পাঠক মিত্র
উপন্যাসের নায়ক শব্দ নিজেই যা বাংলা সাহিত্যে প্রথম বলা যেতে পারে
শব্দের স্রোত অবিরত ভেসে চলেছে চারপাশে । ভেসে চলেছে সব শব্দের স্রোতে । সেই স্রোতের কোনো শব্দের প্রতিক্রিয়ায় কেউবা নিঃশব্দ, আবার কেউবা প্রতিক্রিয়ামুখী । কেউবা আবার শব্দের স্রোতে খুঁজে বেড়ায় এমন এক শব্দ যে শব্দের ঝাঁজে জড়িয়ে থাকে এমন এক রঙ, রস যা খুঁজে বেড়ায় যাঁরা তাঁদের একপ্রকার পাগল বলে যাঁকে অবশ্য বলা যায় শব্দ-পাগল । কখনো সে হয়তো শুনতে পায় শব্দের দুঃখ, কান্না, কখনো বা আনন্দ, আবার কখনো সে হয়তো নিজে কাঁদে শব্দের জন্য । শব্দ নিয়ে নানা অনুভূতি ও তার প্রকাশের আকুতি নিয়েই কথাকার শরদিন্দু সাহা’র ‘তিনটি উপন্যাস’ এক মলাটে, যা ইংরেজিতে ‘ট্রিলজি’ বললে সম্পূর্ণভাবে তা বলা হয় ।
প্রথম উপন্যাস এক শব্দ-পাগল মানে শব্দ-সন্ধানীর কাহিনী নিয়ে ‘একটি শব্দের জন্য’ । শব্দের স্রোতে শব্দের সন্ধানে শব্দ-পাগল অভিমন্যু ঘুরে বেড়ায় কখনো তার স্বপ্নে, কখনো পথে পথে, লেখক হয়ে ওঠার তাগিদে । বইপাড়ার অলিতে গলিতে প্রকাশকের দরজায় দরজায় । প্রতিনিয়ত শব্দের মিছিল সুশৃঙ্খলভাবে বন্দি হচ্ছে যেখানে । পাশাপাশি পথচারী, ক্রেতা-বিক্রেতা, বই নির্মাণ শিল্প ও শিল্পীর নানা শব্দের চক্রবূহ্যে কখনো আটকে পড়ে অভিমন্যু । সেই চক্রবূহ্য ভেদ করতে পারে এমন শব্দবানের সন্ধানে তার চিন্তাভাবনা বিদ্ধ হলেও সঠিক শব্দ খুঁজে না পাওয়ার যন্ত্রণায় নিঃশব্দ কাতরাতে থাকে কখনও । চিন্তার ফাঁকে ফাঁকে বুদবুদ উঠে জড়িয়ে দেয় কত কথার কাহিনী । যদি তার একটু একটু করেও উদ্ধার করতে পারে মণিমুক্তো । এই আশায় তার মাথার চারপাশে ঘুরতে থাকে শব্দের ঝাঁজ । সেই ঝাঁজ থেকে জন্ম নেয় আরও শব্দ । এভাবে কখন তার ভাবনার দরজা খুলে যায় । শব্দগুলো ধিক ধিক আওয়াজে শব্দের নির্মাণ ভাষাকে জড়িয়ে স্মৃতিমেদুর করে তোলে । কত কল্পনার সেতুকে জোড়া লাগিয়ে কত অজানা দেশে নিয়ে চলে যায় । মানুষ আর প্রকৃতির মিশে যাওয়ার যে আকুতি তাকে কখনো ধরে ফেলে । তবুও সে মনে করে শব্দের প্রত্যাশা থেকে বেঁচে ফেরা অত সহজ কাজ নয় । তাই হয়তো কখনো সে প্রশ্নের সাথে মনে মনে বলতে থাকে, শব্দ কি মানুষ তৈরি করার কোনো ক্ষমতা রাখে ? নাকি বাতাসের হিসহিসানিকে সঙ্গে নিয়ে শব্দ তার রূপ খুঁজে পেতে চায় । শব্দের রূপ দেখার দ্বন্দ্বই তো তার ভেতর বাহিরে । এই দ্বন্দ্ব নিয়ে তাঁর মনে হয় যেন একসময় শিল্পীসত্ত্বা ব্যক্তিসত্ত্বাকে ছাপিয়ে যায় । এই সত্ত্বায় সে অবাক হয়ে পড়ে কতশত শব্দের নাড়াচাড়ায় বইয়ের পৃথিবীর জন্মে । তবুও এক নতুন সমীকরণের পাঁজরে জীবনটাকে দেখার তাগিদে সেই জন্ম থেকে রূপের ঘ্রাণ নেওয়া, অন্তহীন অক্ষরের ব্যাপারি সাজা, সবটাই যেন তার কাছে কেমন গোলমেলে লাগে ।
এভাবে কথাকার শব্দ-সন্ধানী অভিমন্যুর শব্দ খোঁজার পরিক্রমায় তুলে ধরেছেন কলেজস্ট্রিট বইপাড়ার এক ইতিহাসকে । তার চলমান ইতিহাসে শব্দের পাহাড় গড়ার অজস্র কারিগর, যাঁরা ঘাম ঝরিয়ে চলেছে তাঁদের দুঃখের অনুচ্চারিত শব্দে । তবু সংস্কৃত কলেজের সাইনবোর্ডে বিদ্যাসাগর কোন অঙ্গীকারে আজও চেয়ে আছেন যাঁকে একদিন তাঁর সমাজ-পরিবার বিসর্জন দিয়েছেন । পরবর্তী সময়ে বিপ্লবে আত্মহুতির শব্দের আগুন ছড়িয়েছিল যাঁরা । বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ,শরৎচন্দ্র থেকে নজরুল সবার স্পর্শ পেতে নিজেদের অক্ষমতার প্রশ্ন উঠে আসে । আর আজকে লেখকদের সেই শিরদাঁড়া হারিয়ে যাওয়ার কথা উঠে এসেছে যাঁরা প্রতিনিয়ত সমঝোতা করে চলেছে । কিন্তু অভিমন্যু সে কোনো সমঝোতার পথে হাঁটার কথা ভাবেনি । তাই সে বইপাড়ার অভিষেক, সুধীর, সুবর্ণ আর সুমন্তদের শব্দের ভালবাসায় তাদের জীবনের অভাবকে সে দেখতে পারে । তাঁদের সেই অভাব সত্তেও নিজেদের আনন্দকে পরস্পর কিভাবে ভাগ করে নিতে পারে তাও দেখতে পায় । মিটিং, মিছিল, প্রতিবাদের ভাষা তাদের নেই । মালিক আর শ্রমিকের বৈষম্য নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই । অভিমন্যু শব্দ খোঁজার কষ্টেও এ বৈষম্য সে দেখতে পায় । এই বৈষম্যে সে নাম-না জীবনের দিকে ঘুরে যেতে পারে ধীরে ধীরে । যারা জীবনের জমিতে হাল চষেছিল, বপন করেছিল বীজ, তাদেরই ছুঁয়ে ফেলতে চায় । কিন্তু এ-ও এক জীবনে সম্ভব নয় বলেই তার মনে প্রশ্ন জাগে । তাই কত দুঃখ, কত যন্ত্রণা নিয়ে শব্দগুলোর হাহাকার শুনতে পায় সে। আর এভাবে শব্দের মধ্যে অন্তরিন হয়ে শব্দ বেঁচে ওঠে তার বাঁচার মধ্যে ।
শব্দের বাঁচার মধ্যে নিজেকে বাঁচাতে শহরের অলিতে গলিতে দক্ষিণ থেকে উত্তর ফুটপাতের ব্যস্ততার ভিড় থেকে বস্তির ভিড়, মিছিলের শব্দ থেকে শহরের সারাদিনের ব্যস্ততার গভীরে প্রতিনিয়ত চলছে যেন শব্দের আখড়া । সেই আখড়ায় আখড়ায় অভিমন্যু এক শব্দ-কাঙাল হয়ে কথাকারের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘শব্দ-কাঙাল’এ কত সুর ও বেসুরো শব্দদের বাঁচাতে রাস্তা খুঁজতে চায়, বাঁচার তাগিদ ছড়িয়ে দিতে চায়, বাঁচাতে চায়, বাঁচতে চায় । বিশেষ করে মলঙ্গা লেন অভিমন্যুকে রোজ শিখিয়ে দেয় কোথা দিয়ে হেঁটে গেলে তার কলমটা শব্দে জড়াজড়ি করে কোন দিকে যাবে । হয়তো তার যন্ত্রণা বোধটা শব্দের এক নতুন জগতে নিয়ে যাবে ।
প্লাস্টিকের ছাউনি ঘেরা ঝুপড়ির গর্ভবতী নারীর জীবন যন্ত্রণার শব্দ উন্নয়নের আলোয় বিচার চলে না । যদিও পার্টির সাহায্যে ফুটপাতের জীবন । কিন্তু কোনো মিছিলের ব্যানারে এদের যন্ত্রণা লেখা থাকে না । ক্ষমতার অলিন্দের প্লানে এরা বেঁচে থাকে না । অভিমন্যুর কাছে মনে হয়, চারিদিকে যেন মড়ক লেগেছে । বিশেষ করে মানুষের আচরণে, আত্মবিশ্বাসে, আস্থায়, । আসলে সমাজ-রাজনীতির শব্দ পাল্টে যাচ্ছে । হিংসা ও নিষ্ঠুরতার শব্দের প্রশ্রয়ে রাজনীতির কুশীলবরা মানুষদের নিয়ে লোফালুফি করছে । সমাজ পীড়িত হচ্ছে মিথ্যা ভাষণে ক্ষমতার গন্ধে । পচা-গলা ধ্বস্ত মানুষগুলোর আলোর খোঁজে অভিমন্যু দৌড়োচ্ছে সঞ্জীবন মন্ত্রের খোঁজে শব্দগুলোকে জাগিয়ে তুলতে যা আধমরাদের ঘা মারবে । অভিমন্যুর ভিতরে নতুন শব্দের পৃথিবী জন্ম নিচ্ছে । কিন্তু তবুও সে যেন এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছে না । চারপাশ থেকে কারা যেন টেনে ধরছে যারা শুধু নিজেদেরকে চিনতে পারে না, অন্যদের চেনাতেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় । আসলে এরা কলম ধরে কিন্তু কলমের মান রাখতে পারে না । কিন্তু আলতাফ, ঋতুপর্ণ তাঁদের মেধা, পরিশ্রম আর জীবনদর্শনে হয়ে উঠেছে যথার্থ শব্দশিল্পী যেভাবে অভিমন্যু পৌঁছে যেতে চাইছে । তখন অভিমন্যু শব্দের আশা যেন খুঁজে পায় । যদিও তাঁদের সেই শিল্পের বাজার মূল্য নেই, মানে পাঠক-মূল্য নেই। তাই কিছু না-পাওয়ার হতাশা, যন্ত্রণা নিয়েও সাহিত্যের নতুন নতুন দ্বার উন্মুক্ত করার মঞ্চ তৈরির কথা ভাবে তারা যেখানে ভিন্ন চিন্তার শরিকরা নিরাপদ ও নির্ভাবনায় হাত-পা ছড়াতে পারে । কিন্তু কত মঞ্চই একসময় কখন কেমন ব্যক্তিময় হয়ে ওঠে । আসলে সকলের সাংগঠনিক না হয়ে ওঠার প্রবণতা থেকে ল্যাং মারামারি একটা সামাজিক ও এক অন্য রাজনৈতিক দূষণ । এই দূষণে সাহিত্যে আজ নতুন চিন্তার স্বাদ আর নতুন মননশীল সৃষ্টির আনন্দ থেকে পাঠক বঞ্চিত । ঋতুপর্ণের কথায় বৈষম্যের রাজনীতি থেকে সমাজের চেহারা থেকে কতই না পচনের গন্ধ বাতাসের ছড়াচ্ছে । আলতাফ মনে করে এমন যা কিছু ঘটছে তা জ্ঞানের বৈষম্যে । কিন্তু জ্ঞানের এই বৈষম্যে অভিমন্যুর মনে পড়ছে তার বাবার কথা । তার বাবা একদিন বলেছিলেন, বইয়ের জন্য কাউকে কাঁদতে দেখেছে কিনা । শব্দের জন্য সে কাঁদে । সে কান্না তার শব্দের প্রতি ভালবাসায় । বাবার কথা মনে পড়ছে, আজ যখন পাঠাগারে সাজানো বইগুলো কথা বলছে তার সঙ্গে। বইকে ভালবেসে কথা বললে শব্দগুলো বইয়ের পাতা থেকে জীবন্ত হয়ে মনের সাধে কথা বলতে থাকে । হৃদয়ে বাজে কথার শব্দ বৃষ্টির ফোঁটার মত । এ যেন এক জাদু যা দিয়ে সবার মন চুরি করে নিতে পারে । অভিমন্যু জানায় তার পূর্বজদের জীবনের পর জীবনে অজস্র সময় কেড়েছে শব্দের রূপ আর অন্তরের খোঁজে । সেই খোঁজে থাকে পুরনো বইয়ের গন্ধ পুরনো সময়ের অতীত আত্মীয়ের মতোই । পুরনো গন্ধ আর শব্দের মিলন বড় মধুর আর স্পর্শকাতর । এমনকি এই গন্ধে পোকামাকড়রাও কথা বলে ওঠে অভিমন্যুর সাথে । যেখানে তারা জেনে গেছে বইয়ের পাতায় এমন জিনিস আছে যা মানুষের মনের চাকাগুলোকে অনায়াসে চালিয়ে দিতে পারে । এক শব্দের কাঁপুনিতে পাঠাগার ধ্বংস হয়ে পড়ছে বলে অভিমন্যুর মনে হতেই মূহুর্তে পছন্দের বইগুলো জাপটে ধরতে চেয়েছে সে । বইগুলোর ফোঁপানো কান্না শুনতে পায় । সেই ধ্বংসাবশেষে মৃতপ্রায় হয়ে ভাবতে থাকে আলতাফ আর ঋতুপর্ণের লড়াই । সে লড়াই কি জেতা সম্ভব ? এ প্রশ্নের সাথে মনে করে সে, নিজের প্রিয় শব্দগুলো মাটির অতলে হারিয়ে যাচ্ছে যাদের আয়ু এক একটা গোটা জীবন, সেই শব্দ-সম্ভার মাটি খুঁড়ে কেইবা তুলতে পারবে ।
‘শব্দ-নৈঃশব্দ্য’-এ মানিকদা শব্দ সম্ভারের মালা অনায়াসেই গেঁথে ফেলেন । অভিমন্যু ও তার সমসাময়িক সকলের কাছে প্রিয় তাদের মানিকদা । যিনি নিঃশব্দে শব্দের মিছিলকে অতি সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। তিনি যেন সব শব্দ-সম্ভারকে তার লেখায় সাজিয়ে তোলার জাদু জানেন । তিনি হয়ে উঠেছেন প্রকৃত শব্দশিল্পী । কারণ তাঁদের মানিকদা জানেন শব্দ সমুদ্রে ডুবে থাকতে । যদিও অভিমন্যু মানিকদাকে ভাবের ঘরে ভেসে থাকার কথা বলেছিল যাতে জীবনের নিত্য নতুন ঘটনাগুলো মানিকদার জীবন থেকে হারিয়ে না যায় । কিন্তু মানিকদা তার উত্তরে বলেন, ডুবে থাকা আর ভেসে থাকা র হাজার যোজন ফারাকেই তাঁর বিচরণ এবং লড়াই । এমন মানস সমুদ্রে সাঁতার কাটতে পারেন বলেই নতুন লেখকদের লেখার সদর্থক প্রকৃত পরামর্শদাতা হয়ে উঠতে পারেন । ভালোকে ভাল বলার জন্য তার শব্দ কখনোই সৌন্দর্য হারায়নি । এমনকি পূর্বজ মহান লেখকদের লেখার আলোচনার আসরে তার আলোচনা এক একবার নতুন নতুনভাবে মাত্রা এনে দেয় । আসলে মানিকদা অন্তরের অতলে ডুব দিয়ে এক একটা শব্দকে ছেঁকে নিতে পারে । মনের মত শব্দের ভেলায় ভেসে বেড়াতে পারে নিজের বিশ্বে । কারও গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যানের হিসেব না কষে নিজেকে নিংড়ে নিতে জানে । এভাবে শব্দের অনুভবে ও অনুভবের শব্দে নিঃশব্দে বিষয়ের গভীরে ডুব দিয়ে নিঃশব্দের ভাষায় মধুর লেখা লিখে চলেন শুধু নিজের জন্য নয়, আগামী দিনে সবার জন্য ।
শব্দ পরিক্রমায় দুঃখ, কষ্ট, আকুতি, ক্ষোভ সবকিছুই শব্দের প্রতি স্রষ্টার প্রেম ও ভালবাসা । এ পথে স্রষ্টার জীবনযুদ্ধে নামাওঠার কাহিনী নিয়ে শরদিন্দু সাহা’র এই তিনটি উপন্যাসের কুশীলবের নায়ক ‘শব্দ’ নিজেই । সমস্ত শব্দকর্মী ও তাঁদের শ্রমের ফসলের স্পর্শলাভের আশায় যাঁরা থাকেন, তাঁদের সকলের কাছে এই ‘ট্রিলজি’ আলাদাভাবে এক প্রেরণা র সংকেত পৌঁছে দেবে, নিশ্চিত করে তা বলা যায় । আর একটা কথা বলতেই হয় শব্দকে ঘিরে এই ‘ট্রিলজি’ বাংলা সাহিত্যে প্রথম ত বটেই, তবে সাহিত্যের সব ভাষার ক্ষেত্রে সেই দাবি প্রতিষ্ঠিত-যে হবে না তা হয়তো সময় একদিন বলবে ।
তিনটি উপন্যাস– শরদিন্দু সাহা
ক্রিয়েটিভ পাবলিকেশন, কলকাতা-9
বিনিময়- 250 টাকা