সৌমিতা রায় চৌধুরী

পর্ব – ১

উনিশ শতকের বাংলা সিনেমায় পরিবারগত বা সামাজিক, রাজনৈতিক ও বিভিন্ন ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের কমেডি চলচ্চিত্রের নির্মাণও হয়েছে। এই সময় সত্যজিৎ রায়, তপন সিনহা, ঋত্বিক ঘটকদের মত পরিচালকদের পেয়েছে বাংলা চলচ্চিত্র শিল্প। বিশ শতকে সেই ধারাবাহিকতাকে বহন করে চলার চেষ্টা করছেন নতুন প্রজন্মের পরিচালকেরা। চিন্তাভাবনায় বেশ কিছু পরিবর্তনের রেশ থাকছে ধারাহিকতাকে বজায় রেখে। এমনই একটি ভিন্ন চিন্তার চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন পরিচালক অনীক দত্ত। ২০১২ সালে মুক্তি পাওয়া এমনই একটি চলচ্চিত্র ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’। 

‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ চলচ্চিত্রে যে সমস্ত চরিত্র একসময় জীবিত অবস্থায় দাপটের সাথে জীবনকে যাপন করেছেন, মৃত্যুর পর অশরীরী আত্মা হয়ে সেই জীবনের ধারাবাহিকতা বহন করেছেন। তাই এই সিনেমায় চরিত্রেরা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সাথেই আগে পরিচয় করাই আপনাদের। 

অভিনেতা পরাণ বন্দোপাধ্যায় অভিনয় করেছিলেন রায়বাহাদুর দর্পনারায়ণের চরিত্রে। চলচ্চিত্রটিতে দেখানো হয়েছে গ্রামীণ বাংলার জমিদারি এস্টেটে ভ্রমণের সময় ডাকাতদের হাতে তিনি মারা যান এবং ভূত হয়ে নিজের তৈরি প্রাসাদেই বসবাস শুরু করেন। স্বস্তিকা মুখার্জী অভিনয় করেন কদলিবালা দাসী নামে ১৯৪০ সালের একজন অভিনেত্রীর চরিত্রে। যিনি দর্পনারায়ণের পুত্রের প্রেমে প্রতারণার কবলে পড়ে আত্মহত্যা করেন এবং ভূত হয়ে ওই প্রাসাদেই বসবাস শুরু করেন। ভূতনাথ ভাদুড়ীর চরিত্রে অভিনয় করেন সুমিত সমাদ্দার। নোয়াখালীর দাঙ্গা থেকে পালিয়ে আসা এক হিন্দু বাঙালি উদ্বাস্তু ভূত। ঘটনাচক্রে তিনিও এই বাড়িরই বাসিন্দা। 

সব্যসাচী চক্রবর্তী অভিনয় করেন বিপ্লব দাশগুপ্তের চরিত্রে। তিনি এই চলচ্চিত্রের গল্পকার। প্রকৃতপক্ষে তিনি নকশাল বিদ্রোহে জড়িত একজন সি পি আই এম এল ক্যাডারের ভূত। যাকে পুলিশ বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করে। বিপ্লব এই বাড়িরই ছেলে। স্যার ডোনাল্ড রাম্পসের চরিত্রে অভিনয় করেন জর্জ বেকার। ইনি একজন ইংরেজ ভূত। রাম্পসে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী সশস্ত্র বিপ্লবীদের হাতে নিহত হন। দর্পনারায়ণের ইংরেজ বন্ধু হিসেবে মৃত্যুর পরে এই বাড়িতেই এসে বসবাস শুরু করেন।

প্রোমোটার গণেশ ভূতোরিয়ার চরিত্রে অভিনয় করেন মীর আফসার আলী। একে ভূতেরাই ভয় দেখিয়ে এলাকা ছাড়া করে। অভিনেতা উদয় শংকর পাল অভিনয় করেন আত্মারাম পাসোয়ান নামে একজন নিম্ন বর্ণের রিকশা চালকের ভূমিকায়। তিনি একটি গাড়ি দূর্ঘটনায় মারা যান এবং দর্পনারায়ণের ইচ্ছা অনুসারে রিকশা করে এদিক ওদিক যাওয়ার সুবিধার জন্য এই বাড়িতেই তাকে রেখে দেওয়া হয়। পলাশীর যুদ্ধে নিহত সিরাজ উদ দৌলার সেবাকারী রাঁধুনি খাজা খাঁয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন প্রদীপ দাশগুপ্ত। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ উদ দৌলার পক্ষ নিয়ে তিনিও মৃত্যুবরণ করেছিলেন। দর্পনারায়ণের প্রাসাদে রাঁধুনি হিসেবে কাজ করছিলেন এই খাজা খাঁ। 

সমদর্শী দত্ত সংগীতশিল্পী পাবলো পাত্রনবীশের চরিত্রে অভিনয় করেন। অতিরিক্ত মাদক সেবনের জন্য তার মৃত্যু হয়। সংগীত চর্চার জন্যই তাকে প্রাসাদে স্থান দেওয়া হয়। কোয়েল ধরের চরিত্রে অভিনয় করেন মমতাজ সরকার। একজন শিল্পপতির মেয়ে বাবার অভিভাবকত্বের কারণে প্রেমিকের ধোঁকাবাজির জন্য আত্মহত্যা করে। চার্মিং লেডি হিসেবে নাতনির বয়সী মেয়েটি দর্পনারায়ণের এই প্রাসাদেই স্থান পায়। 

অয়ন সেনগুপ্তের ভূমিকায় অভিনয় করেন পরমব্রত চ্যাটার্জী। তিনি একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভাবী পরিচালক। ভূতের থেকে সাহায্য পাওয়া এক জীবন্ত চরিত্র হল অয়ন। ব্রিগেডিয়ার যুধাজিত সরকারের চরিত্রে অভিনয় করেন বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী। কার্গিল যুদ্ধে নিহত একজন সেনা কর্মকর্তার ভূত হল এই ব্রিগেডিয়ার। প্রাসাদের সিকিউরিটির দায়িত্ব নিয়ে এই প্রাসাদেই বসবাস করেন তিনি। 

শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করেন হাতকাটা কার্তিকের চরিত্রে। সে একজন মস্তান। একে ঘুমন্ত অবস্থায় তারই শিষ্য হত্যা করে। স্থানীয় রাজনৈতিক গুন্ডার চরিত্রে অভিনয় করেন খরাজ মুখোপাধ্যায়। এটি একটি জীবন্ত চরিত্র। মনামী ঘোষ অভিনয় করেন লক্ষ্মীর চরিত্রে। যে প্রোমোটার গণেশ ভূতোরিয়ার স্ত্রীর ভূত। যাকে গণেশ ভূতোরিয়া পণের জন্য পুড়িয়ে মেরেছিল। নায়িকা মধুমিতা সান্যালের চরিত্রে অভিনয় করেন শ্রীলেখা মিত্র।

কদলিবালার প্রেমিক কেশব নারায়ণ চৌধুরীর ভূমিকায় অভিনয় করেন দেবদূত ঘোষ। সঞ্জয় বিশ্বাস গণেশ ভূতোরিয়ার সেক্রেটারি টি কে গুছাইতের ভূমিকায় অভিনয় করেন। চৌধুরী প্যালেসের কেয়ারটেকার হিসেবে সুধীরবাবুর ভূমিকায় অভিনয় করেন বিভু ভট্টাচার্য্য। 

তরুণ উদ্যমী হবু চিত্র পরিচালক অয়ন সেনগুপ্ত নিজের প্রথম সিনেমার শ্যুটিংয়ের জন্য লোকেশন দেখতে আসেন। স্থানটি হল হানাবাড়ি বলে কুখ্যাত চৌধুরী প্যালেস। সাধারণত সূর্য ডোবার আগেই এখানে কাজকর্ম শেষ করার নিয়ম। বিশেষ কারণে অয়ন সন্ধের পরেও এই বাড়িতে অপেক্ষা করতে বাধ্য হয়। এই সময়ে বাড়িরই একজন ব্যক্তি বিপ্লব চৌধুরীর সঙ্গে তার আলাপ হয়। আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি জানতে পারেন সত্তর দশকের আগে পর্যন্ত সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি এমনকি সাংস্কৃতিক বিষয়েও এই ব্যক্তির জ্ঞান প্রখর। কথা প্রসঙ্গে নিজের সিনেমা তৈরির গল্প খুঁজছেন বলে জানান পরিচালক অয়ন। বিপ্লব বলেন, প্রোমোটারি আর দখলদারির জেড়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে জাতি, ধর্ম, পেশা, লিঙ্গ ও প্রজন্ম নির্বিশেষে গৃহহীন ভূতেরা আস্তানার খোঁজে এই পরিত্যক্ত প্রাসাদে এসে জড়ো হয়। নিজেদের মত করে তারা তাদের ভৌতিক জীবন কাটাচ্ছিল। 

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য দর্পনারায়ণ চৌধুরীর বর্তমান জীবিত প্রজন্ম এই প্রাসাদের একাংশে বসবাস করে। বিশাল প্রাসাদের মেরামতি ও প্রাচীন জিনিসপত্রের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে বিশাল অর্থের প্রয়োজন তা কিছুটা সামলানোর জন্য বাড়ির একাংশ শ্যুটিংয়ের কাজে ভাড়া দিলে তা ভূতের উপদ্রবে পণ্ড হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে গণেশ ভূতোরিয়া এই প্রাসাদ ভেঙে শপিং মল তৈরির চেষ্টা চালালে ভূতেরা একযোগে সেই মতলব পণ্ড করে দেয়। 

ভূতেরা নিজেদের পিকনিক, চিংড়ি ইলিশ লড়াই, কার্গিল যুদ্ধের বর্ণনা, যুবক ভূত পাবলো পত্রনবীশ এবং যুবতী ভূত কোয়েল ধর নিজেদের জীবিত জীবনের আলোচনায় বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। এইভাবেই কাটছিল ভৌতিক জীবনযাপন। এক ভূত চতুর্দশীর রাতে ভূতেদের ফাংশন এবং ফ্যাশন প্যারেড চলার সময় ব্রিগেডিয়ার যুধাজিত প্রোমোটার গণেশ ভূতোরিয়াকে দেখে ফেলে এবং তাকে এলাকা ছাড়া করার পরিকল্পনা করে সকলকে সঙ্গে নিয়ে। 

গণেশ ভূতোরিয়ার মৃত স্ত্রী লক্ষ্মী ভূতোরিয়াকে কাজে লাগানো হয়। হাতকাটা কার্তিক গণেশ ভূতোরিয়াকে প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানায়। তাকে বোঝানো হয় সেখানেই বাড়ির দলিল হস্তান্তর হবে। কিছুটা নাচ, গান ও মদ্যপানের মধ্য দিয়ে বিষয়টা সেলিব্রেট করা হবে। ভূতোরিয়া প্রাসাদে এলে লক্ষ্মী ভূতোরিয়ার নাচে উৎসাহিত হন গণেশ ভূতোরিয়া। আগাগোড়া ঘোমটা টানা লক্ষ্মী ভূতোরিয়া যখন গণেশ ভূতোরিয়ার সামনে নিজের অগ্নিদগ্ধ মুখ প্রকাশ করে, কোনোমতে তখন সেই ভৌতিক পরিবেশ থেকে পালিয়ে বাঁচে গণেশ ভূতোরিয়া। অয়ন এই কাহিনী শোনে বিপ্লব চৌধুরীর কাছ থেকে। একটি ফোনের আওয়াজে অয়নের যখন ঘুম ভাঙে তখন সে দেখে তার সামনে এক থলি মোহর পড়ে আছে। 

ভূতেদের দেওয়া টাকায় ভূতের বলা কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে সেই ভূতুরে প্রাসাদেই ভূতেদের ওপর তৈরি হল সিনেমা ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’।  প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *