দীপান্বিতা
জর্জ অরওয়েল
আসল নাম এরিক আর্থার ব্লেয়ার। জন্ম ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে। মাত্র ৪৬ বছর বেঁচে ছিলেন এই বহুমুখী প্রতিভাধর ইংরেজ সাহিত্যিক। সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে সুতীব্র বিবেকবোধ, গণতান্ত্রিক সমাজবাদের ওপর বিশ্বাস, ভাষাগত সারণ্যে আগ্রহ এবং স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রবল ও বিপ্লবাত্মক ঘোষণায় উদ্ভাসিত তাঁর সাহিত্য। উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা, সমালোচনা ও সাংবাদিকতা ভিত্তিক রচনা প্রভৃতি নানা ক্ষেত্রে ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। তাঁর নাম থেকেই ইংরেজি ভাষায় অরওয়েলিয়ান শব্দটি এসেছে। স্যাটায়ার মূলক উপন্যাস অ্যনিমাল ফার্ম, স্প্যানিশ সিভিল ওয়ার নিয়ে হোমেজ টু কাটালোনিয়া এবং উপন্যাস ১৯৮৪ তাঁকে জগৎবিখ্যাত করেছে।

বিহারের মোতিহারিতে জন্ম, বাবা ছিলেন ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের ওপিয়াম ডিপার্টমেন্টে কর্মরত। মায়ের ছোটবেলা কেটেছিল বার্মায়। পারিবারিক সচ্ছলতা বিশেষ ছিল না। এক বছর বয়সের সময় মা তাঁকে ও অন্য ভাই-বোনদের নিয়ে ইংল্যান্ডে চলে যান। বাবার সঙ্গে খুব কমই দেখা হতো।
অর্থাভাবে স্কুলের পড়াশুনা কিছুটা বাধা পেয়েছিল। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের চেষ্টায় বৃত্তি ও অন্যান্য উৎস থেকে টাকার ব্যবস্থা হওয়ায় পড়াশোনা সম্ভব হয়েছিল। স্কুলের দিনগুলি তাঁর বিশেষ প্রিয় ছিল না। পড়াশুনা ভালবাসতেন না। কোনক্রমে কলেজের পড়াশোনা শেষ করে ইন্ডিয়ান ইম্পিরিয়াল পুলিশে চাকরির পরীক্ষা দিয়ে পাস করে যান। ঠাকুমা বর্মায় থাকতেন বলে তিনি ওখানেই পুলিশের চাকরি নিয়েছিলেন। চাকরির সুবাদে বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে অভিজ্ঞতা ও দায়িত্ববোধ বেড়ে যায়। পদোন্নতিও ঘটে। কিন্তু পাঁচ বছর চাকরি করার পর মারাত্মক ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তাঁকে ইংল্যান্ড ফিরে যেতে হয়। তখনই মনে লেখক হওয়ার বাসনা জেগে ওঠে এবং চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। বর্মাতে পুলিশের চাকরির অভিজ্ঞতা ভিত্তি করে লেখেন বার্মিজ ডেজ নামে উপন্যাস এবং কিছু প্রবন্ধ।
লেখক হওয়ার তাগিদে তিনি লন্ডন শহরে দরিদ্র অধ্যুষিত এলাকা গুলি ঘুরে দেখেন বছরখানেক। থাকতেন এক সাধারণ লজিং হাউসে। পরের বছর চলে যান প্যারিসে, সেখানে আরো কম খরচে থাকা ও বোহেমিয়ান জীবন কাটানো সম্ভব। এই দুটি বিষয় ছিল উঠতি লেখকদের বড় আকর্ষণ।
দু বছরের মাথায় আবার তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন ও প্যারিসে যে লজিং হাউসে থাকতেন সেখান থেকে তাঁর সর্বস্ব চুরি হয়ে যায়। অর্থাভাবে তিনি তখন হোটেলে বাসন-কোষন ধোয়ার কাজ করতেন। তারপর তিনি ফিরে আসেন ইংল্যান্ডের পৈত্রিক ভিটেতে যেখানে তার বোন ভালোই রোজগার করছিলেন।
এর কিছুদিন পর তিনি লন্ডনের একটি ছোট স্কুলে শিক্ষকতার কাজ পান। স্কুলের ছাত্র সংখ্যা ছিল মাত্র কুড়ি জন এবং তাকে নিয়ে শিক্ষক দুজন। এ সময়ই তিনি ছদ্মনাম জর্জ অরওয়েল নিয়ে পুরোদমে লেখালেখি শুরু করেন। বেশ কয়েকটি লেখা ভালো প্রকাশকের কাছ থেকে প্রকাশিত হয়। একটা কলেজেও পড়ানোর কাজ পেয়ে যান। একটা মোটরসাইকেল কিনে শহরতলি এলাকায় যথেচ্ছ ঘোরাঘুরি করে বেড়াতে গিয়ে ঠান্ডা লাগিয়ে নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে মরতে মরতে বেঁচে যান। শিক্ষকতার কাজও ছেড়ে দেন।
এ সময় তার বার্মিজ ডেজ উপন্যাসটির প্রকাশকরা প্রত্যাখ্যান করলে তিনি বেশ হতাশ হয়ে পড়েন। তার শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখতে থাকেন আর ক্লারজিম্যানস্ ডটার নামে উপন্যাস। এ সময় স্পেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে রিপাবলিকান দলের হয়ে তিনি তাতে যোগ দেন এবং বিপক্ষের রাইফেলের গুলি এসে গলায় লাগে। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। ইতিমধ্যে অবশ্য আইলিন নামে একটি মেয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যুদ্ধে যাওয়ার আবেদন জানিয়ে সফল হন না। আনফিট বলে প্রত্যাখ্যান করা হয়। পরে বিবিসি বেতার থেকে ফুল টাইমার হিসেবে নিয়োগ ঘটে। এই সূত্রে বহু বিখ্যাত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসেন তিনি। আবার ব্রংকাইটিসে আক্রান্ত হয়ে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। দু’বছর চাকরি করার পর বিবিসি থেকেও ইস্তফা দেন এবং লিখতে শুরু করেন বিখ্যাত উপন্যাস অ্যনিমাল ফার্ম। ট্রিবিউন পত্রিকায় সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে কাজ পান।
পরে অবজারভার পত্রিকায় ওয়ার করেসপন্ডেন্ট হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। আইলিন এ সময় মারা যান। সাংবাদিক হিসেবে লন্ডনের বিখ্যাত কাগজ গুলিতে লেখা বেরতে থাকে এবং তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ১৯৮৪ লিখতে থাকেন। বেশ কয়েকজন মহিলাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হন এবং আবারও ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। যক্ষা রোগে আক্রান্ত হন। অসুখ গোপন করে লিখে যান ১৯৮৪ উপন্যাস। প্রায় মরণাপন্ন অবস্থায় তাঁকে একটি স্যানিটরিয়ামে ভর্তি করা হয়। সেখানেই অল্প দিনের মধ্যে তিনি মারা যান। প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine
