তাপস সরকার
লেখক পরিচিতি
( সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা।কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়।প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘ দিয়ে। পেশায় অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক। )
অধ্যায় : তিন
এবার আমার সত্যি সন্দেহ হচ্ছে, আমিও ঠিক মানুষ কিনা। হয়তো নিজের অগোচরেই আমি অন্যকিছু।
আমার মধ্যে যেসব উদ্ভট ব্যাপার ঘটে চলেছে এগুলিকে কোনভাবেই স্বাভাবিক বলা যায় না। এসব তো মানুষের লক্ষ্মণ নয়। যদি আমি সত্যিই মানুষ না হই তো কী করা উচিত ? এমন কোন ব্যবস্থা আছে কি যার আশ্রয় নিলে মানুষ নয় এমন কেউ মানুষ হয়ে যেতে পারে ?
ধরা যাক, আমি সত্যিই মানুষ নই। মানুষের ছদ্মবেশ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এখানে দু’টো প্রশ্ন আছে। আমার এই গোপন রহস্যটা আমি নিজেই কেন জানি না ? যদি আমি মানুষ না হই তো আসলে কী ? এই দ্বিতীয় প্রশ্নটা বেশি গোলমাল পাকিয়ে দিল। মানুষ না হলে কী হতে পারি ? জন্তু-জানোয়ার হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। রাক্ষস-খোক্কস, ভূত-প্রেত অথবা অপদেবতা এমনও বলতে পারি না নিজেকে। ভিনগ্রহীও হব না অবশ্যই, কারণ নিজেই জানি পৃথিবীতেই আমার বসবাস। কোনজন্মে অন্য কোন গ্রহে-টোহে ছিলাম বলে জানিনা। তাহলে আমি কী ?
কলম ধরেছিলাম নিজের সমস্যাগুলি বলব বলে। সমস্যা অথবা বিপদ। এখন দেখছি নতুন আরেক বিপদ জুটল কপালে। নিজেকেই নিজে চিনতে পারছি না। নিজের কাছেই নিজের পরিচয়টা অস্পষ্ট। তাহলে এতক্ষণ যাদের কথা বললাম তারাও কি আমার মতোই বিপদগ্রস্ত ? তারা কি তাদের অন্যরকম অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন ? নাকি তারাও তাদের আসল পরিচয় হাতড়ে বেড়াচ্ছে ?
আজকাল আমি আর কোন মানুষকেই মানুষ বলে ভাবতে পারি না। কাউকে দেখলেই মনে হয় সে আসলে অন্যকিছু, মানুষ সেজে আছে। অথবা কেউ হয়তো এখন মানুষ, কিন্তু যেকোন সময় অন্যকিছু হয়ে যাবে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল যে কারো সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলতে পারি না। মনে হতে থাকে, যার সঙ্গে কথা বলছি সে মানুষ তো ! মানুষ হোক বা না হোক, আমার ক্ষতিবৃদ্ধির কোন ব্যাপার নেই। বোঝাতে চেষ্টা করি নিজেকে। কিন্তু ভিতরে কী যে একটা কাঁটা খচ খচ করতেই থাকে, তাকে ভুলতে পারি না।
এমনিতেও যে লোকজনের সঙ্গে আমার মেলামেশা বা যাদের দেখছি রাস্তায় নামলে অথবা যাদের কথা শুনিটুনি তারা সবাই মানুষ হলেও স্বভাবে বা আচরণে হামেশাই অন্যরকম হয়ে যায়। কোন মানুষের চেহারা বা চালচলন দেখে তাকে প্রায়ই অচেনা মনে হয়। কারো সম্পর্কে আমরা বলেও থাকি যে অমুক ব্যক্তি কেমন পাল্টে গেছে। চেনা লোককে প্রায়ই বিশেষ কারণে অচেনা মনে হতে থাকে। সেসব তো আছেই। আমি নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম, এই যে কোন পরিচিত ব্যক্তির কারণে-অকারণে চেহারা-চরিত্রের অপরিচিত প্রকাশ এটাওতো কম বিস্ময়কর নয়। অথবা করোও চারিত্রিক স্খলন, যাকে যা ভাবতে পারি না তার তা হয়ে যাওয়া, যাকে যেমন ভাবি তার তেমন না হওয়া, এসব বিষয়ওতো প্রতিমুহূর্তে প্রমাণ করছে যে প্রত্যেকেরই অন্যরকম প্রকাশ রয়েছে। তাহলে আমি ব্যাপারটাকে নিয়ে কেন এত ভাবছি ?
সকালবেলাতেই বাড়ির সামনে রাস্তায় চেঁচামেচি। যদুপতি বাজারের ব্যাগ হাতে নেমেছে রিকশা থেকে। রিকশাচালকের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে তার ঝগড়া। চালক বলছে, ভাড়া এগারো টাকা। যদুপতি দশ টাকার বেশি দেবে না কিছুতেই। একটাকার জন্য তুলকালাম কাণ্ড। প্রায়ই হয় এমন। যদুপতি রিকশায় চাপবে আর ভাড়া নিয়ে সব রিকশাচালকের সঙ্গেই ঝামেলা পাকাবে। চালক যা ভাড়া বলবে সবসময় যদুপতি তার চেয়ে একটাকা কম দিতে চাইবে। ওই একটাকা নিয়ে রিকশাচালকের সঙ্গে ঝামেলা হবেই হবে। এটা চেনা দৃশ্য। এই যদুপতিরই আবার অন্যরকম একটা চেনা চেহারা আছে। রোজ অফিসে যাওয়ার সময় স্টেশনের পাশে কালীমন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে সে যুক্তকরে প্রণাম করবে। তারপর পকেট থেকে একটাকা বার করে প্রণামী বাক্সে ফেলে দেবে। দু’টোই চেনা দৃশ্য, তবুও চেনা যায় না।
বাজারে হরিপদ মুরগির মাংস বিক্রি করে। পোল্ট্রি মুরগির দোকান। খাঁচায় থাকে মুরগিগুলো। বটি নিয়ে নিজেই বসে হরিপদ। খদ্দের এসে দাঁড়ায় আর সে কচাৎ-কচাৎ করে মুরগির গলা কাটে। গলাকাটা মুরগিগুলির ছটফট করতে থাকা শরীর পা চাপা দিয়ে সে মাংস কাটতে থাকে। সকাল-বিকেল দু’বেলাই সে দোকান খোলে। ভাবলেশহীন মুখে মুরগির গলা কেটেই যায়। রাতে ঘুমোবার আগে বসে বসে হিসেবে-নিকেশ করে। সারাদিনের বেচাবিক্রির হিসেব। সে নাহয় হল। কিন্তু হিসেব শেষ করেও কেন সে ঘুমোতে যায় না ? অন্য একটা খাতা নিয়ে কী আবার লিখতে বসে ? অন্য কোন হিসেব ? এই অন্য হিসেবের কথা একমাত্র হরিপদই জানে। সে জানায় না কাউকে। সংকোচে অথবা ভয়ে। কারণ, ঘুমোবার আগে সে কবিতা লেখে। হিসেব মেলে না।
চন্দ্রিকার ছিল পুতুল খেলার শখ। ছোটবেলায়। শখ না বলে নেশা বলাই উচিত। পুতুল ছিল দু’-চারটে। তাদের সে রোজ সাজাত-গোজাত, খাওয়াত, স্নান করাত, ঘুম পাড়াত। তাদের সঙ্গে কথা বলত, খেলা করত। এই নিয়ে মায়ের কাছে রোজ বকুনি খেত বেচারা। পড়াশুনা পড়ে থাকত, মা কিছু কাজ করতে বললে ফাঁকি দিত, এমনকি স্কুলেও যেতে চাইত না। ওই এক পুতুল খেলার নেশায়। তার মা তাকে আর পুতুল কিনে দিত না। দোকানে রঙ-বেরঙের কত কত পুতুল ! সে কান্নাকাটি করত, বায়না ধরত। মা শুনত না। বাবাও ছিল কড়া ধাতের লোক। তার কাছে আবদার করার সাহস পেত না। চন্দ্রিকা ভাবত, বড় হয়ে সে দোকানের সব পুতুল কিনে নেবে। সারাদিন কেবল পুতুল খেলবে। সেই চন্দ্রিকা এখন বড় হয়েছে। তার মেয়ের নাম ইত্রিশা। সে এখন স্কুলে পড়ে। সকাল আটটায় স্কুলে যায়, ফেরে বিকেল পাঁচটায়। স্কুল থেকে ফিরে ঘন্টাখানেক ঘুমোয়। ঘুম থাকে উঠে ইত্রিশা খেলতে চায়। তার শোকেস ভর্তি প্রচুর পুতুল। সবই জন্মদিনের উপহার। চন্দ্রিকা মেয়ের কথায় কান দেয় না। ঘুম থেকে তুলেই তাকে পড়াতে নিয়ে বসে। পুতুলরা শোকেসে থেকে যায়। ইত্রিশা সজল চোখে তাদের দিকে তাকায়, ভয়ে ভয়ে, মাকে লুকিয়ে। তার মা ভীষণ কড়া। সব পড়া তৈরি না হলে রেহাই নেই। পুতুল খেলবে কখন ইত্রিশা ? সে জানে না তার মা চন্দ্রিকার ছোটবেলাটা কেমন ছিল। ওইসময়ে মাকে তো সে দেখেনি। আর মেয়েকে নিজের ছোটবেলার সব গল্প শোনায় নি চন্দ্রিকা, বিশেষ করে নিজের পুতুল খেলার গল্প। পড়িয়েই সময় পায় না, গল্প শোনাবে কখন ?
কিছু কিছু লোক আছে যারা সঙ্গে থাকলে স্বচ্ছন্দে সময় কেটে যায়। রত্নেশ তেমনই একজন। সে থাকলে আর কারো কথা বলার দরকার হয় না। অনুকৃতি জানে, প্ৰায়ণ জানে, সবাই জানে যে রত্নেশ সঙ্গে থাকলে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা মারে জোরসে। কথা ফুরোতেই চায় না। বাড়িতে আসর জমিয়েই হোক বা পথেঘাটে হাঁটতে হাঁটতে। সপ্তাহে না হোক মাসে অন্তত এক-দু’বার দেখা হত ওদের। অনুকৃতি আর প্ৰায়ণ যেত তার বাড়িতে, তাদের বাড়িতেও আসত সে। কত যে বিচিত্র বিষয় নিয়ে গল্প হত তাদের ! তারপর একদিন রত্নেশ কর্মসূত্রে হঠাৎ শহরের বাইরে চলে গেল। দূরে গেলে যোগাযোগও ক্ষীণ হয়ে যায়। রত্নেশের আর কোন খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। প্ৰায়ণ আর অনুকৃতি কখনো-সখনো নিজেদের মধ্যে বলে রত্নেশের কথা। দেখতে দেখতে কেটে গেল কয়েক বছর। চারপাশে অনেক কিছু পাল্টে গেল। তারপর একদিন হঠাৎই আবার রত্নেশ ফিরে এল শহরে। সে নিজেই যোগাযোগ করল অনুকৃতি আর প্ৰায়ণের সঙ্গে। নিজের বাড়িতে যেতে নেমন্তন্ন করল তাদের। একদিন সময় করে তারা দু’জনে গেল রত্নেশের বাড়ি। ঘন্টাখানেক থাকল। এই এক ঘন্টা সময় তাদের কাছে দুর্বিষহ হয়ে গেল। তারা দেখল, রত্নেশ কথা বলতে ভুলে গেছে। সেই যে তার আড্ডা মারার অফুরন্ত দম তা আর নেই। এখন সে কথা বলে থেমে থেমে, সাজানো-গোজানো কথা। সে আর আগের মত নিজে থেকে অনর্গল কথা বলতে পারে না। তাকে কথা বলাতে হয়। বললেও একটি-দু’টি কথা বলেই সে চুপ করে যায়, বেশি বলার কিছু খুঁজে পায় না।
অনেকদিন পর দৃকের সঙ্গে আবার দেখা হওয়ার পর নির্লিপ্তার মনে হল, দেখা না হলেও ভাল হত। কারণ, ‘কেমন আছো’, ‘ভাল আছি’, এইরকম মাপা মাপা ভদ্রতা বিনিময় করেই তাদের কথা ফুরিয়ে যাবে ভাবা যায়নি। দৃক তাদের বাড়িতেই মানুষ, জন্ম থেকে। দাদা থাকত দেশের বাইরে, বউদি ছেলেমেয়ে নিয়ে তাদের সঙ্গে। বাচ্চা বয়স থেকেই তার নিজের মায়ের চেয়েও নির্লিপ্তা তার বেশি আপন। পিসিমণিকে সে চোখে হারাত। বাইরে কোথাও গেলে নির্লিপ্তার হাত ধরে দৃক, ঘরে থাকলেও তার পিছন পিছন ঘুরঘুর। মায়ের সঙ্গে ঝগড়া পর্যন্ত করত সে পিসিমণির পক্ষ নিয়ে। নির্লিপ্তার বন্ধুরা তার চেয়ে দৃককেই বেশি চিনত। তাকে ফেলে নির্লিপ্তা কোথাও গেলে সে মুখ অন্ধকার করে বসে থাকত পথের দিকে তাকিয়ে। বউদি তারপর চলে যায় দাদার কাছে, দৃক হোস্টেলে। নির্লিপ্তারও বিয়ে হয়ে যায়। সাংসারিক কারণে দাদার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়। তবুও নির্লিপ্তা ভাবত, দৃক সেই ছোট্টবেলার দৃকই আছে, যদিও যোগাযোগ প্রায় ছিলই না। তার ভুল ভাঙ্গে চাকরি পেয়েও দৃক যখন তাকে জানায় না, খবরটা সে শোনে অন্যের কাছে। আর এতদিন পর দৃককে মুখোমুখি দেখে নির্লিপ্তা বোঝে যে ফেলে আসা ওই সম্পর্কটা জাদুঘরে চলে গেছে।
ঘরে যে লোকটা চরিত্রবান সেজে থাকে আর বউকে সারাক্ষণ শোনায় সে কতটা ধন্য এমন স্ত্রী পেয়ে, সেই ব্যক্তি দেখি বাইরে গিয়ে অন্য মহিলার মন ভেজাতে বলে যাচ্ছে তার স্ত্রী তার জীবনটা তছনছ করে দিয়েছে। যে লোকটা পকেটমারকে পেটায়, চোরকে ধরে, তাকে কি দেখছি না ঘুষ খেতে ? আজকে যে লোকটা একরকম কালকে তার আরেকরকম হয়ে যাওয়ার ঘটনা তো ঘটে চলছে হরদম। এসব দেখে প্রায়ই যদি মনে হয়, যাকে এখন দেখছি তাকে সত্যিই তখন দেখেছি কিনা বা যাকে দেখে আসছি সেই লোকটিকেই দেখছি কিনা তাতে কি খুব একটা দোষ দেওয়া যায় ? মানুষের পরিচিতি বড়ই গোলমেলে ব্যাপার, এতদিনে এটাই বুঝতে পারলাম যে কাউকে আমি চিনি বলে বড়াই করতে পারি না।
হরেনের মুদিখানার দোকান। দুই ছেলেমেয়ে। ছেলে সোমেন বড়, মেয়ে কাকলি ছোট। দু’-আড়াই বছরের তফাৎ। হলে কী হবে, সোমেন তার বোনকে খুবই ভালবাসে। তাকে ভাল খাবার দিলে আগে সে বোনকে খাওয়ায়। পুজোয় তার নিজের জামাকাপড় হোক না হোক বোনের জন্য নতুন জামা-জুতো কেনা হল কিনা তাই নিয়ে সে ব্যস্ত থাকে। ছোটবেলায় সে বাবা-মায়ের কাছে বায়না ধরত বোনকে এই পুতুল সেই পুতুল বা খেলনা কিনে দিতে। বড় হওয়ার পরও তার এই ভালবাসা অটুট ছিল। নিজের হাতখরচ বাঁচিয়ে সে বোনের জন্য নানা জিনিস কিনে আনত। মেয়ের বিয়েতে হরেন যা খরচ করবে ভেবেছিল তার চেয়ে বেশি খরচ করে ফেলল, কারণ তার ছেলে। সোমেনের দাবি মেনে গয়নাগাটি ও অন্য উপঢৌকন বাড়াতে হল, জাঁকজমক ও খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনও কম করা গেল না। দুর্ভাগ্যক্রমে বোনের বিয়েটা টিঁকল না। তিন বছরের মাথায় কাকলি শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে হরেনের বাড়ি চলে এল। সঙ্গে তার দু’বছরের একটি ছেলে। হরেন আর কী করে, মেয়ের জন্য বাড়ির একতলায় দু’খানা ঘর নির্দিষ্ট করে দিল। মেয়ে যাতে চাকরি পায় তার জন্য এক-দু’লাখ টাকা খরচ করে কোন একটা কোর্স করাতে লাগল। ততদিনে সোমেনেরও বিয়ে হয়ে গেছে। চাকরিও জুটিয়েছে একটা। একদিন গভীর রাতে সে তার বউকে বলল,
‘বাবা তো দেখছি কাকলিকে সবই দিয়ে দেবে। আমাদের জন্য কী আর থাকবে ? বাড়ির একতলাটা তো গেল, দোকানটাও না যায়! একটা বুদ্ধি করেছি শোন। তুমি এখন থেকে বাবার সঙ্গে দোকানে গিয়ে বসো। বাবার বয়স হয়েছে, তুমি বলবে যে তুমি তাকে সাহায্য করবে দোকানে থেকে। আমি পারব না, চাকরি আছে। কিন্তু তোমাকে গিয়ে দোকানে বসতে হবে, দোকানটার দখল রাখতে হবে।’
হরেন ছেলে আর ছেলের বউয়ের কথা মেনে নিল। সন্ধের পর ছেলের বউ তার সঙ্গে দোকানে বসতে লাগল। সোমেন এখন নিশ্চিন্ত। দোকানটা তার দখলে থেকে যাবে এভাবেই। বোন সেটা দাবি করতে পারবে না কোনদিন। আর এভাবেই পুরোনো সোমেন এখন অন্যরকম সোমেন হয়ে গেল। ভেঙেচুরে গুঁড়ো গুঁড়ো হয় জীবনের সূচনালগ্ন।
কেউ অন্যরকম হয়ে যায় কোন এক নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে, কেউ আবার যখন-তখন অন্যরকম। রিমঝিম বোঝে না দু’দিন পর পর কী হয় সিক্তার। আলাপ তাদের অনেকদিনের। সিক্তার বিয়ে হয়নি, হবে বলেও মনে হয়না। এনজিও-টেনজিও অনেককিছু করে বেড়ায় সারাদিন। কোনটাই তেমন কাজের কাজ নয়, তবে সবসময় এমন ভাব দেখায় যেন সে জগতে সবচেয়ে ব্যস্ত কেউ। এর সঙ্গে চেনা, ওর সঙ্গে চেনা, শুনলে মনে হয় উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরুর মধ্যে যত দেশ আছে সব দেশের লোক তাকে চেনে। এত ব্যস্ত এবং সময়ের এত অভাব হলেও সে নিজেই রিমঝিমকে যখন ফোন করে কথা ফুরোতেই চায় না। রিমঝিমের নিজের সংসার আছে, সে সত্যি ব্যস্ত হলেও সিক্তার সঙ্গে আড্ডা মারার সুযোগ পারতে ছাড়ে না। সময় করে কোন কাফেতে বা রেস্টুরেন্টে যায় দু’জনে, আবার সিক্তা তার বাড়িতেও আসে। এটা হল সিক্তা যখন চেনা চেহারায় থাকে তার কথা। হঠাৎ সে একদিন নোটিশ না দিয়ে অচেনা হয়ে যায়, রিমঝিম ফোন করলে ধরে না, পরে কলব্যাকও করে না। রহস্যজনকভাবে সে চুপ করে থাকে, কোন যোগাযোগ রাখে না রিমঝিমের সঙ্গে। এক-দু’মাস, কখনও বা তারও বেশি সময় এভাবে হারিয়ে থাকে, আবার একদিন নিজেই যোগাযোগ করে।
করুণাশিসবাবুকে সবসময় হাসিখুশিই দেখতাম। খুব আমুদে মানুষ, অচেনা লোকের সঙ্গেও ভাব জমাতে ওস্তাদ। আমরা আবার তাঁর উৎসাহের বহর দেখে মাঝেমধ্যে বিরক্তও হতাম। মেজাজ তো সবসময় সবার প্রসন্ন থাকে না, হতেই পারে কখনো কেউ ঠাট্টা-ইয়ার্কি করার মত অবস্থায় থাকত না। সেসব ভ্রূক্ষেপ ছিল না তাঁর। সবাইকে নিয়ে মজা করেই যেতেন। এই স্বভাবের জন্য পিছনে অনেকে তাঁর সমালোচনাও করত। কেউ কেউ আবার তাঁকে এড়িয়েও চলত। সেই করুণাশিসবাবুকে কয়েক মাসের ব্যবধানে কিছুদিন আগে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। ভদ্রলোক হাসতে ভুলে গেছেন। কেউ কথা বললেও তিনি কথা বলতে চান না। চুপচাপ, গম্ভীর হয়ে গেছেন। একজন প্রাণবন্ত লোক কিভাবে এমন নীরব হয়ে যেতে পারেন মাথায় ঢোকে না।
এভাবেই সব মানুষকে চলাফেরা করতে দেখছি সবসময়। তাদের চেনা চেহারা কখনো অচেনা হয়ে যায়, কখনো অচেনা চেহারা চেনা-চেনা ঠেকে। কেউ ঘরে একরকম, বাইরে অন্যরকম। কারো চেহারা ব্যক্তি বা স্থান বা সময়বিশেষে পাল্টে পাল্টে যায়। একেক পরিস্থিতিতে একেকরকম। লোকেরা পাল্টে যায় জানা ছিল, কিন্তু কী আকৃতি ধারণ করতে পারে জানতাম না। যতই অন্যরকম হোক না কেন, ভাবতাম মানুষ সবসময় মানুষই থাকে। রিক্ত আমাকে দেখিয়ে দিল একটা অন্য জগৎ। মানুষ কতভাবে অন্যরকম হয়ে যায় এবং কতভাবে তার সেই বিচিত্র প্রকাশ ঘটায় এসব আমি কল্পনাও করতে পারতাম না। আগে আমি জানতাম যে সবাই ঠিক মানুষ, আর এখন আমি বুঝেছি যে জীবনে একজনও ঠিক মানুষ দেখিনি। ঠিক মানুষ সত্যিই কি কেউ আছে ? ক্রমশ এই সন্দেহ বদ্ধমূল হতে চলেছে। এটা আমার জন্য ভাল না খারাপ বুঝতেও সমস্যা হচ্ছে। তবে কেমন যেন হতাশা গ্রাস করেছে আমাকে। গোড়াতেই তার কথা উল্লেখও করেছি। এতকিছুর মধ্যে এটুকুই আশার কথা যে রিক্ত বলেছে, কেউ না কেউ ঠিক মানুষ সত্যিই আছে। রিক্তর কথা অবিশ্বাস করার কারণ নেই বলেই ভরসা পাই। সে যে আমার চেয়ে অনেক বেশি খোঁজখবর রাখে তা তো প্রমাণিত সত্য।
রহস্যের অন্য আরও দিক আছে, সেটাও আমি জানতাম না। রিক্ত জানত, আর আমাকে একদিন বলল,
‘এমনও হতে পারে, তুই যাকে দেখছিস সে হয়তো অন্য কেউ, সে নয়।’
‘সে তো দেখলামই, মৌনাক্ষি বেড়াল হয়ে গেছে, বা বেড়াল হয়ে গেছে মৌনাক্ষি।’
রিক্ত বাধা না দিয়ে শুনল আমার কথা। তারপর ধীরস্থির ভঙ্গিতে বলতে লাগল,
‘ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। মানুষরা সব ঠিক মানুষ নয় সেটা তো তুই দেখেছিস। এই বিষয়টা তোর আর বোঝার বাকি নেই। আমি এখন সেই প্রসঙ্গটা বলছি না। তোকে বলতে চাইছি আরেকটা নতুন বিষয়। এখানে মানুষ অন্যকিছু বা অন্যরকম হয়ে যায় না। মানুষরা মানুষই থাকে, পরিচয়টা ওলোট-পালোট হয়ে যায়। আমাকে হয়তো তুই রিক্ত বলে জানিস, কিন্তু আমি আসলে রিক্ত নই। আমার মধ্যে ঢুকে বসে আছে অন্য কেউ।’
আমার সব গোলমাল হয়ে যেতে লাগল। চোখমুখ দেখে রিক্ত আমার অবস্থাটা বুঝতে পারল। থেমে গিয়ে সময় দিল আমাকে ধাতস্থ হওয়ার জন্য। সে থামতেই আমি সপাটে প্রশ্ন করলাম,
‘তাহলে তুই রিক্ত কোথায় আছিস ?’
‘আমি হয়তো অন্য কোন পরিচয়ে আছি।’
‘যেখানে খুশি থাক্। তোকে যখন তোর চেহারায় দেখছি, তাকে তুই ভাবতে সমস্যাটা কী ? আমার জেনে কী লাভ আসল তুই কার মধ্যে ঢুকে আছিস ?’
রিক্ত চিন্তিত গলায় বলল,
‘লাভক্ষতির ব্যাপার নয়। বিষয়টা অন্য। তুই রেগে যাচ্ছিস। আমি তোকে জোর করতে চাই না। কেবল জানাচ্ছি যে মানুষের মধ্যে অনেকরকম রহস্য আছে। মানুষ যে পাল্টে অন্যকিছু হয়ে যায় তাই নয়, অন্যকিছু না হয়ে সে শুধু তার পরিচয়টা পাল্টে নিতে পারে। বিশ্বাস করবি কি করবি না সেটা তোর ব্যাপার।’
আমার উষ্ণতা কমে গিয়েছিল। বললাম,
‘বিশ্বাস করব না কী রে ! হান্ড্রেড পার্সেন্ট বিশ্বাস করছি। কিন্তু ব্যাপারটা গোলমেলে ঠেকছে। বুঝিয়ে দে, বা দেখিয়ে দে।তাহলে আর অস্পষ্ট থাকবে না।’
‘বুঝিয়ে দিতে পারি। মনে করতে পারিস, তুই জন্ম থেকে একজনকে জানিস ভুবনবাবু বলে। আর একজন আছে রবিনবাবু। তাকে তুই চিনতে পারিস বা না পারিস। একটা সময় পর ভুবনবাবু হয়ে গেল রবিনবাবু, আর তুই জানতেও পারলি না পরিবর্তনটা। ভুবনবাবু তারপর থেকে রবিনবাবু হয়েই বাঁচতে লাগল। কেউ ব্যাপারটা টেরই পেল না। এই পরিবর্তনের পর সবাই যাকে রবিনবাবু বলে ভাবল সে আসলে ভুবনবাবু।’
‘রবিনবাবু গেল কোথায় ?’
‘এই ব্যাপারটাই গোলমেলে। রবিনবাবু পারস্পরিক বোঝাপড়ায় ভুবনবাবু হয়ে যেতে পারে, আবার না-ও পারে।’
‘কিন্তু তাকে তো কোথাও যেতেই হবে, ভুবনবাবু তো তার মধ্যে ঢুকে গেছে !’
‘সে না যেতেও পারে, যেমন ছিল তেমন থেকে গেলেও ক্ষতি নেই। আবার সে দরকার হলে অন্য কেউ হয়ে যেতে পারে। সেটা যে ভুবনবাবু হতেই হবে এমন নয়।’
গোটা ব্যাপারটা হজম করতে একটু সময় নিলাম। রিক্ত সেই সুযোগটা দিল। নানা প্রশ্ন জাগছিল মনে। জিজ্ঞেস করলাম,
‘ভুবনবাবু তো রবিনবাবু হয়ে গেল। কিন্তু ভুবনবাবুর চেহারা নিয়ে কে থাকল ?’
‘বোঝাপড়া থাকলে রবিনবাবু চলে আসবে। এখানটা একটু গোলমেলে। ভুবনবাবু নিজেও থেকে যেতে পারে দু’জায়গায়। তৃতীয় অন্য কেউও আসতে পারে।’
‘এই ব্যাপারটা কি প্রত্যেকের জীবনে একবারই ঘটে ?’
‘একদমই না। কারো জীবনে বারবার, এমনকি দিনে কয়েকবারও ঘটতে পারে ঘটনাটা। নিজের মধ্যে যখনই আমার থাকতে ভালো লাগে না আমি তখন ভুবনবাবু, রবিনবাবু, মধুবাবু, হরিবাবু ইত্যাদি নানাজন হয়ে যেতে থাকি। ঘুরে ঘুরে দেখি কোথায় থাকতে ভাল লাগে। কার মধ্যে যাব তার কোন বাধা নেই। বিখ্যাত-অখ্যাত যে কোন লোকের মধ্যেই যেতে পারি। কেউ এভাবে ঘন ঘন অন্য লোকের মধ্যে গিয়ে আশ্রয় নেয় বা নিজেকে অন্য লোকের সঙ্গে পাল্টে নেয়। আবার কেউ হয়তো একবারই জীবনে এমন পাল্টাপাল্টি করে। যাই হোক না কেন, প্রত্যেকের জীবনে এই ঘটনা ঘটবেই। একবার বা হাজারবার। কেউ নিজেকে সম্পূর্ণ পছন্দ করে না। ভুবনবাবু হয়ে যায় রবিনবাবু বা মধুবাবু বা হরিবাবু বা যোগেনবাবু। চলতেই থাকে পাল্টাপাল্টি। কেউ সারাজীবন কেবল ভুবনবাবু হয়ে বাঁচে না।’
বুঝলাম। কিন্তু এই ব্যাপারটা ঘটে কিভাবে ?’
‘সেটা না দেখলে বুঝবি না। সবসময় দেখে যে বোঝা যাবে তারও কোন গ্যারান্টি নেই, কারণ কেউ হয়তো যদুবাবু হয়ে গেল, সারাজীবন থেকে গেল যদুবাবু হয়েই। তাকে দেখতে তোরও সারাজীবন কেটে যাবে। এসব দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন। তবে ক্ষণস্থায়ী পরিবর্তন ঘটেই চলেছে। সেসব দেখা যেতেই পারে। দেখলেই বুঝবি কিভাবে ঘটে।’
রিক্তকে নিয়ে শুরু করতে চলেছি এবার এক নতুন অনুসন্ধান। এবার আমরা দেখব কিভাবে মানুষে মানুষে পাল্টাপাল্টি চোখের সামনে ঘটে চলেছে সবার অজান্তে।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)