পাঠক মিত্র

‘কথাপট’ সাহিত্যপট বিচার ও নির্মাণের পথনির্দেশ 

‘ছোটগল্প’ বলতে কি ? এ নিয়ে বিস্তর কাটাছেঁড়া হয়েছে বা আরো হতে পারে বা হবে । কিন্তু শব্দটি সাহিত্যকর্মী থেকে চিন্তক পাঠকদের কাছে নানাভাবে তার উপস্থাপনা হাজির করে থাকে । তবে ‘ছোটগল্প’ শব্দটি নানা উপাদানের এমন একটি সমন্বয় যা পাঠককের সামনে হাজারো প্রশ্ন হাজির করে । আর সেই প্রশ্নে ছোটগল্প তার নিজের পথে গমন করে গল্পকারের হাত ধরে । ছোটগল্পের পথ ও তার গতি নিয়ে বিশিষ্ট কথাকার সাধন চট্টোপাধ্যায়ের মূল্যবান বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ ‘কথাপট’ সকল সাহিত্যকর্মী ও মননশীল পাঠককে শুধু সমৃদ্ধ করবে তা নয়, বরং তাঁদেরও সাহিত্য বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাকে বৈজ্ঞানিক যুক্তিনির্ভর করে তুলবে । প্রবন্ধগুলি মূলতঃ আধুনিক বাংলা ছোটগল্প-কেন্দ্রিক । মাত্র এগারোটি প্রবন্ধের সংকলন নিয়ে শ্রী চট্টোপাধ্যায়ের এই ‘কথাপট’ । যার মধ্যে ছ’টি প্রবন্ধে আধুনিক বাংলা ছোটগল্পের ভাষা, স্টাইল, সময় ও সাময়িকতা, বাস্তবতা, বিকল্প আধুনিকতা, আঞ্চলিক ভাষা-সাহিত্যের মূল্যায়নহীনতা নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন । আর পাঁচটি প্রবন্ধে পাঁচজন পূর্বসূরীদের নিয়ে তিনি তাঁর দৃষ্টির আধুনিকতার প্রেক্ষিতে মূল্যায়ন করেছেন । 

প্রথম প্রবন্ধে আধুনিক ছোটগল্পের ভাষা, স্টাইল ও তার বাস্তবতা নিয়ে আলোচনার প্রথমেই দেখিয়েছেন ছোটগল্পের জয়যাত্রা কিভাবে ঘটেছে । ছোটগল্পের জয়যাত্রায় রূপকথার প্রসঙ্গ এসেছে । শুধু প্রসঙ্গ নয় তুলনাও করেছেন । রূপকথার কাহিনীর দেশ-কাল বলে কিছু নেই। কিন্তু ছোটগল্পে যা উপস্থিত । কাহিনীর বিস্তারে ভাষা প্রয়োজন । লেখক বলেছেন রূপকথার পরিসরে ভাষা গোলাম হয়ে থাকে কাহিনীর দাপটে । আর ছোটগল্পে ভাষা কাহিনীর বিস্তার ঘটায় । রূপকথার কাহিনী সবই রূপক । সারার্থে থাকে নীতি, উপদেশ । ছোটগল্পের আকর্ষণ কাহিনী । কখনও রূপকধর্মী হলেও সবই মানুষকে ধারণ করে । লেখকের কথায়, ‘মানুষ ব্যতীত ছোটগল্পের কেন্দ্র গড়ে উঠতে পারে না । যেদিন জাদু সামিয়ানায় মানুষ চেপে বসল অভিকর্ষকে মেনে , সময় ও দেশ-চেতনা এবং শিল্প-ভাষা যখন সামিয়ানার শিকড় গেড়ে দিল মাটিতে, তখনই রূপকথার ছুটি–ছোটগল্পের জয়যাত্রা ।’   

সামন্ততন্ত্র থেকে ধনততন্ত্রের রূপান্তরে মানুষের ব্যক্তি পরিচয় গড়ে ওঠার ইতিহাসে ছোটগল্পের জন্মবৃত্তান্ত ও তার জয়যাত্রা । লেখক তাই বলেছেন ধনতন্ত্রের গর্ভে ছোটগল্পের জন্ম । ধনতন্ত্রে ব্যক্তির পরিচয় গড়ে উঠলেও সেই পরিচয়ে নানা অপূর্ণতা ভরে উঠেছে ধনতন্ত্রের ক্রমবিকাশ ধারায় । ব্যক্তি পরিচয়ের নানা অপূর্ণতার শিল্পরূপ ছোটগল্প। লেখকের কথায় আরো স্পষ্ট হয়, ‘মানুষের ‘ব্যক্তি’ না হয়ে ওঠার অপূর্ণতা শিল্পরূপ পেয়েছিল ছোটগল্পের মধ্যে ; ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে । অথচ ধনতন্ত্রের ক্রমবিকাশে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতায় যখন মানুষের ক্ষয়-ভাঙন-অসুস্থ-স্বাতন্ত্রবাদ ব্যক্তিকে রুগ্ন, স্যাঁতস্যাঁতে, ভঙ্গুর করে তুলল, ছোটগল্পই তখন অপূর্ণতার নতুন রোগলক্ষণগুলো কাম্যু, কাফকা বা সার্ত্র-এর কলমে ঝলসে তুলল ।’ 

দেশ-কাল-ভাষা ও তাৎপর্যময়তায় ভরা জীবনের অপূর্ণতার কথাই ছোটগল্প । এই ছোটগল্পের আদল-কাঠামো কেমন হতে পারে তার আভাস দিতে লেখক রবীন্দ্রনাথ থেকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস পর্যন্ত নানা ব্যক্তিত্বের নানা পর্বের ছোটগল্পের প্রসঙ্গ এনেছেন । কিন্তু গল্পের আদল-কাঠামো কারুর সঙ্গে কারুর মিল নেই । এর কারণ হিসেবে লেখক বলেছেন ‘স্থান-কাল নিরপেক্ষ ঘন নিরেট এক খন্ড পাথরের মত ছোটগল্পের কোনও ছাঁচেগড়া সংজ্ঞা হয় না । ..ছোটগল্প তো অপূর্ণতার কথাই বলতে এসেছে, তাহলে কীভাবে তাকে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব ? সে মিথ্যে শর্তের বাধা কাটিয়ে ক্রমাগত জীবন-সমাজ-সিস্টেম, এবং ব্যক্তির ভয়-ভালবাসা, রিরংসাবিষয়ক সব কিছুর অপূর্ণতার কথাই বলে যায় ।’

আবার রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘ছোটগল্পে থাকবে ছোট ছোট ঘটনা-ছোট দুঃখ — বিন্দুতে সিন্দুর স্বাদ, যা শেষ হয়েও শেষ হয় না ।’ সাত-আট দশক পর আখতারুজ্জামান বলেছেন, ছোট দুঃখ বলে বর্তমান পৃথিবীতে কিছুই হয় না । যে পাট চাষীটি বাংলার প্রত্যন্ত গাঁয়ে ভাঙা চালায় ছোট দুঃখ ভোগ করে, খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে এর সাথে সুতোর মত জড়িয়ে আছে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির যোগসাজস ।..’শাস্তি’ গল্পে চন্দরা যে দুঃখে ফাঁসির আগে স্বামীকে দেখবার সুযোগের প্রস্তাবে, ‘মরণ’ বলে হেসে ওঠে, তা কি ছোট দুঃখ? 

ছোটগল্পের প্রকৃত সংজ্ঞায়িত করা হয়তো দুঃসাধ্য, তবুও লেখকের কথায়, ‘ছোটগল্প অনির্দিষ্ট, অনায়তনিক, অকেলাসিত, ছকবিহীন শিল্প আঙ্গিকের আড়ালে এমন একটি ছক বা লেখকের স্টাইলের স্পর্শে দ্বিতীয় একটি বাস্তবের জন্ম দেয় । আর দ্বিতীয় বাস্তব ও স্টাইল হল পরস্পরের পরিপূরক ।’ যা আখ্যান স্রষ্টার মন ও মেধার সৃষ্টি । 

ইন্দ্রিয় বাস্তবতায় মন ও মেধার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় লেখক গড়ে তোলেন আখ্যানের শিল্পবাস্তব । আবার ব্যক্তি-সমাজের টানাপোড়েনে চেতনার আলোকে বোধদীপ্ত হলেই শিল্পবাস্তব অনুঘটকের কাজ করে । তখন  কল্পনার সত্য ইন্দ্রিয়বাস্তবকে মন ও মেধার বিশ্লেষণে গড়ে তোলে মানুষের মনোভূমির উৎকৃষ্ট শিল্প । এই শিল্পে থাকে স্টাইলের ছোঁয়া যার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ব্যক্তি লেখকের রুচি, জীবনদর্শন, নান্দনিক বোধ, ভাষা, বর্ণনা ভঙ্গি । শুধু তাই নয় । স্টাইল একটি সামাজিক ক্রিয়া যার গভীরে ভাষা-শব্দ-বাক্য গঠন, বিষয় নির্বাচন, নান্দনিক বোধের বিভিন্ন দিক ও মানের সবগুলোর লব্ধি । 

এই লব্ধির উদাহরণ দিতে এ-বাংলার কয়েকজন লেখকের ছোটগল্পের উড়ানের কয়েকটি লাইন তুলে ধরেছেন । ভগীরথ মিশ্রের ‘অসুখ’, সোহরাব হোসেনের ‘গাভীন সময়’, শরদিন্দু সাহার ‘বিশ্বামিত্রের খড়ম’ গল্পের উল্লেখ করেছেন । বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘাটের কথা’ যদি ছোটগল্পের সূচনা নির্দেশিত হয়, শতাধিক বছর ধরে বিভিন্ন জটিল পথে ভাষা ও স্টাইলের পরিবর্তন ধরে আজ অনেক উৎকৃষ্ট এই ছোটগল্প । প্রবন্ধকার এমনই মত পোষণ করেছেন । 

প্রবন্ধকার বলছেন, ‘আসল কথা প্রতিটি কালখন্ডেই লেখকরা নানা ভঙ্গি বা স্টাইলে লিখে থাকেন । আমাদের ছোটগল্পের অতীত বহুস্বরিক ।’ তাই রবীন্দ্রনাথ থেকে সমরেশ বসু, বিমল কর থেকে আজ পর্যন্ত সকলেই একই সুরে লেখেননি । 

বর্তমানে যে ধারাটি বাংলা গল্পে প্রবল বলে প্রবন্ধকার মনে করেছেন, তার প্রধান দুটি বৈশিষ্ট্য।  একটি বহুমাত্রিকতা, আর একটি আখ্যান মেরু । যেখানে এই কাহিনীমেরুর আকর্ষণ-বিকর্ষণে এমন একটি পাঠ নির্মাণ–যা পাঠভেদে ক্রমান্বয়ে বিনির্মাণ সাপেক্ষ । তখন গল্পের মধ্য দিয়ে কোন বার্তা পাঠকের চেতনায় পৌঁছে দেয় ছোটগল্প। ছোটগল্প ঘটনাজীর্ণ নিটোল কাহিনী নয় । কাহিনীধর্মিতা বজায় রেখেও কাহিনীর ভারকে অস্বীকার করা যায়, যা রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ঘাটের কথা’ গল্পে দেখিয়েছেন । এ বিষয়ে প্রবন্ধকার বলছেন, ‘যেন আধুনিক কোন ক্যামেরাম্যান নানা কোণে যন্ত্রটিকে পাতছেন ।’  

গত শতাব্দীর সত্তরের পর থেকেই ছোটগল্প নীরবে অপ্রত্যক্ষ দাবি জানাচ্ছিল গল্প নির্মাণের রবীন্দ্রনাথের এই আধুনিক ফর্মকে । যা নিঃশব্দে নানা লিটল ম্যাগাজিনের মধ্য দিয়ে ধারাটি ফিরে এসেছে বলে প্রবন্ধকার মনে করেন । তিনি মনে করেন, ‘যে-সব লেখকরা বিকল্পধারার কথা বলছেন, তারা আসলে রবীন্দ্রানুসারী এবং এ দেশীয় আধুনিকতায় বিশ্বাসী– যে-ধারাটিকে রবীন্দ্রনাথ বলতেন ‘চিরকেলে আধুনিক’ । ‘আধুনিকতা’ শব্দটির মধ্যে যে তাৎক্ষণিকতা বা হুজুগধর্মিতা আছে, তা এড়িয়ে  ‘চিরকেলে আধুনিক’ হওয়াই তো ক্লাসিকের লক্ষণ ।’ প্রাবন্ধিক আরো মনে করেন,’বর্তমানে বিশ্বায়ন-প্রক্রিয়া ও আঞ্চলিক সাহিত্যের অবমূল্যায়নের মধ্যে আমরা যদি বাংলা ছোটগল্পে আধুনিকতা, উত্তর-আধুনিকতা বা ম্যাজিক রিয়ালিজমের চৌখুপ্পির বিকল্পে রবীন্দ্রনাথের কোনও ভাবনাসূত্রের মধ্য দিয়ে আমাদের আধুনিকতার সন্ধান পাই, তবে সেইসব বিকল্প লেখকরা আমাদের অবশ্যই ভরসাস্থল ।’

একদিকে প্রবন্ধকার রবীন্দ্রনাথের মধ্য দিয়ে ভরসাস্থল খুঁজে পেলেও,  আর একদিকে তিনি দেখতে পেয়েছেন যে আধুনিকতার দোহাই পেড়ে অতীত সম্পর্কে অর্ধ-সত্য প্রচার চলছে । আর সেই প্রচারে রবীন্দ্রনাথ থেকে সত্যজিৎ ঋত্বিকের মূল্যায়ন হারিয়ে যেতে থাকে । প্রাবন্ধিকের মতে ‘জীবনমুখী’ ঝকঝকে চকচকে মচমচে প্রযোজনার নামে আর্ট-ফর্মের অস্তিত্ব কেনা-বেচার হাটে পণ্য-সম । এ সবকিছুই ‘উৎপাদিত সংস্কৃতি’র ফসল । এই উৎপাদনে পুঁজি, বাজার, ক্রেতা প্রধান বিবেচ্য । প্রাবন্ধিক এই সংস্কৃতিকে তুলনা করেছেন অনেকটা ‘বাওয়া ডিমের’ মত । এই ডিমের স্বাদ আছে, চেহারা আছে, সাদা ঝকঝকে, কিন্তু প্রজনন ক্ষমতা নেই। তেমনই এই সংস্কৃতির উৎপাদনে পাঠকের মনে কোনও প্রশ্ন বা আলাদা অস্তিত্বের জন্ম দিতে পারে না । এই সংস্কৃতি ক্ষমতাবানরা বানিয়ে তোলে যা মানুষের মগজ ছাঁকেন, ছিবড়ে করেন । এটাই ধনতান্ত্রিক পুঁজির সংস্কৃতি । ‘বেস্ট সেল’, পুরস্কার, ‘সেরা সাহিত্য-সিনেমা-নাটক’-এর নামে এই সংস্কৃতির ভালত্ব বলে প্রচার চলে । এই প্রচারে লেখকের গা-ভাসানো আম-দুধ আলাদা করা কঠিন করে তোলে । যেখানে বিপ্লবের কথা থাকে অথচ বিপ্লবের প্রাণ থাকে না । তাই স্রষ্টার জীবনযাত্রা তাঁর সৃষ্টির বিচার নয় । কিন্তু প্রাবন্ধিক বিশিষ্ট দার্শনিক এডওয়ার্ড সৈদের কথা দিয়ে ‘উৎপাদিত সংস্কৃতি’র এই গোপণীয়তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। সৈদের কথায়,’বয়ানের অন্দর-সদর যেমন বিবেচনাধীন, তেমনি আবার বয়ান-কর্তা/কর্ত্রীর জীবনযাপনও আলোচনাধীন ।’ এই আলোচনা ক্লাসিক সংস্কৃতি’র খোঁজ দিতে পারে । ‘উৎপাদিত সংস্কৃতি’ ক্ষমতাবানদের আকাঙ্খাকে টিকিয়ে রাখে যেখানে পাঠক ও শ্রোতা শুধু রাজনৈতিক ও নিরপেক্ষ জীব ছাড়া আর কিছু নয় । কিন্তু ক্লাসিক সংস্কৃতি ক্রেতা ও পাঠককে সমাজ ও রাজনৈতিক সচেতন মানুষ হিসেবে রূপ দান করে । উৎপাদিত সংস্কৃতি-পুঁজির দাপটে এমন রূপ দানের ভাবনাকে দলিত করার প্রয়াস চলছে অহরহ । তবুও উৎপাদিত সংস্কৃতি’র দাপট থেকে মুক্তির একমাত্র পথ বাঙালি জাতির ক্লাসিক সাহিত্য । এটাই বিশ্বাস করেন প্রাবন্ধিক। তিনি মনে করেন ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে যোগাযোগ রাখতে পারলেই ক্লাসিকের মধ্যেই পুনরুজ্জীবনের বীজ অঙ্কুরিত হবে । ক্লাসিক-ই পারে আধুনিকতার সঙ্কট ‘উৎপাদিত সংস্কৃতি’র মোকাবিলা করতে । আর আছে সংস্কৃতির অফুরন্ত ভান্ডার ‘লোক সংস্কৃতি’ । সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ আমাদের একমাত্র আশ্রয় । 

রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’, ‘রক্তকরবী’ হয়ে ‘রথের রশি’তে পৌঁছেছিলেন পুঁজিবাদের বিকৃতি, জনগণের ক্ষমতা ও সঙ্কীর্ণ আধুনিক ইউরোপের সাময়িকতায় । আর এই সাময়িকতার হাত থেকে তিনি শিল্প ও সাহিত্যকে বাঁচানোর ধ্রুপদী ধর্ম শিখিয়েছেন । যা আজকের সময়ে সঙ্কটের আক্রমণ সত্বেও মুক্ত বাজার ও ভোগের বন্যায় শিল্প-সাহিত্যে সাময়িকতার জাঁকজমক জেঁকে বসেছে । তাই সংস্কৃতির গুণগতমানের বিচার চলে ভোক্তার সংখ্যা দিয়ে । 

ক্লাসিক সাহিত্য স্তব্ধ সময়ের ভাবনাকে তুলে ধরে । যার মধ্যে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের লক্ষণ নিয়ে সময় এক বিশেষ মাত্রা হয়ে ওঠে । ক্লাসিক শিল্পের এটাই মূল লক্ষণ । এই লক্ষণ বোঝাতে প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ নাটকের প্রসঙ্গ এনেছেন । ক্লাসিক চর্চার ব্যাপারে প্রাবন্ধিক একটি দিকও নির্দেশ করেছেন । তাঁর কথায়, ‘আমাদের সাময়িকতার ক্ষয়, রুগ্নতা ও ‘প্রলাপবকবার’ স্তরে জাতির বিশল্যকরণী হিসেবে নতুনভাবে ক্লাসিক চর্চা শুরু করা দরকার। আধুনিকতাকে ‘সাময়িকতায়’ রূপান্তরিত করে নয়, ঐতিহ্যের মিশ্রণেই আধুনিক সময়কে ধরতে হবে সমস্ত শিল্পে । আর ঐতিহ্য মানেই জীবন্ত কোষ–যা স্তব্ধ বিপুল সময়ের মধ্যে গচ্ছিত থাকে । গ্ল্যামার বা মুহুর্ত-আক্রান্ত জীবনযাত্রা দিয়ে এই কোষটিকে ধরা যায় না বলেই আমাদের সংস্কৃতিকে ক্রমাগত আক্রমণ ও আত্মসাৎ করে চলেছে অনুকরণের দায়ভার । এটুকু ঢাকতে প্রতি মুহুর্তে বাজারে আসছে গালভরা নামের বহুরূপী তত্ত্ব, ঐ মার্কিন মুলুক ও পশ্চিম ইউরোপ থেকে । এই নতুন প্রাচীর বা বাঁধ ভাঙ্গব কবে আমরা ?’ এ প্রশ্নের উত্তর প্রাবন্ধিক নিজেই দিয়েছেন । ভাষার প্রেক্ষিতে আরও ভাল ছোটগল্প তিনি চান । উদাহরণ হিসেবে বলেছেন, ‘বিজ্ঞানে ইলেকট্রনের কক্ষ পরিবর্তনে যেমন শক্তির বিকিরণ বা শোষণ ঘটে এবং নানা উজ্জ্বল বর্ণে সাদাচোখে শক্তির রূপান্তরটুকু দেখা যায় । ভাষার ক্ষেত্রেও তাই।  ভাষার কক্ষচ্যুতি ঘটলে গল্পে ফুটে ওঠে তরতাজা টাটকা কিছু অভিভব।’ এভাবেই নতুন সহস্রাব্দে কিম্ভূত-সময়কে impulse সহ তুলতে হবে এবং তার জন্য ‘ভাল’ গল্পগুলোকে ‘আরও ভাল’ করে তুলতে হবে বলে তিনি মনে করেন । যেখানে বিন্যাস, শব্দ এবং সমগ্র আখ্যানের চলনের সময়ের মধ্যে নানা contrast সৃষ্টি করা প্রয়োজন–যা হবে তৃতীয় বিশ্বের বাস্তবে, নতুুন মিলেনিয়ামের ছোটগল্প।  

রবীন্দ্রোত্তর যুগে বিভূতিভূষণ, মাণিক, তারাশঙ্করের পর বাংলাসাহিত্যের, বাংলা লেখকদের যথার্থ মূল্যায়ন না হলে বাংলা সাহিত্যের বেঁচে থাকার প্রাণ থাকে না বলে প্রাবন্ধিক মনে করেন । আন্তর্জাতিক ও জাতীয় স্তরে ইংরেজি সাহিত্যের সাপেক্ষে বাংলা সাহিত্য তথা আঞ্চলিক সাহিত্যের অবস্থান সম্পর্কে নানা প্রশ্ন রেখেছেন । আসলে আঞ্চলিক বা বাংলা সাহিত্যকে এ বাংলায় ‘promote’ বলতে যা বোঝায় , তা হয়নি । যদি না সাহিত্য একাদেমি বাইশটি ভাষার সাহিত্যের পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকত । এর জন্য শিক্ষা ব্যবস্থায় সাহিত্য চর্চার উদ্যোগের দৈনতা প্রসঙ্গে সংশয় প্রকাশ করেছেন। যদিও পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাদেমি, সাহিত্য একাদেমি বা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ বর্তমান । তবু সাহিত্যের বিচার-বিশ্লেষণে তাঁদের উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন । যেখানে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়, পদ ও অধিকারের জন্য বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিক চক্র গড়ে ওঠে এবং অধিকাংশ সময় জুড়ে থাকে গোল ফোকড়ে চৌকো পেরেক ঠোকার ইতিবৃত্ত। এমন অবস্থায় তাহলে আঞ্চলিক সাহিত্য আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি কিভাবে মাথা তুলে দাঁড়াবে ? বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তর থেকে এইসব সাহিত্য প্রতিষ্ঠান উপযুক্ত পরিকল্পনায়, সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যদি আধুনিক সময়কে না ধরতে পারে, তবে বাইরের চাপ এবং ভেতরের দুর্বলতার জন্য আঞ্চলিক সাহিত্যকে দুয়োরানী হতে হবে বলে প্রাবন্ধিক মনে করেন ।  

তবু ইতিহাসের প্রয়োজনে দায়বদ্ধ লেখকরা মিলেনিয়ামের গল্প নতুনভাবে সৃষ্টি করবেন বলে প্রাবন্ধিক আশা প্রকাশ করেন । আর রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি বিভূতিভূষণ, মাণিক, তারাশঙ্কর, সোমেন চন্দ, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় আর এখন হাসান আজিজুল হক আমাদের পথ দেখাতে পারে । প্রাবন্ধিক বলেন, ‘তারাশঙ্করের ক্রণটোপ বদলে গেলেও জাত-ধর্ম-বর্ণের মূল দ্বন্বগুলো আমাদের তৃতীয় বিশ্বের সমাজ থেকে মুছে যায়নি বলে, তারাশঙ্করের সাহিত্য আজও ভীষণ জরুরি ।..তারাশঙ্কর যেভাবে folk-motive গুলো কাজে লাগিয়েছেন, তা উত্তরসাধকদের কাছে অবশ্য শিক্ষণীয় । আর সোমেন চন্দর গল্পের স্বকীয়তা যা গণতন্ত্রের বাতাবরণ তৈরি করে । যে বাতাবরণ মাণিক, সমরেশ বসু, বিষ্ণু দে’র মত লেখকদের বলিষ্ঠ কলম আমাদের বুঝতে দেয়নি । সোমেনের কাহিনীতে, ভাষায়, উপস্থাপনায় এবং আঙ্গিকে আমরা ইতিহাস, ঐতিহ্য, শ্রেণীচেতনার সঙ্গে কৌতুক, হিউমার এবং হৃদয়সর্বস্ব বুদ্ধির উপস্থিতি বাংলার প্রগতি ধারায় একটি ‘নন-এলিট’ ঐতিহ্যের সূচনা করেছিলেন বলেই প্রাবন্ধিক বিশ্বাস করেন । 

হাসান আজিজুল হকের গল্পগুলো ব্যাপ্তি-বিল-ঝুনো মাটি-বর্জপাত, কাদা, রু রু বাতাস, বৃক্ষ, শামুক থেকে শুরু করে শহরের আগ্রাসন, গিলে খাওয়া আধুনিকতা নিয়ে তৃতীয় বিশ্বের বিশাল একটি ক্যানভাস তৈরি করে । কাহিনীর ঘনঘটা নেই, তবু ক্যানভাসের বিশালত্ব থেকে পাঠক বঞ্চিত হয় না । নতুন নতুন দিগন্ত আবিষ্কৃত হচ্ছে তাঁর গল্পে । তাই ব্যক্তি-বাস্তব ও সাহিত্যবাস্তব- দুই কুলেই তিনি আমাদের সবক্ষেত্রেই পরম ভরসার ভূমি ।

এই সাহিত্যবাস্তব নিয়ে ছোটগল্প মুক্ত বাজার আর সংস্কৃতির বিশ্বায়নে নতুন শতাব্দীতে সমাজজীবনে যত জরুরি হয়ে উঠবে, রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের কাছে জুটবে অনাদর, অবহেলা । নিরাপত্তাহীনতায় বালিতে মুখ গোঁজা উটপাখিদের সংখ্যা যতই বাড়ুক না কেন, তবু ছোটগল্পের মৃত্যু নেই । প্রাবন্ধিকের ‘কথাপট’ সেই কথাই বলে যা সকল দায়বদ্ধ সাহিত্যকর্মীর কাছে এক পথনির্দেশ ।

কথাপট

সাধন চট্টোপাধ্যায় 

শিল্পভাষা আকাদেমি

কলকাতা–২৭

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *