শরদিন্দু সাহা
লেখক পরিচিতি
বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।সম্প্রতি লেখক ‘দীপ্তি রায়চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২৪’-এ সম্মানিত হয়েছেন।
বিষয় পরিচিতি
(রেভারেন্ড জেমস্ লঙ যে লক্ষ্য স্থির রেখে জীবনকে চালনা করেছেন তা শুধুমাত্র ঘটনাক্রম দিয়ে ধরা যায় না। তাঁর কর্মজীবনের পরিক্রমায় যে অন্তর্নিহিত শক্তি ও প্রভাব রয়েছে তাকে কোনও এক শিল্প মাধ্যম দিয়ে উপলব্ধি করা যায় না। কারণ কোনো সরলরেখায় তিনি তাঁর কাজকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, নানা উত্থান পতন ঘাত প্রতিঘাত তাকে পীড়িত করেছিল, বিপর্যস্ত করেছিল। তিনি প্রবল আত্মশক্তিতে তার মোকাবেলা করেছিলেন এবং কর্তব্যকর্মে অটুট ছিলেন। তাঁর কাজের পরিধি ও ব্যাপ্তি একজন শিক্ষকের, সমাজসেবকের, মানবপ্রেমির যা মূলত শাসক ও শোষিতর মাঝখানে একজন প্রতিবাদীর, সত্যবাদীর, বলা যায় একজন দ্বান্দ্বিক ব্যক্তিত্বের। যার না-বলা কথা, জানা-অজানার কল্পনা ও বাস্তবের মিলন নিয়ে উপন্যাস লেখা সম্ভব অসম্ভবের দোলাচল মাত্র, তবুও শব্দের মায়ায় ধরার সামান্য প্রচেষ্টা। কোথায় তার অন্ত হবে প্রকৃত অর্থে বলা খুব কঠিন। এই মহান মানুষটির শৈল্পিক জীবনকে ছুঁয়ে যাওয়া আর কি।)
ঘৃণার বাদ্য থামিয়ে এবার মমতার মাদল বাজা
আমার স্বদেশীরা যখন ব্যবস্থা-সচিব বীটন সাহেবের চারখানা আইনের পাণ্ডুলিপিকে ‘কালা আইন’ আখ্যা দিয়ে সোচ্চারে আঙুল তুলছেন, তখনই বোঝা যাচ্ছিল বিভেদটা কতটা চওড়া হচ্ছে। এক জাতির মধ্যেই কত জাতির ঘৃণ্য পরিচয় সমান্তরাল চলছে। এই ধাক্কাটা দিয়েছে বলেই না স্পষ্ট হচ্ছে টর্নেডোর মতো অত্যাচারের মুহূর্তগুলো। কারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, কারা টিকে থাকবে, কেউ জানে না। শুধু এক বিবর্ণ প্রতিচ্ছবি ইঙ্গিত দিচ্ছিল মুনাফার লোভ কোনো সভ্য জাতিকে কেমন করে বর্বর অসভ্য করে তোলে পলে পলে। আমার আত্মানুসন্ধান আমাকে দিয়ে বলিয়ে নিচ্ছিল, নিজেকে পাল্টানোর সময় এসে গেছে। এদেশবাসী ইংরেজরা যে এতটা অমানুষ হয়ে গোটা ভারতবর্ষে ও ইংল্যান্ডের বুদ্ধিজীবীদের মন বিষিয়ে দিতে পারে এটা তো কল্পনাতীত ছিল। রাজপুরুষরাও টু শব্দটি করলেন না। হায়, এই দুর্ভাগা দেশ আর এই দেশের মানুষ, এদের এই সীমাহীন যন্ত্রণা নিয়ে বলার মতো রামগোপাল ঘোষ ছাড়া কেউই রইল না। মফস্বলবাসীদের কাছ থেকে শোনা কিছু অপরিচিত শব্দ আমার কাছে পরিচিত হতে লাগলো অন্তরে বাইরে। এটা অবশ্যম্ভাবীই ছিল, জীবনের কাছে হিসেব চাইতে হবে না, মানুষ যখন মরে যাচ্ছে, তলিয়ে যাচ্ছে আঁধার থেকে আরও আঁধারে আমার করণীয় কর্তব্য আমাকে স্থির করে নিতে হবে বইকি। এই তো গেল দৃশ্যমান বর্তমানের কথা, অদৃশ্যমান ভবিষ্যতও যে পথ চেয়ে বসে আছে, তার হাল কে এসে ধরবে। অনধিকার হস্তক্ষেপ সভ্য মানুষের যখন হস্তগত হয়, তখন বলার কিছু থাকে না, শুধু নিশ্চুপ নিরালায় বসে থেকে দিন গোনা। মানুষ কাঁদছে, কে মোছাবে এই অশ্রু, ঘরের কোনায় শব্দগুলো থমকে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। রোজই যন্ত্রণার ছবি বহন করে ঘরে ফিরছে বাংলার দুস্থ ছাপোষা মানুষগুলো। দৌড়ে ছুটে এসে এক চাষী এসে উগরে দিল মনের কথা, ভয়ঙ্কর প্রশ্ন তুলে দিল, ‘এটা কার দেশ বলতে পারেন? এই দেশকে আমি আর চিনতে পারি না, কারা যেন দিন দুপুরে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে আমার গরু বাছুর, গোলার ধান। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, কেন নিয়ে যাচ্ছে জানতে পারি না। আমার বউটাকেও গায়েব করেছে ওই নীলকর সাহেবরা। কেমনে আমাদের দিন গুজরান হচ্ছে, দেখার মতো একটা লোকও নেই। দেশে থেকেও সাহেব বাবা আমরা পরদেশী হয়ে গেলাম।’
আয়নাটা ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছে, মানুষের মুখগুলো হয়ে যাচ্ছে ঘোলাটে। এক একটা দিন এমনও যায় মানুষ আর মানুষের মাঝে থাকে না। চাষীর বেটা চাষী হয়ে জলাজমির ধারে খড়ের চাল আর গোবর লেপটানো পাটকাঠির বেড়ার ঘরে জীবন কাটিয়ে দেয়, জীবনভর হাঁড়ভাঙা খাটুনি খেটে কুঁজো হয়ে লাঠি ভর দিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখে পৃথিবীটা কেমন বদলে যাচ্ছে আর সে অসহায় হয়ে হাত কামরাচ্ছে আর গরু ছাগলগুলো ঘাস থেকে মুখ তুলে আপনমনেই নিজের গা নিজে চাটছে। সে রোজই দেখে আর ভাবে – এখান থেকে বেরোনোর কোনো রাস্তাই কি খোলা নেই? ওর কত চিন্তা, কাঁচা ধান কখন পাকা হবে, তারপর ঘরে তুলবে। এরই মাঝে কত বিপত্তি, ভারী বর্ষার জলে থই থই করলে খলবল করে উঠে সাপেদের দল, ফোঁস ফোঁস করে ফণা উঁচিয়ে তেড়ে আসে, দৌড়ে পালানো ছাড়া প্রাণ বাঁচানো যায় না। ‘কী সর্বনাশ কী সর্বনাশ, সাহেব বাবা এমন কথা মুখে আনব কেমন করে! সেই ভয়াল দিনে দংশনে ছটফট করে জ্যান্ত মানুষগুলো বিনা দোষে যেমনভাবে পটল যে তোলে, সেই দৃশ্য কী চোখে দেখা যায়?’ তবুও সেই চাষীর ভাঙাচোরা ঘরটাই সম্বল করে জীবনকে কাটাছেঁড়া করা। আমি ভাবি, এই মুখগুলো কেবলমাত্র আমিই দেখতে পাই, আর কারও কি নজরে পড়ে না! কামার কুমোর জেলে জোলারা সংসারের জোয়াল টেনে যে চরম দুঃখ কষ্টে দিন কাটায়, ওদের ভেতরের চেহারাটা আরও এত যে ফাটাফুটা তা অন্তরের উপলব্ধি ছাড়া টের পাওয়া যাবে কেমন করে? আর একটু কাছে গিয়ে ছুঁলেই মরচে ধরা লোহার মতোই ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ে। এমন জীর্ণ দশা শুধুই আঁধারে ঢেকে থাকে না, এ যেন ভিন্নতর এক পৃথিবীর কোলে হাত পা ছুঁড়ছে অহরহ, এই গল্প আমার সমাজের মানুষদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেও যে ভাববে আষাঢ়ে গল্প শোনাচ্ছি। ভাবছি দায়টা কার? জবাব দেওয়ার কথা যাদের তাঁরা কি হাজার হাজার মাইল দূর থেকে শুনতে পাবে? ওরা লুন্ঠিত সম্পদের ঘেরাটোপে মেকি সভ্যতা নিয়ে মাথায় সোনার মুকুট পরে বিশ্বের দরবারে রাজা সেজে বসে আছে, সামান্য এক পাদ্রীর প্রতিবেদন ওদের গায়ে কোনো জ্বালা ধরাবে, এ-ও কী ভাবা যায়!
নিরাপদ দূরত্বে বেঁচে থাকাটাই যারা ভবিতব্য মনে করে, তাঁদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাইলে জোরালো প্রতিবাদ করবে না আবার! এটা আভিজাত্যের নষ্টামি ছাড়া আর কি। ওরা জিতে যাবে এটাই তো আজকের ভন্ডদের যারা সাদা চামড়ার রং চড়িয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তাদের চরম এক ধূর্তামি। ওদের চাবুকের ঘায়ে পরদেশীদের রক্ত ঝরবে, এটাই তো ওরা চায়, আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে মেমদের পাশে নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে ফুরফুরে বাতাস গায়ে মেখে পৌঁছে যাবে কল্পিত এমন এক স্বর্গের দেশে যার কোনো সীমানা মাপা যায় না। পেছনে পরে থাকবে কেটো ধূতি পরে স্বদেশী ভিক্ষুকের দল, তা যদি না হবে এমন আসমুদ্র হিমাচল ব্ল্যাক আ্যক্ট ব্ল্যাক আ্যক্ট করে এমন শোরগোল শুরু করবে কেন! কি জানি হয়তো এরা গোড়া থেকেই নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের এক চতুরতা ও গোপন আকাঙ্খাকে প্রশ্রয় দিয়ে ডালপালা মেলতে চাইছে বাংলার আকাশে বাতাসে। এরা কি ধরে ফেলেছে সবকিছু, এরা কি জেনে ফেলেছে যাবতীয় দূর্বলতা, সামাজিক গোলমাল, কোনো এমন অন্তঃসারশূন্যতা যাকে ঢাল করে ওরা আগামী দিনের ছক কষবে। তাহলে এখানে আমার পথ কী হবে, আমাকে নির্বাচন করে নিতে হবে আমার কাজের পরিধি, কোন পথ ধরে এগোলে চিনে নিতে পারব, কোনটা অবলম্বন করবে, আর কোনটা দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দিতে হবে বঙ্গোপসাগরের জলে, ভাসতে ভাসতে ওরা চলে যাবে মহাসমুদ্রে। মাঝে মাঝে মনে হয় কোনো কূল নেই, কিনারা নেই, এমনই এক অবস্থার ঘূর্ণিপাকে জড়িয়ে যাচ্ছি, পালাতে গেলেও নিস্তার নেই আবার ডুব দিলেও কখন তলদেশে গিয়ে পৌঁছব জানি না, হাবুডুবু খেয়ে তলিয়ে যাচ্ছি আরও গভীর থেকে গভীরে।
মানুষের অন্তর যখন কাঁদে, বাকি জগৎ পুড়তে থাকে আমি তখন বুঁদ হয়ে ভাবতে থাকি, কবে আবার নতুনের স্বাদ পাব, গন্ধে আকুল হবে চারপাশ। সেই দূর্গন্ধ ম ম করে এমন করে ছড়িয়ে পড়ল চারপাশ টিকে থাকার দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিয়ে খাবি খেতে শুরু করল এদেশীয়রা, কালা আইনগুলি ব্যবস্থাপক সভা হতে অন্তর্হিত হল। জয়ের খুশিতে মফস্বলবাসী ইংরেজগণ দ্বিগুণ আনন্দে অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে তুলল। বীটন সাহেব ক্ষোভে দুঃখে অতিরিক্ত শ্রমের চাপ সহ্য করতে না পেরে জীবন থেকে হারিয়ে গেলেন। দেশীয়দের মনে ইংরেজদের প্রতি ধীরে ধীরে এক অবিশ্বাসের বাতাবরণ সৃষ্টি হল। বুঝলাম এই অবস্থাই দেশীয় শিক্ষিতদের মনে যে ঘৃণার জন্ম দেবে তা হয়তো একদিন ইংরেজ শাসনের ভীতকে নাড়িয়ে দেবে যা কিনা কোন সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা নেবে না। আমি ক্রমশ লক্ষ্য করলাম এতদিন পর্যন্ত ওদের যে শরীরী ভাষা ছিল তা তলানিতে ঠেকেছে। কে বলতে পারে তা আজ না হয় কাল এক বড় আন্দোলনের সূচনা করবে না। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে মুক্তচিন্তক ইংরেজ বন্ধুদের মতামত চেয়েছিলাম। উত্তরগুলো উৎসাহব্যঞ্জক ছিল না, বলল, ‘লঙ, এই মুহূর্তে সরকার বাহাদুরের মতলব বুঝতে কোনো নিরপেক্ষ মন্তব্য করা সমিচীন হবে না, কি আমাদের জন্য, না তোমার এই দেশে আসার লক্ষ্য সার্থক করার জন্য।’ আমি ধন্দে পড়লাম এই ভেবে আমি কী উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছি আর কী অনুমান করছি। তবুও তর্ক জুড়ে দিতে ক্ষান্ত হলাম না। আরও এগোতে হবে, এগোবার মন্ত্রগুলো আমাকে জেনে নিতে হবে একে একে। এক সুহৃদ শলা পরামর্শ দিল ‘এত সহজ কথা নয়, কাঁটায় ভরা। এই দেশের মাটিতে আগুন আছে, দপ দপ করে জ্বলে যখন উঠবে, টেরটি পাবে।’ কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো ছিল না, যে আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তা ছিল ওর উচ্চারণের মধ্যে ভেবে দেখার মতো। ভারতবাসীর আত্মাকে ছুঁতে গেলে যেতে হবে অনেক দূর। ওই তো ওদের কত কথা চালাচালি, কথার মোড়কে কথার রস মিশিয়ে টক ঝাল মিষ্টির গল্প বানানো, এ-ও যেন চুম্বকের মতো টানে, ওরা যখন হাসে দু’হাতে তালি মারে, ওরা যখন কাঁদে, ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে শুরু করে কত ঘাত প্রতিঘাতের কল্পকাহিনী, মনে হয় এক ভিন্নগ্ৰহের দিনযাপন। ও বলে, ‘জীবন তো এমনই, জীবনকে এমন করেই পাঁজাকোলে করে টেনে নিয়ে যেতে হয়, তবেই তো মজা।’
প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত ‘বঙ্গদেশীয় জমিদার সভা’ আর জর্জ টমসনের নব্যবঙ্গের ‘ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া সোসাইটি” সম্মিলিত ‘ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েশন’ ব্ল্যাক অ্যাক্ট প্রণয়নে ব্যর্থতার সুফল কিনা সময় বলবে, তবে এটা অস্বীকার করবার উপায় নেই স্বদেশীদের মধ্যে অপমানের মোক্ষম সময় দরজায় কড়া নাড়ছে, না হয় রাজা রাধাকান্ত দেব থেকে শুরু করে বাবু রামগোপাল ঘোষ, বাবু প্যারীচাঁদ মিত্র, বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুররা সকলে একই ছাতার তলে এলেন কেমন করে! আমরা এই নিয়ে নিজেদের মধ্যে কম বলাবলি তো করলাম না। এর জেরও কম সময় ধরে চলে নি। কেউ কেউ এমনও বলল, ‘এটা লঙ বুঝলেন এক যুগান্তকারী ঘটনা হতে চলেছে। দেখবেন এক মোড় ঘুরে যাবে, ভিন্ন খাতে বইবে গঙ্গার জল। কে বলতে পারে, যার ঢেউ এতকাল কলিকাতাকে শুধুই ছুঁয়ে যাচ্ছিল, অচিরেই মফস্বল গ্ৰাম গঞ্জে ছুঁয়ে যাবে না। তবে কিনা কোম্পানির প্রশাসনকে এবার নড়েচড়ে বসতে হবে।’ যেই ভাবনা সেই কাজ, সবটাই যেন অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল, দেশের মানুষ বুঝে গেল এতদিন পরে বোধ হয় তাদের কথা তুলে ধরার জন্য এক শক্তপোক্ত মঞ্চ বাঁধা হল। রাজপুরুষদের এমন উপলব্ধি অবান্তর নয় যে দেশীয়দের স্বত্ব ও অধিকারকে আর অস্বীকার করা যাবে না। এই এসোসিয়েশনই তাদের সমস্যা গভর্নমেন্টের গোচরে আনার মাধ্যম হয়ে উঠবে।
গোলদিঘির ধারে রামতনু লাহিড়ী মহাশয়ের সঙ্গে আমার সাক্ষাতের কথা আমি ভুলি কেমন করে। কত কথাই তিনি মন খুলে গড়গড় করে বলে গেলেন। আমি শুধু দু’চোখ ভরে তাঁর বলার ভঙ্গি দেখেছি আর দু’কান দিয়ে কথার পিঠে কথা শুনেছি। তাঁর উপবীত পরিত্যাগের কথা যেন গল্পের মতোই শোনাল। কোনো এক বালকের শ্লেষাত্মক কথার ফল যে এতদূর গড়াতে পারে, নিজের চোখে না দেখলে মিথ্যা বলেই ধরে নিতাম। ধর্মের অনুশাসন না মানলে যে সমাজে ধোপা নাপিত ও ভৃত্যের সেবা থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়, এমন সিদ্ধান্ত দুংসাহসিক ছাড়া আর কি। তিনি কাতর কন্ঠে বললেন, ‘কবে আমাদের দেশ এই অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে? আমাদের লড়াই ইংরেজ সাহেবদের কাছ থেকে অধিকার অর্জনে আঁটকে থাকলে চলবে না, নিজেদের ঘরও সাফসুতরো করতে হবে।’ ওনার প্রতিটি শব্দ আমি অন্তর দিয়ে গ্ৰহণ করলাম। হয়তো এটাই সত্যি এই মানুষরাই পারে যাবতীয় কুসংস্কারকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে, আমরা হলাম পরদেশী, আমাদের সকল ভালো উদ্দেশ্যকেই এই সমাজের মানুষ সন্দেহের চোখে দেখে। যতদিন না ওদের একজন হয়ে পরিবর্তনের মর্ম না বোঝাতে পারি, সকল উপদেশ এদের কাছে অরণ্যে রোদনই হবে, এক পা এগিয়ে দু’পা পিছানো। লাহিড়ী মহাশয়ের কথার মধ্যে কথা এটাই স্পষ্ট হলো গোড়া ধরে টান দিতে হবে তবে যদি কিছু পাল্টানো যায়। তিনি বলেই চললেন, ‘ লঙ সাহেব পাশ্চাত্যরা ভাবেন আমরা কয়েক যোজন দূরে, আসলে কিন্তু তা নয়, এই পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো আমাদের মধ্যেও অনেক কিছু আছে, আপনাদের কাছে ধরা পড়ছে না, যদি সম্ভব হয় সেগুলো খুঁজে বের করুন। আপনাদের পক্ষেই সম্ভব, কারণ সেই কৌশল আপনারা রপ্ত করেছেন, সেই প্রক্রিয়া পরীক্ষা করে দেখেছেন, হয়তো আমরা দেখার অপেক্ষায় আছি।’ অনেক ভাবনার উপকরণ আমাকে যখন তাড়িয়ে মারছে, অনতিদূরেই নজরে পড়ল ডেভিড হেয়ারের স্মৃতিস্তম্ভ, খোদাই করা নামটা স্মরণ করালো ‘ওহে লেগে পড়, এখনও অনেক দূর যেতে হবে।’ ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোঁটা দিঘির জলে তৈরি করছে মৃদু ঢেউ,সঙ্গে হালকা বাতাসের কাঁপুনি, হিন্দু কলেজের গা বেয়ে ঝরে পড়ছে জলের ধারা। রাজা রামমোহন রায়, ডেভিড হেয়ার, রাধাকান্ত দেবরা ঠিক করলেন দেশীয় দের ইংরেজি, ভারতীয় ভাষা, সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়ে আধুনিক মনন তৈরি করবেন। লাহিড়ী মশাই এই স্থান ছেড়েছেন কম সময় তো হয়নি। হেয়ার সাহেব আমার শরীর ও মনে এমন করে জাঁকিয়ে বসেছেন, আমি কিছুতেই মুক্ত হতে পারছি না। কতগুলো দিন তো পার হয়ে গেল, কেমন করে যে গেল, দলে দলে কত মানুষ তাঁর মৃতদেহের সঙ্গে হেঁটেছে, কী এক অমোঘ আকর্ষণে এদেশের মানুষ চোখের জল ফেলেছিল, দৃশ্যটা কত যে জ্যান্ত হয়ে আছে বলে বোঝাতে পারব না। তিনি জানতেন বোধহয় আজ বৃক্ষ রোপন করলে একদিন ফল ফলবেই ফলবে।
জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা, আজ ভাবছেন, যে পথে চললে প্রতি পদে পদে হোঁচট খেতে হবে, এতটাই সহজ হয়ে যাবে সে পথ কোনো একদিন, হয়তো মানুষের দুচোখ জুড়িয়ে যাবে, সারি সারি গাছের ছায়ারা আলোর খেলায় মেতে উঠে নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণা করবে, পথচারীরা মাড়িয়ে যাবে তো যাবে, কে তার ভ্রুক্ষেপ করবে। এমনও তো হতে পারে ডুবন্ত আলোয় ছায়ারা দোল খেতে খেতে ঘুমন্ত রাতের শব্দহীন নির্জনতাকে সাধুবাদ জানাবে। আমার কল্পনায় যে স্বপ্নগুলো জেগে উঠছে ঠিক এই সময় আমি মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছি অগণিত মানুষের চোখে ঘুম নেই, ওরা সন্তানের চোখে হাত বুলায়, নিজেদের রাতজাগাকে অনায়াসে মিলিয়ে দিয়ে বলতে থাকে ‘হে আলো, তুমি পরম করুণাময়কে নিয়ে ধরার বুকে নেমে এসো।’ কারা যেন ভেবে না বসে পাদ্রী বেটার মনে ধর্মের গুঞ্জন শুরু হয়েছে। বিপদের আঁচ আমার গায়ে লাগছে না, কেমন করে বলি। চিন্তার দৈন্যতা কিংবা অনধিকার কায়েম করার মনোবৃত্তিই, দূর্বলকে টেনে নীচে নামানোর ইচ্ছাকে প্রবল ঝঞ্চার রূপ দেয়। এই ইচ্ছার জন্ম কীভাবে জন্মায়, কবে থেকে জন্মায় এর উৎস জানা সহজ কর্ম নয়। তবে সময়কে অস্বীকার করব আর সময়ের মানুষগুলো অপাঙক্তেয় হয়ে থাকবে, এটাও তো মানা যায় না, যেমন মানা যায় না বিশ্ব জুড়ে জ্ঞানের উন্মেষ ঘটে চলেছে বলে দক্ষিণ এশিয়ার এই প্রাচীন সভ্যতার এক প্রান্তে গঙ্গা পদ্মা পাড়ের ধারে উন্মুখ হয়ে থাকা সভ্যতাকে এড়িয়ে যাওয়া । আমি জানি না এই মানুষগুলোর চিন্তাকে কোন ভাবে জায়গা দেব। অক্ষয়কুমার দত্ত মহাশয় তাল ঠুকে বললেন, ‘বাঙ্গালীর একটা নিজস্বতা আছে বই কি, আপনারা যত খুশি ছাল ছাড়ানোর ইচ্ছা ছাড়ান, তাতে এই জাতের কিছু আসে যায় না, নিজের ঘরে বসেই না কৃত্তিবাস বাংলায় রামায়ন লিখেছিলেন, পুরোটাই ভাববেন না, বাল্মীকি রামায়নের ভাবানুবাদ, বাংলার নারী পুরুষের মনের কথা উঠে আসে নি, এই সিদ্ধান্ত সহজে আসা অনুচিত কাজ হবে। তাহলেই বুঝুন, আমাদের জীবনদর্শনের স্রোতটা কোন দিকে বইছে, তাই বলে ভাববেন না আমি নবজাগরণকে অস্বীকার করছি। যে যার মতো চলুক, তবে সাহেব-সুবোদের ভাবখানা আমাদের ঘাড়ে চাপাতে গেলে বাঙালিদের মনের কথা যে অধরা থেকে যাবে, আমি পুরোপুরি নিঃসন্দেহে বলতে পারি।’ মানুষটা এক লহমায় কথাগুলো বললেন বটে, কিন্তু আমার হজম করতে সময় লাগল। ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানব-প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার’ গ্ৰন্থদ্বয় সংগ্ৰহ করেছি কিন্তু অন্য বইয়ের ভারে এখনও পাতা ওল্টাতে পারিনি। এমন কথা ওনার মুখেই মানায়। ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা সম্পাদনায় ব্রাহ্মধর্মের প্রচার করলেও সাংবাদিকতা ও সাহিত্যমূল্য তো কম ছিল না। তাই বলেই না বিদ্যাসাগরের সঙ্গে হাতে হাত ধরে এত পথ পাড়ি দেওয়া। রাতের পর রাত জেগে বাঙালির সত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলা। মানুষকে কেমন করে ঋণী করে ফেলা যায়, সেটা মানুষ না বুঝতে পারলেও সময় ঠিক বুঝিয়ে দেয় তার নিজস্ব নিয়মে।
আমার ধর্মের সঙ্গে এই জাতির ধর্মবিশ্বাসের তফাৎ ঠিক কোন জায়গায়, আমার ভূমিকা তাকে কতখানি ত্বরান্বিত করবে আমি জানি না। তবে আর কেউ বুঝুক না বুঝুক কাজটা যে সহজ হবে না আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ষড়ঋতুর এই দেশে আর কী আছে সময় বলবে, জাত্যাভিমান নিয়ে এরা ভরপুর হয়ে আছে, এক পা দু’পা এগোলেই টের পাওয়া যায়। আমার এই ভাবনার ফাঁকেই অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে, বাংলার মাটি ভিজে যাচ্ছে তার মতো করে। জলের স্রোত উঠে আসছে জলাজমিন ছেড়ে ঘরের দূয়ারে। যে বাড়িগুলো একটু আগেও স্পষ্ট ছিল বলে আনন্দে উৎফুল্ল হচ্ছিলাম নাড়ি নক্ষত্র জানব বলে, এখন আস্তে আস্তে ঘোলাটে হয়ে উঠছে। ঠিক ওই চেনা মানুষগুলোর মতো, এতদিন মনে হয়েছিল এদের রঙঢঙ সবই যেন জেনে বসে আছি, ওদের কথাবার্তায় চালচলনে, সেইমতো বিচার বিবেচনাও শুরু করে দিয়েছি, কিছুদিন যেতে না যেতেই মনে হচ্ছে আমার ধারনা সম্পূর্ণ ভুল। আসলে ওরা আমাকে চেনাতে চাইনি বলেই নিজেদের গুটিয়ে রেখেছিল। ওদের আর দোষ কী! গোটা পৃথিবীর শাষকরাই তো নিজেদের আবরণের নীচে লুকিয়ে রেখেছে, এ-ও এক অদ্ভুত রকমের ছদ্মবেশ, সকলে যেন সকলের সঙ্গে খেলছে লুকোচুরি। আধিপত্য বিস্তারের আকাঙ্খায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুখ ও মুখোশের তফাৎ দিনে দিনে স্পষ্ট হচ্ছে। বাঙালি উচ্চশিক্ষিত বিদ্দজনরা নিজেদের কথাগুলো সোচ্চারে এমনভাবে উচ্চারণ করছে যা ইংরেজরা কল্পনাতেও স্থান দেয় নি, তাই তো ওদের গাত্রদাহ। আমার স্বগোত্রীয়রা আমাকে পর্যুদস্ত করতে চেয়ে গোপনে যে অস্ত্রে শান দিচ্ছে তার উপযুক্ত জবাব ওরা অচিরেই পেয়ে যাবে। যারা থাবা বসাতে চাইছে বসাক গড নিশ্চয়ই সেই বিচারের ভার নিজের কাঁধে তুলে নেবে। আমার দায় হলো শুধু সাধারণের ক্ষমতাটুকু চিনিয়ে দেওয়া। আমি জানি না এই পরিবর্তনের ছিটেফোঁটা আমি স্বচক্ষে দেখতে পাব কিনা। সামাজিক কাঠামোতে যে জঙ ধরে আছে তাকে চেঁছেপুছে পরিষ্কার করে আসল চেহারা বের করে আনতে হবে যে কোনও মূল্য আমি শুধু এইটুকু জানি। পরাধীন দেশের ঝুল ঝাড়তে গেলে যে প্রতিরোধ জরুরি, যেই জনবিস্ফোরণ সময় দাবী করে তার বিন্দুবিসর্গ দেখা মিলছে না। এমন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মানুষের ঘুম ভাঙাতে কারা পৌঁছে যাবে সেই মেঠো পথে, এই প্রশ্ন আমাকে বার বার করে তুলতে হবে।
রামতনু লাহিড়ী মহাশয় বিলক্ষণ জানতেন, বললেন, ‘জেমস্ লঙ আরও অনেক প্রদীপ জ্বালাতে হবে, শুধু সলতে উস্কে দিলে তো হবে না, তেল ঢালতে হবে, আর দরজায় দরজায় গিয়ে সেই প্রদীপের আলো দেখাতে হবে, রাজাবাবু মেট্রোপলিটান কলেজ স্থাপন করেছেন ঠিক কথা, সরকারের উৎসাহে অনেক মিডল স্কুল ও বাঙলা স্কুল হয়েছে সে-ও সাধু কাজ, কিন্তু গরীব মানুষদের দিকে তাকিয়ে দেখুন, তারা কীভাবে এতে লাভবান হবে, ভেবে দেখতে হবে। শিক্ষক তৈরির কাজে নর্মাল বিদ্যালয় হয়েছে মন্দ নয়, কিন্তু সে আর কতটুকু, শিক্ষকের অভাবে ছাত্ররা বিষয়ের অন্দরে ঢুকতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছে।’ কথাগুলো শুনে চমকে গেলাম। মানুষটার দূরদর্শীতা হয়তো একদিন এই দেশের আম মানুষের কাজে আসবে। স্কুলের চেয়ারে বসে তিনি তাঁর উজ্জ্বল চোখ দুটো বড় বড় করে ভবিষ্যৎ দর্শন করছেন। শত শত ছাত্র বিদ্যালয়ে আসছে। গরীব ছাত্ররা টেবিলে বসে শিক্ষকদের কাছে জানতে চাইছে কত অজানা বিষয়, শুধু নিজেদের দেশের কথা নয়, বিশ্বের অঙ্গনে ছড়িয়ে থাকা জ্ঞান বিজ্ঞান ওদের মধ্যে সত্যকে জানার জন্য উদ্বুদ্ধ করছে, যুক্তি তর্ক দিয়ে নিজেদের স্বাধীন মতামতকে ব্যক্ত করছে। আমার ইসলিংটনের চার্চ মিশনারি সোসাইটির কথা বারবার করে মনে পড়ছে, কত বিষয়ে মগ্ন থেকে জীবন কেটেছে, একবারের জন্যও মনে হয়নি কোন বিশেষ সংকল্পে বিদ্যা অর্জনের পথে নেমেছি। জ্ঞানলিপ্সার এক অদম্য আকাঙ্খা পেয়ে বসেছিল বুঝি। ভাষা আমাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে, প্রতিটি শব্দ আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে জীবনের স্পন্দন। শব্দের যে এত ক্ষমতা সেদিন বুঝেছিলাম, হিব্রু, গ্ৰীক, লাতিন ও ইংরেজি ভাষার মায়ায় জড়িয়ে গিয়ে মানুষের শত বছরের আক্ষরিক কন্ঠস্বর আমাকে চিনিয়ে দিয়েছিল কী চাই, আর কোন পথে চাই, ক্রমে ক্রমে আমার প্রিয় বিষয় হয়ে উঠেছিল ধর্মতত্ত্ব ও ক্লাসিক। এমন ধ্যান ধারণাই আমার অন্তরাত্মাকে জাগিয়ে তুলে বলেছিল ‘ চার্চ মিশনারি সোসাইটিতে যোগদানই তোর ভবিতব্য, যা কালক্ষেপ না করে আবেদন কর।’ ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেল নিজের নিয়মেই। আমার ভবিষ্যৎ তাই আমার কাছে জবাব চাইছে ‘ যা কিছু ঘটছে কিংবা কাল ঘটবে, তার মুখোমুখি হতেই হবে, ক্রুশবিদ্ধ তো যন্ত্রণার এক অচেনা মুহূর্ত তাকে আপন করে না নিলে সত্যমিথ্যা ভালোমন্দের নিরুপন হবে কেমন করে!’ বুঝেছিলাম নিজের কথাগুলো বলতে হবে, তাই তো বলে চলেছি আজও এই অচেনা মানুষের গোলকধাঁধায়। এদের কথা আমি ওদেরকে শুনিয়েই ছাড়ব। তাই কী অ্যাংলো-আইরিশ মিশনারি সোসাইটির ধর্মযাজক সেজে বসে আছি? নিজের কাছে রাখা এই প্রশ্নের জবাব হয়তো আমার কাছে নেই, আছে বোধ হয় ওই রুগ্ন, রোগাক্রান্ত, অভুক্ত মানুষগুলোর রোজনামচায়। তবে কী বাঁদর গুলো হনুমান সেজে বসে আছে, কোন একদিন মানুষ হবে বলে? প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas magazine
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)
