তপোপ্রিয়

নদীর নাম গোমতী 

কেউ যে কত প্রিয় বোঝা যায় বিচ্ছেদ হলে। আমার জীবনে একটি নদী এসেছিল। শৈশব, বালকবেলা আর কৈশোর সেই নদীকে দেখে কেটেছিল। যখন ছিলাম কাছাকাছি, চলতে-ফিরতে দেখা হত তখন বুঝিনি তাকে দেখা কেমন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। তাকে না দেখতে পেলে কষ্ট হবে কিনা। আজ সেই নদীর কাছ থেকে অনেক দূর সরে এসে আমার বসবাস। তাকে আর দেখার উপায় নেই। আমার কেমন ফাঁকা-ফাঁকা লাগে। 

হয়তো সবারই জীবনে কোন না কোন প্রিয় নদী আছে। জীবনে আমিও অনেক নদী দেখেছি। কিন্তু একটি নদীই আমার প্রিয় হয়ে উঠেছিল, তার নাম গোমতী। ত্রিপুরা রাজ্যে সে নদীর ঘরসংসার। আমার সঙ্গে তার নিয়মিত দেখা হত যখন আমিও সেখানে ছিলাম। কত যে বিচিত্র পরিবেশে তার সঙ্গে দেখা হত ! কখনো বিস্তৃত মাঠ জুড়ে সরষে খেত, মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে গোমতী, একেবারেই নিরীহ মেজাজে। আবার সেই নদীতেই দেখতে পেতাম দু’পাশে খাড়াই পাহাড়ি ঢাল রেখে গভীর খাদ বানিয়ে দুর্বার ছন্দে এগিয়ে চলেছে। কখনোবা দীর্ঘদেহী শাল গাছের জঙ্গল কাটিয়ে যাওয়ার সময় দেখতাম নদীর বুকে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে নিঃশব্দ ঝোপঝাড় বা হৃষ্টপুষ্ট কোন গাছ। পাড়াগাঁয়ের রান্নাঘর আর সবজি বাগানের পাশ দিয়েও তাকে বয়ে যেতে দেখেছি পাড়াবেড়ানো আইবুড়ো মেয়েদের মত। আবার সঘন আখখেতের পর রুক্ষ মেঠো জমি পেরিয়ে বিস্তীর্ণ বালুকাবেলার ঢাল ধরে অনেকটা এগিয়ে কোনদিন খুঁজে পেয়েছি গোমতীকে, ওধারে উঁচু পারে বিক্ষিপ্ত ভাঙ্গনের চিহ্ন লাল মাটির দেয়ালে, যেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়াচ্ছে গাঙশালিকের হই-চই। তখন পৃথিবীর অবসন্ন বুকে দেখা দিয়েছে গোধূলি, নদীর কালো চঞ্চল জলে রক্তবর্ণের খাপছাড়া ঝিকিমিকি। তার পাড়ে ঘুরে বেড়াতাম একা বা বন্ধুদের সঙ্গে অথচ বুঝতাম না সে আমার কত প্রিয় হয়ে গেছে। এখন জীবনের অন্য অর্ধ আমাকে নিয়ে এসেছে অন্য রাজ্যে। গোমতীকে ফেলে এসেছি অনেক দূরে। আর তার দেখা পাই না। কোন কোন দিন বাড়ির ছাদে নিস্তব্ধরাতে একা যদি ঘুরি, হয়তো আকাশে দেখা হয় ছায়াপথের সঙ্গে। তার আদল খানিকটা নদীর মতো। তখন আমার মনে পড়ে গোমতীর মুখ। আমার কেমন কান্না পেতে থাকে। 

বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে যেত সেই নদী। পিচের রাস্তা বাজারের বুক চিরে সোজা চলে গিয়েছিল নদী পর্যন্ত, হেঁটে অন্তত দশ-পনের মিনিট। বাজারের পর ওই রাস্তার বাঁ ধারে লোকজনের বাড়িঘর, ডান ধারে বিশাল চর আর তাতে সবজি খেত। নদী যেদিকে চলেছে তার উল্টোমুখী ওই চরের জমি বিস্তৃত হতে হতে চলে গেছে দূরের গ্রামে, চাঁদ সাক্ষী রেখে কত কত রাত সেইসব জমির আল ধরে চলে যেতাম কত গাঁয়ে। কুয়াশা গায়ে জড়িয়ে নিথর হয়ে থাকত সরষে খেত, লাল শাক ভিজে থাকত সদ্য শিশিরে। বাজার থেকে বেরিয়ে রাস্তা নদী পর্যন্ত যাওয়ার বাঁ হাতে লোকজনের বাড়িঘর। কিছুটা পার হওয়ার পর বাঁ দিক থেকেই অন্য একটি রাস্তা চলে গেছে মির্জা বলে এক জনপদের দিকে। আরেকটু এগিয়ে গেলে আবার আরেকটি রাস্তা ওই বাঁ ধার থেকেই বেরিয়ে পাহাড়ের পর পাহাড় ডিঙিয়ে গিয়ে মিলেছে উপজাতি অধ্যুষিত তৈবান্দাল এলাকায়। তারপরে রাস্তা ঢালু হয়ে নেমে গেছে নদীর দিকে, ডানপাশে বেদিবাঁধানো এক বিশাল বটগাছকে রেখে। ওই বটগাছের তলায় চৈত্র সংক্রান্তিতে জাঁকজমক করে শিবের পুজো হত। মা ডালা সাজিয়ে যেত, আমাদের বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে অন্তত দেড়-দু’ কিলোমিটার। আমিও যেতাম মায়ের সঙ্গে। সকালে উঠে স্নান সেরে কাচা কাপড় পরে শুদ্ধ হয়ে ডালা সাজাতে বসত মা। সেই আনন্দ আমার আজ হারিয়ে গেছে। জীবনে কত কী যে হারিয়ে যায়, ফিরে পাওয়ার উপায় থাকে না। কোন এক বন্যায় নদীর জলের ধাক্কা সেই বটগাছটাকেও বেবিসুদ্ধ উপড়ে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। 

এদিক থেকে রাস্তা গিয়ে শেষ হয়েছিল নদীর এধারে, ওধার থেকে আবার রাস্তার সূত্রপাত। আসলে রাস্তা একটাই, মাঝখানটা নদী কেটে দিয়েছিল। যাত্রীবাহী বাসগুলি নদীর এপারে যাত্রীদের নামিয়ে দিত, তারা সব নৌকো করে নদী পেরিয়ে ওপারে গিয়ে অপেক্ষা করত। বাসও পার হত নৌকায়। দু’টি বড় বড় নৌকো পাশাপাশি জুড়ে ওপরে কাঠের পাঠাতন বানানো হত। বাস রাস্তা থেকে উঠে যেত সেই কাঠের পাঠাতনে। ওপারে গিয়ে নৌকো ছেড়ে আবার রাস্তায় নামলে অপেক্ষমান যাত্রীরা সব হই হই করে উঠে বসত বাসে। একবার একটা বাস পাটাতনে উঠেই ভারসাম্য হারিয়ে সোজা গিয়ে পড়েছিল নদীর মধ্যে। সে এক হুলস্থুল কান্ড।

নদীর সেই খেয়াঘাটকে স্থানীয় ভাষায় বলা হত গুদারাঘাট। তার মালিক ছিল চিন্তা সিং নামের একটা লোক। সেই চিন্তা সিং-এর দশাসই চেহারা, গাল বেয়ে নেমে এসেছে বিশাল গোঁফজোড়া। বটবেদির ঠিক ধার ঘেঁষে ছিল একটা বেড়ার ঘর। তার মধ্যে মাচার ওপর সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে ক্যাশ বাক্সকে তাকিয়া বানিয়ে বসে থাকতো চিন্তা সিং। পরনে তার ধুতি আর গেঞ্জি, বাড়ি তার বিহারে। যানবাহন আর লোকজন নদী পারাপারের সময় পয়সা দিয়ে যেত চিন্তা সিং-এর ক্যাশবাক্সে।

শুনতাম চিন্তা সিং-এর স্বভাব নাকি ভালো ছিল না। তার গুদারাঘাটের পাশেই আবার ছিল একটা দেশি মদের ঠেক, তারও মালিক চিন্তা সিং। সেই ছোট বয়সে আমার কোন ধারণাই ছিল না খেয়াঘাটের মালিকানা মানে কী। পরে বুঝেছিলাম, চিন্তা সিং সরকারের কাছ থেকে নদী পারাপারের ইজারা নিয়েছিল। এই ইজারা নেওয়ার ব্যাপারটা সম্পর্কেও আমার কোন ধারণা ছিল না। ভাবতাম চিন্তা সিং বোধহয় এমনি এমনি লোকজন, গাড়িঘোড়াকে নদী পারাপার করে পয়সা তুলতে শুরু করেছে। হয়তো ব্যাপারটা নিজে নিজেই ঠিক হয়ে গেছে। তার পিছনে যে কত কী আয়োজন থাকতে পারে সেসব আমার মাথাতে ছিল না।

পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি বড়দের জগতের অনেক সমীকরণের কোন মানে বুঝতাম না ছোটবেলায়। যেসব রাস্তা দিয়ে গাড়ি-ঘোড়া চলে ভাবতাম বুঝি সেসব এমনি এমনি তৈরি হয়ে যায়। কোনো গ্রামে কোন স্কুল হয়েছে, মনে হত তাও নিশ্চয় আপনা আপনি তৈরি হয়ে আছে। রাস্তার বিদ্যুৎ বা টেলিফোনের লাইন সেসব সম্পর্কেও এমনই ধারণা ছিল। জানতাম অবশ্য সরকার এসব বানায়। ছোটবেলায় ভাবতাম সরকার এক সর্বশক্তিমান পদার্থ যাকে চোখে দেখা যায় না। যার ইচ্ছে হলে যে কোন জিনিস তৈরি হয়ে যেতে পারে। 

তারপর একটু বড় হওয়ার পর ঠিকাদার বলে একদল লোকের কথা জানতে পেরেছিলাম যারা নানা রকম নির্মাণকর্মের সঙ্গে যুক্ত। রাস্তাঘাট, বাড়িঘর ইত্যাদি সব বানায় তারাই। এই রহস্য জানার পরও ধারণা ছিল বোধ হয় কন্ট্রাকটাররা কোন এক চালু নিয়মে নানা নির্মাণকর্মের সঙ্গে আপনা আপনি যুক্ত হয়ে যায়। চুক্তি, টেন্ডার, লাভক্ষতি ইত্যাদি কত যে এলাহি কান্ড এসব নির্মাণকর্মের পিছনে সে সবকিছু বুঝতাম না। এখন কেমন স্পষ্ট বুঝি, একটা রাস্তা তৈরি করে যে কন্ট্রাকটার সে আবেদন করে সরকারের টেন্ডার দেখে, কাজের বরাত পেয়ে এস্টিমেট বানায়। লোকজন, মালমশলা যোগাড় করে সরকারের কাছে কাজের হিসেব পাঠায়, ইত্যাদি কত কী। ছোটবেলায় ভাবতাম, বুঝি কোন এক অলিখিত নিয়মে কন্ট্রাক্টর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রাস্তা বানিয়ে দিয়ে গেল, যেন এটাই তার কাজ।কী স্বার্থ থাকতে পারে এমন কাজের পিছনে ভেবে দেখতাম না। আমার আরও মনে হত যে রাস্তা, বিদ্যুতের লাইন ইত্যাদি যা যা থাকার দরকার সেসব আপন নিয়মে নিজে থেকেই হাজির হয়ে যাচ্ছে।

এখন আমি অনেক বিষয় বুঝতে পারি যেসব ছোটবেলায় বুঝতাম না বা বোঝার কথা ভাবতাম না। তবুও আমার ভাবনা হয়, কখনো কখনো বড় উদাসীন হয়ে পড়ি যখন প্রশ্ন জাগে যে জগতের সব সমীকরণের মানে আমি বুঝতে পেরে গেছি কিনা। এই যে আমার মানুষ হওয়া পৃথিবীর এক নির্দিষ্ট সময়ে, এই যে আমার উপস্থিতি, এই যে জীবনের পথ বেয়ে আমার এগিয়ে চলা, পৃথিবীতে এই যে প্রাণের স্পন্দন, বিশ্বজগতের এই যে অস্তিত্ব, আমি ভাবি এসবই বুঝি এমনি এমনি হয়ে যাচ্ছে কোন এক অলিখিত নিয়মে। কখনও ভেবে দেখি না, পিছনে কোন ঠিকাদার বা কোন সরকার আছে কিনা। নিজেকে আমার এখনো সময় সময় অবুঝ বালক বলে মনে হয়। ছোটবেলায় যেমন ভাবতাম রাস্তাটা আপনা আপনি হাজির হয়ে গেল, তেমনি এখনো ভাবি পৃথিবীটা অকারণে নিজে নিজেই হাজির হয়ে আছে। আমার এই অবোধ বালকত্ব কি একশ বছর পরমায়ুতেও কাটতে পারে ? অথবা হাজার বছরের পরমায়ু কি মানুষকে বোঝাতে পারে যে হাজার কোটি বছরের প্রবীণ বিশ্বজগতের নিয়ম-নীতির স্বরূপ ?

বাজারের পর গোমতীর ওপর ব্রিজ তৈরির কথা ভাসছিল লোকের মুখে মুখে। সেই ব্রিজ ঘিরে এলাকার লোকজন কত না স্বপ্ন আলোচনা করত শুনতাম। আমার মায়েরও বড় আশা ছিল ব্রিজ একদিন সত্যি তৈরি হবে। ত্রিপুরা ছেড়ে চলে এলাম তারপর। ব্রিজ আর তৈরি হয়নি। অনেক অনেক দিন পর কোন এক সূত্রে সেদিন খবর পেলাম, ব্রিজটা নাকি সত্যি তৈরি হয়েছে। শুনে আমি হঠাৎ কেমন মুহ্যমান হয়ে পড়লাম। আজ ত্রিপুরা অনেক দূরে, গোমতী এখন পূর্বজন্মের স্মৃতি মত। তবুও মনে হল, বুঝি কোনো স্বজনের খবর পেলাম। আর আমার মনে পড়ল মায়ের মুখ। গোমতীতে ব্রিজ হবে এই আলোচনা করতে গিয়ে মায়ের মুখে যে উৎসাহের পুলক আর চোখে যে আনন্দ দেখতাম তা আবার আমার অন্তরে জ্বলজ্বল করে উঠল। আর আমি কেমন বিষণ্ণ হয়ে পড়লাম। আমার ইচ্ছে করল মাকে ডেকে শোনাই, জানো মা, গোমতীতে সত্যি ব্রিজ তৈরি হয়েছে। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেও মাকে খুঁজে পেলাম না যাতে আমি শোনাতে পারি এই আনন্দ সংবাদ।

আমার মায়েরও এমনই একটি প্রিয় নদী ছিল। মা গোমতীকে খুব একটা পছন্দ করত না। গোমতী ছিল মায়ের কাছে নিচু জাতের এক নদী। মায়ের কাছে শুনেছিলাম উচ্চবর্ণের গোমতীর বাস ভারতের অন্য কোন প্রদেশে যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে শ্রীরামচন্দ্রের নাম। মায়ের প্রিয় নদীর নাম বুড়িগঙ্গা। সেই নদীর নিবাস ছিল ঢাকা জেলায়, মায়ের ছোট্টবেলার বাড়ির পাশে। বুড়িগঙ্গা মায়ের কাছে কুলীন নদী। তার কথা বলতে গিয়ে মা মুখে আনত মনোরম হাসি। সেই নদীর সঙ্গে খেলাধুলায় কেটেছিল মায়ের ছোটবেলা। 

মাকেও দেখতাম বুড়িগঙ্গা নদীর জন্য দুঃখ করতে। মায়ের সঙ্গেও সেই নদীর বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছিল অনেকদিন। আমার তখন মজা লাগত মাকে দেখে। নদী কি মানুষ নাকি যে তার জন্য এমন হাহাকার, ভাবতাম মাকে দেখে। বুড়িগঙ্গা নদীর কথা বলতে গিয়ে মা তারপর শুরু করত তার বাবা-মায়ের কথা, ছোটবেলার সঙ্গীসাথি আর পুরনো বাসস্থানের কথা। আজ এতদিন পর বুঝতে পারছি, নদীর জন্য মায়ের অন্তরের সেই আকুল হুতাশ। নদী মানে কেবল নদী নয়, নদীর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে পরিবার, পরিজন, বন্ধুবান্ধব, বাড়িঘর, জীবন। গোমতীকে হারিয়ে আমিও এখন তেমনি কাতর মা যেমন কাতর ছিল বুড়িগঙ্গার জন্য। 

নৌকো করে নদী পারাপার বড়ই অসুবিধের। ওপারে ছিল অনেক গ্রাম। সেসব গ্রামের লোকদের হরদম আসতে হত এপারে।এপারে স্কুলকলেজ, বাজারহাট, হাসপাতাল, দোকানপাট। বড় দরকার ছিল একটা ব্রিজের। অনেকদিন ধরেই নদীর ওপর ব্রিজ হওয়ার কথা হচ্ছিল। ওই কথাই সার। তখন সবাই মিলে বাজারের পর নদীর ওপর বাঁশের মাচা দিয়ে একটা সেতু বানাল। দুটি করে লম্বা বাঁশ ইংরেজি এক্স অক্ষরের মত বেঁধে নদীর তলায় পুঁতে দেওয়া হল প্রথমে। পাঁচ দশ ফিট পরপর এমনই এক একটি জোড়াবাঁশের এক্স দাঁড় করিয়ে দিল লোকরা সারা নদীর প্রস্থ বরাবর। সেই এক্সে-এর জোড়ের ওপর প্রায় ফুট তিনেক চওড়া বাঁশের মাচা একের পর এক চাপিয়ে তৈরি হল গোটা সেতু। লম্বায় সেতুটা খুব ছোট ছিল না, অন্তত পাঁচ-সাতশ ফিট তো হবেই। নদীর বুক থেকে সেতুর উচ্চতাও ছিল কয়েকশ ফিট। নিচে তাকালে মাথা চক্কর দিয়ে উঠত। আমি জীবনে দু’-চার বার ওই মাচান সেতু দিয়ে নদী পেরিয়ে ছিলাম ভয়ে ভয়ে। মা জানত না আমার এই দুঃসাহসের কথা, জানলে আতঙ্কে হয়তো হার্টফেলই করত। মায়ের বড়ই দুশ্চিন্তা ছিল আমাকে নিয়ে। অথচ ছেলে-বুড়ো সবাই দেখতাম দৌড়ে দৌড়ে অনায়াসে ওই সেতু পেরিয়ে যেত চোখ বুজে। তারা অবশ্য কেউই নদী পার হওয়ার সময় আমার মত উদ্ভট ভাবনা ভাবত না। সেতুর ওপর উঠলে আমার কেবল মনে হত, আচমকা যদি হোঁচট খেয়ে উল্টে পড়ি বা হঠাৎ যদি পকেট থেকে কলমটা পড়ে যায়।

গোমতী আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। এমনি করে মায়ের জীবন থেকেও হারিয়ে গিয়েছিল বুড়িগঙ্গা। অবশ্য আমি ইচ্ছে করলে অনায়াসেই ত্রিপুরায় গিয়ে দেখে আসতে পারি গোমতীকে। দেখে আসতে পারি ঠিকই কিন্তু তবুও কি তাকে আর ফিরে পাবো ? যদি আবার গোমতীর ধারে গিয়ে বসতে পারতাম আর পাশে থাকত মা তাহলেই বুঝি ভুলতে পারতাম যন্ত্রণা। আসলে মাকেও তো আমি হারিয়ে ফেলেছি। গোমতীকে তাই আমি আর সত্যিই কোনদিন ফেরত পাব না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *