মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস
পর্ব – ৩০
রূপলাগির সমীর কাকার কথা মনে পড়তে মনে পড়ল রবি কাকার কথাও। রূপলাগি থেকে একটু দূরেই ট্রপিকাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার ছিল। আর আরেক পাশে ছিল সেবাসদন। ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো বাবার সূত্রে পরিচিত ছিল। খুব ছোট থেকে ঘন ঘন প্রবল সর্দি-কাশিতে ভুগতাম বলে মাঝে মাঝেই আমাকে নানার টেস্টের খপ্পরে পড়তে হতো। সকাল সকাল খালি পেটে বাবা কখনো পাঠিয়ে দিত ট্রপিকালে বা কখনো আবার সেবাসদনে। কালনার রাস্তার দুই পাশেই তখন পুরোনো পুরোনো মোটা দেওয়াল, উঁচু বারান্দাসমেত বাড়ি দেখতে পাওয়া যেত। এইরকমই একটা বাড়ির একতলাতে ট্রপিকাল চলত। আমি গেলেই ট্রপিকালের অন্যতম মালিক রবিকাকা নানা রকম মজা করত। সকাল সকাল অনেকেরই খালি পেটে রক্ত দেওয়ার তাড়া থাকতো। জমা হওয়া মল মূত্রের স্যাম্পেল হ্যাণ্ডেল করতে হরিজন পাড়ার কেউ কেউ থাকতেন এই সব সেন্টারে। আমরা এখনকার বাচ্চাদের মতো অতি স্মার্ট ছিলাম না। কোথাও বসতে বললেন চুপ করে বসে থাকতাম আর দেখতাম অনেক রকম মানুষের আসা-যাওয়া, কর্মীদের কাজকর্ম। যাবার আগে বাবা হাতে কিছু অল্প টাকা দিয়ে দিয়ে বলতেন যে বউনির সময় কিছু দিয়ে আসতে হবে। বাবার সাথে নিশ্চয়ই অন্য বোঝাপড়া থাকতো কাকাদের, যেমন সমস্ত ডায়গনস্টিক সেন্টারের সাথে চিকিৎসকদের একটা বিশেষ বোঝাপড়া থাকে। রবি কাকার দুই মেয়েকে আমি পরবর্তীকালে আমার ছাত্রী হিসেবে পেয়েছিলাম।
রবি কাকাও আর ইহজগতে নেই, এই কথা জেনে সে সব পুরনো কথাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল।

সিদ্ধেশ্বরী মোড়ের শংকর নার্সারির দোকানটার উল্টোদিকে রাজদার যে অ্যাকোরিয়াম, রঙিন মাছ ইত্যাদির দোকানের কথা পূর্বে বলেছিলাম সেখানে রাজদার বাবার একটা কাপড়ের দোকান ছিল। যতদূর মনে হয় দোকানটার নাম ছিল টাঙ্গাইল বস্ত্রালয় বা এইরকম কিছু। দোকানের নামটাই আমার কাছে বড় অদ্ভুত লাগতো। পরে একটু বড় হয়ে বুঝতে পেরেছিলাম যে টাঙ্গাইল এক ধরনের শাড়ি, এবং এটা বাংলাদেশে পাওয়া যায়। রাজদা বলে ডাকলেও সম্পর্কে কাকা। রাজদার বাবাকে দাদু বলে ডাকতাম। দাদু ক্যুরিয়ার সার্ভিস শুরু করেছিলেন পরবর্তীকালে। ওনার ছেলে এই ব্যবসাটাকেও ধরে রেখেছে।
কালনার এরকম পুরনো পুরনো জিনিসের কথা হঠাৎ মনে পড়ে। যেমন এখন যেখানে বিশাল আকৃতির বিশাল মার্ট হয়েছে সেখানে আগে ছিল অশোক শ মিল। স্টেশন থেকে বাড়ি আসার পথে রাতের পূর্ণসিনেমা পার করে শুনশান চড়ক তলা, প্রায় গ্রাম্য ঘর বাড়ি, কবরখানার ছমছমে হাতছানি সব হারিয়ে গেছে মাল্টিপ্লেক্স আর ব্যাঙ্কোয়েট হলের চাকচিক্যে। সাউ সরকার মোড় থেকে শশীবালা স্কুলের দিকে যাবার রাস্তার কথা মনে আছে কারো! কি চুপচাপ! কি নিস্তরঙ্গ! পুরোনো সব বাড়ির সারি। না ছিল তারা মা মিষ্টির দোকান, না কাঠের আসবাব বানানোর দোকানটা। আবার এই দুটো দোকানের ও স্থায়িত্ব ছিল না বেশি দিন।

পাল্টে যাওয়াই ধর্ম শহরের। একদিন হয়ত হঠাৎ পুরোনো পাড়ায় হাজির হয়ে ভাবব, এটাই কি আমার পাড়া! পুরোনো সব বাড়ি তার প্রাচীন খোলস তো আমি থাকতে থাকতেই পরিবর্তন শুরু করেছিলো। শর্মা বাড়ি, সাগর দত্তের বাড়ি, হাত বদল হওয়া আরও কত বাড়ি -নতুন নতুন রূপটানে যৌবন ধরে রাখছে। আর কেউ কেউ নতুন শরীরে নতুন আত্মায় আত্মপ্রকাশ করছে। শুধুমাত্র সিদ্ধেশ্বরী মোড়ের কাছে দাঁড়ালেই যতটা পাল্টা হাওয়া আমাকে ঘায়েল করে, আমি আর ভাবতে পারি না বেশিদূর। নব্বই পঁচানব্বই সাল বুকের মাঝে ধাক্কা দেয়। বৈদ্যনাথ স্যারের বাড়ি, সামনে কুয়োওয়ালা মুদিখানা, চপ দোকান, সরিৎ স্যারের বাড়ি, ছোটদেউড়ির দিকে ছুট দেওয়া প্রায় অন্ধকার গলি, সিদ্ধেশ্বরী মায়ের মন্দিরের ওপাশে গঙ্গার হাওয়ায় শুনশান সন্ধ্যার নেমে আসা সব যেন এক লহমায় আমায় বলে, এই মোড়ের মাথার ঝকঝকে চকচকে আলোগুলো মিথ্যে। এরা আমার নয়, এরা কোনোদিন ভালোবাসেনি আমায়। প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)
