নীলাদ্রি পাল

বাংলার আনাচে কানাচে প্রতিবেদনটি ‘প্রতিভাস’ ওয়েব ম্যাগাজিনের পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। আমাদের প্রতিদিনের চলার পথের ধারে চোখের সামনে থাকা বিভিন্ন স্থাপত্যের পিছনে যে বিশাল ইতিহাস বা বিভিন্ন ঘটনা রয়েছে সেই বিষয়ে আমরা জানি কজন? সেসব নিয়েই এই প্রতিবেদন বাংলার আনাচে কানাচে। ম্যাগাজিনটির অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর সংখ্যায় আলোচনা করব খোদ কলকাতা শহরের রোমহর্ষক ঘটনা সমূহ নিয়ে। অর্থাৎ কলকাতার বিভিন্ন স্থাপত্য ও বিভিন্ন জায়গা নিয়ে যে ভৌতিক গল্প জড়িয়ে আছে, সেই গল্প বলব এই তিন সংখ্যায়। এবার শেষ পর্ব…..

গত নভেম্বর সংখ্যায় ব্রিটিশ কর্তাদের ব্যবহৃত বাড়ির সঙ্গে জড়িত ভৌতিক কার্যকলাপ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের প্রতিষ্ঠিত তাদের কাছাড়ি বাড়ি ক্লাইভ হাউসের সঙ্গে জড়িত ভৌতিক কার্যকলাপের পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতার আধুনিক সত্য ইতিহাস প্রথম মুদ্রণ আকারে প্রকাশ করেছিলাম এই ধারাবাহিক প্রতিবেদনে। এইবারে আবার ফিরে আসি কলকাতার অন্যান্য জায়গাকে নিয়ে রটিত ভৌতিক কার্যকলাপের প্রসঙ্গে। 

ব্রিটিশ আমলে গভর্নর জেনারেলদের বাড়ি, বর্তমানে আলিপুরের ন্যাশনাল লাইব্রেরির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভৌতিক কাহিনী। একটা ত্রিকোণ প্রেম ও ডুয়েলের গল্প নিয়ে সেই ভৌতিক কার্যকলাপ। একটা ভুতুড়ে পালকির আনাগোনা নিয়ে সেই ত্রিকোণ প্রেম ও ডুয়েলের গল্প। এছাড়াও বিভিন্ন আত্মার আনাগোনা ছড়িয়ে আছে ন্যাশনাল লাইব্রেরির আনাচেকানাচে। বিভিন্ন গল্পের মধ্যে বহুল প্রচলিত গল্পটি হল লর্ড মেটকাফের স্ত্রীর আত্মাকে নিয়ে। অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন প্রিয় ছিলেন লেডি মেটকাফ। লাইব্রেরির বই ঘাঁটাঘাঁটি করে কেউ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখলে খুব বিরক্ত হন তিনি। অনেক লাইব্রেরির সদস্য ও নাইট গার্ড তার উপস্থিতি টের পেয়েছেন ও পদশব্দ শুনেছেন। 

ডালহৌসি অঞ্চলের দিকে এবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যাক। জেনারেল পোস্ট অফিস (জি পি ও) যেখানে অবস্থিত, সেই অঞ্চলেই আগে ছিল পুরনো ফোর্ট উইলিয়াম। এখানে যারা রাত্রিকালীন কর্তব্য পালন করেন, তারা মাঝেমধ্যেই অনুভব করেন ছায়ামূর্তির আনাগোনা ও ঘোড়ার ডাকের শব্দ। 

এবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যাক ডালহৌসি অঞ্চলের বিখ্যাত বাড়ি রাইটার্স বিল্ডিংয়ের দিকে। ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সেনাপতি রাজা মানসিংহের কাছ থেকে হালিশহর থেকে ডায়মন্ডহারবার পর্যন্ত আটটি বিস্তির্ণ পরগনার নিষ্কর জায়গীর এবং রায় ও চৌধুরী উপাধি লাভ করেন সাবর্ণ গোত্রীয় লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়। কলকাতার জমিদার হয়ে লক্ষ্মীকান্ত পরিচিত হন রায় লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় মজুমদার চৌধুরী নামে। পত্তন হয় সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের। বর্তমানে রাইটার্স বিল্ডিং যে স্থানে অবস্থিত সেখানে লক্ষ্মীকান্ত তাঁর জমিদারির কাজ সামলানোর জন্য গড়ে তোলেন কাছাড়ি বাড়ি। এটিই কলকাতার প্রথম কাছাড়ি বাড়ি। জমিদারি আমলে সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের এই কাছাড়ি বাড়িকেই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সংস্কার করে তাদের করণিকদের বসবাস করার জন্য গড়ে তোলে। পরবর্তীকালে এটি ব্রিটিশদের প্রশাসনিক ভবনে পরিণত হয়। কলকাতা পুলিশের অত্যাচারী ইন্সপেক্টর জেনারেল সিম্পসনকে ১৯৩০ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামী বিনয়, বাদল, দীনেশ এইখানে হত্যা করেন। ভীষণ মাত্রায় স্বদেশি বিরোধী সিম্পসন বিভিন্ন নতুন ধরনের কৌশলে বিপ্লবীদের ওপর অত্যাচার করতেন। সিম্পসনের অতৃপ্ত আত্মা এখনো রাইটার্স বিল্ডিংয়ে দাপিয়ে বেড়ায় বলে মনে করেন অনেকে। এছাড়াও অনেক অলৌকিক কার্যকলাপ এখানকার রাতের রক্ষীদের চোখে পড়েছে বলে শোনা যায়। 

রাইটার্স বিল্ডিংয়ের অদূরে হেঁটে এবার ঢুকে পড়া যাক কলকাতা পুলিশের হেডকোয়ার্টার লালবাজারে। শোনা যায় জমিদারি আমলে এখানে সাবর্ণদের আস্তাবল ছিল, আর ছিল জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনীর বারাক। যে লাঠিয়াল বাহিনীর প্রধান ছিলেন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির দাদু জন ফিরিঙ্গি। রাইটার্স বিল্ডিং ও লালবাজারের আশপাশের কোনো এক স্থানে ছিল সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের শ্যামরাইয়ের মন্দির। যে শ্যামরাই পরবর্তীকালে হালিশহরে স্থানান্তরিত হয়। শ্যামরাইয়ের এই মন্দিরে দোল উৎসব পালন করা হত। সাবর্ণ পরিবারের মহিলারা এই শ্যামরাইয়ের মন্দিরে এসে দোল খেলতেন। দোল খেলার পরে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের বিপরীতের দিঘিতে এসে স্নান করতেন। দোল খেলার রঙে দিঘির জলের রং হয়ে উঠত লাল। সেই থেকে ওই দিঘির নাম হয় লাল দিঘি। দোল খেলার পরে সাবর্ণ মহিলাদের স্নান করা দেখতে জোব চার্ণক তাঁর বাহিনী নিয়ে এসে হাজির হন লাল দিঘির পাড়ে। সাবর্ণ লাঠিয়াল বাহিনীর প্রধান জন ফিরিঙ্গি ও তাঁর লাঠিয়াল বাহিনী জোব চার্ণককে ওই স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য করেন। 

যাইহোক, লোকমুখে কথিত আছে লালবাজারের সেন্ট্রাল লক আপে নাকি রয়েছে ভূতের আনাগোনা। ফিরে যাওয়া যাক নকশাল আমলে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে। ১৯৭২ সালের ২৮ জুলাই নকশাল নেতা চারু মজুমদারের রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয় লালবাজারের এই সেন্ট্রাল লক আপে। শোনা যায় এরপর থেকে অনেকবার সেন্ট্রাল লক আপের সংলগ্ন জায়গায় দেখা গেছে চারু মজুমদারের অশরীরী ছায়ামূর্তিকে। দেখতে পাওয়ার পরমুহুর্তে মিলিয়ে যায় সেই অশরীরী ছায়ামূর্তি। কখনো শোনা যায় তার আর্ত চিৎকার। 

এবার চলে আসা যাক ধর্মতলার এস এন ব্যানার্জী রোডে অবস্থিত লাল রঙের কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনে। অশরীরী কার্যকলাপের ক্ষেত্রে এই বাড়িটিও অন্যান্য ভৌতিক কার্যকলাপের বাড়িগুলো থেকে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। গভীর রাতে নিরালা পরিবেশে মহিলা কণ্ঠের কান্নার আওয়াজের সাথে বিভিন্ন বিচিত্র আওয়াজ শোনা যায়। 

এস এন ব্যানার্জী রোড থেকে জওহরলাল নেহেরু রোড ধরে এগিয়ে গেলে পার্ক স্ট্রিটের আগে বাঁদিকে যে বিরাট লম্বা সাদা বাড়িটি পড়ে, সেটি হল ভারতীয় জাদুঘর। মিশর থেকে আনা মমি নিয়ে এখানে রয়েছে অনেক রহস্য। মিউজিয়ামের বারান্দায় রাতে শোনা যায় পায়ের নুপুরের ধ্বনি। কখনো দেখা যায় সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে একজন শ্রমিক বন্ধ ঘরের দরজা ভেদ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। হলঘরের স্কাইলাইট পরিষ্কার করার সময় দুটো ভারি শোকেসের মাঝে চাপা পড়ে ওই শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছিল বহুদিন আগে। মুখোশের গ্যালারিতে সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় অনেকের মনে হয়েছে পাশ দিয়ে অন্য কেউ বোধহয় পাশ কাটিয়ে চলে গেল। কিন্তু সে অদৃশ্য। মিউজিয়াম চত্বরের মধ্যে আশুতোষ জন্ম শতবার্ষিকী হলে রাতের বেলায় এক অশরীরী রোজ হলের দরজা দিয়ে ঢুকে হলঘরে প্রবেশ করে। হলের চলাচলের রাস্তায় কোনো প্রহরী শুয়ে থাকলে তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয় সেই অশরীরী। 

মিউজিয়ামের ঠিক পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা মৌলালী জোড়া গির্জার দিকে চলে গেছে সেটি হল সদর স্ট্রিট। এখানে বিদেশি পর্যটকদের থাকার জন্য অনেক বাসস্থান রয়েছে। অনেক বছর আগে মিস্টার স্পিক নামে এক বিদেশি নাগরিক থাকতেন এখানে। কোনো বিষয় নিয়ে আর্জি জানাতে স্পিক সাহেবের কাছে এসেছিলেন এক শিখ যুবক। কিন্তু আর্জির বিষয় নিয়ে বচসা বাঁধে দু’জনের। বচসা চলাকালীন শিখ যুবকটি হঠাৎ করে চড়াও হন স্পিক সাহেবের ওপর। সম্ভবত সাহেব বা তাঁর কোনো রক্ষীর ছোড়া গুলি এসে লাগে শিখ যুবকটির শরীরে। লুটিয়ে পড়ে মারা যায় সে সেখানে। জনশ্রুতিতে প্রকাশ, এখনো মাঝেমধ্যে এখানে ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ভুল করে কেউ সেই ঘটনা দেখতে গেলে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় সবকিছু। 

কলকাতার পুরনো বাড়িগুলোতে রয়েছে পুরনো কলকাতার বিভিন্ন কড়চা। প্রোমোটারির কবলে বর্তমানে অবশ্য বিশেষ স্থাপত্যশৈলীর বাড়িগুলি তাদের পুরনো ঐতিহ্য হারিয়ে নতুন ফ্ল্যাট হিসেবে গজিয়ে উঠছে। কোনো কোনো জায়গায় দেখা যায় আইনি জটিলতায় পুরনো বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট করার প্রবণতা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তার বাস্তবায়ন হয় না। হয়তো বা অশরীরীরা নিজেদের বাসস্থানকে আগলে রাখে। ঠিক যেমনটা দেখানো হয়েছিল ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ ছায়াছবিতে। বাড়িতে শ্যুটিং পার্টি যখন ভূতেদের শান্তিতে বিঘ্ন ঘটিয়ে বাড়ির ভূতকর্তাকে উপেক্ষা করছিল তখন নায়িকাকে ভয় দেখিয়ে শ্যুটিং পার্টিকে জব্দ করেছিল ভূতেরা। আবার যখন বাড়ির প্রোমোটারকে ভূতের ভয় দেখিয়ে বাড়িটিকে প্রোমোটিংয়ের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল একদল বিভিন্ন সময়ের এবং বিভিন্ন বয়সের একত্রে বসবাসকারী ভূতেরা। 

“শেষ পর্যন্ত ভূতেরা ঘুরে দাঁড়াল। চৌধুরী বাড়িতে সৃষ্টি হল এক নতুন ইতিহাস। পড়ে পড়ে মার খাওয়া ভূতেদের ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস”।  প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *