তাপস সরকার

লেখক পরিচিতি 

( সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর  বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা।কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়।প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘ দিয়ে। পেশায় অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক। ) 

অধ্যায়: সতেরো

আছিম খুল্লার বৃত্তান্ত বলা যাক। সে পড়েছিল আপাদমস্তক এক সংকটে। অবশ্য আমিও কি সুখেশান্তিতে আছি নাকি? আমার বলতে গেলে, জীবন-মরণ দশা। গোড়া থেকেই হাজার গন্ডা আপদ-বিপদে ভুগতে ভুগতে এখন একেবারে শিখরপ্রাপ্তি ঘটেছে।

বিষম এক উৎকট সংকটে কাতর হয়ে পড়েছি। একই ব্যক্তি আমি একই দেহে খিটিং হয়ে আবার খিটিং-এর প্রধান শত্রু মহা শক্তিধর দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে গিয়েছিলাম। দুজনের নিয়ম-নীতি বা জীবনদর্শন সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী। কী করে এমন হল কে জানে? দোষের মধ্যে খবরের কাগজ পড়ছিলাম, তাতেই এই। যদি খবরের কাগজে খবর না পড়ে টিভির চ্যানেল চালিয়ে খবরওলাদের হাউমাউ খবরের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনতাম তো কী হত ভাবলেও শিউরে উঠছি। খবর পড়ার বা দেখার এই যে বিপত্তি তার ধারণা ছিল না কোনজন্মে। এখন এমন হাল হয়েছে যে কেউ খবর পড়ছে দেখলেই ভয়ে পালাই। কোন বাড়িতে টিভি চালিয়ে কেউ খবর দেখছে আওয়াজ পেলেই আমি ত্রিসীমানা ছেড়ে যেখানে খুশি চলে যাই। একে কী বলা উচিত? নিউজোফোবিয়া?

এই যে সংকট এ কেবল আমারই নয়। পরবর্তী সময়ে সন্ধান করে জেনেছি, এমন বিপদে অল্পবিস্তর সকলেই আক্রান্ত। কেউ প্রকাশ করে না নানা কারণে। অনেকে আবার নিজের সংকটের বৃত্তান্ত ব্যক্ত করতে গিয়েও অবস্থার চাপে বোবা বনে যায়। আসলে জগতে মানুষ সদাসর্বদাই দেখছি পরিস্থিতির শিকার, তাকে আড়াল থেকে চালনা করে কোন অদৃশ্য শক্তি। কেউ মানুক বা না মানুক, আমার এমনই বদ্ধমূল ধারণা হতে চলেছে। এই যে বিশ্বাস, এটাও কি ছাই আমি নিজে পেতে চাইছি নাকি? কেউ আমাকে দিনরাত কানের কাছে অদৃশ্য থেকে বোঝাচ্ছে, আরে হাঁদারাম, এটাই ঘটনা। তুই মঙ্গল চাইলে মেনে নে, না মানলে কচুবনে গিয়ে কচু খা। যাকগে বাবা, অদৃশ্য শক্তিকে চটিয়ে কাজ নেই, যা সে মনের মধ্যে উদয় ঘটাচ্ছে বিনা প্রতিবাদে সুবোধ বালক হয়ে মেনে নিচ্ছি। কারণ মা আমার বলত চিরকাল, মানলে শালগ্রাম না মানলে শিলা। ঠিক বাবা ঠিক, ওহে অদেখা কারিগর, তুমি যা জপাচ্ছ মনের অন্দরে আমি তাকেই বলছি, লা জবাব। তোমার বশীভূত হয়েই থেকে যাচ্ছি।

তখন মনে পড়ল, এমনধারা কীর্তিকলাপের সঙ্গে আগেও কিঞ্চিত পরিচয় ঘটেছিল আমার। আছিম খুল্লা তারই এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। কোন একসময় তার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল, তা এমন তো হরহামেশা কত লোকের সঙ্গেই হয়ে থাকে। কে আর প্রতিটি বিষয় খোদাই করে রাখে মনের খাতায় ? আছিমের নিবাস ছিল কোন্ মহল্লায় তা আর স্মরণে নেই, তার অন্য সব বিবরণও যথোপযুক্ত জানাতে পারব না। তা সেসবে কী দরকার? আমি তো শোনাতে যাচ্ছি সে কী সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল সেই কাহিনী, তাতে তার অন্য সব বিবরণ বা পিতৃপুরুষের পরিচয় না জানলেও চলবে। আছিমের ছিল একখানা ছইওয়ালা নৌকো। একখানা ঘোড়াও ছিল সম্ভবত। সেটা ঘোড়া না হয়ে গাধাও হতে পারে অথবা খচ্চর। যাই হোক না কেন, জীবটা কুকুর-বেড়াল বা গরু-ছাগল হবে না যেহেতু আছিম তার পিঠে চেপে এ-মহল্লা ও-মহল্লা করে বেড়াত। তবে ছইওয়ালা নৌকোটা নৌকোই হবে, ভটভটি কিংবা জাহাজ বা অন্য বস্তু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তো এইসব আগডুম-বাগডুম বাক্যালাপে কালাতিপাত না করে আসল প্রসঙ্গে আসা যাক। বলছিলাম আছিমের একটা ছইওয়ালা নৌকো আর ঘোড়া বা গাধা বা খচ্চরের মালিকানা ছিল। গ্রামের সীমানায় কুটুমএলো নদী, তার ঘাটে বাঁধা থাকত নৌকো। ঘোড়া বা গাধা বা খচ্চরের পিঠে চেপে আছিম বাড়ি থেকে নদীর ঘাটে গিয়ে নৌকোয় চড়ে নদী ধরে এগিয়ে যেত। সেই নদীর যাত্রাপথ গোলমেলে। উজানের দিকে যাও বা ভাঁটার দিকে, তার কোন আদিঅন্ত পাবে না আর তোমার দু’ধারে দেখতে পাবে আজব-আজব দুনিয়া। সেই দুনিয়ার বাসিন্দারা কী যে বস্তু দেখলেও চমক লাগতে বাধ্য। অবশ্য আমি দেখিনি কিছু, আছিম বর্ণনা দিয়েছিল তাদের সেই কোন্ কালে। 

আছিমের নৌকো চলত মনপবনের বাতাসে। এই যে কথাটা, মানে এই মনপবনের বাতাস, সেটা এখনও কানে লেগে আছে এই জন্য যে তার মধ্যে হয়তো ব্যাকরণগত ত্রুটি বর্তমান, থাকলেও আমি নিরুপায় হয়ে লিখছি যেহেতু আছিম ঠিক এই কথাটাই ঘনঘন বলত। সেই মনপবনের বাতাসের ঠেলায় নৌকো তরতরিয়ে এগিয়ে যেত কুটুমএলো নদীর বুক ধরে, আছিম ছইয়ের তলায় বসে গুড়ুক-গুড়ুক তামাক খেত বা নৌকোর ডগায় বসে থাকত জয়-জগন্নাথ হয়ে। নদীর চরে ধবল বালুকারাশিতে পাখপাখালির হইচই না থাকলে কোন এক অচিন শূন্যতা অদৃশ্য হাহাকার মূর্তি ধারণ করে বিরাজমান থাকত আর নিশুতি রাতে চন্দ্রকলার অঙ্গনিঃসৃত অপরূপ জোৎস্নাতে অনুভব করা যেত ছায়া-ছায়া পাখনাধারী অমনুষ্য বালিকাবৃন্দের হাস্যকলরব। তাদের দর্শন পাওয়া যেত না চর্মচক্ষে, মানসলোকে বিহার করত সেই সমস্ত চপলা কন্যারা। আছিম খুল্লা নিত্য তাদের দেখা পেত নৌকো যখন মনপবনের বাতাস লেগে চলে যেত বালুকারাশি বিছানো চরের পাশ কাটিয়ে চন্দ্রালোকের মায়াচ্ছন্নতায় কুটুমএলো নদীর জলে ভেসে। সে সকল বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা সে শুনিয়েছিল আমাকে, তাতে তেমন যে আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলাম এমন নয়। আমাকে বেকুব বানিয়ে দিয়েছিল অন্য এক বিষয়, যা বিশ্বাস করা শক্ত ছিল সে সময়। তবে এখন দেখছি তা অলীক কল্পকাহিনী ছিল না হয়তো।

কোন এক অপরাহ্ণবেলায় মনপবনের বাতাসের টানে আছিম খুল্লার নৌকো গিয়ে ভিড়েছিল কুটুমএলো নদীর দূরবর্তী এমন এক ঘাটে যেখানে বিস্তর গাছ-গাছালির ছত্রছায়ায় অগণিত পক্ষিকুলের অবিশ্রান্ত কলকাকলি। পরিশ্রান্ত আছিম ঘাটলায় নৌকো বেঁধে ডাঙ্গায় নেমে দেখল গুটিকয় মানুষ কিসের প্রতীক্ষায় অপেক্ষমান। তারা তাকে দেখে সহর্ষ অভিনন্দন জানিয়ে গলায় মালা পরিয়ে দিল আর সমাদরে ডেকে নিয়ে গেল এক সুরম্য প্রাসাদে। সেখানে আরও বহু লোকসমাগম দেখল আছিম এবং সকলেই তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে এক সিংহাসনে বসালো। তারপর জনৈক বৃদ্ধ ব্যক্তি এসে তাকে সুদীর্ঘ এক সমাচারপত্র পাঠ করে শোনাতে লাগল। সেখানে ছিল স্বর্গপুরীর খবরাখবর। দেবরাজ ইন্দ্রের রাজসভার বিবরণ আর দেবগণের বর্তমান বিচরণ। শুনতে শুনতে আছিম উপলব্ধি করল, তার চতুর্পার্শ্বে অমরালোকের আগমন ঘটেছে এবং সে স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রে পরিণত হয়েছে। কী করে ঘটেছিল ঘটনাটা আছিম তার ব্যাখ্যা দিতে পারেনি, তবে জানিয়েছিল যে উপস্থিত অপরাপর ব্যক্তিবর্গ কোন আজব মন্ত্রবলে তেত্রিশ কোটি দেবতা হয়ে গিয়েছিল। গুণে দেখেনি যদিও তবুও আছিম নিশ্চিত ছিল যে সংখ্যাটা তেত্রিশ কোটিই হবে। অবশ্য তাকে বাদ দিলে তেত্রিশ কোটির চেয়ে একজন কম। আর এই রূপান্তর আছিমের সেসময় একেবারেই অস্বাভাবিক লাগেনি, বরং নিজেকে দেবরাজ ইন্দ্র ব্যতীত অন্য কিছু মনে হয়নি তার।

আমাকে বৃত্তগোলক ঢোলক কোন এক সময় জানিয়েছিল,

‘তুমি কি ভাবো মানুষ যেমন রূপে জন্মায় তদ্রুপ থেকে যেতে সমর্থ হয় চিরকাল? কদাপি নয়। মনুষ্য চরিত্রের পরিবর্তন অত্যন্ত পরিচিত ঘটনা। যদিবা কেউ একই অবস্থানে থেকে যেতে চায় তো সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে সে সদাসর্বদা অপারগ।’

আমি ঢোলকবাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,

‘এ আবার কী কথা ? এমন সত্যি হয় নাকি?’

শুনে বৃত্তগোলক কিঞ্চিত চটে গিয়ে বলেছিল,

‘না হলে বলতে যেতাম কী হেতু? তুমি কি ভাবো আমার বক্তব্য বিষয়ের আকাল? নাকি আমার ভীতি প্রদর্শনের অভিপ্রায় আছে?’

তাকে শান্ত করার চেষ্টায় বিনীতভাবে বললাম,

‘তা নয়। আসলে আমি জানি, যাকে যেমন দেখি তেমনই সে। ভিতরে যে অন্য রহস্য আছে তা তো বুঝতাম না।’

বৃত্তগোলক ঢোলক তাতে শান্ত হল অবশ্যই। আমাকে জানিয়েছিল,

‘খবরাখবর। নরসমাজে তার ভূমিকা অতীব প্রবল। মনুষ্য জাতি খবরাখবরে বশীভূত, খবরাখবর তাকে গঠন করে। তুমি কি ভাবো প্রাকৃতিক বিষয়াদি মানবচরিত্রের বিকাশ ঘটায়? অধিকাংশে নয়। নরচরিত্র সাজায় খবরাখবর। তুমি কি ভাবো তুমি চল তোমার মত? তোমাকে চালায় খবরাখবর।’

এই তুমি-কি-ভাবো শব্দগুচ্ছ বৃত্তগুলোক ঢোলকের এক মুদ্রাদোষ। কথার বিভিন্ন ফাঁকফোকরে সে যখন খুশি তুমি-কি-ভাবো শব্দগুচ্ছ গুঁজে দেয়। দিক গে, তাকে চটিয়ে লাভ নেই, কথা বলে ভালো। এই যে বিষয়টি সে জানালো এতে আমারও বিস্তর আগ্রহ, যেহেতু ইতিমধ্যেই সংবাদসংশ্লিষ্ট অত্যাশ্চর্য সন্দেহের পরোক্ষ অভিজ্ঞতার শিকার হতে হয়েছে আমাকে। এখন ঢোলকবাবুর বর্ণনা আমার মানসলোকে উদিত প্রশ্নসমূহের উপযুক্ত সমাধান দিতে পারছিল।

পঙ্কিলপলিত ছিন্নতালুক মশাইয়ের দৃষ্টান্ত উত্থাপন করল বৃত্তগোলক। আমি অবশ্য ছিন্নতালুক মশাইকে দেখিনি কোনজন্মে, তবে গোলকবাবু যেভাবে জানালো তাতে মনে হচ্ছিল তাকে আমি চিনি এবং সে আমার সম্মুখে দণ্ডায়মান। 

‘তুমি কি ভাবো খবরাখবর ইদানিং শক্তি অর্জন করেছে? কদাপি নয়। তার উপস্থিতি মানব সভ্যতার সূচনায় এবং কালে কালে তার ক্ষমতা বিকশিত হয়ে এসেছে। যে কোনকালে যে কোনরূপে উপস্থিত থেকেছে খবরাখবর। চিরকাল ইহা সত্য। তুমি কি ভাবো কিভাবে? শোন সেই কাহিনী। তোমাকে পঙ্কিলপলিত ছিন্নতালুকের কথা বলি। সে ছিল অতীব সজ্জন ব্যক্তি।’

বৃত্তগোলক যে কাহিনী শোনালো তা থেকে জানা গেল যে ওই সজ্জন পঙ্কিলপলিত ছিন্নতালুক মশাইয়ের চরিত্রের প্রধান দোষ ছিল অত্যধিক কৌতূহল এবং সেই কারণে যে কোন প্রকার খবরাখবরে ছিল তার চূড়ান্ত আকর্ষণ। দিনরাত কেবল সংবাদ সংগ্রহের ও জানার নেশায় সে মেতে থাকে আর এই করতে করতে সেই সজ্জন ছিন্নতালুক মশাই একদিন পঙ্কিলপলিত দুর্জন ব্যক্তিতে পরিণত হয়। কাহিনী শুনে মনে হল খবরাখবরের বিষয়বস্তু তাকে ওইরকম পাষণ্ড বানিয়েছিল। আমার অবশ্য কোন কিছুই অবিশ্বাস্য ঠেকলো না। বৃত্তগোলক যে ভুল বকছিল এমন একবারও ভাবলাম না বরং তার কথা অনুযায়ী মানবসমাজের ইতিহাস, ভূগোল, কার্যকীর্তি এবং ধর্মকর্ম ইত্যাদি বিষয়গুলি বিশ্লেষণ করে দেখতে পেলাম কিসের প্রভাবে প্রভাবিত বস্তুসকল। ঢোলকবাবু বলেছিল,

‘তুমি জঙ্গলে থাকো অথবা মঙ্গলে, খবরাখবর না পেলে বা না পাঠাতে পারলে তুমি অচল, তুমি মৃত। খবরাখবর তোমাকে সজীব রাখে আবার খবরাখবরই তোমাকে নির্জীব বানায়। তুমি কি ভাবো এতেই বিষয়াদির সমাপ্তি? ভুল, ইহা ভাবনাও ভুল। তোমার জ্ঞাতার্থে আরো কিছু বলা উচিত হবে। খবরাখবর মানুষ ধরে, মানুষ গড়ে, মানুষ মারে এবং ইহাই জাগতিক নিয়ম। তুমি কি ভাবো এই নিয়মের ব্যতিক্রমী কোন বিকল্প ধারণা আছে? যদি বা থাকে সে সমুদয় চর্চাতে বিরত হও, নচেৎ অশেষ দুর্দশা অবশ্যম্ভাবী। খবরাখবর ব্যতীত কেউ বিকশিত হয় না আবার খবরাখবরই কারোও বিনাশ ঘটায়। তুমি যদি নিজেকে অধীনস্থ ভাবো তাতে কোন অশান্তি নেই, যদি সকল কিছু তোমার অধীন ভাবো তাহলেই মুশকিল। তোমার অহংবোধ জাগ্রত হবে এবং খবরাখবরে তুমি অতি বেশি প্রভাবিত হবে যে কোন প্রকারে। তাতেই অনিবার্য পতন। একে বলা যেতে পারে যেমন কর্ম তেমন ফল। ইহা না ভাবিও মনে আমি নারায়ণ, কর্মমত ফল ভোগ করে সর্বজন। মর্মার্থ বুঝতে পারলে? তুমি কি ভাবো বোঝা সহজ?’

বৃত্তগোলক বাবুর এই আরেক বড় দোষ যে বড় বেশি ফেনিল তার কথামালা, মূল প্রসঙ্গে আসতেই চায়না, হাজারো শাখা-উপশাখায় ঘুরতেই থাকে ঘুরতেই থাকে। ক্লান্তিবোধ জাগে শোনায়। তবুও শুনতাম, কারণ তাতে আমার সমস্যার উত্তর ছিল, যদিও গুরুচণ্ডালী দোষে দুষ্ট তার বাক্যজাল শ্রবণসুখে ব্যাঘাত ঘটিয়েই যায়।

ঢোলকবাবু আমাকে মনের সুখে জ্ঞান বিতরণ করেই যেতে লাগল তার নিজস্ব ভাষায় ও ভঙ্গিতে। আমি যত শুনছিলাম ততই যে রহস্যের ঘেরাটোপ তৈরি হয়েছিল তার চরিত্র বুঝতে পারছিলাম। কেন আমার দেশটা অন্য দেশ হয়ে গিয়েছিল এবং কেনই বা আমি সেই নতুন দেশের শাসক হয়ে গিয়েছিলাম তার মোটামুটি একটা আন্দাজ পাওয়া সম্ভব হচ্ছিল। আমি নিজেও ব্যাপারটা ঠিকই অনুমান করতে পেরেছিলাম, যদিও সেই ধারণাটা সঠিক বলে মেনে নিতে ভরসা পাচ্ছিলাম না। এখন বৃত্তগোলক ঢোলকের কথা শুনে সন্দেহ নিরসন হয়ে যেতে লাগল। লোকটার অনেক অভিজ্ঞতা, এসব সৃষ্টিছাড়া বিষয় নিয়ে সদাসর্বদা নাড়াঘাটা করে। কোন এলেবেলে লোক নয়। যে সূত্রে তার সঙ্গে আলাপ সেখানেও বিশ্বাসযোগ্যতা আছে। ঢোলকবাবু ব্যাখ্যা করে জানালো,

‘খবরাখবর জগত চালনা করে। তার মূল্য অনুধাবন করা সাধারণ লোকের সাধ্য নেই। বিষয়াদিকে আকাশ-পাতাল করে দিতে পারে খবরাখবর। তুমি কি ভাবো মানুষ রচনা বা রটনা করে খবরাখবর? তোমার এমত ভাবনা ভুল। অবিলম্বে সংশোধন করা কর্তব্য।’

বলতে যাচ্ছিলাম যে আমি ওইরকম ভাবি না, আমার সম্পর্কে তার এমন ধারণাটাই ভুল। কিন্তু বৃত্তগোলকের সামনে আমার কথা বলার সমস্ত চেষ্টা বেকার হয়ে গেল। লোকটা নিজেই বলবে সব কথা, কাউকে কিছু বলতে দেবে না, এই তার স্বভাব। কাউকে দোষ দেবে তো দিয়েই যাবে একতরফা, আত্মপক্ষ সমর্থনেরও কোন সুযোগ দেবে না। আমি তাই শুনেই গেলাম তার কথা, 

‘তোমার জ্ঞাতার্থে কতিপয় গূঢ় তথ্য প্রদান করা যেতে পারে। মনোযোগ সহকারে অনুধাবন কর। জীবনের নানাহ ক্ষেত্রে এ সকল তথ্য সবিশেষ উপকারে লাগবে। খবরাখবর পরিবাহিত হয় বার্তাবহদের মাধ্যমে। তাদের বিভিন্ন রূপ হতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা মনুষ্য হলেও ইদানিং স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রসমূহ হিসেবেই দেখা যায়। তবে মনুষ্য বার্তাবহরাই আসল। তাদের কারণেই যতো গোলন্দাজ কান্ডকীর্তি। বার্তাবহরা অতীতে ছিল, উপকথায় ছিল, পুরাণে ছিল, বর্তমানেও আছে। খবরাখবর তাদেরই অবদান। কাহিনী সৃষ্টির উপাদান যোগায় তারা। দেবলোক কিরূপ বা তথায় কী আছে না জানলে দেবলোক অধিকারের বাসনা জাগত না দৈত্যকুলের মানসে, কাহিনী জন্ম নিত না সেক্ষেত্রে। তুমি যদি না জান দেশান্তরবাসীদের খবরাখবর তুমি তোমাতেই বিরাজ করবে। তোমার প্রতিবেশীর জীবনযাপনের তথ্য তোমার অজ্ঞাত থাকলে তোমাতেই তুমি সন্তুষ্ট থাকবে। খবরাখবর তোমাকে পাল্টে দেয় উল্টে দেয়, তুমি আর তোমার দেশকাল হয়ে যায় অন্য পর্যায়ের। তুমি অন্যকালে অন্যলোকে বিচরণশীল হয়ে নিজেকে পরিত্যাগ কর। তুমি কি ভাবো এখানেই সমস্ত কিছুর অবসান? ইহা নহে, ইহা নহে। ইহারও পর ইহা আছে। ইহাতেই ইহার ক্ষান্তি হয় না কদাপি।’

আমি বলতে যাচ্ছিলাম, বাপরে বাপ, সামলে নিলাম বড়জোর। মুখ ফসকে বলে ফেললে আর উপায় ছিল না। বৃত্তগোলক আমার চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করে দিত বকেঝকে। তার পছন্দ একনিষ্ঠ নির্বাক শ্রোতা, সে যা বলবে শুনে যেতে হবে প্রশ্ন না তুলে। তার ভান্ডারে অশেষ জ্ঞান। সেসব উপদেশ হয়ে বার হতে শুরু করলে আর আটকায় না। ধৈর্য রাখতে পারে না শ্রোতারা। তাদের উসখুসুনি শুরু হতে থাকে আর তা বৃত্তগোলকের নজরে এলেই রক্ষে নেই। শ্রোতাদের সে দূর্-দূর্ করে তাড়িয়ে দেবে। অবশ্য মানতেই হবে, ঢোলকবাবু যা বলে তা একেবারেই বাস্তব।

যাই হোক, এতক্ষণ এতসব অবান্তর প্রসঙ্গ আলোচনায় চলে এল। আছিম খুল্লাকে নিয়ে কথা হচ্ছিল, তার সেই ছইওয়ালা নৌকো আর কুটুমএলো নদী ধরে যাতায়াত। জ্যোৎস্নারাতে নদীর চরে ছায়ামানবীদের লীলাখেলা আর একদিন ইন্দ্রপুরীতে গিয়ে ইন্দ্র হয়ে যাওয়া। মনপবনের বাতাস লেগে ছইওয়ালা নৌকো আর চলে না, নদীর ঘাটে নিশ্চুপ আটকে থাকে মন খারাপ করে। নৌকো চড়বে কে? আছিম তো এখন দেবরাজ ইন্দ্র, ঐরাবতের পৃষ্ঠে চেপে বজ্র হাতে ঘুরে বেড়ায়। সে কি আর কুটুমএলো নদী ধরে ছইওয়ালা নৌকো চড়ে যেতে পারে? তার কত মান এখন। সেই খবর আবার ঘাটে ঘাটে রটে যায়, আছিম খুল্লা দেবরাজ ইন্দ্র হয়ে গেছে। কেউ তাতে আশ্চর্যান্বিত হয়, কেউবা ঈর্ষান্বিত। কেউ আর এখন নদীর ঘাটের দিকে চেয়ে থাকে না, সবারই ওপর দিকে চোখ হয়ে যায়। সবাই আকাশে তাকিয়ে আছিম খুল্লার সন্ধান চালায়। মানুষ কেমন পাল্টে যেতে থাকে। অভ্যেস পাল্টে যায়, জীবনযাপন অচেনা ঠেকে। সবাই বৃত্তগোলক ঢোলকবাবুর বর্ণনা করা খবরাখবরের প্রভাব। তাতে আছিম হয়ে যায় ইন্দ্রলোকে ইন্দ্র আর মর্তবাসীরা ওপরদিকে তাকাতে শেখে। কুটুমএলো নদী অবশ্য তেমনি বয়ে যেতে থাকে আর নদীর ঘাটে ছইওয়ালা নৌকো দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ।

আমার খিটিং অথবা শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়ে যাওয়াতে কী আর আশ্চর্য? আছিম খুল্লা তো এভাবেই দেবরাজ ইন্দ্র হয়ে গিয়েছিল। সবারই এমন নানা চরিত্রে নানা ভূমিকায় প্রকাশ বা বিকাশ ঘটতে থাকে জীবনভর। কেউ টের পায়, কেউ পায় না। টের পায় যারা তারা সব চেপে যায়। এটাও যে অসুখ একপ্রকার তা বোঝে কে? আমি নিজে এটাকে অসুখ বলেই জানি। এমন এক অসুখ যাতে আমি বলে স্বাধীন কাউকে পাওয়া যায় না। আমি তখনই তো সন্দেহ করেছিলাম, কারণ খবরের কাগজে ঘুজিয়াক দেশের খবর পড়তে পড়তেই খিটিং হয়ে গিয়েছিলাম। ঝড়-জল-বৃষ্টি ইত্যাদি কোথাও কিছু নেই, খামোখা খিটিং হয়ে যাব কেন নাহলে?

আছিম খুল্লা ইন্দ্র হয়ে থাকতে পারেনি চিরকাল। কেউ এমন থাকতে পারেও না। খবরাখবরের প্রভাবে যে একবার অন্যরূপ হতে শেখে তার রূপের পরিবর্তন ঘটতেই থাকে। এ অসুখ নয় তো কী? খবরাখবর রোগজীবাণুর ভূমিকায় অবতীর্ণ। আছিম তাই অনাদিকাল ইন্দ্র হয়ে থাকবে না সেটা বোঝাই গিয়েছিল। তার ইন্দ্রত্ব গেল অচিরেই, তবে সান্তনার কথা এই যে পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটল না। তা ঘটবে কেন, রোগজীবাণুরও তো বাসস্থান দরকার? বাহক যদি না থাকে তারাই বা থাকবে কোথায়? এ কারণেই রোগজীবাণু বাহককে মারতে চায় না, বাহক মরে তার নিজ স্বভাবে। বাহক মরলে খবরাখবর দেখবে কে? তাদেরও অস্তিত্ব তখন বিপন্ন। এটাই জগতের নিয়ম। এর অন্যথা ঘটে না।

আছিমের ইন্দ্রত্ব খোয়াবার কারণ আবার সেই খবরাখবর। না হলে ইন্দ্রলোকে কী আরাম কী সম্পদ তার হদিশ কে জানত? জানল বলেই অসুর আর দৈত্যদানবের দল ধেয়ে গেল ইন্দ্রলোক অধিকারের উদ্দেশ্যে। আছিম কি যুদ্ধ করতে শিখেছিল কোন কালে? সে মনপবনের বাতাস বাহিত ছইওয়ালা নৌকো চড়ে কুটুমএলো নদীপথে পাড়ি জমাত। অসুর-দানবেরা আক্রমণ করতে আসছে দেখে আছিম আগেভাগেই পলায়নের রাস্তা ভাবল। তারপর যা কান্ড ঘটলো তা আর কহতব্য নয়। আছিম চলে গেল দৈত্যপুরীতে, গিয়ে সেখানে দৈত্যরাজা হয়ে বসল, অন্যদিকে দৈত্যদানবরা ইন্দ্রাদি দেবগণে রূপান্তরিত হল। আমূল ওলটপালট দৃশ্যপট, খবরাখবরের এমনই খেলা। ইন্দ্রপুরী হয়ে গেল দৈত্যপুরী আর দৈত্যপুরী হল ইন্দ্রপুরী।

মনপবনের বাতাসচালিত ছইওয়ালা নৌকো বাঁধা পড়ে থাকে নদীর ঘাটে। আছিম আর আসে না, নৌকোও চলে না। সে এখন দৈত্যপুরীতে বাস করে দৈত্যরাজা হয়ে। সেখানেও চিরকালীন বসবাস সম্ভব হল না। অল্প কালের মধ্যেই সে চলে গেল অন্য বাসস্থানে অন্যরূপে। খবরাখবরের প্রভাবে ব্যতিব্যস্ত জীবনযাপন, স্থিতধী হওয়ার জো নেই। চরিত্র পাল্টায়, মানুষ পাল্টায়, চেহারা পাল্টায়, পাল্টে যায় পরিবেশ ও পরিস্থিতি। জনজীবনের গতিধারা আঁকাবাঁকা, সোজা পথের হদিশ হারিয়ে গেছে। আছিমের আর মনে থাকে না ছইওয়ালা নৌকোর কথা, ঘোড়া বা গাধা বা খচ্চরের কথা যাকে সে তার গ্রামের ঘাটের কাছাকাছি রেখে এসেছিল। খবরাখবরের দাপট তাকে আর আছিম খুল্লা হয়ে থাকতে দেয়নি। সে কি আর কোনদিন তার স্বরূপ ফিরে পাবে? নাকি ফিরে পেলেও আগের মত জীবনের নাগাল পাবে? যা হারায় তা তো ফেরত পাওয়া যায় না। আমিও তো এভাবেই হারিয়ে ফেলেছি আমার আসল আমিকে, খিটিং-মিটিং বহুবিধ আজব মানুষ হয়ে জীবন অতিবাহিত করে চলেছি। সবই খবরাখবরের দৌলতে। মানুষ আর মানুষ থাকতে পারে না। এই যে রহস্য তা-ও কি কেউ অনুধাবন করতে পারে? অন্ধকারে হাতড়ে ঘুরে মরছে অন্ধ মুষিকের দল। প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas magazine

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *