অমিতকুমার বিশ্বাস

মেয়েটির সবে ষোলো কি সতেরো। সকাল দশটায় একটা ফোন আসে, ‘মা আমি রানাঘাট বুথ থেকে বলছি, মা!…আমাকে নিয়ে যাও মা!…আমি ঝুলন্ত ব্রিজে মা…’ 

ফোন কেটে যায়। আর তারপরই হইচই। 

গতসন্ধ্যায় গাংনাপুরে মামাবাড়ি বেরিয়েছিল, আর আজ সকালেই ফোন। ফোন আমার মোবাইলেও। তবে মায়ের। এখন থানায় যেতে হবে।

গেলাম। মিসিং ডায়েরি করা হল। কিন্তু পুলিশবাবুদের কোনও হেলদোল নেই। বলল, ‘খবর পেলে জানাব।’ আরও বলল, ‘সোজা রানাঘাট চলে যান।’ আর তাই একটা সুমো ভাড়া করে ছোটা। 

সিলিন্দা আসতেই আমরা রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে তৃতীয় পর্বে ভোট হয়ে গেছে গতসপ্তাহে। আজ চতুর্থ পর্ব। বনগাঁ-চাকদা সড়কের দু-ধারের শিরীষ দাড়ি কামানোর মতোই কেটে সাফ। এখন সেখানে বাঁশের আগা-সহ-কঞ্চিগুচ্ছ কেটে গাছের মতোই বসানো। তাতে বিভিন্ন দলীয় পতাকা। অবিকল গাছ। ভোটগাছ!একেবারে চাকদা পর্যন্ত। 

জানলার পাশে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন মা। তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন পাশের মহিলা। সম্ভবত তিনি মেয়ের মাসি। তার পাশে মেয়ের দাদা। মেয়ের থেকে সামান্য বড় হবে। চুপচাপ। মাঝে মাঝে ফোন আসছে। কেবল তখনই উত্তেজিত। উদ্বিগ্ন। পেছনে বাকুভাই। গোরুপাচারে নাম আছে। লোকে ভয় পায়। তবে গত মাসে একটু বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে পাবলিকের প্যাঁদানি খেয়েছে। রংখেলার দিন নমোপাড়ায় গিয়ে এক জ্ঞাতি গোয়ালাভাইকে মারতে গিয়েই পালটা মার খায়। নমোদের দাবী ছিল, ‘যে-ই হওগে, আমাগে পাড়ায় মস্তানী মারা যাবে না!’ বাকুভাইয়ের কিন্তু মার খেয়েও লজ্জা নেই। লজ্জা দিয়ে গোরুগিরি চলে না। বদলা হিসাবে মাঝে মাঝে নমোপাড়া খেলার মাঠে গভীর রাতে বোম পড়ে। তবে পুরোনো দাপট ফিরিয়ে আনতে সময় লাগবে। 

এই নমোপাড়ার কেউ সরকারি চাকরি করে না। কোম্পানির বাবুগিরিও না। এরা সবই শ্রমিক-কৃষক শ্রেণির। অতএব ভয়ডর নেই। সারাদিন ক্যাঁচাকেঁচি আর বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার মধ্যে দিনরাত কেটে যায়। 

সেই বাকুভাই পিছোনে ঝিমোচ্ছে। সম্পর্কে সে মেয়ের মায়ের তুতো-দাদা। মার খেয়ে পুলিশের কাছে ইমেজ খারাপ। তাই বনগাঁ থানায় ঢোকেনি। কিছুদিন আগেও নাকি থানায় দাপট ছিল ব্যাপক। 

​আমার ফোনে বারবার ফটিকের ফোন আসছে। ফটিক সরকারি চাকরি করে। সেই উত্তরবঙ্গে। পঁয়ত্রিশের কোঠায় বয়স। মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিক। সামনে আঠারো পেরোলেই বিয়ে। আর এরই মধ্যে কিনা… 

​দুপুর। রাস্তার দু-পাশে কেবলই লাল-সবুজ ক্ষমতাধ্বজার দাপট। খালবিলগ্রামের মধ্যে দিয়ে ছুটে যাচ্ছে সুমো। চুলে হাওয়া লাগছে। বৈশাখ মাস। এই হাওয়াতেই যাত্রাপথে আরাম এইটুকুই। আমরা চাকদা হয়ে সোজা রানাঘাট থানায় চলে এলাম। এবারে টিমটা আমাকেই ঠেলে পাঠাল সেখানে। অথচ থানা, কোর্ট, ব্যাংক কিংবা হসপিটাল— এগুলো থেকে শত হস্ত দূরে থাকি। আমার ব্যক্তিত্ব কমে আসে। গা-হাত-পা কাঁপে। বুক ধড়ফড় করে। কেন করে এসব? খেয়ে নেবে কেউ? উত্তর নিজেই দিই। তবু কাঁপুনি ও ধড়ফড়ানি কমে না কিছুতেই। ​

যা হবার তাই, থানা পাত্তাই দিল না আমাকে। কথাই বলল না ঠিকঠাক। ভোট নিয়েই ব্যস্ত। আজ পটাপট সাতটাঅরাজনৈতিক লাশ পড়লেও তাকানোর উপায় নেই। ডিউটি অফিসার বললেন, ‘ঝুলন্ত ব্রিজের কাছে চলে যান। পেলে জানাবেন। বিপদ বুঝলে ফোন করবেন। ওই দেখুন দেওয়ালে নম্বর। তবে আইন হাতে তুলে নেবেন না।’

 ​‘ভারতীয় গণতন্ত্রে ভোট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। এই দু-হাজার চোদ্দোতে এসেও সেটা দেখতে পারছি। এতে আনন্দ আছে। আবার অন্যের আনন্দ থামানোর জন্য খুনখারাপি আছে, বুথজ্যাম আছে। এসব ছেড়ে পুলিশ কি আর আমাদের দিকে নজর দেয়?’ কথাগুলো মেয়ের দাদা বলছিল। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিয়ে বুদ্ধি খুলেছে তার।  

আমরা ঝুলন্ত ব্রিজের কাছে গিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। হ্যাঁ, শুরুতেই পাবলিক টেলিফোন বুথ আছে। মাত্র একটাই। ‘চ্যাটার্জি ভ্যারাইটিস’। ঝাঁপ ফেলা। সকালে নিশ্চয়ই খোলা ছিল। এখন হয় ঘুমোচ্ছে, নইলে ভোট দিতে গেছে। একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি নিজের দোকান থেকে এনলার্জ করে দিয়েছেন মেয়ের মামা। সেটাই এখন আমার হাতে। লোককে দেখাচ্ছি। ‘দাদা, এই মেয়েটিকে কি দেখেছেন কোথাও? সকাল দশটায় শেষবার তাকে এই ব্রিজে দেখা গেছে!’

‘আরে, পুলিশের কাছে যান, দাদা। চিন্তা করবেন না, পেয়ে যাবেন।’

পেয়ে যাব! এতই সস্তা? মিনিকে পেয়েছি? বাংলাদেশ থেকে সবে পিসিবাড়ি এল। তারপর মিসিং। সবিতা এল? সুখেলা এল? 

হাঁটতে-হাঁটতে নদীর ওপাড়ে চলে গেলাম। নদী আর ব্রিজের ফুটের মধ্যে দূরত্ব বেশি নয়। কালো জল। পানায় ভর্তি। মৃদু স্রোতে বয়ে চলেছে। 

না, ওপাড়েও কেউ চিনল না।

খোঁজ নিয়ে জানলাম, চ্যাটার্জি ভ্যারাইটিসের বাড়ি নদীপাড়ে। কিন্তু ওইপাড়ে, অর্থাৎ আমরা যে-পাড় ফেলে এসেছি। বামুনপাড়ায় বাড়ি। 

ব্রিজ পার হবার সময় ঘটে গেল এককাণ্ড। ছেলের ভাই আর মেয়ের দাদার ধাক্কাধাক্কি। ঘুষোঘুষি। বাকুভাই থামিয়ে পারে না। অগত্যা আমি নাক গলাই। হাত গলাই। দুজনকে ধরে থামাই। 

ছেলের ভাইয়ের বয়স এই বছর ত্রিশেক হবে। মেয়ের দাদা এখনও তাকে ‘আংকেল’ বলে ডাকে। আগেও তাই ডাকত।এমনকি পাত্রকেও। বন্ধুর মেয়ের প্রতি হঠাৎ আকর্ষণ চলে এল। এর পেছনে আছে যৌনতা। যৌনতা— পাওয়ারড বাই চাকরি।মানি আলটিমেটলি! ঠোঁটকাটা ‘আংকেল’ সারা-পথে এইসব তত্ত্ব দিয়ে নাড়ছিল আমাকে। আমি শুনছিলাম না কি ঝিমোচ্ছিলাম কে জানে!

‘ভালোবাসা কি আদৌ আছে?’ ঝিম ভেঙে প্রশ্নটি করতেই উত্তরে বললেন, ‘জটিল ও কঠিন প্রশ্ন করলেন, দাদা। ভালোবাসা ঠিক স্বপ্নের মতো। আছে। আবার নেই। যখন আছে মনে হয়, তখন গাছে গাছে ফুল ধরে। বাতাস বয়। বৃষ্টি হয়।জোছনা নামে সাবুদানার মতো। সেগুলো খুঁটে খায় একধরনের উজ্জ্বল রুপোলি বক— যারা প্রতি শীতে সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসে। পৃথিবীকে ঈশ্বরের পরম সৃষ্টি বলে মনে হয় তখন। আর যখন মনে হয় প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই— তখন ভাবনা জাগে— সবই যেন —- তাল!’

এই —- কথাটি ভালোভাবে নেয়নি মেয়ের দাদা। সে গোলাপে ঢাকা ভালোবাসার ইমারতে বিশ্বাস করে। তার মধ্যে এরকম বিশ্রী ব্যাপার আসার কথা নয়। আর এইখানে, অর্থাৎ এই চলমান-ঘটমান প্রেমকাহিনিতে তার বোন যুক্ত। ফলে প্রথমে একবার সতর্ক করে। দ্বিতীয়বার হাত চালিয়ে দেয়। 

মেয়ের মা’র ফুঁপিয়ে কান্না বেড়ে যায়। মেয়ের সঙ্গে পাত্রের যৌন সম্পর্ক হয়ে গেছে। হচ্ছে। আর গোপন খবর, রাকিবের সঙ্গেও হয়েছে। হয়তো এই মুহূর্তেও হচ্ছে। ঠিক যে-মুহূর্তে আমার মুতের চাপ বেড়ে গেছে বহুগুন। ঠিক যে-মুহূর্তে ভারতে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের ভোট হচ্ছে। পার্টির দাদারা এক বিকলাঙ্গকে কোলে তুলে ঢুকে যাচ্ছে বুথে। ইভিএম কম্পার্টমেন্টে। তারপর টুক করে টিপে দিল সঠিক বোতাম। লাল আলো আর শব্দে প্রিসাইডিং অফিসার মাথা নাড়লেন, ভোট পড়েছে। এরই মধ্যে টয়লেট হতে মেয়ের মা প্যাড পালটে নিলেন। 

এইসব কথা আমি জানলাম কীভাবে? আমি কি ভগবান, না কি শয়তান? মনে মনে ভাবলাম, এগুলো আমার অনুমান। বিশ্রী অনুমান। বীভৎস কল্পনা। আর আমি যতই চেষ্টা করি না কেন, নগ্ন দেবীকে দেখলে আমার ভক্তির পরিবর্তে সেক্স জাগে। আগে পাপবোধ হত। ভাবতাম খসে যাবে। এখন ভাবি ধ্বজ হয়ে যাব। প্রকৃত প্রস্তাবে, প্রতিটি মানুষই বোধহয় এমন বীভৎস কল্পনাশক্তি নিয়ে জন্মায়। আর তা নিয়ন্ত্রণ করতে বেশি বেশি ধার্মিক হয়ে ওঠে। লম্বা লাইন দিয়ে মায়ের পুজো দেয়। মানৎ করে।

না, এখনও কিছু খসেনি। তবে আগামীতে কিছু-না-কিছু তো হবেই। অন্তত প্রস্টেট বড় হবে। কষ্ট পাব। কষ্ট পেতে-পেতে মরব। আলটিমেটলি মরতে তো হবেই ভাই। মরণ তো আর সহজে আসে না! আসে অনেক কষ্টের পর। বেদনার পর। আত্মসম্মান হারানোর পর। হেগেমুতে ন্যাটানোর পর। আর এইসবই কিন্তু পাপের শাস্তি। 

কোথায় মেয়ের খোঁজে এসেছি, আর কোথায় এইসব প্রশ্ন জাগছে মনে। আর এইসব যখন জাগছে, মনটা বিষাদে ভরে যাচ্ছে। যেখানে বিশ্বাস নেই, সেখানে বিষাদ আছে। ঈশ্বরে বিশ্বাসও একটা রোমান্টিকতা। প্রেমে বিশ্বাসের মতোই। ‘আমাদের পেছনে পেটো পড়ে, আর হৃদয় বুক থেকে খুলে মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়!’ যাত্রাপথে ছেলের ভাই বলছিল। 

ছেলের ভাই বড়ই অ্যান্টি-রোমান্টিক। জীবনে ছ্যাঁকা খেয়েছে বোধহয়। মানুষ কত সভ্য হয়ে গেল, পালটে গেল,—আর সে কিনা সেই আদিম অসভ্য পৃথিবীতে রয়ে গেল!

হাঁটতে-হাঁটতে নদীপাড়ের বামুনপাড়ায় এসে উপস্থিত হই। দুপুর তখন দুটো। স্নান করে ছাদে গামছা নাড়ছিল কাঞ্চন মল্লিক। ধূসর রঙের বাড়মুডা পরা। গায়ে লেগে থাকা পৈতে। আমাদের দেখেই বলে ওঠে, ‘কী চাই?’ অত্যন্ত বিরক্তিকর গলা। 

‘একটা মেয়ে মিসিং। আপনাদের বুথ থেকে শেষবার কথা বলেছিল।’

‘এই বিষয়ে কোনও কথা বলতে চাই না। আপনারা আসতে পারেন।’

‘আসতে পারেন মানে? আপনি কি আটকে রেখেছেন তাকে?’ আমার মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে এল। 

‘মুখ সামলে!’ উপর থেকে চেঁচিয়ে-মেঁচিয়ে আরও কিছু বলতে চাইল। খেঁকি কুকুরের মতো লাফাতে শুরু করেছেছাদেই। অবশেষে বলে ফেললাম— ‘আমরা থানা থেকে আসছি। থানা আমাদের খুঁজতে অনুমতি দিয়েছে। এই দেখুন কাগজ। আপনি এমন করলে থানায় জানাতে বাধ্য হব যে, আপনিই লুকিয়ে রেখেছেন মেয়েটিকে! আর আপনি রেখেছেন কি না সেটা পুলিশ খতিয়ে দেখবে। মাঝে হ্যারাস হবেন কিন্তু আপনিই।’

ও-স-শ্লা! আমি তো হেব্বি ভয়েস দিতে পারি! লোকজন পাশে আর পুলিশের কাগজ হাতে আছে বলেই বোধহয়। এরা তো জানেই না আমি কোন মুলিবাঁশ! এই একই বিষয় কোনও অফিসে হলে গলায় ফাটা বাঁশি বাজত। কেরানি হাঁ-করে চেয়েথেকে মনে মনে দু-বার গালাগাল দিয়ে জোরে বলে উঠত, ‘পর আপ কহেনা কিয়া চাহেতে হো?’ আমি এবার হিন্দিতে ‘ট্রাই’ করতাম, এবং আরও ঘাবড়ে যেতাম। 

কথাগুলো শুনে ছাদের কাঞ্চন মল্লিক হঠাৎ মিইয়ে গেল। মনে হল দমকা হাওয়ায় ছাদ থেকে ঘুড়ির মতো গোত্তা খেতে-খেতে উড়ে যাবে চূর্ণীর জলে। কাকে এখন কে ভয় পায়! হা হা হা! 

‘দোকানটি বাবা চালান। তিনি এখন ভোট দিতে গেছেন। আপনারা বারান্দায় অপেক্ষা করতে পারেন।’ ছাদ থেকে নেমে এসে অত্যন্ত বিনম্র কণ্ঠে বললেন।

আমরা অপেক্ষা করে দেখলাম, কিন্তু তিনি ফিরলেন না। অথচ এতসময়ে ফিরে আসবার কথা। একবার মনে হল, তিনি ঘরেই। আমি ঘরে হনহন করে ঢুকতেই বাধাপ্রাপ্ত! ‘কোথায় যাচ্ছেন? কী করছেন কী আপনারা? কী চাইছেন বলুন তো?’ ততসময়ে ইনভেস্টিগেশন অফিসারের মতো গটগট করে ঢুকে পড়েছি বেডরুমে। হ্যাঁ, এক বৃদ্ধ ঘুমোচ্ছেন। 

কথা হল। নিজের স্মৃতির সঙ্গে, অস্তিত্বের সঙ্গে, সংসারের সংকটের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করে অবশেষে চিনলেন। হ্যাঁ,মেয়েটি এসেছিল। কিন্তু সে একাই ছিল। 

তবে ফোনে ওইভাবে কথা বলছিল কেন? এ যে বড়ই রহস্য! 

আমার বড্ড খিদে পেয়েছে। নদীর পাড়ে একটা বটগাছ দেখলাম। সেখানে ভুট্টা নিয়ে বসেছে। কয়লার আঁচে পুড়িয়ে দিচ্ছে। একপিস হাতে নিলাম দশ টাকায়। খেতে লাগলাম। খেতে-খেতে গাড়ির কাছে এলাম। দেখি সবাই চুপ। কেবল মেয়ের মা ফুঁপিয়ে যাচ্ছেন। আবার কি তবে রানাঘাট থানায় যাব? 

নাহ্‌, গিয়ে কোনও লাভ নেই। আজকে ওদের পয়সাওয়ালা বা পার্টিওয়ালা লোক ছাড়া কাউকে দেখার সময় হবে না। 

আমরা ফিরতে লাগলাম। আসতে-আসতে খবর পেলাম গাংনাপুর বোম পড়েছে। কেন্দ্রীয় বাহিনী যখম। দু-রাউন্ড গুলি চালিয়েছে। একজনের হাঁটুতে লেগেছে। কাতারে-কাতারে পুলিশ ছুটছে সেদিকেই। 

তাহলে মেয়েটা গেল কোথায়? 

গাড়ি থামল। মেয়ের দাদার নির্দেশে উলটো দিকে ঘুরল। আমরা কি তবে এখন রাকিবের বাড়ির দিকে ছুটছি?নৈহাটি? রাকিব নাকি বাড়িতেই। চলো যাই। সেখানেও নতুন অভিজ্ঞতার মুখে পড়ব। রাকিব যদি বাড়িতেই থাকে, তবে সেখানে গিয়ে কী হবে? রাকিব-ই কি তবে লুকিয়ে রেখেছে? কিন্তু নৈহাটির কাছাকাছি পৌঁছাতেই হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে, ‘মা,আমি বাড়িতে। ওরা আমাকে গলিতে ফেলে দিয়ে গেল!’

আশ্চর্য! মেয়ে বাড়িতে। রাকিব বাড়িতে। পাত্র কর্মস্থল ছেড়ে ভাড়াবাড়িতে। আমরাই কেবল চলছি! 

‘ওরা আমাকে গলিতে ফেলে গেছে!’ —এ হয় কোনওদিন? পিকনিক করতে গিয়েই এমনটা হতে পারে। ‘ওরা আমাকে গলিতে নামিয়ে গেছে।’… রাকিব কি তবে বুঝতে পেরেছে আমরা নৈহাটি যাচ্ছি? আমাদের শান্ত জীবনে এইভাবে উদ্বেগ আনার কোনও মানে হয়? মেয়ের দাদা ও ছেলের ভাইয়ের মধ্যে আর-একবার কিছু একটা হতে যাচ্ছিল, আমি তাকাতেই সব থেমে গেল। বাহ্‌, এ-তো বিরাট প্রাপ্তি! জীবনের সেরা পুরস্কার। আরে ভাই আমার কোনও ব্যক্তিত্ব নেই বুঝতে পেরেই তো আমার প্রেমিকা আমার সঙ্গে থাকবার ঝুঁকিটা আর নেয়নি। সে তো নিজে চোখেই দেখেছে— হাসপাতালের ডায়েরিয়া ওয়ার্ডে গিয়ে তার দাদার খোঁজ নিতে গিয়ে ডাক্তারের সামনে কেমন তোতলাচ্ছিলাম! 

এতকিছু ভেবে আমার কোনও লাভ নেই। মেয়ের মা, দাদা, মাসি, হবু বর— সকলেই খুশি। কেবল মাঝে মাঝে তাত্ত্বিক ঢঙে উদাসীন পড়ছে ছেলের ভাই। কিন্তু চাপা চোয়াল দেখে স্পষ্ট বোঝাই যাচ্ছে উটকো ঝামেলা থেকে মুক্ত হবার কারণে সেও ভীষণ খুশি। বাবুভাই ফোন লাগাচ্ছে ঘন ঘন। দ্রুত ফিরে আসায় তার বিরাট লাভ। তিন লট গোরু আসছে মগরা থেকে। 

কিন্তু মেয়ের বাড়ি পৌঁছে দেখি— এ অন্য মেয়ে! ওরা কিন্তু তাকেই মেয়ে বলে জড়িয়ে ধরছে। হাসছে, কাঁদছে। আমার হাতের ফোটোটির সঙ্গে মিলছে না কিছুতেই। পাত্রের ভাইকে কয়েকবার বললাম। সে আমার দিকে কটমট করে চেয়ে থাকল।পাত্র নিজে হোয়াটসঅ্যাপে কনফার্ম করে বলল, ‘চিন্তা নেই, একই মানুষের।’

মনে হল আমি পাগল হয়ে গেছি, কিংবা একদল পাগল ভর্তি পৃথিবীতে বিশ্রীভাবে বেঁচে আছি। আবার এও হতে পারে— পুরোটাই আমার স্বপ্ন। যদি এই মুহূর্তে তা ভেঙে যায়, যদি উঠে ডায়েরিতে লিখে রাখি অন্তত চার লাইন তার— তবে পরেভালো গল্প লিখতে পারব স্বপ্নের ভেষজ শব্দগুলি থেকে।

আমি কিন্তু ছবি নিয়ে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছি থানার দিকে। থানার বড়বাবু এইবার মন দিলেন দুটো ছবির দিকে। বললেন, ‘এই নিয়ে একটা থ্রিলার লিখে ফেলুন। নিশ্চিত পুরস্কার পাবেন। কিন্তু ততসময় আমাদের লক-আপে থাকতে হবে যে!… ওই বেঞ্চে বসুন। তারপর ভেবে সিদ্ধান্ত নিন। কোনও তাড়াহুড়ো নেই।’

থানা থেকে বেরিয়ে নদীর ঘাটে বসে একটা কথাই ভাবছিলাম— বিগত কয়েক ঘণ্টার জন্য হাইড্রোসিল পার্সোনালিটি ভর করেছিল আমার মধ্যে। এই সভ্যতায় সবাই যখন মেনে নিচ্ছে, আমার আপত্তি কোথায়? 

‘ঠিক।’

কণ্ঠস্বরে চমকে উঠি! আমার সেই প্রেমিকারই তো? কিন্তু তা কি করে সম্ভব? সে তো নিখোঁজ বহুকাল।

প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine    

                                 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *