রক্তিম ভট্টাচার্য

যে রাতে প্রথম রাক্ষুসে চাঁদটা তার আগুনের মতো বিশাল মুখ নিয়ে লোকটাকে গিলে খেতে এল, সেদিনই সে বুঝল, এই পৃথিবীতে তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে এই মুহূর্তেই। কোনও অলীক আশাবাদ নিয়ে বেঁচে থাকার একটুও ইচ্ছে তার কখনও ছিল না। সে বরাবর চেয়েছিল, যখনই সে চন্দ্রাহত হবে এক ঝড়ের রাতের ফাঁকে, যখন প্রবল হাওয়ার পাক আর মেঘের আদিম আড়াল থেকে হাঙরের পাখার মতো জেগে উঠবে লাল গোলার মতো চাঁদ, সেদিনই সে বুঝবে, এই পৃথিবীতে সে বাড়তি মানুষ একজন। তখনই সে কোনও এক দেশে পাড়ি দেবে, যেখানে শুধু তুষারের রাজত্ব চলে। মানুষ থেকে প্রেত- সবাই কেবল তুষারের অবয়ব। তাদের প্রাণে, শ্বাসবায়ুতে বরফের ঢেউ আর শিরা ফেটে যাওয়ার মতো ঠাণ্ডা হাওয়া। লোকটা বুঝল, তার তুষারযাত্রার দিন সমাগত। সুতরাং, সে বিছানা থেকে নেমে ঢকঢক করে এক গ্লাস জল খেল। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে পরল মেরুপ্রদেশের দিকে। দরজা খোলা রইল হাট করে, যেখানে পড়ে থাকা ঘরে একাকীত্বে ক্লান্ত হয়ে আগাছাদের ডেকে নেবে নিঃসীম শূন্যতা, আর দেওয়ালের আনাচেকানাচে স্মৃতিদের ভূত ঘুরে বেড়াবে বিষণ্ণ শিশুদের মতো।

লোকটার নাম ধরে নেওয়া যাক জন মন্মথ। আসলে মন্মথ, পদবী সে ভুলে গেছে কয়েকশো বছর আগে। এটুকু কেবল মনে আছে, যে কোনও একদিন সে তার প্রাক্তন প্রেমিকার সঙ্গে একটা গির্জায় গিয়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিল। গির্জার বিরাট বিরাট থামের প্রাকার, চাঁদোয়ার মতো শীতল ছাদের আচ্ছাদন দেখে তার বেশ ভয় করছিল। পাদ্রীসাহেব তার ভয় পাওয়া দেখে মৃদু হেসেছিলেন। তারপর তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রভু যীশুর সামনে। শরীরের খাঁজে খাঁজে ক্রুশের ঘা দেখে তার ভয় দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তখন মন্মথ’র মনে জন্ম নিয়েছিল এক অপার্থিব আনন্দ। প্রবল ভয়ের পরে হঠাৎ আশার আলো দেখলে মানুষের চোখে জল আসে। মন্মথ’রও এসেছিল। তার চোখ তাকে ধুয়ে দিচ্ছিল জ্যোৎস্নার মতো পিচ্ছিল কাচের খণ্ডে। ও বুঝতে পারছিল, ওকে পৌঁছতেই হবে এই মহামানবের কাছে। আজ না হোক, কাল না হোক, অন্তত মানবসভ্যতার ধ্বংসের আগে নিশ্চয়ই ও একদিন প্রভুর দোরগোড়ায় পৌঁছতে পারবে।

এর পরেই মন্মথ জন নামের শিরোপা পায়। নিজের নাম নিয়ে বেশ গর্ববোধ করতে থাকে। অদ্ভুত একটা বিদেশী বিদেশী অনুভূতি হয়। পরক্ষণেই সে বোঝে, এই নামের আদৌ কোনও মাহাত্ম্য নেই। যখন সে শুধু মন্মথ ছিল, তখন যেমন মানুষ ছিল, জন মন্মথ হবার পরেও তার মধ্যে কোনও বদল হয়নি। কেবল সে এখন স্থানে স্থানে প্রভু যীশুর প্রতিকৃতি দেখতে পায়। যখন বাজারে যায়, মনে হয় মাছওলার ঠিক যেন প্রভুর মতো করুণ অথচ তীব্র চোখে তার দিকে চেয়ে আছে। সে ভয়ে আর মাছ কিনতে পারে না। ছুটে আসে মাংসের দোকানে। এখানে আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, যে মুরগিটাকে ওর বেশ নধর বলে পছন্দ হয়, গলার কাছটা কাটতে যাবার আগেই সে দেখে তার চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে প্রভুর অবয়ব। সে আর মাংস কিনতে পারে না। এই করে তার গত সাড়ে তিনশো বছর মাছ বা মাংস খাওয়া হয়নি। শুধু ফল-মূল খেয়ে কাটিয়েছে, কখনও একটা-আধটা ডিমসেদ্ধ। তার প্রেমিকা তাকে বহুবার রান্না করে খাওয়াতে গেছে, কিন্তু জন মন্মথ কিছুতেই আর কিছু খেতে পারেনি। অবশেষে, তার প্রেমিকা তাকে ছেড়ে চলে গেল যেদিন, সেদিন সে এক টুকরো ঘুঘু পাখির মাংস খেতে পেরেছিল। বিস্বাদ লাগছিল বটে, তবু ভালোও লাগছিল। নিজেকে সে যেন ভুলতে পারছিল মাংসের ছিবড়েতে, আর আত্মবিস্মরণের মতো নির্বোধ আশীর্বাদ আর নেই- এটা সে ভালোমতোই জানে। জানে বলেই, সে আর কাউকে সাড়া দেয় না। জন বলে ডাকলেও না, মন্মথ বলে ডাকলেও না। ধীরে ধীরে পৃথিবীতে সে একটা জড়বস্তু হয়ে উঠতে চায়। তার মাথায় ঘোরে, কীভাবে নিজেকে প্রভুর কাছে সমর্পিত করা যায়, কেমনভাবে নিজেকে করে তোলা যায় চলন্ত এক স্থবির। পাথরের মতো।

মন্মথ এইসব পুরনো কথা ভাবতে ভাবতেই এগিয়ে চলছিল মেরুপ্রদেশের দিকে। সে স্বপ্নে দেখেছে, নিজেকে চরাচরে বিলিয়ে দিতে চাওয়ার মুহূর্তে সমস্ত পাপ-পুণ্যের হিসেব সেরে ফেলতে হয়। হিসেব কষে দেখে নিতে হয়, কোনোদিকের পাল্লা বেশি ভারী নেই তো! তখন বিপরীতদিকের পাল্লায় সম ওজনের কর্ম চাপিয়ে সমান করতে হয়। না-হলে কখনোই পুরোপুরি পৃথিবী থেকে সরে যাওয়া যায় না। মন্মথ তার অতীতের ইতিহাসে খুঁজে নিতে চাইছে নিজের যাবতীয় বোধ ও জ্ঞান, যেখান থেকে অনিঃশেষ কোনও মুহূর্ত এসে হঠাৎ তাকে জানান দেবে, যে আর কী করা তার বাকি আছে!

সে প্রায় পঞ্চাশ হাজার কিলোমিটার হেঁটে ফেলেছে আড়াই বছরে। বেগ কখনোই সে বাড়ায় বা কমায় না, তাতে নাকি মনঃসংযোগ স্থির থাকে না। একটানা একই গতিতে হাঁটতে পারলে নিজেকে অনেক হালকা লাগে। তাই সে মেপে মেপে হাঁটতে থাকে, আর অজান্তেই খুঁজে পেতে থাকে বহু আদিম ঐশ্বর্য। এই ঠিক এক্ষুণি, যখন সে তার প্রাক্তন প্রেমিকার ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়টার কথা ভাবছিল, পথের মাটিতে দেখল একেবারে তার প্রাক্তন প্রেমিকার মতোই দেখতে একটা মুখ খোদাই করা আছে। সেই পানপাতার মতো মুখ, সেই প্রাচীনতম খালের মতো সিঁথি, যা দেখলেই মিউজিয়ামে রাখা অব্যবহৃত কোনও সিঁদুরকৌটোর কথা মনে পড়ে যায়। জন মন্মথ কিছুক্ষণের জন্য থেমে থাকে সেই মুখের দিকে চেয়ে। মনে পড়ে, এই গভীর অতলান্ত চোখের দিকে শেষ কবে এতক্ষণ চেয়েছিল! ওর চোখ দিয়ে একটু জল পড়তে থাকল, আর মনে হল, সেই চোখের জল যেন জমা হচ্ছে এই খোদাই করা চোখের কোণেও। মন্মথ আবার এগিয়ে চলে।

প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার একটানা হাঁটার পর মন্মথ’র চোখ এবার ঘুমে জড়িয়ে এল। সে চারপাশে তাকিয়ে দেখল, এখন সে পৌঁছেছে খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকের কোনও সুপ্রাচীন সভ্যতার কোলে। প্রাসাদোপম অট্টালিকার কঙ্কালগুলো কেমন খাঁ খাঁ করছে। শূন্যতার তেজ এতটাই প্রখর যে, নিজের ছায়াও নিজেকে অস্বীকার করে ঝলসে যাচ্ছে ক্রমশ। পোড়া ইঁটের কিছু বাড়ি, যাদের জানলায় রয়েছে সূচীছিদ্র জালিকা, অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে জন মন্মথ’র দিকে তাকিয়ে রয়েছে। শহরের ঠিক মাঝখানে রয়েছে বিরাট একটা গম্বুজ, যার চারপাশে আগুন জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। মন্মথ বুঝল, এই শহর মেরুপ্রদেশের কাছাকাছিই হবে। তার মন অনাবিল আনন্দে ভরে উঠল। তারপর গম্বুজটার গাঁয়ে হেলান দিয়ে নিজেকে বিছিয়ে দিল জাগতিক দোটানা থেকে কয়েকশো হাত দূরে।

ঘুমের মধ্যে মন্মথ অতীতের স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। সে চেতনেও তাই-ই চাইছিল। এমন কোনও সুখস্মৃতি, যা তাকে তুষারের পথে হেঁটে যাবার সময় মনে মনে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে হাজার বছর আগে। সে স্বপ্নে দেখল, এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণী, যার নগ্ন দেহে লেগে রয়েছে বিশুদ্ধ অমৃতের ছোঁয়া। তার চোখের মণিতে গম রঙের আলো, নাসারন্ধ্রে গোলাপের স্বীয় মেদুরতা। পরিপক্ক ফলের মতো তার উদ্ধত অথচ মেধাবী স্তনে আঁকা রয়েছে মিশরীয় সভ্যতার জান্তব কারুকার্য, আর খোদিত হয়ে আছে ফ্যারাও তুতানখামেনের নখের আঁচড়। নাভির কাছে একটা গোলাকৃতি আলো গভীরের পথ চেয়ে শিউরে শিউরে উঠছে। আলো চায় অন্ধকারের দিকে যাত্রা করতে শুরু করে, মানুষই উল্টোটা ভেবে বসে। গভীর ঘুমের মতো সহজ এই কথাটা মনে হতেই স্বপ্নের মধ্যেই একটু হেসে উঠল জন মন্মথ। সে এখন নিজেকে স্বপ্নের মধ্যে পুরোপুরি ডুবিয়ে দিতে পারলেও স্বপ্নটাকে সে নিয়ন্ত্রণ কর‍তে পারছে। সে বুঝতে পারছে, এই কৃষ্ণাঙ্গ তরুণীর স্বপ্নটা এক্ষুণি শেষ হবার নয়, আর তাই এখনই স্বপ্নান্তরিত হওয়া প্রয়োজন।

আবার পাতালের গহীন স্মৃতির স্তরের মধ্যে চলতে চলতে এক আঁজলা ওম ভেসে আসার মতোই উঠে এল একটা ভয়াবহ বিপজ্জনক সাপ। এই সাপের চোখে রামধনুর মতো আলো, আর শরীরে বেলজিয়ান গ্লাস থেকে ঠিকরে আসা সূর্যের রেখা। সাপটা একটা তিনতলা ঘরকে নিজের আশ্রয়ে লালিত করছে। জন এখন স্বপ্নের মধ্যে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে। সাপটার দিকে সে স্পষ্ট তাকিয়ে রয়েছে, কিন্তু তার চোখে-মুখে ভয়ের লেশমাত্র নেই। সে ভাবছে, যে মেঝের ওপর সে দাঁড়িয়ে, সেখানেই হয়ত বসে রচিত হয়েছিল গ্রীস বনাম ট্রয় যুদ্ধের মহাকাব্যিক কথামালা, অথবা, এই দেওয়ালেই খচিত হয়ে আছে ইডিপাসের সমস্ত আর্তনাদ। মন্মথ’র চোখটা লাভার মতো ভারী হয়ে আসে। সে জানে, তার চোখের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক বিরাট আকারের ক্লান্তি, কিন্তু সে-ক্লান্তি এখন দহনের সময় নয়। তার জন্য আরও অনেক শ্রম জমানো প্রয়োজন। সাপটা ততক্ষণে জন মন্মথকে শিকারের কথা ভাবতে শুরু করেছে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই স্বপ্নটা থেকে বেরিয়ে এল জন। তার এখন আর স্বপ্নের প্রয়োজন নেই।

জনের বয়স আকস্মিকভাবে কমতে শুরু করছে। স্মৃতির প্রাচীন ভার তাকে ক্ষয়িত করেছিল যেভাবে, এখন তারা ক্রমশ পিছু হঠছে। জনের গা থেকে খসে পড়ছে নরম সময়ের প্রলেপ। তাকে ওরা একটা দীর্ঘ সময় জুড়ে আঁকড়ে ধরেছিল। শুষে নিচ্ছিল জনের যাবতীয় উল্লাসের কার্যক্রম। সমস্ত বিষাদঘন আবিষ্কারকে ঘিরে রচিত হয়েছিল সন্তাপের শুষ্কতা, যাকে সঙ্গী করে জীবনের অন্তিম মুলুকে পাড়ি দেওয়াই ভবিতব্য মনে হয়েছিল জনের। কিন্তু এখন তার আর সে-মায়া নেই। নেই দাবিও। জন ভাবছে না কিছুই। ভাবতে চাইছেও না। ভাবনাদের ছুটি দিতে গিয়ে সে নিজেকে ক্রমশ হারিয়ে ফেলতে চায় অসংলগ্ন অসীমের শেষ নিঃশ্বাসের অন্তঃক্ষরণে।

মাছের আঁশের মতো রাত নেমে আসছে সভ্যতার বুকে। জন মন্মথ এখন সম্পূর্ণ একটা শিশুর মতো সরল অথবা বৃদ্ধের মতো ঘোরতর মায়াবী। সে দেখে নেয় ধ্রুবতারার রুদ্ধসঙ্গীত, শুনতে চায় বাস্তুসাপের মর্মভেদী কান্না। নিজের ছায়াকেও সে এখন আর বিশ্বাস করতে পারে না। জন বুঝতে চায়, সে আর জন মন্মথ একই লোক কি না! খুঁজতে চায় মন্মথকে নিজের মধ্যে, অথবা মিলিয়ে নিতে চায় জনকে মন্মথ’র মধ্যে। সাতাশি লক্ষ বছর আগেকার এক পৌরাণিক পরীক্ষাগারের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে হঠাৎ এই ভাবনা কেন মনে হল জনের, সেটাই এখন একমাত্র আশ্চর্যের বিষয় নয়। কারণ, এখন যে বিরাট বাড়িটার সামনে জন এসে দাঁড়িয়েছে, জনের মনে হয়, ক্লাসিকাল গ্রীক অথবা প্রাচীন রোমান যুগে এখানেই সে থাকত।

জনের নিজেকে খুব সস্তার জাতিস্মর বলে মনে হতে থাকে। খেয়ালের মজ্জা বেয়ে সে দেখতে থাকে অদ্ভুত রঙের পাথরের কারুকৃতি। স্নেহজাতীয় পদার্থের মতো একটা গন্ধ ভেসে আসছে কক্ষের ভেতর থেকে। জন শান্ত পায়ে এগিয়ে যায় ভেতরের দিকে। একটা বাদামী রঙের ঘোলাটে কাচের গ্লাস হাতে নিয়ে বসে আছে ঠিক তার মতোই দেখতে একজন বৃদ্ধ দার্শনিক। নাকি বিজ্ঞানী? অথবা, কবি? দেখে বোঝা যায় না স্পষ্ট। ধূসর মেঘের মতো ভারী তাঁর দাড়ি, প্রতিটি অঙ্গসজ্জায় লেগে রয়েছে আজন্মযাপিত জ্ঞানের উন্মাদ অঙ্গীকার। বৃদ্ধের হাত সর্পিলগতিতে পাক খেয়ে উঠছে শিয়রের দিকে। সামনে খোলা একটা খাতায় কিছু কবিতার লাইন, যা পরীক্ষাগারের এই পরিবেশে চূড়ান্ত বিসদৃশ।

“গাছের মতো লাল আর পাতার মতো নীল

শান্ত কিছু পায়রা-পোড়ার ঘ্রাণ

এই আমাদের বেঁচে না-থাকার সামিল

অবাক কোনও মেধাবী স্বরের গান”

জন মন্মথ কবিতাটার দিকে শামুকের মতো কুঞ্চিত চোখে চেয়ে থাকে। সে ভাবতে থাকে, আদৌ কবিতাটার কোনও অর্থ আছে কি না। সে বুঝতে থাকে, এই যে সে কবিতাটার জন্য যে এত ভাবছে, তাতে কবিতাটার কোনও যায় আসে কি না। কবিতাও কি তার পাঠককে বোঝার চেষ্টা করে? সময় দেয় চেতনার অভ্রান্ত গোলকধাঁধায়? মন্মথ এত ভাবতে চায় না। তার আর ভাবার সময়ও নেই। সে দেখছে, বৃদ্ধের চোখে অল্প হাসি। মন্মথ অনুভব করে, চারপাশে হাওয়াদের আর্তনাদ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। শুষ্কতার অন্তিম শ্বাসে বাতাসে ঘন শীত। ঝাপটা দিচ্ছে, চামড়া কেটে বসে যাচ্ছে ভবিষ্যতের ক্ষত। এই কি তবে মেরুপ্রদেশ? এই কি তবে শেষের সেই বিন্দু?

  • হ্যাঁ। এটাই মেরুপ্রদেশের পথে অন্তিম যন্ত্রণাগার। এখানে মানুষের প্রবেশ অবধারিত। আবার নিষিদ্ধও বটে।

এতক্ষণ পর! মানুষের স্বর! মন্মথ নিজের অস্তিত্বকে ভুলতে বসেছিল এত বছর। একটা পিচ্ছিল জড়বস্তুর মতো বেঁচে থাকার যে বেপরোয়া একরোখা অধিকার, তাকেই চক্রবৃদ্ধি সুদে কিনে নিতে চেয়েছিল সে। কিন্তু মানুষের গলা শোনার পর নিজেকে আর যাই হোক, স্থবির রাখা অনুচিত। তাতে বাস্তুতন্ত্রের অপমান। কিন্তু সে বৃদ্ধের কথার কোনও সমান্তরাল পথে না গিয়ে সম্পূর্ণ অন্য বাস্তবোচিত একটা প্রশ্ন করল।

  • মেরুপ্রদেশ আর কতদূরের পথ?

নেহাত সম্মানরক্ষার খাতিরে জিগ্যেস করল মন্মথ। আসলে তার এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না। সে চাইছে, যত দ্রুত সম্ভব পৌঁছে যেতে তুষারের রাজধানীতে, যেখানে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে অসংখ্য সাদা কাক, যাদের দেহে মন্মথই হয়ত লিখে দেবে অপঘাতে মৃত্যুর প্রস্তরলেখ।

হাওয়া ক্রমশ প্রলম্বিত হচ্ছে, আওয়াজ শোনা যাচ্ছে স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানো অযোনিসম্ভূতা প্রেতের। বৃদ্ধ সেই হাওয়াকে একটা সবুজ রঙের বোতলে ভরতে লাগলেন, শুধু নড়তে লাগল পাতলা লেপের মতো ঠোঁটদুটো।

  • নিজেকে সম্পূর্ণ বিস্মৃত করতে ঠিক যতটুকু পথ হাঁটা প্রয়োজন, সেই বিন্দুতেই মেরুপ্রদেশ। তোমার আত্মার ওজন যতটা, তাকে নিজের পাপ এবং যন্ত্রণার পরিধির যোগফল দিয়ে ভাগ করে যেটুকু অবশেষ থাকবে, তাকে তোমার স্বপ্ন দিয়ে গুণ করে দ্যাখো। উত্তর পেয়ে যাবে।

জন মন্মথ আর দ্বিরুক্তি না করে বেরিয়ে পড়ে। ও ধরতে পেরেছে, মেরুপ্রদেশ আর ঠিক ততটাই দূরে, যতটা সে চায়। অতএব, তার আর তাড়াহুড়ো না করলেও চলবে। ও পকেট থেকে একটা আয়না বের করে। নিজেকে দেখে নেয় একবার। আয়নার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে একান্তর কোণে দেখে চলে ইতিহাসে সখেদ স্বীকারোক্তি। মন্মথ দেখে তার শৈশব, যেখানে সে একদিন বরফের টুকরো খেয়ে ফেলে মায়ের ক্রোধের শিকার হয়েছিল। সে দেখে তার ন্যুব্জ বাবা, যিনি একদিন ওকে নিজের রক্তের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন ব্যক্তিগত আঘাতের বিনিময়ে। সেই ক্ষতস্থানে বরফ লাগাতে এলে মন্মথ নিজেই তার ঠাকুমাকে বেঁধে ফেলেছিল এক প্রাচীন বটের গোড়ায়। সে আয়নায় দেখতে পাচ্ছে, তার মৃত ঠাকুমার অন্ত্যেষ্টিতে তুষারের পথ বেয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল একটা সাদা রঙের ঘোড়া, যার সোনালি রঙের কেশরের খানিকটা গুচ্ছ সে একদিন বাড়ির সামনে পড়ে থাকতে দেখে কুড়িয়ে নিজের পকেটে রেখেছিল। আয়না ওকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে অতীতে, আর মন্মথ তার বর্তমানে হাঁটতে থাকে ভবিষ্যতের দিকে।

তাপমাত্রা এখন মাইনাস কয়েক কোটি। আলোর উষ্ণতা সামান্য কিছু আলোকবর্ষ দূরেই। মন্মথ’র শরীরে আর কোনও উত্তেজনা নেই। সে নিজের স্বরকে অবিশ্বাস করে এতক্ষণে নিজেকে এক বুদ্ধিদীপ্ত জড়ে রূপান্তরিত করতে পেরেছে। আয়নাটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় দূরে, তুষারাবৃত এক পাহাড়ের দিকে। সে আয়না পড়ে না মাটিতে, উবু হয়ে ঝুলতে থাকে হাওয়ায়। আর্তনাদ তুলে আনে গভীর খাদ থেকে।

মন্মথ নিজেকে দেখতে পায় অসংখ্য কাকের ভিড়ে, নিজেকে মিশিয়ে দেয় উদাসীন গোপনীয়তার আদিম অঞ্চলে। সে জানে, সে-ই এখানে নাগরিক সভ্যতার প্রথম অবতার, যাকে তুষার নিজেই ডেকেছিল গল্প করবে বলে। সে দেখতে পায় এল ডোরাডো, চিনতে পারে লাপিস লাজুলি। কিন্তু, তার আর উত্তেজনা হয় না। শিহরণ হয় না। চড়া পরে যাওয়া নদীর মতো ম্লান চোখে সে চেয়ে থাকে নতুন শহরের এই সতেজ শীতলতার দিকে, যাকে ঘিরে শুরু হল তাঁর ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন। ভবিষ্যৎ থেকে বর্তমানের পথে।

সমস্ত পার্থিব মায়া ফেলে রেখে জন মন্মথ হয়ে উঠতে থাকে এক সত্যিকারের অবতার। ও বুঝতে পারে না, ওর গায়ে ফুটে উঠছে কালো ছোপ ছোপ রক্তের দাগ, আর ওকে এখন দেখতে লাগছে শান্ত, যন্ত্রণাক্লিষ্ট এক মেষপালকের মতো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *