তুষার বরণ হালদার

লেখক পরিচিতি 

(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা  সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং  বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।) 

ঐতিহাসিক হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী  (১৮৯২ ১৯৫৭) 

প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বিশ্ব বিস্তৃত বাঙালি ঐতিহাসিক হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী জন্মেছিলেন অধুনা বাংলাদেশের বরিশালে। ছোটবেলা থেকেই তিনি পড়াশোনায় ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। প্রাথমিক লেখাপড়া শুরু করেছিলেন বরিশালের বিখ্যাত ব্রজমোহন কলেজে। সেখান থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় তিনি সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে, সেখান থেকে এফ. এ. এবং পরে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইতিহাস অনার্স নিয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন লাভ করেন ঈশান স্কলারশিপ।  ১৯১৩ সালে এম.এ. পরীক্ষাতেও চোখ ধাঁধানো ফল করেছিলেন। হেমচন্দ্রের প্রথম পেশাগত জীবন শুরু হয়েছিল বঙ্গবাসী কলেজে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে। এরপর তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে চার বছরের জন্য অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন। সরকারি বিধি অনুযায়ী তাঁকে চট্টগ্রাম কলেজে যেতে হয়েছিল কিন্তু গবেষণা এবং ইতিহাস চর্চার খাতিরে তিনি মনস্থ করেছিলেন কলকাতাতেই থেকে যেতে। সেই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এই ব্যাপারটি সম্পর্কে অবগত হয়েছিলেন এবং তাঁরই প্রচেষ্টায় হেমচন্দ্রকে কলকাতার বাইরে যেতে হয়নি। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে পড়ানোর দায়িত্ব পেয়েছিলেন। 
   ১৯১৭ সাল থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তারপর তিনি তিন বছরের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেখানকার ইতিহাস বিভাগের প্রধান হয়ে কাজ করেন। ফিরে এসে আবার যোগ দিয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস এবং সংস্কৃতি বিভাগের প্রধান ও সম্মানজনক  ‘কারমাইকেল প্রফেসর ‘  পদে তিনি আসীন হয়েছিলেন। ১৯৫২ সালে অবসরের আগে পর্যন্ত দীর্ঘ ষোলো বছর তিনি এই সম্মানজনক পদে ছিলেন এবং ছাত্র-ছাত্রী পড়ানোর পাশাপাশি ইতিহাস চর্চা তথা ভারতবিদ্যা চর্চার প্রতি নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। 
   বহু ঐতিহাসিক গবেষণার নায়ক অধ্যাপক রায়চৌধুরীর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি ভারত ইতিহাসের লুপ্ত এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন বিভাগগুলিকে দিনের আলোয় এনে পুনরায় তাকে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত করা। ফলস্বরূপ তাঁর বিশ্ব বিখ্যাত গ্রন্থ  ‘ পলিটিকাল হিস্ট্রি অফ এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া ফ্রম দ্য এক্সেশন অফ পরীক্ষিত টু দ্য এক্সটিনশন অফ গুপ্ত ডাইনেস্টি ‘ যেটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর এই মহাগ্রন্থের প্রেক্ষাপটে – মহাভারতের অর্জুনের পুত্র পরীক্ষিতের রাজ্যভার গ্রহণের সময় থেকে মগধের গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তিম কাল পর্যন্ত এক মহাভারতীয় সময়কে ধরা হয়েছে। তাঁর মতে পরীক্ষিত খ্রিস্টপূর্ব নবম শতাব্দীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বেদ উপনিষদ মন্থন করা ছাড়াও অন্যান্য প্রাচীন শাস্ত্র, পুরাণ , বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্ম গ্রন্থ, শিলালিপি গবেষণা এবং বিশেষভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তিনি প্রাচীন ভারতের ইতিহাস চর্চায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। তাঁর একটি বিশেষ কৃতিত্ব এই যে তিনি প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে যে সমস্ত আকর গ্রন্থের সাহায্য নিয়েছিলেন সেগুলির কালক্রম এবং নির্ভরযোগ্যতাও তিনি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন। এটা যে কতটা দুরূহকর্ম এটা তাঁর ছাত্র, গবেষক এবং শিক্ষকরাই বুঝতে পারবেন।
   ভারতবর্ষে বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা যথেষ্ট ছিল। এ দেশে তাদের উৎপত্তি এবং বিস্তার সম্পর্কে তিনি একটি অসাধারণ তথ্যবহুল গ্রন্থ’ ‘ মেটেরিয়ালস ফর দি স্টাডি অফ আরলি হিস্ট্রি অফ বৈষ্ণব সেক্ট ‘ রচনা করেছিলেন। এই গ্রন্থে তিনি শ্রীকৃষ্ণকে ঐতিহাসিক পুরুষ হিসাবে উপস্থাপিত করে তার লৌকিক জীবনের প্রেক্ষাপটে ভাগবত ধর্ম সম্পর্কে বহু অজানা তথ্য পরিবেশন করেছেন।
   অধ্যাপক রায়চৌধুরীর ইতিহাস চর্চার সবথেকে বিশেষত্ব ছিল তাঁর মৌলিক চিন্তা, তথ্যনিষ্ঠতা, যুক্তি প্রবণতা, সর্তকতা এবং প্রামানিকতা বোধ। বিখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছিলেন যে কোনরকম তথ্য অথবা সময় অথবা বছর সম্পর্কে কোন সন্দেহ উপস্থিত হলে অধ্যাপক রায়চৌধুরীর মতামতকেই যথার্থ বলে ধরে নেওয়া হত।
   নিজের গ্রন্থ এবং প্রবন্ধ রচনা ছাড়াও অন্যান্য ঐতিহাসিকদের সম্পাদিত গ্রন্থেও অধ্যাপক রায়চৌধুরীর ছিল বিশেষ অবদান। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য রমেশচন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত বিখ্যাত ‘ বাংলার ইতিহাস গ্রন্থের ‘ তিনটি সুদীর্ঘ অধ্যায় অধ্যাপক রায় চৌধুরীরই রচনা। তিনি দাক্ষিণাত্যের ইতিহাস গ্রন্থ রচনাতেও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন।তাঁর পাণ্ডিত্যের খ্যাতি শুধুমাত্র দেশের সীমার মধ্যে আবদ্ধ ছিল না বিদেশেও পরিব্যপ্ত হয়েছিল। তিনি ভূষিত হয়েছিলেন নানা সম্মানে। ১৯৪১ সালে ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রাচীন ভারতীয় বিভাগের সভাপতির আসন অলংকৃত করেছিলেন; এরপর ১৯৫০ সালে ওই সম্মেলনেরই মূল সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির সম্মানীয় ফেলো। ১৯৫১ সালে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য এশিয়াটিক সোসাইটি তাঁকে বি. সি. লাহা স্বর্ণপদক দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন।
   আরেকটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনার জন্য তথ্য সংগ্রহের কাজে তিনি হাত লাগিয়েছিলেন। সেটি বলা যায় তার আগের সেই বিখ্যাত গ্রন্থ যার প্রেক্ষাপট ছিল অর্জুনের পৌত্র পরীক্ষিতের সময় থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তিম কালের পরবর্তী সময় পর্যন্ত; অর্থাৎ গুপ্ত সাম্রাজ্য ধ্বংসের পরের সময় থেকে মুসলমান আক্রমণের আগের সময় পর্যন্ত ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাস রচনা করা। কিন্তু দেশ এবং জাতির দুর্ভাগ্য যে তাঁর ভগ্নস্বাস্থ্য এবং এর ফলে ১৯৫৭ সালের মে মাসে তাঁর একরকম অকাল প্রয়াণ সেই বাসনা চরিতার্থ করে একটি সম্পূর্ণ গ্রন্থের আকার দিতে পারেননি। তবে এই স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি যেভাবে ভারতবর্ষের প্রাচীন ঐতিহ্য, গৌরব, তার বিশ্বব্যাপী গরিমাকে তিনি তথ্য সহকারে প্রমাণের কষ্টিপাথরে বিচার করে তুলে ধরেছেন তা এক কথায় অনবদ্য। ভারত বিদ্যা চর্চায় তাঁকে অনায়াসে এক নিবেদিত প্রাণ ঐতিহাসিক রূপে অভিহিত করা যেতে পারে। তবে অধিকাংশ মানুষ ভুলে গেলেও এই  বিশ্ববিশ্রুত ঐতিহাসিককে ইতিহাসের ছাত্র, গবেষক, অধ্যাপক এবং ইতিহাস অনুরাগী মানুষ মনে রেখেছে।  প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas magazine

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *