শতদল মিত্র

খরর-খরর শব্দে আঁধার ভাঙে ক্রমে। ভোর ফুটে ওঠে ধীরে আলো জাগিয়ে। সে ঢেউয়ে বাতাসও ঝর-ঝর শব্দে জাগ দিলে পাতু, পতিতপাবন মেটে শরের বারন দিয়ে খরর আওয়াজে  শিবতলা ঝাঁট দেওয়ার নৈমিত্তিক সেবা থেকে খানিক বিরত হয়। কোমরে বাঁ হাতের চেটোর ভরে ধরা মাজাখান টান করে দাঁড়ায়। শীতলরঙা আলো মাখে মুখে, মাথায়, আশরীর। তখনই শিবথানের বৃদ্ধবট একখান শুকনো পাতা ঝরিয়ে খেলে যেন পাতুর সঙ্গে। শিবো হে– এমন মানসমন্ত্রে পাতু বারন দিয়ে পাতাখানি টেনে আনে এতক্ষণের জড়ো করা খড়কুটোর গাদায়। এ রঙ্গে হরিসায়রের পূবপাড়ের পাকুড়গাছের চিরল পাতা রাঙিয়ে নবীন সূর্য ওঠে। চৈত্রের দিন শুরু হয়। আর কদিন পরেই শিবপুজো। না, এখন আর ভক্তা হওয়ার মতো শরীরের জোর পায় না পাতু। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। পরক্ষণেই ঠোঁটে শিবধ্বনি এঁকে নিচু হয়। জড়ো করা খড়কুটো পেছেতে ভরে। দুহাতে পেছেখান আঁকড়ে ধীর পায়ে শিবতলা ছাড়িয়ে সরকারদের খামারবাড়ির পেছনে সারগাদার পানে হাঁটা দেয় পাতু। এবার সে হরিসায়র যাবে। সেখান থেকে জল এনে শিবমন্দিরের বারান্দা, আটচালা তকতকে ধোবে পাতু। আর এ ভাবেই নতুনতর দিন এক জেগে ওঠে এক অন্যতর পবিত্রতায় মানুষটির নিত্যযাপনে।
     না, শিবথান পরিষ্কার করার দায়িত্ব কেউ দেয় নাই পাতুকে। এ তার স্বেচ্ছাসেবা। তার ভালোলাগা। মনের তৃপ্তি। নিত্য ঈশ্বরসেবা তার। এ ক্ষণে যেমন আশরীর আনন্দ মেখে মন্দির ধোয়ায় ব্যস্ত সে। সে আনন্দেই সহসা ঝির ঝির হাওয়া বয় এক পশলা। যেন বা তাকে ভেজাতেই। এ নরমে চোখ চায় পাতু। সে দৃষ্টিতে হঠাৎই করুণ ছায়া ঘনায়। সে ছায়ায় এ গাঁয়ের এ ঠাকুরথানের দুর্গাতলায়, নারাণতলায় খড়কুটোর দল খেলে, ঘূর্ণি তোলে। না, পতিতপাবনের, মেটে যে, বাগদি, তার কায়েতদের দুর্গাআটনে, নারাণতলায় পা দেওয়া পাপ। জ্ঞানত এ পাপ করতে পারবে না পাতু। বুক নিংড়ানো শ্বাস ছাড়ে সে। –শিবো হে! জয় ভোলেবাবা! এ মন্ত্রে সে মন ফেরায় শিবআটনে।কালারুদ্র শিব ভোলেবাবা। সে আপামর সর্বমানুষের! সর্বজীবের। জড়েরও। ভোলেভালা বাবা তার দেবাদিদেব যি। দেবতারও দেবতা সে। অপদেবতারও। এমনই ভাবনা ছায়া দেয় তাকে সে ক্ষণে। নিরক্ষর হলেও কবি-কীর্তনের গানের শোনা-সাগরেদ সে। খানিক-আধেক তত্ত্ব জানে বৈকি পাতু।
     পাতুর সে ভাবনার দোসর হয় জাগন্ত গ্রামখানির দুলকি কথারা।
     –আজকের মতো সেবাকাজ সারা হল তবে!
     –কাজ লয়কো কাকা। এ তো মোর পুজো গো!
     –তুই আছিস তাই! নইলে দুর্গাদালান আর নারাণতলার মতো শিবথানখানাও দাঁত ছিরকুটে পড়ে থাকত বারোমাস।
     –এমনপারা কথা বলো না গো। পাপ লাগবে যি আমার! ঠাকুরের কাজ ঠাকুর করিয়ে নেন। তুমি-আমি তো নিমিত্ত মাত্তর।
     –বাবা ভোলানাথ তোর ভালোই করবে দেখিস!
     কথারা ওঠে এমন ধারায়। ভেসে যায়। ভেসে যায় পাতুর মনও। ঠাকুরের দয়ায় সে তো ভালোই আছে। পাঁচমেয়ের ভালো বরে, ভালো ঘরে বিয়ে দিয়েছে সে। তারা সুখে আছে সবাই। বাবার খোঁজখবর নেয়। ছোটোমেয়ের ঘর তো পাশের গাঁয়েই। ছোটোজামাই খানিকাধেক পড়ালেখা জানে। বাবুদের জমি ভাগে চাষ করার সঙ্গে সঙ্গে শহরে লটকোনার দোকানে কাজও করে। পাঁচহাজার টাকা পায় মাসে। ছোটোজামাইটা ভালো মানুষ খুবই। ছুটির দিনে খবর নেয় তার। আর মেয়ে তো নিত্যি সাঁঝেই আসে। না, ছেলে নাই বলে কোনো আক্ষেপ নাই তার। শুধু বউটো আগে চলে গেল… তা যিনি দিয়েছেন, তিনিই কোলে টেনে নিয়েছেন…! মৃদু শ্বাস ছাড়ে পাতু আনমনে। এ প্রাণবায়ুতে অস্ফুটে ফোটে সে মন্ত্র– শিবো হে! যা এ ঠাকুরথানে স্তব্ধতা আঁকে সহসা। সে শব্দহীনতাকে গাঢ় করতেই  টাউনবাসী বাবুদের বন্ধ কোনো ঘরে ঘুঘু ডেকে ওঠে নির্জন সুরে– ঘু-ঘু… ঘু!
     –ও পাতুকাকা!
     এ ডাক ভেসে আসে ঠাকুরথানের আপাত সে স্তব্ধতাকে গুঁড়িয়েই আচমকা। তবু উড়ে যায় বিভোর পাতুকে না হিলিয়েই যেন! অগত্যা সে আওয়াজ দোসর ডাকে।
     –ও জামাইকাকা! শুনতে পেছ না নাকি!
     চেনা এ সম্বোধনে সম্বিত ফেরে পাতুর। পাতুর, নাকি জামাইয়ের! সেই কবে, কোনকালে এ গাঁয়ে সে এসেছিল ঘরজামাই হয়ে। তার বিয়ে করা বউ একমাত্র মেয়ে। ছেলে ছিল না শ্বশুরের। আর এ গাঁয়ের জমিও তাদের গাঁ থেকে সরেস। নদীলাগোয়া, তাই তিন ফসলি। তাছাড়া শ্বশুরের নিজের ভিটেজমিটুকুও তিনকাঠা প্রায়। তখন পেথ্থম লাল আমল। সে ভিটেজমিও পার্টির পাট্টাপোক্ত ততদিনে। যদিও তার বেশিরভাগটাই বাড়ির পেছুতে কাঁদরের ঢালে। তা হোক না কেন! সেখানেও তো সম্বচ্ছরের কলাটা, মুলোটা লাগানো যাবে নাকি! পাকা চাষি সে। হ্যাঁ, দুমুড়ে চাষও করেছে সে। এ গাঁয়ের সবাই ধন্যি মেনেছে তাকে। আবার টাউনবাসী বাবুদের বর্গাজমিও অনেকটাই শ্বশুরের ভাগে। সি সব তো তারই হবে নাকি এককালে! সোনা ফলাবে সে, সোনা! ফলিয়েছেও সে। এ ভাবনা আলো আঁকে চোখে তার। সে আলোয় ছবি ফোটে। ওর নিজের গাঁখানি ছিল বড় পাথুরে, নির্জলা। আকাশের দয়া হলে তবে চাষ। তা বাদে তারা ছিল ছ’ভাই। বাপের ভাগের জমি ভাগ হলে সে আর কত টুকুন! তাই তার এ গাঁয়ে আসা। গোটা একটো মেয়েছেলে, সঙ্গে মাটিও! নিজের মস্করায় নিজেই আনমনে হাসে যেন সে। তবে বাপোত্তর নামখানা খোয়াতে হয় তাকে। পতিতপাবন, পাতু যে কবে থেকে জামাই নামের বাকল জড়ালো গায়ে জানে না পাতু, জামাই যে।
     –কি গো জামাইকাকা। কানে কি কালা হলে নাকি!  

     বর্তমান চকিতে চেতন ফেরায় পাতুজামাইকে। দেখে পঞ্চাৎ লক্ষ্মীর বর উত্তম বাউড়ি পাছায় বাইক ঠেকিয়ে দু-ঠ্যাং ফাঁক করে গদিয়ান। এক গাল হাসে উত্তমের জামাইকাকা।
    –কানের আর কী দোষ! তিনকুড়ি বয়স কবেই পার করেছি। তা, কী বলচিস বল কেনে!
    –বলছি যে তোমার বার্ধক্যভাতা ঢুকে গেছে। আজ অপিসে যেও বেলাবেলি। টাকাটা তুলে দেব।
     –তা, গেল মাসের মতো আবার ফুরুৎ হবে না তো!
    –না, গো না, আমরা ওপরে জানিয়েছি। এবার পাবে।
     –হ্যাঁ রে, উত্তম আমার আবাসটা আর হবে না! বয়স হল, বেলা ঢলতে লেগেচে… মরার আগে পাকা বাড়িতে যদি ঘুমতে পারতাম… অনেক দিনের সাধ আমার!
     –বলেছি তো আগে। ও তোমার হবার নয়। জমি যে তোমার শ্বশুরের নামে। কাকি বেঁচে থাকতে হতো। তোমার ছোটো জামাইকে শুধিয়ো কেন!
     গাড়ি স্টার্ট দেয় উত্তম। ধুলো উড়িয়ে উড়েই যায় যেন পঞ্চাৎ লক্ষ্মীর বর। তার পেছন পেছন বহুবার বলা কথাখানা ভাসিয়ে দেয় পাতুজামাই– তা তোরা মনে করলেই সব হয়। তোরাই তো গাঁয়ের মন্ত্রি, আইন…!
     ফোঁৎ করে দীর্ঘ একটা শ্বাস ছাড়ে সে। সে কম্পনে ঝরঝর বাতাস বয় চোতদিনের। দূরের রাস্তার মাটি ছিলছিল কাঁপে। আবছা আয়নায় ভেসে ওঠে যেন তার মরা বউয়ের টলটলে মুখখানি! আহা, আজ বেঁচে থাকলে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের হাজার টাকা পেত সে!
     আবারও অবচেতনে বুক মোচড়ানো এক শ্বাস তার দেহ ছাড়ে– শিবো হে, এ লব্জে। যা তাকে বাস্তবে ফেরায়। ঘরপানে হাঁটে পাতু।
মাটিতে আঙুল গেড়ে, তাই ধীরেই। সে ছন্দে মনও অলস ভাসে। ঘরে গিয়ে আগুতে গুড় দিয়ে মুড়ি খাবে সে চাট্টি। মন চাইলে চা-ও। চায়ের নেশা তার বরাবর। নেশার কথায় হঠাৎই বিড়ির নেশা চাগার দেয় তার মনে। তাই তো কতক্ষণ বিড়ি খায় নাই সে! মনে হওয়া ইস্তক ধোঁয়ার সে নেশা খড়িয়ে যায় যেন বা। সে জামার পকেট থেকে বিড়ি-দেশলাই বার করে। দু-আঙুলের আলতো চাপে বিড়িটাকে দুবার পাক দেয়। মুখে দুটো ফুঁক মারে। শলাই জ্বেলে টান দেয় সুখে। বিড়িটা দপ করে জ্বলে ওঠে। গলগলিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে। আঃ! শান্তি!
     নাহ! উত্তম ছোঁড়াটা যাই বলো না কেনে কাজের বটে। বার্ধক্যভাতাটো করে দিয়েচে তো উ-ই। তা দু-একবার আঙুলছাপ দিয়েও টাকাটো পায় নাই সে। ওই তো গেল ফাল্গুনেও পায় নাই। বলে কিনা অনলাইন গলদ, দিল্লির। পরের মাসে যোগ হবে। পাতুরা জানে ও আর যোগ হবার নয় কো। ওটা পার্টির, সরকারি বাবুদের নজরানা। তবুও তো বারোমাসের জায়গায় ন-মাস পাওয়া যায়! ফোকটের পাওনা, যা পাওয়া যায়! ভাবে পাতু। দিন তো চলে যাচ্ছে ঠাকুরের কৃপায়। তা বাদে ১০০ দিনের কাজের টাকা। সিও আধাআধি বখরা। তা লেগ গে! বুড়োমানুষ বলে মাঠে যেতে বারণই করেচে তাকে উত্তম। তাই কি হয়? ধম্ম বলে তো কিছু আচে। আজও। ঠাকুর আচে। অল্যাজ্য কাজ জামাই করে না। করবেও না সে। যেচেই সে মাঠে যায়, দু-চার ঝুড়ি মাটি বয়। উত্তমরা হাসে। খ্যাপায় তাকে,–কাকা ধর্মের ঠেঁয়ে হাজিরা দিতে এসেছে! হাঃ হাঃ! সে হাসির রেশ এ নির্জনেও তৃপ্তির মায়া আঁকে পাতুর ঠোঁটে আনমনে। চলতে চলতে কোমরে হাত দিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় সে খানিক। আনমনা মন ফুকরে ওঠে,–শিবো হে!
#
ঘর থেকে বার হয় পাতু। বারদরজায় শেকল তুলে তালা লাগায়। শহরের অপিসপানে যাবে এবার সে। চোখের ওপর হাত রেখে রোদ দেখে। নাহ! বেলা চড়েচে। দশটা বাজতে লেগেচে প্রায়। হেঁটে যেতে এক ক্রোশ। কতটুকুন আর! বাবুরা আসতে তো সেই এগারোটা। আর ভাগ্য ভালো হলে পথচলতি টোটো পেলেও পেতে পারে। দশটাকা ভাড়া। হাতে থলে ঝুলিয়ে হাঁটা লাগায় পাতু। থলেতে দুটো বড় প্লাস্টিকের বোতল। আসার পথে ডাঙাপাড়ার টিউকল থেকে জল নেবে সে। তার পাড়ায় টিউকলটো আর হল না। পেত্যেকবার ভোটের সময় ভোটবাবুরা কথা দেয়। কিন্তু হয় আর না! সেই ঠাকুরথানে একটো, আর ডাঙাপাড়ায় একটো। বাবুদের বাড়ি বাড়ি নিজেদের চাপাকল। দুয়েকজনের পাম্পও আবার। তা তারা থাকুক ছাই, না থাকুক গাঁয়ে। আর পঞ্চাৎবাবু উত্তমের বাড়িতেও পাম্প লেগেচে হালে। তাদের বেলা লবডঙ্কা! নইলে ভরসা শামুকতলার ইঁদারা, সেই সাহেব আমলের। তাদের পাড়ায় কলটো হলে বাগদি-বাউড়ি, দু’পাড়ারই উপকার। ভাবে পাতু। ভাবনার তালে পা চালায় সে। সে তালে অন্য ওলো ভাবনারাও ভাসে, ওড়ে। ওলো ভাবনার আঁশ ছাড়ালে কথা জাগে।
    –টিউকল! সি তো হয়ে গেছে কোন কালেই! তোমার-আমার নজর খাটো, তাই দেখতে পাই না কো! পঞ্চাৎ দেখতে পায়, সরকারি বাবুরা দেখতে পায়। গান্ধীবাবার কৃপায় ওদের যি ত্রিলয়ন গো!
     –তুমি জামাই ভালো মানুষ। তোমাকে আনতাবড়ি বোঝায় ওরা। তোমার আবাসের ঘরও হয়ে গেছে কবে! তোমার পাকা ঘরে শুয়ে তুমি ঠ্যাং নাচাচ্চ! ছবি সাঁটা আছে ওদের কম্পুটার মেশিনে। তোমার ত্রিলয়ন নাই, তাই দেখো না! আমাদেরও ত্রিলয়ন নাই। আবার আছেও, তবে কানা। তাই আমাদের আবাস শুধু স্বপনে দেখি! হাঃ হাঃ!
     হা-হা রবেই যেন হঠাৎই চোতের হাওয়া বয় ধুলোর ঘূর্ণি তুলে। সে হাওয়ায় পাতু ওলো কথার আঁশ উড়িয়েই দেয়।
    –এত অল্যাজ্য কাজ মানুষে পারে নাকি! দু-চার টাকা মানুষ এদিক ওদিক করে ঠিকই লোভে, তা বলে গোটাগুটি বাড়ি, কল হাওয়ায় মুছে দিতে পারে মানুষ! এ কি ম্যাজিক নাকি… ভানুমতির কেরামতি! এত অধম্ম সইবে মানুষের! তা সে যতই নেতা, সরকারি অফ্সার হোক! তাকে ভালো মানুষ পেয়ে মানুষে দিল্লাগি করে তার সঙ্গে! পাতুর সঙ্গে ভাবনারাও হাঁটে দুলকি তালে। পাকা বাড়ি না হোক গে, সে সুখেই আছে। ভগমানের কৃপায় দু’বেলা ভাত তো জুটছে! আর কী চাই তার? মেয়েরা সুখে ঘরকন্না করচে সোয়ামি-সন্তান নিয়ে। তা বাদে বাবুরা জমি বিচে দিলে তাকে টাকাও দিয়েচে। সে টাকার বেশিরভাগটাই সে পাঁচমেয়েকে সমান ভাগে ভাগ করে দিয়েচে। বাকিটা নিজের নামে পোস্টাপিসে রেখেচে। সুদ পায়। না, বাবুদের কাছে আইনত জমি সে চায় নাই। কে করবে চাষ! আর সেটা অধম্মও হতো। যতই বর্গাদারি আইন থাক– ওদের জমি ওরা বিচবে, সে কেন বাদ সাধবে! অল্যাজ্য কাজ জামাই করে না। তাছাড়া নিজের ভিটেমাটিতে সে আজও শাকটো, ডিঙিলিটো ফলাতে পারে। ঠাকুরের এটুকু দয়া সে পায়। আবার কি! আর বেলা তো ঢলে এল… শিব-শিব, শিবো হে! নির্বিবাদী মানুষটি আকাশে চায়।
     হঠাৎ টোটোর আওয়াজে সামনে তাকায় সে।দেখে ডাঙাপাড়ায় বুধো টোটো নিয়ে দাঁড়িয়ে।
     –তোমাকে দেখেই দাঁড়ালাম গো।
     –যাক ভালোই হল। এত বেলায় আর রোদ ভাঙতে হবে না কো। তা এত বেলায় বেরুচ্চিস যি!
     –সকালে তো আমার বাঁধা প্যাসিঞ্জার। রেখাদিদিকে বাসস্ট্যান্ড ছাড়তে হয়। তা, সঙ্গে সঙ্গে আবার গাঁয়ের প্যাসিঞ্জার পেয়ে গেলাম দুজনা। রবিদাদুর বাড়ির কুটুম। দাদুর খপর করতে এসেছে। তিন চাকা গড়াতে গড়াতে কথা ছোঁড়ে বুধো। –রবিদাদুর তো এখন যায়, তখন যায় অবস্থা। ও মলে তোমার পুণ্যি তো একশোয় একশো নাকি গো! বাপ রে পুণ্যির সেঞ্চুরি!
     আনমনা পাতু বুধোর কথা শোনে না। তার ভাবনায় থাকে যে সকালে তো হল না আজ, বিকেলে রবি সরকারের বাড়ি একবার অবশ্যি যাবে সে খপর নিতে।
     –এবার তোমাকে লোকে শকুনি বলবে গো! এক কম একশো মরা পোড়ানো… সোজা ব্যাপার! তা তুমি গুনেছ তো ঠিক! নাকি জল মিশিয়েছ! নিজের মস্করায় নিজেই হাসে বুধো।
     এটা সত্যি যে পাতু জামাইয়ের এই নিরানব্বয়ের ধাক্কা এ অঞ্চলের পাঁচগাঁয়ের পঞ্চজনার কাছে এক জব্বর ঘটনাই। সবাই অপেক্ষায় পাতুর মরা পোড়ানোর একশো পূর্তির, ছেলেছোকরাদের ভাষায় সেঞ্চুরির। কারো কারো মনে, বিশেষ করে আজকালকার উঠতিদের, সংখ্যায় সন্দেহ জাগলেও তারা মনে বুঝ দেয় তাদের স্মৃতিকে সাক্ষী মেনে। পাঁচগাঁয়ের এমন কোনও মরণ তাদের মনে পড়ে না শেষ পারাণির যে যাত্রায় পাতুজামাই কাঁধ দেয় নাই। একটু বুঝদার হতেই পাতু শ্মশানযাত্রী হতে লেগেছে। প্রথম প্রথম পরিবার-পাড়ার দায়। পরে তা নেশাই যেন। নেশাই বা বলে কী করে পাতু! সংস্কার কথাটা হয়তো পাতুর চেতনপরিধির বাইরেই, তবু ক্রমে ধম্মত সে এ বিশ্বাসে থিতু হয় যে, এই টুকুন তো জীবন! একলা আসা, একলা যাওয়া! মাঝে কান্না-হাসির লীলা। তা মানুষের সে একলা যাত্রায় সঙ্গ দেওয়া মানুষেরই কাজ। তার ধর্ম। জ্ঞানত এ ধর্মটুকুই সারা জীবন যথাসাধ্য পালন করার চেষ্টা করেছে ধার্মিক পাতু, পতিতপাবন নামকে সার্থক করতেই যেন! শুরুতে সংখ্যার গল্প ছিল না। পরে যৌবনে বন্ধুদের সঙ্গে খেলাচ্ছলে একদিন গুনতে গিয়ে দশের গণ্ডি পেরোতেই সংখ্যার সখ্যে পড়ে সে। তারপর এককুড়ি, তিনকুড়ি… দেখতে দেখতে কবে যে নব্বইয়ের গেরো! এখন একশোর কামনায় সেও। একশো হলেই মচ্ছব দেবে সে নিজে। তা বলে কারুর মরণকামনা করেছে পাতু, এ বললে অল্যাজ্য হবে! শত্রুরও না। কারুর মৃত্যুকামনা হত্যার অধিক পাপ! জ্ঞানত এ পাপ পাতু করে নাই কখনো। আজও না। এমত ভাবনা মন্ত্রমুদ্রা আঁকে তার ঠোঁটে– শিবো হে। টোটো থেকে মুখ বাড়িয়ে আকাশপানে চায় সে– রবি সরকারের মঙ্গল করো ঠাকুর! সব্ব জীব-জড়ের ভালো করো ঠাকুর! শিব-শিব! 

#
এগারোটার আগেই অপিসে পৌঁছে যায় পাতু। বাবুরা একে একে আসতে লেগেছে। পাতু দেখে তার আগেই পাঁচজনার লাইন। ওদের গাঁয়ের দিলে বাগদি আর বিশু বাউড়িও হাজির। ওকে দেখে দাঁত বার করে হাসে তারা।
    –বুড়ো ভাতের কাঙাল গো মোরা! লাইন দিয়েচি ভাতের। হেঁ-হেঁ!
     একজন মস্করা করে। পাতু ও অন্যান্যরা হাসি ঝোলায় ঠোঁটে।
      –কথা কম। বড় আওয়াজ হচ্ছে! এক বাবু হাঁকাড় দেয়।
     কথা থামে। গুনগুন সুর ছড়ায় শুধু ঘর জুড়ে পাখার শব্দে মিশে। একসময় কাজ শুরু হয়। ইতিমধ্যে উত্তম পঞ্চাৎও বাইক ডাকিয়ে হাজির হয়। এক এক করে বৃদ্ধ মানুষগুলো মেশিনে বুড়ো আঙুল চাপে। তাদের আধার যাচায় হয়। মেশিনের পর্দায় কী সব লেখা ফুটে ওঠে। অক্ষরহীন ওদের চোখে তা আলো নাচায় কেবল। আগে কথা বলতো মেশিন। এখন বোবা। টাকা উগরে দেয় মেশিন। বুড়োরা কৃতার্থ হাতে টাকা নেয়। গোনেও থুথু লাগিয়ে।
     –যাহ! তোমার টাকা তো আসেনি এবার দেখছি! নেক্সট!
     আঁধার মেখে অর্থহীন মানুষটা পরের জনকে লাইন ছেড়ে নিরুচ্চার সরে দাঁড়ায়। লাইনে দাঁড়ানো পাতুর বুক দুরুদুরু কাঁপে। এবারেও যদি তার টাকা না আসে! লাইন এগোয়। এবার পাতুর পালা। মেশিনে আঙুল চাপে জোরে। সময় থমকায় যেন! মেশিনে ইঁদুর ছোটে বাবুর হাতের কায়দায়।
     –কী হলো! ছবি ফুটছে না কেন! মাথায় ঘষে আরেকবার চাপ দাও ভালো করে দেখি। বাবুটি উদ্বিগ্নই যেন!
     ঘেমে ওঠে পাতু। তবুও আবারও চাপে সে আঙুল মেশিনে গায়ের জোরে।
     –নাহ! আসছে না তো! আচ্ছা বাঁহাতের আঙুলটা দাও তো একবার।
     ঘামতে ঘামতে পাতু নির্দেশ পালন করে। বাবুর চোখে ভ্রূকুটি।
     –নাহ! হচ্ছে না। দেখি তোমার আঙুল! ঘর্মাক্ত পাতু কাঁপা হাত বাড়ায়। –আঙুলের কোনো রেখাই তো নেই তোমার দেখছি! আশ্চর্য! সব রেখা মুছে গেছে! যা হোক ভেবো না। ওপরে জানাব আমি। কিছু একটা ব্যবস্থা হবেই। চোখের রেটিনা তো আছেই। বাবুটি সান্ত্বনা দেয়। হাঁক পাড়ে– নেক্সট!
     কুল কুল করে ঘামে পাতু। আবছা শব্দ কানে আসে– জামাই হে, শিবথান ঝেঁটিয়ে সব চিহ্নৎ মুচে ফেললে যি!
     এ মস্করা বড় আঁতে ঘা দেয় পাতুর। টলতে টলতে ঘামে ভেজা সে চিৎকার করে ওঠে– আমাকে আবাস তো দিলিই না! আবার আধারছাড়াও করে দিলি মা-মেগোর দল! নির্বিবাদী পাতু জীবনে প্রথম প্রতিবাদ করে। শেষও। কেননা এরপরেই পাতু ঝরে পড়েছিল তার লব্জমন্ত্র ঠোঁটে এঁকে– শিবো হে!
#
যদিও পাঁচগাঁয়ের পঞ্চজনার মনের ধন্দ ঘোচে না– পাতুর শেষযাত্রাখানি তার শ্মশানযাত্রার সংখ্যায় যোগ হয়ে পূর্ণ শ-পুণ্যির মাহাত্ম্য পাবে! নাকি নিরানব্বয়ের গেরোতেই বন্দি থাকবে পাতু, পতিতপাবন মেটে, এ মাটির জামাই যে!  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *