পাঠক মিত্র

জীবনানন্দ দাশ একজন বিশিষ্ট চিন্তক

‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’-এ কথা বলেছেন কবি জীবনানন্দ দাশ । তাই তিনি বাংলার রূপে ধানসিঁড়ির তীরে আবার ফিরে আসতে চেয়েছেন । কিন্তু তিনি যে শুধু বাংলার মুখ দেখেছেন, তা নয় । তিনি দেখেছেন সময়ের বিপন্নতা যা মানবসমাজের সংকটকে আরো সংকটাপন্ন করেছে । কবি হিসেবে তাঁর দৃষ্টিতে সে কথা বারেবারেই ধরা পড়েছে । ‘বেলা অবেলা কালবেলা’, ‘আলোপৃথিবী’, ‘মহাপৃথিবী’ নামক কাব্যগ্রন্থগুলি তাঁর সেই দৃষ্টিপাতের ধারা । কবির দৃষ্টিপাতে কবিতার বাইরে যখন সময়ের বিপন্নতা তাঁর অন্য লেখনীতে লিপিবদ্ধ হয় তখন তাঁর দৃষ্টিপাতের গভীরতায় ছাপ ফেলে সময়ের এক অনন্য মূল্যায়ন । এমন মূল্যায়নে তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ ‘আমার কথা কবিতার কথা’ আমাদের সমৃদ্ধ না-করে পারে না । তাঁর ‘কবিতার কথা’-প্রবন্ধ কবিতা-প্রেমী মানুষ মাত্রেই জানেন । যেখানে তাঁর বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন ‘কে কবি’ । এ সম্পর্কে তাঁর বিখ্যাত উক্তি, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি ।’ এ প্রবন্ধের প্রথম লাইন এটি । কবিতার নানা বিষয় নিয়ে তাঁর আলোচনায় আমরা সমৃদ্ধ । এ প্রবন্ধগ্রন্থে তাঁর পনেরো-ষোলোটি প্রবন্ধ সংকলিত আছে । এমনকি রবীন্দ্রনাথ,  নজরুল ও বাংলা কাব্য সম্পর্কে তাঁর আলোচনা পাঠকের চেতনায় এক নতুন ভাবনা তৈরি করবে ।  একজন কবি কবিতা ও কবি সম্পর্কে বিশ্লেষণ করবেন, এতে আর নতুনত্ব কি ? এ প্রশ্ন স্বাভাবিক।  কিন্তু কবিতার বাইরে কোন কবির সমাজ ও সময়ের নিরীক্ষণ তাঁর মনন ও চেতনার আর একটি দিককে নির্দেশ করে । আর তা যদি তদানীন্তন বাস্তব সময়ের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক জটিল আবর্তকে তুলে ধরে,  তখন কবির কাল্পনিক দৃষ্টিভঙ্গিকে অনায়াসে অতিক্রম করতে পারে সাধারণ পাঠক । আর পাঠকের কাছে পরিষ্কার হতে পারে বাস্তব আবর্তের সূত্র। কবির এই প্রবন্ধ গ্রন্থের কয়েকটি প্রবন্ধে সেই সূত্রের উল্লেখ রয়েছে তদানীন্তন সময়ের বিচারে যা আজও তার সমাধান হয়নি । বরং সেই সূত্র আরো জটিল রূপে মহীরুহ ধারণ করতে চলেছে । 

কবি জীবনানন্দ দাশের এই প্রবন্ধগ্রন্থে পাঁচটি প্রবন্ধ শিক্ষা, শিক্ষা ব্যবস্থার ও শিক্ষণ পদ্ধতি সংক্রান্ত যা আজকের সময়ে অনেকটাই তার প্রাসঙ্গিকতা বজায় রেখে চলেছে । ‘শিক্ষার কথা’ প্রবন্ধে এদেশে ইংরাজী শিক্ষার দুরবস্থার কথা স্পষ্টভাব বলেছেন কবি । দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এই শিক্ষা জীর্ণ অবস্থায় টিকে আছে বলে তিনি বলেছেন । ১৩৫৯ সালের এই প্রবন্ধে বলেছেন, ‘…চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগে যারা ইস্কুলে কলেজে শিক্ষা পেয়েছিল তারা আজও দেখছে মেকলে, রামমোহন ইত্যাদি যে ইংরেজি শিক্ষা চালিয়েছিল তারই সেই আদি চেহারা–এখন অনেকটা জীর্ণ ও ধ্বংসের দিকে যদিও–টিকে রয়েছে ।’ এই জীর্ণ অবস্থা থেকে আরো জীর্ণতর অবস্থায় পৌঁছে যাচ্ছে নোট-সর্বস্ব পড়াশোনায় যা তখনই উল্লেখ করেছেন কবি । আসলে পড়াশোনা বা ভাষাশিক্ষা যাই হোক, সবই সহজ ও রুচিকর করে তোলা দরকার বলে তিনি মনে করেছেন । বিশেষত ইংরেজি । কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘ইংরেজি ভাষা এখন পৃথিবীর বিদ্যা ও জ্ঞানের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বাহন । সে পর্যায়ে উঠতে (যদি ওঠা সম্ভব হয়) বাংলা ভাষার এখনও ঢের দেরি আছে, হিন্দির দেরি আরও অনেক বেশি ।’ তিনি আরো বলেন, ‘বিদ্যা ও জ্ঞানবাহী ইংরেজি কোনো বুনিয়াদি বা উপাদান ভাষা মাত্র নয়, তার চেয়ে ঢের বেশি বড়ো, ঢের বেশি সম্পূর্ণ ও সক্রিয় । কাজেই এ ভাষাই শেখা দরকার–শিক্ষার পদ্ধতি ও পাঠ্য যতদূর সম্ভব (বিজ্ঞানসম্মত) সহজ ও রুচিকর করে তোলা ।’ নইলে শিক্ষায় অসাধ থাকলে আর তার সাথে পড়ুয়াদের আর্থিক দুরবস্থায় শিক্ষার উৎসাহ পাওয়ার মত তাদের মনের সুস্থতা হারিয়ে যাবে । সে ইংরেজি ও বাংলা সহ সব ক্ষেত্রেই। ছেলেদের মন সুস্থ করার বাস্তবতা সরকারের টাকায় বা কমিশন বসিয়ে নিলেই হবে না । চাই সদিচ্ছা । সেই সদিচ্ছার অভাব প্রসঙ্গে তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘স্বাধীনতা পেয়েও টাকাকড়ি ঠিক মতন খরচ হচ্ছে না, রাজ্য চালাবার সত্য ও পরিষ্কার কোন সূত্র নেই।  গভর্নমেন্ট হয়তো বলবেন, ব্রিটিশ যা দিয়ে গেছে তা রাতারাতি ভালো করা যায় না । সত্য কথা । কিন্তু এ পাঁচ বছরে ভালো করে তোলবার আগ্রহ সত্য হলে কাজ বেশি না হলেও একটা নতুন আবহ বোধ করা যেত । কিন্তু সেটাই হয়নি ।’ স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত সেই আবহ ভালো করে তোলবার আগ্রহের সত্যতা না-থাকা প্রসঙ্গে জীবনানন্দের আর এক মন্তব্য আজকের সময়েও তার প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি । ‘ভারতবাসীর ও বাঙালির শিক্ষা নিয়ে রামমোহন (তখনকার দিনে যতদূর সম্ভব স্পষ্টতায়) ভেবেছিলেন, পরে বিদ্যাসাগর বঙ্কিম রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন। দেশের সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষানায়কেরা এঁদের চিন্তার ও নির্দেশের ফল গ্রহণ করবার জন্যে কোনো সময়ই বিশেষ ব্যস্ত ছিলেন না; শিক্ষা সম্বন্ধে তাঁদের নিজেদের আলাদা ধারণা ছিল । দেশের বড়ো বড়ো মনীষী বা শিক্ষা কমিশনগুলো (মাঝে-মাঝে কোথাও-কোথাও) যাই ভাবুক বা বলুক না কেন, বেসরকারি ও সরকারি শিক্ষা-কর্তাদের ধারণাই আজ পর্যন্ত আমাদের দেশের ইস্কুল কলেজের শিক্ষায় একমাত্র প্রাধান্য পেয়েছে ।’ আর এমন শিক্ষা-কর্তারা সরকারের উপযুক্ত লোক হয়ে ওঠে । তাই সরকার শিক্ষার জন্য যে কমিশন বসায় তা এঁদের ভেতর থেকেই উপযুক্ত লোকদের নিয়ে; নইলে সে কমিশনের তেমন কোনো যথার্থ থাকে না । অথচ শিক্ষার উন্নতি স্থির করার কাজ ছাত্রদের শিক্ষকদের শিক্ষাবিজ্ঞানে অভিজ্ঞ পন্ডিতদের ও লোকসাধারণের বলে কবি উল্লেখ করেন । অথচ শিক্ষার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত এখন সরকারের, যা ঠিক কাজ নয় বলেও বলেছেন । আসলে এ ব্যাপারে তাঁর উপলব্ধি, ‘দেশের শিক্ষার প্রতি আমাদের স্বাধীন দেশের কর্তৃপক্ষের ভাবগতিক বিশেষ স্পষ্ট নয়; মোটামুটি ধরে নিতে হবে যে তাঁদের খুব সম্ভব কোনো মনোভাব নেই; শিক্ষা নিয়ে তাঁরা দরকারি চিন্তা বা কাজ করতে চান না ।’ এ সম্পর্কে তাঁর ব্যাখ্যায় এই সময়ের ভাবনাও দেশে বিদেশে সমানভাবে জড়িয়ে আছে । ‘গভর্নমেন্টের টাকা প্রথমেই এবং সবচেয়ে বেশি করে শিক্ষার জন্যেই খরচ করা উচিত একথা আজকের জাতিদের পরস্পরের বিদ্বেষের দিকে লক্ষ্য রেখে বলা সম্ভব নয় । প্লেটো যে গণতন্ত্রের কথা ভেবেছিলেন বা গান্ধী যে আদর্শ অহিংস পৃথিবীর কথা বলেছিলেন–সেখানে সব মানুষের সৎ শিক্ষার জন্যেই হয়তো গভর্নমেন্টের টাকা ও পরামর্শ সবচেয়ে আগে বেশি বেঁটে দেওয়ার কথা । কিন্তু আজকের পৃথিবী সেসব নির্দোষ গণতন্ত্রের বলয় থেকে একেবারেই অন্যরকম। কোন জাতির সঙ্গে কোন জাতির কী সূত্র নিয়ে কবে গোল বাঁধবে সব জানা না থাকলেও এটা স্পষ্ট যে, এ পৃথিবীতে নানা দিক দিয়ে নানা জাতির ভেতরে যে ঝগড়া লেগেই আছে, তা যে-কোনো সময় বিষম রূপ নিয়ে দাঁড়াতে পারে । এ অবস্থায় সরকারের টাকা প্রথমে ও খুব সম্ভব সবচেয়ে বেশি পরিমাণে আত্মরক্ষার ব্যাপারেই (বাইরে ও দেশের ভেতরে) যে খরচ হবে সেটা বোঝা যায় ।’ এই সময়ে দেশের সামরিক-বাজেটের তুলনায় শিক্ষা-বাজেট ভগ্নাংশ-মাত্র কবির এ কথাকেই প্রমাণ করে । আমাদের দেশ শিক্ষাকে  সঠিক ও সৎ চিন্তার কাজে প্রকৃতপক্ষে মূল্য দিতে পারবে কিনা সে ভাবনায় ভাবিত হয়েছিলেন কবি। সেই ভাবনা নিয়ে তিনি লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ইস্কুল কলেজে অবাস্তব শিক্ষার মাত্রা বেড়ে গেছে, আরও বাড়বে হয়তো । এমন শিক্ষায় তার ফলাফল খারাপ হতে থাকবে । আর তা হলে, দেশের পক্ষে অশিক্ষিত ও আধো-শিক্ষিত হয়ে পড়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না, ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের নানা রকম দায়িত্বের জায়গায় অনেক কাঁচা লোকের ভিড় এসে পড়ে, সেটা রাষ্ট্রের পক্ষে বিপদের জিনিস । দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্বন্ধে তাচ্ছিল্য দেখিয়ে গভর্নমেন্ট সেই বিপদকে ডেকে আনে এবং যে অজ্ঞতায় ও অন্ধকার দেশ ছেয়ে ফেলে, সেটা মনের ও বাইরের সভ্যতা ও স্বাধীনতা একেবারেই হারিয়ে ফেলার মতো খারাপ জিনিস হয়ে দাঁড়াতে পারে জাতির পক্ষে ।’ আর এক জায়গায় বলছেন,’শিক্ষার যে-কোনো নতুন ব্যবস্থা টাকা ও চরিত্রের অভাবে নষ্ট হয়ে যাবে । —–দেশের কর্মকর্তাদের হাতে দেশের অবস্থা যদি না শোধরায়, কোনো ভালো লক্ষণও অন্তত অনুভব করতে না পারা যায়, তাহলে সে-সবের প্রতিক্রিয়া ছাত্রদের পক্ষে এড়ানো সম্ভব নয়–শিক্ষকদের পক্ষেও না । অথচ অন্য পাঁচ রকম অভীষ্টের চেয়ে শিক্ষা ঢের বেশি দরকারি জাতির জীবনে ।’ শিক্ষার অধঃপতন হলে জাতির সংকট অবস্থার এ এক পূর্বাভাস । কবির এ যেন এক সাবধান বাণী । তাঁর সাবধান বাণীর এই পূর্বাভাসে কতজন আজকের শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থার সংকট নিয়ে ভাবছি আমরা যারা আজকে কবির সাহিত্য নিয়ে বাংলা সাহিত্য নিয়ে গর্ব করি । অথচ তিনি ভাবলেন ।

দেশ ও দশের শিক্ষা নিয়ে শুধু ভাবলেন না, ভাবলেন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা। যে অবস্থায় ভারতবর্ষ দুঃস্থ-দরিদ্রের দেশ–এদেশে কোটি কোটি লোকের দিনে একবেলা অন্ন জোটে মাত্র–আরও কোটি-কোটি দিনের পর দিন উপবাাস করে কাটায় । জাতির বিরাট অংশকে চিরন্তন মন্বন্তরের ভিতর দিয়ে কাল অতিবাহিত করতে হয় ।…এমন অজস্র লোক আছে শহরের ফুটপাত ছাড়া মাথা পাতবার কোনো স্থানই যাদের নেই, এদের চেয়ে একটু স্তর উপরে যারা অন্ধকার কুঠুরির বস্তিতে গাদাগাদি করে থাকে, যাদের বস্তিতে থাকার স্বত্বাধিকার কেবল বিষকুন্ডুলীর মতো পৃথিবীর যাবতীয় পচা আবর্জনা অস্থি ও মর্মে শোষণ করে নেওয়ার শক্তি অর্জন করতে পারে । এমনিতেই দারিদ্রতায় মরে, আবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার এরাই । এমন অসুস্থ সমাজকে বিকশিত করতে রাজনীতিকে প্রগতিশীল জনহিতৈষী ধনবিজ্ঞানের কল্যাণসত্তা দ্বারা বিশোধিত করার প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেন কবি । রাজনীতির এই বিশোধিত ও বিকশিত রূপ রাষ্ট্রিক স্বাধীনতা লাভের উপর নির্ভর করে না । তার জন্য চাই সৎ ও সুচিন্তিত অর্থনৈতিক সুনিয়ন্ত্রণ । 

আজও সেই সৎ ও সুচিন্তিত অর্থনৈতিক সুনিয়ন্ত্রণের অভাব রয়েছে । যার করুণ অবস্থা দেখিয়ে দেয় বিশ্ব ক্ষুধা-সূচকে দেশের স্থান আজ একেবারে নীচের দিকে । অর্থনৈতিক সুনিয়ন্ত্রণের অভাব যে কারণে তার ওপর কবির আলোকপাত তাঁর ‘আলোকপাত’ প্রবন্ধের প্রথম ছত্রেই উল্লেখ করেছেন । ‘আমাদের সমাজ নিয়ন্ত্রণ যে অত্যন্ত অসাধু প্রতি পদেই সে কথা আমরা উপলব্ধি না করে পারি না । কত কম লোক এখানে স্বচ্ছল, সুখী –কত বেশি লোক নিঃসম্বল, অনাথ, অসুস্থ । যাদের টাকা আছে, তাদের হাতেই আরও টাকা আসছে; এদের সংখ্যা কত কম । যাদের টাকা দরকার তারা তা পায় না; অর্থাৎ প্রায় গোটা মানবজাতিই খেতে পরতে একটু অবসর উপভোগ করতে গিয়ে অল্প কয়েক জন মানুষের হাতে প্রবঞ্চিত খেলার পুতুলের মতো ফিরছে ।’ সমাজের এমন অবস্থার পরিবর্তন আজও-যে হয়নি তা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ মাত্রেই জানেন । ভালো সমাজের আবির্ভাব নিয়ে তদানীন্তন সময়ে তাঁর সংশয় আজও দূর হয়েছে বলে বলা যায় না । তাঁর কথায়, ‘গরিব মানুষের দুঃখ যে খারাপ সমাজের অবিচারের ফল–সে তো জানা কথা; এ-ও জানি যে, ভালো সমাজের আবির্ভাব যেন শিশুর হাত বাড়ানোর মতো–আকাশে চাঁদ এলে । এ সফলতা বাস্তবিক শিশুবোধিনী, না সত্যিই সার্থক একদিন আগামী সমাজের দার্শনিক তার উত্তর দেবেন ।’ ভালো সমাজের আবির্ভাব যেখানে ন্যায্য অনুপাতে সকলের অভাব ঘুচে গেলেও দৃষ্টিরীতির সাহস আলো ও সততার উপরেই শান্তি ও আনন্দ নির্ভর করে । কিন্তু সেই দৃষ্টিরীতির পরিবর্তন হয়ে যায় অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অবিচারের জন্য । এই অবিচার চলে ধনতান্ত্রিক দুষ্কৃতীর হাতে । যার সত্যে প্রবেশ করার মতো চাই শিক্ষিত শুদ্ধ দৃষ্টিসফলতা । 

কিন্তু শিক্ষিত শুদ্ধ দৃষ্টিসফলতার জন্য চাই এমন শিক্ষা যা বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে কোনো বিষয়কে বিচার করার ক্ষমতা মানুষ অর্জন করতে পারে । সেই শিক্ষার প্রচলন নিয়ে কবির সংশয় এই আলোচনায় আলোচিত হয়েছে । কবি মনে করেছেন সেই যুক্তির ধারা রামমোহন, বিদ্যাসাগর ও তদানীন্তন কয়েকজন মনীষী প্রশ্ন করতে শিখিয়েছিলেন বাঙালি তথা দেশবাসীকে । পরবর্তী সময়ে কবি বললেন, ‘বাঙালির জীবনে সে জিজ্ঞাসার প্রাধান্য কিছুই তেমন নেই এখন আর । রামমোহন প্রভৃতি মনীষীর ও দেশি-বিদেশি যুক্তি-দর্শনের ফল জাতীয় জীবনে স্থায়ী হবে মনে হয়েছিল। কিন্তু তা হয়নি ।’ এমনকি ধর্মীয় ও আধ্যাত্মবাদে যুক্তি ও নীতি প্রশ্নের মূল্য একেবারে ক্ষয়ের পথে চলেছে বলে কবি মন্তব্য করেছেন । আর এই ক্ষয় আরো বর্ধিষ্ণু যখন ধর্মবাদীদের ধর্মে জাতীয়তাবাদ ঢুকেছে । 

যদিও সমাজের এমন অসঙ্গতি মানুষের মনে বিশেষ করে বাঙালির মনে অনেকটাই কেটে গিয়েছিল বলে কবি মনে করেছিলেন, যখন ইউরোপীয় বিপ্লব থেকে রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রবাদ ও মার্কসবাদের মর্ম এসে পৌঁছতে পেরেছিল এ দেশে ।  রামমোহন ও তাঁর জিজ্ঞাসা যুক্তি, বিদ্যাসাগর মশায়ের কাজ ও যুক্তি যা দিয়ে গেছে তার পরের বিশেষ ধাপ হিসেবে এই সব বিপ্লবের পূর্ব ও উত্তর সিদ্ধান্ত, নতুন চৈতন্য ও বিশ্লেষণের খুব দরকার ছিল বলে কবি মনে করেছিলেন । কিন্তু মার্কসবাদের সত্য-মিথ্যা ভেদ করে জিজ্ঞাসার একান্ত মূল্যের ওপর সে দর্শনে যে জোর দেওয়া হয়েছে, সে পথে চলার মতো তেমন কোনো যোগ্য চিন্তা বা কাজকর্ম যেমন দেখা গেল না, আবার গান্ধীর দর্শনের সহজ অথচ দুঃসাধ্য যুক্তিও বাঙালি তেমন নিল না বলে কবি বলেছেন । 

সমাজে নানা অসংগতি থেকে সাহিত্যের শিল্পফলে তার প্রভাব এবং নানা দর্শনের সাথে তার যোগসূত্র নিয়ে কবি বললেন, ‘গান্ধী, মার্কস, কিয়ের্কগার্ড বা অন্য কারও সিদ্ধান্ত ও দর্শনের সঙ্গে সাহিত্যের বিশেষ কোন সাক্ষাৎ যোগ নেই।  প্রত্যেক সৎ সাহিত্যে কোনো না কোনোরকম জীবনদর্শন আছে, কিন্তু সে দর্শনের ভালোমন্দের সঙ্গে শিল্পফলের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই।….কিন্তু বাংলার স্বভাবে পরিষ্কার যুক্তিও অনেক দেখা গেছে, এবারে তা ঢের বেশি করে লাভ করবার নিতান্ত দরকার বোধ করা যাচ্ছে ।’ কবি মনে করেন, যুক্তিকে ক্ষুণ্ণ করলে বেড়ে যায়, ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারলে প্রায়ই কোনোরকম অন্ধশক্তির কাছেই ভীত বা নির্জিত হতে হয় না, স্পষ্টতা ও কল্যাণের মাত্রা বাড়তে থাকে । 

কবি জীবনানন্দ দাশের ‘আমার কথা কবিতার কথা’ প্রবন্ধগ্রন্থে সংকলিত ছত্রিশটি প্রবন্ধের মধ্যে কবিতা ও সাহিত্য সম্পর্কিত প্রবন্ধ ব্যতীত শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক প্রবন্ধগুলির স্পষ্টতা তাঁর সমাজ ভাবনার যথার্থ প্রতিফলন যা আজকের সময়ের সাথে তার তুলনায় শুধু নয়, চলমান সমাজের নানা বিষয়ে পাঠকের কাছে প্রশ্ন তুলবে । যা দিয়ে জীবনানন্দ দাশকে তাঁর কবিসত্তার বাইরে পাঠক তাঁকে আলাদাভাবে বিশিষ্ট চিন্তক হিসেবে চিনতে পারবে ।

আমার কথা কবিতার কথা

–জীবনানন্দ দাশ 

–ছোঁয়া, হুগলি 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *