বিদ্যুৎ মণ্ডল
প্রথম পর্ব
চণ্ডীগড় সফর
গ্রীষ্ম পেরিয়ে বর্ষা এসেছে, তবুও সূর্যের তাপ মধ্যগগনে। গ্রীষ্মের দাবদাহ অতিষ্ট করে তুলছিল দিন দিন। নিত্য তাপমাত্রা পর্বত শিখরে পৌঁছাচ্ছিল, বাতাসে একেবারে জ্জ্বলন্ত অঙ্গার ঝরে পড়ছিল, বৃষ্টির কোনো দেখা নেই, পর্যাপ্ত জলের জোগান নেই বলে চাষিদের চাষ বন্ধ, মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে, হাজার হাজার কৃষক আত্মহত্যা করে চলেছে, গাছের পাতা গুলো শুকিয়ে ঝরছে, যত্র তত্র পাখিদের মৃতস্তূপ এবং একইভাবে মনের জমিতে আবাদি বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে, সূক্ষ্ম বুদ্ধি শান দেওয়ার অভাবে ভোঁতা, স্থূল, অকেজো হয়ে যেতে বসেছিল এমতাবস্থায় আবহাওয়ার পরিবর্তন একান্ত জরুরী।
বেশ কয়েকদিন ধরে মনটাও কেমন বিষণ্ণ হয়ে আছে। শরীর সুস্থ সুঠাম থাকলেও কোনো জোর নেই মনে, একেবারে নিষ্ক্রিয়, নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। গত কয়েকদিন যাবৎ লক্ষ্য করে যাচ্ছি সময়টাও বড্ড খারাপ যাচ্ছে। যে বিষয়েই মনোনিবেশ করছি সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। মেঘরূপ ঘনকালো অস্বস্তি ছেয়ে ফেলেছে মনের সর্বত্র। মন যে কি চাইছে কিছু ঠাওর করে উঠতে পারছি না। এদিকে বয়স বাড়ার সাথে সাথে ভীষণ একলা হয়ে পড়ছি। আত্মীয় বন্ধু পরিজন থেকে চলে যাচ্ছি ক্রমশ দূরে। মাঝে মাঝে জীবনের মকসদ খুঁজতে খুঁজতে রাত কাবার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু অর্থ কিছু পাচ্ছি না। সকালে বিভাগ, সন্ধ্যায় বাড়ি, এই নিয়মের নেই কোনো ব্যতিক্রম। জীবনের খাতা থেকে যেন মুছে ফেলেছি বিশ্রামের হিসেবটা।
একদিন রাতে ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে দেখলাম একটি বিজ্ঞাপন দেওয়া আছে “মানালি পাস ট্রেক…..সিট সংখ্যা লিমিটেড…” খোঁজ নিয়ে জানতে পারি কিংশুকদা-র টীম ভালোই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হিমালয় থেকে শুরু করে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত। আগে-পিছে কিছু বিবেচনা না করেই দিলাম বুকিং কনফার্ম করে। যাত্রা শুরুর আর মাত্র বাকি এগারো দিন। হাওড়া থেকে চণ্ডীগড় ট্রেনে চেপে, সেখান থেকে কোনো প্রাইভেট গাড়িতে বা বাসে করে পৌঁছাতে হবে মানালি। তবে যাত্রা শুরুর অন্ততপক্ষে একমাস আগে থেকে টিকিট বুক না করলে টিকিট সচরাচর পাওয়া যায় না। কাজেই বুঝতে পারছিলাম না যে আমার কি করে কনফার্ম টিকিট পাওয়া যাবে। হয়তো ওদের বিশেষ কোনো কোটা থাকে এবং তার ভিত্তিতেই অল্পদিনের মধ্যে টিকিট কাটলেও তা কনফার্ম হয়ে যায়।
হঠাৎ করে এত বড় ভ্রমণের কথা জানাতেই বাড়ির লোক হতচকিত হয়ে গেল। বলা নেই কওয়া নেই হুট করে পাহাড় ভ্রমণ; তাও আবার মানালি। মা সপাটে মুখের ওপর বলেই দিল “তোর মাথা ঠিক আছে তো? এই মাত্র এতবড় একটা ধাক্কা থেকে উঠলি। তাছাড়া চেনা নেই, জানা নেই, একদল অচেনা লোকেদের সাথে এতদূর যাবি? ছেলেমানুষি করিস নে, পারলে কাছাকাছি কোথাও থেকে ঘুরে আয়।” “কিন্তু রেজিস্ট্রেশন তো হয়ে গেছে, অগ্রিম টাকাও জমা করে দিয়েছি, এখন আর প্ল্যান চেঞ্জ সম্ভব নয়।”- আমি প্রত্যুত্তরে জানালাম মাকে। অগত্যা আর কথা বাড়াল না মা। বাবাও ঘাবড়ে গেল এই ভেবে যে জানা নেই, শোনা নেই, কাউকে চেনেও না হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল অচেনা মানুষদের সাথে ট্রেকিং-এ যাওয়ার। কে জানে মনে মনে হয়তো ভাবল আমি বাড়িঘর পরিত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার জন্য মনস্থির করেছি। তাছাড়া গত কয়েকদিন ধরে বাড়িতে বলে চলছিলাম যে সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে পাহাড়ে চলে যাব, এক অন্যরকম জীবন কাটাব। আমি বরাবরই এরকমই। না বলে কয়ে হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়ে পড়ি বাড়ির সাথে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে। আশ্বস্ত করে যায় এই বলে যে আমার জন্য যেন কেউ কোনো চিন্তা না করে। তবে অবশ্যি এবারের প্রস্থানটা ঠিক ঐরকম নয়। কারণ গতবার হেমকুণ্ড অভিযান করে ট্রেকিং এর যে স্বাদ পেয়েছিলাম তা পুনরায় রসাস্বাদন করতেই মানালি পাশ পাশ ট্রেক এর এই সিদ্ধান্ত। পাহাড়ের বুকে খোলা আকাশের নীচে তাঁবু খাটিয়ে রাত্রিযাপন কে না করতে চায় বলুন!
প্রস্তুতি পর্ব শুরু হল। কি কি নিতে হবে তার লিস্ট করতে করতে দু চার দিন গেল কেটে। নতুন করে কোনো কেনাকাটার দরকার বোধ করলাম না। যা আছে সেগুলোতেই হয়ে যাবে ভেবে নিশ্চিত বোধ করতে লাগলাম। মাঝে মাঝে একটা দুঃশ্চিন্তা এসে হাজির হচ্ছে মনে, প্রচণ্ড দাবদাহে স্লিপার শ্রেণিতে ভ্রমণ তাও প্রায় দুই দিন ট্রেনেতেই কাটাতেই হবে- এসব ভাবলেই কেমন যেন আগ্রহ উৎফুল্লতা প্রশমিত হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া সঙ্গে কারা যাবেন, তারা কেমনই বা হবেন এসব নিয়ে কিঞ্চিৎ দ্বিধাসংকোচেও ছিলাম। যাকগে যা হবার হবে দেখা যাবে ঐ দিন। কিংশুকদার থেকে যখন জানতে পেরেছিলাম পাহাড়ে রাত কাটাতে হবে, শুনেই শিরায় শিরায় টানটান উত্তেজনা বয়ে গেছিল। সেখানে তাপমাত্র ৬ডিগ্রি এবং তাঁর নীচে থাকবে। একদম চূড়াতে -ডিগ্রিও থাকতে পারে, ভাবতেই কেমন যেন অ্যাডভেঞ্চার অ্যাডভেঞ্চার লাগছে। ভাগ্য অত্যন্ত প্রসন্ন হলে বরফ দর্শনও হয়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যে যাঁরা যাঁরা যাবেন তাদের নিয়ে একটা গ্রুপ বানানো হল। প্রয়োজনীয় জিনিস কি কি অত্যাবশ্যক তার একটা তালিকা পাঠানো হল। সেই অনুযায়ী ব্যাগপ্যাক করলাম। পাহাড়ে বেশি জিনিস নিয়ে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয় ভেবে মালপত্র যত পারলাম কমিয়ে নিলাম। প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটাও জিনিস নেওয়া চলে না পাহাড়ে, সেগুলি পরে কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং এমনকি মৃত্যুরও কারণ হতে পারে। যেহেতু নিজেদের মালপত্র নিজেদেরকেই বহন করতে হবে, তাই সেই অনুযায়ী যত অল্প জিনিস হবে ততই সুখপ্রদ।
একে একে দিন গুণে চলেছি। কে জানে হয়তো ফিরে নাও আসতে পারি। যতবারই দূরে কোথাও যায় ততবারই তার পূর্বে মোটামুটিভাবে যাদের জন্য যা যা করার বা দেবার থাকে সেটা বরবরই পালন করি। এবারও এর বিপরীত হল না। এদিকে সেন্টার-ইন-চার্জ হয়ে স্পেশাল সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষার দায়িত্ব বর্তানো হয়েছে। গত কয়েকদিন সেইসবেরই ইন্তেজাম করে রাখছি, যাতে কোনো অসুবিধা না হয়। বাকি যেগুলি করনীয় ছিল বিভাগীয় প্রধানের হাতে সঁপে দিয়েছি ততক্ষণে। লিখিত পরীক্ষাগুলো সম্পূর্ণ হলেই সেই রাতেই বেরিয়ে পড়বো সেইমত সব আয়োজন ছিল।
অবশেষে এল যাত্রার দিন। সময় যে কি করে বয়ে যায় কেই বা তার হিসাব রাখে! কিন্তু সময় ঠিক আমাদের হিসাব কষে রাখে। ট্রেন ছিল রাত নটা পঞ্চান্নতে। কালকা মেইলেই টিকিট কাটা হয়েছিল- হাওড়া থেকে চণ্ডীপুর। মজার বিষয়, গ্রপে যে টিকিট পাঠানো হয়েছিল সেখানে আমার নাম ছিল না। প্রথমে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, আমার তাহলে কোনো টিকিট হয়নি অথচ আমি যাচ্ছি এটা নিশ্চিত। পরে জানতে পারলাম যে শ্যামল পাণ্ডা নামের ব্যক্তি হয়েই আমাকে যেতে হবে। এজেন্টরা একসাথে অনেক টিকিট বুক করে থাকে অনেক আগেই, অ্যাডভানস। পরে যারা যায় না তাদের শূন্যস্থান পূরণ হয় আমার মতো আগন্তুকদের দ্বারা যাদের হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়ে যাওয়ার বাসনা জাগে। যাইহোক, রাতেই ট্রেন কাজেই রাত্রিভোজন সেরেই ট্রেনে চাপতে হবে। সারাদিন ধরে পুনরায় ব্যাগপ্যাক করলাম। সঙ্গে প্রায় কেজি খানেক ড্রাই ফ্রুট নিয়ে নিলাম। সন্ধ্যেতেই রাত্রিভোজন সম্পন্ন করে হাওড়ার উদ্দেশ্য পাড়ি দিলাম। দিনটা ছিল রবিবার। পথঘাট অন্যদিনের তুলনায় একটু কম লোকারণ্য। রাতের কলকাতা সুন্দরী যেন এক অপরূপ সাজে সেজে উঠেছে, কি অদ্ভুত লাবণ্য, বড়োবড়ো ইমারতগুলো যেন আকাশ ফুঁড়ে মাথা তুলে আছে। ছবির মতো দৃশ্যগুলো দ্রুত গতিতে পালটে পাল্টে যাচ্ছে। বিশ্বসুন্দরী কলকাতাকে পেছনে ফেলে কত কষ্ট হচ্ছে। কত মায়া জড়ানো এশহর, টুকরো টুকরো শতসহস্র স্মৃতি দিয়ে ঘিরে রেখেছে মনের প্রাচীর। মনে হচ্ছে যেন চেনা পথের দিশা ছাড়িয়ে কোনো অজানা রহস্য উদ্ঘাটনের আর্জি নিয়ে পথে নেমেছি। মুঠো মুঠো ধনসম্পদ, কিংবা অপার প্রাকৃতিক ঐশর্য্য অপেক্ষা করে আছে আমাদের আসার। এসব ভাবতে ভাবতে গাড়ি একটা ব্রিজে উঠতেই বুঝলাম পৌঁছে গেছি হাওড়াতে। নীচে মা গঙ্গা আপন খেয়ালে বয়ে চলেছে। দুপাশের শহর যেন গঙ্গার জলেই তাদের ঘাঁটি গেড়েছে। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ চিকিমিকি আলোতে ঢেউগুলো রুপোলী চাঁদের আলোতে লুকোচুরি খেলে চলেছে। মনে হচ্ছে যেন সমগ্র শহর তাদের বসত গেড়েছে নদীগর্ভেই।
নটা বাজার অনেক আগেই পৌঁছালাম হাওড়াতে। ঘড়ির কাঁটা একই তানে হেঁটে চলেছে। এখন শুধু ট্রেনের অপেক্ষায়। এক এক করে গ্রুপের সকল সদস্যরা আসতে থাকলেন। সব নতুন মুখেদের ভিড় এসে হাজির হতে লাগল। তাদের মধ্যে একজনকে চেনা লাগল এবং তিনি যদুবংশেরই সদস্য। পরিচয় বিনিময় করে কথোপকথন শুরু হল। আগামী দশ এগারো দিনের দীর্ঘ যাত্রার ভাগীদার সকলে। তবে টিকিট যেভাবে কাটা হয়েছিল কেমন যেন খাপছাড়া হতে হয়েছিল। কেউ কেউ এসি কামরাতে, কেউ কেউ আবার আছে আশেপাশের কোচে। আমাদের ছয়জনের টিকিট একই কক্ষে সংরক্ষিত হয়েছিল। আমি এখন শ্যামল পাণ্ডা, এই নামেই চণ্ডীগড় পর্যন্ত গন্তব্য। গাইডকে ধরে তের জন ছিল আমাদের টীমে। কিংশুক দায়ের টিম হলেও কলকাতা থেকে গাইডের দায়িত্ব বর্তানো হয়েছিল মনোজদার উপর। গম্ভীর, মেজাজি স্বভাবের মানুষ তিনি। যাইহোক, আলাপ বিনিময় শেষ করে যে যার সংরক্ষিত শয়ন আসনে উপবিষ্ট হলেন। রাতের খাবার গ্রহণ করেই প্রাই সকলেই রওনা হয়েছিলেন। দু একজন যারা রাতের খাবার না খেয়েই ট্রেনে চেপেছিল তারা রাত্রিভোজন সম্পন্ন করে নিদ্রা যেতে ব্যস্ত। আমি সাইড আপারে গ্যারেজ হয়ে গেলাম। রাতের বেলা ভেবেছিলাম ট্রেনে চাদর লাগতে পারে, কিন্তু যা হল ঠিক তার উল্টো। গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার। পাখাগুলি যেভাবে বিভাজিত ছিল তাতে সাইড আপারে কারো সিট সংরক্ষিত হলে তাঁর কপালে দুঃখ আছে। অগত্যা ভারী পোষাক গুলো পরিত্যাগ করে হাল্কা রাতের পোষাক পরিধান করে শয়ন করলাম। ট্রেন ছুটে চলেছে আপন বেগে, না জানি কোন অচিন দেশে নিয়ে যাচ্ছে। শুধু একটাই আওয়াজ কানে আসছে- “ঝকাঝক….. ঝকঝক ঝকাঝক…… ভোঁ… ঝকাঝক… ঝকঝক ঝকাঝক…..” ট্রেনের আওয়াজের সুরে কত মনগড়া শব্দ ভাবতে ভাবতে ঘুমের দেশে ঢুলে পড়লাম।
ট্রেনের ঝাঁকুনিতে ঘুম ঠিকমতো হয় না আমার। ব্রেক ঘুম হতে হতে রাত্রি গড়িয়ে ভোরের ঝাঁঝালো কুয়াশামাখা গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা মারতেই ঘুমটা কেটে গেল। দূরে থেকে একটা স্বর ভেসে এল কানে- “চায়ে….., চায়ে… লেমন টি হ্যায়; চায়ে হ্যায়…” বিক্রেতাদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে জোরকদমে। গরমের দাপটে ঘুম তো হলই না, পরন্তু খুব ভোরেই জাগতে হল। উপরের আসন থেকে নেমে নীচে বসে, সকালের প্রকৃতি দেখার লোভে জানালা থেকে মুখ গলিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি বাইরের দ্রুত সরে সরে যাওয়া দৃশ্যগুলোর দিকে। ট্রেন চলার কোনো বিরতি নেই, তীব্র বেগে ছুটে চলেছে সবকিছুকে পিছনে ফেলে। তার কোনো পিছু টান নেই, না আছে কোনো অতিক্রম করা দৃশ্যকে আগলে রাখা, না আছে পেরিয়ে যাওয়া বিষয়ের প্রতি মায়া। এ শুধু সামনের দিকে, তথা সামনের পথেই ছুটতে শিখেছে। আমরা মানুষেরা যদি এই ধরণের অভ্যাস বজায় রাখতে পারতাম, তাহলে হয়তো পৃথিবীর বুকে থেকে মুছে যেত আত্মহত্যার মতো মহা অভিশাপগুলি, মুছে যেত বিষণ্ণতা, মন থেকে কেটে যেত নৈরাশ্য।
চারিদিকে সবুজে সবুজে খেলা শুরু করে দিয়েছে। ধূসর মেঘমুক্ত নীল আকাশের নীচে সবুজের প্যাচ দেখলে চোখদুটো ধেয়ে যায় বারেবার। দূরে একদল গোরু সবুজ কচি কচি ঘাস তৃপ্তিভরে রসাস্বাদন করছে, আর মাঝে মাঝে আশেপাশে ওপর নীচে বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে যাচ্ছে। একঝাঁক পাখি ডানা মেলে গান গাইতে গাইতে উড়ে চলেছে বাতাসের ছন্দে। এত সকালে কোনো মোড়ল পাখি তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এদিক ওদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে সম্ভবত খাবারের খোঁজেই। ভোর-সকালের এক অপূর্ব ঘ্রাণ, যেন মনে হয়ে গোটা সকালের সাথেই মিশে আছি।
দিনের আলোর তীব্রতা যত বাড়তে লাগল ততই কষ্টের পরিমাণও বেড়ে যেতে লাগল। স্লিপার শ্রেণীতে গরমের সময় যাওয়া যে এতটা কষ্টকর হবে তার আন্দাজ আগে থেকেই আঁচ করতে পারছিলাম। কতশত মানুষ দিব্যিই এইগরমে ঘুমিয়ে আছে, এমনকি তাদের নাসিকারন্ধ্র হতে নির্গত বাতাস জয়ঢাকের ন্যায় বেজে চলেছে। এরাই পারে বলি হারি।
সকালে হাল্কা টিফিন করে নিলাম ট্রেনেই মধ্যেই পাওয়া খাদ্যাদি সামগ্রী দিয়ে। এক এক করে গ্রুপের সবাই এসে জাঁকিয়ে বসল, আড্ডা গল্পগাছা শুরু হয়ে গেল। রাত্রে সেভাবে আলাপ হয়ে ওঠেনি, সকালে তা সম্পূর্ণ হল। দেখলাম আমাদের সাথে একজন ক্লাস টুয়েলভের বাচ্ছাও এসেছে। সে চুপচাপ বসে ফোন ঘেটে চলেছে একমনে। একটা ধমক দিতেই সে থতমত খেয়ে গেল। তাকে বললাম, “এই ছেলে এত ফোন এডিকটেড হলে ট্রেকিং অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ নেবে কি করে ?” সে চটজলদি ফোনটা পকেটে রেখে হাসি মুখে উত্তর দিল, “সময় কাটছে না দাদা, তাই ফোন এ গেম খেলে সময় পাস করছি। তবে গেম বেশি খেলি না। ফোনে বেশি পড়াশুনাই করি।” ছেলেটির উত্তরে প্রসন্ন হয়ে বার্তালাপ শুরু করে দিলাম। ভোরে দূর্গাপুর থেকে আমাদের যদুবংশেরই এক দাদা উঠেছিল সেও এই ট্রেকিং গ্রুপের সদস্য। তারসাথেও হল পরিচয়। প্রথমদিকে ভাবছিলাম যে কিভাবে সময়গুলো অতিবাহিত হবে কে জানে। কিন্তু না বেশ লাগছে- খোলা জানালা দিয়ে মাঠঘাট ছুটে চলেছে আর এদিকে এ ওকে, সে তাকে শব্দের পর শব্দ ছুঁড়ে চলেছে হাসি-ঠাট্টাতামাসা। কখন যে দুপুর ঘনিয়ে এল তার কিচ্ছু টের পাওয়া গেল না। গল্প একেবারে জমে বসেছে। একটা তাসের ডেক কে খুব মিস করছিলাম। স্টেশন থেকে কিনে নেব ভেবেও ভুলে গেছি। ট্রেনের মধ্যে আমরা যে মাহল বানিয়ে রেখেছিলাম তাস হলে ব্যাপারটা মাখো মাখো হয়ে যেত। কি আর করার, ব্যাড লাক। সকালে ভালোরকম ব্রেকফাস্ট করলেও বসে বসে সময় কাটাতে কাটাতে খুব তাড়াতাড়ি খিদে পেয়ে গেল। আই আর সি টি সি-র কর্মীকে ডেকে সকলের মধ্যহ্ন ভোজনের তালিকা দিয়ে দেওয়া হল। বিশ ত্রিশ মিনিট এর মধ্যে খাবার চলে আসবে। সকলে হাপিত্যেশ হয়ে খাবারের অপেক্ষা করে আছে। তবে মনোজ দা যেন কিছু একটা ভেবে চলেছে, কেমন যেন আনমোনা হয়ে ছিলেন। জানিনা তখন ওনার মনে কি ভাবনা বাসা বেঁধেছিল। পরে জিজ্ঞেসও করিনি কখোনো। যেটুকু না জানা ছিল তা না জানাই থাক। এদিকে খাবার আসতেই বাধল গণ্ডগোল। খাবারের মেনুতে দইয়ের উল্লেখ থাকলেও আই আর সি টি সি কর্মী বিষয়টাকে একেবারে নাকচ করে দিলেন। বললেন, “দাদা দই পাওয়া যাবে না, আগে দেওয়া হত এখন আর দেওয়া হয় না।“ দেবু দা শুনে খচে আগুন, বছরে তিন চারতে করে ট্রেক করে সে আর বরবরই ট্রেনের খাবার অর্ডার করে খায়। এ ছেলে বলে কি! বলল “আমি প্রায় যাতায়াত করি আমাকে গল্প দেবেন না দাদা। দই না পেলে যা করার আমি করছি।” সঙ্গে সঙ্গে কর্মীটি ঘাবরে গিয়ে উত্তর দিল, “দাদা দইয়ের স্টক শেষ, তবু আমি দেখছি।” আমাদের দেখাদেখি বাকি লোকেরাও দইয়ের দাবি জানাল।
মিনিট দশ পনের পরই খাবার দিয়ে চলে গেল সে। খাওয়া সেরে দইয়ের খুলিতে হাত দিয়ে দেখি দই এলিয়ে গেছে। পচা দই দিয়ে গেছে রেলকর্মী। খুব সম্ভবত তাকে চাপ দেওয়া হয়েছে বলে বোধহয় এই পচা এলিয়ে যাওয়া দই দিয়ে গেছে। কেউ কেউ খিদের চোটে দই খেয়েও নিল। আমি সকলকে বারণ করলাম দই না খেতে। দেবুদা তো প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে গেছে, ফোন বের করে তৎক্ষণাৎ রেলবিভাগে অভিযোগ দায়ের করে দিল। দশ থেকে কুড়ি মিনিট পর যিনি ঐ ট্রেনে খাবারের দায়িত্বে ছিলেন হন্তদন্ত হয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “স্যার আপলোগোনে এক কমপ্লেন ডালা। উসকে বারে মে কুছ জানকারি লেনা থা। আপ জারা বাতাইয়েগা প্রবলেম ক্যা থা?” দেবু দা হিন্দিতেই উত্তর করে আদ্যোপান্ত বিষয়টা বুঝিয়ে দিল। সেই রেলকর্মীকে ডাকা হল। তিনি এসে ক্ষমা চেয়ে নিলেন এবং মাফিনামা অনুযায়ী পরের স্টেশনে আমাদেরকে এক কেজি টকদই দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক বললেন, “স্যার আপকা প্রবলেম ত সলভ হো গয়া। আপ প্লিজ কমপ্লেন কো উঠা লিজিয়েগা অউর ফীডব্যাক ভি ডাল দিজিয়েগা। নহি তো হামলোগোকা নকরি গবানা পড় যায়ে।” আমরা তাকে আশ্বস্ত করলাম এবং তিনি প্রস্থান করলেন।
দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। যে যার বাড়ির লোকের সাথে বার্তালাম সেরে নিয়ে ফোনে ভিডিও বা ফেসবুক বা হোয়াটস্যাপ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমাদের কক্ষেই আমাদের সাথেই একটা পরিবারও ছিলেন। তাদের গন্তব্যস্থল ছিল দিল্লি। বাঙালি লোক, দিল্লিতে ব্যাবসা করে সেটল্ হয়ে গেছেন। গত রাত থেকে তারাও আমাদের লক্ষ্য করছেন কিন্তু সেই অর্থে প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া সেভাবে আলাপ জমে ওঠেনি। তারা যেন পরিবারের সবকিছুই উঠিয়ে নিয়ে এসেছে ট্রেনে। নুন, তেল, কাচালঙ্কা থেকে শুরু করে দিনাতিপাতের জন্য যাবতীয় সাজসরঞ্জামের সবই তাদের কাছে ছিল। সন্ধ্যেবেলা তাদের সাথে গল্পগাছা করে জানতে পারলাম যে তিনি দুই ছেলেকে নিয়ে শশুর বাড়ি থেকে দিল্লিতে ফিরছেন। ওঁর আদি বাড়ি যদিও হাওড়াতে, কিন্তু কর্মসূত্রে তিনি সপরিবারে দিল্লির বাসিন্দাই হয়ে গেছেন।
বাচ্ছা দুটি গোলু গোলু, ছোট ছেলেটি চেহারায় একেবারে প্রায় আমার ভাগ্নার মত। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমার গভীর সখ্যতা হয়ে গেল দুই ভায়ের সাথে। বড়ো মায়া জন্মে গেল। মাঝে মাঝে ছোট্টুটার জন্য খাবারদাবারও কিনে দিচ্ছি। বড়টা আমার ফোনের পকেট এফ এম শুনতে ব্যস্ত। দুজনেই এক কথায় সর্বদা আমাকে সঙ্গী হিসাবে পেয়ে যে খুব খুশী তা তাদের আচরণেই বলে দিচ্ছে। বাইরের ছবিগুলো এত দ্রুত পালিয়ে যাচ্ছিল যে মনে হচ্ছে যেন এত কাছে থেকেও তাদেরকে ধরতে পারছি না; ধরতে যাওয়ার আগেই ফুড়ুৎ করে উড়ে যাচ্ছে। উঁচু পাহাড়-পর্বতের ভিতর দিয়ে ঊর্ধশ্বাসে ছুটে চলেছে ট্রেন। দিগন্ত বিস্তৃত ছবির বইয়ের মত দৃশ্যগুলো মুহূর্তেই ভেসে এসে অন্তর্হিত হচ্ছে স্লাইড শো এর মতো। হাওয়া ছুটে চলেছে, ছুটে যাচ্ছি আমিও। মেঘেদের দল টুকি দিয়ে লুকোচুরি খেলছে। কখনো বিরাট আকার ধারণ করে আমাকে শাসিয়ে যাচ্ছে, তো কখনো প্রলয় নৃত্য করে চলেছে ভয়ঙ্কর নটরাজরূপ ধারণ করে, আবার কখনো শান্ত, নিস্তব্ধ হয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে অদ্ভুতভাবে, সে যেন কিছু বলতে চাইছে, আমি না পড়তে পারছি তার ভাব, না বোঝাতে পারছি আমার মনের ভাষা। দুজনেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে, ভাষার আদানপ্রদান না হয়েও হয়তো ভাবের আদান প্রদান হয়ে চলেছে। সে এক অন্যরকম আলাপ। বৃষ্টির জল ছিটকে মাথায় আসার সাথে সাথে অনর্গল হাঁচি শুরু হতে বেগতিক দেখে ফিরে আসলাম নিজের আসনে।
এক পশলা বৃষ্টি এসে পালিয়ে গেল উত্তপ্ত অনিলকে সিক্ত করে দিয়ে। মুহূর্তেই ঘনকালো মেঘ ধেয়ে এসে আঁধার ঘনিয়ে এল। আবহাওয়া একটু শীতল হয়ে গেলে, জানালা থেকে মুখ সরিয়ে একটু চোখ বুঝিয়ে গান শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি তার হুস নেই। ঘুম ভাঙলে দেখলাম আসর জমে উঠেছে সকলের হাসি গল্পে। আমাদের গ্রুপের বাকিরা এসে হই হুল্লোড় শুরু করছে, মনোজদা পরবর্তী পরিকল্পনা কি আছে সবাইকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। আমি শায়িত অবস্থায় নিচে ঝুঁকে শুনলাম বিষয়টা। বেশ আত্মতৃপ্তিবোধ গ্রাস করল, অর্থ উপার্জন তো সবাই করে কিন্তু জীবনের স্বাদ পায় কজন ! জীবনকে উপভোগ করে কজন ! বরফের ওপর দিয়ে ট্রেক হবে শুনেই ভেতরেই অ্যাডভেঞ্চার প্রেমী জিহ্বাসত্ত্বা লকলক করে উঠল। যেই একথা শুনবে যে বরফে বিছানো পথের মধ্য দিয়ে দুহাতে বরফের গোলা ছুঁড়তে ছুঁড়তে যেতে হবে বহুদূর, সেই যে মুহূর্তেই ডুব দেবে কল্পনার এক গভীর সাগরে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
এদিকে, মাহল বেশ অন্যরকম। একদিকে গল্প চলছে, অন্যদিকে দিল্লিগামী পরিবারের সাথে সখ্যতা হয়ে যাওয়ায় তারাও জড়তা কাটিয়ে খোশমেজাজে কথোপকথন চালিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের টীমের সবাইও দেখছি বহাল তবিয়তে গল্পতে মসগুল। অন্যদিকে পাশের কক্ষের যাত্রীদের গলার আওয়াজ মাঝে মাঝে চিকুর মেরে উঠছে। খুব সম্ভবত তারা ব্যস্ত তাস পেটাতে, যার বরাদ ভালো যাচ্ছে সে তৎক্ষণাৎ চেঁচিয়ে উঠছে। আরেকদিকে কাকিমা সকলের জন্য বিরাট এক পাত্রে মশলামুড়ি মাখা শুরু করে দিয়েছেন। এই যাত্রাপথেই তারা এত আপন হয়ে গেছে যে নিজেদের জন্য টিফিন বানাতে গিয়ে কি মনে হল, বিশাল এক গামলাবাটি বের করে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারা কজন আছেন?” মনোজদা উত্তর করল- “আমরা বারো তের জন আছি, তার মধ্যে কেউ কেউ এসি কামরাতে আছে, কেউ কেউ আগে পিছে আছে। তবে, এখানে আমরা আটজন আছি।” কাকিমা বাদাম, নারকেল, চানাচুর, ধনে, ঝুরি আরও দশ-বিশ রকম আইটেম মুড়িতে দিয়ে যা খাসা মশলা মুড়ি বানিয়ে ছিলেন, তার স্বাদ এখনো লেগে আছে রসনাতে। তারপর বড়ো বড়ো কাগজের ঠোঙা ভর্তি করে সকলের হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমরা সকলে হতবাক। “আমরা শুধু খাবো, আপনারাও খান ভালো লাগবে” কথাগুলি এখনো কানে বাজছে। আমি খানিক পরে অবশ্যি কাকিমাদের সবাইকে চা খাওয়াই এবং ওঁরা খুশীও হয় খুব।
ঘড়িতে তখন আটটা কি সাড়ে আটটা, রাতের ভোজনের ব্যবস্থা করতে হবে নইলে পরে অর্ডার করার সুযোগ থাকবে না। আর রাতে ভরপেট না খেতে পেলে পরের দিন কষ্ট আছে। পরের দিন সকাল থেকে সন্ধ্যে গাড়িতেই কেটে যাবে। বাকিরা স্টেশনের হোটেল থেকে অর্ডার করার সিদ্ধান্ত নিলেও আমি রাতে ট্রেনের খাবারই প্রেফার করলাম। বাইরের ঠ্যালা সামলানোর থেকে আই আর সি টি সি-এর খাবার সহজেই হেডেক ছাড়া পাওয়া যাবে। দেবু দাও আমার সঙ্গে সহমত পোষণ করল। খাবারের অর্ডার দিয়ে ট্রেনের দরজার পাদানিতে বসে ফুরফুরে বাতাস নিচ্ছি আর চলন্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। ঘন কালো মেঘ যেমন নীল ধবধবে আকাশে এসে বাসা বেঁধে মাঝে মাঝে আকাশের সৌন্দর্যহরণ করে, ঠিক তেমনি জীবন প্রবাহের গতি প্রতিহত করতে মাঝে মাঝে আসে উপপ্লব, বিপাক, বিপত্তি ইত্যাদি; সম্পূর্ণ জীবনটা তখন তছনছ হয়ে যায়। এসব কত কি নিজমনে ভেবে যাচ্ছি কখনো একা একা হাসছি তো কখনো বিষণ্ণ হয়ে পড়ছি। হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে এবং ঘোরের তন্দ্রা ছুটে যায়। সাইড ব্যাগ থেকে হেডফোন বের করে কলটা রিসিভ করি। দিদি কল করে নিয়মমাফিক সারাদিনের গল্প শোনে। কথাবার্তা চলছে, অকস্মাৎ পেছন থেকে একটা হাতের টান পড়ে আমার গেঞ্জিতে, আমি তোয়াক্কা না করে কথা বলায় রীতিমত ব্যস্ত। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি দুজন জি. আর. পি.। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “show your adhar card.” আরেকজন সঙ্গে সঙ্গে বললেন “take him to the custody.” আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলাম। দিদিকে কলটা কেটে দিতে বলে তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম “What did I do Sir?” তাঁরা রাগে বিস্ফারিত হয়ে বললেন “তেরা আই ডি দে।” আমি যে শ্যামল পাণ্ডা নামে যাচ্ছি মনে পড়তেই ধুকপুকুনি শুরু হয়ে গেল। ভীষণভাবে ঘাবড়ে গেলাম। একদম কিংকর্তব্যবিমূঢ়। নিজেই নিজের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছি। আমি তখন একেবারে দিশেহার কি বলা উচিত, কার নাম নিয়ে বলব, আমার আধার কার্ড দেখাব কিনা এইসব বিষয় মাথার মধ্যে কুরে কুরে খাচ্ছে। আমাকে অন্ততপক্ষে কিছু বলতে হবে। কিছু বলার আগেই দুজনের একজন আমার হাতটা টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগল।
দ্বিতীয় পর্ব
ছাটাংসেরীর সন্ধ্যা
…..অনুনয় বিনয় করার পর রেলপুলিশ কর্মীচারিগণ আমাকে ছেড়ে দিলেন। জানতে পারলাম যে, দু একদিন আগেই ওই একই ট্রেনে একজন যুবক আত্মহত্যা করেছেন। অনেকসময় ট্রেনের পাদানিতে বসে থাকা অবস্থায় তীব্র হাওয়ার ঝাপ্টায় ভারসাম্য না রাখতে পেরে কেউ কেউ চলন্ত ট্রেন থেকে পড়ে গিয়ে তৎক্ষণাৎ …….. কেউ বা প্রেমিক/প্রেমিকার সাথে বার্তালাপের মাঝে উত্তেজনার বশে আবেগী হয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপিয়ে প্রাণ বিসর্জন করে। কখনো কখনো অসাবধানতা বশত পড়ে গিয়ে প্রাণ হারায়। এবিষয়ে রেলকর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগও দায়ের হয়েছে। সেকারণে রেলবিভাগের কর্মীরা সর্বদা এবিষয়ে সচেতন থাকেন। চলন্ত ট্রেনের দরজার কাছে ঝুঁকে থাকতে দেখলে ধমক দিয়ে সরিয়ে আনেন। অনেকসময় কারো কারো থেকে জরিমানা ধার্য করা হয়। যাইহোক, এযাত্রায় কোনোমতে রেহাই পেয়ে গেলাম।
ভোররাতেই চণ্ডীগড়ে নামার কথা ছিল কিন্তু চণ্ডীগড় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল হয়ে গেল। সময়ের থেকে প্রায় তিন-চার ঘণ্টা দেরীতে পৌঁছাল। ট্রেন থেকে নেমে সকলে একত্রিত হয়ে চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে নামলাম। একটু একটু করে সকালের আলো ফুটতে শুরু করেছে, ভোরের ঝাঁঝালো কুয়াশার গন্ধ আনেক আগেই দিনের আলোর সাথে মিশে এক অন্যরকম পরিবেশ তৈরি করেছে। ষ্টেশন চত্বর থেকে বাইরে এসে দেখলাম ষ্টেশনের শোভা মন্দ নয়। বড়ো বড়ো স্তম্ভগুলো দূর্গের কারারক্ষীর ন্যায় ঠায় দাঁড়িয়ে যুগের পর যুগ ধরে পাহারা দিয়ে চলেছে। চণ্ডীগড় ষ্টেশন খুব বেশি প্রাচীন না হলে ও বাহ্যিক বেশভূষা এমন যে, যে কেউ বলবে ষ্টেশনের বয়স অন্ততপক্ষে আশি-একশো বছর।
ষ্টেশনের বাইরে তাকাতেই চোখদুটি জুড়িয়ে গেল। নাম না জানা এক হলুদ রঙের ফুলেদের দল ভিড় করে আছে। দূরে থেকে দেখলেই যে কেউ ভাববেন আঙুরফল। যখন ঐ ফুলেদের ওপর প্রথম পলক পড়েছিল, আমিও আঙ্গুর ভেবে তাদেরকে ভুল করেছিলাম। গাছে পাতা নেই শুধু থোকা থোকা ফুলে ঢাকা, ঠিক যেন থোকা থোকা আঙুরফল ঝুলে আছে। পাখিরদল ভিড় করে এসে সেই ফুলের পাপড়ি খাচ্ছে আর কিচিরমিচির করে চলেছে। মনে হচ্ছে যেন আঙুর বাগানে ঢুকে একদল অনধিকার প্রবেশকারী কোঁচড় কোঁচড় ফল ছিঁড়ে পালানোর উপক্রম। আমাদের গাড়ি আসতে তখনও বাকি। পিঠ থেকে মালপত্র নামিয়ে রাস্তার ধারে উঁচু ফুটপাতের একটা কোণে বসে পড়লাম। অনাদরে অগ্রাহ্যভাবে ভাসতে ভাসতে মেঘ যেমন কোনো পাহাড়ে গিয়ে নিজের সর্বস্ব হারিয়ে ঝরে পড়ে, তেমনি বিধ্বস্তের মতো মাটিতেই বসে পড়লাম। আমাকে বসতে দেখে কয়েকজন তাদের মনের দ্বিধাদ্বন্দ দূর করে পাশে বসল। একা একা সেই আঙুরফুলের শোভা উপভোগ করছিলাম, অতঃপর বাকিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করালাম। এতসুন্দর অপ্রত্যাশিত নান্দনিক শোভার মধ্য দিয়ে সকালের সূচনা হবে ভাবিনি কখোনো। কিছুপর উন্মুক্ত আকাশের দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করলাম গোটা চারেক চিল মাথার ওপরে গোল গোল করে ঘুরেই চলেছে। কে জানে ভোরের আলো ফুটতেই তারাও বুঝি মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছে। অথবা আমাদের সকলের ঘাড়ে বিরাট বিরাট বোঝা দেখে প্রাতরাশ সারবার পরিকল্পনা করেছে, ভেবেছে হয়তো রাশি রাশি খাবার পেয়ে যাবে।
কিছুপর দুটো গাড়ি আসল। ছয়জন করে দুটো গাড়িতে বারোজনের জায়গা হতে কোনো অসুবিধা হল না। আকাশের অবস্থা তেমন ভালো ঠেকছে না। যখন তখন বৃষ্টি নেমে যেতে পারে। চালক বৃষ্টির আশঙ্কা করেই আমাদের মালপত্রগুলোকে গাড়ির ছাদে তুলে দিয়ে প্লাস্টিক ঢাকা দিয়ে ভালো করে বেঁধে নিলেন। তারপর গাড়ি ছুটতে লাগলো তীরের বেগে। সূর্য্যিমামা টুকি দিয়েছে অনেক আগেই, হয়তো মেঘের কারণে তাঁকে দেখা যাচ্ছে না। চারপাশের গাছপালা ঝোপঝাড় পিছনে ফেলে গাড়ি ছুটে চলল রুদ্ধশ্বাসে। রাতে ভালো ঘুম না হওয়ার কারণে এবং গাড়ির ভেতরে এসির শীতল পরিবেশে চোখে ঘুম লেগে গেল। ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে নিলাম। ঘুম ভাঙতেই মনে হল যেন রাত্রিরটা গাড়িতেই কাটিয়েছি। সমতল ভূমি ছাড়িয়ে রাস্তা পাহাড়ের দিকে উঠে গেছে। চণ্ডীগড় থেকে মানালির দূরত্ব ২৮৬ কিলোমিটার। তবে আমাদের গন্তব্যস্থান মানালির ঠিক ৪০/৫০ কিলোমিটার আগে রাইসানে। তবে রাইসান বললে ভূল হবে কারণ চণ্ডীগড় হয়ে মানালির পথে রাইসান এর আগে ছাটাং সেরী নামে একটি জায়গা আছে, সেখানেই আমাদের রাত্রিবাস হবে, সেটাই গন্তব্যস্থান। হরেদরে চণ্ডীগড় থেকে ছাটাং সেরীর দূরত্ব প্রায় ২২৭ কিলোমিটার। পাহাড়ি পথ, চড়াই-উতরাই, আঁকাবাঁকা পথ। গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে কম করে ৬ থেকে আট ঘণ্টা তো লাগবেই। তারপর যদি রাস্তা বন্ধ থাকে বা কোনো দূর্ঘটনা হয় তাহলে তো গেলই, সন্ধ্যের আগে পৌঁছানো কোনোমতেই সম্ভব হবে না।
রাত্রে আধপেটা খেয়ে শুয়েছিলাম। তার ফলস্বরূপ খিদেই পেট চোঁ চোঁ করছে। সামনের কোনো ধাবাতে যদি একটু টিফিন হয়ে যেত মন্দ হত না। গাড়ির ড্রাইভার আশ্বস্ত করলেন যে সামনের একটা ঐতিহ্যবাহী ধাবাতে স্নানের ব্যবস্থা আছে সেখানেই কিছু টিফিন খাওয়া যাবে। সামনেই বিরাট এক অট্টালিকা, বড়োবড়ো করে লেখা “মঞ্জিত রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড লজ”। ঘুমঘুম চোখে নেমে রেস্তোরাঁর ভিতর প্রবেশ করা হল। একদিকে কাস্টোমারদের জন্য খাবারের ঘর, তার পাশেই একটা বড়ো স্নানের হলঘর। পথযাত্রিদের কথা ভেবেই এমন বানানো হয়েছে। সেখানেই সকলে শৌচাদি কর্ম সম্পাদন করল।
গাড়ি ছুটে চলেছে একইভাবে। গতি আগের থেকে বেশ বেড়েছে মনে হল। বাকিদের দিকে তাকিয়ে অবাক এতক্ষণ ভাবছিলাম আমিই বুঝি ঘুমাচ্ছি, কিন্তু না বাকিদের অবস্থাও তাই। অনিরুদ্ধ দা চালকের পাশের আসনে বসে ঘুমিয়ে ঢুলছে, হুশ নেই তার। মাঝে মাঝে ঢুলে ঢুলে পড়ছে আর চশমাটা ঠিক করে নিচ্ছে। মনোজদা উচ্চস্বরে নাসিকাধ্বনি তুলে ঘুমাচ্ছে, দেবুদাও ঘুমিয়ে হাওয়া। বাকিদেরও একই হাল। আর সত্যিই তো এই প্যাচপ্যাচে ঘেমো অবস্থায় দুদিন কাটাবার পর যদি কেউ এসির হাওয়া পাই এমনিতেই সে ঘুমে কেলিয়ে পড়বে। আমি একঘণ্টা ঘুমিয়ে তাজা অনুভব করছি। জানালার দিকে তাকিয়ে মোহান্বিত হয়ে বাইরের দৃশ্যগুলো দেখে চলেছি। পথের দুধারে অসংখ্য আপেল, ন্যাসপাতি গাছেদের ভিড়। কচিকচি আপেল, ন্যাসপাতি ফলে ভরে আছে। পাহাড়ে জনবসতি তেমন নেই। একটা বাড়ি থেকে অপর বাড়ির দূরত্ব দু’এক কিমিরও অধিক, কোথাও কোথাও আবার পাঁচ কিমি হবে হয়তো। তবে কিছু থাক আর না থাক সকলেরই বাড়িতে এক বা একাধিক ফোর হুইলার।
একে একে খড়ার, কুরালি অতিক্রম করে রুপনগরের প্রবেশ করতেই ঘটল গোলযোগ। পাহাড়ের রাস্তাগুলো ওয়ানওয়ে। একটা মালবাহী গাড়ির চাকা পাঙচার হওয়ায়, রাস্তা অবরোধ। যতক্ষণ না পর্যন্ত গাড়ি সরছে ততক্ষণ সব যাতায়াত ব্যহত। কোনো গাড়ি পারাপার হতে পারছে না। নীচে গভীর খাত। বেগড়বাই করলেই ছবি শেষ। রাস্তা প্রায় আট থেকে দশ ফুট চওড়া। আমি গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। ভাবলাম একটু হাতাহাতি করে যদি তাড়াতাড়ি সারানো যায়। দেখলাম ইতিমধ্যে তিন চারজন কর্মী নিযুক্ত হয়ে গেছেন। যাত্রীবাহী পথিকেরা অকথ্য ভাষায় গাড়ির ড্রাইভারকে গালিগালাজ করছে। এরকম পরিবেশে চুপ থাকাই উচিত হবে। ভিড় উপচে পড়ছে। একটু অসাবধান হলে গাড়ি গড়িয়ে খাতে পড়ে যেতে পারে। মিনিট পাঁচেক কেটে গেল। একটু কেশে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “পাজি, টায়ার লাগবানে মে টাইম কিতনা লাগেগা?” গাড়ির তলা থেকে একটা আওয়াজ আসল, “পাজি বাস বিস তিস মিনটো মে হো জায়েগা।” গাড়িটির অবস্থা এবং কাজের গতি কিন্তু অন্য কথা বলছিল। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ড্রাইভারকে বললাম, “পাজি, দুসরা কহি রাস্তা হে তো উধর সে চলিয়ে, ইধর মেরাম্মত করনে মে ঘণ্টোসেভি জাদা টাইম লাগ জায়েগা।” পাহাড়ে সঙ্কীর্ণ বিপদবহুল রাস্তাতে ব্যাক গিয়ারে গাড়ি চালানো খুব পারদর্শিতা এবং ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার। আমাদের গাড়ির চালক ভীষণ সুদক্ষ ও জ্ঞানী। তিনি ব্যাক গিয়ারে নামলেন কিছুটা, নীচে একটু চওড়া রাস্তার কাছে পৌঁছে গাড়ি ঘুরিয়ে অন্য একটি রাস্তা ধরলেন। যাত্রাপথে বহু ছোটোবড়ো টানেল অতিক্রম করতে হল। টানেল এ প্রবেশ করতেই আপনা থেকে আওয়াজ বন্ধ, শুনেছি উচ্চস্বরে হর্ন বাজানোও নিষিদ্ধ। একেকটা টানেল পার হবার সময় মনে হচ্ছিল যেন টাইম ট্রাভেল করে গুহার ভিতরে প্রবেশ করছি। কোনো কোনো টানেলের ভিতর এত ঘুটঘুটে অন্ধকার যে ভালো করে ঠাওর করা গেল না। কিছু দূর অন্তর শুধু মিট মিট করে বাল্ব জ্জ্বলছে কেবল রাস্তার কলেবর দেখার জন্য। তবে বেশিরভাগক্ষেত্রে কাজ চলছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাজ সম্পূর্ণ শেষ। টানেলের ভেতর সে এক অপূর্ব সৌন্দর্য। চারিদিকে লাইট, ক্যামেরা, এমনকি স্পীড মাপার মেশিন বসানো। এইরকম বহু টানেলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা অতিক্রম করতে হল। দীর্ঘ পথ অতিক্রম যাতে না করতে হয়, সরাসরি এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে কম সময়েই পৌঁছে যাওয়ার জন্য টানেলগুলি তৈরি করা। ভাবতে অবাক লাগে, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কতটা পরিশ্রম করে এইসব টানেলগুলো তৈরি করা হয়েছে।
প্রায় সকলেই গভীর নিদ্রায় মগ্ন। ড্রাইভার খুব গভীর মনোযোগ সহকারে গাড়ি চালাচ্ছেন, এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে, এক টানেল থেকে আরেক টানেল অতিক্রম করে যাচ্ছেন। আমরা যেন ওপরদিকে উঠেই চলেছি। পথ শেষ নেই। পথের ক্লান্তি নেই। না আছে পথিকের ক্লান্তি। রূপনগর ছাড়িয়ে ভরতগড়, তারপর কিরতপুর সাহেব এর প্রবেশপথে বিশাল ফটক। ফটক অতিক্রম করে একটা দীর্ঘ সেতু। সেতুর নীচে কোনো অজানা নদী প্রবাহিত হয়ে গিয়েছে। স্বচ্ছ আয়নার মত তার জল। সূর্যের আলোর সাথে সোনা খসে খসে পড়ছে, নদী স্পর্শ করতেই ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে নদীর গভীরেই। দেখতে দেখতে বিলাসপুরে প্রবেশ করেছি। পথের দুধারে আপেল, ন্যাসপাতি, খুমানি, আলুবোখরা বা (আঞ্চলিক ভাষায় যা আড়ু) ফলে আছে অসংখ্যা। গাছের পাতার থেকে ফলের পরিমাণ বেশি। কি অপরূপ তার শোভা, কি বিচিত্র তার সাজ। দুদণ্ড দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। গাড়ি এঁকেবেঁকে চলেছে সাপের মতো। পাহাড়ের গা বেয়ে কখনো ওপরে উঠছে তো কখনো নীচে নামছে। নদীর দু ধারেই খুমানি ফলে ভরে রয়েছে। গাড়ি দৌড়াচ্ছে একটানা, বাইরের দৃশ্য খুব কাছে টানছে। মনের ভেতরে জমে থাকা বিষাদ, ব্যর্থতা, না পাওয়া, পেয়ে হারানোর মতো বিরাট স্তূপ দূর পাহাড়ের চরণে মিলিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। নিজেকে খুব হাল্কা অনুভব করছি। তখনই বুঝতে পারলাম যে এতদিন এই বিরাট পাথর মনের দ্বারের পথ রুদ্ধ করে রেখেছিল, পাহাড়ের কাছে আসতেই পাহাড় সেই বোঝা নিজের কলেবরে টেনে নিচ্ছে। একারণে প্রত্যককেই বছরে দু’ তিনবার, অন্তত কমপক্ষে একবার পাহাড়ের কাছে এসে সমর্পণ করা উচিত।
বহুক্ষণ হয়ে গেল, ক্ষুধা গ্রাস করেছে। খাবার প্রস্তাব দিতেই সকলেই একসঙ্গে সম্মতি জানাল। গাড়ি অবিরত ছুটে চলেছে তখনও। বিলাসপুর অতিক্রম করে বারমানা পেরিয়ে সুন্দরনগরে প্রবেশ করেছে। ড্রাইভার কে অনুরোধ করতেই তিনি জানিয়ে দিলেন যে সামনেই তাঁর চেনা ভালো হোটেল আছে সেখানেই খাওয়া সেরে নেওয়া যাবে। সেইমতো সুন্দরনগরে ড্রাইভারের পরিচিত একটি ধাবার সামনে গাড়ি থামানো হল। এসির মধ্যে থেকে বাইরে বেরোতেই অনুভব করলাম আগুন ঝরছে বাতাসে, বেশিক্ষণ থাকলে ঝলসে যাব। রৌদ্রের তেজ সাঙ্ঘাতিক রকমের। তাছাড়া, পাহাড়ে রোদের ঝাঁঝ সর্বদা একটু বেশিই থাকে। বাইরেটা ভালো করে দেখবো বলে তোয়ালেটা গায়ে জড়িয়ে সামনের দিকে পদচারনা করলাম। হোটেলের চারপাশে আপেলের মস্ত বাগান। তাতে আপেল ধরে আছে অসংখ্য। সম্ভবত পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য, একইসাথে হোটেলের শোভা বর্ধনের জন্য দোকানীর এরূপ নান্দনিক প্রয়াস।
দুপুরের ভোজন সেরে পুনরায় যাত্রা শুরু হল। পথ বেশি বাকি নেই। সম্ভবত দেড় দু ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাব গন্তব্যস্থানে। সুন্দরনগর ছাড়িয়ে নার চক, তারপর মান্ডিতে প্রবেশ করলাম। দু তিন দিন আগেই মাণ্ডিতে বান এসেছিল। বানের প্রভাবে মাণ্ডির জনজীবন একেবারে বিপর্যস্ত। বেঘোরে কত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে তার হিসাব নেই। শ’ শ’ গবাদি পশু নদী তার ক্রোড়ে টেনে নিয়েছে। নদীর তীরের বড়বড় বাড়িগুলো ঝুরঝুর করে ঝরে মিশে গেছে নদীতে। সে এক ভয়ানক পরিস্থিতি। এমনকি কয়েকদিন যাত্রী পারাপারের সমস্যাও ছিল। তবে সে সমস্যা এখন নেই। মাণ্ডি পেরিয়ে পাণ্ডো, তাকোলি, বাজুরার মধ্যে দিয়ে ভুন্টর শহরে প্রবেশ করা হল। খুব কাছেই বিমানবন্দর। আকাশপথে মানালি আসতে হলে এই ভুণ্টর বিমানবন্দরই একমাত্র পথ। কেউ চাইলেই মানালি পৌঁছানোর জন্য নেতাজি সুভাষচন্দ্রবোস বিমানবন্দর হয়ে সরাসরি ভুণ্টর বিমানবন্দর আসতে পারেন,। ভুন্টর থেকে ঘণ্টা খানেকের পথ মানালি। কি অপূর্ব দৃশ্য, নদীর তীর বরাবর চলে গেছে রাস্তা। রাস্তার একদিকে নদী স্প্রিঙের মতো লম্বা হয়ে বয়ে গেছে, অন্য দিকে বিশাল বিশাল পাহাড় মাথা উঁচু করে কালের পর কাল ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। নদীতে কায়াকিং, র্যাফটিং হচ্ছে। দলেদলে যুবক যুবতীরা হইহুল্লোড় করতে করতে আনন্দ উপভোগ করছে। চলন্ত গাড়ি থেকে উপরে যতদূর পর্যন্ত চোখ যায় দেখা গেল আট দশটা বড়োবড়ো বেলুন উড়ছে, সঙ্গে দুজন করে মানুষও উড়ছে। তারা প্যারা গ্লাইডিং করছে। মনস্থির করে নিলাম যে পরিকল্পনার বাইরে সময় পেলে প্যারা গ্লাইডিং অবশ্যই করতে হবে। কয়েক মিনিটের মধ্যে ভুন্টর অতিক্রম করে কুল্লু ভ্যালিতে প্রবেশ করেছি আমরা। অনতিদূরেই বিশ্ববিখ্যাত কুল্লুর বৈষ্ণদেবী মন্দিরের মতো দর্শনীয় স্থান রয়েছে। আমাদের গতিপথ সেদিকে নয় যদিও।
কুল্লু উপত্যকার পাশ দিয়ে গাড়ি তীব্র বেগে ছুটে চলেছে। মনে হছে যেন স্বর্গের দেশে চলে এসেছি। যেদিকে তাকাচ্ছি বামে-ডানে সবদিকে ছোটবড়ো পাহাড়গুলি সাদা পেঁজা তুলোয় ঢাকা। বড়োবড়ো পাহাড় রূপোর বিচিত্র মুকুট পরিহিত, কারো কারো কায়া এত বিশাল যে আকাশ ভেদ করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। পাশ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে তুলোর মতো মেঘেদের দল। যেন মনে হচ্ছে ছুটে গিয়ে দুহাতে জাপটে ধরে আস্তিনের পকেটবন্দি করে রাখি তাদের। উদ্দেশ্যহীনভাবে ভেসে চলেছে মেঘেরা, যখন চাইছে একটু করে জল ছিটিয়ে আবার ভেসে যাচ্ছে দূরে বহুদূরে। কেই বা জানে কতদূর ভেসে যাবে, কতক্ষণ রবে তারা। মানবজাতি ছুটে চলেছে অজানা পথের সন্ধানে উদ্দেশ্যহীনভাবে। জানে না তারা কোথায় তাদের বিরতি, কোথায় তাদের থামা, কোথায় বা তাদের পরিণতি।
আমাদের যাত্রাপথ কুল্লু থেকে রাইসনের দিকে যেতে ছাটাংসেরী নামক একটি ছোট্ট হিমাচলি গ্রামে। শেরপা, বুদ্ধিজি(বুদ্ধি সিং নেগি) সেখানেই থাকেন। তাঁর বাড়িতেই আশ্রয়ের ব্যবস্থা। খাওয়া দাওয়া সেখানেই হবে। আগামীকাল ভোরে ট্রেকিং শুরু হবে। সেইমতো সব আয়োজন করে রাখা। টীমের মালিক কিংশুকদা অন্য একটা টীম নিয়ে হামতা পাস ট্রেকে গেছিল, ট্রেক সেরে বুদ্ধিজির বাড়িতেই থাকবে, সেখানেই প্রথম মোলাকাত হবে। কুল্লু উপত্যকা পেরিয়ে আবার পাহাড়ের ওপরে ওঠা শুরু হল। সাপের মতো এদিকে ওদিকে এঁকেবেঁকে কখনো বিরাট পাথরের নীচ দিয়ে, কখনো বা সদ্য খসে পড়া পাথরের মধ্য দিয়ে, কখনো কখনো দুই পাহাড়ের মাঝখানের সঙ্কীর্ণ রাস্তার মধ্য আমাদের রথ ছুটে চলেছে। কিছু মুহূর্তের অপেক্ষা। গন্তব্যস্থানের বেশি বাকি নেই। দুপুরের উত্তপ্ত বাতাস ক্রমশ শীতল হতে শুরু করেছে। এই কুয়াশা তো এই রোদ্র। সোঁ সোঁ করে তীরের বেগে ছুটে চলেছে গাড়ি। মিনিট দশেক পর পৌঁছালাম ছাটাংসেরী অবশেষে।
সময় আন্দাজ মতো বিকাল চারটে বা সাড়ে চারটে হবে। ছাটাংসেরী বাসস্ট্যাণ্ড এ সকলে নেমে পড়লাম। বুদ্ধিজি আমাদের অপেক্ষাতেই ছিলেন সেখানে। ছাটাংসেরী থেকে একটি রাস্তা ওপরে পাহাড়ের দিকে চলে গেছে। মূলত সেইদিকেই সকলকে হাঁটতে হবে। মেইন রাস্তা থেকে বিশ ত্রিশ গজের মধ্যেই বুদ্ধিজির বাড়ি। গাড়ি থেকে নামতেই চোখে পড়ল প্রত্যকের ঘরে আপেল, ন্যাসপাতি, খুমানি, আলুবোখরা ইত্যাদি ফলের বাগান। থোকা থোকা আপেল, ন্যাসপাতি ঝুলছে গাছে গাছে। দেখে মনে মনে কি যে আনন্দ হচ্ছে তা বলে বোঝানো যাবে না। যাইহোক, কিংশুক দাদার সাথে সরাসরি প্রথম আলাপ হল সেখানেই। সে সকলকে বুদ্ধিজির ঘরে নিয়ে গেল। একটা মাঝারি সাইজের লোহার দরজা ঠেলে ভারী ভারী মালপত্র নিয়ে বুদ্ধিজির ঘরে প্রবেশ করা হল। তাঁর পরিবারের সবার সঙ্গে আলাপ হল একে একে। প্রথমে মনে হয়েছিল কেমন যেন বেমানান, বেখাপ্পা বাড়িটি। পরে দূর থেকে লক্ষ্য করেছিলাম যে, ঢালু জায়গার ওপর বাড়িটি বানানো। পাহাড়ি ঘরদোরগুলো সচরাচর এমনই হয়ে থাকে। বুদ্ধিজির বাড়ির সামনে একটি ছোট্ট বাগান, সেখানে আলু, মূলো, ফুলকপি, বাঁধকপি, টম্যাটো, বেগুন ইত্যাদি সব্জির চাষ। বাগানের এককোণে, দুধরণের দুটো আপেল গাছ, একটা খুমানি ফলের গাছ, দু তিনটা আলুবোখরা গাছ।
আলাপ-পরিচয় পর্ব শেষ হলে একে একে সবাই স্নান করতে গেল। বাড়ির সামনেই বড়ো বড়ো দুটো স্নানের ঘর। তবে, নদীতে স্নান করার বড় ইচ্ছে হল। মেইন রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে প্রধান নদী। বুদ্ধিজির বাড়ির খোলা ছাদে বসলেই নদীপ্রবাহের কুলু কুলু ধ্বনি ভেসে আসে। কয়েকদিন আগে বাণের কারণে নদীতে স্নান করা নিষিদ্ধ। অগত্যা বুদ্ধিজির বাড়িতেই স্নানাদি সম্পন্ন করতে হল। কাকিমা সকলকে চা দিয়ে গেলেন। ঘড়িতে তখন বোধহয় পাঁচটা কি সাড়ে পাঁচটা হবে। কয়েকজন ভাবলাম মানালি মার্কেটটা একটু ঘুরে দেখলে মন্দ হত না। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেলাম যেহেতু আটটার পর আর ফেরার বাস নাও পাওয়া যেতে পারে। আমরা চার বান্দা তৎক্ষণাৎ ছাটাংসেরী থেকে স্থানীয় বাসে চেপে মানালির উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করে দিয়েছি। বাসের সকল যাত্রীরা আমাদের দিকে ভীষণ কৌতুহলি দৃষ্টিতে, তাঁরা আমাদের সাথে কথা বলতে প্রচণ্ড উৎসুক। কেউ কেউ যেচে পড়ে গল্প করছেন কেউ সুযোগ পাচ্ছেন না। আমরা চারজনে এত গল্প জুড়ে দিয়েছি, তাও খোদ মাতৃভাষায় যে সকলে আমাদের ক্রিয়াকলাপ অনুসরণ করে চলেছে। কেউ কেউ তাকিয়ে মিচকি হেসে যাচ্ছে। এদিকে ড্রাইভার খোশমেজাজে হিমাচলী গান ছেড়েছে “কুছ সৈলড়িয়া, কুছ পিলড়িয়া হো, লেই বাঞ্জারা আয়া লেই দে ডোলা বাংড়ীয়া…..”, “উঁচিয়া কৈলাসা হোওও শিব মেরে বাসদে হ্যাঁ…..”।
মিনিট চল্লিশেক পর পৌঁছালাম মানালিতে। পাহাড়ে সন্ধ্যে নামে বেশ দেরিতে। দিনের আলো তখনও বিদ্যমান স্পষ্টরূপে। মানালির সিটি মার্কেট ঘুরে দেখা হল। দারুণ বাহারে সুসজ্জিত দোকানগুলো। আয়তনে মানলি সিটি মার্কেট দীর্ঘ নয়, তবে কলকাতার যেকোনো সুন্দর জায়গার থেকেও অনেক সুন্দর। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখে যাচ্ছি চারিদিক। ভীষণ আধুনিক নাজে সজ্জিত প্রত্যেকটা ঘর। সম্ভবত চার-পাঁচ মাস বাদে প্রায়ই সারাবছর বরফ থাকে। শীতের মরশুমে তুষার ঝড় হয়। সর্বত্র বরফে ঢেকে থাকে। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারীর মধ্যে অবশ্যই অন্তত একবার আসা উচিত। তাহলেই শীতের সৌন্দার্য উপভোগ করা যাবে, পাওয়া যাবে তুষার ঝড়। এসব ভাবতে ভাবতেই ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি এসে গেল। একটা স্থানীয় দোকানে প্রবেশ করা হল মোমো খেতে। চিকেন মোমোর ফরমাশ দেওয়া হল। দোকানদার একজন মহিলা ছিলেন। তিনি খাতিরদারি করে বসতে দিলেন ঠিকই কিন্তু মোমো দিতে হয়তো ভুলে গেছেন। গল্প করতে করতে সময় পার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মোমো আর এসে পৌঁছাচ্ছে না। প্রায় পঁচিশ ত্রিশ মিনিট পর মোমো আসল কিন্তু চিকেন স্ট্রু সুপ কই, চিকেন স্ট্রু যখন পরিবেশিত হল এদিকে তখন মোমো শেষ। এক অদ্ভুদ অভিজ্ঞতা হল। তারপর, মানালির সিটি মার্কেট থেকে পঞ্চু (রেইন কোর্ট) কেনা হল। বাইরে বৃষ্টি তখনও থামেনি। বৃষ্টির মধ্যে আইসক্রিম খেলাম সকলে। এবার ছাটাংসেরী ফেরার পালা। সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে অনেক আগেই। জোনাকির মতো বিন্দু বিন্দু আলো জ্জ্বলে উঠেছে পাহাড়ের সর্বত্র। কোনোমতে বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ে দৌড়ে এসে শেষ বাসটায় চাপলাম। এবার ছাটাংসেরী ফেরার পালা। প্রথমে একজনকে, তারপর দ্বিতীয় জনকে, এইভাবে বাকিদেরকে সিটে বসিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে খোলা জানালার দিকে চেয়ে সন্ধ্যের মানালি দেখছি। জানালার বাইরের পৃথিবী কোনো জাদুবলে নিজের কাছের দিকে টানছে। সম্মোহিত হয়ে সেই দৃশ্যের কাছে নিজেকে সঁপে দিচ্ছি। পাথুরে বাতাসের ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা মারল। এই বিশেষ প্রকার সৌরভ কেবল পাহাড়েরই সৌরভ। পাহাড় ছেড়ে সমতল ভূমিতে এইরূপ গন্ধের অনুভব হয় না কখনো। এরকম অপার্থিব সৌন্দার্য, অপ্রাকৃতিক সৌরভ, অকৃত্তিম প্রেম পৃথিবীর আর কোথায় পাবে।
যাবার সময় একটা বিষয় চোখে পড়েনি, ফেরার সময় যে বাসে চাপলাম সেই বাসের কন্ডাকটর প্রত্যেকটা স্টপেজ আসতে সিটি দিয়ে বাস থামাচ্ছিল। আমি খুব আগ্রহ এবং উৎসুক হয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম যেন কন্ডাকটর এর প্রেমে পড়েছি। একজন ভদ্রলোক আমার কৌতুহল প্রশমিত করতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপলোগ বঙ্গাল সে হো না জী? পাহাড়ো মে সিটি সে বাস রুকতা, অউর সিটি সেহি বাস চলতা। আপলোগ ন্যয়া হো ইসলিয়ে নহি জানতে।” আমি বোকাবোকা ভাবে বললাম, “হ্যাঁ জী, হাম বঙ্গাল সে, কলকাত্তা সে আয়ে। আসল মে ম্যায় তো কভি এইসা দেখা নহি, সিটি সে বাস রুকতা হ্যায় অউর জ্যাতা ভি হ্যায়। বহুত হ্যায়রান রহা ইসলিয়ে। শুকরিয়া।” বৃষ্টি থেমেছে বোধহয়। বাইরের শীতল বাতাস মুখে এসে ঝাপ্টা মারতেই দাঁত শিলিয়ে গেল। বাইরের পাহাড়জুড়ে বিন্দু বিন্দু আলো যেন জোনাকির মতো ছেঁকে ধরে আছে। কি অপূর্ব মনোহর দৃশ্য, সাত জন্মও তপস্যা করলে এমন দৃশ্যের ভাগীদার হওয়া যায় কিনা আমার ঠিক জানা নেই। ইচ্ছে করে এভাবেই যেন যুগ যুগ ধরে এই দৃশ্যই দেখতে থাকি। নদীর বয়ে চলার কুলু কুলু আওয়াজ আর বাতাসের মাদকতার সৌরভ যেন পাহাড়ে সারা গায়ে মিশে আছে, মিশে আছে কত আলো কত খুশি, কত মধুর স্মৃতি, কত অজানা উষ্ণতা ধোয়া আশঙ্কায় কাটানো রাত। হাতাবাড়ালে যাদের নাগালে পাওয়া যায় না, আদের পাওয়া যায় না বাস্তবের অনুভবে।
তৃতীয় পর্ব
কোটলা কাণ্ড
ভোর থেকেই তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। রাইসান থেকে কিছু দূরে পাতলীকুল। পাতলীকুল থেকে দুটি রাস্তা বেরিয়ে গেছে যার বামদিকে চলে গেছে সাংচার এবং ডানদিকেরটা সোজা মানালি। পরিকল্পনামাফিক আমাদের ট্রেকিং শুরু হবে সাংচার থেকে। আবহাওয়া সাথ দিলেই ভালোই ভালোই ট্রেকিং-এর আনন্দ উপভোগ করা যাবে। সাড়ে পাঁচটার মধ্যে সকলের প্রাতরাশ সম্পূর্ণ হওয়া চাই। ঘড়ির শেষ সীমা বাঁধা আছে ছটা থেকে সাড়ে ছটা। তারমধ্যে কেউ যদি প্রস্তুত হতে না পারে তাহলে তাকে ছাড়াই যাত্রা শুরু হবে। কিংশুক দা রাতে খাবার পর এবিষয়ে সকলকে সচেতন করে দিল।
আগামী পাঁচ দিন পাহাড়েই থাকতে হবে। প্রত্যেকদিন কম করে ৭/৮ ঘণ্টা পাহাড়ে অবরোহণ চলতে হতে পারে। কাজেই পিঠের বোঝা অতিরিক্ত না হওয়াই কাঙ্খিত। প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিস একদম নেওয়া যাবে না। যে যে জিনিসগুলো অপ্রয়োজনীয় সেগুলো বুদ্ধিজির বাড়িতেই ছেড়ে যাওয়া হবে। পাঁচদিনের জন্য তেমন বিশেষ কিছুর দরকার হবে বলে মনে হয় না। স্নান করার কোনো প্রশ্ন নেই। তাপমাত্রা ৬ থেকে ৮ ডিগ্রী-এর মধ্যেই ঘোরাফেরা করবে প্রথম দু তিন দিন। প্রয়োজনে বরফের পথ অতিক্রম করতে হতে পারে। বর্ষাকালের ট্রেক। তাই বৃষ্টির আসার সম্ভবনা প্রবল। পাহাড়ে এই রোদ তো এই বৃষ্টি। ঠাণ্ডার কারণে ভালো শীতরোধক পোষাক নিতে হবে। এরপর টুকিটাকি জিনিসপত্র ছাড়া আর তেমন বিশেষকিছু নেবার দরকার নেই। সেইমতো সকলে ব্যাগপ্যাক করে নিল। যাদের ট্রেকিং পোল, প্যান্ট, রেইন কভার ইত্যাদি ছিল না কিংশুক দা জোগান দিয়ে দিল। আমার শুধু দরকার ছিল একটা স্টিক বা লাঠি জাতীয় কিছু। ভাবলাম যাত্রাপথেই গাছের ডাল বানিয়ে কাজ চালিয়ে নেব।
খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। সকালের নিত্যাদি ক্রিয়া শেষ করে একে একে সব প্রস্তুতি নিচ্ছে। আগামী পাঁচদিন স্নান করতে পারবো না ভেবে ঐ কনকনে ঠাণ্ডাজলে স্নান করে ফ্রেশ হয়ে গেলাম। কয়েকটা খুমানি ফল সংগ্রহ করলাম এবং সাটিয়ে দিলাম সকাল সকাল। বুদ্ধিজির স্ত্রী রুটি আর সব্জি বানিয়েছেন। ভাতও পাওয়া যাবে। যার যেটা খেতে মন চাইবে সে সেটা খাবে। বেশিরভাগ সকলেই রুটি খেল। আমি দুটোই সাটালাম; একটা রুটি আর অল্প একটু ভাত। এদিকে বেলা বাড়তে না বাড়তেই আবহাওয়ার পরিবর্তন হতে লাগল। আকাশ ঘনিয়ে এসেছে। জমকালো মেঘে আকাশ ঢেকে রয়েছে। বেগতিক দেখে আনপ্যাক করে বেশ কিছু জিনিসপত্র রিসাফল করে নিলাম। বৃষ্টির আশঙ্কা করে দুটো প্যাণ্ট এক্সট্রা নিয়ে নিলাম। সাড়ে ছটা থেকে পৌনে সাতটার মধ্যেই যাত্রা শুরু হল বুদ্ধিজির বাড়ি থেকে। রাইসানকে পেছনে ফেলে গাড়ি ছুটছে আঁকাবাঁকা পথে। জানালা দিয়ে হু হু করে ঢুকছে ঠাণ্ডা বাতাস। রীতিমত দাঁত শিলিয়ে যাচ্ছে। সূর্য অনেক আগেই নাম সাক্ষর করে মেঘেদের আড়ালে নিখোঁজ। পাতলীকুল থেকে পাঁচদিনের প্রয়োজনীয় জিনিস উঠিয়ে নেওয়া হল। আমাদের রথ ছুটে চলেছে সাংচার-এর দিকে। পাতলীকুল ছেড়ে পাহাড়ে ওঠার রাস্তা ধরতেই গোলযোগ। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। ঠাণ্ডাটা হুস করে বেড়ে গেল। পাহাড়ের ওপরে উঠছি আর নীচের মানালিকে এক অদ্ভুত লাগছে, কুয়াশায় ঢেকে গেছে। মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। রাস্তার বাঁক এত ভয়ানক সেদিকে তাকালেই আত্মারাম ফুড়ুৎ। অন্ততপক্ষে ৩৪০ থেকে ৩৫০ ডিগ্রী কোণে রাস্তাগুলো এঁকেবেঁকে ওপরে উঠে গিয়েছে। রাস্তার দুপাশের খুমানি, আপেল, ন্যাসপাতি ইত্যাদি ফলের গাছগুলো যেন সবে স্নান করে উঠেছে। বৃষ্টি পড়ার থামা নেই। বদ্ধ জানালা থেকে উপভোগ করছি পাহাড়ি বৃষ্টি। এর বহু আগেই অভিজ্ঞতা হয়েছে যে পাহাড় বড্ড বেখেয়ালি, এই ঝকঝকে রোদ্দুর তো পরক্ষণেই বৃষ্টি। আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি আর মনে মনে ভাবছি শেষমেষ বৃষ্টিতেই ট্রেক করতে হবে। তাছাড়া মেঘ পাহাড়ের সৌন্দর্যকে ঢেকে রেখে দিলে তাঁকে দেখে দুচোখে জুড়াবো কিভাবে?
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমরা সাংচার গ্রামে উপস্থিত হলাম। গাড়ি দুটো আনলোড করা হল। ইতিমধ্যে কিংশুকদার কথা মতো স্থানীয় রমেশ তাওজি তাঁর তাগড়াই ছটা খচ্চর আর একটা মাদি ঘোড়া নিয়ে হাজির। সাংচার গ্রামের যেখানে রাস্তা শেষ হয়েছে সেখানে একটি বাড়ির ছাদের ছাওনিতে আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এদিকে বৃষ্টি পড়ে চলেছে একটানা। বৃষ্টির গতি কমা তো দূরের কথা বরং ক্রমশ বেড়েই চলেছে। একদিকে ঘোড়ার পিঠে মালপত্র গোছানো চলছে, অন্যদিকে বৃষ্টির মোকাবিলা করে ট্রেক করার প্রস্তুতি চলছে। বিশ ত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করার পরও যখন বৃষ্টি থামছে না তখন অগত্যা উপায় নেই ঝমঝমে বৃষ্টির মধ্যেই যাত্রা শুরু হয়ে গেল। ভাবলাম এই ট্রেকে হয়তো কোনো ট্রেকিং পোলের দরকার নেই। মিনিট দশেক পর যখন সাংচার গ্রাম ছেড়ে পাহাড় চড়া শুরু হয়ে গিয়েছে তখন অনুভব করলাম যে রাস্তা একদম খাঁড়াই ওপরে উঠে গেছে, বৃষ্টিতে পিছলে যাওয়ার সম্ভবনা প্রবল। ইতিমধ্যে দু চারজন পিছলেও গিয়েছে। বেগতিক দেখে আখরোট গাছের ছোট একটা ডাল ভেঙে নিয়ে ট্রেকিং পোল বানিয়ে নিলাম। বুদ্ধিজির সাথে সাথে হাঁটতে লাগলাম। ছেলেবেলা থেকেই দ্রুত হাঁটি। বংশগত বললে ভুল হবে না। আমার বাবা এখনও এত দ্রুত হাঁটেন যে পাশ দিয়ে গেলে না তাকিয়ে উপায় নেই। যে কেউ দেখলে ভাববেন যে বাড়িতে হয়তো কোনো জরুরী তলব পড়েছে। কিন্তু বাবার ওটাই স্বাভাবিক। জিনেটিকালি সেই ধারা আমার মধ্যেও বর্তমান। রানিং ওয়াকিং বিভিন্ন অ্যাপ্সে পরিমাপ করে দেখেছি স্বাভাবিক হাঁটলে এক কিলোমিটার অতিক্রম করতে আমার সময় লাগে প্রায় ৯ মিনিট।
যাইহোক, পাহাড়ে হাঁটা আর সমতলে হাঁটা আসমান জমিন ফারাক। বুদ্ধিজি, মনোজদা আর আমি আগে আগে হেঁটে চলেছি, মাঝে মাঝে সকলের জন্য অপেক্ষা করছি। বৃষ্টি পড়ে চলেছে মুষলধারে। দেবব্রত দা আর অনিরুদ্ধ দাদাদ্বয় পরে আমাদের সাথে যোগ দেয় এবং টীমটা তিনটা দলে ভাগ হয়ে যায়। প্রথমদিকে অমরা চার পাঁচজন মাঝখানে সপ্তর্ষী, সন্দিপন এবং মহুল আর পেছন দিকে চার-পাঁচজনকে নিয়ে কিংশুকদায়ের টীম। টি-শার্টের ওপরে একটা সোয়েটার তার ওপর পঞ্চু। ভেতরটা ঘেমে সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এদিকে বৃষ্টির জলে চশমার কাঁচ অস্বচ্ছ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, দু চার মিনিট অন্তর অন্তর চশমার কাঁচ পরিষ্কার করে নিচ্ছি। ভাগ্যিস একটা তোয়ালে ছিল পকেটে। বাইরের তাপমাত্রা ১০ থেকে ১২ ডিগ্রী হবে। কিন্তু শরীর দিয়ে ঘাম ঝরছে। ঘাম ঝরা যেন আমার জন্মগত অধিকার। অফিসে এসির নীচে বসেও আমার মাঝে মাঝে ঘাম ঝরে। ট্রেকিং শুরুর আধাঘণ্টা পরেই মথার টুপি খুলে দিতে হল। তার আরো কিছু পরে সোয়েটার ঝেড়ে ফেলতে হল।
প্রথমদিকে টানা দেড় দু ঘণ্টা বৃষ্টি পড়ার পর, একটু মোড়বদল হল। খানিক বৃষ্টি তো কিঞ্চিৎ বিরতি। তবে বৃষ্টির মধ্যে পাহাড়ে ট্রেকিং এর অনুভূতি যে কি অপূর্ব তা বলে বোঝানো যাবে না। রোদ্দুর থাকলে পাঁচমিনিট হাঁটলেই অবস্থা কাহিল হয়ে যেত, কিন্তু বৃষ্টির কারণে অনেক সহজেই অনেকটা পথ অতিক্রম করা সম্ভবপর হল। ঘণ্টা তিনেক কেটে গেল, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ে ওঠা চলতে লাগল একই ছন্দে। সঙ্গে জমানো জল শেষ। এদিকে পেটে ক্ষুধার দেবী ভর করে বসল, তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে। আগেপিছে বহু ঝর্ণাধারা বয়ে গেছে কিন্তু সেগুলো খাওয়া স্বাস্থকর কিনা ইতস্তত করছি বুদ্ধিজি আমার অভিপ্রায় বুঝতে পেরে বললেন, “ঝর্নাকা পানি বহুত মিঠাস হোতি হ্যায়। আপ আঁখ বন্দ করকে পি সকতে হো বাবু। বরফ্ পিঘলকে উপরসে পানি আ রহা হ্যায়। ইস পানি বহুত শুদ্ধ অউর সেহেদ কে লিয়ে আচ্ছা ভি হ্যায়।” বুদ্ধিজি আরও কিছু বলতে চাইছিলেন আমি তাঁর কথায় আগ্রহ না দেখিয়ে ঢক ঢক করে ঝর্ণার জল খেয়ে পিপাসা মেটালাম। খিদেই পেটে আগুন জ্বলছিল, সেই আগুনের লেলিহান শিখাকে কিছুক্ষণের জন্য শান্ত করলাম বটে কিন্তু দুধের স্বাদ কি আর ঘোলে মেটে। অগত্যা উপায় নেই যে।
পরিকল্পনামাফিক কোটলাতেই প্রথম দিনের ক্যাম্প করা হবে। শুনেছি কিংশুকদা যতবারই মানালি পাশ ট্রেক করিয়েছে ততবারই কোটলাতেই তাঁবু গেড়েছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। কত চড়াই উৎরাই পেরলে তবে কোটলাতে পৌঁছবো তা ঠিক ঠাওর করতে না পেরে বুদ্ধিজিকে শুধালাম, “বুদ্ধিজি কোটলা পৌছনে মে অউর কিতনা অয়াক্ত লাগেগা?” বুদ্ধিজি হেসে হেসে বললেন, “পাহাড়ো চড়নে মে তকলিফ হো রহা হে বাবু? এইসাহি চলতে রহোগে তো অউর বিশ ত্রিস মিনিটো মে পৌঁছ যাওগে।” আমি প্রত্যুত্তরে বললাম, “মেরা কোহি দিক্কত নহি হ রহা হ্যায়, লেকিন বহুত ভুক লাগা। অউর পিছে জো লোগো রহে গহি উনলোগোকে লিয়ে বারবার রুকনা পড় রহা হ্যায়, এ ঠিক নহি লগ রহ হ্যায়।” বুদ্ধিজি কিছু বললেন না শুধু মৃদু হাসলেন।
বৃষ্টি ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে যেতেই হাল্কা রোদের আভা ঠিকরে বেরিয়ে আসছে মেঘেদের আড়াল থেকে। কি ভীষণ স্বর্গীয় অনুভূতি তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। একটা ঢালু জায়গা দেখে সকলে বিশ্রাম নেওয়া হল। একটা গাছের ডাল শুকনো হয়ে ভেঙে পড়ে ছিল সেখানেই বসে পড়লাম। পঞ্চু/রেইন কোট ছাতা যার যা ছিল সব পুনরায় রুকস্যাকে প্যাক করে নেওয়া হল। সঙ্গে যেসব শুকনো ফল ছিল তা থেকে অল্প অল্প খাওয়া হল। রূপালি আকাশের দিকে তাকিয়ে কত কথা ভেসে আসছে। কত স্মৃতিকে পিছনে ফেলে রেখে অপ্রত্যাশিতভাবে এখানে চলে আসা। যতক্ষণ না কোটলাতে তাঁবু গাড়া হচ্ছে এবং তারপর উনুনে চাল চাপানো হচ্ছে ততক্ষণ পেটে খিল দিয়ে বসে থাকতে হবে সকলকে। সময় অতিবাহিত করে কোনো লাভ নেই, বরং লস আছে; তাহলে দেরিতে খাবার জুটবে। সামনের রাস্তা একেবারে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে। দূরে থেকে দেখলে ভয়ানক ভয়ানক লাগে। যে কারো মনে হতে পারে নানা বন্য প্রাণি হয়তো আড়ালে লুকিয়ে আছে শিকারের খোঁজে। ইদানিং কোনো জংলী জানোয়ারের সন্ধান পাওয়া যায়নি যদিও। অথচ মনটা কেমন যেন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে তাদেরকে দেখার জন্য। বুদ্ধিজি বলে চলছিল যে এই অঞ্চলে গোট্টু নামক বন্য পশুদের উৎপাত সাংঘাতিক রকমের। তবে একসঙ্গে এতজনকে দেখে কোনো বন্য প্রাণীই কাছে ঘেঁষতে সাহস করবে না। তাদেরও প্রাণের ভয় আছে। মনকে সান্তনা দিলাম যে বন্য জন্তুর দেখা না হোক, পাহাড়ি সাপের দেখা নিশ্চয় পাবো। কিন্তু কৈ কারোরই দেখা পেলাম না যে। না পাহাড়ি চিতা, না গোট্টু, না কোনো সাপখোপ।
নয় নয় করে বিশ ত্রিশ নয়, প্রায় একঘন্টা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ে উঠে চলেছি। পাহাড়ি রকমারি অদ্ভুত সুন্দর ফুল ছাড়া কোনো বন্য প্রাণি চোখে পড়ল না। মনোজ দার থেকে শুনলাম যে রমেশ তাও জি তাঁর ঘোড়া এবং দলবল নিয়ে আগে পৌঁছে যাবেন কোটলাতে পৌঁছে একটা ঝর্ণা দেখে তাঁবু খাটিয়ে রান্না শুরু করে দেবেন। সেইমতো সকলে মহানন্দে হেঁটে চলেছে। প্রথম দিনের যাত্রা এতটা খাড়াই হবে বুঝে উঠতে পারিনি। জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে উপরে বিস ত্রিশ গজের মধ্যে পাহাড়ের ঢালে একটা টিনের ছাওনি দেখা যাচ্ছে। সম্ভবতঃ সেটাই আমাদের আজকের যাত্রা সীমা। যদিও কিংশুক দা বলেছিল যে প্রয়োজন পড়লে পরিস্থিতি বুঝে রাত্রেও ট্রেক করতে হতে পারে। সকলে সেই মতো প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে। যাইহোক, অন্তিম সীমা দেখতে পেয়ে যেন সকলে জোর পেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা কোটলাতে পৌঁছে গেলাম। কিন্তু কোথায় কোটলা, কোথায় তাঁবু খাটানো ! কোথায় রমেশ তাওজির তোড়জোড় !
পাহাড়ের ঢালে একখানা টিনের ছাওনি ছাড়া কাউকে কোথাও দেখতে পাওয়া গেল না। পাহাড়ের ওপর থেকে একটা সরু সুতোর মতো ঝর্ণা নীচে বয়ে চলেছে। এখানে জলের কোনো অসুবিধা হবে না। তাঁবু খাটানোর জন্য এর থেকে ভালো জায়গা আর হয় না। টিনের ছাওনির পাশেই একটা ছোট্ট ঘরও আছে। তবে সেটা অবশ্য তালাবন্ধ। ওপর থেকে নীচের মানালি শহর কে ছবির মতো লাগছিল, ঠিক যেন কোনো শিল্পি তাঁর নিপুণ তুলির টান দিয়ে যেখানে যে বিষয়ের সমাবেশ ঘটানোর প্রয়োজন সেভাবেই এঁকে দিয়েছেন। কুল্লু উপত্যকার সৌন্দর্যে সিক্ত হয়ে আছে হিমাচলের পদতলে থাকা এই ছোট্ট শহর মানালি। আয়তনে বড় না হলেও বেশ সাজানো গোছানো পরিপাটী। দূষণ কম ও শুদ্ধ বাতাসের কারণে পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো মেঘেদের যাওয়া আসা অনুভব করা যাচ্ছে। কোটলা থেকে মানালিকে দেখা এক স্বর্গীয় অনুভূতি, এক অপার আনন্দ। বিশাল বিশাল অট্টালিকা, বিরাট বিরাট বিল্ডিং, বিধ্বংসী বিপাসা নদী কোটলা থেকে যেন মনে হচ্ছে সবুজের মাঝে বিন্দু বিন্দু ছোপ ছোপ। কিংশুকদা, মনোজ দা এবং বুদ্ধিজি ছাড়া বাকিরা আমার মত নতুন। হা করে তাকিয়ে আছে সবাই নীচের শহরের দিকে। এত নৈসর্গিক শোভা মুহূর্তেই বশ করে নিয়েছিল। দূরে কালিয়াণি পাশ, হনুমান ডিব্বা ও আরো বেশ কয়েকটা পাহাড়, সবকটির মাথায় বিরাট বিরাট বরফের মুকুট। রোদের আলো পড়তেই সেগুলো থেকে এমন জ্যোতি বেরিয়ে আসছে যে সকলেই অভিভূত হয়ে সেই দৃশ্যহরণকারি পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে। এ যেন এক মহাকাশসম সার্থকতা। প্রথমদিনেই এই দৈবিক পার্থিব মুগ্ধতা হাসিল হয়ে যাবে বোধহয় কারোরই প্রত্যাশাতে ছিল না। একেই বলে মেঘ না চাইতেই জল।
একে একে সকলে কোটলাতে পৌঁছল কিন্তু রমেশ তাঁওজিদের কোনো দেখা নেই। ঘোড়ার দলেরও পাত্তা নেই কোনো। এদিকে খিদের চোটে পেটে ছুঁচো ডন দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছে, বোধহয় মরে গেছে। ভাগ্যিস সকলের কাছে কিছু না কিছু খাবার ছিল, সেই খাবারেই কমবেশি সকলের আপাতকালীন ক্ষুধার নিবৃত্তি হয়। ঘড়িতে সময় বলছে দুপুর দুটো, আকাশের দিকে তাকিয়ে তার কিচ্ছুটি আন্দাজ করা যায় না, ঘন জমাটবাঁধা মেঘদের দল একবার বামে থেকে ডাইনে তো ডাইনে থেকে বামে ভেসে বেড়াচ্ছে। ইতিমধ্যে ভেজা জুতো, পোষাক পাল্টে রীতিমত শীতের পোষাক পরে জোরকদমে গল্প চলছে। তাপমাত্রা আন্দাজমতো ৮ ডিগ্রি থেকে ৯ ডিগ্রি হবে। তার বেশি হবে না। এভাবে ঘণ্টাখানেক পেরিয়ে গেলেও ঘোড়াসমেত মালপত্র নিয়ে তাওজি আসছে না দেখে কিংশুক দা মনোজদাকে নীচে পাঠাল। মনোজ দায়ের স্টামিনার দাগ দিতে হয়। তার বয়স ৪২+ হলেও বুদ্ধিজির সাথে পা মিলিয়ে হাঁটার ক্ষমতা রাখে। বেগতিক দেখে বেচারাকে আবার নীচে নামতে হবে। মালপত্র না আসলে তাঁবু খাটানোও সম্ভব নয়। ক্লান্তি গ্রাস করে ফেলেছে সকলকে। মাঝে মাঝে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি টুঁকি দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। ভাগ্যিস ছাওনিটা ছিল বলে এ যাত্রায় রেহাই।
সকলে অপেক্ষা করে ক্লান্ত অবসন্ন। শুধু যে শারীরিক অবসাদ গ্রাস করেছে তা নয়, এই বুঝি ওরা এল এই ভাবতে ভাবতে মনও অবসন্ন হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে। এভাবে আরো ত্রিশ মিনিট অতিক্রম হয়ে গেছে। কারও কোনো পাত্তা নেই। না আসছে ঘোড়া না আসছে সারথি তাওজি। তাহলে না খেয়েই কি মরতে হবে? নাকি আশ্রয়ের অভাবে এই কনকনে ঠান্ডায় বেঘোরে মরতে হবে সকলকে? অথবা কি আমাদের ফিরে যেতে হবে? আমরা কি পারবো এই অবসন্ন বিধ্বস্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে নীচে যেতে?
চতুর্থ পর্ব
মাইলি থালের বনফায়ার
মনোজ দা তাওজিদের খুঁজতে যাবার আধা ঘণ্টার মধ্যেই মালপত্রসহ একে একে পাঁচটা খচ্চর ও একটি ঘোড়া নিয়ে রমেশ তাওজি হাজির হয়। তারপর অবশ্যি মনোজ দাও ফিরে আসে কোটলাতে। কিংশুকদা দেরীর কারণ জানতে চাইলে তাওজি জানায় যে কোটলাতে আসার মাঝপথে ছয়টা খচ্চরের মধ্যে থেকে একটা খচ্চর মালপত্রসহ ভল্টি খেয়ে নীচে পড়ে যায়, একেবারে কেলেঙ্কারি কাণ্ড, গড়াতে গড়াতে একদম সে নীচে পাকা রাস্তায় পড়ে পা হাত ভেঙে একেবারে বিদিখিচ্চিরি পরিস্থিতি। খুব ভালোরকম চোট পায় সে। পাহাড় থেকে পড়ে গিয়েও মরেনি এই যা রেহাই। তবে, একটা পা ভেঙে যায়, সারা শরীরে আঁচড়ের ক্ষত। সেজন্য পুনরায় তাওজি নীচে নেমে খচ্চরটাকে খুঁজে, তার পিঠের মালপত্র একজায়গায় করে অল্প অল্প করে বাকি খচ্চরের পিঠে লোড করতে এত সময় চলে যায়। নয়তো সব নিয়মমাফিকই ছিল। শুনে খুব খারাপ লাগছিল। একটা অবলা প্রাণী বলে তার কষ্টটা কেউ হয়তো বুঝতে পারলো না। প্রথমদিকে তাওজি ঘটনাটি বলতে চাইছিল না। কিংশুক দা জিজ্ঞেস করতে হাসতে হাসতে সে বলছিল, “কুছ নহি বাস চিজোকো দোবারা লোড করনা পড়া, ইসলিয়ে থোড়া দের লগ গয়া।” তাঁকে একটু চাপ দিলে, আসলে কি ঘটেছিল, পরে সেটা জানায়। তাওজি যখন বলছিল তখন খেয়াল করে দেখলাম চোখ জলে ছলছল করছে। নিজের ছেলেমেয়েদের মতো সে তার পোষ্যগুলোকে আগলে রেখেছে এতদিন। কেউ আঘাত পেলে তারও তো আঘাত লাগে মনে। আর সেটাই স্বাভাবিক। তাওজি একটু দুঃখমিশ্রিত মজা করে বলল, “সোচ রহা থা ছুরি কি সাদি করবা দেঙ্গে, লেকিন উসকি তো প্যার টুট চুকে।” সকলে শুনে হো হো করে হাসল।
সেদিনের মতো রাতে ট্রেক করার পরিকল্পনা ইতি রাখতে হল। বাইরে ঠাণ্ডা বাড়ছে বইকি কমছে না। শীতের পোষাক পরিধান করেও পাহাড়ি দমকা বাতাসে দাঁত সিলিয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। মালপত্র আসতে মনোজদা, সন্দিপণ এবং আমি তাঁবু খাটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। অন্যদিকে কিংশুকদা আর বুদ্ধিজি কিচেন তাঁবু পেতে রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নির্ধারিত সময়ের থেকে প্রায় দু আড়াই ঘণ্টা দেরি হয়ে যাওয়ায় ঠিক হল যে আলু আর পিঁয়াজের পকোড়া দিয়ে মুড়ি খাওয়া হবে এবং তারসাথে গরম গরম চা। সময় বিকাল চারটে কি সাড়ে চারটে হবে। সেসময় লাঞ্চ করলে রাতের খাবার আর কেউ খেতে পারবে না। অথচ রাতের খাবারটা ভীষণ দরকার এই কারণে যে পরদিন সকাল ছয়টার মধ্যেই কোটলা ছেড়ে পাহাড় চড়া শুরু হয়ে যাবে। কাজেই পাঁচটার দিকে পকোড়া দিয়ে মুড়ি সাটালাম সকলে। কয়েকজন ক্লান্তির কারণে ঘুমিয়ে গেল। আমি ফোটোগ্রাফার হয়ে এদিক ওদিক ছবি তুলে যাচ্ছি আর আমার দুই সাকরেদকে শিখিয়ে যাচ্ছি। এদিকে তাওজি বনফায়ার এর আয়োজন করছে। ছবি পর্ব শেষ হলে দেখি ফোটোগ্রাফারের নিজেরই ছবি নেই কোনো, বাকিদের ছবিতে গ্যালরি ভর্তি। যারা পাহাড়ে যায় তারা ভালোমতোই জানে যে পাহাড়ে দেরিতে সন্ধ্যে হয়, ঘড়িতে তখনও ৭টা বেজে চল্লিশ মিনিট হয়ে গেছে তবুও দিনের আলো উজ্জ্বলমান। ৮টার মধ্যে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে যেতে হবে নইলে পরের দিন কাকভোরে ওঠা সম্ভব হবে না।
চারিদিকটা একটু ভালো করে ঘুরে নিলাম। রাতে যদি ছোটো বাইরে বা বড় বাইরে লাগে তাহলে খোলা আকাশের নীচে কোনো না কোনো পাথরের আড়ালে সারতে হবে। বনফায়ারের আগুন তেঁতে উঠেছে। জুতো এবং মোজা জোড়া নিয়ে আগুনের পাশে পাথরে শুকাতে দিলাম। সকলে গোল করে বসে পড়ল আগুনকে ঘিরে। র্যাম্বো ফসিলস্ চালিয়ে দিল। আগুনের লেলিহান শিখা আর রূপম ইসলামের আগুন শব্দের আবহাওয়ায় গল্পের আসর জমে উঠেছে, খোলা আকাশ সাক্ষী, দূরে আড়াল থেকে গল্প শুনে যাচ্ছে চাঁদমামা, লজ্জায় মাথা নত করে নীরব হয়ে গল্প শুনছে পাহাড়ও। জঙ্গল নিস্তব্ধ। পাখিদের গানের আওয়াজ বন্ধ, তারা বোধহয় ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বুদ্ধিজি বলল, “কভি কভি ভালু চলা আতে হ্যাঁয় আগকি দুয়ো লেনে কে লিয়ে। রাতমে জঙ্গলোমে যাহা আগ জলতা হ্যাঁয় উধার হি ভালু চলা যাতা হ্যাঁয়।” শুনে কয়েকজন খুব ঘাবড়ে গেল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ইতনা লোগোকে সামনে কভি আতা হ্যায় ভালু? উ ডরতা নহি?” বুদ্ধিজি চোখদুটো বড় বড় গোল্লা পাকিয়ে বলল, “ভালু দুয়ো লেনে আতে হ্যাঁয় লেকিন ইন্সানোকে ডরসে কভি নজদিক নহি আতে হ্যায়। কভি কভি উসকে নজর কিসি শিকার পে আ যাতা তো আপনা শিকার কো দূর সে নিশানা লাগাকে কিসি পেড় পর চড় যাতা হ্যায়। আগার শিকার কো একেলা দেখে তো উঠা লে যাতে হ্যায়।” শুনে গা ছমছম করছে সবার। মনে মনে চাইছিলাম যে এরকম কিছু হোক। গ্রামের বাড়িতে রোজ দশ বিশটা শেয়াল দেখি, তাই শেয়ালে অ্যাডভেঞ্চার পাই না। যদি ভালু বা চিতার দর্শন হয়ে যেত তাহলে পুরো মাখামাখি হয়ে যেত। কিংশুক দাদা বলে দিল কারো টয়লেট যাবার প্রয়োজন হলে যেন একা না যায়, দলে যায়। প্রত্যেকের কাছে টর্চ আছে, প্রয়োজনে একটা লাঠি নিয়ে যায় যেন।
জুতো মোজা জোড়া শুকিয়ে গেলে দেরী না করে রাতের খাবার খেলাম। ঠাণ্ডা জাকিয়ে পড়ছে, বাইরের তাপমাত্রা অন্দাজমতো ৬ ডিগ্রী থেকে ৮ ডিগ্রী হবে। খাওয়া সেরে মিনিট দশ পনের পাইচারি করলাম ভাবলাম রাতের পাহাড় কুমারীকে উপভোগ করি কিছু চোখে পড়লেও পড়তে পারে। কিন্তু না ! ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে স্লিপিং ব্যাগের ভেতর গ্যারেজ হয়ে গেলাম। এই প্রথম স্লিপিং ব্যাগের ভেতর ঘুমাতে হবে। তাঁবু খাটানো হয়েছে সমান জায়গা দেখে। তবু কেমন যেন অসমতল লাগছে। ট্রেকিং ব্যাগটাকে বালিশ বানিয়ে নিলাম। স্লিপিং ব্যাগের ভেতর শুয়ে নিজেকে কেমন যেন শুয়োপোকা শুয়োপোকা লাগছে। মনে মনে ভাবছি ঘুমাতে পারবো কিনা। কখন মুহূর্তেই ঘুম ঢুলে এল তার কিছুটি টের পেলাম না। ভোর পাঁচটায় আর্লাম বাজতেই ঘুম ভেঙে গেল, জেগে গেলাম। বাকি কয়েকজন বিরক্ত হয়ে চিৎকার শুরু করে দিয়েছে যে কেন এত সকালে আলার্ম বাজবে। তৎক্ষণাৎ আর্লাম অফ করে দিয়ে বাইরের অন্ধকারাচ্ছন্ন মেঘাচ্ছন্ন কুয়াশাচ্ছন্ন ঠাণ্ডাতে এদিক ওদিকে ঘুরলাম। পাহাড়ি সবুজ বন্যগন্ধ নাকে আসতেই মনে এক অপার তৃপ্তি গ্রাস করল। পাহাড়ের খুব কাছে না আসলে এ অনুভূতি হওয়া কখোনোই সম্ভব নয়। কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকারের পানে তাকাতেই কে যেন কানে কানে বলে গেল, “কত সহস্র ঘণ্টা অপচয় করেছিস ভুলভাল জিনিসের পিছনে ছুটে”; আগে যদি পাহাড়ের স্বাদ পেতাম, কাশ ! জীবনটাই বদলে যেতে পারতো। কিছু পরেই অল্প অল্প করে দিনের আলো ফুটতেই নিম্নচাপ আসতে লাগল। কিন্তু কি করে এই খোলা আকাশের নীচে সেই কর্ম সম্পাদন করব তা নিয়ে ইতস্তত হচ্ছে। এক এক করে সকলের মহাকর্মাদি সারা হয়ে গেল, আমার আর হল না। অথচ অনেক ভোরেই জেগে গেছি।
এদিকে কিংশুক দাদা সব্বাইকে জাগিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি ব্যাগপ্যাক করে নিতে বলে চলে গেল সকালের নাস্তার তোড়জোড় করতে। ইতিমধ্যে ভোরেই এক পশলা চা পান হয়ে গেছে। এবার শুধু টিফিনের অপেক্ষাই। এদিকে সময় কালস্রোতের মতো ভেসে যাচ্ছে। অনেক দ্বিধা সন্দিগ্ধতা দূর করে পটির উদ্দেশ্যে গেলাম। পূর্বে কখনো এ অভিজ্ঞতার সুযোগ হয়নি। তাঁবু থেকে বেশ কিছুটা দূরে এক পাথরের আড়ালে লজ্জাসরম বোধ সরিয়ে বসলাম অবশেষে। কিন্তু গোলযোগ বাঁধল ফেরার পথে। টিস্যু পেপার সহযোগে শৌচাদি কর্ম সেরে ফেরার পথে নীচের দিকে নামার সময় একটা শিশিরভেজা ঘাসপাথরের ওপর পা রাখতেই পিছলে গিয়ে একেবারে নাস্তানাবুদ। নিজেকে থামাতে গিয়ে পাথরের গায়ে আঁচড়ে ডানহাতের তিনটা আঙুলের বারটা বেজে যায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে, সে এক রক্তারক্তি কাণ্ড। এ যাত্রায় কোনোমতে রক্তপাতের ওপর দিয়ে বেঁচে গেলাম। যদি পাথরের সাথে ঘষা খেয়ে খেয়ে নিজেকে রুখতে না পারতাম তাহলে আর কিছু বলার থাকতো না, ছবি হয়ে যেতাম। যাইহোক, রক্ত বন্ধ হলে কাউকে কিছু না বলে ঝরনার জলে ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে নিলাম। সঙ্গে গোটা বিশেক ব্যাণ্ডেড ছিল তার কয়েকটিতে কাজ মিটে গেল। আমার জায়গায় যদি অন্য কেউ থাকতো তাহলে হয়তো ট্রেকিং সেখানেই থেমে যেত, নেহাত আমি ছিলাম তাই টুশব্দটিও হয় নি।
সকলের জন্য অপেক্ষা করছে বুদ্ধিজির হাতে প্রস্তুত গরম গরম রুটি, ভাত, ডাল, সব্জি। সকালের আহার সেরে পৌনে সাতটা নাগাদ আবার যাত্রা শুরু হল। আজ অন্তত সাত থেকে আট ঘণ্টার ট্রেক করতে হবে পরবর্তী ক্যাম্পে পৌঁছতে। বুদ্ধিজি শাল গাছের ছড়ি কেটে আমার জন্য একটা খুব সুন্দর ট্রেকিং পোল বানিয়ে দিলেন। সকলকে লজেন্স, জুস, বিস্কিট, চকোলেটের একটা করে প্যাকেট ধরিয়ে দেওয়া হল। ট্রেকিং চলকালীন প্রত্যেকদিনই এমন একটা প্যাকেট দেওয়া হয় পথে এনার্জি যোগানোর জন্য। আমি আর বুদ্ধিজি আগে আগে চলছি, বাকিরা সব পিছিয়ে, বুদ্ধিজি সুযোগ পেলেই আমার তারিফ করছে, আমিও কম যাচ্ছি না। বুদ্ধিজি নিজের জীবনের অনেক কাহিনি অনেক ইতিহাস অনেক অভিজ্ঞতার গল্প শোনাচ্ছেন। ট্রেকিং-এ কোনো কষ্ট অনুভূত হচ্ছে না। দশ/বিশ মিনিট পাহাড় চড়া হয় তো বাকি পাঁচ দশ মিনিট বাকিদের জন্য অপেক্ষা করে কেটে যায়। মাঝে বাবাই দা ও আরো অনেকে আমাকে বলে যায় এত দ্রুত হাঁটার কোনো দরকার নেই, তুমি কোনো যুদ্ধ জয় করবে না। একপ্রকার আমার দ্রুত গতির কারণে আমাকে চেটে যায়। একটু কেমন অস্বস্তি বোধ হয়। সিদ্ধান্ত নিই যে বাকি ট্রেকটা মাঝখানে থাকবো, কারো কোনো লিড লাগলে মেকাপ করে দেব।
যাত্রা শুরুর মিনিট দশকের মধ্যেই কোটলা ছাড়িয়ে আমরা ঘন জঙ্গলের পথ অনুসরণ করে হেঁটে চলেছি। সামনে বুদ্ধিজি, তারপর দেবব্রত দা, অনিরুদ্ধ দা তারপর আমি। আমার সাথে পা মিলিয়ে পাহাড় চড়ছে র্যাম্বো ভাই, সন্দীপন, মেহুল আর অনুশ্রিতা দি। তার পিছনে বাকি সবাই রয়েছে। আজকের রাস্তা একেবারে সম্পূর্ণ আলাদা। প্রত্যেক মোড়েই অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ মিশে আছে। কোটলার ঝরনা ধরে খাঁড়াই পাহাড়ে ওপরে যে সরু ঘাস কাটিয়েদের রাস্তা দেখা যাচ্ছে সেই রাস্তা ধরেই এঁকেবেঁকে পাহাড় চড়া হচ্ছে। দেড় দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেছে ফোন সেভাবে ব্যবহার হয়নি, চার্জও বেশি নেই। পাহাড়ের রূপকে ছবিবন্দী করা চলছে অনবরত। সন্দিপনের ফোনের ক্যামেরাটা সুন্দর। সে আমাকে সেটা গছিয়ে দিয়েছে। যখন মন চাইছে ছবি তুলে চলেছি, তবে অবশ্যি আমার নিজের নয়, বাকি সবার। আগেই বলেছিলাম ছবি তোলার হাত আমার নেহাত মন্দ নয়। প্রায় সকলেই চাইছে আমি ছবি তুলে দিই তাদের। কারো কারো ছবি না তুলে এগিয়ে গেলে মনখারাপ করছে। এভাবে ঘণ্টা দুয়েক অতিক্রম হল। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল একটা বড় গাছের নীচে মিনিট পাঁচেকের আশ্রয় নিয়ে আবার যাত্রা শুরু হবে। বিরাট একটা পাইন গাছের নীচে গা এলিয়ে মিনিট পাঁচেকের বিশ্রাম করা হল। জল বিস্কুট, চকোলেট কাজু কিশমিশ খেয়ে পুনরায় যাত্রা শুরু হল।
আজ প্রকৃতি আমাদের সহায়। বৃষ্টির কোনো দেখা নেই। মাঝে মাঝে মেঘেদের দল ভেসে এসে শরীর ছুঁয়ে পালিয়ে যাচ্ছে, নতুন বৌ স্বামীর সোহাগে লজ্জা পেয়ে যেমন এদিক ওদিক লুকিয়ে পড়ছে এ যেন ঠিক তেমনই। সকলে হেঁটে চলেছি লাইন করে। সামনে এক বিশাল ঘন জঙ্গল। দূর থেকে কিছু ঠাওর করা সম্ভব নয়। শাল, সেগুন, পাইনের বিশাল বিশাল গাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে, তারাও পাহাড়ের মতো মৌন, অভিমানী। ভিতরে প্রবেশ করতেই বোঝা যাচ্ছে কতবছর রোদের আলো পৌঁছায়নি। গাছগুলোর পাতা ছাওনির মতো একে ওপরের সাথে জুড়ে গিয়ে ছাদ হয়ে আছে। সেই পাতার ছাদ ভেদ করে আলো পৌঁছানোর সাধ্যি কি আছে ! শুকনো পাতা বিছিয়ে সমুদ্র হয়ে আছে। পা দিতেই এক হাঁটু করে ডুবে যাচ্ছে। একেবারে নিস্তব্ধ, শান্ত। মাঝে মাঝে পাখিদের ডাক কানে আসছে। তার ওপর দিয়ে সকলের সারি সারি হেঁটে চলায় খসখস শব্দে জঙ্গলের ঘুম ভাঙছে। মিনিট দশ’পনের সেই পথেই পাড়ি দিয়ে পাহাড়ের ওপরে ওঠা চলছে। জঙ্গলের পথ শেষ করতে না করতেই সামনে যা দেখলাম দেখে চক্ষুচরকগাছ। কি ভয়নকভাবে বিরাট এক হাড়ের কঙ্কাল পড়ে আছে। সম্ভবত পাহাড়ি গোরু বা মহিষ হবে, ভাল্লুক বা নেকড়ের হাতে বেঘোরে প্রাণ খুইয়েছে। বুদ্ধিজি চোখ দুটো বড়বড় গোল্লা করে বললেন, “বাবু ইসে জরুর ভালুনে খা লিয়া, গাই ইয়া ভ্যাষ নে আপনে টীম সে বিছড় গয়া থা সায়দ। পাহাড়োমে ইসলিয়ে হামেশা টীমকে সাথ মিলজুলকে চলনা চাহিয়ে। নহি তো ভালু ইয়া ভেড়িয়াকো খা যায়েগা।” আরও একটু সামনে যেতেই দেখি বিরাট এক শিং, ভেতরটা ফাঁপা। সম্ভবত মহিষের বা পাহাড়ি গরুর হবে। বেচারা বোধহয় কোনো ভালু বা হায়নার পেটে গেছে। তবে, হাড়ের কঙ্কাল দেখার পর থেকে প্রত্যকের মধ্যে একটু পরিবর্তন দেখা গেল। কেউ আর দলছুট হয়ে এগিয়ে বা পিছিয়ে চলার দুঃসাহস দেখাল না। জঙ্গলের পথ অতিক্রম করে সামনের প্রবেশ বিস্তীর্ণ সবুজ পাহাড়ি ঘাসের বনের মধ্য দিয়ে, সঙ্গে ফার, জুনিফার গাছের ঝোপ। দূর থেকে মনে হচ্ছিল কেউ যেন সবুজের বিছানা পেতে দিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে বহুবছর ধরে। উপরে ওঠার কোনো পরিচিত রাস্তা নেই। বিছানাটা ঢালু হয়ে ওপরে উঠে গিয়েছে। সেখানে জনমানুষের কোনো পদচিহ্ন নেই। বেশ খানিকটা চলার পথ বাকিদের খুব ক্লান্ত, অবসন্ন দেখাচ্ছিল। অগত্যা কিংশুকদাকে বলে একটু বিশ্রামের ব্যবস্থা করি। মিনিট দশেক বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় পথচলা শুরু। বুদ্ধিজিকে জিজ্ঞেস করলাম, “বুদ্ধিজি হামলোক কাহা ঠেহেরেঙ্গে আজ? অউর কিতনা লাগেগা পৌছনমে?” তিনি তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন, “অউর যাদা নহি, বাস বিস তিস মিনটোমে পৌছ জায়েঙ্গে।”
যত উপরে ওঠা হচ্ছে তত পাহাড়ের প্রতি প্রেম গভীর, গাঢ়, দৃঢ় হয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে নিস্তব্ধতা, বাতাসের শান্তির শ্বাস, প্রাণ জুরিয়ে যাচ্ছে। সর্বত্র এক অপার শান্তি বিরাজ করছে। বারবার নিজেকে দোষারোপ করে যাচ্ছি কেন যে এতবছর ঘুমিয়ে ছিলাম অজ্ঞতার তিমির আচ্ছাদনে আবৃত হয়ে ! আধাঘণ্টাখানেকের মধ্যে পাহাড়ের একটা ঢালু জায়গায় পৌঁছানো হল অবশেষে, যার কিছুটা ওপরে উত্তরপূর্বদিকে একটা সুতোর মতো ঝর্ণা বয়ে নীচে চলে গিয়েছে। চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল পড়ে যাচ্ছে সেই ঝর্ণাধারা থেকে। নীচে হাতদশেকের মধ্যে পাইন, সিডার ইত্যাদি গাছের ঘন বন। এই জায়গাটিকেই স্থানীয় লোকেরা ‘মাইলিথাল’ বলে অভিহিত করে থাকেন। উত্তরে পাহাড়ের গায়ে পাহাড় ঘষাঘষিলেগে ওপরে উঠে গিয়েছে। সবুঝ ঘাসের পাতা বিছানা সেইদিকেই উঠে গিয়েছে। একে একে সকলে মাইলিথালে পৌঁছালে ঘড়িতে তখন দুপুর দুটো বেজে দশ মিনিট হয়েছে। দেরী না করে তাওজি এবং বুদ্ধিজি একটা জায়গা নির্বাচন করে, আমি মনোজদা এবং সন্দীপ তাঁবু খাটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এদিকে বুদ্ধিজি, কিংশুকদা এবং বাবাই দা রান্নার ব্যবস্থা শুরু করে দেয়।
আজকের পরিকল্পনা ছিল দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে পুনরায় ট্রেকিং-এ বেরিয়ে পড়া হবে। কিন্তু, কয়েকজন পায়ে এত ব্যথা পেল যে কিংশুক দাও মেনে নিল। সকলে এবিষয়ে একমত হল যে, মাইলি থাল ভালো করে ঘুরে উপভোগ করা হোক। ঘণ্টাখানেকের অনেক আগেই বুদ্ধিজি গরম গরম খিচুড়ি, সব্জী আর ডিমভাজার আয়জন করে ফেলল। রসনা তৃপ্তি করে খেলাম। দুপুরে তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রী থেকে ১৫/১৬ ডিগ্রী থাকলেও মেঘেদের দল যখন তাঁবু ঢেকে ফেলে তখন হু হু করে পারদের স্তর কমে ৮ থেকে ১০ ডিগ্রীতে পৌঁছাচ্ছে। বুদ্ধিজির থেকে শুনলাম যে, মাথার ওপর সূর্য ডুবে গেলে তাপমাত্রা কমতে কমতে একেবারে মাইনাসে না পৌঁছালেও তা রাতে ২ থেকে ৪/৫ ডিগ্রীতে পৌঁছায়। যাকে বলে ঠাণ্ডা একেবারে জাঁকিয়ে পড়ে। ছেলেবেলা থেকেই আমার ঠাণ্ডার ধাত, একটুতেই ঠাণ্ডা লেগে যায়। তবে, মজার বিষয় হল, এখন পর্যন্ত ঠাণ্ডা সেভাবে কাহিল করতে পারিনি। সঙ্গে মন্টিকোপ এ নিয়ে রেখেছি, প্রয়োজনে ব্যবহার করতে হবে। যেদিন বুদ্ধিজির বাড়িতে পৌঁছেছিলাম কেবলমাত্র সেই দিনেই একটি ব্যবহার করেছিলাম। যাইহোক, গরমের পোষাক চাপিয়ে মাইলিথালের চারিদিকে ঘুরে নিতে হবে; কে জানে “জিন্দেগী না মিলেগী দোবারা”। তাছাড়া এখনও পর্যন্ত তার আর দরকার হয়নি। বেরোব ভাবছি হঠাৎ চারিদিক দমকা মেঘে ঢেকে গেল মুহূর্তেই। ঘনমেঘের আস্তরণ দূরীভূত হলে তাঁবু থেকে বেরিয়ে দেখি আমি স্বর্গের দেশে। তাঁবুর পশ্চিমদিকটা ঘন জঙ্গলে ঢাকা যার সামনে বিরাট বিরাট মহীরুহের জঙ্গল ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না। কিন্তু বাকি তিনদিকে যা দেখলাম কি বলব, কোনো শব্দপ্রয়োগই ব্যক্ত করতে পারবে না যে কিরকম অপারমার্থিক অনুভূতি হয়েছিল। আশেপাশের সবকয়টি পাহারের মাথায় বরফ ধেকে ফেলেছে। মনে হচ্ছে যেন সবুজের মাথায় কেউ তুলোর পাহাড় বানিয়েছে বিশেষ একপ্রকারে। কি অপূর্ব তার শোভা, কি মাধূর্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে।
বুদ্ধিজিকে একটা আইস কুঠার নিয়ে ঝোপের দিকে এগোতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, “বুদ্ধিজি আপ কাহা যা রহে হো?” বুদ্ধিজি দূরে থেকে উত্তর করল, “জড়িবুটি লেনে যা রহা হু, ইধর পাহাড়োমে বহুত জড়িবুটি মিলতা হ্যায়। হাম যব নীচে যাতে হে গাঁওকা লোক চলে আতা হ্যায় দাবাই লেনে।” আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, “হম ভি আপকে সাথ জানা চাতে হে।” আমার কথা শেষ হতে না হতে বাকি সকলে ও একসাথে বলল আমারাও যাব। বুদ্ধিজি শুনেই খুব খুশি। সকলে একসাথে জড়িবুটির সন্ধানে বেরিয়ে গেলাম। বুদ্ধিজি বিশেষ প্রকারের পাহাড়ি ঘাসের গোড়া উপড়িয়ে সকলকে দেখিয়ে বললেন, “এ দাবাই দাঁতো কে লিয়ে। হম সাক্রো সালসে পাহাড়োমে এহি দাবাই ইস্তেমাল করকে আ রহে হ্যায়। জব কিসিকা দাঁত দুকতা হ্যায় ইয়া দাঁত ইধরউধর হো যাতা হ্যায় তব বো ইস মূলিকো শুখাকে ছোটা সা হিসসা ইস্তেমাল করতা হ্যায়।” দেবব্রত দা, অনিরুদ্ধ দা শিকড় তুলতে লেগে গেল। বুদ্ধিজি এক জায়গায় বসে পাহাড়ের গল্প শোনাতে লাগলেন। সকলে মোহিত হয়ে সেই গল্প শুনছে, আমরা কয়েকজন শিকড় তুলছি। বেশ খানিকটা শিকড় তোলা হলে বুদ্ধিজি বললেন, “এ বহত জাদা হো গয়া। চার পাচ সাল ইসসে হো জায়েগা। চলো আপলোক বপাশ চলতে হ্যায়।” সকলে তাঁবুতে ফিরে আসলাম। ততক্ষণে গরম গরম টিফিনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে- পকোড়া, ক্ষীর ইত্যাদি।
খাওয়া সেরে সন্দীপন বায়না ধরল ছবি তুলে দেওয়ার জন্য। একে একে বাকিরাও যোগ দিল। সকলের ছবি তুলতে তুলতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। দেবুদা তো ছবি পাগল, ভিন্ন ভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে কতবার করে যে ছবি তুলতে হল তা বলে বোঝানো যাবে না। একসময় বিরক্ত হয়ে বললাম “চলো তো অনেক হল, এত ছবি খাবে কে। তুমি এমনিতেই হিরো, এত পোজ দিয়ে ছবি না তুললেও লোকে খুব খাবে।” দেবুদা লজ্জা পেল। ফিরে এসে তাঁবুর মধ্যে ঢুকে পড়লাম। দিনের আলো তখনও মিশে যায়নি পাহাড়ের আড়ালে। পাহাড়ে বরবরই ভালো করে সন্ধ্যে নামতে আটটা বেজে যায়। তবে, তাপমাত্রা ক্রমশ কমতে শুরু করেছে। প্রচণ্ড শীতল পাহাড়ি হাওয়া বইছে। মনে হচ্ছে যেন ঠাণ্ডার ধারালো তীর শরীরে বিদ্ধ। এক মিনিট তাঁবুর বাইরে থাকলেই গরম পোষাক পরেও সারা শরীর জমে যাচ্ছে। তাওজি নীচের জঙ্গল থেকে শুকনো কাঠ সংগ্রহ করে অনেক আগেই বনফায়রের আয়োজন করে ফেলেছে। সুরেশ, তাওজিকে সার্বিকভাবে সাহায্য করে চলেছে।
তাঁবুর বাইরে সর্বত্র গাড় মেঘে ঢাকা। কতকগুলি তাগড়াই শুকনো কাঠ জ্বালিয়ে দিল সুরেশ। রান্নার কাজে বুদ্ধিজি, কিংশুকদা এবং বাবাই দা ব্যস্ত। বাকি সকলে বনফায়রকে গোল করে ঘিরে। বনফায়ারের আগুন তেঁতে উঠেছে। আগুনের তাপ গমগম করছে। তাওজি কোমরের গাঁট থেকে দেশি চুল্লুর বোতল বের করে কয়েক ঢোক মেরে তৎক্ষণাৎ গাঁটের মধ্যে লুকিয়ে রাখছে। তরলের রঙ অন্ধকারে ঠিক ঠাওর করতে পারা যায়নি, তবে আগুনের সামনে ধরতেই হলুদ জাতীয় তরল চোখে পড়ল। আমাদের টীমের কয়েকজন আবদার করতে তাওজি গাঁট খুলে বোতলটা এগিয়ে দেয়। দূরে মাঝে মাঝে দু একটা পাখি কিচিরমিচির করে ডেকে উঠছে। আশপাশ একেবারে নিস্তব্ধ। আমাদের গলার স্বর যেন জয়ঢাকের মত বাজছে পাহাড়ে। আগুনের পাশে গোল করে বসে একে অপরের মুখোমুখি। চোখে চোখে অনেকে অনেক কিছু বলে যাচ্ছে, মুখে কোনো কথা বলছে না। তাদের মধ্যে কারো কারো চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, অথচ কাঁদছে না। সম্ভবত নিজের নিজের কাছের মানুষের অভাব অনুভব করছে। আগুনের রক্তিভ আলোতে তাদের মুখ খুব অসহায়, নিঃস্ব লাগছে। কেউ বুঝতে পারছে না যে আমি আড়াল থেকে কমবেশি সকলের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছি। আমিও অবশ্যি কিছুক্ষণের জন্য স্মরণ করছিলাম যাদেরকেই আপন করে কাছে টেনেছি তারাই আমার সাথে সুযোগে সদব্যবহার করেছে। মুহূর্তেই ভাবনাকে সরিয়ে বাকিদের মন পড়াতে শুরু করলাম। পরিস্থিতি অন্যরকম দেখে প্রস্তাব দিলাম যে গানের লড়াই হোক, যাতে সকলের মনের পরিবর্তন হয়। শুরুটা হল গানের লড়াই-এর মধ্যে দিয়ে। একদিকে ছেলেদের টীম, অন্যদিকে মেয়েদের টীম। ছেলেরা সংখ্যায় বেশি হলেও মেয়েদের দু তিন জন মেয়ের কাছে পেরে ওঠার নয়। তবে যে পক্ষেরই হোক না কেন সকলে মিলে পাহাড়ের নিস্তব্ধতা ভেদ করে একইসুরে গান গাওয়া হল। কিছুপর গানের মোড় বদল হল। ডাক্তার সাহেবা একাই গানের আসর জমিয়ে তুলল, আর. জে. ম্যাডামও অবশ্যি সাথ দিল। রান্নাবান্না সেরে এসে বাকিরাও একে একে যোগ দিল। সে এক অদ্ভুদ আনন্দ, এক অন্যরকম আমেজ। তাপমাত্রা ৪ থেকে ৫/৬ ডিগ্রি হবে হয়তো। গমগমে বনফায়ারের আগুন, যেদিক আগুনের সামনে সেদিক গরম, অন্যদিক ঠাণ্ডাতে বরফ হয়ে যাচ্ছে। তাওজি হিমাচলি ভাষায় গান করছে, আঞ্চলিক গান থেকে শুরু করে আধুনিক, এমনকি অত্যাধুনিক সবরকম সঙ্গীত পরিবেশিত হচ্ছে। ঐ সুন্দর মুহূর্তের সাক্ষী হতে পেরে নিজেকে বড় সৌভাগ্যবান বলে মনে হচ্ছিল।
বনফায়ারের আগুনে পাহাড়ের স্নিগ্ধতা মেঘেদের শীতলতা, গাঢ় অন্ধকারের গহীনতা সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। গানের মাঝে মাঝে কিংশুকদায়ের মজার মজার গল্প, অভিজ্ঞতা আসরের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছিল। হঠাৎ, এক ভয়ানক চিৎকারের আওয়াজ কানে আসে নীচের জঙ্গল থেকে। আগেই বলেছি তাঁবু থেকে বিশ ত্রিশ গজের মধ্যেই জঙ্গল। আগুন্তক আওয়াজের ভয়ঙ্করতা, বিকটতা এত প্রবল যে ভয় পেয়ে কেউ কেউ তাঁবুর মধ্যে চলে গেল। বাকিদের যারা আগুনের চারপাশে বসে ছিল সকলে ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে গেল। আমিও অবাক কম হয়নি। তাওজিকে জিজ্ঞেস করলাম, “তাওজি এ চিঁখ কিসকি থি?” তাওজি চোখদুটো বড়োবড়ো করে হিমাচলি ভাষায় কিছু একটা বলল। আমার বোধগম্য হল না ঠিক। পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, “কনসি জঙ্গলি জানবর থি বো?”, বুদ্ধিজি তখন বললেন, “স্নো লেপার্ড কি চিঁখ থি। ও সায়দ আসপাস হি হ্যায়, দুয়ো লেনে আয়া। ভালু কে জ্যাসা এ ভি কভি কভি আগ কি দুয়ো লেনে আতি হ্যায়।” কথা শেষ হওয়ার আগেই বাকিদের হৃৎপিণ্ড যেন খুলে বেরিয়ে আসল, দে ছুট। এক লাফে ছুটে তাঁবুর মধ্যে ঢুকে গেল। আমি বরাবরই ডানপিটে সাহসি, স্নো লেপার্ডের নাম শুনেই তাকে দেখার বড় বাসনা হল। কতবার কল্পনায়, স্বপ্নে বাঘের সাথে কুমিরের সাথে লড়াই করেছি। এইবার না হয় মুখোমুখি হওয়া হবে। তাওজিকে বললাম, “তাওজি মেরেকো স্নো লেপার্ড দেখনা হ্যায়। প্লিজ চলিয়ে না একবার।” কিংশুকদা বারণ করল। বারণ মানে কে! দুটো টর্চলাইট নিয়ে যেদিক থেকে আওয়াজ আসছিল সেই দিকেই সুরেশ, তাওজি এবং আমি এগিয়ে গেলাম।
পঞ্চম পর্ব
বরফে ঢাকা মানালি পাস
ঐ হাড়হিম করা শীতের রাতে দশ-পনের মিনিট স্নো লেপার্ড এর সন্ধানে জঙ্গলে অনুসন্ধান চালানো হল। কিন্তু না শেষমেশ হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হল। তাওজি বললেন, “বেচারা কাহা ছুপকে ব্যাঠা হ্যায় উসে ঢুন্ডনা বহত মুশকিল হ্যায়।” অগত্যা অখুশি হয়েই ফিরে আসলাম। মনে মনে ভাবলাম স্নো লেপার্ডের এত কাছে এসেও দেখা হল না। বনফায়ারের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। রাতও অনেক গভীর হয়েছে। বিষণ্ণ মনে অবসন্ন রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছিলাম। হঠাৎ বুদ্ধিজির আওয়াজে ঘোর কাটল, “সুরেশ গোট্টু থা। আগ কি দুয়ো লেনে আয়ি থি।” আমি উৎসাহভরে জিজ্ঞেস করলাম, “বুদ্ধিজি, গোট্টু কনসি জানবর হ্যায়? বো ক্যা ইনসান খাতে হ্যায়?” বুদ্ধিজি হেসে হেসে বললেন, “ইস জানবর স্রিফ পাহাড়োমে মিলতা হ্যায়। কভি কভি ভুখি গোট্টু কো ইনসান খা জাতা হ্যায়।” চোখদুটো বড়োবড়ো করে গোল্লা পাকিয়ে বললেন, “গোট্টু লেপার্ড নহি হ্যায় লেকিন উসসে ভি খতরনাক হ্যায়।” বুদ্ধিজির ভয়ানক ভঙ্গিতে বোধহয় রাতের আকাশের মায়াবী পরিবেশ ভয় পেয়ে আরও মায়াবী হয়ে উঠল। যাইহোক, আবার কাল খুব সকালে যাত্রা শুরু করতে হবে। ফ্রাইড রাইস চিকেন আর কিছু একটা সব্জির আয়োজন করা হয়েছে ডিনারে। বেশিরভাগ সকলে খেয়ে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে গ্যারেজ হয়ে গেছে। আমি খাওয়া সেরে বাইরে একটু পাইচারি করছি। মাথার ওপর নীল আকাশ, দু একটা তারা মিটমিট করে জ্বলছে, বাইরে অন্ধকার গাঢ়। হু হু করে শীতল বাতাস এসে গায়ে ধাক্কা মারছে। দু-তিন দফা গরমের পোষাক পরেও গা হাতপা ঠাণ্ডায় জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে। বেশিক্ষণ থাকলে নিউমোনিয়া হয়ে যাবে ভেবে তাঁবুতে ফিরে শুয়ে পড়লাম।
পরদিন সকাল ছটায় ঘুম ভেঙে বাইরে তাকিয়ে দেখি মেঘের পাহাড় জমে আছে চারিদিকে। মেঘেদের এত ভিড় জমেছে যে পাশের তাঁবুই চোখে পড়ছে না, অতিরিক্ত ঠাণ্ডা। মেঘ গলে তাঁবুর মাথার ওপর জল থলথল করছে, ভেতরে দু এক ফোঁটা জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। তৎক্ষণাৎ জমা জল ফেলে দিয়ে তাঁবুর মধ্যেই অপেক্ষা করছি কখন রোদ্দুরের আলো গায়ে মাখবো এই ভেবে। মিনিট পাঁচ-সাতেক পর মেঘেদের দল ঘরে ফিরে গেলে ঝলমলিয়ে রোদের আলো ঠোকা মারে তাঁবুর দরজায়। দরজা খুলে দেখি বনফায়ারের আগুন তখনও জ্বলছে একইভাবে। আমাদের সবকটি তাঁবু ভিজে সোপ সোপ করছে। কাজেই সেগুলি ভালো করে না শোকালে আজরাত্রিতে কষ্টের শেষ থাকবে না। তাঁবুগুলোকে খুলে রোদে শোকাতে দেওয়া হল। পরিকল্পনা মাফিক সাড়ে ছয়টার মধ্যেই নতুন পথে যাত্রা শুরু করার কথা। মজার বিষয় হল, গতরাতের ভয়াবহ চিৎকারে ভয় পেয়ে দিনের বেলায় নীচের জঙ্গলে যেতে একা কেউ সাহস পাচ্ছে না। গতরাতের স্নো লেপার্ডের চিৎকার বিভীষিকার মতো গেঁথে আছে সকলের মনে। যাইহোক, যতক্ষণ না তাঁবুগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে পুরোপুরি যাত্রা শুরু করা যাবে না। এদিকে অনেক ভোররাত থেকে টিফিনের আয়োজন চলছে। সম্ভবত খাবার প্রস্তুতও হয়ে গেছে।
সকালের খাবার সেরে সাতটার মধ্যে যাত্রা শুরু হয়ে গেল। আগের দিনই রানিসুইলেকে পৌঁছে সেখানেই তাঁবু পাতার কথা ছিল। বিভিন্ন কারণে তা হয়ে না ওঠাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে একেবারে মানালি পাসপাসের কাছে পৌঁছে যাত্রা থামবে। যেহেতু পাসপাসের ওখানে বরফে ঢাকা থাকবে সেজন্য আমাদের গন্তব্যের একটু নীচে তাঁবু পাতা হবে যাতে করে পরদিনই যেন আমরা সামিট করে নীচে নামতে পারি। তাছাড়া পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় সর্বদা জল পাওয়া যায় না, সারা জায়গা বরফে ঢাকা থাকে। তাঁবু পাতার মতো পরিবেশও পাওয়া যায় না। তাছাড়া পরিস্থিতি বলে দেবে কোথায় কি করতে হবে।
মাইলি থাল থেকে আমরা যত উপরের দিকে উঠছি রাস্তা ততই খাড়া হয়ে চলেছে। ঘণ্টাখানেক পথ অতিক্রম করার পর সামনে এক কঠিন রাস্তা। বিশাল বিশাল পাথর ভেঙে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। এ রাস্তা ভীষণ দূরহ। একটু অসাবধান হলেই নীচে পড়ে গিয়ে খাতে কিংবা পাথরের ভেতরে ঢুকে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন করতে হবে। বুদ্ধিজিকে শুধালাম, “বুদ্ধিজি ইস জাগাকা নাম ক্য হ্যায়? ইধর ইতনা বড়া বড়া পাত্থর কাহা সে আয়া?” বুদ্ধিজি কি জানে কি মনে করে হাসলেন এবং তারপর উত্তর দিলেন, “ইস জাগাকো হম কালাপাত্থর কেহেতা হ্যায়। এক টাইম থা জব ইধর বহত বড়া চট্টান থা। ইস চট্টান কো টপকানে মে লোগোকো বহত তকলিফ হোতা থা। একদিন অচানক সবলোগোনে ভয়ানক আওয়াজ শুনা। লোগোনে দেখা চট্টান না রহি। পুরখোনে কেহেতে হ্যায়, পাহাড়ো কি দেবী কি দুয়া সে এ হুয়ি। উস ঘট্না কে বাদ সে সবলোগ পাহাড়ো কি দেবী কো পুজকে আরহা হ্যায়।” তবে, কালাপাত্থর জায়গাটা বেশ খাসা। যেমন ভয়ানক, তেমন সুন্দর। এখানে ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ পাওয়া যায়। যেন এক স্বর্গের দেশ। যেদিকে তাকাই সেদিকেই তুষার শৃঙ্গ, প্রত্যেকেই যেন সাদা তুলোর মুকুট পরে আছে। রোদের আলো সেইসব পর্বত শৃঙ্গে পড়তেই তাদেরকে অতীব সুন্দর লাগছে। সেখানে মিনিট পাঁচেকের বিশ্রাম নেওয়া হল। ছবি সেশন হল। তারপর আবার পথ চলা। আশেপাশে কোনো শব্দ নেই, নীচে দু একটা বাজপাখি, চীলের আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। একেবারে সুনসান নিস্তব্ধ। নিস্তব্ধতা ভেদ করে কেবল পায়ের ছপছপ আওয়াজ হচ্ছে। হঠাৎ চোখে পড়ল যে কিছুটা দূরে তুলোর মতো একটা বিছানা পাতা। বুদ্ধিজিকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে সেটা তুলোর বিছানা নয়, বরফের আস্তরণ। মনে হচ্ছে যেন তুলো বা সোলার স্তর মেখে আছে পাহাড়ের সর্বত্র গাত্রপোষাকে। দূরে থেকে প্রথমবারের জন্য দেখে বুঝতেই পারছিলাম না। কাছে যেতেই মন খুশিতে ভরে গেল। র্যাম্ব ভাই এবং আমি আনন্দে নাচতে শুরু করে দিলাম। বরফের বল বানিয়ে খেললাম। সে কি আনন্দ তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এর আগে যদিও হেমকুণ্ড অভিযানে গ্লেসিয়ার পেয়েছিলাম। কিন্তু সে আনন্দের মাত্রা এক অন্যরকম। আর এই মুহূর্তে যে আনন্দ, আবেগ, উৎফুল্লুতা সারা মনের প্রাসাদ জুড়ে গ্রাস করেছে তার প্রকাশ করা কোনোদিনই সম্ভব নয়।
আবার পথ চলা শুরু হয়ে গেল। জীবনটাই একটা যাত্রা, যেখানে শুধু এগিয়ে যেতে হয়, থেমেছ তো নিশ্চিহ্ন হয়েছো। যাইহোক, কিংশুক দা এবং বাবাই দা এসকট্ হিসাবে পিছনে, তাওজি সার্বাগ্রে এগিয়ে চলেছে, সঙ্গে আমি আর দেবব্রত দা। বুদ্ধিজি তারপর, বুদ্ধিজির সঙ্গে অনিরুদ্ধ দা, তারপর অনুশ্রীতা দি চলেছে। পাহাড়ের ঢাল বরাবর চলা হচ্ছে, স্থানীয় কোনো রাস্তার লেশমাত্র নেই। আমরা যেপথে এগিয়ে চলেছি সেই পথই রাস্তা। তাওজিই আসলে পথপ্রদর্শকের ভূমিকায়। আগের থেকে গতিশীলতা একটু বেড়েছে। সূর্যের তাপ সহ্য করা যাচ্ছে না। ঘামে ভেতরের পোষাক ভিজে গেছে। এক একটা করে পোষাক খুলে ব্যাগের গায়ে ঝুলিয়ে পথ চলেছি। একেকটা পাহড় টপকে চলেছি। ছেলেবেলাতে পড়া ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের রচিত ‘কেদারনাথের পথে’র স্মৃতিচারণ করছি আর মনে মনে তৃপ্ত হচ্ছি এই ভেবে যে আমরাও সকলে চলেছি চড়াই উৎরাই পথ অতিক্রম করে। লেখাটিকে কল্পনায় যেভাবে এঁকেছিলাম ঠিক সেইরকমই অভিজ্ঞতা হচ্ছে। যদিও আমাদের অভিযান কেদারনাথ নয়, একেবারেই অন্যরকম। যাইহোক, ভাবলাম সম্পূর্ণ রাস্তাটাই খসখসে শুকনো পাবো। কিন্তু প্রকৃতি আর সঙ্গ দিল কৈ ?
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নেমে এল। ঠাণ্ডাটা বেড়ে গেল নিমেষেই। ব্যাগের সাইড পকেটে পঞ্চু রাখা ছিল, সেটা গলিয়ে নিলাম। হু হু করে পাহাড়ি বাতাস বইছে, যেন বরফের ছ্যাঁকা লাগছে। ক্ষণে ক্ষণে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ এসে ঢেকে ফেলছে পথঘাট, মেঘেদের চাদর কাটিয়ে চলেছি সকলে। দূরে যে সাদা তুলোর বিছানা দেখেছিলাম একে একে সেই বিছানা অতিক্রম করে রানিসুই হ্রদের কাছে পৌঁছাতে হবে। সাদা তুলোর কাছে আসতেই বুঝলাম যে পাহাড়ের গায়ে গায়ে ছোপ ছোপ বরফের স্তর জমে আছে, কোথাও দশ মিটার তো কোথাও বিশ ত্রিশ মিটার। এখানের সর্বত্রই বরফ ঢেকে ছিল। মে মাস থেকে বরফ গলা শুরু হয়ে যায়। যে স্থানে বরফের স্তরের গভীরতা বেশি ছিল সেই স্থান সম্পূর্ণ বরফ মুক্ত হতে পারেনি। সেকারণেই যত্রতত্র বরফের আস্তরণ। বৃষ্টি জিরিয়ে নিচ্ছে বোধহয়। কিছুপর দ্বিতীয় যে বরফের পথ পেলাম সেটা আনুমানিক দশ-বারো মিটার চওড়া হবে, লম্বায় ঠিক কতটা হবে তা আন্দাজ করা সম্ভব নয় যেহেতু বরফের আস্তরণ পাহাড়ের গা ঘেঁষে সোজা নীচে নেমে গেছে। দেখলেই গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। বরফের পথ অতিক্রমকালে যদি কেউ পা পিছলে ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলে তাহলে আর বলতে হবে না, পাহাড়ের ওপর কেন একেবারে ওপরে উঠে যাবে যে ! কাজেই বরফের পথ যেখানে ঢালু হয়ে নীচে নেমে গিয়েছে সেখানে প্রচণ্ড সাবধানতার সঙ্গে অতিক্রম করতে হবে। বুদ্ধিজি, মনোজ দা, আর আমি প্রথমে পৌঁছালাম। পেছন পেছন র্যাম্বো ভাই এবং তারপর আর. যে. ম্যাডাম। বুদ্ধিজি বলে দিলেন কিভাবে বরফের রাস্তা পেরোতে হয়। মাথায় একেবারে গেঁথে গেল বিষয়টা। এক অভিনব পদ্ধতিতে জুতো কাত করে আংটার মতো ব্যবহার করে খুবই সন্তর্পণে বরফের রাস্তা অতিক্রম করলাম, তারপর র্যাম্বো। যদিও সে পিছলে বরফেই আছড়ে পড়ে গেছিল। একইভাবে আর জে ম্যাডামও পিছলে ধপাস করে বসে পড়েছিল বরফের ওপর। আমি হাত ধরে র্যাম্বোকে, র্যাম্বো তাকে পার করে দিল। মনোজদা অনেক আগেই এসে পড়েছিল। বুদ্ধিজি রাস্তা দেখিয়ে দিলে আমাদের পিছু পিছু সেও এল। বরফের ওপর যেই পা টা রেখেছে মনোজদা, সড়্সড়্ সড়্সড়্ করে পিছলে আট থেকে দশ ফুট নীচে গড়িয়ে গেল। ভাগ্যিস হাতে আইস অ্যাক্স ছিল, সেটা দিয়ে কোনোমতে রেহাই পেয়ে গেল। তা নাহলে একেবারে খাতে গড়িয়ে পড়ত। একে একে বাকিরা এসে পৌঁছালে তাওজি এবং মনোজদা এসকট হিসাবে বাকিদের বরফের পথ অতিক্রম করাল।
ঢালু বরফের পথ অতিক্রম করে এক পাহাড় টপকে আরেক পাহাড়ে পৌঁছানো হল। সেখানে হরেকরকমের সবুঝ হলুদ গোলাপী লাল ঘাসজাতীয় ফুলে ভরে আছে। কি অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য। মুহূর্তেই ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্সের ছবি ভেসে আসল। মন চাইছে ছুট্টে গিয়ে তাদেরকে জড়িয়ে নিই। বুদ্ধিজির থেকে জানতে পারলাম এই ঘাসজাতীয় উদ্ভিদগুলি হিমালয়ের অহংকার, হিমালয়ের গৌরব। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসে এই সব উদ্ভিদ, ফুল, শেকড় ইত্যাদি সংগ্রহ করতে। বিজ্ঞানী থেকে গবেষক প্রায়ই সকলেই এইসব সংগ্রহ করে থাকেন। পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষদের জীবন দাঁড়িয়ে আছে এই গাছগাছড়ার ওপর। কবিরাজী চিকিৎসার প্রায় সম্পূর্ণ তারা এই পাহাড় থেকেই সংগ্রহ করে থাকেন। পথ চলা শুরু পুনরায়। অভিমুখ উপরের দিকে। আমি মনের হরষে হেলতে দুলতে উপরের দিকে উঠছি, হঠাৎ পাহাড়ের গায়ে শুকনো মরা ঘাস দেখে থ হয়ে গেলাম। সবুজ পাহাড়ে মরা ঘাস এল কিভাবে ! বুঝলাম বছরের বেশিরভাগসময়ই বরফ ঢেকে থাকে সেই কারণে বরফের নীচে ঘাসগুলি মরা মরা। খুব সম্ভবত সপ্তাখানেক হয়েছে হয়তো বরফ গলে আলগা হয়েছে ঘাসের স্তর।
মুহূর্তেই কে যেন সারা পাহাড় জুড়ে কুয়াশা ছড়িয়ে গেল। ঘন ভারী শীতল মেঘে ছেয়ে গেল। কিছুই দেখা যাচ্ছে না; না নীচে না ওপরে, না সামনে না পিছনে। বৃষ্টি এল বলে। মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল, ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। পুনরায় জ্যাকেট টা পরে নিলাম। পঞ্চুটা ব্যাগের সাইড পকেটেই ছিল, সেটাও গায়ে জড়িয়ে নিলাম। আর যাই হোক বৃষ্টি থেকে রক্ষে পেতে হবে, তা না হলে ট্রেকিং এর সমস্ত অ্যাডভেঞ্চার মাটি হয়ে যাবে। বৃষ্টির জল হাতে, চোখে-মুখে বরফের টুকরোর মতো ঠোকর মারছে। কয়েক মিনিট আগেই চারপাশের পাহাড়, গাছপালা কত হাস্যোজ্জ্বল লাগছিল, মেঘেদের অত্যাচারের কাছে তারা আর পেরে উঠল না। বৃষ্টিভেজা মাটির সোঁদা সোঁদা গন্ধের সাথে মেঘেদের বিবর্ণ গন্ধ মেখে এক অদ্ভুত সুন্দর অতিপ্রাকৃত গন্ধে পাহাড়ের সর্বত্র ম-ম করছিল। মাঝে মাঝে কচি আখরোটের গন্ধের সঙ্গে ফার গাছের সবুজ ঝাঁঝালো গন্ধ ভেসে আসছে। এই হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি তো এই ঝিরিঝিরি। ঘণ্টাখানেক এভাবেই চলছে বৃষ্টি। বৃষ্টিতেই চওড়া-দীর্ঘ বরফের পথ অতিক্রম করা চলছে। তাওজি এবং বুদ্ধজি এসকটের কাজ করছেন। মনোজ দা আইস কুঠার দিয়ে পথ বানিয়ে দিচ্ছে, বাকিরা সেই পথ অনুসরণ করছে। তবে, সকলেই একেবারে তেঁতে উঠেছে, মনে মনে বোধহয় বৃষ্টিকে চাইছেনা কেউই। অগত্যা পবনদেব ভক্তের কথা না শুনে আর থাকেন কি করে ! তিনি ঝোড়ো হাওয়া দিয়ে প্রথমে মেঘেদেরকে স্নানান্তরিত করলেন, বৃষ্টি থেমে গেল নিমেষেই। ঝলমলিয়ে রোদ উঠল। আগের থেকে তার তেজ দ্বিগুণ, শোভা মনোমুগ্ধকর, লাবণ্য অতুলনীয়, যেন সদ্য অন্ধকারের মধ্য থেকেই জন্ম নিয়েছে সমস্ত বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডকে তার রূপে দৃশ্যমান করতে। কতশত বছর ধরে এভাবেই হাজার হাজার পাহাড়ের সৌন্দার্য পরিপূর্ণ হচ্ছে সূর্যের লাবণ্য মেখে; সূর্যের কণা থেকে বিন্দু বিন্দু সোনা নিয়ে সোনালী হয়েছে রোদ, সোনালী হয়েছে পাহাড়; সূর্যের তেজ মেখে তেজস্বী হয়েছে বাতাস; —কেউ কি তার হিসেব রেখেছে কখনো।
শীতল ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে চলেছে অনবরত। কিছু পথ চলার পর গরমের পোষাক পরে পথ চলতে পারছি না। এক এক করে শীতের পোষাক খুলে ফেলতে হল। ঘামে ভিজে গিয়েছে ভেতরের পোষাকগুলো। তবে, তাপমাত্রা আন্দাজ মতো নয়-দশ ডিগ্রী হবে হয়তো, তথাপি একটি মাত্র টি-শার্ট গায়ে গলিয়ে দিব্যি পথ অতিক্রম করা যাচ্ছে। মনে মনে ভাবলাম আর বৃষ্টি আসবে না। বাকি পথ রোদের সাথে হেঁটে পৌঁছে যাব। চলতে চলতে পৌছালাম এক সাদা চাদরের মতো বিস্তির্ণ জায়গায়। রোদে আলোতে তাকে তুলোর বিছানা বললে নেহাত ভুল হবে না। কাছে পৌঁছতেই বুঝতে পারলাম বরফের পথ। পাহাড়ের ঢালে প্রায় নব্বই একশো মিটার লম্বা হয়ে পড়ে আছে বরফ, সেই দিকেই আমাদের গন্তব্য। তবে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেল বরফের গভীরতা কম করে তিন চার ফিটের মতো হবে, কোথাও কোথাও তার থেকে বেশিও হতে পারে। এরূপ পথ খুবই বিপজ্জনক। বুদ্ধিজি এক এক করে ঘোড়া ও খচ্চর কে পাঠিয়ে দিলেন সেই পথে। তাদের পথের চিহ্ন দেখে উপলব্ধি করা গেল যে কোনদিকে বরফ বেশি শক্ত হয়ে জমাট বেঁধে আছে আর কোনদিকে আলগা হয়ে আছে। বুদ্ধিজির দেওয়া কৌশল অবলম্বন করে সেই দিকেই এগোলাম। দিব্যই এগিয়ে যাচ্ছি, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। হঠাৎ কিংশুক দা, বাবাই দা আমাকে ঝেড়ে দিল, “তোমাকে বারণ করেছি নিজের ইচ্ছেমত বরফের ওপর দিয়ে যেতে। বেশি বাড়াবাড়ি কোরো না, হিরোগিরি বেরিয়ে যাবে।” অথচ ততক্ষণে আমি ধাতস্থ হয়ে গেছি বরফের ওপর দিয়ে পথ চলতে। আনন্দ করতে এসে এভাবে যে হিউমিলিয়েট হতে হবে ভাবিনি কখনো। সত্যি বলতে এমন হয়েছে যে প্রায় সকলেই বরফের পথ অতিক্রম করতে গিয়ে টলে পড়ে গিয়েছে বা পিছলে পড়েছে, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে একবারও এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি বলেই, আত্মবিশ্বাস প্রবল বেড়ে গিয়েছিল। এমনকি আমাদের সঙ্গে যে ডাক্তার ম্যাডাম ছিলেন তিনি তো সাংঘাতিক ভাবে পিছলে পড়ে যাচ্ছিলেন, বুদ্ধিজি এবং আমি দ্রুত সেই দিকেই ছুটে গেছিলাম, তাওজি অনতিদূরেই ছিল, সে যাত্রাই ম্যাডামকে পাকড়াও করতে পেরেছিলেন। ভয়ে সকলের গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছিল। যে মুহূর্তে তাওজি তাকে আটকাতে পেরেছিল তখন যেন ধড়ে প্রাণ পাই। যাইহোক বড়ো দাদা, তাছাড়া প্রো ট্রেকার বলে কথা, তাদের কথা না শুনলে হয়। কাজেই কারো মুখের ওপর তর্ক না করে বুদ্ধিজির সাথে পা মিলিয়ে এগিয়ে গেলাম।
রানিসুই হ্রদকে পিছনে ফেলে সামনের দিকে হেঁটে চলেছি। সঙ্গে রাখা জল শেষ হয়েছে অনেক আগেই। বুদ্ধিজিকে জিজ্ঞেস করলাম, “বুদ্ধিজি লেক কে পানি পিনে কা লায়েক হ্যায়?” বুদ্ধিজি বললেন, “ইধর যাহা যাহা পানি মিলে সব শুদ্ধ পানি হি হ্যায়। বরফ্ পিঘলকে জমীনকে তরফ বহে গয়ে। নীচে গাঁওকি লোক এই পানি পিতে হ্যায়। আপ আঁখ বন্ধ করকে পি লো, জিতনা চায়ে পি লো। ইস তরফ শুদ্ধ পানি অউর কহি নহি মিলেগি।” মনের আনন্দে হাতের কোশে করে রানিসুই হ্রদের জল পান করে পিপাসা মিটিয়ে আবার পথ চলতে শুরু করলাম। সামনেই একটা ছোট্ট ঢিবির মতো জায়গা দেখা যাচ্ছে, সেখানেই তাঁবু ফেলতে হবে। বুদ্ধিজি ঝড়ের গতিতে হেঁটে চলেছেন তার পিছনে আমি, আমার পিছনে মনোজ দা, দেবব্রত দা, অনিরুদ্ধ দা এবং বাকিরা। ঢিবিটা দেখে মনে হচ্ছে এই তো একটুখানি রাস্তা বাকি একছুটে পৌঁছে যাব। কিন্তু মিনিট দুয়েক ছোটার পর গলা শুকিয়ে এল। মনে পড়ে গেল ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্সে ঘটে যাওয়া কাণ্ডের কথা। কাজেই সে ভুল দ্বিতীয়বার করলে চলবে না। পায়ের গতি কমিয়ে কোনোক্রমে ঢিবিটার কাছে পৌঁছতেই দেখতে পেলাম বরফের বিছানার তলা দিয়ে স্বচ্ছ কা৬চের মতো জল সশব্দে নীচের দিকে বয়ে গেছে ঝরনার হয়ে। লোভ সামলাতে পারলাম না, সেই ঝরনার জলে চুমুক লাগিয়ে আবার জল খেলাম কিছু মুহূর্তকে মুঠোফোনে বন্দি করে নিলাম। চোখে পড়ল সামনেই এক তাঁবু, ঐদিকে এগোতে যাব দেখি এক সাধুবাবা সেই তাঁবু থেকে বাইরে বের হলেন। বুদ্ধিজি তাঁর সাথে হিমাচলি ভাষায় কিছু আলাপ সেরে নিলেন। অঙ্গভঙ্গিতে বুঝলাম ভালোমন্দের শুভেচ্ছা বার্তা জ্ঞাপন করে তাঁর এখানে থাকার কারণ জানতে চাইলেন বুদ্ধিজি। তিনি উত্তর দিলেন জড়িবুটি, গাছগাছড়া ওষুধ সংগ্রহ করতে এসেছেন। আমার মতো বুদ্ধিজিরো প্রথমে ভ্রম হয়েছিল যে সেটাই আমাদের আশ্রয়স্থল। ঐ ঢিবির পাশেই আর একটি ঢিবি ছিল। দুইয়ের মিলনস্থলে এক বরফের বিছানা যার নীচে বরফ গলে গিয়ে সশব্দে ঝরনা ধারণ করে নিম্নে প্রবাহিত হয়ে গিয়েছে। চট্টান পার হয়ে ঢিবির কাছে যেতেই দেখি সুরেশ জি ঘোড়া খচ্চর নিয়ে আমাদের আগেই পৌঁছে গিয়েছে। মালপত্র আলগা করার কাজ চলছে। মনোজ দা পৌঁছানোর সাথে সাথে দুজনে তাঁবু খাটাতে লাগলাম। সন্দীপনও হাতাহাতি করে এগিয়ে আসল। একে একে বাকিরাও আসল। তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রী থেকে ৫/৬ ডিগ্রী হবে। বাইরে বেশিক্ষণ থাকলে ঠাণ্ডাতে সমস্যা হয়ে যেতে পারে। সেজন্য সকলকে অনুরোধ করা হল তারা যেন তাঁবুর ভেতর থেকে বাইরে না বেরোয়। ফোন অনেক আগেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে। এদিকে ঘড়িতে চার্জ দিতে ভুলে গেছিলাম কাজেই সময় তখন দুপুর আন্দাজ মতো দুটো-আড়াইটে বা তিনিটা হবে। কিন্তু চারিদিকে গাড় মেঘ এমন ভাবে ঢেকে রেখেছে যেন ভোর ভোর অনুভূত হচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে তেরহাজার ফুটেরও বেশি ওপরে। সামিট থেকে মাত্র আধা ঘণ্টার পথ। কিন্তু সেখানে জল পাওয়া যাবে না বলে এখানেই এই ঢিবির ওপর আশ্রয়স্থল।
একদিকে রান্নার আয়জন চলছে অন্যদিকে কিংশুক দা, বাবাই দা ও মনোজ দা- মিলে মানালি পাস পাসের কাছে অন্তিম গন্তব্যস্থল খানপাড়ি ডিব্বা ভ্রমণ করে দেখতে গেল সেখানকার অবস্থা কেমন, কতটা বরফ জমে আছে ইত্যাদি। এদিকে প্রবল বেঘে শীতল বাতাস বইছে। সকলে দুটো তিনটে যে যেকটা পারছে গরমের পোষাক চাপিয়ে ঠাণ্ডাতে কাঁপছে। যেখানে তাঁবু ফেলা হয়েছে তার দুদিকেই দুট বরফের বিছানা পাতা আছে। তা থেকে ধোঁয়ার মত জলীয়বাষ্প ওপরের দিকে নির্গত হচ্ছে। দেখতে দেখতে চা পকোড়া চলে এল। খানিক পর সূয্যিমামা টুঁকি দিয়ে ঝলমলিয়ে তাকাল। বাইরে খোলা আকাশের নীচে বসে খাওয়া চলছে, গল্পগাছা চলছে। এভাবে প্রায় আধাঘণ্টা কেটে গেল, কিন্তু না কিংশুক দা, না মনোজ দা-য়েরা এসে পৌঁছাল। চারিদিকে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেল
ষষ্ঠ পর্ব
পথ হারিয়ে ব্রানফার্ট
মনে মনে ভাবছি যে বিপদ হল নাকি কোনো। না, সেরকম কিছু নয়। আরো কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর দেখলাম দূরে সামনের টিলাটার আড়াল থেকে কিছু গোলাকার বস্তু নড়াচড়া করছে। কিছুটা সামনে আসতেই মনে হল যেন মনোজদায়েরা ফিরে আসছে। কিন্তু ভালো করে ঠাওর করবার আগে উড়ো মেঘ কোথা থেকে ক্ষিপ্রবেগে এসে সর্বত্র ঢেকে ফেলল। বাইরে বসে চা আর পকোড়া সহযোগে চারপাশের বরফে ঢাকা ভূস্বর্গের সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। হঠাৎ করে তাতে ব্যাঘাত ঘটিয়ে দিল উটকো মেঘ। বিন্দু বিন্দু জলকণা ঝির ঝির করে ঝরে পড়ছে। দুতিন চাপান শীতের পোষাক পরেও খুব শীত করছে। অগত্যা খাবারের প্লেট নিয়ে তাঁবুর মধ্যে ঢুকে গেলাম। মিনিট দশ পনের বাদে মেঘ দূরীভূত হলে আবার সূর্য্যী মামা মৃদু হাসি মুখে আবির্ভূত। পুনরায় বাইরে গিয়ে বসি। এতক্ষণ পর টীলার পেছনের ছায়া স্পষ্ট হয়। কিংশুকদাদারা নিজেদের মধ্যে কিছু গভীর বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে করতে তাঁবুর দিকেই ফিরছে। জানতে পারলাম যে মানালি পাসের কাছে বরফের স্তর এত পুরু হয়ে জমে আছে যে সেপথে আরোহণ করে হিড়িম্বা টেম্পলের দিকে গমন করা বিপজ্জনক। ফেরার অন্য কোনো পথ আবিষ্কার করতে হবে।
র্যাম্বোর ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম সময় সাড়ে সাতটা। মজার বিষয় তখনও সম্পূর্ণরূপে দিনের আলো বিরাজমান। মনের অজান্তেই দূরে পরিষ্কার নীল আকাশের পানে তাকিয়ে তৃপ্তি বোধ করছি আর ভাবছি কাশ মা-বাবাকে ভিডিও কল করে যদি এই অপরূপ দৃশ্য দেখাতে পারতাম ! কে জানে বাড়িতে ততক্ষণে সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হব হব। কারণ, জুন মাসে সন্ধ্যে নামে ছয়টা-সাড়ে ছয়টার মধ্যেই। পাহাড়বাসিদের কাছে খুব ভোরেই যেমন সকাল হয়ে যায় তেমনি খুব তাড়াতাড়ি রাত আসে না। এখানে আটটার আগে সন্ধ্যে নামে না। যাইহোক, দুদিন আগেই ফোন বাবাজী দেহত্যাগ করেছে। তাকে পুণরায় জীবিত করবার চেষ্টা যে করিনি তা কিন্তু নয়। কিন্তু কয়েকজনের কাছে পাওয়ার ব্যাঙ্ক থাকলেও তারা কাউকে দিতে নারাজ। আমি তো সরল মনে একজনকে বলে তৎক্ষণাৎ প্রত্যক্ষিত হয়ে যথেষ্ট লজ্জা বোধ করেছি। আর সত্যিই তো কেন দেবে তারা? বাড়িতে টেবিলে পাওয়ার ব্যাঙ্কটাকে অগ্রাহ্য করে ফেলে এসেছি। কাজেই ভুগতে তো হবেই আমাকে। র্যাম্বোর পাওয়ার ব্যাঙ্কে প্রথম দিনই চার্জ করেছিলাম। সে তাকে এত অপব্যবহার করেছে, সেটাও গতরাত্রে দেহত্যাগ করেছে মাইলিথালের তাঁবুতে।
একদিকে কিচেন টেন্টে খাবারের আয়োজন চলছে, প্রায় সকলেই উত্তাপের লোভে সেখানে আসন গেঁড়ে বসেছে, অন্যদিকে ঐ দুর্গম স্থানে যেখানে ধারেকাছে কোনো গাছেদের দেখা নেই সেখনে সুরেশ জী এক পাঁজা জুনিফার গাছ উপড়ে এনে বনফায়ারের আয়োজন করছেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “সুরেশ জী আপ ইতনা ফায়ারউড কাহা সে লায়ে, আসপাস তো অ্যাইসা কুছ দিখাই নহি দে রহা হ্যায়?” সুরেশ জী হাসতে হাসতে উত্তর করল, “বগলকে পাহাড়সে লায়া স্যার। সুখা নহি। আগে কাচ্চা-সুখা জো মিলা উখড়কে লে আয়া।” এই প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় এতটা পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে তিনি পাশের পাহাড় থেকে মাথায় করে এক বোজা জুনিফার গাছ উপড়ে এনেছেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান বেড়ে গেল। তিনি একটা কুলাহড়ি দিয়ে বনগাছগুলোকে ছোটো ছোটো করে কাটতে লাগলেন। দেখে মনে মনে কষ্ট হল, আমি বললাম, “মেরেকো দিজিয়ে ম্যায় ভি থোড়া প্রয়াস করে।” তিনি সেই আগের মতো হাসি দিয়ে বললেন, “স্যার, আপসে নহি হো পায়েগা। বহত হার্ড চিজ হ্যায় এ। দেখনে মে লাগ সকতা হ্যায় বহত আসানিসে আপ কর লোগে, লেকিন কাচ্চা জুনিফারকা ঝাড়ি একদম আমরুদ পেড় সে ভি য়াদা শক্ত হ্যায়।” আমি কিছু না বলে তাঁর হাত থেকে কুঠারটা কেড়ে নিয়ে জুনিফারের জঙ্গলগুলোকে কাটতে লাগলাম। মিনিট দশ পনের করার পর বুঝলাম হাতে ফোসকা পড়েছে, সত্যিই গাছগুলো খুবই শক্ত। তাদেরকে টুকরো টুকরো করতে যথেষ্ট কায়িক পরিশ্রম করতে হল।
পরদিন খুব ভোরে দিনের আলো উঁকি মারতেই ঘুম ভেঙে গেল, সতেজ শীতল পাহাড়ি বাতাসের গন্ধে আমাদের তাঁবুটা ভরে উঠলে আর শুয়ে থাকতে পারলাম না। ঠাণ্ডার ভয়ে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যেই শুয়ে শুয়ে আধো আলো আধো ছায়াময় তাঁবুর পৃথিবীর সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। উঠে পড়লাম, ঝটপট চোখেমুখে বরফগলা জলের ঝাপটা দিয়ে গরমের পোশাক জড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে পড়লাম। কনকনে বাতাস ছুটে এসে নাকে ধাক্কা মারতেই লাগাতার হাঁচি দিতে শুরু করলো। নাকাল হয়ে একটা গ্লাস নিয়ে ছুটে গেলাম রান্নার তাঁবুটার কাছে। বুদ্ধিজি চা খেতে খেতে বলল, “আপ তুরন্ত চা পি লিজিয়ে, দাবাই কা কাম করেনা।” গ্লাসটা বাড়িয়ে চা নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরলাম। সন্দীপণ ডাক দিল যাত্রা শুরু করা হবে। তড়িঘড়ি ফিরে এসে গোগ্রাসে দুটো রুটি আর সব্জী সাঁটিয়ে নিলাম।
তারপর মনোজদা আর আমি তাঁবুগুলো খুলে ফেললাম। সকাল ৮ টার মধ্যেই মানালি পাস পাসের কাছে খানপাড়ি ডিব্বা পৌঁছে আবার ফিরে আসতে হবে। যাত্রা শুরু হয়ে গেল ঘড়িতে তখন কাঁটায় কাঁটায় ছয়টা বাজে। রাস্তা তেমন দুর্গম নয়। তবে মাঝে মাঝে বরফের রাস্তা যেগুলো পেরোতে বেশ কিছু জনকে নাজেহাল হতে হচ্ছে। কয়েকজন তো পিছলে গিয়ে বরফ কাপড়ে চোপড়ে করে ফেলছে। এদিকে দ্রুত পথ অতিক্রম করার জো নেই, নইলে আবার পেছন থেকে শব্দবাণ ছুটে আসবে “হিরোগিরি করতে এসো না, এটা পাহাড়”। যাহ সালা ! মুক্তি আজাদি স্বাধীনতার খোঁজে পাহাড়ে এসেছি সেখানে কাটি করার মত লোক থাকবে, তা কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি। যাই হোক, অগত্যা কি আর করার, ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছি পাহাড়ের চূড়ার দিকে। যত উপরের দিকে এগোচ্ছি তত দৃষ্টি পথের বাধা দূরীভূত হতে থাকছে।
একটু একটু করে পাহাড়ের চূড়া অর্থাৎ খানপাড়ী ডিব্বার দিকে অগ্রসর হচ্ছি পৃথিবীকে যেন নিচের দিকে যেতে দেখছি। প্রকট হচ্ছে চারপাশের পীরপাঞ্জল পর্বতমালার পর্বতসকল সব একটু একটু করে উন্মোচিত হচ্ছে। আবেগে আপ্লুত হয়ে পাগলের মতো ছুটছি একবার এদিকে তো একবার ওদিকে। কি অপরূপ দৃশ্য। ছবির বইয়ের দেখা দৃশ্যগুলো চোখের সামনে এত জীবন্ত এত প্রাণবন্ত যে মনে হচ্ছে এখনো স্বপ্নের জগতে। পাহাড়ের গায়ে বরফ আলগা হয়ে শুকনো মরা ঘাসগুলো একটু একটু করে জিইয়ে উঠছে। যত্র তত্র হীরের মতো স্বচ্ছ শুভ্র পাথরের টুকরো গুলো ছড়িয়ে। তাদের কিছু কিছু দুহাতে কুড়িয়ে ব্যাগের সাইড পকেট ভর্তি করছি।
সকালে রোদ্রের তেজ জোরালো না থাকায় হাঁটতে বেশি পরিশ্রম বোধ হচ্ছে না। মানালি পাসের কাছে পৌঁছাতেই সামনে পিছনের সব আবরণ আলগা হয়ে পৃথিবীর সৌন্দর্য বেরিয়ে এলে। মনে হল যেন বিরাট এক গুপ্তধনের হদিস পেয়ে গেলাম। একদম নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে কিন্তু মনটা যেন এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। আটকে রাখতে পারছি না তাকে। আর মিনিট পাঁচেক এগোলেই চূড়ায় পৌঁছে যাব। অবশেষে পাহাড়ের একদম টপে উঠে পতাকা উত্তোলন হল, ছবি তোলা হল।
প্রত্যেকটা পাথরের ঢিবির কাছে গিয়ে ভারী ভারী একটা করে পাথর চাপিয়ে দিচ্ছি আর পাগলের মতো ছুটছি। সন্দীপণ মুঠোফোনে বন্দী করে চলছে সেই দৃশ্য। খানপাড়ি ডিব্বা থেকে থ্রী সিক্সটি ভিউ পাওয়া যায়। ডাইনে বামে যেদিকে তাকাই সেদিকেই যেন কেউ রঙ তুলি দিয়ে ধূসর শুভ্র বরফের পাহাড় এঁকে দিয়ে চলে গেছে। কোনোদিনই ভাবিনি এই অবিস্মরণীয় মুহূর্তের সাক্ষী হতে পারব। গতবছর হেমকুণ্ড অভিযানে গিয়ে ঠিক এমন অনুভূতি হয়েছিল। তবে সেখানে সামিটের কোনো ব্যাপার ছিল না, পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছানোর কোনো পরিকল্পনা ছিল না, হেমকুণ্ডের গুরুদ্বারাতে পৌঁছে বরফগলা জলে স্নান করে প্রার্থনা করেই ফিরে এসেছিলাম। তবে, পাহাড়ের সৌন্দর্যের সর্বশেষ পর্যায় বোধহয় একবারে চূড়ায় পৌঁছে থ্রী সিক্সটি ভিউ পাওয়া। যেদিকে তাকায় তীরের ফলার মতো পর্বতের মাথাগুলো নীলাকাশ ভেদ করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে তাদের শ্বেতশুভ্র চাদর জড়ানো। এত অপূর্ব এত মনমুগ্ধকর সে অভিজ্ঞতা কখনো ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। প্রত্যেকেই এত খুশি এত আনন্দিত যেন পাহাড়ও সেই আনন্দের সাক্ষী হতে তার শোভা বর্ধন করে যাচ্ছে। একটু একটু করে সেও যেন সতেজ প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে।
বাকিরা সকলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে কেউ রিলস্ বানাচ্ছে বরফের ওপর তো কেউ ভিডিও করছে। কেউ কেউ আবার ভিডিও কল করে আত্মীয় পরিজনের সাথে খুশির মুহুর্ত ভাগ করে নিচ্ছে। কিংশুক দাদা ডাক দিল সবাইকে নামতে হবে। মানালি পাস পাসের কাছে বরফের এত পুরু আস্তরণ জমে গেছে যে ঐ পথে নামতে গেলে একটা কিছু অঘটন ঘটে গেলে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। তাই রে পথে অবরোহন করেছিলাম সেই পথেই আরোহন করতে হবে। সকলে নীচের দিকে নামতে শুরু করেছে।
ভাবতেই মনে মনে খুব কষ্ট হল। কাশ আমার ফোনটা জীবিত থাকলে বাবা মাকে ভিডিও কল করে দেখাতে পারতাম। হঠাৎ কি মনে হল এক ছুটে একটু উপরে উঠে ফোনটা বের করে অন করলাম অন হয়ে আবার অফ হয়ে গেল। দ্বিতীয়বার চেষ্টা করলাম ফোন রেড সিগন্যাল দিয়ে ১ পার্সেন্ট চার্জ দেখালো। এদিকে নীচে থেকে ডাক আসছে “এই চলো চলো সবাই জোরে পা চালিয়ে চলো।” আমি ১ পার্সেন্ট চার্জ নিয়ে ভিডিও কল করে বাবা মাকে সেই অপরূপ সৌন্দর্য শেয়ার করলাম। বাব-মা একসাথেই আগ্রহ সহকারে দেখল। তারাও ভীষণ খুশি হল।২০-৩০ সেকেণ্ডের মধ্যেই ভিডিও কল হতে হতে অফ হয়ে গেল। তবুও এক অপার ত তৃপ্তিবোধ করলাম। মনে হল যেন মানালি পাস সামিট এইবার সম্পূর্ণ হল। কয়েক মুহূর্তে জন্য জীবনের সার্থকতা অনুভব করলাম।
যে পথে এসেছিলাম ঠিক সেই পথেই নীচের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। বুদ্ধিজিকে শুধিয়ে জানতে পারলাম মাইলি থাল পৌঁছে রাস্তা পরিবর্তন করে একেবারে সরাসরি খাড়াইভাবে মানালি শহরে নামা হবে। তবে একদিনে হবে বলে তো মনে হয় না, প্রয়োজনে একটা রাত জঙ্গলে কাটাতে হতে পারে। একদিনে ১৪০০০ ফুট নীচে আরোহণ করা যে একেবারে অসম্ভব তা ঠিক নয়, তবে আমাদের লোকাল রাস্তা জানাও নেই, তাছাড়া একই গতিতে সকলের পক্ষে নামা সম্ভব ও নয়। তবে, ওঠার সময় সময় ও কায়িক শক্তি অত্যাধিক ব্যায় করতে হয়েছিল। নামার ক্ষেত্রে সেটা আর নেই। কম সময় দ্রুত আরোহণ সম্ভব। তবে, খেয়াল রাখতে হয় রে হাঁটতে বা পায়ের গোড়ালিতে যেন কোনো আঘাত না হয়। সকলে সারি সারি লাইন ধরে চলছি সেই একই পথে। রানিসুই লেককে পিছনে ফেলে ঘণ্টা তিনেক বা তারও একটু বেশির মধ্যেই পৌঁছে গেলাম মাইলি থাল। আবহাওয়া একদম পারফেক্ট। মেঘে ঢাকা। রোদ্দুরের তেজ মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে। রোদ্দুর থাকলে কম সময়ে বেশি পথ অতিক্রম করা সম্ভব হবে না, ডি-হাইড্রেশনও হতে পারে।
মাইলি থালে পৌঁছে একটু বিশ্রাম নিয়ে উত্তর পশ্চিমে রাস্তা ধরা হল এবং সেই দিকেই অগ্রসর হয়ে চলেছে সকলে। কম করে আরো ১০০০-২০০০ ফিট চলার পর খাড়াই একটি পাহাড়ের কাছে এসে তাওজি বুদ্ধিজি সকলে থেমে গেল। আমরাও সেখানে গিয়ে বসে পড়লাম। বুঝলাম রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছে শেরপা। বুদ্ধিজি কিংশুক দাদাকে বলল “কিংশুক সায়াদ হামলোক গলদ রাস্তা পকড় লিয়া। ফিরসে ওপাস জানা পড়েগা সায়দ। চল দুসরে জঙ্গলকে রাস্তা ধুন্ডকে যাতে হ্যায়।” ওখানে সকলে মিনিট দশেকের জন্য বসে পড়ল। এদিকে সন্দীপণ আর চলতে পারছে না। ছেলেকে বললাম তোমার ব্যাগটা আমাকে দাও। সে লজ্জায় বোধহয় আমাকে অবজ্ঞা করে বলল। না না ঠিক আছে তবে দ্রুত হাঁটতে পারছে না। পিঠে ব্যাগ নিয়ে একেবারে ঘেমে নেয়ে স্নান হয়ে গেছে। সকলেই পিঠে ব্যাগ নিয়ে অবরোহণ আরোহণ করছি। তাই ঘর্মাক্ত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। সন্দীপণের শারীরিক অবস্থা নিয়ে বেশি মাথা ঘামালাম না সেকারণে। তাওজি নতুন রাস্তা খুঁজে সকলকে সে পথ অনুসরণ করতে বললেন। আমি মধ্যমণি হয়ে চলছি। জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করতেই ঘন গাঢ় অন্ধকার ছেয়ে এল। সেখানে দিনের আলো প্রবেশ করতে পারে না। এক হাঁটু শুকনো পাতার সমুদ্র সেখানে। তবে সেখানে প্রচুর বন্য স্ট্রবেরী ফলের গাছ ছিল। পথের দুধারে হাজার হাজার লাল হলুদ পাকা পাকা বন্য স্ট্রবেরী, মালবেরী ফলে আছে। বুদ্ধিজিকে জিজ্ঞেস করলাম, “বুদ্ধিজি এ ফল হাম খা সকতে হ্যায়? দেখনে মে তো আচ্ছা স্বদেষ্ট লাগতা হ্যায়। “বুদ্ধিজি একটা পাকা ফল তুলে নিয়ে মুখে দিয়ে বলল, “জি জি এ ফল বহুত স্বদেষ্ট হ্যায়। আপ বিলকুল খা সকতে হো। লেকিন জ্যাদা খা লোগে তো পেট কা প্রবলেম আ সকতা হ্যায়।” বুদ্ধিজির কথা শেষ হওয়ার আগেই দুহাতে যেদিকে যত পাকা টকটকে লাল, হলুদ বন্য স্ট্রবেরী, মালবেরী তোলা যায় তুলেই সরাসরি মখে পুরে দিচ্ছি। ধোয়ার কোনো গল্প নেই। ছেলেবেলার স্মৃতি ভেসে আসছে, জঙলি ফলগুলো খেয়ে এক অপার তৃপ্তি বোধ করছি। আমার দেখা দেখি কয়েকজন পাকা রসালো ফল ছিঁড়তে শুরু করে দিল।
জঙ্গলের পথ পেরিয়ে এক বিশাল ঢিবির সামনে এসে একটু থেমে গেলাম। বৃষ্টি বাবাজীবন আর থাকতে পারল না, হুড়মুড়িয়ে নেমে এল। পঞ্চুটাকে খুলে ঝেড়ে নিয়ে গায়ে চপিয়ে দিলাম, দু এক পা যেতে না যেতে বৃষ্টি থেমে গেল। আবার তাকে ব্যাগে পুরে নিলাম। পথচলা শুরু হল আবার। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে অনেক নীচে একটা ঘন জঙ্গল একেবারে সোজা নীচে নেমে গেছে। পাইন, ফার, সিডার, স্প্রুস গাছের বিশাল সারি, মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে যুগ যুগ ধরে। সম্ভবত সেই জঙ্গলেই প্রবেশ করতে হবে। তাতেই ঘোর অনর্থ হল। জঙ্গলের মধ্যে কিছুটা পথ আরোহণ করার পর, পথভ্রান্ত হলাম। কিছুপর একে একে সকলে একত্রিত হলে বুদ্ধিজি কিংশুক দাদার সাথে কিছু একটা পরামর্শ করল এবং সকলকে বলল যে রাস্তা গুলিয়ে গেছে নীচে কোথাও ভালো একটা জায়গা পেলে সেখানেই তাঁবু খাটানো হবে। আজ কোনোভাবেই একেবারে নীচে নামা সম্ভব হবে না। অগত্যা কি আর করা যাবে। এদিকে জঙ্গলের খাড়া পথে আরোহণ করে সন্দীপণের অবস্থা কাহিল। সে না পারছে অবরোহণ করতে না পারছে আরোহণ করতে। নীচে নামার সময় কোনোভাবে তাঁর পায়ের মাংসপেশিতে খিঁচ ধরেছে, হাঁটুতে খুব আঘাত পেয়েছে বেচারা। বাবাইদা নীজের বোঝাটা খচ্চরের পীঠে চাপিয়ে সন্দীপণের লাগেজটা নিয়েছে। সন্দীপণ কখোনো বাবাইদায়ের হাত ধরে নামছে তো কখোনো কিংশুকদায়ের। সকলে ভীষণ চিন্তিত। বেচারা নীচে পৌঁছাতে পারবে তো।
ঘণ্টা দুয়েক অতিবাহিত হল। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। শুকনো খাবার শেষ হয়ে গেছে। সকলেই খুব ক্ষুধার্ত। কাছাকাছি জলের সন্ধান চলছে। জল পেয়ে গেলেই সেখানে তাঁবু গাঢ়া হবে। কিছু পর একটি জায়গা পাওয়া গেল, বড়ো বড়ো পাহাড়ি বনগাছে ভর্তি, কাছেই ঝরনার জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। এর থেকে ভালো জায়গা হয়তো আর পাওয়া যাবে না ভেবে সেখানেই তাঁবু লাগানো হল। তাওজিকে জিজ্ঞেস করে জানলাম জায়গাটা ব্রানফার্ট নামে পরিচিত। সেখানে কিছুটা জায়গা বিরাট বিরাট সাদা সাদা পাথরের ঢাকা। সেকারণে কেউ কেউ এই জায়গাটাকে দুদুপাত্থর বলেও অভিহিত করে থাকে।
জঙ্গল পরিষ্কার করে ব্রানফার্টেই রাত্রিযাপনের আয়োজন করা হল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বুদ্ধিজি পিঁয়াজি আর আলুর পকোড়া সহযোগে চামুড়ি পরিবেশন করল। খেতে খেতেই আশেপাশে ঘোরা হল। পাশেই একটু নীচে দুটো তাঁবু ফেলা, বুদ্ধিজির চেনা লোক। গোরু মহিষ চড়াতে এসেছিলেন। ঐদিন বকরিঈদ, কিছু গবাদিপশু সরবরাহ দিতে হবে বলে কয়েকদিন ধরে সপরিবারে সেখানে থাকছেন ভদ্রলোক। আমাদের দেখতে পেয়ে নিজেই আলাপ করতে চলে আসলেন। খুব রসিক মানুষ। গায়ে প্রচণ্ড জোর, প্রচুর পরিশ্রম করেন। রোজ প্রায় পাহাড়ের ওপরে ওঠেন এবং নামেনও। গল্প করে খুশী হয়ে যাবার সময় সকলকে নেমন্তন্ন করে গেলেন। খাঁটি দুধের চা খাওয়াবেন সকলকে। কয়েকজন তো চায়ের সাথে ভেড়ার মাংস খাবার লোভে ঘণ্টাখানেক পরেই ভদ্রলোকের তাঁবুতে হাজির হল, কিন্তু মুখটা বেজায় করে, চা খেয়েই তাদেরকে ফিরে আসতে হল। শুনলাম ভদ্রলোক কতকগুলো ভেড়া-ছাগল ভাগিয়েছেন ঠিকই কিন্তু কিছু মাংস রেখে বাকি নীচে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
ক্যাম্পফায়ারের ব্যবস্থা চলছে। হাতাহাতি করে কিছু শুকনো কাঠ কাটলাম। খুব ক্লান্ত লাগছে। মনে মনে ভাবছি কখন যে রাতের খাবার খেয়ে স্লিপিং ব্যাগে গ্যারেজ হয়ে যাব। অনিরুদ্ধদাদার সাথে বেশ জমিয়ে গল্প করার অবসর পেয়ে গেলাম। অনেক কথোপকথন হল। হাড় হিম করা ঠাণ্ডা না পড়লেও আন্দাজ মতো ৮ থেকে ৯ ডিগ্রী তো হবেই। হু হু করে শীতল বাতাস বইছে। বনফায়ারের কাছে বসে আগুন পোহাচ্ছি। তাওজি, রমেশজি হিন্দি হিমাচলি মিশিয়ে নানা কাহিনি শোনাচ্ছেন। সে এক স্বর্গীয় অনুভূতি, এক মায়াবী সুন্দর রাত। সারাদিন যাত্রা করে অবসাদের কোনো লেশমাত্র নেই। কে জানে যখন ব্যস্ত শহরের ভীড়ে হারিয়ে যাব, এই স্মৃতিচারণ করে পুণঃ পুণঃ ফিরে আসবো মানলি পাসে, ফিরে আসবো রানিসুই লেকে অথবা ফিরে আসবো ব্রানফার্টে। সাড়ে আটটা নটা নাগাদ রাতের খাবার খেয়ে নিদ্রা মগ্ন হলাম। পরদিন নীচে ফিরতে হবে। বুদ্ধিজির স্ত্রী আমাদের জন্য দেশি পাঁঠার মাংসের ঝোল রান্না করে বসে থাকবেন। কব্জী ডুবিয়ে তৃপ্তি করে খাবো।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)