেশ তাকে এক নামে চেনে। দক্ষিনের চলচ্চিত্র জগতে তিনি এক ও একছত্র সঙ্গিত পরিচালক। প্রথম দিন তাঁর বাজনা শুনে ইল্লাইয়া রাজা তাকে নিজের দলে নিয়ে ছিলেন। সেই দিনটা পলাশের মনে আছে। সকালে স্নান সেরে, শুভ্র বসনে স্টুডিয়োতে প্রবেশ করেই ডেকে ছিলেন পলাশকে। তারপর বলেছিলেন, বাজাও। পলাশ সে দিন নিজেকে উজাড় করে বাজিয়ে ছিল রাগ ভৈরবী। দু চোখ বুজে শুনেছিলেন তিনি। তারপর বলেছিলেন কাল থেকে চলে আসবে। প্রতি শিফট এ দুশো টাকা পাবে। কাজের কোন শেষ নেই। তোমার ভালো লাগবে। সেই শুরু।
অনেক দিন হল সে বাড়ি যায় নি। মাস তিনেক পরে এই কোডাম্বাক্কম কলোনিতে সে বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। পলাশ খুবই দরিদ্র ঘরের সন্তান। বাবা একটি সোনার দোকানে কারিগর, মা সেলাই ইস্কুলে সেলাই শেখায় ও সেলাই করে । এহেন সংসারে চেলো বাজানোর জন্য পলাশের জন্ম এক অভাবনীয় ঘটনা। মনে নেই, এখন আর মনে নেই কে তাকে পাড়ার ফনী বাবুর কাছে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানেই চেলো বাজানোর হাতে খড়ি পলাশের। খুব বেশী পড়াশোনা করতে পারে নি । বাবার দোকানের মালিক কে বলে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। দু দিন পরে আর সে মুখো হয় নি। বাবা কে বলেছিল, আমি এই কাজ করতে পারব না। বলে সে আবার চেলো বাজানোর পথে ফিরে এসেছিল।
আমার এক মাত্র পুত্রর বয়স তখন দু বছর। পলাশ মাঝে মাঝেই চলে আসত আমদের বাড়ি।
একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, কীরে বাড়ি যাবি না?
একগাল হেসে বলল, না, বাবা মা আসছে সামনের মাসে। খুব উত্তেজিত লাগছে। এলে তোমাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। বলে সে আমার ছেলের সঙ্গে খেলতে লাগল।
আমি তার খেলার ব্যাপারটা লক্ষ করছিলাম। সে আমার ছেলেকে ডার্ট দিয়ে একটা বিন্দুর উপর টিপ করে মারতে শেখাচ্ছিল। ডার্ট টি বার বার সেই বিন্দুর আশে পাশে লাগছিল, পলাশ তাকে দেখিয়ে দিচ্ছিল কি করে ঠিক গোল লাল বিন্দুটিতে মারতে হয়। সে বার বার মুখে বলছিল, ঠিক ওই জায়গাটা ফোকাস কর বাবাই।
আমার ছেলে ফোকাস কাকে বলে জানে না। সে একটি ডার্ট ছুঁড়ে তাকাল আমার দিকে। আমি ছেলে কে বললাম পলাশ কাকার কাছে ভাল করে শেখো। আর সেই সময় আমার প্রিয় ফিজিক্সের মাস্টার চন্দ্রবিন্দু স্যারের কথা মনে পড়ল। একদিন লেন্স পড়াতে পড়াতে একটা প্রিজম আর একটা হলুদ পোস্ট কার্ড নিয়ে ক্লাসের বাইরে এসে ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন আমাদের। প্রিজম টি রোদের সামনে ধরে পোস্টকার্ড টি নীচ থেকে আস্তে আস্তে উপরে তুলে আনতে লাগলেন। আমাদের বলেছিলেন পোস্টকার্ডটিকে লক্ষ রাখতে। আমরা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ দেখি কার্ডটিতে আগুন । স্যার বলেছিলেন, যে জায়গায় এই আগুন জ্বলছে সেটাকে বলে ফোকাল পয়েন্ট আর প্রিজম থেকে এই ফোকাল পয়েন্টের দুরত্ত্বকে বলে ফোকাল লেংন্থ। আমদের আর কোনদিন ভূল হয় নি। কিন্তু তারপর চন্দ্রবিন্দু স্যার বলেছিলেন, জীবনে বড় হতে গেলে এই ফোকাসটা ঠিক করতে হয়। করলে সেখানে সৃষ্টির আগুন জ্বালানো সম্ভব।
আমি পলাশের মধ্যে সেই ফোকাস প্রশিক্ষনের ঝলক দেখতে পেলাম। জিজ্ঞসা করলাম , কত দূর পড়াশোনা করেছিস।
পলাশ বলল, হায়ার সেকেন্ডারি। তারপর চলে এসেছি। আমি আর পড়ব না। আমি স্পোকেন ইংলিশ এর ক্লাস করি। এটা খুব দরকার।
-কেন?
– সে একদিন বলব, বলে সে চলে গেল। তার শিফটের সময় ।
আমাকে মঝে মাঝেই ট্যুরে যেতে হয় দক্ষিনের চারটি প্রদেশের বিভিন্ন শহরে । অলকা একাই থাকে বাবাই কে নিয়ে। পাড়াটা পরিচ্ছন্ন, নতুন এপার্ট্মেন্ট উঠেছে পাশপাশি অনেক। মাদ্রাজের বাইরের অনেক পরিবার এখানে ফ্ল্যাট কিনেছে। শহরের খুব কাছেকাছি অথচ শহরের ভিড় নেই এমন একটি নির্মল বসতি মাদ্রাজের মধ্যে সহজে চোখে পড়ে না। কাছেই টি-নগর, মেরিনা বিচ খুব দূরে নয়। ভাল্লুভর কোট্ট্যায়াম দু হাত দূরে। প্রাচীন বেঙ্গলী ক্লাব মাত্র দশ মিনিটের পথ। এই অঞ্চলের মানুষরা সরল, অনারাম্বড় ও শিক্ষিত। ইঞ্জিনীয়ার ও ডাক্তারের ছড়াছড়ি । আর দেখার মত প্রায় প্রতিপাড়ায় একাধিক মদের দোকান । দেশী মদ বা কান্ট্রি লিকার সদা পাউচে বিক্রি হয়। অলকা একদিন ট্যুর থেকে ফিরলে বলল, কদিন আগে পলাশ এসেছিল। দেখলাম মন খুব খারাপ। ইল্লাই রাজার ওখানে কিছু গোলমাল হয়েছে। বলল, কাজ ছেড়ে দিয়েছি।
আমি বললাম, কেন? সে কী? এত ভাল সুযোগ ছেড়ে দিল? এই ত শুনলাম ওর মা বাবা আসবে?
অলকা বলল, আমিও তো তাই জানতাম। এই খবরটা শুনে আমি আর জিজ্ঞেস করার সাহস পাইনি।
-আবার অবে আসবে কিছু বলেছে?
-না। কবে বলেনি। তবে আসবে বলেছে।
আমি অপেক্ষায় আছি। মাঝে মাঝে মনে পরে তার কথা। আমি তার বাড়ি চিনি না। চিনলে গিয়ে খবর নিতাম। বিদেশ বিভূয়ে নিজেদেরই তো নিজেদের খবর রাখতে হয়।
একদিন অফিস বেরোব। দেখি পলাশ একটা সাইকেল নিয়ে আমাদের বাড়ির দিকে আসছে। আমাকে দেখেই বলল, দাদা, আজ সন্ধ্যে বেলা থাকবেন তো?
থাকব। বলে আমি অফিস চলে যাই। ফোনে অলকা কে বলি পলাশ আজ আসতে পারে, বসিয়ে রেখো। আমার একটু দেরী হতে পারে।
আমার আর মনে থাকে না যে পলাশ আসবে। যেমন হয়, দেরী হয়েছে ফিরতে। অলকা বাড়ি ঢুকতেই বলল, পলাশ কখন থেকে তোমার জন্য বসে আছে।
আমি বললাম, কই?
-ছেলের সঙ্গে খেলছে।
দেখি ভিতরের ঘরে বাবাই এর সঙ্গে খেলছে পলাশ। আমাকে দেখেই উঠে বসল। বলল, দাদা, খবর আছে। আমি আমেরিকা ট্যুরে যাচ্ছি। বলে এক গাল হাসি।
-ট্যুরে যাচ্ছিস মানে?
ইল্লাই রাজার কাজ ছেড়ে দিয়েছি। আমি এ আর রহমানের টিমে জয়েন করেছি। বলিনি বউদিকে। দুজন কে একসঙ্গে বলব বলে। এবার বললাম। টিকিট ও ভিসা সব হয়ে গেছে। চার মাসের ট্যুর । তার পর এসে রহমান সাহেবের কাছেই থাকব।
আমি অবাক হয়ে পলাশের দিকে তাকাই আর চন্দ্রবিন্দু স্যারের কথাটা মনে হয়। ফোকাস ঠিক করতে পারলে সেখানে আগুন ও জ্বালানো যায়। কোথাকার দক্ষিনেশ্বরের পলাশ এবার আর এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছবে কে জানে? আমি বুঝতে পারছিলাম স্পোকেন ইংলিশ কেন জরুরী ছিল তার কাছে।
আমি তাকে অভিনন্দন জানাতে দু চোখ তার চিকচিক করে উঠল।
শিব
চৌরঙ্গি রোডের উপর এভারেস্ট হাউসে নোসিল কোম্পানির অফিসে ইন্ডিয়ান প্লাস্টিক এসোসিয়েশানের উদ্যোগে শনিবার করে প্লাস্টিক টেকনোলজি ক্লাস হত। শনিবার ছুটির দিন। বিভিন্ন প্লাস্টিক কোম্পানি থেকে তাদের বড় সাহেবেরা এসে ক্লাস নিতেন। বিখ্যাত কোম্পানি যেমন আই সি আই, আংলিয়া প্লাস্টিক, এমন কোম্পানির কারখানার টেকনোক্রাটরাও ক্লাস নিতেন। উদ্দেশ্য ছিল কলকাতায় প্লাস্টিক কারখানায় দক্ষ কর্মচারি যোগান দেওয়া। কোন টাকা লাগত না। বিনা মুল্যে ট্রেনিং পেয়ে গেলে কেই বা ছাড়ে। আমি ও যোগ দিলাম। চারিদিকে চাকরির হাহাকার তখন । এই সময় বিনা খরচায় শিক্ষানবিশী। তারপর দেশের বিখ্যাত কোম্পানির অফিসে। কে জানে কোথায় বিড়ালের শিকে ছিঁড়ে?
রাজস্থানের বিকানীর থেকে সদ্য কোলকাতায় এসেছে শিব। মাথায় এক মাথা ঝাকড়া চুল, নাক তা ছোট, সারে পাঁচ ফুত লম্বা, সপ্রতিভ শিবের সঙ্গে দেখা লিফটে। লিফটের বোতাম টিপতে দেখেই আমাকে প্রশ্ন করল, আপনি নয় তলায়?
আমি ঘাড় নারলাম। শিব হাত বাড়িয়ে নিজের নাম বলল,। তার পর যেটা বলল, তাতে আমি চমকে উঠি। বলল, আমি বীটস পিলানী থেকে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার।
আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি কিচুক্ষণ। বিটস পিলানী? তা এখানে কী করতে?
–ট্রেইনিং নিতে?
–চাকরি পাওনি? তোমাদের তো বাজারে দারুণ ডিমান্ড। হাত বাড়ালেই চাকরি। কেউ বিটস এ জইন করলে মেয়ের বাবারা তাক করে থাকে। কবে পাশ করে বেরবে। তারপর ।
একগাল নির্মল হাসি হাসল শিব। বলল, না। চেষ্টাই করি নি। আমি ওই পথের লোক নয়।
সেই আলাপ। তার পর ক্লাসে সে আমার পাশেই বসত। দেখতাম ভীষন মন দিয়ে ক্লাস করে। ইঞ্জিনিয়ার তাই টেকনিকাল প্রশ্ন করলে শিক্ষকদের মাঝে মাঝে ভিরমি খেতে দেখি। ফলে অল্পদিনের মধ্যে শিব কে সবার চোখে পরে গেল। প্রোগ্রাম ম্যানেজার দেখা হলেই শিবকে কেমন খাতির করে বলত, শিব, তোমার কোন অসুবিধা হলে আমাকে ফোন কর। আমাদের তিনি খুব একটা হিসেবের খাতায় ধরতেন না। আমার স্থির বিশ্বাস শিব একদিন যে কোন প্লাস্টিক কারখানার সর্বচ্চ পদে চাকরি করবে। তাকে আটকে রাখার কেউ নেই।
আর একটা গুণ ছিল শিবের। সে সবার সঙ্গে মিশে যেতে পারত অনায়াসে। সে ছেলেই হোক আর মেয়েই হোক। ছয় মাসের হপ্তান্তের ক্লাস, তার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতাম সারা সপ্তাহ। তখন প্লাস্টিক এক নতুন বস্তু। কি না হয় তাতে? বেলুন, নল, বালতি, মগ, ঢাকা, ত্রিপল, ফিল্ম, বাদ্য, যন্ত্রপাতি,। লোকের ধারণা হয়ে ছিল লোহা লক্কর, স্টিল, পাট এর সব ভাত মেরে দেবে দু এক বছরেই। এই বস্তুটির ভবিষ্যত পারদ উজ্জ্বল।
পড়তে পড়তে এটা বুঝতে পারছিলাম এই বস্তুটি কোন আম, জাম নারকেলের মত বস্তু নয়। এর নানা ধরন আছে। নানা ধরণ নানার কাজে ব্যবহার হয়। আবার তৈরি জিনিস পুরনো হলে গলিয়ে আবার কিছু নতুন জিনিস করা যায়। ফলে ব্যবহারও অনেক বিস্তৃত। ফলে লোকের প্রয়োজন হবে একথার অপেক্ষা থাকে না।
শিব মারোয়ারি হলেও অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে নয়। সে কথা সে অকপটে স্বীকার করেছে। পড়াশোনা করেছে স্কলারশিপের সাহায্যে। মেধাবী ছাত্র ছিল তাই তার পড়ার চাপ তার পরিবারকে বইতে হয় নি। এ জন্য সে ভগবানের নাম করে। সে বলত সে ভগবানের কৃপাধন্য। ফলে সে যে শিব ভক্ত হবে এতে আর অবাক হবার কী আছে?
বাঙালি হয়েও যে বাঙ্গালিদের চিনতে সারা জীবন লেগে যায় সে প্রায় সব বাঙালি মাত্রই জানে। আমি এই মারোয়ারি সম্প্রদায়ের কথা খুব বেশি জানি না। আমাদের যেমন কয়েকশো পদবি আছে তাদের তেমন নেই। এমনি একটা ধারনা ছিল। আগর্বাল তা তেমনি একটা। একদিন শিবকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার এখানে কে থাকে?
শিব বলল, কেউ নেই। আমার কোন আত্মীয় স্বজন নেই কলকাতায়।
–কার ভরসায় এখানে চলে এলে সেই বিকানির থেকে?
শিব বলল, নেই ত কী হয়েছে। মারোয়ারি সমাজ তো আছে। তারাই সব। তারাই আমাদের আত্মীয়, বন্ধু, গাইড।
–মানে?
–মানে আমি মারোয়ারি জানাতেই তারাই সব থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
–তাই নাকি?
— হান, আমি তাদের হোস্টেলে থাকি, আমার কোন খরচা লাগে না। আমার মতন অনেকে আছে। নানান কাজে আছে। তারা পরে রোজগার করলে তারাই আবার খেপে খেপে টাকা শোধ দেয়, সাহায্য করে।
–বেশ ভাল সিস্টেম তো?
–আজকের নাকি। কতও দিন থেকে চলে আসছে। প্রথম যারা রাজস্থান থেকে কলকাতায় ব্যাবসা করতে এসেছিল তারা করেছে। দারুণ সিস্টেম। তাই আমার কোন টেনসান নেই।
আমি অবাক হয়ে ভাবতাম আমাদের রাজ্য, আমদের শহর কলকাতায় এমন কী বাঙ্গালীদের প্রতিষ্ঠান আছে? কোন ব্যবস্থা নেই কেন? কেউ কী ভাবেনি একদিন গ্রাম গঞ্জ থেকে গরীব মেধাবী ছাত্ররা কলকাতার বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়তে এলে তারা কোথায় থাকবে? বা তার মতন কেউ দুবেলা খাবার এর টেনসান না নিয়ে উজ্জ্বল জীবন বুন্তে পারে? তাঁর ব্যবস্থা!
না বোধ হয় ভাবেনি। তার হয়ত অন্যতম কারন এই সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের দেশ ছেড়ে অন্য রাজ্যে বাস করতে এসেছিল। তাই স্বজাতি টান তাদের রক্তে মিশে ছিল।
একদিন শিব ক্লাসে এল না। এমন হয় নি আগে? সে কামাই করার ছেলে নয়। তবু সে না আসতে পরের শনিবার প্রশ্ন করলাম, কি ব্যাপার? শরীর খারপ ছিল নাকী?
–না। ত? শরীর ঠিক আছে।
–তাহলে এব্যসেন্ট?
–ওহো! ওইদিন আমাদের সমিতিতে আমার ইনটারভিউ ছিল।
— কিসের? চাকরির?
একগাল হেসে শিব বলল, আরে না না। চাকরির হবে কেন? আমি একটা ব্যবসার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সে টা নিয়েই কথা হল, কিসের ব্যবসা, কি ভাবে করব, কি কি চাই, লাভ কত হতে পারে, কবে থেকে শুরু করব? এসব আর কী।
আমি অবাক হয়ে শিব কে প্রশ্ন করি, তুমি পিলানির ছাত্র, প্লাস্টিক টেকনোলজি ট্রেন্ড, তুমি এই বয়সে ব্যবসা করবে?
–এটাই তো ব্যবসার বয়স ব্রো। বলে প্রবল আস্থার ভঙ্গিমা করল শিব।
আমি বললাম, ব্যবসা করবে টাকা কোথায় ?
–দরকার নেই তো। সমিতি আমাকে সাপোর্ট করবে। পরে ফিরিয়ে দিতে হয় কিস্তিতে কিস্তিতে। কোন প্রব্লেমই নেই।
আমি আরও একবার অবাকের চেয়েও অবাক হলাম।
কোর্স শেষের পর আর শিবের সঙ্গে কোন দিন দেখাই হয় নি। আমি কলকাতার বাইরে চলে গেলাম চাকরির কারণে। দেখা হবার সম্ভবনা রইল না। আমি প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি থেকেও অনেক দুরে চলে গেলাম। থাকলে হয়ত দেখা হত, কোথাও কোন সমাবেশে, সেমিনারে। আচমকা দেখা হতেও পারত। দেখা হলে আমিও শিব কে জড়িয়ে ধরে পুরাণ বন্ধুত্বের নিবু নিবু আগুন অনুভব করতুম। শিব হয় তো বলত, ব্রো কেমন আছো? আল ইস ওয়েল?
অনেক দিন পর কলকাতায় ফিরে কি কাজের জন্য একদিন আর্মেনিয়ান স্ট্রিটে ঢুকেছি, একটা সাইন বোর্ড দেখে থমকে দাঁড়ালাম। “শিব প্লাস্টিক”। সম্পুর্ণ হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির অতল থকে শিবের মুখটা ডলফিনের মত ভেসে উঠল। আমি অবাক হয়ে ভিতরে তাকিয়ে দেখলাম এক বয়স্ক মানুষ বসে আছেন ভিতরে । তাঁর চার পাশে অনেক বস্তা, এক এক বস্তায় এক এক রঙের প্লাস্টিক গুলি। ইংরাজী তে যাকে বলে গ্রানুয়েলস। যেন চারি দিকে নানান রঙের ফুল ফুটে আছে। আমি সন্তর্পণে ভিতরে ঢুকি। ভদ্রলোক আমাকে দেখে সাদরে ভিতরে যাবার আমন্ত্রণ করলেন। আসুন আসুন , দেখুন হাই ডেন্সিটি , লো ডেন্সিটি সব রকমের গ্রানুয়েলস আছে। সব রঙের মাল পাবেন। আমি মুহূর্তে বুঝতে পারি ভদ্রলোক ভুল বুঝেছেন। আমি প্লাস্টিকের গুলি কিনতে আসিনি। তাঁর নরম গলায় জিজ্ঞেস করলাম, এটা কার দোকান?
ভদ্রলোক হঠাৎ সতর্ক হয়ে প্রশ্ন করলেন, কেন বলুন তো? আপনি কোথা থেকে আসছেন?
আমি চটপট তাকে সান্তনা দিয়ে বললাম, না না আমি কোন সরকারি অফিস থেকে আসছে না। এমনি জিজ্ঞেস করলাম।
ভদ্রলোক একবার আমার আপাদ মস্তক দেখে ভিতরের ঘরের দিকে হাত দেখালেন। ঘরের ভিতর দেখি সাদা চুল, মোটা শরীর, , পুরু চশমা চোখে বসে আছেন এক ভদ্রলোক। আমি তাকে দেখে বলে বসে, শিব না?
চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পরে শিব। তার পর এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, হোয়াট এ সারপ্রাইজ? ত্রিশ সাল বাদ!
আমার গলা বুজে আসে। কথা বের হয় না। শিব আমাকে ভুলে যায় নি। এর চেয়ে আনন্দের কথা আর কী হতে পারে?
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি সেই অমলিন হাসি, সহৃদয় কন্ঠ, আর অমায়িক ব্যবহার। আমাকে বসতে বলে প্রশ্ন করল, কি খাবে?
–না না। তুমি ব্যস্ত হয়ো না। আমার খাবার অনেক বিধি নিষেধ আছে।
–তোমার মনে আছে আমি কিছু টাকা ধার করে ব্যবসা করব বলেছিলাম। এই সেই আমার বিজনেস।
— দেখলাম অনেক বস্তা রাখা বাইরে। প্লাস্টিক গুলির। নানান রঙের।
— হ্যাঁ। এটা খুচরো। লোকালে কেজি দরে বিক্রি হয়।
— কেজি দরে। মানে? কেজি দরে কিনে মানুষ কি করে?
— তোমার ধারনা আছে কত জন এই বড়বাজার অঞ্চলে প্লাস্টিকের ডট পেনের বড তৈরি করে?
— না ।
— প্রায় একশ জন। ছোট বড় মিলিয়ে । তারা পেন কোম্পানি কে দেয়। কোম্পানি রিফিল ভরে নাম দিয়ে প্যাক করে বাজারে ছাড়ে।
আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকাই। পিলানির ইঞ্জিনিয়ার বড় বাজারে খুচরো বিক্রেতা?
শিব বলল, খুব কম পুঁজি থেকে শুরু করেছিলাম। আস্তে আস্তে বড় হতে সময় লেগেছে। এ ছাড়া আমার সাপ্পাই আছে নর্থ ইস্ট, উড়িষ্যা, বিহার ,রাঁচী ও পোর্ট ব্লেয়ার। সব ডট পেন প্রস্তুতকারী। বলে সে এক অসীম পরিতৃপ্তির হাসি হাসল। এই হাসি শুধু সাফল্য থেকে আসে না, বিজয়ী হলেই তবে আসে। আমি তো এমন হাসি আমার চাকরি জীবনে কোন দিন হাসতে পারিনি ।
অমিতেশ
ন’তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে কলকাতার দিকে তাকালে পুরো শহরটাকে দেখা যায়। কিন্তু মানুষের বেলায় তা হয় না। সামনাসামনি মানুষের একদিক দেখা যায়। পুরো মানুষ দেখা যায় না। তাই মানুষ চেনা চিরকালেই কঠিন, বেশিরভাগ সময়েই ভূল হয় । মানুষ ও শহর উপর থেকে দেখাই শ্রেয়, এই সবই ভাবছিল অমিতেশ।
কেন এই কথাটা হঠাৎ মনে এল সে টা ঠিক মাথায় এল না। তবে সকালের ঘটনাটাই তাকে ভিতরে ভিতরে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে বার বার। নিজেকে অনেকবার বুঝিয়েছে, শান্ত হও, শান্ত হও। বাড়িতে বউ বাচ্ছা আছে, মায়ের ওষুধ আছে, বিন্টের ইস্কুলের মাইনে আছে। নিজের সিগারেট আছে। এই সব একলপ্তে বন্ধ হবে সেটা কী ঠিক? মন মানছে না। কে যেন ভিতর থেকে বলছে , এই সব কিছুই নয়। এই পৃথিবী বিশাল। মাথা নত করাটা পুরুষের কাজ নয়। হাতে তির আর ধনুক থাকলে হিংস্র বন্য জন্তুকে মারতে দুমিনিট সময় লাগে না। সুযোগ বারবার আসে না। আর সুযোগ হাতছাড়া হলে আবার কোন শতাব্দীতে আসবে তাঁর ঠিক নেই। হতেও পারে আর সারা জীবন নাও আসতে পারে। তাঁর চেয়ে এসেছে যখন লুফে নাও। আবার মনে হচ্ছে সে তো বাগচী সাহেবের এক দিকটা দেখেছে।
যখনই দেখেছে, তাঁর মুখ, চোখ আর মুখমণ্ডল দেখেছে। পুরোটা তো দেখেনি। পুরো লোকটা কি তাহলে তেমন নয়? যদি তাই না হয় তাহলে কে সে? মালিকের লাভ লোকসান হোক আর নাই হোক তার এত মাথা ব্যাথা কিসের? সে কেন তার চাকরির উপর মাঝে মাঝে লাল কালি ছিটিয়ে রক্তাক্ত করে চলেছে?
২)
প্রথমে ইঙ্গিত দিয়েছিল, এভাবে বেশী দিন চলবে না। গত বছরের ফলাফল এমন একটা জাায়ায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে কোম্পানির অনেক অঙ্গ না কাটলে সে আর শ্বাস নিতে পারবে না। কেন পারবে না তার কোন কারণ নেই। কিন্তু পারবে না। সেই ইঙ্গিত বাগচী সাহেব নাকি মালিকের ইঙ্গিতে দেখেছে। তাই তারি নকল করে অমিতেকে যখন ইশারা করে, তখন না শোনার ভান করে ছিল সে। ছাড়তে হলে আপনি ছাড়ুন, আমি কেন? আপনার তো পকেট আমাদের থেকে অনেক ভারী, সেটা আপনি জানেন না? মুখে বলে নি, সেও ইঙ্গিতে বলেছিল। দুজনেই ইঙ্গিতে খেলছিল বেশ কয়েক মাস। তারপর একদিন সে সময়টি এসে হাজির। বাগচি আর না বলে পারল না। বলল, অমিতেশ, আর তিন মাস।
মানে?
–মানে আর তিন মাসের মধ্যে তোমাকে খুঁজে নিতে হবে। ডাউন সাইজ করবে কোম্পানি। শুধু তুমি নও। প্রায় প্রতিটি ব্রাঞ্চ এর উপর কোপ পড়বে। আমার হাত বাঁধা।
অমিতেশ সে দিন কিছু বলে নি। কিন্তু সে তলে তলে খবর পেয়েছে নতুন ছেলে নেবার তোরজোর চলছে। তার অর্ধেক মাইনেতে।
একদিন দরজা ঠেলেই ঘরে ঢুকে এল অমিতেশ।
বাগচী ফাইল থেকে মুখ তুলে প্রশ্ন করল, কী ব্যাপার। আসার আগে নক করতে হয় সেটাও ভুলে গেছো?
কোন উত্তর নেই। বাগচী এবার তার চোখের উপর চোখ রেখে বলল, যা বলার তাড়াতাড়ি বল। সময় নেই।
এবার অমিতেশ যেন দান দেবার সুযোগ পেয়েছে। আপনাকে একটা প্রশ্ন আছে আমার।
–কী?
–আমার সঙ্গে এই চোর পুলিশ খেলাটা কত দিন খেলবেন?
–মানে?
–মানে খুব সহজ। আমাকে চাকরি থেকে ছাঁটিয়ে আপনার নিজের লোককে অল্প পয়সায় নিয়োগ করবেন বলে বড়সাহেব কে কেন বোঝালেন?
–কী যা তা বলছ?
–ঠিক বলেছি না ভুল?
–ভুল।
–না। আপনি মিথ্যে কথা অনর্গল বলতে পারেন আমি জানি। কিন্তু আমার সঙ্গে সেই চেষ্টা করবেন না। ধরা পরে গেছেন।
–না জেনে কথা বলছ।
প্যান্টের পকেটের ভিতর মুঠোটা শক্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসছিল। অমিতেশ সামলে নিল। বাগচীর চেম্বার ছেড়ে বেড়িয়ে এসে নিজের জায়গায় যেতে যেতে ভাবল। এত সহজে বেজী মেরে বাহবা সে নেবে না।
৩)
কোলাঘাটের অদূরে জাতীয় সড়কের পাশে প্রায় দশ একরের উপর ন্যাশান্যাল কেমিক্যালের বিশাল কারখানা। গুড় থেকে মদ বা আলকোহল করার বিশাল ডিস্টিলারি আছে অনেকটা জায়গা জুড়ে। আর মদকে কেমিক্যাল প্রক্রিয়ায় ভেঙে তার অনু থেকে বারো রকমের ভিন্ন ভিন্ন কেমিক্যাল তৈরি। এই কারখানায় কাজ করে প্রায় একশোর উপর মানুষ। বাগচী সেই কোম্পানির পারচেজ ম্যানেজার। চাকরিটি অনেক দিনের। কানের দুপাশ সাদা, নাক টিকল, নাকের উপর গোল্ডেন ফ্রামের চশমা। গায়ের রঙেই তাঁর বয়স লুকিয়ে সে মধ্য চল্লিশের সুপুরুষ। কিন্তু তাঁর মুখ খুব মিষ্টি ও আন্তরিক। প্রায় সকলের সঙ্গে হেসে কথা বলে তাঁর একটি কারণ সে সবাইকে বোঝতে চায়, সে সকলের প্রিয় ও আপন। এ এক পাবলিসিটি স্টান্ট। বাগচী কে না দেখলে বোঝ যাবে না। এক এক সময় সে কাঁচের মত সচ্ছ আবার অন্য সময় সে কাঁকরের মত অমসৃণ। তাঁর এই দ্বৈত সত্তাই তাকে অনেক কাছের ও অনেক দুরের মানুষ করে রাখে।
আড়কাঠি হয়েছে অমিতেশ। সে তাঁর ঘুঘুর বাসাটা আবিস্কার করে ফেলেছিল একদিন। সে দিন কী কারণে অফিস থেকে বেরোতে দেরি। সে যে অপিসে আছে খেয়াল ছিল না বাগচীর। সে ডেকে পাঠিয়েছিল শ্যাম বাগারিয়াকে। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় শ্যামকে অফিস ঢুকতেই সে সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। এত রাতে তো কেউ আসে না অফিসে? শ্যাম বাগচীর ঘরে ঢুকতেই তার ঘরে লাল আলো জ্বলে উঠেছিল। মানে বাগচী বিজি । ডিস্টার্ব করা যাবে না।
অমিতেশ সেটা দেখেই তৈরি হয়ে বেড়িয়ে গেছিল অফিস থেকে যাতে বাগচী তাকে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখতে না পায়। ঠিক তাই হলো। বাগচীর বাইরে এসে দেখল অমিতেশ নেই তার সিটে। চলে গেছে। আপদ গেছে। অমিতেশ অফিস থেকে বেরিয়ে পাশের একটা রেঁস্তোরায় বসে রইল কিচুক্ষণ। তারপর দেখল দুজনে অফিস থেকে বেড়িয়েছে। পিছু নিল অমিতেশ।
কিছু দূরে তারা দু জনে একটা রেঁস্তোরার বসল মুখোমুখি। কাচের ভিতর দিয়ে কিছুটা দূর থেকে ফলো করল অমিতেশ। এক সময় সুইটকেসটা বাগচীর হাতে দিয়ে গাড়িতে উঠে পরল শ্যাম। বাগচী যেন কিছু কিনে রাস্তার ধারে অপেক্ষা করছে। বোঝার যো নেই। সে ড্রাইভার কে ডেকে নিলে মিনিট পাঁচেক পরে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে এসে দাঁড়াল। বাগচী উঠতে যাবে অমিতেশ সামনা সামনি দাঁড়িয়ে বলল, আমাকে একটু লিফট দেবেন স্যার? লেট হয়ে গেছে আজ।
নিরুপায় বাগচী তাকে লিফট দিয়েছিল। কিন্তু অমিতেশ জানে সেদিন বাগচী বুঝে গিয়েছিল যে সে তাকে অনুসরণ করেছে। তার এত রাত অব্দি থাকার কথা না। সামনের সিট বসে ছিল অমিতেশ। পিছনের সিটে বাগচী আর সুটকেস। কাঁচা মালের সাপ্ল্যারের উপহার। মাঝে মাঝে বাগচী সুটকেসের উপর হাত বুলিয়ে নিচ্ছে । আড় চোখে দেখে ছিল অমিতেশ।
সেদিন যে বাগচী সন্ধেহ করেছিল তার লক্ষণ বেশ মনে আছে অমিতেশের। বাগচী তার ঘরে ঘনঘন ডাকা কমিয়ে দিল। কাজ অনেকটাই ভাগ করে দিল বিমলেন্দু নামের বলে এক তরুণ কর্মচারি কে। আর নতুন মালপত্র কেনার জন্য কোটেশান আনার কাজটা প্রায় নিজের হাতে নিয়ে, কাকে দিয়ে করাচ্ছিল সেটা টের পেল না অমিতেশ। সেই থেকে শুরু। এই দুরত্ব ফিতে দিয়ে মাপা যায় না, অনুভবে আর চোখের দৃষ্টিতে মেপে নিতে হয়। অমিতেশ ও তাই করছিল।
৪)
বাড়ি ফেরার পথে হাতি বাগান বাজার থেকে একটা ছোরা কিনল অমিতেশ। ছোরা টা কেনার পর থেকেই তার মাথার মধ্যে সবর্ক্ষণ বাগচীর মুখটা ভেসে উঠতে লাগল। অফিসে, অফিসের বাইরে বাগচী তাকে ছেড়ে যাচ্ছে না। সে একদিন ছোরাটা ড্রয়ারের মধ্যে রেখে বাড়ি এল, কিন্তু তাতেও অবস্থার পরিবর্তন হল না। দিন দিন অমিতেশ বুঝতে পারছিল তাকে সরানোর আপ্রান চেষ্টা করে চলেছে বাগচী। আকারে ইঙ্গিতে সে বুঝিয়ে দিচ্ছে।
একদিন বাড়িতে বলেই ফেলল অমিতেশ । বউ মহুয়া বলল, সম্মান আগে না চাকরি আগে সেটা ঠিক কর। চাকরির যে অবস্থা চলে গেলে কী করবে? চাকরি কোথায়? তাছাড়া তোমার বয়স একটু বেড়েও গেছে।
সারা দিন অমিতেশের মনের ভিতরে এক তুমুল যুদ্ধ চলছে। আজ সে বারান্দায় বেড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাতেই দেখল বাগচী বেড়িয়ে যাচ্ছে নিজের চেম্বার ছেড়ে। সে যেন ওৎ পেতে ছিল। যেই সে লিফটে ঢুকল, অমিতেশ বারান্দা থেকে সেই হাতি বাগানের ছোরা নিয়ে তৈরি হল । বাগচী গেট দিয়ে বেড়িয়ে গাড়ির জন্য দাঁড়াবে। তাই দাঁড়াল। আর অমিতেশ উপর থেকে সময় ক্যাল্কুলেট করে ছোরাটা ফেলে দিল নীচে। যাতে তাঁর মাথা ফুটো করে শরীরে ঢুকে যায় ছোরাটা। কোন দিক থেকে মেরেছে বোঝা না যায়।
নীচের দিকে তাকিয়ে রইল অমিতেশ। ছোরাটা মাধ্যাকর্ষনের টানে প্রবল গতিতে নিচে নেমে বাগচীর পাশে আছড়ে পড়ল। সচকিত হয়ে এক লাফে ছিটকে গেলে বাগচী। অমিতেশ ততক্ষণে নিজের সিটে এসে বসেছে। খবরটা আসতে একটু দেরি হল। সে শুনল অল্পের জন্য বেঁচে গেছে বাগচী।
তাই বোধ হয় হয়, এই সব মানুষের এ ভাবে আচমকা মৃত্যু হয় না। তারা অল্পের জন্য বেঁচে যায়। আর অমিতেশের মত মানুষেরা ছোরা কেনে গোপনে, সামনা সামনি ব্যবহার করতে পারে না। লক্ষভ্রষ্ঠ হয় বার বার।
আদিত্য
আদিত্য এসেছিল হুগলী জেলার কোন এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে জীবিকার সন্ধানে। কোলকাতা শহর তাঁর সম্পুর্ণ অচেনা। কী করে যে আমাদের বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানির পিয়নের চাকরি জুটিয়ে ছিল সে একমাত্র আদিত্যই জানে। কেউ তাকে কোন দিন প্রশ্ন করে নি। লোকে বলে সে আমাদের অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে অসহায়ের মত কাঁদছিল। আমাদের অফিসের নাগ সাহেবের চোখে পড়ে যায়।হেমন্ত নাগ তখন এই অফিসের বড়কর্তা, রিজিওন্যাল ম্যানেজার। আদিত্য গ্রামের হলে কী হবে সে ফর্সা, মুখমন্ডলে আধা পরিচ্ছনতার ছাপ ছিল, আর মুখের মধ্যে একটা শান্ত ভাব। সেটাই নাগ সাহেবকে আকর্ষণ করেছিল। তিনি আদিত্যকে নিয়ে অফিসে পিয়নের কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন । পরিস্কার জামা প্যান্টে আদিত্যকে আধা শহুরে লাগত। গাঁয়ের মুর্খ, অশিক্ষিত মনে হত না। যদিও আদিত্য একশো ভাগ তাই। কিন্তু তাঁর একটা গুণ ছিল। হুকুম তাঁর কাছে ছিল বেদবাক্য। তাই সে অচিরেই নাগ সাহেবের নিজের লোক হয়ে গেল। মাস ছয়েক পর আদিত্য শহুরে হয়ে গেল। ইয়েস স্যার, নো স্যার, ওকে স্যার, বলতে শুরু করল। আমাদের অফিসের সরকার দেখেছে একদিন সে অফিসের থেকে দূরে গাড়ির পিছনে আপনমনে সিগারেট টানছে। আর পথচলতি সুন্দরী মেয়েদের দিকে গুলগুল করে তাকিয়ে দেখছে। সরকারকে দেখে লজ্জায় মাথা নিচু করে আড়ালে লুকিয়ে ছিল আদিত্য। সেই নিয়ে তাকে অনেকেই খ্যাপাত। তাতে আদিত্যের কোন হেলদোল ছিল না। শুনেই হেসে দিত । লোকের কাছে নিজের পরিচয় দিত অফিস এ্যসিস্টান্ট । শুনতে খারাপ লাগতো না। সত্যি তো সে অফিসে সকলকে সাহায্য করে। তাহলে সহায়ক হতে বাধা কোথায়?
দেখতে দেখতে তিন বছর কেটে গেল। অফিসের সকলের’ই খুব প্রিয় আদিত্য। একদিন সে নাগসাহেবের ঘরে ঢুকে বলল ,স্যার, আমি আর এই চাকরি করব না। আমি ছেড়ে দিতে চাই।
শুনে নাগ সাহেব তো অবাক। প্রথমে বিশ্বাস করেন নি। বললেন, কেন ছাড়বি? ঠিক আছে মাইনে কিছুটা বাড়িয়ে দিচ্ছি।
আদিত্য বলল, না, মাইনের জন্য বলছি না। মাইনে যা দেন তাতে ঘরের খরচা মোটামুটি চলেই যায়। মাসের শেষে কিছু হাতে থাকে। তা দিয়ে পোস্ট অফিসে বউয়ের নামে রেকারিং করেছি।
নাগ সাহেবের আবার অবাক হবার পালা। আদিত্যর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে প্রশ্ন , সেই কি? তুই বিবাহিত? বলিস নি তো আগে?
আদিত্য বলল, এটা কী আর বলার কথা? বয়স হবার আগে বা পরে মানুষ বিয়ে করে। আমি একটু আগেই করেছিলাম স্যার।
নাগ সাহেব বললেন, মানে? কত দিন আগে বিয়ে করেছিস?
আদিত্য বলল, এখানে চাকরি পাবার আগে।
নাগ সাহেব বললেন, তাহলে তুই ইন্টারভিউতে মিথ্যে কথা বলেছিলি?
আদিত্য বলল, না বলে উপায় ছিল না। দেশ থেকে তপতীকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। মেদিনীপুরের এক উকিল এর কাছে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করি বাড়ির অমতে। বাড়িতে তুমুল ঝগড়া।
বাবা,মা আমাদের বিয়ে মানতে চাইল না। বলল, বেড়িয়ে যা। ওই মেয়েকে আমরা বাড়িতে বউ করে তুলতে পারব না।
নাগ সাহেবের মুখ চোখ কেমন বদলে গেল। বললেন, কেন? মেয়ে তাঁর কী দোষ?
আদিত্য বলল, আমরা বামুন আর ওরা বাগদি। তাঁর উপর বাল-বিধবা। ওদের সমাজে দশ -বার বছরে বিয়ে দিয়ে দেয়। তাঁর পর মুনিষ খাটে শ্বশুর বাড়িতে। ওর বিয়ে হয়েছিল জেলার শহর থেকে অনেক দুরের এক গ্রামে। সেখানে চাষের কাজ করতে গিয়ে তাঁর স্বামীর মৃত্যু হয়। তাঁর পরই সে ফিরে আসে আমাদের গ্রামে।
নাগ সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, তোর সঙ্গে আলাপ কী করে?
–আমরা এক’ই ইস্কুলে পড়তাম। এক ক্লাসে। ছোটবেলা থেকে আমাদের মেলামেশা।
খানিক থামলেন নাগ সাহেব । তাঁর পর বললেন, তা অন্য কোথাও চাকরি পেয়েছিস তাই ছাড়তে চাইছিস?
আদিত্য বলল, না। আপনি যখন চাকরি দেন তখন আমি হায়ার সেকেন্ডারি তে তে ফার্স্ট ডিভিসানে পাশ। আমার চাকরির খুব দরকার ছিল। তাই সব গোপন করেছিলুম। নিজেকে লুকিয়েছিলুম। বলিনি। বললে চাকরি হতো না। আমি জানতাম।
নাগ সাহেব এবার বললেন ,আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কেন তুই চাকরি ছাড়তে চাইছিস? তুই কি নিজের কিছু করতে চাস? মানে নিজের বিজনেস?
আদিত্য বলল, না স্যার, বিজনেস করার মত পয়সা কোথায়?
–তাহলে?
আদিত্য সঙ্গের ব্যাগ থেকে একটা সার্টিফিকেট বের করে টেবিলে রাখল নাগ সাহেবের। তাঁর পর বলল আমি আর্টিকেলশিপ জয়েন করতে চাই। কথা হয়েছে একটা সি এ ফার্মের সঙ্গে।
নাগ সাহেব কাগজটার দিকে তাকিয়ে দেখে আদিত্যকে ফেরত দিয়ে বললেন , আই আম ভেরি হ্যাপি। বলে চেয়ার ছেড়ে সবাইকে বলল, আদিত্য এত দিন আমাদের চরম ধোঁকা দিয়েছে । তাই আমরা তাকে আজ সকলে মিলে খাওয়াবো।
সুকিয়া স্ট্রীটের একটি বস্তির একটা ঘরে তপতীকে তুলেছিল আদিত্য। সে এক কঠিন সময়। অচেনা কলকাতা শহরে কি করে রোজগার করতে হয় তা এক গোলকধাঁধা। তপতীর কলকাতায় এসে তাঁর সব পরিচয় নতুন করে নির্ধারিত হয়। সামান্য ইস্কুলের দৌলতে সে পরিচ্ছন্ন, পরিস্কার ও বিনয়ী। দু তিনটে বাড়ির ঠিকে কাজ হাতে পেয়ে গিয়েছিল । আদিত্য ঘুরে বেড়াতে লাগল বড়বাজারের মুটে, কুরিয়ারের ডেলিভারিম্যান, কিরণ জ্যোতিষীর চেলা এমনি সব বিচিত্র ভুমিকায়। আমাদের অফিসের পাশে একটি টিভি চ্যানেলের অফিসে সে এসেছিল কিরণ জ্যোতিষীর মাসের কন্ট্রাক্টের টাকা জমা দিতে। প্রতিদিন রাত দশটায় কিরণ একঘন্টার প্রোগ্রাম করে এই চ্যানেলে। সেদিন তাঁর মাসিক কিস্তির টাকা দিতে এসেছিল আদিত্য, চার হাজার টাকা পকেটমার হয়ে যায় তাঁর। ভয়ে, দুঃখে অফিসের নিচে অসহায় আদিত্য কাঁদছিল ঠিক তখনই নাগ সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তার।
আমাদের অফিসে চাকরি করতে করতে বাড়ি ফেরার পথে সে প্রতিদিন রাতের এক সান্ধ্য কলেজে বি কম অনার্স এর ক্লাস করত। সেই পরিশ্রমের ফলকই তাঁর হাতের কাগজটি। ফার্স্ট ক্লাস আদিত্য জানা।
এখানেই আদিত্যর কথা শেষ হতে পারত। এর পর আর আমাদের অফিসের সঙ্গে আদিত্যর কোন যোগাযোগ ছিলনা। বছর দুই পর নাগ সাহেবের অবসর গ্রহণের সময় হয়ে গেল। তাঁর কিছুদিন পর আমিও এই কোম্পানি ছেড়ে দিল্লী চলে যাই। নতুন চাকরির সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে কোলকাতার সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমাগত ক্ষীণ হতে লাগল। আমার এই নতুন চাকরিতে পৃথিবীর নানা জায়গায় দৌড়তে হয়, বেশির ভাগই এক অফিসের মিটিং থেকে অন্য অফিসের মিটিং সেরে হোটেলে ফিরে আসা দিনের শেষে। তাঁর পর দিল্লীর বাড়িতে ফোন করে পরিবারের সঙ্গে কথা বলে দিনানিপাত। এভাবেই চলছিল, যে ভাবে আবহমান কাল জীবন অতিবাহিত হয়েছে মধ্যবিত্ত মানুষদের । জীবন সংগ্রাম বা জীবনাপাত বলা হয় ঝুলন্ত মাসিক মাইনের ললিপপ সামনে রেখে। এই ইঁন্দূর রেসে আমি আমার অনেক প্রিয়জনের প্রয়োজনে পাশে থাকতে পারিনি। মার মৃত্যুর সময় আমি আমেদাবাদে। ভাই এর ফোনে খবর পেয়ে রাতের বিমান ধরে ভোর রাতে দমদমে নামি।
কাতার দেশের দোহা শহরের হিল্টন হোটেলে সেবার একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে যেতে হয়েছিলো। পৃথিবীর মাটির নীচের সম্পদ তেল ও গ্যাস এর ব্যবহার ক্রমাগত বেড়ে যাবার ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের যে পরিবর্তন আসন্ন তার উপরই এই সম্মেলন। কী ভাবে, কোন পথে আগামী পৃথিবী এগিয়ে যাবে,তার দিক নির্দেশ ও নির্ণয় করাই ছিল এই সেমিনারের মুল লক্ষ। নিয়ম হিসেবে ঠিক ছিল, কোন দেশ কোন কিছু গোপন করতে পারবে না। খোলাখুলি আলোচনা করতে হবে। ভারত থেকে আমি ও আর একজন গেছেন এই সম্মেলনে। সম্মেলনের দিন সকাল সারে নটায় সেমিনার হলে সবাই। দুপুরে লাঞ্চের সময় আমি থমকে গেলাম । দেখি আমাকে দেখে এগিয়ে আসছে আদিত্য। দূর থেকে চিনতে পেরেছে আমায়। এগিয়ে এসে বলল, দাদা আপনি?
আমিও তাঁর হাতে হাত রেখে বিস্ময়ে বিমুঢ। বলল, এই হোটেলে উঠেছেন?
আমি বললাম , হ্যাঁ।
সেমিনারের পর কফি খাব। চলে যাবেন না যেন, বলে কার সঙ্গে দেখা করতে চলে গেল।
আমি পিছন থেকে দেখলাম আদিত্যকে। বহু দিন পর । বিদেশে।
কফির টেবিলে আমাকে ডেকে বসাল আদিত্য। তার পর নিজের পকেট থেকে বিজনেস কার্ডটা বের করে দিয়ে বলল, এখন আর কিছুই লুকানো যাবে না। দেখি সে পেশায় চাটার্ড । একটি বিখ্যাত কোম্পানির ফিনান্স ডিরেকটার। দুবাই থেকে এসেছে পরিবেশ পরিবর্তনে অর্থনৈতিক পরিবর্তনের বিষয়ে বলতে এই সেমিনারে। তার বক্তৃতার সময় আগামী কাল সকাল দশটা। প্রতিভাস ম্যাগাজিন
সুন্দর গল্প।