মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস
পঞ্চদশ পর্ব
পুরাতন মূল্যবোধ অবক্ষয়ের পচা ডোবায় নতুন ঝড় উঠেছে। যুগ পাল্টানোর ঝড় কিনা জানিনা তবে চিন্তা পাল্টানোর তো বটেই! এই পালটা হাওয়ার মুখে দাঁড়িয়ে পুরনো কথা ভাবতে যেন বেশি করে ভালো লাগে। সেই আমাদের পুরোনো পাড়া, সেই পুরোনো মানুষজন, সেই একটা সবাইকে নিয়ে সবার মধ্যে বাঁচার অন্য তাগিদ।
আমাদের বাড়ির একতলায় দাদুর ডিসপেনসারির কথা আগেই বলেছিলাম। প্রথম দিকে পূর্ব দিকের ঘরে ছিল চেম্বার। আমার জন্মের আগের কথা। পরে রাম মিত্তির দাদু ওদিকের ঘরে ওষুধের দোকান করে। সামনের চারটে ঘরের দুটো ওষুধের দোকানের, আর দুটো আমাদের চেম্বারের, আমি জ্ঞানত তাই দেখে আসছি। আরও পরে মিত্তিরদের ‘মিত্র মেডিক্যাল’ হাত বদল হয়ে যায় অনুপ লোদের হাতে। এই দোকান ঘর, এই চেম্বারের সূত্র ধরে কত মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠতা, আত্মিক যোগ স্থাপিত হয়েছিল, আবার কালের নিয়মে কত সম্পর্কে ভাঙনও ধরেছে। রামদাদু, দাদুর ছেলেরা – বিশেষ করে অরুণকাকা, অচিন্ত্য (শিবু) কাকার কথা, ওষুধের ডিস্ট্রিবিউশনের কাজের ছেলেদের মধ্যে কালীকাকার কথা বেশ মনে পড়ে। কি সুন্দর একটা জমজমাট ভাব তখন পাড়া জুড়েই! শিবুকাকার ভাইপোরা কালনায় এলে ওদেরও দেখা মিলত। এক সাথে ক্যারাম পেটা, গল্পের বই পড়ার মজা ছিল। শিবুকাকাদের খবর জানি না দীর্ঘ দিন। ও বাড়ির তৃষার সাথেই শুধু লেখালেখির সূত্রে মাঝে মাঝে দেখা হতো কালনায় থাকতে।
আমাদের বাড়িতে তখন কল ছিল না, মিউনিসিপ্যালিটির জল বাড়িতে আসার ব্যবস্থা ছিল না তখনও। নিত্যদিনের কাজ কুয়ো থেকে জল তুলে চলতো। কিন্তু রান্না, খাওয়া কুয়োর জলে করা হতো না। সেই জন্য বাইরে থেকে জলের ব্যবস্থা করতে হতো। রাস্তার ধারে বিভিন্ন জায়গায় ছিল টিউব কল। শশী বালা স্কুলের কাছে আর নিচের রাস্তায় টিউবওয়েল ছিল। ধারে যেখানে জল সংগ্রহ করে বাকিরা ঘরে ঘরে জল দিয়ে যেত। যারা নিজেরা বাইরের থেকে টিউবওলের জল সংগ্রহ করতে পারত না তারা বাঁকিদের সাথে কথা বলে বাড়িতে জলের ব্যবস্থা করত। আমাদের বাড়িতে যিনি জল দিতে আসতেন তাকে আমরা বলতাম গজানন জেঠু। জেঠুর আদি বাড়ি ছিল উড়িষ্যায়। কালনায় ফুল ব্যবসায়ী ধনীদের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন আর বাড়ি বাড়ি জল সরবরাহ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। বাঁশের বাঁকের দুদিকে তেলের টিন কেটে দড়ি বেঁধে ঝোলানো থাকতো। টিউব কল থেকে জল পাম্প করে করে ওই দুটো টিনে ভরে বারবার বিভিন্ন বাড়িতে জলের সরবরাহ করে বেড়াতেন। আমাদের বাড়িতে মাটির জালা ছিল। বাঁক থেকে জল জালায় ঢেলে রাখলে সেখান থেকে আবার মগে করে করে কুঁজোতেও ভরে নেওয়া হতো। একটু পরের দিকে ক্যান্ডেল লাগানো প্লাস্টিকের ফিল্টার কেনা হয়েছিল তাতে ওপরের প্রকোষ্ঠে জল ঢেলে দিলে জল পরিশুদ্ধ হয়ে নিচের প্রকোষ্ঠে এসে পড়তো। সেই জল কল খুলে গ্লাসে নিয়ে পান করা যেত। বোতল থেকে জল খাবার তখনও আমাদের মধ্যে প্রচলিত হয়নি। গজাননের মত এরকম বাঁকে বাঁকে জল সরবরাহ করে তখন সেই সময় অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। মাঝে মাঝে গজানন যখন দেশের বাড়ি যেতেন তখন অন্য কাউকে আমাদের বাড়িতে জল দেয়ার কথা বলে যেতেন। আমরা ভাই-বোনেরা যখন বেশ খানিকটা বড় হয়ে গেছিলাম তখন আমাদের বাড়িতে মিউনিসিপ্যালিটির জলের লাইন এলো। তারপর নিজেরাই নিজেদের খাবার জল ভরে নিতে পারতাম। সব বাড়ি থেকেই গজানন জেঠুদের প্রয়োজন ফুরিয়েছিল ধীরে ধীরে।
সকাল বিকেল গজানন জেঠুর জল দিতে আসার কথা খুবই মনে পড়ে। সে সেদিনটার কথাও মনে পড়ে, যেদিন উঠোনে বসে পুতুল খেলছিলাম আর গজানন জেঠু এসে খবর দিলেন, ইন্দিরা গান্ধী নাকি খুন হয়েছেন।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত হয়ে গেছিলেন যে সমস্ত মানুষজন তেমনি একজন গজনন জেঠু। জেঠুর কথা ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল বসুমতি পিসির কথা। বসুমতি পিসিরা ছিল হরিজন। এবং আমাদের সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ আজও এই হরিজনরা। আজ থেকে কুড়ি তিরিশ বছর আগেও এদের ছাড়া আমাদের প্রতিটি দিন চলা কষ্টদায়ক ছিল কারণ তখনো শহরের সমস্ত বাড়িতে উন্নত শৌচাগার ছিল না। মানুষের পুরুষ তখনও মানুষের দ্বারাই বহন করে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হত। পৌরসভায় হরিজনদের মধ্য থেকে এই কর্মী নিয়োগ করা হতো। সত্যি কথা বলতে কি এই ব্যবস্থাটার কথা ভাবতে গেলেও গলার কাছে একটা কষ্ট আটকে আসে।
যাই হোক, বসুমতি বেশি ব্যক্তিগতভাবেও আমাদের বাড়িতে কাজ করতেন। খুব সকাল সকাল বসুমতিপিসি এসে দরজা ধাক্কা দিত। আমাদের নিচের উঠোন, দাদুর ডিসপেনসারি ও তার সংলগ্ন ঘর ইত্যাদি ঝাঁটা দিয়ে পরিষ্কার করে ধুয়ে দিত। ডাক্তারখানাতে যে প্রাত্যহিক নোংরা জমতো, অর্থাৎ ড্রেসিং করার পর ফেলে দেওয়া পুঁজ রক্তমাখা ব্যান্ডেজ, ব্যবহৃত ওষুধ পত্রের ফয়েল, ইনজেকশনের ভয়েল, কাগজ পত্র ইত্যাদি জমা হতো সেগুলোকে পরিষ্কার করা ছিল তার কাজ। কখনো কখনো বসুমতি পিসির সঙ্গে পিসে, কখনো কখনো তাদের ছেলেরাও আসতো। মিউনিসিপ্যালিটি অফিসের পেছনদিকে হরিজন পল্লীতে ওদের পরিবার থাকতো। নিত্যদিনের এই আসা যাওয়ায় একটা টান ছিল পরস্পরের। বসুমতি পিসি ইহকালের মায়া কাটালেও পিসির ছেলেদের সাথে দেখা হলে পুরোনো নানা স্মৃতি ঘুরে ফিরে আসে।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)