সৌমিতা রায় চৌধুরী
ফুল ভালোবাসে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। সাজসজ্জার প্রধান অঙ্গ ফুল। এই ফুলকে কেন্দ্র করে সমগ্র ভারতবর্ষে প্রায় আট রকমের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
প্রথম যে অনুষ্ঠানটির নাম করা যেতে পারে সেটি হলো টিউলিপ উৎসব, যা জম্মু ও কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে প্রতি বছর মার্চ-এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় সত্তর রকমের টিউলিপের প্রজাতি এশিয়ার এই বৃহত্তম উদ্যানে চাষ করা হয়। ডাল লেকের পাশেও এই ফুলের সমারোহ দেখা যায়। কাশ্মীরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে এবং দেশি-বিদেশি পর্যটককে আকৃষ্ট করতে টিউলিপ উৎসব অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। উৎসবটি প্রায় পনেরো দিন ধরে চলে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বোট চালনা এবং স্থানীয় মানুষদের অংশগ্রহণে উৎসবটি মহিমান্বিত হয়। এই সময়ে কাশ্মীরের আবহাওয়া থাকে অত্যন্ত মনোরম। মাটি থেকে তিন-চার ফুট উচ্চতার সারিবদ্ধ রঙিন ফুলগুলি এক অনন্য দৃশ্য সৌন্দর্য সৃষ্টি করে।
দ্বিতীয় যে ফুল উৎসবটির কথা আলোচনা করা যেতে পারে সেটি হলো চণ্ডীগড়ের গোলাপ উৎসব। এই উৎসবটি জাকির হুসেন রোজ গার্ডেনে ও লেজার গার্ডেনে ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয়। গন্ধ এবং বর্ণে সমগ্র পরিবেশকে স্বর্গীয় রূপ দান করে এই উৎসব। চণ্ডীগড়ে এই সময়ে প্রচুর পর্যটকের আগমন ঘটে। চণ্ডীগড় সরকার হেলিকপ্টার ট্যুরের ব্যবস্থা রাখেন। এছাড়া ঢালাও খাদ্য ও পানীয়ের ব্যবস্থাও থাকে। একটি বিশেষ দৃশ্যমানতা থেকে সমগ্র উৎসবটিকে দেখার ব্যবস্থা থাকে।
পঞ্জাবের আরও একটি ফুলের উৎসব হলো ‘বসন্ত পঞ্চমী’। যখন সূর্যমুখী ফুল ফুঁটে ওঠে তখন পঞ্জাবের ফুলের ক্ষেত গুলো সোনালী-হলুদ বর্ণে চোখে এক মায়াবী ধাঁধার সৃষ্টি করে। এই সময়ে আকাশে ওড়ে ঘুড়ি। পঞ্জাবী জনগণ হলুদ পোশাকে সজ্জিত হয়। হলুদ রঙে সেজে সমগ্র পঞ্জাববাসী খাওয়াদাওয়া, ঘুড়ি ওড়ানো এবং সূর্যমুখী ফুল থেকে তেল তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকে।
তৃতীয় উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয় তামিলনাড়ুর উটিতে। মে মাস নাগাদ এখানকার ফুল উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮৫ সাল থেকে নিয়মিত এই উৎসব পালন করা হয়ে আসছে। রংবেরঙের ফুলের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের সব্জি ও ফলেরও প্রদর্শন করা হয় এই উৎসবে। এখানকার ফুলের বাগান গুলিকে ফুল চাষীরা এমন এক নয়নাভিরাম দৃশ্য সৃষ্টি করে যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। একটি বিশেষ উচ্চতায় একটি ফুলের টবকে এমনভাবে হেলিয়ে রাখা হয় যেন মনে হয় সমগ্র ফুলের বাগানটি ওই হেলানো টবের ঝরে পড়া ফুলেই তৈরি হয়েছে।
পরবর্তী ফুলের উৎসবটি সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকে অনুষ্ঠিত হয়। এপ্রিল মাস নাগাদ এই উৎসবটি পালন করা হয়। প্রায় ছশো বিরল প্রজাতির অর্কিড ও পঞ্চাশ প্রজাতির রডোডেনড্রন এই প্রদর্শনীতে প্রদর্শন করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির গোলাপ, ফার্ন, ঔষধি, ক্যাকটাস জাতীয় গাছ, লতা ও গুল্ম জাতীয় গাছও প্রদর্শনীতে স্থান পায়। কিছু কিছু বৃহৎ গাছের বনসাই প্রদর্শনীকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলে। পাশাপাশি চলে খাদ্য উৎসব। স্থানীয় খাবারের পাশাপাশি দেশবিদেশের খাবারের উৎসবে সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করা হয়। সব মিলিয়ে এপ্রিল-মে মাস নাগাদ গ্যাংটকের গাছে গাছে যেমন কমলা লেবু ভরে থাকে, পাশাপাশি গাছ ও ফুলের প্রদর্শনীতে রংবাহারী এক মেলা বসে। খাদ্য উৎসব সেই প্রদর্শনীকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলে। সিকিমে এই সময় পর্যটকদের ঢল নামে। এই উৎসবটি ‘ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাওয়ার ফেস্টিভাল’ বলে অভিহিত করা হয়।
ভারতবর্ষের আরো একটি ফুলের উৎসব হলো ‘লালবাগ ফ্লাওয়ার শো’। এটি ভারতের বাগানের শহর বেঙ্গালুরুতে অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি বছর লালবাগ বোটানিক্যাল গার্ডেনের উদ্যোগে বছরে দু’বার এই উৎসব পালন করা হয়। প্রজাতন্ত্র দিবস ও স্বাধীনতা দিবসের সপ্তাহ ব্যাপী এই উৎসব পালন করা হয়। ফুল দিয়ে বিভিন্ন রেপ্লিকা বানানো হয়। হাতি, ঘোড়া, সৈনিক এমনকি পাহাড় এবং বিভিন্ন জায়গাও ফুলের রেপ্লিকায় স্থান পায়। উচ্চমানের ফুলের শিল্পীরা অধ্যবসায়ের মাধ্যমে এই ধরনের শিল্পকর্ম ফুটিয়ে তোলেন যা পর্যটক হিসেবে আসা মানুষকে মুগ্ধ করে।
আরও একটি হৃদয়গ্রাহী দর্শক আকৃষ্ট করা পুষ্প প্রদর্শনী হলো ‘কাস প্লাতু ফ্লাওয়ার শো’। মহারাষ্ট্রে অগাস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে এই পুষ্প প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। সমস্ত এলাকা রঙে রঙে রঙিন হয়ে থাকে। সাড়ে আটশো প্রজাতির বনলতা জাতীয় ফুল এলাকাকে রঙিন করে তোলে। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে এই কাস প্লাতু ফুলের উৎসবকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। মহারাষ্ট্রের প্রকৃতিকে প্রকৃতভাবে উপলব্ধি করতে গেলে বর্ষার পরবর্তী সময়ে রঙিন বনলতা এবং প্রজাপতির সমাবেশে ঘুরে আসতে হবে মহারাষ্ট্র।
অপর একটি বড় ফুলের উৎসব ‘দশেরা ফ্লাওয়ার শো”। এটি অনুষ্ঠিত হয় মাইসোরের নিশাদবাগে। এই অনুষ্ঠানটি হয় সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে। এই পুষ্প প্রদর্শনীর বৈশিষ্ট্য হলো, প্রচুর পরিমাণে গোলাপ এবং অর্কিডের ব্যবহার। কিছু বিরল প্রজাতির ফুলের সমাবেশ তুলে ধরা হয় এই প্রদর্শনীতে। ফুলের প্রদর্শনীর পাশাপাশি মিউজিক্যাল ফাউন্টেন এই প্রদর্শনীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ফুল এবং ঝর্নায় সাজানো এলাকা এক মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করে। প্রায় বারো দিন ধরে এই প্রদর্শনী চলে। হাতির মিছিল, শিল্প প্রদর্শনী এবং খাদ্য উৎসবও ‘দশেরা ফ্লাওয়ার শো’-এর অঙ্গ। দর্শনার্থীদের উপস্থিতিতে এই প্রদর্শনী থাকে সবসময় সরগরম।
আরও একবার চোখ রাখতে হয় উত্তর পূর্ব দিকে। মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ে নভেম্বর মাস থেকে শুরু হয় ‘চেরি ব্লসম ফেস্টিভ্যাল। এই উৎসব নভেম্বর মাস থেকে শুরু হয়ে বসন্তকাল পর্যন্ত চলে। দিনের বেলায় গাছের নিচে চেরি ব্লসম কার্পেটের মতো পরে থাকে। গাছের নিচে পরে থাকা কার্পেটের মতো চেরি ব্লসমের ওপর পা ফেলে চলা এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। আর রাতের বেলায় বিভিন্ন রকমের উৎসবের আয়োজন থাকে। নাচ, গান ও খাওয়াদাওয়ার পাশাপাশি রাতে এক পেগ ওয়াইনও চলতে পারে। এই সময় সমস্ত শহর আনন্দ দেওয়ার জন্য প্রায় জেগেই কাটায়।
এইধরনের প্রত্যেকটা ফুলের উৎসবই আসলে প্রকৃতির রং ও জীবনের উৎসব। প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ ওইসব বিশেষ দিনে উৎসবের আঙিনায় পৌঁছে প্রকৃতির রূপ, রস, গন্ধ, মাধুর্যকে আস্বাদন করতে চান যাতে জীবন আরো সহজ এবং সুন্দর হয়ে ওঠে।
তামিলনাড়ুর পোঙ্গল উৎসব
“নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান,
বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান।”
ভারতবর্ষ কৃষি প্রধান দেশ। বিশালায়তন ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ফসল কাটার উৎসব পালন করা হয়। প্রধানত মকরসংক্রান্তির দিনটিকে ফসল কাটার উৎসব হিসেবে পালন করা হয়। বাংলার নবান্ন উৎসবের মতো সুদূর দক্ষিণে তামিলনাড়ুতে পালিত হয় পোঙ্গল উৎসব। এই পোঙ্গল উৎসবে তামিলরা সেদ্ধ চাল ও গুড় ফুটিয়ে সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে নিবেদন করে। এই ভোগপ্রসাদকে পোঙ্গল বলা হয়। আবার তামিল ভাষায় পোঙ্গল শব্দের অর্থ ফোটানো।
তামিলদের এই পোঙ্গল উৎসব প্রায় এক হাজার বছরের পুরনো। তামিল জাতির ঐতিহ্যবাহী উৎসব এটি। প্রধানত সূর্য দেবতার পূজা করা হয়। সূর্যের কিরণেই ফসল পরিপুষ্ট হয়। তাই প্রকৃতির এই দানকে কৃতজ্ঞতা জানানো হয়।
পোঙ্গল উৎসবের সময় তামিল জনগণ নতুন জামাকাপড় পরে এবং উপাদেয় খাদ্য রান্না করে নিজেদের মধ্যে শুভেচ্ছা বিনিময় করে। চারদিন ধরে এই উৎসব পালন করা হয়। প্রথম দিনের পোঙ্গলকে ‘ভোগী পোঙ্গল’ বলা হয় এবং এইদিন ঘরদোর পরিষ্কার করা হয়। সূর্যের পাশাপাশি বৃষ্টির দেবতা এবং মেঘের দেবতারও স্তব গাওয়া হয়। বিশেষ আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আগুনের চারপাশে নাচ করে ফসলের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। বাড়ির প্রবেশ দ্বারে রঙ্গোলি তৈরি করা হয়।
পোঙ্গলের দ্বিতীয় দিনটির নাম ‘সূর্য পোঙ্গল’। মহিলারা এই দিনে মাটির পাত্রে চাল এবং দুধ একসাথে সেদ্ধ করে সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য নিবেদন করে। রান্নার জায়গায় হলুদ পাতা এবং মালা দিয়ে সাজানো হয়। এছাড়া আঁখ, কলা, নারকেল এই নৈবেদ্যতে দেওয়া হয়। মহিলারা রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকে এবং পুরুষেরা সূর্য নমস্কার ও অন্যান্য আচার অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকে। এইদিন কলাপাতা এবং নতুন ‘পোঙ্গল কোলাম’ দিয়ে ঘর সাজানো হয়। পোঙ্গল প্রস্তুত হয়ে গেলে ভগবান সূর্য এবং প্রভু গণেশের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়।
তৃতীয় দিনের পোঙ্গল উৎসবের নাম ‘মাত্তু পোঙ্গল’। মাত্তুর অর্থ হলো গরু। গরু, ষাঁড়, বলদ কৃষক পরিবারে কৃষি কাজে সহায়তা করে। তাই এই গবাদি পশুকেও এই পোঙ্গল উৎসবে পুজো করা হয়। ঘন্টা এবং মালা দিয়ে তাদের সাজানো হয় ও গায়ে রং লাগানো হয়। এরপর গবাদি পশুদের নিয়ে যাওয়া হয় শহরের কেন্দ্রস্থলে পোঙ্গল খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে। এই অনুষ্ঠানের পর গবাদি পশুর আশেপাশে কোনো অশুভ শক্তি যাতে না আসে, সেই কারণে একটি বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
‘কানুন পোঙ্গল’ হলো চতুর্থ দিনের উৎসব। এইদিন তামিল পরিবারগুলো পরস্পর পরস্পরের সাথে মিলিত হয়। সমস্ত আচার অনুষ্ঠান শেষে হলুদ পাতা বিছিয়ে অবশিষ্ট পোঙ্গল নৈবেদ্য ওই পাতাগুলোর ওপর সাজিয়ে দেওয়া হয়, যাতে পাখিরা সেগুলো খেতে পারে।
তামিলনাড়ুতে পোঙ্গল উৎসবের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে এই উৎসব পালন করা হয়। এই মাসটি তামিলদের কাছে অত্যন্ত শুভ।
বসন্ত উৎসব
সরস্বতী পুজো দিয়ে যে বসন্ত উৎসবের সূচনা, তার সমাপ্তি ঘটে রং-আবির-পিচকিরির দোল উৎসব পালনের মধ্যে দিয়ে। সরস্বতী পুজো যদি হয় কৈশোরের আনন্দ, দোল তবে যৌবনের উচ্ছ্বাসের বিকাশ। বসন্তকালের সূচনায় মাঘ মাসের পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পুজো যেমন বিদ্যার দেবীর আরাধনা, দোল উৎসব তেমনই রাধাকৃষ্ণের প্রেম লীলার আরাধনা।
বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুসারে ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ রাধিকা ও অন্যান্য গোপিনীদের সঙ্গে রং খেলায় মেতেছিলেন। সেই থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি। রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহকে দোলায় চড়িয়ে, আবির উড়িয়ে কীর্তন গান সহযোগে শোভাযাত্রা বের হয়। দেবতাকে আবির নিবেদনের পর ভক্তরা পরস্পর রং খেলায় মেতে ওঠেন। ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয় বলে দিনটি দোল পূর্ণিমা নামে পরিচিত। আবার এই তিথিতে চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মতিথি বলে দিনটি গৌর পূর্ণিমা নামেও অনেকের কাছে পরিচিত।
দোলের আগের দিনের সন্ধ্যায় খড়-কাঠ-বাঁশ সহযোগে মেড়া বেঁধে, সেই মেড়ায় আগুন জ্বালিয়ে এক বহ্নি উৎসবের আয়োজন করা হয়, যা হোলিকা দহন অথবা মেড়া পোড়া, চলতি কথায় নেড়া পোড়া নামে পরিচিত।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু অপরাজেয় থাকার বর পেয়েছিলেন। তাই কোনো দেবতাকেই মানতেন না। হিরণ্যকশিপুর বোন ছিলেন হোলিকা। দুই ভাইবোনই নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছিলেন। হিরণ্যকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদ ছিলেন বিষ্ণুর ভক্ত। প্রহ্লাদকে শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে হোলিকা প্রহ্লাদকে নিয়ে জ্বলন্ত চিতায় বসেন। আগুন জ্বলে উঠতেই অগ্নিদগ্ধ হন হোলিকা। বিষ্ণু ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হয়ে দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুকে হত্যা করে তাঁর ভক্ত প্রহ্লাদকে রক্ষা করেন। ঘটনাটি প্রকৃতপক্ষে অশুভের বিরুদ্ধে শুভের জয়ের প্রতীক। অশুভ শক্তির বিনাশ করে শুভ শক্তির আবাহনের জন্য দোল পূর্ণিমার আগের দিনের সন্ধ্যায় হোলিকা দহন বা নেড়া পোড়া অনুষ্ঠিত হয়।
হিন্দুধর্মে দোল একটি প্রাচীন উৎসব। ‘নারদ পুরাণ’, ‘ভবিষ্য পুরাণ’ এবং ‘জৈমিনি মীমাংসায়’ রং উৎসবের বিবরণ পাওয়া যায়। সপ্তম শতাব্দীর এক শিলালিপিতে রাজা হর্ষবর্ধন কর্তৃক হোলিকা উৎসব পালনের বিবরণ পাওয়া যায়। হর্ষবর্ধনের নাটক ‘রত্নাবলী’-তে হোলিকা উৎসবের উল্লেখ আছে। ইতিহাসবিদ আল বেরুনীর লেখা থেকে জানা যায় মধ্যযুগে কোনো কোনো অঞ্চলে মুসলিমরাও হোলিকা উৎসবে সামিল হতেন।
বৈষ্ণব কবি গোবিন্দ দাসের রচনায় দোল পূর্ণিমায় শ্রীকৃষ্ণ রাধিকা ও গোপিনীদের রং খেলার অপূর্ব বিবরণ মেলে।
“খেলত ফাগু বৃন্দাবন-চান্দ।।
ঋতুপতি মন মথ মন মথ ছান্দ।
সুন্দরীগণ কর মণ্ডলী মাঝ।
রঙ্গিনি প্রেম তরঙ্গিনী সাজ।
আগু ফাগু দেই নাগরি-নয়নে।
অবসরে নাগর চুম্বয়ে বয়নে।।”
সারা ভারতবর্ষেই বৈষ্ণব সম্প্রদায় অধ্যুষিত রাজ্যগুলিতে দোল উৎসব পালন করা হয়। অবাঙালি রাজ্যগুলিতে এই দোল উৎসব ‘হোলি’ বলে পরিচিত। ঋতুরাজ বসন্তের আগমন প্রকৃতিকে করে তোলে রঙিন। শিমুল, পলাশ সহ নানান বর্ণের ফুলের সমাহারে প্রকৃতি সেজে ওঠে। মানুষের মনে লাগে দোল।
বাংলায় এই দোল উৎসবের সূচনা হয়েছিল গৌড়বঙ্গে বৈষ্ণব ভাবধারার বিস্তারের মাধ্যমে। বৈষ্ণব ভাবধারার বিশ্বাস অনুযায়ী দোল পূর্ণিমার দিন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবির ও গুলাল (রং মিশ্রিত জল) নিয়ে শ্রীরাধা ও অন্যান্য গোপিনীদের সঙ্গে রঙের খেলায় মেতেছিলেন। সেই কারণে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরাধা ও তাঁদের সখী গোপিনীরা এই দোল উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু। দোলনায় দোল খাওয়ার সঙ্গে রঙ খেলার উৎসবে মেতে ওঠার মাধ্যমেই এই দোল যাত্রা বা হোলি উৎসবের উৎপত্তি। শ্রীকৃষ্ণের এই লীলাবিলাস কবে শুরু হয়েছিল, সেই বিষয় সঠিকভাবে জানা না গেলেও বিভিন্ন আখ্যান ও পদে সেই কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে।
হিন্দু পুরাণ অনুসারে প্রায় দু’হাজার বছর আগে উত্তরপ্রদেশের বৃন্দাবনে এই উৎসবের প্রচলন হয়েছিল বলে মনে করা হয়। বেদ, ভবিষ্য পুরাণ ও নারদ পুরাণে এই উৎসবের বর্ণনা রয়েছে। মহাকবি কালিদাসের ঋতুসংহার কাব্যের বসন্ত বর্ণনায় দেখা গিয়েছে যুবতী ও রমণীরা চন্দন, কুসুম রং ও কুমকুম মিশ্রিত রঙে নিজেদের রাঙিয়ে তুলতেন। দক্ষিণ ভারতের বিজয়নগরের হাম্পির মন্দিরের দেয়ালগুলোয় রাজকুমার ও রাজকুমারীর রঙের উৎসবে মেতে ওঠার দৃশ্য খোদাই করা আছে।
প্রজাদের মনোরঞ্জনের জন্য ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার জমিদার সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের বিদ্যাধর রায় চৌধুরী লাল দিঘির পাড়ে বর্তমানে রাইটার্স বিল্ডিং যে স্থানে অবস্থিত, সেখানে কলকাতার প্রথম দোতলা কাছাড়ি বাড়িতে ওই পরিবারের শ্যামরাইয়ের মন্দিরে শুরু করেন দোল উৎসব। এটিই কলকাতার প্রথম দোল উৎসব। দোল পূর্ণিমায় নয়, সপ্তম দোলে এই দোল উৎসব পালন করা হত। সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের মহিলারা রং খেলে কাছাড়ি বাড়ির সামনের এই দিঘিতে স্নান করতেন। দোল খেলার রং মিশে সেই দিঘির জলের রং হয়ে উঠত লাল। সেই কারণে এই দিঘির নামকরণ হয় ‘লাল দিঘি’।
আধুনিক বাংলায় দোল উৎসবের সূচনা করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯২০ সালে শান্তিনিকেতনে এই দোল উৎসবের সূচনা হয়। তবে দোল উৎসব নয়, বসন্ত উৎসব নামে শান্তিনিকেতনের এই উৎসব পরিচিতি লাভ করে। দোল পূর্ণিমার দিন এই বসন্ত উৎসব পালন করা হত। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আবির খেলার মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনৃত্য ও গানে এই বসন্ত উৎসবকে শান্তিনিকেতন কার্নিভালের রূপ দিয়েছেন। দেশবিদেশ থেকে দলে দলে মানুষ এসে ভিড় করতেন শান্তিনিকেতনের এই বসন্ত উৎসবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমস্যার কারণে এই বসন্ত উৎসব গত কয়েক বছর ধরে বন্ধ হয়ে রয়েছে।