পাঠক মিত্র

এক অনন্য ঘ্রাণের কাব্য

অনুভূতি শব্দটির ক্রিয়া সকলের ক্ষেত্রে এক হবে তা কখনোই হতে পারে না । সমস্ত ক্ষেত্রেই। যে কোন বিষয়েই হোক না কেন । প্রেম, প্রকৃতি, সুখ, দুঃখ, আনন্দ কষ্ট যা কিছুই হোক না কেন । এমনকি জীবনের স্রোতে ভেসে যেতে যেতে চারপাশের স্পর্শ, গন্ধ, রঙ সকলের কাছে একরকম হবে তাও নয় । তবে অনুভূতির রঙকে রূপকে ধরে রাখতে পারে মানুষ তাঁর হৃদয়ে । যা স্মৃতির উজান বেয়ে জানান দিয়ে যায় নির্জনতায়, নিঃসঙ্গতায় কিংবা কখনো কোন বিশেষ মুহুর্তে । সমস্ত কিছুই হৃদয় ও মনের ক্যানভাসে সীমাবদ্ধ যা বয়ে যায় সময় বিশেষে, পরিস্থিতি বিশেষে। কিন্তু লেখক ও কবিরা এই সীমাবদ্ধ অতিক্রম করতে পারেন । তাঁদের অনুভূতির রঙ, রূপ, রস সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা কিছু নয় । তবে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন । নির্জনতা, নিঃসঙ্গতা সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে অন্য মাত্রায় বয়ে নিয়ে চলে । তাই সেই অনুভূতি তাঁরা কেবল হৃদয়ে লিপিবদ্ধ করে রাখতে পারেন না, কলমের শব্দবৃষ্টিতে খোদাই করে তার রূপ, রঙ, গন্ধ সংমিশ্রণে নির্মাণ করেন এক একটি ছবি। আবার সেই ছবির এক একটির রূপ, রঙ, ঘ্রাণ আলাদা আলাদা মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ে । ছবির রূপ, ছবির রঙ আকর্ষণের ক্ষমতা রাখতে পারে, কিন্তু সেই ক্ষমতা টিকে থাকবে তখনই যদি তার ঘ্রাণ থাকে । যে ঘ্রাণের মাদকতায় সৃষ্টিকারী আবিষ্ট হয়ে সৃষ্টিতে মাতে । সেই সৃষ্টির ঘ্রাণই আবার অন্যকে মাতিয়ে তোলে । নির্জনতার ঘ্রাণ, নিঃসঙ্গতার ঘ্রাণ, এমনকি মৃত্যুর ঘ্রাণ থেকে ভাষার ঘ্রাণে যখন সৃষ্টিকারী ডুব দেয়, তখন তাঁর সৃষ্টি পাঠকের মনকে ভরিয়ে দিতে পারে । এমনই এক সৃষ্টি ‘মোমের ঘ্রাণ’ । ছোট ছোট স্তবক আর মুক্তগদ্যের শরীরের ঘ্রাণে গড়ে উঠেছে ‘মোমের ঘ্রাণ’ । কবি দীপক দাস-এর এই কাব্যগ্রন্থে সেই ঘ্রাণের বাষ্প নির্গত হচ্ছে । সেই বাষ্পে কেউ খুঁজে পেতে পারে কিছু অনন্য স্পর্শ।  কেউ প্রেম ও অপ্রেমে ফেলে আসা স্মৃতির কোটরে ঢুঁ দিতে পারে যা পাওয়া না-পাওয়া র এক দার্শনিক বিশ্লেষণ মগ্ন করে তুলতে পারে । যে বিশ্লেষণে জীবনের অশান্তির পথচলায় আলাদা শান্তির খোঁজ দিতে পারে, তাকে স্পর্শ করার বাসনা তৈরি করতে পারে। 

অনুভূতির বিশ্লেষণে শান্তির পথ দৃশ্যমান হয় যখন নিজের দোষ, ত্রুটি, অপরাধ, অকৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে পারার মধ্য দিয়ে। হয়তো তখন সময়ের পথ চলা অনেকটাই হয়ে গেছে, কিংবা সময়ের বিবর্তন হয়েছে অনেকটাই। তখন স্বীকার করার আকুতির ঘ্রাণ মানসিক তৃপ্তি দিতে পারে অনেকটাই।  প্রিয়জনের অদৃশ্য উপস্থিতির নিকট এমনই তৃপ্তির স্বীকারোক্তি কবি দাসের এই কাব্যগ্রন্থে।

‘যদি কোনো অপরাধ করে থাকি/ক্ষমা কোরো শামসের’ কিংবা ‘এই ডুবে যাবার ভিতর/এই ক্রমাগত মিথ্যা যাপনের ভিতর/শুধু..শুধু তোমাকেই খুনি ভেবেছি’ বা ‘তবে তুমি যে কবিতার মতো কখনো সাবলীল ছিলে না/ তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই’ — এমন স্বীকারোক্তি কোন জটিলতায় ভরা নয় । সফলতার ঘ্রাণকে কবি ভাষার জালে আবদ্ধ করতে পেরেছে । 

আবার স্বীকারোক্তি অক্ষমতা, কর্তব্যহীনতার যন্ত্রণা তাঁর শব্দবৃষ্টির জলে এক নিস্তব্ধ শান্তি খুঁজে পেতে চেয়েছে। পিতৃহারার যন্ত্রণায় সম্বিৎ ফিরে পেয়েছে চিতার লেলিহান শিখায় । কবি দাস তাই লিখতে পেরেছে–‘আমার ধমনীতে তোমার নিথর দেহ/সমস্ত নিস্পৃহতাকে তাচ্ছিল্য করে বলছ–/দেখ, হেরে গিয়েও কীভাবে জিতে যাওয়া যায়’/..’জ্বলন্ত চিতার ক্রোধ/তীক্ষ্ণ নীরবতাকেও হার মানায় ।’ পিতার মৃত্যুতে কবি মহাশূণ্যে হারিয়ে গেছে । কবি বলছে, ‘চিতায় বাবা জ্বলতে থাকে, আর আজীবন বাবার আগুনে আমি পুড়তে থাকি..খাঁ..খাঁ..নিদারুণ পুড়তে থাকি..মহাশূণ্যতা আমার চারপাশ জুড়ে ।’ এই শূন্যতা থেকে বাবার স্মৃতির সবকিছুই রয়েছে, কিন্তু যেটা নেই কবির সেই অনুভূতি যেন সমাজের ছবিটাকেও যেন ইঙ্গিত করে । ‘তবে যেটা নেই/সেটা হল–একটা টানটান শিরদাঁড়া/একটা মজবুত মস্তিষ্ক/আর, এক উঠোন চলাচল করা সাদা বাতাস’ । এই কাব্যগ্রন্থের পঞ্চান্নটি কবিতার মধ্যে নয়টি কবিতার বিষয় ‘বাবা’ । বাবার মৃত্যু কবির চেতনায় মৃত্যুচেতনার তরঙ্গে অন্যমাত্রায় যেন তরঙ্গায়িত হয়েছে । তাই নিরাসক্ত জীবন হাস্যকর হয়ে ওঠে এমনকি তার অতীত ও ভবিষ্যত সবই । কবি কখনও সকলকে মৃত্যুমুখর দেখতে পায়, আবার কোথাও মৃত্যুকে শারীরিক শীতলতা ছাড়া কিছুই অনুভব করতে পারে না। 

মৃত্যুচেতনার গভীরে চলমান সময়ের ঘ্রাণ অনুভবে সমাজের ক্রূরতার ছবি এঁকে চলে । যে ক্রূরতা প্রকৃতি আর নারীকে বিধ্বস্ত করে চলে একদল অত্যাচারী । তার বিরুদ্ধে যে কোন প্রতিবাদই সূচনা অক্ষর হয়ে জেগে ওঠে যেন। ‘যুগের পর যুগ চলেছেন সরু যোনিপথ পেরিয়ে/..এখান থেকে কামদুনির উচ্চতা খুব বেশি নয়/..তুমি হয়তো নক্ষত্রহীন সন্ত্রাসের আবহ অতিক্রম করে পৌঁছে গেছ/..তোমার দুধের বোঁটা থেকে ঝরে পড়ছে লুটে নেওয়া ইজ্জত কথা/..অত্যাচারীর ক্রূরতা ভেদ করে কোর্ট রুম জেগে ওঠে /..এই অনিশ্চিত কয়ামৎ থেকে জেগে উঠবৈ  সূচনা অক্ষর ।’ কবির প্রতিবাদ ঝরে পড়ে নিঃশব্দ বৈষম্যের গাণিতিক সংকেত । ‘তোমাদের মিথ্যা বুদবুদের মত উড়ে যায়/আর সেই মিথ্যায় দেখো অজস্র ক্ষত মুখ । তাই মানুষের কাছে ভাত ছাড়া মিছিলের অন্য কোন রং নেই। সেই ভাত রাষ্ট্রের হাঁড়িতে ফুটছে । আর পতাকা হাতে দৌড়ে চলেছে সকলে । কবির চেতনায় বৈষম্যের ঘ্রাণের এক ছবি দিয়ে পর্দার আড়ালে ক্রূরতার জনককে দেখিয়ে দিতে পেরেছে । ‘ভাত এবার সেনসেক্স নিফটি ছুঁয়ে ফুটপাতের স্তনে/ বোকা পথশিশুটি হাঁ করে ঈশরকেই দুষছে …’ । এই লাইন কবির মৃত্যুচেতনার সব দর্শনকে অতিক্রম করে যায় । জ্বলন্ত মোমবাতির ক্ষয়ে যাওয়া মোম-ঘ্রাণের উষ্ণতায় শুধু মৃত্যুচেতনার কাছে সকল স্বীকারোক্তি নয়, সেই উষ্ণতায় জেগে ওঠে কয়ামতের এক সূচনা অক্ষর। সেই অক্ষরবৃষ্টির ঘ্রাণের বাষ্পে অক্ষর-বৃত্তে কবি দাস যে রামধনু এঁকেছেন তা অনন্য। তবে এই বৃত্তে না-বলা কথার ঘ্রাণ আছে । অথচ কবির ‘কথামুখ’ অনুপস্থিত থাকায় সেই ঘ্রাণের ইঙ্গিত থেকে পাঠক একেবারেই বঞ্চিত হলেও ‘মোমের ঘ্রাণ’ পাঠকের ইন্দ্রিয়কে কবিতার অনন্য ঘ্রাণে আবিষ্ট করবে। প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine

মোমের ঘ্রাণ/দীপক দাস

শহরতলি, মালদা- ৭৩২১০১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *