সৌমিতা রায় চৌধুরী

পর্ব – ১৫

‘লা পিয়েরে ফিলোসফেল’ ফরাসি ভাষায় যার অর্থ পরশপাথর। ১৯৫৮ সালের বাংলা ভাষার একটি ফ্যান্টাসি কমেডি চলচ্চিত্র ‘পরশপাথর’। নির্মাণ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। পরশুরাম ছদ্মনামে রাজশেখর বসুর ‘পরশপাথর’ ছোট গল্প অবলম্বনে কাহিনীটি চিত্রায়িত হয়েছে। চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক সত্যজিৎ রায়। প্রধান চরিত্রটি অতুলনীয় রসবোধের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী। রাণীবালা দেবীর অভিনয় দর্শকদের মনে দাগ কেটেছিল। 

পরেশচন্দ্র দত্ত (তুলসী চক্রবর্তী) কলকাতার একজন মধ্যবিত্ত ব্যাংক কেরানি। বৃষ্টির দিনে অনিচ্ছুকভাবে তিনি একটি দাতব্য ম্যাচে যোগ দেন। যেখানে ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল সেখানে তিনি একটি ছোট গোলাকার পাথর খুঁজে পান। এটিকে মার্বেল ভেবে নিজের ভাগনেকে সেই পাথর দিয়ে দেন। শিশুটি সেটি নিয়ে খেলতে গিয়ে যাতেই ছোঁয়ায় সেটি তৎক্ষণাৎ সোনা হয়ে যায়। এই বিস্ময়কর বিষয়টি দেখার পরে পরেশবাবু কিছু মিষ্টির বিনিময়ে পাথরটি নিয়ে নেন। নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কিছু জিনিসের উপর পাথরটির শক্তি পরীক্ষা করেন। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে প্রচুর পুরনো কামানের গোলা ডাস্টবিনে পড়ে থাকত। পরেশবাবু কিছু কামানের গোলাকে সোনায় পরিণত করে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেন। এইভাবে সহজেই হাতে প্রচুর অর্থ আসার কারণে পরেশবাবুর জীবনযাত্রার মান সম্পূর্ণ বদলে যায়। নতুন বাড়ি, গাড়ি, বিভিন্ন আসবাবপত্রের পাশাপাশি বিভিন্ন সভা সমিতিতে যোগদান এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগের পরিমাণ বেড়ে যায়। প্রিয়তোষ হেনরি বিশ্বাস (কালী ব্যানার্জী) নামে একজন তরুণ ব্যক্তিকে ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে নিয়োগ করেন। 

পরেশবাবু ছিলেন একজন সাধারণ মানের ব্যাংক কর্মী। শহুরে উচ্চবিত্ত জীবনযাপনের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। কিন্তু হঠাৎ হাতে প্রচুর অর্থ আসায় বিভিন্ন পার্টিতে যোগদানের আমন্ত্রণ পান। একটি ককটেল পার্টিতে বিদেশী মদ খেয়ে মাতাল হয়ে কিছু অস্বাভাবিক আচরণ করেন। পার্টির নিয়ম অনুযায়ী তাকে বেরিয়ে যেতে বলা হয়। সেই মুহূর্তে তিনি একটি লোহার মূর্তিকে সোনায় রূপান্তরিত করেন। ঘটনাটি সংবাদপত্রের শিরোনামে চলে আসে। চারদিক থেকে প্রচুর কৌতুহলী মানুষের প্রশ্ন পরেশ দত্তকে আতঙ্কিত করে তোলে। স্ত্রী গিরিবালা দেবীকে নিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। চলে যাওয়ার আগে ব্যক্তিগত সচিব প্রিয়তোষের হাতে নিজের যাবতীয় সোনায় পরিণত করা সম্পত্তি এবং পাথরটি হস্তান্তর করে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার কথা বলে যান। কিন্তু পুলিশ মিস্টার ও মিসেস দত্তকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য থানায় নিয়ে যায়। প্রিয়তোষের কাছে সবকিছু আছে জানার পরে পুলিশ প্রিয়তোষের খোঁজে গিয়ে জানতে পারে পরশপাথরটি রক্ষা করতে মরিয়া প্রিয়তোষ পাথরটি গিলে ফেলেছে। প্রিয়তোষকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। ডা. নন্দী (মণি শ্রীমানি) বিস্ময়ের সাথে জানান পাথরটি প্রিয়তোষ হজম করে ফেলেছে। প্রিয়তোষের পাথর হজম সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরেশ দত্তের লোহা থেকে বানানো সোনার জিনিসগুলি আবার লোহায় রূপান্তরিত হয়। 

দত্ত দম্পতি তাদের পুরনো ভৃত্য (জহর রায়)-এর সাথে মিলিত হয় এবং মাঝখানের ধনী হওয়ার বিড়ম্বনার সময়টুকু বাদ দিয়ে নিজেদের স্বস্তির জীবনে ফিরে যাওয়ার আনন্দে মেতে ওঠে। মুক্তি পেয়ে পরেশবাবু স্ত্রী, ব্যক্তিগত সচিব ও পুরনো ভৃত্যকে নিয়ে গড়ের মাঠে জুড়ি গাড়ি করে বেরিয়ে পরেন। মধ্যবিত্ত পরিশ্রমী বাস্তব জীবনে বাঁচার প্রকৃত স্বাদ খুঁজে পায়। 

এই ছবিটিতে অভিনয় করেছেন তুলসী চক্রবর্তী, রাণীবালা দেবী, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, হরিধন মুখোপাধ্যায়, বীরেশ্বর সেন, মণি শ্রীমানি, সন্তোষ দত্ত, ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ি সান্যাল, কমল মিত্র, নীতিশ মুখোপাধ্যায়, সুবোধ গাঙ্গুলী, তুলসী লাহিড়ী, অমর মল্লিক, চন্দ্রাবতী দেবী, রেণুকা রায় এবং ভারতী দেবী। ছবিটি সম্পাদনা করেছেন দুলাল দত্ত এবং সংগীত পরিচালনা করেছেন রবিশঙ্কর। 

সত্যজিৎ রায় এই চলচ্চিত্রটিকে কৌতুক, কল্পনা, ব্যঙ্গ, প্রহসন এবং উদ্দীপনার সংমিশ্রণ হিসেবে আখ্যা দেন। চলচ্চিত্রটি ১৯৫৮ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে স্থান পায়। সেখানে এটি ‘পাম ডি অর’ ( শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র) বিভাগে প্রতিযোগিতা করে। 

প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *