সুদীপ ঘোষাল

মহাকবি কাশীরামদাস

কাশীরাম দাসের মহাভারত মূল মহাকাব্যের আক্ষরিক অনুবাদ নয়, ভাবানুবাদ। তিনিও কৃত্তিবাস ওঝা এবং মালাধর বসু’র মতো মূল গ্রন্থের কাহিনী বর্জন বা অন্য গ্রন্থ থেকে কাহিনী সংযোজন করেছেন। মহাভারতের ভীষ্ম পর্বের গীতা পর্বাধ্যায়সহ অনেক গুরুগম্ভীর দার্শনিক আলোচনা তিনি বাদ দিয়েছেন। আবার শ্রীবৎস চিন্তা, সুভদ্রা হরণের মতো বাঙালি-মানসের উপযোগী নানা কাহিনী অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ থেকে সংযোজন করেছেন। আসলে, মহাভারতের মূলানুগ অনুবাদ নয়, কবির উদ্দেশ্য ছিল মহাভারতের নীতিকথাগুলি বাঙালি সমাজে প্রচার করা। মহাভারতে সংসার জীবন, সত্যপালন, ন্যায়ধর্মাচরণ, বীরত্ব, সতীত্ব, সত্যনিষ্ঠা, ঈশ্বরভক্তি, ধার্মিকতা, উদারতা, আত্মবিসর্জন প্রভৃতি যেসব সদগুণের কথা বলা হয়েছে এবং যা হিন্দুধর্মের মূল ভিত্তি, তা-র প্রচারই মহাভারত অনুবাদের মাধ্যমে করতে চেয়েছিলেন কাশীরাম দাস।

কাশীরাম দাস বর্ধমানের ইন্দ্রাণী পরগণার অন্তর্গত সিঙ্গি গ্রামে এক বৈষ্ণব কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এ গ্রাম এখনও আছে এবং এই গ্রামে কাশিরামের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলি আজও বর্তমান। তাঁরা দেব উপাধিধারী কায়স্থ।তাঁর পিতার নাম ছিল কমলাকান্ত। কবিরা ছিলেন তিন ভাই—কৃষ্ণরাম, কাশীরাম ও গদাধর।তারা প্রত্যেকেই ছিলেন কবি।অগ্রজ কৃষ্ণদাস শ্রীকৃষ্ণবিজয় এবং শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণ অনুসরণে শ্রীকৃষ্ণবিলাস নামে কাব্য লেখেন। অনুজ গদাধর লিখেছিলেন জগন্নাথমঙ্গল বা জগৎমঙ্গল কাব্য। গদাধরের জগৎমঙ্গল কাব্যে এই বর্ণনার অনুরূপ উল্লেখ আছে। কবির অনুজ গদাধরের পুত্রের নাম নন্দরাম দাস। কাশীরাম বেদব্যাস বিরচিত সংস্কৃত মহাকাব্য মহাভারত অবলম্বনে লেখেন ভারত-পাঁচালী।কাশীরাম দাস সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন।তিনি অধুনা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার আবাসগড় বা আসিগড় বা আওসগড়ের জমিদার বাড়ির আশ্রয়ে থেকে শিক্ষকতা করতেন।কথিত আছে, উক্ত জমিদার বাড়িতে কথক ও সংস্কৃত পণ্ডিতদের মুখে মহাভারতের কাহিনী শুনে তিনি বাংলা ভাষায় মহাভারত অনুবাদে উদ্বুদ্ধ হন। গবেষকদের অনুমান, ভারত-পাঁচালী রচনা সমাপ্ত হয়েছিল ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে কিংবা সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। তাদের আরও অনুমান, কাশীরাম দাস সম্পূর্ণ মহাভারত অনুবাদ করে যেতে পারেননি। আদি, সভা, বন ও বিরাট – এই চার পর্ব অনুবাদের পর তাঁর মৃত্যু হলে তাঁর জামাই অবশিষ্টাংশ অনুবাদ করেন। অন্যমতে, তার ভাইপো নন্দরাম ও অন্যান্য আত্মীয়রা মিলে অনুবাদকর্ম সমাপ্ত করেন।শান্তিপর্ব কৃষ্ণানন্দ বসু ও স্বর্গারোহণ পর্ব জয়ন্ত দাস  লিখেছিলেন।

কাশীরামের নামে আঠারো পর্বে সমাপ্ত বিশাল মহাভারত প্রচলিত আছে। তবে তিনি আদি, সভা, বন ও বিরাট এ চার পর্ব রচনা করে মারা যান; পরে তাঁর পুত্র, ভ্রাতুষ্পুত্র ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজন মিলে কাব্যখানি সমাপ্ত করেন। এটি ১৮০১-১৮০৩-এর মধ্যে  শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে আংশিকভাবে প্রকাশিত হয়। তারপর ১৮৩৬ সালে জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের সম্পাদনায় একই প্রেস থেকে সম্পূর্ণ আকারে মুদ্রিত হয়। পরবর্তীকালে আরও অনেকেই কাব্যটি সম্পাদনা করেন।

কাশীরামের পূর্বে ও পরে আরও অনেকে পূর্ণ ও খন্ডিত আকারে মহাভারত রচনা করেছেন; কিন্তু সেগুলির মধ্যে কাশীরামের গ্রন্থই শ্রেষ্ঠ। বেদব্যাসের সংস্কৃত মহাভারত ও অন্য অনেক উৎস থেকে উপাদান নিয়ে কাশীরাম প্রায় স্বাধীনভাবে বাংলা মহাভারত রচনা করেন। বাঙালির কাছে কৃত্তিবাসের  রামায়ণ ও কাশীরামের মহাভারত সমান গুরুত্বপূর্ণ। উভয় কাব্য যুগ যুগ ধরে হিন্দুদের ঘরে ঘরে পঠিত হচ্ছে। প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *