রাজীব তন্তুবায়
জ্বলন্ত দুপুরে নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে দ্বারকেশ্বর। খাঁ খাঁ করছে দুই পাড়। এক পাশে উঁচু ঢিপির মতো জায়গাটায় একটা সুবিশাল কুসুম গাছ, বেহায়ার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রোদ মাখছে গায়। তারই নীচে হেলান দিয়ে একাই বসে রয়েছে দুলু। খালি গা। ন্যাড়া মাথায় সদ্য গজানো চুলে দর দর করে ঘামছে ছেলেটা।
কিছুটা দূরে দু-একটা আধপোড়া সাদাকালো মড়াকাঠ, চিতাভস্ম আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাঙা কলসির টুকরো। পাশেই বালিগুলো চিকচিক করছে রোদে। একদৃষ্টে সেদিকেই তাকিয়ে আছে দুলু।
নামে নদী, আসলে শুধু বালি আর বালি। কিছুদিন আগে পর্যন্ত যে ক্ষীণ জলধারাটা অতিকষ্টে এঁকেবেঁকে বয়ে চলছিল মাঝ বরাবর, শেষ বোশেখের রক্ত-শুকানো রোদ তাও যেন শুষে নিয়েছে সব। অথচ এই দ্বারকেশ্বরই গেল বর্ষায় দু’কূল ছাপিয়ে ভরে উঠেছিল কানায় কানায়। কী তার ভয়ঙ্কর চেহারা ! তারপর বর্ষা ফুরোলেই আবার দুর্বল হয়ে পড়ে দ্বারকেশ্বর। শেষমেষ, চোত-বোশেখ এলেই এক বুক বালি নিয়ে পড়ে থাকে, নির্বাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখে সবকিছু। এই যেমন এখন দেখছে দুলুকে, কীভাবে হাঁটুমুড়ে আনমনা হয়ে বসে আছে একাকী।
লখাইখুড়ো গরু-ছাগল নিয়ে বাড়ি ফিরছিল সেই পথে। দুলুকে ওইভাবে বসে থাকতে দেখে একটু যেন থমকে যায়। রোদে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া ছাতাটা বন্ধ করে কাছে এসে বলে, ‘কী রে দুলু, আজকেও ইখেনে বসে আছু ? তোকে যে সেদিন ইদিকে আসতে বারণ কৈল্লম বাপ!’
চেনা কণ্ঠস্বর শুনে চোখ তুলে তাকায় দুলু। একটা কথাও বেরোয় না মুখ দিয়ে। শুকনো গলায় বারকয়েক ঢোক গিলার চেষ্টা করে শুধু।
লখাইখুড়ো মাথা থেকে গামছাটা খুলে কোমরে শক্ত করে বেঁধে, দুলুর পাশে এসে বসে। কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘এইভাবে রোদ বেলায় একা একা শ্মশানকুঁড়ে বসে থাকতে নাই তোকে। যা হবার তা হয়েছে। আর ত করার কিছু নাই বাপ। তুই ঘরের বড়। তোকেই ত সব সামলাতে হবেক। এইভাবে থাকলে কি আর চলবেক রে! যা, ঘর যা।’
দুলুর কোনো সাড়াশব্দ নেই । সে তখনও রোদে পোড়া গাছটির মতোই চুপচাপ। লখাইখুড়ো একনাগাড়ে কত কথা বলে চলেছে, একটাও যেন কানে ঢুকছে তার। এই কটাদিন এত কথা, এত আশ্বাস, এত সমবেদনা এমনকি এত কুৎসা কানের ভিতর যাওয়া আসা করেছে, সব যেন একসাথে জমাট বেঁধে পাথরের মতো আটকে গেছে গলি পথে। যা ভেদ করে সব কথা আর কানে যায় না এখন।
লখাইখুড়ো তখনও বলে চলেছে, ‘আর যাই হোক, তোর বাবা ত আর তেমন একটা ভাল লোক ছিল নাই রে।’ কথাটা শেষ হতে না হতে গরুগুলো গোঙানি দিয়ে দৌড়াতে শুরু করে নদীর উপর। হুড়োহুড়ি লেগে যায় নিজেদের মধ্যে।
‘এই দ্যাখ। এই শালার গরুগুলান এক জায়গায় থির থাকার লয়। জল খাবেক মনে হচ্ছে।— ইখেনে একা বসে থাকিস না দুলু। ঘরকে যা…’ বলেই উঠে পর ‘হৈ’ ‘হৈ’ করতে করতে গরুর পিছনে দৌড় লাগায় লখাইখুড়ো।
কানের পাথরটা যেন নড়ে ওঠে একটুখানি। অস্থির হয়ে ওঠে দুলু। সঙ্গে সঙ্গে চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে জল গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে। লোকে আর যাই বলুক, সে তো জানে তার বাবা কেমন লোক ছিল । দোষের দোষ, বড্ড মদ গিলত লোকটা। মদের ঘোরে কোন হুঁশ থাকত না তার। কিছু বললেই হাত চালিয়ে দিত এলোপাতাড়ি।কতবার চড়-চাপড় খেয়েছে দুলু — দুলুর মা । মায়ের তো পিঠের চামড়া, চুলের গোড়া, শুকনো গাল রোজকার প্রহারে অসাড়ই হয়ে গিয়েছিল প্রায়। সেবার এমন মার খেয়েছিল দুলু, জ্বরই চলে এসেছিল কাঁপুনি দিয়ে। তখন বাবা নিজে গিয়ে গ্রামীণ ডাক্তার সনাতনবাবুর কাছ থেকে ওষুধ এনে দিয়েছিল। দুলু প্রশ্ন করেছিল, ‘তুমি আমাকে মারবেই যখন, তখন ওষুধ আনলে কেনে?’
ফ্যালফ্যাল করে হেসেছিল বাবা। মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলেছিল, ‘ বাবারা এমনিই হয়। যখন বাবা হবি, তখন বুঝবি।’
জ্বরের ঘোরে শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল দুলু।
ইদানিং কয়েকটা মাস অনেকটা কমে এসেছিল মাতলামি। তবুও কেন যে আবার…। ভাবতে ভাবতে শিউরে ওঠে দুলু। হাঁটুতে মাথা গুঁজে ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে আবার।
ততক্ষণে নড়েছে গাছের পাতাগুলো। শুকনো বাতাস বইতে শুরু করেছে নদীর উপর। প্রচন্ড গরম । নাক কান ঝলসে যাওয়ার জোগাড়। দুলুর তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে শুধু শূন্যদৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে দূরে। যেখানে দুটো চিল ডানা মেলে উড়তে উড়তে গোল গোল করে ঘুরছে নদীর বাঁকে। আরও দূরে, ওই পাড়ে আধ-ভাঙ্গা কুঁড়েটার দিকে চলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। দেখতে দেখতে ঝাপসা হয়ে আসে চোখদুটো। যেখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে একটা অবয়ব — কোটরে ঢুকে যাওয়া দুটো চোখ, হাসলেই যে চোখের পাশের চামড়া কুঁচকে যায়। হাসছে লোকটা। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে দুলু।
গত বর্ষায় দ্বারকেশ্বরের জল পৌঁছে গিয়েছিল তাদের গ্রামে। এত বৃষ্টি হয়েছিল, তাদের মাটির ঘরের একটা দেওয়ালই ধসে পড়ে ছিল সেবার। বিরাট একটা অসহায়তার ছায়া ফুটে উঠেছিল বাবার চোখে-মুখে। এক বুক নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিল, ‘পার্টির লোকগুলা সবাইকে ঘর দিল, আমাদের আর দিল নাই রে। বললেই বলে পরের লটে নাম আসবেক। পরের লট যে আর কবে হবেক?’
মুখ ফসকে দুলু বলে ফেলেছিল, ‘তুমি নকি পার্টির লোকের সঙ্গে ঘুরাঘুরি কর নাই। অন্য পার্টির লোকের সঙ্গে কথা বল, মোড়ে একসঙ্গে বসে চা খাও। তাই ত উয়ারা আমাদেরকে ঘর দেই নাই!’
‘তুই কুথায় শুনলি ই কথা?’
‘শুনেছি।’
‘সে ত লোকে অমন বহু কিছু বলে। গাঁয়ে ঘরে থাকতে গেলে মানুষের সঙ্গে মানুষ কথা বলবেক নাই? তাতে যদি ঘর না দিচ্ছে ত নাই দিক।’
‘তুমিও ত বিপ্লবের বাবার মত পার্টির সঙ্গে ঘুরতে পার।’
‘ধুর, গরিব লোকের আবার পার্টি কী র!’
বড় আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলেছিল বাবা। তারপর বৃষ্টি থামতেই, জল নামতেই, দুই বাপ-বেটা মিলে লেগে পড়েছিল দেওয়াল তোলার কাজে। তখন বাবার সে কি আনন্দ। যে কোন কাজে হাত লাগিয়ে সাহায্য করলে ভীষণ খুশি হত বাবা। নতুন করে উদ্যম ফিরে পেত কাজে। দুলু সেটা বুঝত খুব। তাই তো নিজের থেকেই এগিয়ে আসত এইভাবে।
‘তুমি মদ খাও কেনে বাবা ? ছাড়ে দিতে পার নাই ?’ মাটির তাল এগিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করেছিল দুলু।
‘কতবার ভাবেছি ছাড়ে দিব। কিন্তু কই আর ছাড়তে পারল্যম। বিকাল ফুরায় সন্ধ্যা হলেই আর থাকতে লারি।’ দেওয়ালে মাটি লেপতে লেপতে মাথা নেড়ে বলেছিল বাবা।
‘কেনে, ছাড়তে পার নাই কেনে ?’ বিস্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছিল দুলু। ‘তোমার কিছু হয়ে গেলে তখন কী হবেক ? একদিন দেখবে ওই মদেই টানে লিয়ে যাবেক তুমাকে।’
হো হো করে হেসে ছিল বাবা। ‘না রে দুলু, অত সহজে মরব নাই। ইটা হচ্ছে কেতরের জীবন। তাছাড়া, মদ খায়ে মরলে সরকার ত একগাদা টাকা দিবেক তোদের। ভাবনা কী ? হা-হা-হা…’
পাশেই রান্না করছিল দুলুর মা। ঝনঝন করে বলেছিল, ‘আর তখন তুমি শ্মশান থাকে উঠে আসে ভোগ করবে সেই টাকা! আদিখ্যেতা রাখার জায়গা নাই।’
‘এই দ্যাখ, এই দ্যাখ। তোর মা আর ইয়ার্কি বুঝল নাই কন দিন।’ ঘাড় নেড়ে নেড়ে কথাগুলো বলেছিল বাবা।
‘না বাবা, তুমি আর ভাটি যাবে নাই বলে দিলম। নইলে আমিও মদ খাওয়া ধরব তুমার মতন।’ জোর দিয়ে বলে ওঠেছিল দুলু।
‘ধুর বোকা। অমন বলতে আছে নকি !’
বাবার কথাটা শেষ হতে না হতে মা বলেছিল, ‘মাতালের ছেলা ত মাতাল হবেকেই। দাঁড়া, যেদিন মহিলা সমিতির সব মহিলা মিলে ঠ্যাঙা-লাঠি লিয়ে মদের ঠেকগুলা সব ভাঙতে বেরাব, সেদিন বুঝবি।’
‘এই দ্যাখ, কী সব বইলতে শুরু কইল্ল তোর মা।’ হালকা প্রতিবাদ করে ওঠে বাবা, ‘ সব কথা ধইল্লে চলে?’
‘মা, তুই চুপ কর। নইলে কথা বলতে বলতে তোদের ঝগড়া শুরু হয়ে যাবেক। মিছামিছি অশান্তি ঘরে।’ পরিস্থিতির সামাল দেওয়ার চেষ্টা করল দুলু।
‘ ঠিক আছে লে, ধীরে ধীরে একদিন ছাড়ে দিব, হল্য ? চল ত ইবার, নদীতে গা-টা ধুয়ে আসি। বেলা হল্য।’ বাবার মুখে কথাগুলো শুনে বড্ড ভাল লেগেছিল সেদিন। স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল দিনগুলো। একরকম প্রায় নাচতে নাচতে স্নান করতে গিয়েছিল দুলু।
দ্বারকেশ্বরের তখন ভরা যৌবন। দু’বাপ-বেটা গামছায় ছাকনি দিয়ে চুনো মাছ ধরে বাড়ি ফিরেছিল খুশি মনে। হঠাৎ কী করে যে কী হয়ে গেল, ভাবতে ভাবতে বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠল দুলুর। অজান্তেই হাঁটুর উপর মৃদু কামড় বসাতে লাগলো কাঁপা দাঁতে। জোরে জোরে শ্বাস বইতে লাগলো নাক বেয়ে।
সেদিন সকালে বৃষ্টি হয়েছিল খুব। দুপুরে বৃষ্টি থামলেও মেঘ কাটেনি তখনও। অন্যদিনের মতো সেদিনও বাবা, দুলু আর তার বোন ফুলকি খেতে বসেছিল বারান্দায়। কথা হতে হতে ফুলকি বলে ফেলে, ‘জান বাবা, দাদা বলছিল তুমার কাছে টাকা লিয়ে একটা বড় ফোন কিনবেক। ফেসবুক ন কী সব কইরবেক।’
‘কেনে, যেটা আছে উটায় হচ্ছে নাই ?’ ভাত চিবোতে চিবোতে বলে দুলুর বাবা।
‘ইটা কন ফোন হল্য? আমার বন্ধুদের সবার বড় ফোন আছে। আমারই শুধু নাই। সবার কাছে উটা বার করতে লইজ্জা লাগে — তুমি কী আর বুঝবে !” একরাশ অভিমান উগরে দিয়েছিল দুলু।
‘লোকের সঙে সঙ ! তোর বাপের কি আর অত টাকা আছে যে বড় ফোন কিনে দিবেক। নিজে যখন রোজগার করবি, তখন লিবি।’ গম্ভীর স্বরে কথাগুলো বলেছিল বাবা।
দুলুর মা কাছেই বসেছিল। সে তখন বলে, ‘কেনে, মদ গিলার বেলায় টাকা আছে। নিজের বুনের বেলায় টাকা আছে। আর ছেলাটাকে একটা ফোন কিনে দিবার বেলায় টাকা জুটছে নাই ?’
চুপ করে খেতে থাকে বাবা। মা থামে না, ‘ আর জুটবেক কী করে, তোদের লিয়ে কন ভাবনা আছে? যা করবো সেই আমি। বাপ হয়েছে!’
‘বেশি কথা বাড়াস না দুলুর মা। শান্তিতে দুটা খাতে দে। তাতাস না আমাকে। মনটা ভালো নাই।’ ধমক দিয়ে উঠেছিল দুলুর বাবা।
‘বুইনের কথা উঠতেই অমনি গায়ে ফস্কা পড়ে গেল?’ মুখ নেড়ে নেড়ে বলতে থাকে মা। ‘ভাইগ্নাটার ভুজনায় অত মোটা রুপার বিছাটা কে দিতে বলে ছিল ? দুটা বালা দিলেই ত হত্য। তার বেলায় পিরিত একেবারে উপচে পড়ছে। কেনে, উয়াদেরও ত অনেক আছে। কোনদিন কিছু দিয়েছে তুমার ছেলা-মিয়াদের হাতে?’
‘তাতে কী হয়েছে?’ উত্তেজিত হয়ে ওঠে দুলুর বাবা। ‘আমার ভাইগ্নাকে আমি কী দিব, তাতে তুই বলার কে?’
‘বঠে, বঠে…!’ দুলুর মাও বলতে ছাড়ে না, ‘নিজের ছেলাটার বেলায় শুধু নাই। আর ভাইগ্নার বেলায় টাকাগুলো আকাশ থাকে উড়ে আসে।’
‘না, তোর বাপ যে দিয়ে যায় । এই লে, খাবই নাই আর।’ বলে দাঁত কষে হুর্ করে ছুঁড়ে দেয় ভাতের থালাটা। উঠোন জুড়ে ভাতে ভাতময়। দেখেশুনে ভয়ে কেঁদে উঠেছিল ফুলকি। দুলুও গম্ভীর।
গম্ভীর না হয়ে উপায় কী? এ তো আর প্রথম অশান্তি নয়। জ্ঞান হওয়া অব্দি রোজ রোজ কত অশান্তি দেখে বড় হয়েছে। এ একরকম গা সওয়া হয়ে গেছে তার। কিন্তু কতদিন আর সহ্য হয় ? কতবার কতভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছে বাবা-মাকে। বোঝানোর সময় ওরা বুঝেওছে তখন। যেন আর কোন দিন অশান্তি করবে না বাড়িতে। কিন্তু পরে আবার সেই কে সেই! না পেরে বহুবার ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে নদীর বালিতে এসে একটু খানি শান্তি পাওয়ার চেষ্টা করেছে দুলু। কিন্তু চাইলেই কি আর হয়! যার অন্তরে অশান্তির স্রোত, নদী তাকে কীভাবে সান্ত্বনা দেয়?
কতবার মনে হয়েছে ঘরবাড়ি ছেড়ে ছুড়ে উপর পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে বেঙ্গালোরে কাজে চলে যাবে। দুটো টাকাও রোজগার হবে। রোজকার এই অশান্তির হাত থেকে তো বাঁচবে অন্তত! কিন্তু ফুলকির কথা ভেবে আর এগোতে পারেনি। সে পালিয়ে গেলে তো আর অশান্তি থামবে না। তখন ফুলকি বেচারি একা একা কেঁদে মরে যাবে।
এদিকে দুলুর মা কাঁদো কাঁদো গলায় বলে চলেছে, ‘ ছইড়া, কত ভাত ছড়াবি ছইড়া। দ্যাখি তোকে কে আদর করে খাওয়ায়? আমি বলে তোর মত মাতালের সঙ্গে এত বছর ঘর করছি। অন্য মিয়া হলে কবে পালাত তোর ঘর ছাড়ে। হাঁড়-মাস জ্বালে দিলি আমার।’ বলেই কান্না জুড়ে দেয় সেখানে।
কোন কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল বাবা। দুলুর তখন করুণ অবস্থা। ভাত আর গলা পেরোতে চায় না। তবুও বিষন্ন মনে যতগুলো পারল খেয়ে, হাত ধুয়ে, চুপচাপ উঠে পড়েছিল কোঠায়।
শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে, মাধ্যমিকের রেজাল্টটা বেরোক। যদি পাশ করে তাহলে অন্য ভাবনা। নইলে সোজা বেঙ্গালোর।
ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়াল ছিল না তার। ঘুম ভাঙে মায়ের চিৎকারে। ‘ও মাগো, মরাই দিল গো — এ দুলু, আয়রে বাবা — আমাকে মারে দিল রে…’
চমকে উঠেছিল দুলু। বাবা আবার মদ খেয়ে এসেছে ! কিছু না ভেবে সিঁড়িকাঠ বেয়ে তরতর করে কোঠা থেকে নেমে পড়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে। দেখে, বাবা তার মাকে চুলের মুঠি ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে রাস্তার দিকে। পড়ে পড়ে চিৎকার করছে মা।
স্থির থাকতে পারে না দুলু। ছুটে এসে যতটা পারা যায় গায়ের জোরে ধাক্কা দেয় বাবাকে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে বাবা। কাছেই একটা বড় পাথরের চাঁই ছিল উঠোনে। দড়াম করে মাথাটা ঠোক্কর খায় সেই পাথরটার উপর। সঙ্গে সঙ্গে নাকে-মুখে রক্তে রক্তময়। তীব্রস্বরে গোঙাতে গোঙাতে কাটা ছাগলের মতো ছটফট করতে থাকে মাটির উপর। দেখতে দেখতে একবার জোরে কেঁপে ওঠে শরীর, তারপর ধীরে ধীরে থেমে যায় কম্পন।
‘ই কী করলি রে দুলু ! ই কী করলি বাবা…’ আর্তনাদ করে ওঠে দুলুর মা। ততক্ষণে পাড়ার লোকজন সব জড়ো হয়ে গেছে দুলুদের উঠোনে। খবর পেয়ে সনাতন ডাক্তারও ছুটে এসেছিলেন সেখানে। ভিড় ঠেলে কাছে গিয়ে দুলুর বাবার হাতটা ধরে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ঘাড় নেড়ে বলেন, ‘সুবিধা বুঝছি নাই, গাড়ি ডাক শিগগির !’
‘বাবা গো’ বলে কেঁদে লুটিয়ে পড়ল ফুলকি। কাঁদতে কাঁদতে মা তো অজ্ঞান। পাড়ার লোকই তড়িঘড়ি টোটোয় তুলে ছুটল হাসপাতালে। দিন কয়েকের মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেল সব ছোটাছুটি। দুলু তখন চুপচাপ। কত লোক, কত কথা, কত কোলাহল। তারপর বাকি তো সব নিজের চোখেই দেখেছে দ্বারকেশ্বর।
হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া এসে লাগে দুলুর মুখে। কেঁপে ওঠে দুলু। পশ্চিম আকাশে সূর্য তখন ঢেকে গেছে ঘোর কালো মেঘে। বাতাসের গতিটা একটু বেড়েছে। কালবৈশাখী এলো বলে। দুলু তখনও এক দৃষ্টিতে তার বাবার চিতাভস্মের দিকে তাকিয়ে।
‘দাদা!’
হঠাৎ ডাকে দুলু পিছন ফিরে তাকায়। দেখে ফুলকি এসে দাঁড়িয়েছে কোনসময়। ছোট ছোট চোখ করে বলে, ‘ঘর চ, মামাদাদু আসেছে। আমাদের নিয়ে যাবেক। মা বইল্ল তুইও যাবি।’
উঠে দাঁড়ায় দুলু। কিছু না বলে দু’এক পা করে এগিয়ে যায় নদীর দিকে। এসে থামে চিতাভস্মের কাছে। ফুলকিও তার পিছনে এসে দাঁড়ায়। চোখ তুলে ফুলকির দিকে তাকায় দুলু। কাঁদছে ফুলকি। শান্ত স্বরে দুলু বলে,’তোরা যা বুনি, আমি যাব নাই।’
হাত দিয়ে চোখ মুছে ফুলকি বলে, ‘চ ন রে দাদা। ইখেনে থাকিস না।’
গর্জে ওঠে দুলু, ‘বইল্লম ত যাব নাই। ইখেন ছাড়ে কুথাও যাব নাই।’ বলেই নদীর চরে বালির উপর দৌড়াতে থাকে — দূরে — অনেক দূরে। ফুলকি শুধু নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সেই দিকে।
কালবৈশাখী তখন ভয়ঙ্কর নদীর পাড় জুড়ে। হঠাৎ ‘চড়াং’ করে বাজ পড়ে কিছুটা দূরের একটা তালগাছে। কেঁপে ওঠে দুলু। ঝলসে ওঠে চোখ। থমকে দাঁড়ায় নদীর মাঝে। পিছন ফিরে দেখে ফুলকি কেমন কুঁকড়ে গিয়ে দু’হাত দিয়ে কান ঢেকে বসে পড়েছে বালির উপর। থরথর করে কাঁপছে ভয়ে।
সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বোনকে। হাতটা ধরে টেনে তুলে তাকে। উড়ে আসা ধুলোবালি ভেদ করে তড়িঘড়ি হাঁটা লাগায় পাড়ের দিকে। বুক চিতিয়ে পড়ে থাকে দ্বারকেশ্বর। বিদ্যুতের ঝলকানিতে চেয়ে দেখে কীভাবে নরম বালিতে ছোটো ছোটো দাগ রেখে দুই জোড়া পা এগিয়ে চলেছে ঘরের দিকে। প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine
