প্রীতন্বিতা
নতুন মানুষ
ভ্যান ডেম অভিনীত সাইবর্গ সিনেমার কথা মনে পড়ে ? সাইবর্গ আসলে মানুষের এক নতুন প্রজন্ম যাদের শরীরে নানা রকম কলকব্জা জুড়ে মানব দেহের অনেক দুর্বলতা দূর করা হয়েছে। শোয়ার্জেনেগার অভিনীত টার্মিনেটর সিরিজের ছবিগুলিতেও এমন সব সাইবর্গদের দেখা যায়। টারমিনেটরের সাইবর্গরা আবার চেহারা পাল্টে অন্যরূপও ধরতে পারে। আমাদের পুরাণের কাহিনীগুলিতে দেবতা ও রাক্ষসদের দেখা যেত এমন অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী। যখন-তখন যেকোনো রূপ ধারণ করতে সক্ষম।
বাস্তবে জিন প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষকে কল্পবিজ্ঞানের বা পুরাণের এইসব বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ বা দেবতাদের আদলে গড়ে তোলার একটা চেষ্টা চলছে। মানুষের শরীর খুব একটা শক্তপোক্ত নয়। যেকোনো ছোটখাটো দুর্ঘটনাতেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর অসুখ-বিসুখে কাবু হয়ে পড়ে। শরীরের মাংস চট করে ছেঁড়া সম্ভব, হাড়গুলো ভঙ্গুর। চামড়ার আচ্ছাদনটাও মোটেই মজবুত নয়, একটু আঘাতেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেহভ্যন্তরস্থ প্রত্যঙ্গগুলিও অল্প আঘাতেই নষ্ট হতে পারে আর তেমন হলে মারাত্মক। যদি ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ স্বয়ংক্রিয়ভাবে মেরামত বা পুনরুৎপাদন করা যায় তো সমস্যাটা মিটতে পারে। জিন প্রযুক্তি ব্যবহার করে এমন নতুন মানুষ তৈরির কথা ভাবা হচ্ছে যারা এসব বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হবে। তার মেরুদন্ড আর শরীরের হাড়গুলো তৈরি হবে বিশেষ কোনো শক্ত পদার্থ দিয়ে। শরীর নাহয় পুনরুৎপাদন করা গেল, মনটা কিভাবে তৈরি হবে ? অক্সিজেনের অভাবে মস্তিষ্ক কয়েক মিনিটের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়। এর উত্তর হিসেবে ছোট দুটো ফুসফুস আর হৃদপিণ্ড শিরা ও ধমনী তন্ত্রের সমন্বয়ে গড়ে গলার কাছে আটকে দেওয়া হবে, প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য।
মানুষের পরিপাক ব্যবস্থাও বিশেষ সবল নয়। অনেক জৈব খাদ্য কণাকে প্রয়োজনীয় এনজাইমের অভাবে আমরা হজম করতে পারি না। পেটে কিছু নতুন গ্রন্থি জুড়ে বিশেষ বিশেষ ব্যাকটেরিয়ার চাষ করে এসব এনজাইম পাওয়া যেতে পারে। খাদ্যদ্রব্য সহজে হজম করতে পারলে বর্জ্য পদার্থ জমিয়ে রাখার অতবড় বৃহদান্ত্রের দরকার নেই। সাত মিটার লম্বা বৃহদান্ত্রকে কমিয়ে এক মিটার করলেই যথেষ্ট। পরিবর্তে পেটে প্রচুর চর্বি জমিয়ে রাখা যায়, খাবার না পাওয়া গেলে যাকে শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার করে বেশ কিছুদিন না খেয়েও থাকা সম্ভব।
মানুষের ইন্দ্রিয়গুলিকে আরো কর্মক্ষম করা যেতে পারে। মাছির মতো পুঞ্জাক্ষি জুরে দেওয়া গেলে দিনের মতো রাতেও মানুষ দেখতে পাবে। জীবন্ত আলোকোজ্জ্বল ব্যাকটেরিয়ার বসতি চোখের মধ্যে গড়ে তুললে নতুন মানুষ জলের তলায়ও দেখতে পারবে। বাদুড় আর সামুদ্রিক স্তন্যপায়ীদের মতো কানকে দেখার কাজে লাগানো যায়। উচ্চ কম্পাঙ্কের শব্দ মানুষ শুনতে পায় না, এটা শোনার জন্য কানে একটা অতিরিক্ত গ্রাহক যন্ত্র লাগানো যেতে পারে। পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে একটি অতিরিক্ত ইন্দ্রিয় নতুন মানুষকে দেওয়া যায় যাকে বলা হবে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। এর সাহায্যে মানুষ অন্যের মনের কথা পড়তে পারবে, অনাগত অনেক বিষয় বুঝতে সক্ষম হবে।
নতুন মানুষ জলেও তার বসতি স্থাপন করতে পারে। তিমি, ডলফিন, সিল মাছেদের মত স্তন্যপায়ীরা যদি জলে থাকতে পারে মানুষ কেন পারবে না ? মুশকিল হল জলের চাপে রক্তে মিশে থাকা গ্যাসগুলি শিরায়, স্নায়ুতন্ত্রে আর হৃদপিন্ডে বুদবুদ তৈরি করে মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এই সমস্যার সমাধান আগে দরকার। জলে থাকা স্তন্যপায়ীদের দৃষ্টান্ত এখানে গ্রহণ করা যায় আর দরকার উভচরদের মতো ফুসফুসের সঙ্গে একটি ফুলকা যা দিয়ে জলেও মানুষ নিঃশ্বাস নিতে পারবে। মানবভ্রূণে ফুলকার মতো একটি অকেজো প্রত্যঙ্গ দেখাও যায় যাকে জিন বিদ্যার সাহায্যে কর্মক্ষম করে নিলেই চলবে। এই মূল সমস্যা দুটির সমাধান খুঁজে পেলেই স্থলচরদের পাশাপাশি জলচর মানুষরাও এক সমান্তরাল সভ্যতা গড়ে তুলতে পারবে। সমুদ্রের তলায় থাকার জায়গা আর খাদ্যের কোন অভাবই থাকবে না।
নতুন মানুষ তারপর যাবে মহাকাশে। পৃথিবীর অনুরূপ একটি বায়ুমণ্ডল আর পরিবেশ ক্যাপসুলে ভরে নিয়ে গেলেও নিয়ে যেতে পারবে না পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ। অন্য গ্রহ বা উপগ্রহে গেলে সেই অঞ্চলের মাধ্যাকর্ষণ সহ্য করার মতো শারীরিক অবস্থা তৈরি করতে হবে। চামড়া হবে আরও শক্ত আর মোটা। চোখগুলো ঢাকতে হবে বিশেষ লেন্স দিয়ে। মাধ্যাকর্ষণ কম হলে শরীরের ভার বহনে পায়ের দরকার নেই। পাগুলিকে নতুন দু’ জোড়া হাত বানানো যেতে পারে। দুটো অতিরিক্ত ফুসফুস দরকার। একটাতে থাকবে সঞ্চিত অক্সিজেন, অন্যটাতে বর্জ্য কার্বন-ডাই-অক্সাইড রাখা যাবে।
এভাবেই ভবিষ্যতের নতুন মানুষ জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে এক উন্নত সভ্যতা গড়ে তুলবে কোন একদিন।