রম্যরচনা
অধ্যায় : নয়
দোকানে যাওয়ার দরকার ছিল। দরকার হয় প্রায়ই, কিন্তু হাচিয়া ফাল দুটো-একটা জিনিসের জন্য যখন-তখন দোকানে যেতে চায় না। দরকার জমতে জমতে একগাদা হয়ে গেলে তখন সে দোকানে যাওয়ার কথা ভাবে। আসলে সব লোক যেমন কড়াইতে ডাল চাপিয়ে দেখে যদি হলুদ নেই তো তখনই দৌড়ে হলুদ কিনে আনে দোকান থেকে, হাচিয়া ফালের স্বভাব তেমন নয়। কড়াইতে ডাল চাপিয়ে যদি সে দেখে হলুদ বাড়ন্ত তো হলুদের বিকল্প হিসেবে কয়েক চামচ জ্যাম বা জেলি ডালে ঢেলে দেয়। আসলে হুটহাট দোকানে যারা যায় তাদের বিশেষ কাজ থাকে না বলে সময়ের মূল্য বোঝে না। হাচিয়া ফাল বেকার সময় নষ্ট করার পক্ষপাতী নয়, যেহেতু তার কাজ প্রচুর। প্রধান কাজ, বসে বসে শত্রুদের লিস্ট তৈরি করা এবং পাশাপাশি তাদের বৈশিষ্ট্য ও বিবরণ লিখে রাখা। তাছাড়া কিভাবে শত্রুদের এড়িয়ে চলা বা জব্দ করা যায় সেসব ভেবে ভেবেও কুলিয়ে উঠতে পারে না সে। তাই রামা-শ্যামার মতো অকারণে ফালতু যাতে সময় নষ্ট না হয় এ ব্যাপারে সে যথেষ্ট সচেতন।
এটার বিকল্প ওটা, ওটার বিকল্প সেটা করে করে যখন সে দেখে ঘরে আর কোনটারই কোন বিকল্প নেই তখন বাধ্য হয়ে তাকে দোকানে যেতে হয়। কোন একটা দোকানে সে ঘন ঘন বা বারবার যায় না, নিত্য নিত্য দোকান পাল্টায়। তার কারণ একটাই। কোন দোকানে ঘন ঘন বা বারবার গেলে সে জানে ওই দোকানদার তার শত্রু হয়ে যাবে এবং তাকে ঠকাবে। তাই সে বিভিন্ন দোকানে ঘুরে ঘুরে জিনিস কেনে এবং এভাবে যাচাই করে দেখে বিভিন্ন দোকানে কোন্ জিনিসের কী দাম। এতে তার পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়, কোন দোকানদার তাকে ঠকালো কিনা। সেজন্য তাকে কোন কোনবার হয়তো পাড়া ছেড়ে দশ-বিশ কিলোমিটারও দূরে যেতে হয়। এটুকু সতর্কতা নেওয়া ছাড়া উপায় নেই তার কাছে। ঠেকে ও ঠকে শিক্ষা হয়েছে তার, নাহলে ঘরের কাছে পঞ্চাশটা দোকান থাকতে সে দশ-বিশ কিলোমিটার দূরের দোকানে যায় কি শখ করে?
বাড়ি থেকে দশ হাত গেলেই বিশাল এক মুদি দোকান। হেন দ্রব্য নেই যা পাওয়া যাবে না। মালিক চেনালোক, হাকুৎ ফুৎ। তো এই দশ হাত দূরের দোকান ফেলে দশ কিলোমিটার দূরে যায় কেন সে? যায় কি বেড়াতে? হাকুৎ ফুৎ-এর দোকান থেকেই সে জিনিসপত্র কিনত। একটু-আধটু সন্দেহ হলেও গায়ে মাখত না। প্রথমটায় সে দোকানে গেলেই হাকুৎ ফুৎ তাকে উদ্দেশ্য করে মজার গলায় বলত,
‘কী হে, এবার যে খুব তাড়াতাড়ি এলে? এর মধ্যেই সব ফুরিয়ে গেল? একটু বেশি খাওয়া-দাওয়া করে ফেলেছ মনে হচ্ছে? সাবধান! লোকে কিন্তু খেয়েই মরে।’
এই বলাটার মধ্যে কেমন একটা টিটকিরি-টিটকিরি ব্যাপার থাকত আর বলত সে কথাগুলি অন্য পাঁচজন খদ্দেরের সামনেই। তারাও সবাই দাঁত বার করে হাসত। এত হাসাহাসির কী থাকতে পারে সে বুঝত না। খাওয়া-দাওয়ার জন্য তার খুব বেশি সরঞ্জাম দরকার হয় না ঠিক কথা। দু কিলো চাল, পাঁচশ গ্রাম আটা, দু’শ মিলি তেল, তিনশ গ্রাম ডাল—– এইরকম কম কম জিনিসপত্র হলেই তার মাসখানেক চলে যায়। দু’শ গ্রাম মাছ কিনলে সপ্তাহ খানেক ধরে খায়। মাসে আড়াইশো গ্রাম চিকেনের বেশি সে খেতে পারে না। এক লিটার দুধ কিনে চালায় সে পনের দিন। একটা ডিম ফাটিয়ে অর্ধেকটা দিয়ে পোচ বানায় সকালে, ওবেলা বাকি অর্ধেকটা দিয়ে ওমলেট ভাজে। পারলে সে একটা ডিম তিন ভাগ করে দু’ ভাগ দিয়ে ওমলেট বানিয়ে ও তৃতীয় ভাগ সেদ্ধ করে খেত। অনেক গবেষণা করেও তেমন উপায় খুঁজে পায়নি। মাসে পনেরটা আলু হলেই তার হয়ে যায়, কারণ রোজ সে অর্ধেকটা আলুর বেশি খেতে পারে না। সাইজ যেমনই হোক না কেন, একটা পেঁয়াজ দিয়ে চলে তার পাঁচদিন। পঞ্চাশ গ্রাম আদা লাগে মাসে। স্বাস্থ্য-খরচ ইত্যাদি সমস্ত কিছু বিবেচনা করে তার এমন মেপে মেপে খাওয়া-দাওয়া। সরকারের দেওয়া যে কোন অনুদান, কোন বিক্রেতার ঘোষিত যে কোন ছাড় বা উপহার পেতে সর্বাগ্রে লাইনে দাঁড়ায়। সে অপচয় পছন্দ করে না। সাদাসিধে জীবনযাপনে বিশ্বাসী ও অভ্যস্ত। হালুম-হুলুম করে গান্ডেপিন্ডে রাক্ষসের মত যা পেলাম তাই গিলে গেলাম বা দেদার টাকা খরচ করে বাহারি পোশাক রোজ কিনলাম, এসব তার দু’চক্ষের বিষ। হ্যাঁ, তার রেশন কার্ডও আছে আর নিয়মিত রেশন দেওয়া জিনিসও নিয়ে আসে। ওইজন্য দোকানে অত কম যেতে হয় জিনিসপত্র কিনতে। তো সেই রেশন কার্ড রাখতে তাকে কী ঝুঁকি পোহাতে হয়েছে সেটা কি কেউ জানে? তাকে সরকারের লোকরা রেশন দেবে না কিছুতেই, যেহেতু হাজার চেষ্টা করেও সে নিজেকে গরীব প্রমাণ করতে পারেনি। তখন সে বুদ্ধি করে একটা কুকুর পুষতে শুরু করে আর সেই কুকুরের নাম রাখে হাসি। হাসি নামটা কেন নির্বাচন করল সে নিজেও জানে না, কারণ কুকুরটাকে কোন জন্মে হাসতে দেখা যায়নি। তারপর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এবং চেষ্টাচরিত্র করে সে হাসি নামে একটি অনাথ নাবালিকা মেয়ের জন্য একটি রেশন কার্ড করাতে পারে। এক ঢিলে তিন পাখি মারার ধান্দা ছিল তার। একতো হাসি নামের মেয়েটির জন্য রেশনের খাদ্যদ্রব্য পেয়ে যাবে ফোকোটে, দুই, একজন সঙ্গী পেলে একা একা লাগবে না ও কুকুর প্রভুভক্ত বলে সে জীবনে প্রথম এক বন্ধু পাবে, আর তিন, হাসির বাচ্চা হলে সেগুলি ভালো দামে বিক্রি করা যাবে যেহেতু হাসি একটি মেয়ে কুকুর ছিল। সেই কুকুর হাসি তাকে কামড়ে দিয়েছিল আর তাতে কী ভোগান্তি হয়েছিল তা তো আগেই বলা হয়েছে। তারপর হাসিকে সে ভাগিয়ে দেয়। পারলে ফাঁসিতে ঝোলাত, সেটা পারেনি পশুপ্রেমীদের ভয়ে। তাদের পাল্লায় পড়ে তাকে একবার যথেষ্ট নাকাল হতে হয়েছিল। সে বৃত্তান্ত নাহয় পরে জানানো যাবে। যায় হোক, রেশন কার্ডটা কিন্তু রেখে দেয় কুকুর তাড়িয়ে দিয়েও। তার জন্য শেষমেষ কী হল সে তো অন্য গল্প।
হাকুৎ ফুৎ তার দোকানে গেলেই ওই রকম বিদ্রূপ করত সদাসর্বদা। তবুও মুখ বুজে সব সহ্য করত হাচিয়া ফাল, যেহেতু লোকটা জিনিসপত্রের দাম অন্যদের তুলনায় কম নিত। নাহলে হাকুৎ ফুৎ যে তার এক বড় শত্রু তাতে কোন সন্দেহ থাকার কারণ ছিল না। শত্রু না হলে সর্বসময় ওইরকম খোঁচা মারা কথা বলে কেউ সর্বসমক্ষে? আর তার বিদ্রূপ শুনে তার দিকে তাকিয়ে অন্য যেসব খদ্দেররা ফ্যাক ফ্যাক করে হাসত তারাও মিত্র নয় একজনও। মিত্র হলে হাকুৎ ফুৎ-এর বিদ্রূপ শুনে না হেসে তারা লোকটাকে বকাবকি করত।
এমনই চলছিল দিনের পর দিন। তারপর একসময় হাচিয়া ফাল ভাবল, হাকুৎ ফুৎ তার শত্রু এবং যেসব খদ্দেররা তার কথা শুনে হেসে আকুল হয় তারাও তার শত্রু। এই শত্রুপুরী থেকে সে জীবনধারণের জিনিসপত্র কিনে যাচ্ছে এবং খাচ্ছে-দাচ্ছে। এ তো ভালো কথা নয়। যে কোনদিন সবাই মিলে ষড়যন্ত্র করে একটা বিপদ ঘটিয়ে দিতেই পারে। হয়তো খাদ্যদ্রব্য হিসেবে কোন বিষাক্ত বস্তু তাকে দিয়ে দিল আর সে খেয়ে ফট করে মরে গেল। এসব ভেবে অত্যধিক দুশ্চিন্তায় পুরো কয়েক রাত টানা না ঘুমিয়ে কাটলো তার। সাতদিন এভাবে কাটিয়ে সে প্রতিজ্ঞা করল, জীবনে আর কোনদিনও যাবে না ওই দোকানে। দশ টাকা বাঁচাবার বা দশ কিলোমিটার হাঁটার তুলনায় দশ বছর বেশি পরমায়ু লাভ করা বেশি বিবেচনার কাজ। প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)
