তাপস সরকার

লেখক পরিচিতি 

( সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর  বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা।কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়।প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘ দিয়ে। পেশায় অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক। ) 

অধ্যায় : দুই

আমার কী বিপদ বলতে যাচ্ছিলাম। বিপদ একটি নয়, একাধিক। বিপদগুলির কথা বলতে হবেই। কিন্তু মুশকিলটা অন্য। রিক্তর সঙ্গে ঘুরে যেসব মানুষকে দেখছি মানুষ নয় আমাকে কি তাদের মত মনে হচ্ছে না ? আমার বিপদগুলির জন্য ? সত্যি যারা মানুষ তাদের কি এমন আজব বিপদ হয় ? এখন আমার মনে ক্রমাগত এই সন্দেহ জোরদার হচ্ছে, আমিও সত্যি মানুষ কিনা। আমার মধ্যে যেসব বিপদ ঘটছে, যেসব সমস্যার শিকার হয়ে চলেছি আমি তাতে তো নিজেকে আর সত্যি মানুষ বলে ভাবতে ইচ্ছে করছে না। সত্যি মানুষ তাহলে কে ?

রিক্তকে গিয়ে ধরলাম আমি। 

‘তুই তো আমাকে আচ্ছা ফ্যাসাদে ফেলে দিয়েছিস ! সব লোককে দেখলেই মনে হচ্ছে অস্বাভাবিক। কাউকে আর বিশ্বাস করতে পারছি না। এমনকি, নিজেকেও মানুষ বলে মনে হচ্ছে না।’

রিক্তকে চিন্তিত দেখাল। একটু সময় নিয়ে ভেবে সে বলল,

‘এক কাজ করি চল্। আমাদের খোঁজার দৃষ্টিকোণটা উল্টে দিই।’

‘কী রকম ?’

‘এতদিন কী দেখলাম ? হাজার হাজার মানুষের ভিড় থেকে খুঁজে বার করছিলাম কারা ঠিক মানুষ নয়। এবার বরং খুঁজে দেখি এই হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে কারা ঠিক ঠিক মানুষ।’

‘তাতে কী হেরফের হবে ?’

একটু উষ্ণ ছিল আমার গলার স্বর। রিক্ত বোঝাবার চেষ্টা করল। 

‘এতে সান্ত্বনার জায়গা থাকবে। এখন তুই প্রথমেই সবাইকে মানুষ ভেবে এগোচ্ছিস। পরে মানুষ নয় দেখে হতাশ হয়ে যাচ্ছিস। আর উল্টোভাবে চললে তুই প্রথমেই ভেবে নিবি যে এই হাজার হাজার মানুষের কেউ ঠিক মানুষ নয়। তারপর দেখতে হবে তার মধ্যেও কেউ ঠিক মানুষ কিনা। যদি দু’-একজনও ঠিক ঠিক মানুষ পেয়ে যাস তো তোর সব দুঃখ কেটে যাবে। মনে হবে পৃথিবীটা সত্যি সুন্দর এবং এখানে বেঁচে থাকা যায়।’

কথাটা আমার পছন্দ হল। কে মানুষ নয় খোঁজার চেয়ে কে মানুষ সেটা খোঁজা অনেক বেশি আশাব্যঞ্জক। সেই কাজটা কিভাবে শুরু করা যেতে পারে ?

‘এতদিন আমি লোক বাছাই করতাম। সেই লোকগুলিকে আমি জানতাম ঠিক মানুষ নয়। তোকে তাই দেখাতাম। এবার তুই লোক বাছাই করে নে। এমন লোক যাদের আমি চিনি না। তারপর খোঁজ নিয়ে দেখব তারা আসলে কী।’

কোন্ লোক বাছাই করব ? লোকে লোকারণ্য এই শহর থেকে লোক বেছে নিতে গিয়ে দেখলাম, কাজটা মোটেই সহজ নয়। ওপরে দেখে তো সবাইকে মানুষ বলেই মনে হয়। কিন্তু এই ক’দিন রিক্তর সঙ্গে থেকে আমার ধারণা পাল্টে গেছে। মানুষ দেখলেই মনে হয়, এটা একটা ছদ্মবেশ। আড়ালে লুকিয়ে আছে কোন রহস্য। লোক বাছতে গিয়ে মহা বিড়ম্বনায় পরে গেলাম। কয়েকদিন কয়েকজন লোককে যথাসম্ভব দেখে গেলাম। কোন অস্বাভাবিক আচরণ নজরে এলোনা কারোরই। মনে হল, এদের সবাই ঠিক ঠিক মানুষ। এদের মধ্যেই একজনকে বেছে নিলে হয়ে যায়। বাছাই করেই সন্দেহ হল, রিক্তর মত দেখার ক্ষমতা নেই আমার। তাই, যাকে বাছাই করেছি সে ঠিক তো ? প্রথমে ঠিক মনে হলেও এখন কেমন সন্দেহ হচ্ছে। হয়তো দেখা যাবে লোকটার দু’টো শিং আছে, কখনো গজায় কখনো লুকিয়ে থাকে। অর্থাৎ লোকটা ঠিক মানুষ নয়। সবার ক্ষেত্রেই এইরকম মনে হতে লাগল আমার। আজ একে বাছি তো কাল বাদ দিই। এই করে করে কাউকে আর বাছাই করা হয়ে ওঠেই না। 

আসলে আমার মধ্যে একটা ভয় ধরে গিয়েছিল। যাকে বাছাই করছি সে যদি ঠিক মানুষ না হয় ? রিক্তর কল্যাণে এই ভয়। তার সঙ্গে এই ক’দিন ঘুরে ঘুরে যাদের দেখেছি তারা সবাই কোন না কোনভাবে অন্যরকম। ওপরে তাদের দেখে কে বলবে তারা ঠিক মানুষ নয় ? কেউ চব্বিশঘন্টা লেগে থাকলেও বলতে পারবে না। একেবারে অতি আপনজনের পক্ষেও কারো গোপন রহস্য জানা প্রায় অসম্ভব। আমি বাজি রেখে বলতে পারি যে গদাধর পাকড়াশির স্ত্রী কিংবা ছেলেমেয়েরা কেউ জানেই না ভদ্রলোকের গোপন ব্যাপারটা। কিন্তু রিক্ত জানে, আর তার কল্যাণে জেনেছি আমি। আসলে এইসব গোপন বিষয় জানতে হলে দরকার বিশেষ চোখ, বিশেষ অনুভুতি। সেটা সবার থাকে না।  

ইন্দ্রায়ুধ মুখুজ্জেকে শেষপর্যন্ত আমি বেছে নিলাম। আমার পাড়াতেই থাকেন। অনেকদিন ধরে লোকটাকে আমি দেখে আসছি। মৌখিক আলাপও আছে তাঁর সঙ্গে। তেমন কিছু দহরম-মহরম ভাব না থাকলেও কোনদিন অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েনি। বেশ সুপুরুষ, বয়স চল্লিশের কোঠায়। ইঞ্জিনীয়ার। রোজ নিজেই গাড়ি চালিয়ে কাজে বেরোন। সঙ্গে স্ত্রী দ্রোহিনীকে নিয়ে যান। ভদ্রমহিলা সুন্দরী এবং কোন একটা অফিসে চাকরি করেন। তাঁদের কোন ছেলেমেয়ে নেই। পাড়াতে রয়েছে সুন্দর দোতলা বাড়ি। ছুটির দিন ছাড়া রোজ সকালে দু’জনে একই সঙ্গে বেরিয়ে যান, রাতে ফেরেনও একসঙ্গে। বাড়িতে এছাড়া আর কেউ থাকে না। 

দিন কয়েক রিক্ত আর আমি বাইরে বিভিন্ন জায়গায় তাঁদের পিছনে লেগে রইলাম। তেমন কিছুই নজরে এল না। নিয়ম করে অফিসে যাওয়া, অফিস সংক্রান্ত কাজেই অন্য কোথাও ঘোরাঘুরি, এক-দু’দিন কোন হোটেল বা রেস্তোরাঁতে খাওয়া-দাওয়া—- এর বাইরে আর কিছু নেই। রাতে দু’জনে একসঙ্গে বাড়ি ফিরে গাড়ি একতলার গ্যারেজে ঢুকিয়ে দিয়ে ভিতরে চলে যান। আবার পরদিন সকালে একসঙ্গে কাজে বেরোন। তাহলে কি এঁদের কোন রহস্য নেই ? এঁরাই কি ঠিক ঠিক মানুষ ? রিক্ত সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। সে যে কী বোঝে কেজানে ! আমাকে বলল,

‘বাড়ির বাইরে এঁদের কোন রহস্য নেই। এঁদের সব রহস্য রাত্তিরে, বাড়ির ভিতর।’

‘তুই কি ভাবছিস এঁরাও ঠিক মানুষ নয় ?’

আমার প্রশ্ন শুনে রিক্ত দায়সারা ভঙ্গিতে জানাল,

‘মানুষের আসল রূপ কখন প্রকাশ পাবে কেউ জানে না। অন্যের কথা বাদ দে, সে নিজেও অনেক সময় জানে না সে আসলে কে।’

বড়োই গোলমেলে ব্যাপার। বুঝতে চেষ্টা করলে পাগল হয়ে যাব। তার চেয়ে ভাল রিক্ত যা করে তার সঙ্গে তাই করে যাওয়া। আমরা এবার ইন্দ্রায়ুধ ও তাঁর স্ত্রী দ্রোহিনী বাড়ি ফেরার পর সারা রাত কিভাবে কাটান, কোন রহস্যজনক কাজে লিপ্ত হন কিনা সেইদিকে মনোযোগ দিলাম। বড়জোর দু’দিন পরই ঘটনাটা ঘটল। রাত তখন একটা হবে। অনেক আগেই তাঁরা খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়েছিলেন। ঘুমিয়েও গিয়েছিলেন অবশ্যই। হঠাৎই ইন্দ্রায়ুধ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ঘরে হালকা নীল আলো জ্বলছিল। তার মধ্যে দিয়ে হেঁটে হেঁটে ভদ্রলোক বাথরুমে গেলেন। আলো জ্বালালেন। বাথরুমের মধ্যে রয়েছে একটা জলভর্তি বাথটাব। ইন্দ্রায়ুধ সেই জলে সারা শরীর ডুবিয়ে শুয়ে পড়লেন। বাথরুমের দরজা খোলাই ছিল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে দ্রোহিনী বাথটাবের পাশে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর হাতে একটা বোতল। ছিপি খুলে সেই বোতল থেকে হলদে রঙের কিছু একটা তরল পদার্থ জলে ঢেলে দিয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন। গিয়ে আবার নিজের বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। আর ওদিকে বাথরুমে কী কাণ্ড ঘটছিল ? ইন্দ্রায়ুধের শরীর একটু একটু করে জলের মধ্যে গলে যেতে লাগল। মনে হচ্ছিল তাঁর শরীরটা যেন চিনির ডেলা। ঘন্টাখানেকের মধ্যে সমস্তটা শরীর জলে গুলে মিশে গেল। ইন্দ্রায়ুধের চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট রইল না। বাথটাবের জল যেমন ছিল তেমনই থেকে গেল। জলের রঙ বা পরিমাণের কোন পরিবর্তন ঘটল না। 

ভোরবেলা দ্রোহিনী আবার বাথরুমে এলেন। প্রথমেই বাথটাবের ছিপি খুলে দিলেন। গলগল করে সব জল বেরিয়ে গেল। পরে রইল সাদামতন কী একটা পদার্থ। অন্য একটা বোতল থেকে দ্রোহিনী তাতে সবুজ রঙের তরল ঢেলে দিলেন খানিকটা। সেই থকথকে সাদা পদার্থটা ফুট ফুট করে ফুটতে লাগল। খানিকটা সময়ের মধ্যেই বাথটাবে আবার ইন্দ্রায়ুধ ফিরে এলেন। অবিকল আগের চেহারায়। 

পরদিন রাতে একই কাণ্ড ঘটতে দেখলাম দ্রোহিনীর ক্ষেত্রে। আমরা তারপর আবিষ্কার করলাম যে ইন্দ্রায়ুধ আর দ্রোহিনী সপ্তাহে অন্তত একদিন রাতের বেলায় চার-পাঁচ ঘন্টার জন্য জলের সঙ্গে মিশে যান। এবং এভাবেই তাঁরা বেঁচে থাকেন। 

আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য হল রাধামাধব বস্ত্রালয়ের মালিক জনার্দন সাহা। ভদ্রলোক ঘোর সংসারী, পোড় খাওয়া ব্যবসায়ী। কল্পনা-টল্পনা তাঁর ধাতে নেই। চা ভেবে চা-ই খান, মুড়িকে মুড়িই বলেন। আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম যে এই ব্যক্তির ক্ষেত্রে অন্যরকম কিছু ঘটার সম্ভাবনা নেই। এমন কাঠখোট্টা লোক, আবেগ বলে কোন বস্তুর সঙ্গে যাঁর কোন পরিচয় নেই তাঁর ক্ষেত্রে কী আর রহস্য থাকতে পারে ? রিক্ত আমার কথা মন দিয়ে শুনল এবং বলল,

‘একটা কথা তুই বারবার গুলিয়ে ফেলছিস। ওপর দেখে মানুষ চেনা যায় না। মানুষের আসল রূপ একটা অন্য ব্যাপার। সব ধারণা গোলমাল করে দেয়।’

আমি উত্তর দিলাম না, প্রতিবাদ জানাবার কোন কারণ ছিল না বলে। এখন পর্যন্ত যা দেখেছি তাতে আমার কোন ধারণা দাঁড়াতেই পারছে না। রিক্ত যা সন্দেহ করছে মিলে যাচ্ছে যেমন করেই হোক। 

জনার্দনবাবুর তিন ছেলেমেয়ে। বিশাল তিনতলা বাড়ি। স্ত্রী ছাড়াও বাবা আছেন তাঁর। কাজের লোকও আছে একজন। ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করে। স্ত্রী ভদ্রমহিলার দশাসই চেহারা, সবসময় সেজেগুজে থাকেন। আর ব্যবহারও বিশেষ মধুর নয়। সবার সঙ্গে রেগে রেগে কথা বলেন। যেমন স্বামী তেমন স্ত্রী। 

বাড়ির একতলায় গোডাউন। সেখানে কর্মচারীদের আনাগোনা। দোকান বন্ধ করে দশটার মধ্যে বাড়ি ফিরে একতলার একটা ঘরে বসে জনার্দনবাবু ঘন্টাখানেক কর্মচারীদের সঙ্গে কাটান। হিসেবে-নিকেশ করেন। যাই হোক না কেন, রাত বারোটার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি সমস্ত কাজকর্ম সেরে বাড়ি অন্ধকার করে ঘুমিয়ে পড়েন সবাই মিলে। এটাই নিত্যদিনের নিয়ম। কোন ব্যতিক্রম হয় না। 

বাড়ি তো অন্ধকার হয়ে যায়, তারপর কী হয় ? কী আর হবে, সবাই মিলে অবশ্যই ঘুমিয়ে পড়ে। এটাই স্বাভাবিক। সবাই তাই ভাববে। রিক্তর ভাবনা অন্যরকম। তার ধারণা, বাড়ি অন্ধকার হওয়ার পরই কিছু ঘটে। কী ঘটে সেটাই রহস্য। সেটাই আমাদের দেখার বিষয়। 

তিনতলায় একটা বড় হলঘর আছে। দোতলার সব আলো নিভিয়ে জনার্দন সেই ঘরে উঠে এলেন। সঙ্গে তাঁর তিন ছেলেমেয়ে, স্ত্রী এবং বাবা। একতলার আলো আগেই নেভানো ছিল। সারা বাড়িতে তখন কেবল তিনতলার ঘরেই আলো জ্বলছে। ঘরের দুই প্রান্তের দুই দেয়ালে একটা করে মোটা হুক পোঁতা। শক্তপোক্ত ও লম্বা একটা দড়ির একপ্রান্ত জনার্দন একদিকের দেয়ালে হুকের সঙ্গে বাঁধলেন। দড়ির অন্যপ্রান্ত বাঁধলেন অন্যদিকের দেয়ালটার হুকে। দু’প্রান্তে হুকের সঙ্গে বাঁধা দড়ি টানটান হয়ে রইল। জনার্দন এবার তাঁর সবচেয়ে ছোট ছেলেটাকে কোলে নিয়ে উঁচু করে তুলে ধরলেন। বাচ্চা ছেলেটা দু’হাতে দড়ি আঁকড়ে ঝুলে পড়ল। তাঁর বড়ছেলে আর মেয়ে ওপরদিকে লাফ মেরে মেরে দড়িটা ধরে নিয়ে ঝুলতে লাগল। স্ত্রী দু’হাত তুলেও একটুর জন্য দড়ির নাগাল পাচ্ছিলেন না। জনার্দন কোমর ধরে একটু তুলতেই ভদ্রমহিলা দড়িটা দু’হাত দিয়ে ধরে ফেললেন। তাঁর বাবা পায়ে ডিঙি মেরে দড়ির নাগাল পেয়ে গেলেন। সবশেষে জনার্দন। তিনি প্রথমে ঘরের আলো নেভালেন। চারদিক অন্ধকার হয়ে যেতে প্রথমে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। চোখ সয়ে যাওয়ার পর জনার্দন সতর্ক পায়ে তাঁর বাবার পাশে এসে দু’হাত তুলে একটু চেষ্টাতেই দড়ির নাগাল পেয়ে গেলেন। অন্ধকার হলঘরে সবাই এভাবে দড়ি ধরে ঝুলতে লাগল। মিনিট দুয়েক পর জনার্দনের গলা শোনা গেল। অস্ফুট গলায় তিনি বলছিলেন,

‘হিটিঙ্গা ফিচিফিচি নাটিঙ্গা। নাটিঙ্গা হিচিহিচি ফিটিঙ্গা।’

তারপর দেখা গেল আজব কাণ্ড। জনার্দনের বউ হয়ে গেলেন একটা শাড়ি, ছেলে দু’জন দু’টো শার্ট, মেয়েটা ফ্রক, বাবা ধুতি আর জনার্দন নিজে একটা লুঙ্গি। সারারাত দড়িতে মেলে দেওয়া অবস্থায় ধুতি, শার্ট, লুঙ্গি, ফ্রক আর শাড়ি হয়ে ঝুলতে লাগল জনার্দন সাহার গোটা পরিবার। বাড়ির কাজের লোকটার যে কী হল বা সে কোথায় কিভাবে থাকল তা অবশ্য বোঝা গেল না। 

একসময় রাতের অন্ধকার ফিকে হয়ে এল। পাখিটাখি ডাকতে লাগল। তিনতলার হলঘরে ঘষা কাচের জানলা দিয়ে আলোর আভাষ পাওয়া গেল। বোঝা যাচ্ছিল ভোর হয়ে আসছে। ঘরের ভিতর থেকে অন্ধকার কেটে যেতেই দড়িতে ঝুলন্ত লুঙ্গি হয়ে গেল জনার্দন, ধুতি তাঁর বাবা, শাড়ি আবার স্ত্রী এবং শার্ট ও ফ্রক ছেলেমেয়েরা। দড়ি ছেড়ে দিয়ে ঝুপ ঝুপ করে নেমে এল সবাই মেঝের ওপর। হুক থেকে খুলে দড়িটা জনার্দন ঘরের কোণায় গুটিয়ে রাখলেন। 

এরপর আর কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবার ভরসা পাচ্ছিলাম না। রিক্ত আমার অবস্থা বুঝে বলল,

‘আর একটু দেখতে পারিস।’

‘আর দেখে কী হবে ? আমার তো মনে হচ্ছে কেউই ঠিক মানুষ নয়।’

হতাশ গলায় বললাম আমি। রিক্ত আশা দিয়ে জানাল,

‘না রে, আছে। কেউ না কেউ ঠিক মানুষ হতে বাধ্য। তাদের খোঁজ পাওয়াটাই শক্ত কাজ। তবুও তারা আছে। তারা না থাকলে মানুষের চেহারা বরাবরের জন্য অন্যরকম হয়ে থাকত। কোন মানুষকেই তুই মানুষের চেহারায় দেখতে পেতিস না। সে একটা বিচ্ছিরি অবস্থা হয়ে যেত।’

রিক্তর কাছে উৎসাহ পেয়ে ভাবলাম, আরও একটু দেখাই যাক। আবার আরেকজন কাউকে বেছে নিতে হবে। পছন্দ করার দায়িত্বটা আমার ওপরই থাকল। খুব একটা ভাবনা-চিন্তা করতে গেলাম না। হাতের কাছে পেয়ে গেলাম মৌনাক্ষিকে। রিক্তকে বললাম তার কথা।  

মৌনাক্ষি গুহ। একাই ভাড়া থাকে একটা বাড়ির একতলাতে। এই বাড়িতে থাকছে সে তার জন্ম থেকে। বাড়িটা ভাড়া নিয়েছিলেন তার বাবা। তিনি চাকরি করতেন ব্যাঙ্কে। বাবা-মা দু’জনেই মারা গেছেন অন্তত সাত-আট বছর হবে। বাড়িটা ছেড়ে সে অন্য কোথাও যায়নি। বাড়িওয়ালা মাসিমা-মেশোমশাইও তাকে স্নেহ করেন। নিজে মৌনাক্ষি একটা স্কুলে পড়ায়। 

তার তেমন বন্ধুবান্ধব নেই। স্কুলে সহকর্মীদের সঙ্গেও খুব যে ভাব-ভালোবাসা এমন নয়। কারো স্বভাব এরকমই, খুব একটা মিশুকে হতে পারে না। মৌনাক্ষি তাই একা হয়ে আছে। নিজের একাকিত্ব দূর করতে সে অনেকগুলি বেড়াল পোষে। ঘটা করে আবার নাম রেখেছে প্রত্যেকের। কেউ কুচি, কেউ ঘোলা, কেউ হামি, কেউ ঝোলা—- এমনধারা নাম সবার। স্কুল না থাকলে সারাদিন কাটে তার বেড়ালগুলির সঙ্গে। তাদের জন্য সে রান্না করে, খাওয়ায়-দাওয়ায়। গল্পগুজব করেও সময় কাটায়। পাড়ার সবাই মৌনাক্ষিকে চেনে তার বেড়ালগুলির জন্য। 

রিক্ত আর আমি তার অলক্ষে তার পিছনে লেগে রইলাম। অবশ্য লেগে থাকার আর কী আছে ? স্কুলে ছাড়া সে কোথাও যায় না। স্কুলের সময়টুকু বাদ দিয়ে সে বাড়িতেই থাকে সবসময়। প্রথমদিন তার সঙ্গে গেলাম, আবার বাড়ি পর্যন্ত ফিরে এলাম। দ্বিতীয়দিন আবার সে যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্কুলের দিকে যাচ্ছে আমরা তার পিছু নিলাম। যেতে যেতে রিক্ত আমাকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,

‘গতকাল তুই মেয়েটিকে ভাল করে দেখেছিলিস ?’

‘হ্যাঁ।’

একটু অবাক হয়ে উত্তর দিলাম। রিক্ত পাল্টা প্রশ্ন করল,

‘আজকেও ভাল করে দেখছিস ?’

‘দেখছি তো। হয়েছেটা কী ?’

আসলে তুই ওকে ঠিকমত কালও দেখিস নি, আজও দেখছিস না।’

রিক্ত গম্ভীর গলায় তার অভিমত জানাল। আমি উত্তর দিতে গিয়ে একটু রেগেই গেলাম,

‘মানে ? কী বলতে চাইছিস ?’

‘ভাল করে দেখলে তুই বুঝতে পারতিস, কালকের মৌনাক্ষি আর আজকের মৌনাক্ষি এক নয়।’

ব্যাপারটা আমার কেমন গোলমাল পাকিয়ে গেল। হতভম্ব গলায় প্রশ্ন তুললাম,

‘তুই কী করে বুঝলি ?’

‘দেখে। এমনি দেখলে বোঝা যাবে না। মনে হবে একজন মৌনাক্ষিকেই দেখছিস। কিন্তু একজন নয় মোটেও। সূক্ষ্ম একটা পার্থক্য আছে। এইযে অদল-বদল, আমার বিশ্বাসটা ঘরেই হয় এবং রাত্তিরে।’

বাড়ি ফেরার পর সেদিন রাতে আমরা তার ওপর নজর রাখলাম। বেড়ালদের নিয়ে তার ব্যস্ততা চলল রাত ন’টা পর্যন্ত। রান্নাবান্না, গল্পগুজব, খাওয়া-দাওয়া। নিজেও খেয়ে নিল সে। বেড়ালদের সঙ্গে নিয়ে টিভিও দেখল কিছুক্ষণ। রাত দশটা নাগাদ ঘুমোবার আয়োজন করল। বেড়ালদের শোওয়ার জন্য খাট আর বিছানারও ব্যবস্থা আছে। সবাইকে তাদের বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর কুচি নামের বেড়ালটাকে তুলে নিল তাদের মধ্যে থেকে। কুচিকে নিয়ে সে শুয়ে পড়ল নিজের বিছানায়। দেখা গেল, সে জড়িয়ে ধরে আছে কুচিকে এবং কুচিও তার সামনের দু’টো পা দিয়ে তাকে ধরে রাখল। তারপর দেখা গেল একটা রূপান্তর প্রক্রিয়া। মৌনাক্ষি আস্তে আস্তে কুচি হয়ে গেল আর কুচি পাল্টে গেল মৌনাক্ষির চেহারায়। এই কাণ্ডের পর দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়ল। 

পরদিন মৌনাক্ষি বেড়াল হয়ে বাড়িতে থেকে গেল আর তার চেহারা নিয়ে কুচি চলে গেল স্কুলে। বিকেলে বাড়ি ফেরার পর মৌনাক্ষিরূপী কুচি অন্য বেড়ালদের নিয়ে মাতামাতি করতে লাগল, যেমন দেখেছিলাম আগের রাতে। রাত দশটার পর মৌনাক্ষি, অর্থাৎ কুচি অন্য বেড়ালদের তাদের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ঘোলাকে নিয়ে এল নিজের সঙ্গে। তারপর আবার সেই রূপান্তর প্রক্রিয়া। ঘোলা পেয়ে গেল মৌনাক্ষির শরীর আর কুচি হয়ে গেল ঘোলা। পরদিন মৌনাক্ষিরূপী ঘোলাই গেল স্কুলে পড়াতে। 

আমার কেমন সব তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল। রিক্তর কাছে জানতে চাইলাম,

‘রোজ রাতেই তো পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। একেকটা বেড়াল পেয়ে যাচ্ছে মৌনাক্ষির শরীর। কোন্ বেড়ালটা ছিল আসল মৌনাক্ষি, যেখান থেকে এই পরিবর্তনের সূচনা ?’

রিক্ত কিছুটা হতাশ ভঙ্গিতে জানাল,

‘আসল মৌনাক্ষি হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে তার বেড়ালদের মধ্যেই। তাকে আর কোনদিন খুঁজে পাওয়া যাবে না।’  

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *