শিশির আজম

An Andalusian Dog

আর্টের বিভিন্ন মিডিয়ামের ভিতর মিথষ্ক্রিয়া, সংশ্লেষণ, বিচ্যূরণ বা স্ফূরণ বরাবর ঘটে এসেছে। কিন্তু সেটা ফরাসি দেশে যতটা ঘটেছে, যে বিষম মাত্রায় ঘটেছে এমনটা ভূ বিশ্বের অন্যত্র দেখা যায়নি। কথাটা কেন বলছি? কারণ এখন আমরা কথা বলবো সিনেমা নিয়ে। আর সিনেমাটা এমন সময়কার যখন সিনেমা কথা বলতে শেখেনি, রং আসেনি সিনেমায়। তারপরও এই সিনেমা আজও আমাদের অনুভূতিকে সমানভাবে নাড়া দেয়। আমাদের বিস্মিত করে। অল্প কয়েকটি শটে এই সিনেমার এডিটিং শেষ করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিটি শট যেন দর্শকের অনুভূতির আঙিনায় সমানভাবে প্রজ্জ্বলিত। ১ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডের সময়ে ধারালো রেজরে তরুনির চোখ কেটে ফেলার কোলাজটা তো সিনেমার ইতিহাসে মাস্টারক্লাস হিসেবে পরিগণিত। লং শট, মিড শট, ক্লোজ শটসহ বিভিন্ন মিশ্র শটে এরকম মনে রাখবার মতো বেশ কিছু কোলাজ বুনুয়েল আমাদের দিয়েছেন তার চেতন-অবচেতনের যুক্তিনিষ্ঠ-বুদ্ধিদীপ্ত এই ছবিতে। সালভাদর দালির প্রত্যক্ষ প্ররোচনায় ১৯২৯ সালে স্বল্প বাজেটের An Andalusian Dog নির্মাণ করেন লুই বুনুয়েল। উল্লেখ্য, দালি আর বুনুয়েল এই দুই স্প্যানিশ মাতাদরই মারাত্মক জিনিয়াস আর পাগলাটে স্বভাবের ছিলেন। বুনুয়েল স্বপ্নে দেখলেন ধারালো ছুরিতে তরুণীর চোখ কেটে ফেলার দৃশ্য, আর দালি স্বপ্ন দেখলেন হাতের তালু ফুড়ে এক ঝাঁক পিঁপড়ের চলাফেরা। তারপর এই দুই স্বপ্ন এরা আছড়ে ফেললেন প্যারির ক্যাফের টেবিলে, তারপর তা ফুটে উঠলো সেলুলয়েডের পর্দায়। নির্মিত হলো মাত্র ১৬ মিনিটের ‘আন চিয়েন আন্দালু’ বা ‘এক আন্দালুসীয় কুকুর’। এটা কোন গতানুগতিক সিনেমা ছিল না, আজও নেই। প্যারিতে প্রথম প্রদর্শনীর সময় বুনুয়েল তো আতঙ্কে ছিলেন দর্শক ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠেন কি না। প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন পিকাসো, জ্যা কঁকতো আর আদ্রে ব্রেতোসহ প্যারির বহু রথি মহারথি। বুনুয়েলকে বিস্মিত করে সিনেমাটা দর্শকের ভিতর ব্যাপক সাড়া ফেলে। প্রদর্শনী হলগুলোতে উপচে পড়া ভীড়। বলা যায়, এই ক্ষুদ্রায়তনের সিনেমাটি সিনেমার ইতিহাসকে নতুনভাবে লিখতে বাধ্য করেছিল। এটা ছিল প্রথম স্যুরিয়ালিস্ট ফিল্ম যেটা বিশেষত বুর্জোয়া মনোভাবাপন্ন মধ্যবিত্ত ফরাসি তরুনদেরকে খেপিয়ে তুলেছিল। আপাত ঝকঝকে তকতকে ইউরোপের ভিতরটা যে পচে গিয়েছে, ভিতরটা ফাঁপা, দুর্গন্ধযুক্ত এটা মেনে নেওয়া বেশ কঠিনই ছিল।  হ্যা, ১৯৩০ সালে নির্মিত পরবর্তী ছবি The Golden Age ও বুর্জোয়া সমাজের উম্মত্ততা, যৌনবিকৃতি আর প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়ে মস্করা করে। স্মরণ করা যায়, ভাটিকান থেকে সেসময় বুনুয়েলকে হুমকি দেয়া হয়েছিল। ছবি দেখতে গিয়ে আমরা যে চোখ আর প্রথাবদ্ধ পরিশীলিত ভাবনাকাঠামো নিয়ে পর্দার সামনে বসি সেই চোখ আর ভাবনাকাঠামোর প্রতি বুনুয়েল বিদ্রুপ ছুঁড়ে দিয়েছেন। এতে নির্দিষ্ট প্লট নেই, কাহিনীর ধারাবাহিকতা নেই। এই সিনেমাটা যতবার আমি দেখেছি নতুন একটা কবিতা পড়বার মতো অনুভূতি আমার হয়েছে। যে কবিতার মাথামুন্ডু কিছু নেই। আছে কিছু ইমেজের সহিংস অভ্যর্থনা। অথবা যেন দাঁড়িয়ে আছি দালির স্টুডিওতে। ছড়ানো ছিটানো রং, প্যালেট আর অসম্পূর্ণ ক্যানভাস আমাদের দিকে আক্রমণের ভঙ্গিতে। যেন এস এম সুলতান বিশাল ক্যানভাসে রং ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছেন। যদিও ‘এ্যান আন্দালুসিয়ান ডগ’ সাদাকালোয় নির্মিত, কিন্তু এতে রঙের কি কমতি আছে? আমরা টের পাই, প্যারিতে স্যুরিয়ালিস্ট পান্ডাদের যে মজলিশ বসেছিল সেখানে কেন সগর্বে নিজের অস্তিত্ব জাহির করেছিল এই ‘আন্দালুসীয় কুকুর’। সে সময় ধ্রূপদী শব্দের পরিমন্ডলে রীতিমতো নাশকতা চালিয়ে আদ্রে ব্রেতো, লুই আরাগঁ, পল এল্যুয়ার আর কঁকতো কবিতায় পরাবাস্তববাদের জোয়ার বইয়ে দিচ্ছেন। পিকাসো, দালি, ম্যাগরিত্তের মতো চিত্রযজ্ঞভূমির চাঁড়ালেরা ক্যানভাস ভরিয়ে তুলছেন পরাবাস্তববাদের হিংস্র ও অরমণীয় রঙে। তো কঁকতো-বুনুয়েল বসে থাকবেন কেন? ওরাও নেমে পড়লেন ক্যামেরা হাতে পরাবাস্তববাদের যজ্ঞভূমিতে। যে চোখে আমরা বরাবর সিনেমা দেখে থাকি সেভাবে স্ক্রিনের সামনে বসলে আমাদের ধাক্কা না খেয়ে উপায় নেই। দর্শক এখানে কাহিনীর পারস্পর্য তেমন খুঁজে পাবেন না। দর্শকের মনে হতে পারে এখানে সেজান ছোঁপ ছোঁপ রঙের খেলা খেলে গেছেন বুনুয়েলের নামে। আর দালি তো আছেনই। দালির টেবিল থেকে আর সুপরিসর দেয়াল থেকে যেমন সময় চুঁয়ে চুঁয়ে গড়িয়ে মেঝেয় পড়ে তেমনি এখানে রয়েছে ওর অদ্ভুত স্বপ্নের জগৎ  আর ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণের ক্যারিকেচার। গল্পটা শুরু হয়েছে ‘একদা এক সময়’ থেকে। কিছুক্ষণ পর কাহিনী বদলে তা এক লাফে হয়ে যায় ‘আট বছর পরে’। অথচ এই কালপর্বে গল্পের চরিত্রগুলোর বিকাশ তেমন আমাদের চোখে পরিলক্ষিত হয় না। আমরা দেখি ধারাবাহিকতাহীন উল্লম্ফন। যেটা পরবর্তীতে গদারের সিনেমার অন্যতম আর্কিটেকচার হয়ে দাঁড়াবে। শুরুতে দেখি বুনুয়েল স্বয়ং বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রেজরে ধার দিচ্ছেন আর বুড়ো আঙুলে পরীক্ষা করে নিচ্ছেন সেই ধার। এরপর মেঘে ঢাকা আবছা চাঁদ আর ক্লোজআপে এক তরুণীকে দেখা যায়, শান্ত। এরপরই দেখা যায় ধারালো রেজরে বুনুয়েল কাটছেন তরুনীটির চোখ। এরপর দালির কম্পোজিশানের মতো একটার পর একটা দৃশ্য আমরা দেখি। যেগুলোর ভিতর আপাত কোন পারস্পর্য নেই। কিন্তু এগুলো দর্শক-অনুভূতিতে টংকার তোলে, রেনেসাঁ যুক্তিবিচার আর ফরাসি নান্দনিকতায় প্রশ্নবোধক চিহ্ন রেখে। কেন তোলে, এই প্রশ্ন আর্টক্রিটিকরা তুলতে পারেন না। কেন না ব্র্যাক-পিকাসো-দালি-ম্যাগরিত্তের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্ন তো কেউ তোলেননি পূর্বে। তো সিনেমায় এটা নতুন। দর্শকের অনভ্যস্ত চোখে মানিয়ে নেয়াটা সহজ না। একটার পর একটা অসংলগ্ন ইমেজের খেলা দর্শকের উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়। বিভ্রান্তও কি করে? সব ঘটনাই দ্রুত ঘটে। এই যেমন দেখা যায় হাতের তালুতে গর্ত, সেখান থেকে পিঁপড়ে বেরুচ্ছে। তরুনিটির বগলের লোম থেকে সমুদ্রসৈকত, পিয়ানোর সঙ্গে মৃত পঁচা গাধার শরীর, বইয়ের পিস্তলে রূপান্তর, আবার রাস্তার সমুদ্র হয়ে যাওয়া। এমনই সব দৃশ্যকল্প নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘একটি আন্দালুসীয় কুকুর’র শরীর। গাধার চিত্রকল্পটি সম্ভবত দালি পেয়েছেন স্প্যানিশ কবিতার অন্যতম মহিরুহ হুয়ান রামন হিমেনেথের সৃষ্ট ‘প্লাতেরো’ থেকে। উল্লেখ্য, দালি-বুনুয়েল দুজনই আন্দালুসীয় স্প্যানিশ। আর আন্দালুসীয় রূপকথা-উপকথা-লোকগাথা-সাহিত্যে ঘোড়া-গাধা-ষাড় বড় এক অংশ দখল করে আছে। তার স্পিরিট ১৬ মিনিটের এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিদ্ঘুটে সব দৃশ্যের পরতে পরতে আমরা দেখতে পাই। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই পারস্পর্যহীনতা যেমন দর্শকের প্রথাগত গ্রকো-রোমার রুচি ও ভাবনাকাঠামোয় আঘাত করে তেমনি দর্শককে উৎসাহিতও করে নতুন দৃশ্যকল্পে ঢুকে যেতে। পুরো ব্যাপারটাই চলচ্চিত্রকার হিসেবে বুনুয়েলের জন্য ছিল মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। প্রথম থেকে এক দৃশ্যকল্প পার হয়ে আমরা আরেক দৃশ্যকল্পে প্রবেশ করি, তারপর আরেকটা, তারপর আরেকটা…। এক দৃশ্যের সঙ্গে আরেক দৃশ্যের কোন মিল নেই। কিন্তু গল্পের শেষে (গল্পের কি শেষ আছে এই সিনেমায়?) কি এক ধরণের গথিক স্থৈর্য আমরা অনুভব করিনে, এক অসহনীয়তা সত্তেও? এটাই দালি, এটাই বুনুয়েল। বুনুয়েল নিজে অবশ্য এই সিনেমাকে সে সময়ের আঁভাগার্ড আন্দোলনের হিংসাত্মক প্রতিক্রিয়া হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর এটা ছিল দর্শকের প্রতি তার সর্বাত্মক শৈল্পীক সংবেদনশীলতা! আজ ‘একটি আন্দালুসীয় কুকুর’কেবল একটি সিনেমা আর নেই। কবিতা, চিত্রকলা, ভাস্কর্য এমন কি পরবর্তীকালের সিনেমাও আক্রান্ত হয়েছে ইউরোপকে গিলে খেতে উদ্যত ফ্যাসিবাদের ঊষামুহূর্তে প্যারিতে থিতু হওয়া পরাবাস্তবতার আঁচ সত্তায় বয়ে বেড়ানো দুই পাগলাটে বন্ধু দালি-বুনুয়েল নির্মিত সংক্ষিপ্ত রানিং-টাইমের ‘ঐতিহ্যবিদ্বেষী’ গৎবাঁধা প্রকরণের বাইরের এই সিনেমা দ্বারা। হ্যা, ঐতিহ্যবিদ্বেষ কিন্তু নতুন ঐতিহ্যের উস্কানিদাতা!

প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *