তপোপ্রিয়

রোদন ভরা এ দিনান্ত

দিন ফুরোবার সময় দেখি তার গায়ের আনাচে-কানাচে জমে ওঠে কচি কচি বিষণ্ণ বিলাপ, তারা থেকে থেকে কান্না আনে আমার দিনান্তের নানান অলিন্দে। কত কিছু হারিয়ে গেছে, কত কিছু হারিয়ে যায় ধরাছোঁয়ার সীমানা থেকে। কেমন করে হারিয়ে গেছে আমার মা। এদের কিছুই আবার কি ফিরে আসবে আমার প্রাত্যহিক ঘনঘটায়? 

চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি যখন আমার সহপাঠী হয়েছিল একটি ত্রিপুরী ছেলে। তার নাম ছিল বরুণ মুড়াসিং। আমরা সেসময় থাকতাম ত্রিপুরাতে। বরুণ ছিল বেশ স্বাস্থ্যবান, সরল-সাদাসিধে। বাংলা বলতে ভালই, তবে হরহামেশা মিশিয়ে ফেলতো নিজের ভাষা। ছেলেরা সব মজা করত তাই নিয়ে। বরুণ তাতে অপ্রস্তুত হত, রেগেও যেত। সে যেহেতু ক্ষেপে যেত আর মারমুখী হয়ে তাড়া করতো তাই তার পিছনে লেগে মজা পেতো সবাই। রেগে গেলেও সে যে মারকুটে ছিল এমন নয়। এই রেগে গেল, পরক্ষণই আবার হাসিখুশি। আমার সঙ্গে তার সম্পর্ক বেশ ভাল ছিল, যেহেতু অন্যদের মতো আমি তার পিছনে লাগতে যেতাম না। তবুও আমার ওপরও সে একবার খেপে গিয়েছিল। তার জন্য আমি দায়ী। বরুণের বাবার নাম ছিল বাঁশিচান মুড়াসিং। বাবার এমন নামটা নিয়েও ছেলেরাও ওকে খেপাত। একদিন আমার কী দুর্মতি হলো, বরুনকে দেখেই হঠাৎ ওর বাবাকে নিয়ে এক লাইন ছড়া বানিয়ে সুর করে বলে উঠলাম, ‘বাঁশমুড়া দিয়া আসে বাঁশি চান বৈষ্ণব।’ বাঁশমুড়া মানে বাঁশ ঝাড়, কথ্য ভাষায়। বরুণ শুনেই অগ্নিশর্মা, দৌড়ে এসে আমাকে ধরে ফেলল। ওর মূর্তি দেখে আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম, আর আমাকে ঘাবড়ে যেতে দেখে বরুনেরও রাগ কমে এলো। কেবল চোখ পাকিয়ে আমাকে শাসিয়ে বলল, ‘আর কুনোদিন ইতান কইবা না কিন্তুক।’

বলছিলাম এই পারস্পরিক সম্পর্কটার কথাই। আমাদের সঙ্গে স্কুলে পড়তো নানান উপজাতীয় ছেলেমেয়েরা— জামাতিয়া, দেববর্মণ, রিয়াং ইত্যাদি। তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিল সাবলীল ও স্বাভাবিক। কোনদিনও খুঁজে পাইনি আমরা-ওরা বিভাজন, সবাই ছিলাম ‘আমরা’। পাহাড়ি উপজাতিদের সঙ্গে পূর্ববঙ্গ থেকে উৎখাত উদ্বাস্তু বাঙ্গালীদের সম্পর্কটা ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। স্থানচ্যুতদের আগমনকে ওরা সন্দেহের চোখে দেখেনি, বরং নিজেদের প্রতিকূল আদিভূমিতে নবাগতদের বাসস্থান স্থাপনের লড়াইতে তারা পাশে দাঁড়িয়েছিল। আমাদের জমি জমাতে কাজকর্মে আসতো উপজাতীয় লোকগুলি। মায়ের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ। মা বলতো, 

‘লোকগুলি খুব সৎ। ওদের ছলচাতুরি চোট্টামি নেই।’

জমি জমাতে কাজ করার সময় মজুরি নিয়ে ওরা দরাদরি করতে জানতো না, ঠকানো যেত খুব সহজেই। হয়তো কাজ তেমন উৎকর্ষ ছিল না, তবে খাটতে পারতো প্রচুর। কাজে ফাঁকি মারার প্রশ্নই নেই, এক-আধঘন্টা বেশিও কাজ করে যেত যেহেতু যেহেতু কখন কাজ শেষ করা উচিত সেই হিসেবে মাথায় থাকতো না। মা বলতো, ওদের মাথায় কুবুদ্ধি ঢোকাতো সঙ্গী বাঙালি জনমজুরেরা। ওরা বেশি কাজ করলে বা ধরাধরি না করলে যেহেতু নিজেদের অসুবিধে। এমনও হয়েছে যে কাজ সেরে হিসেবের ভুলে হয়তো কম টাকা পেয়েছে, কোন প্রশ্ন না করে তাই নিয়ে হাসিমুখে বাড়ি চলে গেল। একবার এমনই এক ঘটনায় জনৈক উপজাতি জনমজুরকে মা মোট হিসেব থেকে আট আনা কম দিয়ে ফেলেছিল। রাতে আবার হিসেব মেলাতে গিয়ে ভুলটা ধরা পড়ে মায়ের। পরদিন সে কাজে এলেই মা তাকে বলে, 

‘শোনো, কাল তোমাকে ভুল করে আট আনা কম দিয়ে ফেলেছি। আজ যাওয়ার সময় সেটা নিয়ে যেও।’

মায়ের কথা শুনে সেই যে বেচারার দুশ্চিন্তা শুরু হলো সারাদিন সে আর ভালোমতো কাজই করতে পারল না। একটু পরপরই মাকে এসে বলে, কেন সে আট আনা বেশি পাবে। বোঝাতে বোঝাতে মায়ের মুখ ব্যথা, তবুও সে বুঝবে না। সে আট আনা আজ নেবে না কিছুতেই। মা তাকে বলল, 

‘আরে, না নিলে তুমি ঠকে যাবে।’

কিন্তু সে শুনবে না। তার এক কথা, কালকের হিসেব আবার আজকে টেনে আনা কেন। কাল যা হয়ে গেছে চুকে গেছে, আজ তার জের টেনে আনা মোটেই উচিত নয়। তখন গত শতাব্দীর ষাট দশকের শেষভাগ, আট আনা পয়সার মূল্য অনেক। ওই পয়সায় এক বেলা ভালো খাওয়া দাওয়া হয়ে যায়। 

এই সরল লোক গুলো আশির দশকের সূচনায় হুবহু পাল্টে গেল। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জাগিয়ে তুলল বিশেষ এক রাজনৈতিক দল। তাদের মধ্যে জন্ম নিল আমরা-ওরা বিভাজন। এভাবেই আমরা-ওরা বিভাজন সর্বত্র মুখরোচক করে তুলেছে রাজনৈতিক স্বার্থন্বেষীরা। সেই যেমন নিজেদের স্বার্থে উপজাতীয় জন মজুরদের মাথায় কুবুদ্ধি ঢোকাত বাঙ্গালী ফাঁকিবাজ জনমজুরেরা। এই সততাহরণও এক ধরনের দূষণ। সেইসব সহজ সরল লোকগুলি আমরা-ওরা বিভাজন শিখে তীরধনুক, বর্শা, টাঙ্গি, নিয়ে বাঙ্গালীদের একসময় কচুকাটা করেছিল। হাতে তুলে নিয়ে ছিল ভয়ংকর আগ্নেয়াস্ত্র।

আমার দিনান্তের সৌম্য ছায়ায় এমনি সব সম্পর্ক বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার শোক কান্না গড়ে তোলে।

পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার ঘটনা মনে পড়ে। ওখানে চা বাগিচা দেখতে গিয়ে আরণ্যক পাহাড়ি ঢালের শেষে উপত্যকায় খুঁজে পেয়েছিলাম নিভৃত এক জলাশয়, তার পাশ দিয়ে হেঁটো পথ ধান জমি আর চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দূরে চলে গিয়েছিল কোন গ্রামে। একদল আদিবাসী মহিলা গ্রামের দিকে যাচ্ছিল, আমাদের দেখে দাঁড়ালো তারা। উমুমতুমুমের বয়স তখন চার-পাঁচ, সেও অনভ্যস্ত পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল ওই উন্মুক্ত আনন্দে। এক প্রৌঢ়া আদিবাসী রমণী সশস্তমুখে তাকে কোলে তুলে নিয়ে বলেছিল, 

‘কিরে ননা, আমাদের ঘর যাবি? 

এই সাদর আমন্ত্রণ পরবর্তীকালে দেখেছিলাম উধাও হয়ে গিয়েছিল। কোন্ কলকাঠি হিংস্র শ্বাপদ বানিয়ে দেয় সহজ মানুষকে? আমার অবাধো বিচরণের স্বাধীনতা এভাবেই কি বিপদসংকুল হয়ে যেতে থাকবে?

দার্জিলিং-এর দিকে যতবার গেছি পাহাড়ি রাস্তায় দেখেছি, দুটো গাড়ি মুখোমুখি হলে ড্রাইভাররা পরস্পর পরস্পরকে হাত তুলে কুশল বিনিময় করে। আমরা-ওরা বিভাজন থাকে না ওদের মধ্যে। এই সহৃদয় অভিবাদন জানানো হারিয়ে যাবে, দেখে হাত তুলবে না ভাবলেই আমার দিনান্তের গায়ে শোকাচ্ছন্ন ছায়া ঘনিয়ে আসে।

যদি আমার স্বাভাবিক বাসভূমি অধিকৃত হয়ে যায়, খাবার ফুরিয়ে আসে, পারিবারিক সদস্যরা অত্যাচারিত হয় আমি বিদ্রোহী হতে বাধ্য। কিন্তু এই বিদ্রোহ হিংস্র হয়ে ওঠে যখন রাজনৈতিক সচেতনতা এসে প্রবেশ করে। এই অনুপ্রবেশ অনেক ক্ষেত্রেই অনেক কিছুকে অপব্যাখ্যা করে, অকারণে অহেতুক অস্থিরতা তৈরি হয়ে যায়। পৃথিবীর জনমানুষে এই যে উচাটনতা এ বোধহয় রাজনৈতিক চেতনা প্রসারেরই কুফল। 

পৃথিবীর মানুষরা সবাই আমার আত্মীয় একথা ভাবতে যত ভালো লাগে তত ধিক খারাপ লাগে যখন ভাবি একটি একটি করে জনপদ আমার জন্য শ্বাপদসংকুল হয়ে উঠছে। তাহলে আমি প্রাণের বিলাপ জানাবো কোথায়? 

আমার দিনান্তের কণ্ঠস্বরে তাই কান্নার সরবতা। মাকে হারাবার পর এমনিতেই আমি শোকাতুর। সেই লোক ভুলিয়ে দিতে পারে যে মানুষ তারাও দেখছি ক্রমশ আমার জগত থেকে এক এক করে কেবলই দূরে সরে সরে যাচ্ছে।

প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *