শরদিন্দু সাহা
লেখক পরিচিতি
বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।সম্প্রতি লেখক ‘দীপ্তি রায়চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২৪’-এ সম্মানিত হয়েছেন।
বিষয় পরিচিতি
(রেভারেন্ড জেমস্ লঙ যে লক্ষ্য স্থির রেখে জীবনকে চালনা করেছেন তা শুধুমাত্র ঘটনাক্রম দিয়ে ধরা যায় না। তাঁর কর্মজীবনের পরিক্রমায় যে অন্তর্নিহিত শক্তি ও প্রভাব রয়েছে তাকে কোনও এক শিল্প মাধ্যম দিয়ে উপলব্ধি করা যায় না। কারণ কোনো সরলরেখায় তিনি তাঁর কাজকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, নানা উত্থান পতন ঘাত প্রতিঘাত তাকে পীড়িত করেছিল, বিপর্যস্ত করেছিল। তিনি প্রবল আত্মশক্তিতে তার মোকাবেলা করেছিলেন এবং কর্তব্যকর্মে অটুট ছিলেন। তাঁর কাজের পরিধি ও ব্যাপ্তি একজন শিক্ষকের, সমাজসেবকের, মানবপ্রেমির যা মূলত শাসক ও শোষিতর মাঝখানে একজন প্রতিবাদীর, সত্যবাদীর, বলা যায় একজন দ্বান্দ্বিক ব্যক্তিত্বের। যার না-বলা কথা, জানা-অজানার কল্পনা ও বাস্তবের মিলন নিয়ে উপন্যাস লেখা সম্ভব অসম্ভবের দোলাচল মাত্র, তবুও শব্দের মায়ায় ধরার সামান্য প্রচেষ্টা। কোথায় তার অন্ত হবে প্রকৃত অর্থে বলা খুব কঠিন। এই মহান মানুষটির শৈল্পিক জীবনকে ছুঁয়ে যাওয়া আর কি।)
জ্বালাও আলো পথের ধারে
একদিন এমনও হতে পারে পৃথিবীর সকল সত্য আকাশ মাটি সমুদ্রের সঙ্গে মিলেমিশে সত্যের এক নতুন সংজ্ঞা তৈরি করবে। কী জানি কে বলতে পারে আমি জেমস্ লঙ সেদিন যদি কোনো এক গোধূলির বিকেলে দৃষ্টি হারিয়ে ফেলি আর সেই অন্ধ কুঠুরিতে এমন এক জীবনের সন্ধান পেয়ে যাই যেখানে সকল মৃত্যুও জন্মের বেশে এসে হাজির হবে। তখন কী আমি এক নতুন মূল্যায়নে ব্যস্ত হবো যা নিমেষে সবকিছু পাল্টে দিতে পারে, আমার কল্পনাশক্তিকে ভেঙে চুরমার করে জন্ম দিতে পারে এমন এক শক্তি যা থেকে পালানোর ক্ষমতা আমার নিজেরও নেই। আমি এখন দ্বিধাগ্ৰস্ত, যে মুখগুলো আমায় স্বস্তি দিচ্ছে না, কেবলই ছড়িয়ে দিচ্ছে এমন শব্দতরঙ্গ ‘কিছু করুন সাহেব-বাবা, এমন কিছু করুন যাতে আমাদের কথাগুলো ওদের মনে গিয়ে ধাক্কা মারে।’ কথাগুলোর ওজন যে নেই তা আমি কেমন করে বলি। ওরা যে নিত্য যন্ত্রণায় বলি হচ্ছে, এ-কথা কী অস্বীকার করার জো আছে। হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় মিলিটারি অডিটর জেনারেলের অফিসে সহকারী অডিটরের দায়িত্ব সামলে ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকার সম্পাদকের ভূমিকায় দিনরাত এক করে ফেলছেন। কী করে যে এত কর্মকাণ্ড সামলাচ্ছেন শুনেও শ্লাঘা বোধ হয়। সংবাদের গতিপ্রকৃতি দেখে মনে হয় আসলে যে কথাগুলো আশু প্রয়োজন, একদম গোড়া থেকে টান মারছেন, লোকটার এলেম আছে, কোনো তোষামোদির ধার ধারেন না। একজন নির্ভীক সম্পাদকের যা যা গুণ থাকা দরকার, তা তো ধারন করছেনই, মাঝে মাঝে মনে হয় উপছে পড়ছে নায়াগ্রার জলপ্রপাতের মতো। কত কথাই না কানে আসে – অসম্ভব মেধাবী ও বড় হৃদয়ের মানুষ। এমন একজন মানুষ বাঙালির জীবনে বোধ হয় বড় প্রয়োজন। শুধু কী তাই, যখন থেকে রাজনৈতিক দাবিদাওয়া আদায়ের মঞ্চ রাজা রাধাকান্ত দেবদের নেতৃত্বাধীন ল্যান্ড হোল্ডারস সোসোইটি আর রামগোপাল ঘোষ ও প্যারিচাঁদ মিত্র মহাশয়ের পরিচালনাধীন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি মিলেমিশে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন হলো, এই ভদ্রলোকই হাল ধরলেন যদি নতুন কলেবরে এর কার্যক্রম শুরু করা যায়। কী অভিপ্সা আর কী উন্মাদনা, এমন লক্ষ্য স্থির রেখে চলার মানুষের বড় তো অভাব। অনেকেই তো সুযোগ খুঁজছেন বড় সাহেবদের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বাড়তি সুবিধা আদায় করে নেওয়া যায় কেমন করে, দেশের মানুষের মুখগুলোর কথা কী ওদের মনে পড়ে তখন! গাঁ-গঞ্জের মানুষরা ওদের নজরেই আসে না, আসে শুধু ওই ভাবনা যাতে হরিশ্চন্দ্রের মতো মানুষদের বদনাম করে, লোক ক্ষেপিয়ে, ইংরেজদের মন বিষিয়ে দেওয়া যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় ইংরেজরা দেশীয়দের যত অমঙ্গল করে, স্বদেশীরাই করে শত গুণ বেশি। কে আপন, কে পর, বোঝা দুষ্কর।
এই নদী কোন নদী আমি কেমন করে জানবো! কত খাল বিল এসে মাথা গলিয়েছে, তাই তো দেখে দেখে আমি মন জুড়োই। মনে তো হয় থাক এশিয়াটিক সোসাইটির অত তাল তাল পুস্তক আর পুঁথিগত বিদ্যা, আগে তো জীবন থেকে শিখে পড়ে নি, অন্তর জুড়োক, পরে তো বিদ্যা বিলোবো। কাদের জন্য কীসের বিদ্যা ছড়াবো, ঘুরে ঘুরে বুঝলাম তারাও কী কম জানে? মানুষের হুঁশ আর মান ফিরাবো বলেই না এত ক্রোশ দূরে পার করে আসা, ফল কি আর ফলবে? ঘোড়ার ডিম! কত মানুষ তো ধূতি পরে খালি পায়ে কত কত দূর থেকে যে আসছে, ওরা নিজেরাও জানে না কবে গন্তব্যে পৌঁছবে। তবুও ছোট্ট নদীর তির তির করে বয়ে যাওয়া ঢেউ দেখতে দেখতেই ওরা পথ চলে। বুঝে নিতে চায় এই চলা কবে আবার মিলে যাবে কোনো এক অনাত্মীয়র সঙ্গে, ওরা যে মুখ চেয়ে বসে আছে কবে ওই নতুন অতিথির সাক্ষাৎ পাবে। একজন একতারায় সুর তুলে গানের কলি ভাঁজছে, আহা! যেমন কথা, তেমন গায়কী, মনে দাগ কেটে গেল। বললাম, কোথায় যাও? হেসে উত্তর দিল, কোথায় আর যাবো, যেদিকে দুচোখ যায়, সেই আলোতে পথের নিশানা মাপি, না হলে আমরা কী কখনও চেনা পথে হেঁটেছি, না হাঁটার অভ্যাস আছে। লোকটা বেড়ে বলেছে তো, একটু ঝাঁকিয়ে দেখব নাকি। নিজের মনের দোলনায় চড়তে আমার ভেতরটা বড়ো আঁকুপাঁকু করে। কত কিছুই না ধরতে চাই, কিন্তু ধরতে আর পাই কই। পাদ্রী সাহেব দেখে লোকটা তড়িঘড়ি পা চালাতে চাইলো। কী জানি হয়তো ভাবলো, আমি নাছোড়বান্দা, কথার জালে জড়িয়ে ফেলতে পারি। ওর ভাবনাকে উস্কে দিয়ে বললাম, এত কী ভাবছ, ভিন্ন ধর্মের লোক বলে সঙ্কোচ হচ্ছে? বলল, না সাহেব-বাবা, এত ছুৎমার্গ আমাদের থাকতে নেই। মানুষে মানুষে তফাৎ করলে আর গান বাঁধবো কেমন করে! বললাম, গান যে বাঁধো, এত শব্দ খুঁজে পাও কেমন করে? বলল, শব্দই তো সব, শাস্ত্রে একটা কথা আছে – শব্দব্রক্ষ্ম। একটা বজরা তখন ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করে নির্দিষ্ট যাত্রাপথের দিকে এগিয়ে চলেছে। কে বলতে পারে কোন বংশের জমিদার গিন্নি আত্মীয় পরিজন সমেত গল্প গুজবে মেতে আছে, পারের খবর নেবে সে অবসর কোথায়? কত গরীব ঘুরবো ছাপোষা মানুষগুলো কোন পথ দিয়ে হাঁটে, কোন দুঃখ বেদনা ঝোলায় পুরে শরীরের ভার সামলাতে গিয়ে ভেবে নিচ্ছে ওদের গল্পগুলো কবে থেকে তৈরি হয়েছে আসলে কেউ জানে না। আমার ওদের ভাবসাব দেখেই বোঝা উচিত ছিল, ওদের কত জীবনই কতকাল থেকে জং ধরে আছে। লোকটা আবার একতারা বাজিয়ে কত গানের কলিতে সুরের প্রলেপ মাখে। বললাম এত তরঙ্গ যে তৈরি করো, তার মর্মকথার ওজন জানো? বলল, না জানলে চলবে কেন সাহেব, দরদ না থাকলে কখনও কি হৃদয় জাগে? আহা! তুমি তো আমার অন্তরের কথাই তোমার মুখে বসিয়েছ?
বুঝলাম, ওরা ওদের জীবন নিয়ে বাঁচে, নিজেদের ঘরকে মনের মতো সাজিয়ে গুছিয়ে নতুন নতুন স্বপ্ন দেখে, সেই স্বপ্ন ছড়িয়ে দেয় মাঠে ঘাটে, খালে বিলে, মঠে মন্দিরে। কত দিন কত মাস কত বছরে নতুন নতুন কথাকে আলো আঁধারির ছায়াপথে বিছিয়ে দেয়, এই জীবনের ঠিকানা ওরাই একমাত্র জানে, না হলে এত অক্ষরের মালা যে গাঁথবে তার রসদ মিলবে কোথায়! এক ঝাঁক পাখি ডানা নাড়াতে নাড়াতেই আমার চোখের সামনে উধাও হয়ে গিয়ে কোন জলা জঙ্গলে সেঁধিয়ে গেলো, কোন ডাকে গলা ফাটালো, আমার দৃষ্টির আলোয় ধরা পড়তে থাকলেও ছায়ার মতো মিলিয়ে গেল। আমার নির্জনতার স্বাদ আমাকে নিয়ে টানাটানি শুরু করলে, উত্তেজনার পারদটা ওঠানামা করলো সুযোগ বুঝে। পাওনা গণ্ডার হিসাব চাইবে এমন মুরোদ কোথায়, তাই তো ঘাড় বাঁকিয়ে মাথা নীচু করে কারো কাছে কোনো দাবী না জানিয়ে থালাটা উঁচিয়ে ধরে অনুনয় বিনয় করে – দুটো ভাত দেবে গো মা, মাঠের ধান ইঁদুরে খেয়েছে, ঘরের ধান পোকায় খেয়েছে। ছেলেটা কাঁচুমাচু হয়ে হাত দুটো ধরে এমন জোরে হ্যাঁচকা টান মারলো – চল বাপ ঘর চল, মায়ের উনুনে আগুন পোহাবো। ওর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো ফোঁটা ফোঁটা জল। উদোম গায়ে কীসের যেন ছোপ ছোপ দাগ। পায়ের আঙ্গুলগুলো চলতে গিয়ে যেন মটকে গেলো। আমি পথ চিনতে চাইলাম, ওরা ভয়ে ভয়ে চোখের আড়াল হয়ে গেল। ওদের উঠোন থেকে উঠে আসছে সিদ্ধ ধানের জলধোয়া গন্ধ। ওরা আছে তো বেশ, আসর জমিয়েছে বেশ, ঢোল করতাল বাজিয়ে নাম-সংকীর্তনের দল নামিয়েছে, আমার আগমণ হেলায় উপেক্ষা করবে এমন অভদ্র ওরা নয়। ওরা কী খুঁজে বেড়ায়, কেন খুঁজে বেড়ায়! আমি তাহলে যা খুঁজে বেড়াচ্ছি তা কী কেবলই আবেগহীন নিয়মের বেড়াজালে বন্দী, এই প্রশ্ন কাকে করবো? ওদের দল ভেঙে এমন একজন দলছুট পাখির মতো কোনো লক্ষ্য ছাড়াই ঢোল বাজিয়ে নাচতে নাচতে চলে যেতে যেতেই একবার ফিরে তাকালো। বলল, এই দেহের মধ্যে মন যে কোথায় ঘাপটি মেরে আছে, জানতে চাইলেও জানা যায় না, তোমরা বাইরে খোঁজ আর আমরা খুঁজছি অন্দরে, দিনরাত এক করে ফেলছি, পেয়েছি এক ঘোড়ার ডিম। লোকটার কথাতে যে অদ্ভুত জাদু আছে, মাঝে মাঝে চোখ পিট পিট করে আবার কী মনে করে উড়ো উড়ো মেঘের খেলা দেখবে বলে দু’হাতে তালি বাজায়, ঢোলটা নামিয়ে রাখে, কোমরটা বেঁকিয়ে দু’পাক ঘুরে নেয়। একেই কী বলে ছন্দহীনতায় আর এক ছন্দ, বাঁচতে গেলে কী এমন কিছুর প্রয়োজন আছে! হয়তো আছে, নয়তো নেই কিন্তু একটা পথের নিশানা ধরে হাঁটতে হবে, এই প্রশ্ন কী অসংগত? লোকটা ফিক করে হাসলো – রাখো তো সাহেব তোমার গত বাঁধা কথা, আমরা হলেম গিয়ে বেহিসাবি চলার মানুষ, কত আর দেখবে, কেমন করে আর দেখবে, কোনো কুল কিনারা মিলবে না গো। যায় তো সে চলেই যায়, সে কী আর ফিরে আসে কোনদিন? আসলে কী আর তুমি আসবে গো, আসবে তোমার ভাব, এটাও বোঝ না। মরা মরা শুকনো ঘাসগুলো নিয়ে কত আদিখ্যেতাই না করে, মুঠো মুঠো ঘাস মাটি আলগা করে হাতের মুঠোয় নেয়, জলের ঢেউয়ে মিশিয়ে দিতে পেরে ওর কী আনন্দ! আনন্দের ফোয়ারা ছুটিয়ে দলের মানুষ দলেই মিশে যায়, আমার ভাবনার তোয়াক্কা করার ওর কী আর ফুরসত আছে, না কি থাকতে আছে।
হরিশ্চন্দ্রকে বললাম, আপনিও এসেছেন? হরিশ্চন্দ্র আমার কথা শুনেও না শোনার ভান করলো। বললো, আমার জমিন, আমার আকাশ, বাতাসও আমার, আমি আসবো না তো, আপনি আসবেন? হরিশ্চন্দ্র অবলীলায় আমাকে অধিকারের কথা স্মরণ করালো। আরও কিছু কথা বলতে গিয়েও থেমে গেল। চোখের পলকে দূরের গ্ৰামখানার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এ আমার দেশ, আমার দেশের অন্দরে আছে অনেক দেশ, সাহেব আপনাদের দেশের মানুষরা আমার দেশের মানুষকে চিনতেই পারলো না, দেশ শাসন করবে কী! দেশ শাসন করতে এলেম লাগে। হরিশ্চন্দ্র কি বোঝাতে যে চাইলো কি জানি, আরে ইংরেজ জাতের তাকতের অভাব আছে নাকি? তারা চাইলে পারে না, এই ভারত ভূমিতে কিছু আছে! কত দেশে দেশে ইংরেজদের বিষ নিঃশ্বাসের ছোঁয়া লেগেছে, সে কী আমি জানি না। জানতে তো হবেই এমন কিছু আছে বলেই না এত দাপাদাপি। হরিশ্চন্দ্র বলল, লঙ সাহেব মানুষের স্বরূপ নির্ণয় করা এত সহজ নয়, এখানে মাটি, মানুষ ও সময় মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে, উল্টেপাল্টে দেখুন না, টেরটি পেয়ে যাবেন। পোড়া পোড়া গন্ধ ভেসে আসছে, মানুষের চামড়া পোড়ার গন্ধ কিন্তু কোনো চিতা তো জ্বলছে না। জ্বলছে সাহেব, আপনার দৃষ্টি অত দূরে পৌঁছতে লম্বা সময় নেবে। গন্ধটা জীবনের অর্থ কাকে বলে চিনিয়ে দেয়। ওই তো দূরে, অনেক দূরে, লাশ নয়, মরা মানুষের শরীর ঘিরে ওরা একে একে টেনে নিচ্ছে আত্মীয়তার ঘ্রাণ, ওদের রোদনে কত না-পাওয়ার প্রলাপ, আর্তনাদ মুড়িয়ে ফেলছে কত গাছগাছালির শাখা-প্রশাখা। হরিশ্চন্দ্রের প্রতিটি কথার মোড়কে একে একে লাগছে নানা রঙ। ওঁর দৃষ্টি নিমেষে পৌঁছে যাচ্ছে কারও বাড়ির সদর দরজায়, কারওবা ঘরের চৌকাঠে, কারওবা চৌকাঠ টপকে অন্দরমহলে। বললেন, সাহেব, ওই যে দেখছেন যারা নদীতে জাল ফেলছে মাছ ধরবে বলে, জোয়ারের জল কখন এসে যে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাবে ওরা জানে কী! জলের ধারা ছিটকে এসে ওদের শরীর ভিজে যাচ্ছে, তবুও জীবন দিয়ে লড়াই করছে জীবনকে বাঁচাবে বলেই না, ছেলের জীবন, মেয়ের জীবন, মা-বাবা-ভাই-বোনের জীবন। ওরা শুধু বেঁচে থাকতে চায় কিন্তু জীবনের অর্থ খোঁজার কোনো দায় নেই, শুধু ওইটুকুই, ঝড়-ঝঞ্জায় ঘর বাড়ি উজার হয়ে যাবে না, মোটা কাপড় পরেই কাল কাটবে। বললাম, এসব কথাতো ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরতে পারেন। মৃদু হেসে বললেন, হাতে গরম প্রমাণ না পেলে এই দুঃখ দুর্দশাগ্ৰস্ত পীড়িত মানুষের কথা নিয়ে ভাববার কোন দায় পড়েছে শহুরে বাবুদের? বললাম, তাহলে আপনিই-বা এত ভাবছেন কেন? দুঃখ কষ্টের জ্বালা যন্ত্রণাটা হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাই বলে। আমি এও জানি যেটুকু আলোর ছটা এসে কলিকাতার অলিগলির পথ চেনাচ্ছে, এর বেশি যে এগোবে তার আয়োজন কোথায়! আপনাদের ধর্মশাস্ত্রে পরকালের কথাই বলে, না ইহকালের জ্বালা জুড়োবার পথও চেনায়? আমি ঘাড় নেড়ে আমার মত জানালাম। ওনার ভেতরটা যেন জ্বলে উঠলো, বললেন, তাহলে এই দেশে এসেছেন কোন লোভে? বললাম, এই তো নতুন কিছু নয়, ওলন্দাজ পর্তুগিজ মোগলরাও এই দেশ শাসন করেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী, তখন তো আপনারা এই প্রশ্ন তোলেন নি। জিজিয়া কর, দহশালা পদ্ধতিতে ভূমি কর চালু করেছিল, যত দোষ আমাদের বেলায়! দেশ রাজ্য শাসনের অজুহাতে ধর্মান্তরিত করে নি, তাহলে আমাদের দুষছেন কেন? নিজেদের প্রশ্ন করছেন না কেন, কেন জানতে চাইছেন না এই সাধারণ মানুষগুলো আজও জুবুথুবু হয়ে কেন মাথা হেঁট করে ঘুরে বেড়ায়? কেন ওরা প্রশ্ন করতে গিয়েও ঢোক গেলে, জবাব চাওয়া তো দূরের কথা, জমিদারদের রক্তচক্ষু ওদের দমিয়ে রাখে? হরিশ্চন্দ্র ক্ষণিক নিশ্চুপ হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। প্রশ্নের ভারে ওর হৃদয়ের স্পন্দন শুনতে পায় প্রবল জোড়ে। বোধ হয় বুঝতে পারে আরও কত কাজ বাকি পড়ে আছে।
কে গাইছে এমন করে! এই দেশের আকাশে বাতাসে কি গানের সুর ঘুরে বেড়ায়। সোনালী ধানের ছড়াগুলো হাওয়ায় হাওয়ায় দুলে দুলে লুটিয়ে পড়ছে। ভেতরটা কেমন করে ওঠে, বোঝাতে পারি না। এই দেশের চাষীদের কাছে কি এমন জাদুকাঠি আছে, যার জেরে ওরা এমন ফসল ফলায়, ধানের শীষে চলে এমন রঙের খেলা। খুশিতে মনটা আনচান করে উঠলে আলপথ ধরে হাঁটা শুরু করি। এই পথ যে কোথায় গিয়ে শেষ হবে আমি নিজেই জানি না, তবুও হাঁটা থামাই না। মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে যেতে যেতে দেখি ওরা কেউ লাঙ্গল দিয়ে চাষ করছে। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির ফোঁটা টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে থকথকে কাদা মাটির বুকে, চলে যাচ্ছে সে জল-কাদা আপনমনে গড়িয়ে গড়িয়ে। অদ্ভুত লাগছে সে মাটির গন্ধ। আক্ষেপ হচ্ছে এমিলিকে এমন দৃশ্যের সাক্ষী করাতে পারলাম না। কিছুদিন আগে পেটের ব্যামোতে ভুগেছিল। শরীর আর মনের সঙ্গে আপোষ করে গরীব ঘরের মেয়েদেরকে মানুষ করার নেশায় মেতেছে, কোনো বাধাই ওর কাছে বাধা নয়, হার মানবে বলে তো পরের দেশকে নিজের দেশ বানিয়ে নেয় নি! এই তো সেদিন যে মেয়েটি ঘর ছেড়ে ওর কাছে আশ্রয় চেয়ে বলেছিল, ‘আমি শিখতে চাই মেমসাহেব।’ কী সুন্দর ওর সুঁচের কাজ, ও অনায়াসে ফুটিয়ে তুলতে পারে কাপড়ের উপর ওর মনের ভাষা, বিমূর্ত ছবি। এমিলির চক্ষু তো ছানাবড়া। জিজ্ঞেস করলো, ‘কেমন করে শিখলে এসব?’ এমন করে যে মনের ভাব ফুটিয়ে তুলতে পারে তার মনটা জানি কত সুন্দর। গ্ৰামের বড়কর্তা ওর কানে কানে বললো – পাঠাস নারে মেয়েকে মেমের ঘরে, কবে দেখবি একদিন খেষ্টান করে নেবে। এমিলি অভয় দিয়ে বলল, ‘ভয় নেই রে, ভয় নেই, আমি তোর ধর্ম পাল্টাবো না। পড়ালেখা শেখাবো, আগে শিক্ষা, তবে তো নিজের সকল প্রশ্নের উত্তর নিজেই খুঁজে পাবি।’ এমিলি দিনরাত প্রাণপাত করে ওদের কথা শোনে, আর নিজের কথাও শোনায় গায়ে হাত বুলিয়ে। আজকাল ও চলনসই বাংলাটা রপ্ত করে নিয়েছে। ওকে নিয়ে আমার বড় ভয়, কখন কোন পরিকল্পনা করে বসে, তাকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কত তো ঝক্কি কিন্তু কে কার কথা শোনে, মেয়েদের মধ্যে নাকি মাতৃত্ব খুঁজে পায় ও। আমি মাঠ পেরিয়ে এক বটগাছের ছায়ায় এসে দাঁড়াতেই কত যে পাখির কুজন শুনতে পাই। ইতিউতি উঁকি মেরে দেখি কোথায় গেল ওরা। ডালপালাগুলো নড়েচড়ে উঠলে মনে হলো ওরা নিশ্চয়ই আছে, পাতার গন্ধ শুকতে শুকতে ওরা এলিয়ে পড়েছে ওদের ঘরবাড়িতে। সত্যিই তো সকলের ঘরবাড়ি আছে, আমি কোনটাকে সম্বোধন করবো নিজের ভিটে বলে। কত খড় কত পাটকাঠি উড়ে উড়ে চলে এলো এধার ওধার। কত পাখির ডানা এবার পতপত শব্দ করলো, কেই-বা কাকে চেনে জানে। মানুষে মানুষে আত্মীয়তার জমিনে কে কখন চাষাবাদ করে ফসল ফলাতে? চিন্তাগুলো আমার চারপাশে শুধু কিলবিল করে। এর মাঝেও শুনতে পাই জলপিপিদের ডুবু ডুবু শব্দ, ওরা ভেসে ওঠে। আমি কত কী দেখতে চাই, চিন্তার স্রোতে ভেসে যেতে যেতে গাছ পুকুর সব যেন একাকার হয়ে আমার পৃথিবীটাকে ওলটপালট করে দেয়। টিয়া, বুলবুলি আর ময়নাদের বিচিত্র গায়ের রঙ আর স্বরের কোলাকুলি আমাকে অস্থির করে তোলে। আহা মানুষ ভরদুপুরে কোথায় যেন যায়, ওদের দিকে ফিরেও তাকায় না কেউ, ওরা বিড়বিড় করে নিজেদের মনের কথা কাউকে না শুনিয়ে যেন গিলে ফেলে ভিন্ন কোনো কথার জন্ম দেবে বলে। কী দেখবে, আমি কেমন করে দেখাবো, মানুষের স্রোত তো আর থামে না। ওরা জায়গা পাল্টায়, আমাকে দেখেও না-দেখার ভান করে মাড়িয়ে মাড়িয়ে চলে যায়।
একজন অন্যজনকে গায়ে ঠেলা মেরে বলেছে, কীরে গা না, এই তো গান ধরার উপযুক্ত সময়, বেলা চলে গেলে আঁধার নামলে সকলেই তো ঘরে ফিরে যাবে, তখন কে শুনবে, কার গান। সব গানের কথা শূন্যে মিলিয়ে গেলে বৃথা হয়ে যাবে সব গানের কলি! শ্রোতারা হারিয়ে গেলে এই সুর সৃষ্টির মাহাত্ম্য আর রইলো বাকি কি? আরেক জন বলল, তবে ধরেই ফেলি, কি বলিস ? আরে ধর ধরেই ফেল, মনের কথা ফুরিয়ে গেলে আর যে ফিরে আসবে না। আমি বোঝার চেষ্টা করি ওদের মনের ভাষা –
দিন দরিয়ার মাঝে দেখলাম আজব কারখানা।
ডুবলে পরে রতন পাবি, ভাসলে পরে পাবি না ।।
দেহের মাঝে বাড়ি আছে, সেই বাড়িতে চুরি হয়েছে
ছয়জনাতে সিঁদ কেটেছে, চুরি করে একজনা ।।
বলে কীরে ওরা! ভাঙা ভাঙা শব্দ কানে ভেসে আসে। শব্দগুলো দিয়ে জীবনকে ভাঙচুর করা যাবে এ-তো আমি স্বপ্নেও কল্পনা করি নি। আমি ওদের কী জ্ঞান দেব, ওদের জ্ঞানের ভাণ্ডার থেকে চুরি করে করে আমাকে নিয়ে যেতে হবে অনেক মণি মাণিক্য হিরে জহরত, চুরির দায়ে পড়ি তো পড়ি পরে ভাববো, আগে তো নিজের ঘরটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে নি। কী আশ্চর্য কথা! বলে কিনা ‘দেহের মাঝে নদী আছে, সেই নদীতে নৌকা চলছে, ছয়জনাতে গুন টানছে, হাল ধরেছে একজনা।’ আর কোন শব্দের অর্থ আমি হৃদয়ঙ্গম করতে অপারগ হয়ে ভাবতে শুরু করলাম ওদের ভুবনের কোন পারে গিয়ে নোঙর করলে আমি আমার মনের ঠিকানা খুঁজে পাবো। কত প্রশ্নের মধ্যে এমন অঙ্ক আছে সেই সমাধান খুঁজতে অনেক সময় লাগবে। আরে এই দেশ তো এক আশ্চর্য দেশ, আরও আশ্চর্য দেশের মানুষ! পাশ্চাত্য-বাসীরা এত গর্বে গর্বিত, এদের এতকাল তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এসেছে, কলকাতার যুবক ছেলেরাও বলে বেড়াচ্ছে – আমাদের এই পৃথিবীকে উপহার দেবার মতো এমন কী আছে? ওরা ইংরাজ সাজবে বলে উঠে পড়ে লেগেছে। মূর্খ ওরা, ওরা এখনও ওদের সমাজ চিনল না, হাতড়ে বেড়াচ্ছে সেই পথ, যেই পথে সাহেব সেজে রায়বাহাদুর হবে। ওরা বলতে চায়, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মাঝখানের সময়টা আমাদের শিখিয়ে দেয়, বেলা গেলো, সন্ধ্যে হলো, দিন ফুরালো, রস নিংড়ে নাও, না হয় ছিবড়ে হয়ে যাবে, হাঁড়গোড় সর্বস্ব শরীরটা নিয়ে করবে কি তখন? কথাটা ফেলনার নয়, প্রকৃতির কাছে নতজানু হয়ে ক্ষমা ভিক্ষা করো, না হয় ভুলের মাশুল গুনতে গুনতে আর তো কিছু অবশিষ্ট থাকবে না একদিন। আশায় আশায় দিন ফুরোবে। বাক্যগুলো ভেঙে ভেঙে চুরমার হয়ে পৌঁছলে সেই শব্দগুলো এমন ঢঙে এলো তখন দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকা ছাড়া আর কী কোনো রাস্তা খোলা আছে! ‘দেহের মাঝে বাগান আছে, নানা জাতের ফুল ফুটেছে। সৌরভে জগৎ মেতেছে, লালনের প্রাণ মাতলো না।’ অন্তহীন জিজ্ঞাসা আমাকে তাড়িয়ে মারছে, সময় আর সময় থাকছে না, এই মহাবিশ্বের সময়কে নিয়ে খেলে বেড়াচ্ছে কে বা কারা? তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে সবকিছু, আমার অস্তিত্বের খোলনলচে পাল্টে এই যেন নতুন এক মনোজগতের ঠিকানায় জীবনকে দেখা। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এর চর্চা শুরু হয়েছে তা আমাকে আগে জেনে নিতে হবে, তারপর লেগে পড়তে হবে, পাতার পর পাতা উল্টাতে হবে, এমন সিদ্ধান্তে কারা এর আগে পৌঁছেছে, না হয় অসম্পূর্ণ থেকে যাবে অনেক কিছুই।
কী নিয়ে এত রাতদিন ঘাটাঘাটি করছেন হরিশ্চন্দ্রবাবু? বললো, তেমন কিছু না। কালকে একটা আর্টিকেল লিখতে হবে, ভাবছি কোন কথাটা বলবো, আর কোন কথাটা পাঠকের মগজ আর মননের গবেষণার জন্য ছেড়ে দেবো। বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহের প্রস্তাব পুস্তকাকারে প্রকাশিত হলেও আমার দায়িত্বটা তো আমি এড়িয়ে যেতে পারি না, জনমত সংগ্ৰহ করাও জরুরি হয়ে পড়েছে, না হলে যে ষোলো কলা পূর্ণ হবে না। ভাবছি লেখাটা কোন বিন্দু থেকে শুরু করবো। রাধাকান্ত দেব তো এই প্রস্তাবের বিপক্ষে উঠেপড়ে লেগেছেন। গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি শেষে কোন পক্ষে যোগ দেন আর ওঁর মতামতই কি সেই দিকে তাকিয়ে আছি তীর্থের কাকের মতো। হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহ আইন পাস হবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। বিদ্যাসাগরের এত প্রচেষ্টা না বৃথা চলে যায়। বা! আপনি আমাকে এক নতুন শব্দ শোনালেন – তীর্থের কাক, দাঁড়ান, আমার ডায়েরিতে লিখে রাখি, পরে না হয় স্মরণে থাকবে না, সমূহ ক্ষতি হয়ে যাবে তাহলে। হরিশ্চন্দ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বললেন, একটা শব্দের জন্য আপনার এত আকুতি, এমনটা তো আগে কখনও চোখে পড়েনি, তা-ও আবার বিজাতীয় ভাষার জন্য। মানুষটার চোখে মুখে নিজের ভাষার জন্য মমত্ববোধ দেখে আমি অবাকই হয়ে গেলাম। বললাম, এত রাত জেগে সম্পাদকীয় লিখলে শরীরে সইবে না যে। কথা প্রসঙ্গে তিনি টেনে আনলেন গত বছরের ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ প্রসঙ্গ। খানিকটা সংকোচ বোধ করলেন কী জানি আমি আবার মনঃক্ষুন্ন হই কিনা। সিধু ও কানুকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে মারা হয়েছিল। দারোগা মহাজনদের হত্যা করেছিল, কম সাঁওতালদের তো মারে নি, প্রায় পঁচিশ হাজার। ওরা কি সইতে পেরেছিল ক্রমবর্ধমান সরকারি খাজনার চাপ, জোতদার, জমিদারদের শোষণ। এই খবর শুধু কলিকাতাকে তোলপাড় করে নি, গোটা ইউরোপকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ‘হিন্দু পেট্রিয়ট-এর ভূমিকা তো কম ছিল না। গরীব মানুষগুলোর জন্য প্রাণ কেঁদে উঠেছিল, ইংরেজদের রক্তচক্ষুকে পরোয়া না করে হরিশ্চন্দ্র কলম ধরেছিল চাঁচাছোলা ভাষায়। আমি ভবানীপুরের বাড়িতে উল্টো দিকের চেয়ারে বসে লক্ষ্য করছি তাঁর উজ্জ্বল দুটি চোখ, কীসের স্বপ্নে যেন মশগুল হয়ে আছে, কোনো নতুন শব্দ আবিস্কারের জন্য ছটফট শুরু করেছে। বুঝলেন লঙ সাহেব, আপনি ঠিকই বলেছেন আমার দেশের মানুষ ভালো নেই, পরস্পর ছোট আঘাত ওদের মেরুদন্ড ভেঙে দিচ্ছে, মাথা তুলে যে দাঁড়াবে সেই শক্তিটুকু নেই, আমি আজকাল এতই দুশ্চিন্তায় থাকি, কোনো শব্দ খুঁজে পাই না যাতে সাহেবদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি অথচ সাধারণ মানুষরা ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’-এর দিকে মুখ চেয়ে বসে থাকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিন্তু সুবিচার করছে না, একদিন না একদিন ওদের এই দুষ্কর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হবে, সেইদিন বেশি দূরে নয়। শুনেছি, এই মানুষটাই নাকি কাশীপ্রসাদ ঘোষ-এর ‘Hindu Intelligencer’-এ একের পর এক য়ে জ্বালাময়ী প্রবন্ধ লিখে পাঠকদের সচেতন করেছিল কী ঘটছে, আর কী ঘটতে চলেছে। শুধু কী তাই পাঁচ মাস কালের মধ্যে ৫৭ টি বাঁধাই ‘এডিনবরা রিভিউ’ মাত্র দুই তিন বার পড়ে হৃদ্গত করেছিলেন। যেন তেন মানুষ তো নয়ই, অনেক সম্ভাবনাময় বার্তা ছড়িয়ে দিনরাত এক করে দিচ্ছেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শেষ গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং বিধবা বিবাহকে আইনি স্বীকৃতি তো দিয়ে দিলেন। শুনলাম বিদ্যাসাগর মহাশয়কে এই নিয়ে হত্যা করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। হায়রে বাংলা, কত ধরনের নিষ্ঠুর মানুষরাই এই সমাজে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে, মেয়েদের ঘরবন্দী না করা পর্যন্ত ওদের স্বস্তি নেই, নিদ্রা নেই । পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজের নগ্ন চেহারা আমাকে স্তম্ভিত করে দিল। সাহেবরা কেউ কেউ বলতে আরম্ভ করেছে, আমি বেশি ভারতীয় কম পাদ্রী। সমাজে অনিয়ম মাথা তুলে দাঁড়ালে তখন কী ইংরেজ আর কী ভারতীয়, মানুষ পরিচয়টাই মুখ্য হয়ে উঠে, আমি তার থেকে বাদ যাই কেমন করে! ডালহৌসি স্কোয়ারের দিকে যেতে যেতে মনে হলো এই অঞ্চলটারই একসময় নাম ছিল ‘ট্যাঙ্ক স্কোয়ার’। ইতিহাসে কত কীই-না ঘটে, এমন একদিন আসবে না কে বলতে পারে এই নামও পাল্টে যেতে পারে। সময়ই তো সব, সবকিছুর কেমন অনায়াসে জবাব দিয়ে দেয়, এর চেয়ে সেরা আর কে আছে, কোটি মানুষের চেয়েও লক্ষ গুণ বড়। রাস্তায় আবার দেখা হরিশ্চন্দ্রের সঙ্গে – আরে হনহন করে চললেন কোথায়? বলল, আরে আপনি শোনেন নি বুঝি, সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেছে, এখন আমার অনেক কাজ। এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজে গরুর চর্বি আর শুকরের চর্বি ব্যবহার নিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীরা বিদ্রোহ শুরু করেছে। ওঁর অস্থিরতা দেখে সান্ত্বনা দিলাম – ওই নিয়ে এত ভাববেন না, কোম্পানি ঠিক সামলে নেবে। আরে না না, আপনি বুঝছেন না সাহেব, ব্যারাকপুরে সংগ্ৰাম প্রতিরোধ, ধর্মীয় অসন্তোষ শুরু হয়ে গেছে। ইতিমধ্যেই বিপ্লব মিরাট ছাড়িয়ে বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও দিল্লীতে ছড়িয়ে পড়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, এর কারণ কী বলতে পারেন? লালদীঘিরর দিকে তাকিয়ে যা বললেন – ব্রিটিশদের কঠোর অর্থনৈতিক নীতি, ভূমি কর বৃদ্ধি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে হস্তক্ষেপ আর অনেক দিনের জমে থাকা ক্ষোভ। আমি জানি না এই আন্দোলন থামবে কবে? কথার গতির সঙ্গে হাঁটার গতিও বেড়ে গেল। রাস্তায় রাস্তায় তৈল বাতিগুলো জ্বলে উঠলে হরিশ্চন্দ্র আপনমনেই বলে উঠল – স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ রোপন হয়ে গেল বুঝি। হিন্দু পেট্রিয়টের দায়-দায়িত্ব কয়েক গুণ বেড়ে গেল। লেখার ধারও আমাকে এমন করে বাড়াতে হবে যাতে ইংরেজদের কাঁপুনি ছোটে, বৈদ্যুতিক টেলিগ্ৰাফ মারফত আরও বৈদেশিক সংবাদ আনিয়ে নিতে হবে। অডিটর জেনারেল-এর চাকরি যায় যাবে। আমি এই অবস্থায় কোন দিকে যে যাবো? তবে এটা বুঝলাম এই মানুষটির মধ্যে আগুন আছে, সেই আগুনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে আজ না হয় কাল, কাল না হয় পরশু। যদিও ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ লর্ড ক্যানিংকে শান্ত করার জন্য পরে ছেপেছিল – সিপাহী-বিদ্রোহ কেবল কুসংস্কারাপন্ন সিপাহীগণের কার্য মাত্র, দেশের প্রজাবর্গের তাহার সহিত যোগ নাই। আমার অনুভবে এই বক্তব্য হরিশ্চন্দ্রের সিপাহীদের রাজরোষ থেকে বাঁচাবার একটা কৌশল মাত্র, মনের কথা নয়।
প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas magazine
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)
