নীলাদ্রি পাল
বাংলার আনাচে কানাচে প্রতিবেদনটি ‘প্রতিভাস’ ওয়েব ম্যাগাজিনের পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। আমাদের প্রতিদিনের চলার পথের ধারে চোখের সামনে থাকা বিভিন্ন স্থাপত্যের পিছনে যে বিশাল ইতিহাস বা বিভিন্ন ঘটনা রয়েছে সেই বিষয়ে আমরা জানি কজন? সেসব নিয়েই এই প্রতিবেদন বাংলার আনাচে কানাচে। ম্যাগাজিনটির অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর সংখ্যায় আলোচনা করব খোদ কলকাতা শহরের রোমহর্ষক ঘটনা সমূহ নিয়ে। অর্থাৎ কলকাতার বিভিন্ন স্থাপত্য ও বিভিন্ন জায়গা নিয়ে যে ভৌতিক গল্প জড়িয়ে আছে, সেই গল্প বলব এই তিন সংখ্যায়।
ভূত মানে অতীত। অতীতের স্মৃতি একদিকে যেমন দেয় সুখকর অনুভূতি আবার কখনো দেয় কষ্ট। কখনো কষ্টের অনুভূতির মধ্যে জড়িয়ে থাকে হাড়হিম করা ভয়াল স্মৃতি। লোকমুখে সেই ভয়াল স্মৃতির কথা শুনে গা ছমছম করে ওঠে।
পুরনো যেকোনো জিনিসের সাথে মিশে থাকে কোনো না কোনো গল্প। আধুনিক মেট্রো শহর আমাদের কলকাতা যতোই আধুনিক হয়ে উঠুক না কেন, সেখানেও রয়েছে অনেক পুরনো স্মৃতি। আর সেই স্মৃতি ঘিরে খোদ কলকাতারই বেশ কিছু জায়গা নিয়ে রয়েছে ভূতুড়ে গল্প।
ভূতের খাস ডেরা কলকাতার কবরস্থান ও শ্মশান দিয়ে শুরু করি কলকাতার ভূতুড়ে জায়গার গল্প। কলকাতায় রয়েছে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অনেক কবরস্থান। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান, গ্রিক, ইহুদি, আর্মেনিয়ান, চীনা সব সম্প্রদায়ের মানুষদের কবরস্থান রয়েছে খাস কলকাতায়।

১৭৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পার্ক স্ট্রিটের শেষ প্রান্ত মল্লিক বাজারে আচার্য জগদীশচন্দ্র রোডের কাছে ‘সাউথ পার্ক স্ট্রিট সেমেট্রি’ দিয়ে শুরু করা যাক কলকাতার ভূতুড়ে স্থানের গল্প। ১৭৯০ সাল পর্যন্ত এই কবরস্থানে কবর দেওয়া হয়েছিল। কলকাতার প্রাচীন চার্চ হীন কবরস্থান এটি। বর্তমানে এটি একটি হেরিটেজ সাইট হলেও কলকাতার বিখ্যাত ভৌতিক স্থানগুলোর একটি এই ‘সাউথ পার্ক স্ট্রিট সেমেটরি’। অধিকাংশ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মৃত কর্মচারী ও তাদের পরিবারের মৃত মানুষদের কবর দেওয়া হত এইখানে। শোনা যায় উঁচু পাঁচিল ঘেরা গাছপালায় ঢাকা এই কবরস্থানের কবরের অধিবাসীরা রাত হলেই জেগে ওঠে। তাদের উপস্থিতি টের পাওয়ার হাত থেকে রেহাই পেতে আশপাশের বাসিন্দারা রাতে তাদের বাড়ির জানলা বন্ধ রাখেন। সন্দীপ রায়ের ফেলুদা সিরিজের ‘গোরস্থানে সাবধান’ সিনেমার শুটিং হয়েছিল এই কবরস্থানে। জানা যায়, এই সিনেমার শুটিংয়ের সময় এমন অনেক ঘটনা ঘটেছিল যা সাধারণত ঘটে না। এখানে যারা ঘুরতে আসেন তাদের অনেকেই এই কবরস্থানের ভিতরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু কবরস্থানের গেটের বাইরে এলেই সুস্থ হয়ে যান।

রাস্তার অপরদিকে রয়েছে ১৮৪০ সালে নির্মিত ‘লোয়ার সার্কুলার রোড সেমেটরি। এই কবরস্থানে এখনো কবর দেওয়া হয়। ব্রিটিশ কর্মচারীদের সাথে কিছু বিখ্যাত মানুষের কবরও রয়েছে এইখানে। ছোটখাটো কিছু ভূতুড়ে ঘটনা ঘটলেও সবচেয়ে বেশি ভয়াল ঘটনা হল সিভিল সার্ভেন্ট স্যার উইলিয়াম ম্যাকনটনের কবরে। প্রথম ইঙ্গ আফগান যুদ্ধে তিনি নিহত হন। শত্রুপক্ষ তার মরদেহ ছিন্নভিন্ন করে ছড়িয়ে দেয়। ম্যাকনটনের স্ত্রী বহু কষ্ট করে ওই ছিন্নভিন্ন দেহ একত্র করে এই কবরস্থানে এনে কবর দেন। শোনা যায়, এই কবরটির সামনে গিয়ে এই ঘটনার কথা বললে কবর সংলগ্ন গাছটি থরথর করে কাঁপতে থাকে।
ট্যাংরা-তপসিয়া অঞ্চলে চায়নাটাউনে রয়েছে কয়েকটি কবরখানা। চিনাদের কবর দেওয়া হয় এই কবরস্থানগুলিতে। কবরস্থানগুলি নির্জন আর বেশ ছোট। এখানকার ভারি বাতাস অনেকেই টের পান। সবসময় মনে হয় সঙ্গে কেউ আছে। এই কবরস্থানগুলিতেও নানান ভৌতিক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন অনেকেই।
পার্ক সার্কাস অঞ্চলে রয়েছে হিন্দুদের একটি কবরখানা। গোবরা বাস স্টপেজের কাছে এই কবরস্থান। খুব বেশি প্রাচীন নয় এটি। মৃত সদ্যোজাত ও হিন্দু শিশুদের কবর দেওয়া হয় এইখানে। কিছু বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী গুরুদেবকে সমাধিস্থ করা হয়েছে এই কবরস্থানে। অনেক সময় শিশুদের কান্নার আওয়াজ ও খোল করতালের আওয়াজ শুনেছেন অনেকে। অনেক সময় এই অঞ্চলের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে।

নিমতলা মহাশ্মশানকে অনেকে ভৌতিক শ্মশান বলে মনে করেন। এই মহাশ্মশান লাগোয়া শিব মন্দিরটি বিখ্যাত ভূতনাথ মন্দির হিসেবে পরিচিত। ভূতনাথ মন্দিরের পাশের শ্মশানে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমাধি। অঘোরী সন্ন্যাসীরা এই শ্মশানে সাধনা করতে আসেন অমাবস্যার রাতে। গভীর রাতে আত্মাদের ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন এই শ্মশানের অনেক প্রহরী।
১ নম্বর গার্স্টিন প্লেসে প্রাচীন একটি কবরস্থান ও হাসপাতালের জমির ওপর গড়ে উঠেছিল আকাশবাণীর পুরনো অফিস। এই অফিসে অনেকে সাহেবদের আত্মার ঘোরাফেরা দেখেছেন। দেখেছেন নানানরকম ভৌতিক কার্যকলাপ।

নিমতলা শ্মশান থেকে গঙ্গার ধার দিয়ে উত্তরে শোভাবাজার লঞ্চ ঘাটের দিকে এগিয়ে গেলেই এক বিখ্যাত ভূতুড়ে বাড়ি দেখতে পাওয়া যায়। ‘পুতুল বাড়ি’ নামে এই বাড়ি পরিচিত। এই বাড়ির একতলায় এখন কিছু মানুষ বসবাস করেন। বাড়িটির গায়ে সুন্দর নকশা করা ছিল। সেই নকশার ঝলকের চিহ্ন এখনো দেখা যায়। একসময় এক বাঙালি বাবু এই বাড়িতে অনেক দাসদাসী সহ বসবাস করতেন। সেই বাবুটি ছিলেন বিকৃত কাম যৌনতায় অভ্যস্ত। দাসদাসীদের সাথে জোর করে যৌন সংসর্গ করে তার লালসা মেটাতেন। পরে তাদের হত্যা করে বাড়ির পিছনের জায়গায় গর্ত করে তাদের মৃতদেহ মাটি চাপা দিয়ে রাখতেন। আজও সেই মেয়েদের আত্মার কান্নার শব্দ শোনা যায় রাত্রিবেলায়।

নিমতলা শ্মশানে দাহ করা মরদেহের অস্থি বিসর্জন দেওয়া হয় গঙ্গার যে ঘাটে সেখানে অনেক সময়ই মানুষ জলে ডুবে মারা যায়। হাওড়া ব্রিজের নিচে মল্লিকঘাট ফুলের বাজার লাগোয়া মল্লিকঘাট, ছোটেলালের ঘাট, রামচন্দ্র গোয়েঙ্কা ঘাটে খুব ভোরে যারা স্নান করতে যায় তাদের অনেকেই দেখেছে সর্বাঙ্গে সাদা কাপড় জড়ানো মহিলাকে হেঁটে যেতে। নাকিসুরে সেই মহিলা লোকজনদের ডাকে। কেউ সেই মহিলার দিকে এগিয়ে গেলে মহিলা অদৃশ্য হয়ে যায়। আরো ভয়াবহ ঘটনা হল, বাঁচার তাগিদে গঙ্গাবক্ষ থেকে দুটো হাত উঠে আসছে। যেন কোনো ডুবন্ত মানুষ বাঁচার তাগিদে শেষ চেষ্টা করছে। ভুল করে যারা সেই ডুবন্ত মানুষকে বাঁচাতে যায়, তাদের টেনে জলের গভীরে নিয়ে গিয়ে সলিল সমাধি ঘটায়। হাওড়া ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করা ও দূর্ঘটনায় জলে ডুবে মৃত্যু হওয়া অশরীরীদের এই কার্যকলাপ বলে মনে করেন অনেকে।
প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine
