শরদিন্দু সাহা
লেখক পরিচিতি
বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।সম্প্রতি লেখক ‘দীপ্তি রায়চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২৪’-এ সম্মানিত হয়েছেন।
বিষয় পরিচিতি
(রেভারেন্ড জেমস্ লঙ যে লক্ষ্য স্থির রেখে জীবনকে চালনা করেছেন তা শুধুমাত্র ঘটনাক্রম দিয়ে ধরা যায় না। তাঁর কর্মজীবনের পরিক্রমায় যে অন্তর্নিহিত শক্তি ও প্রভাব রয়েছে তাকে কোনও এক শিল্প মাধ্যম দিয়ে উপলব্ধি করা যায় না। কারণ কোনো সরলরেখায় তিনি তাঁর কাজকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, নানা উত্থান পতন ঘাত প্রতিঘাত তাকে পীড়িত করেছিল, বিপর্যস্ত করেছিল। তিনি প্রবল আত্মশক্তিতে তার মোকাবেলা করেছিলেন এবং কর্তব্যকর্মে অটুট ছিলেন। তাঁর কাজের পরিধি ও ব্যাপ্তি একজন শিক্ষকের, সমাজসেবকের, মানবপ্রেমির যা মূলত শাসক ও শোষিতর মাঝখানে একজন প্রতিবাদীর, সত্যবাদীর, বলা যায় একজন দ্বান্দ্বিক ব্যক্তিত্বের। যার না-বলা কথা, জানা-অজানার কল্পনা ও বাস্তবের মিলন নিয়ে উপন্যাস লেখা সম্ভব অসম্ভবের দোলাচল মাত্র, তবুও শব্দের মায়ায় ধরার সামান্য প্রচেষ্টা। কোথায় তার অন্ত হবে প্রকৃত অর্থে বলা খুব কঠিন। এই মহান মানুষটির শৈল্পিক জীবনকে ছুঁয়ে যাওয়া আর কি।)
জ্বালো প্রদীপ মাটির ওই আঁধার ঘরে
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আর মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সামাজিক আন্দোলন এবং সমাজসংস্কারের আঁচ আমি একটু একটু করে টের পাচ্ছিলাম। সিএমএস ভবনে অখ্রিষ্টান ছাত্রদলের বাইরে যে আর একটা জগতের জন্ম হচ্ছে তাতে খানিকটা আহ্লাদিত হয়েছিলাম, বুঝতে চাইছিলাম এই ঢেউটা কেমন, কোন পথ দিয়ে ছুটে আসছে, কেমন হবে তার আগামীর রূপ, ইসলিংটনের চার্চ মিশনারি সোসাইটি কলেজের প্রশিক্ষণ এই পরিবর্তিত আবহাওয়ার এদেশীয়দের কী কাজেই বা আসবে। চিন্তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব আমাকে আক্রান্ত করে ফেলছে ক্রমশ। বেথুন সাহেবের কর্মকাণ্ড আমার যাজকের ভূমিকার সঙ্গে কোথায় মেলানো যায় সেই ভাবনায় ভাবিত হতে হতেই মনে হলো আমার এই অবস্থান কতটা যুক্তিযুক্ত ও উপযোগী করে তুলবে আমাকে আর আমার যোগসূত্রকে। দ্বিধা দ্বন্দ্বটা কাটিয়ে তুলতে যাবো এমন সময় এক ছাত্র এসে বলল, ‘ফাদার লং, বিদ্যাসাগর মহাশয় আজ হিন্দু কলেজে কথা চালাচালি করবেন, চলুন সরাসরি ওনার সংস্কারের অমৃত বাণী শুনি।’ লোভটা পেয়ে বসলো। এমন একজন মানুষকে মঞ্চে বক্তৃতারত দেখতে মন উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। এই মানুষটির অস্তিত্ব বাঙালি জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ যাঁরা আশপাশে থাকেন তাঁরাই উপলব্ধি করেন। সম্প্রতি কিছু পুস্তক আমার হাতে এসে পৌঁছেছে। ‘বেতাল পঞ্চবংশতি’ পাঠে আমার চোখ খুলে গেল। বাংলা ভাষা যে এমন মিষ্টি হতে পারে আমার কল্পনাতীত ছিল। মানুষটাকে দেখার আগ্রহ আমার চতুর্গুণ বেড়ে গেল। সামনাসামনি দেখে মনে হলো এমনও হয়!
কে এই মানুষটি? ইনিই কী বিদ্যাসাগর! কথার বাঁধুনিতে উপস্থিত শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রেখেছেন। প্রতিটি শব্দের মধ্যে সমাজকে মসৃণ করার আকুল আবেদন ঝরে পড়ছে। মানুষের জন্য এমন দরদ কম মানুষের মধ্যে দেখেছি। এত জ্ঞান, এত বুদ্ধির সম্ভার নিয়ে যিনি প্রতিটি কথা উচ্চারণ করছেন কিন্তু কী সাদামাটা পোশাক, কে বলবে ইনি বাংলার মানুষের নয়নের মণি! পরণে সাদা রঙের আলখাল্লা ও পায়জামা, পায়ে চটি জুতা, শরীরের তুলনায় বড় মাথার মানুষটির আত্মবিশ্বাস চাক্ষুষ না করলে হৃদয়ঙ্গম করা কষ্টকর। আমি নিজের সঙ্গে মেলাবার চেষ্টা করলাম – আমি যা ভাবি, উনি কি তাই ভাবেন? প্রাচ্যের এই মানুষটির সঙ্গে পাশ্চাত্যের কোথাও অজান্তেই যেন মিলন ঘটে গেছে, যদি তাই না হবে তবে এমন সংষ্কারমুক্তির কথা অবলীলাক্রমে বলেন কী করে! আমি যেন ইংল্যান্ডের কোনো সভায় বসে কোন এক প্রাজ্ঞ ব্যক্তির সমাজবিজ্ঞানের কথা শুনতে পাচ্ছি। এই এমন এক আশ্চর্য অনুভূতি যা সকল জাতির মানুষকেই মুক্তির সন্ধান দেয়। আমার এমন বিশ্বাস জন্মাল যে এই মানুষটির ভাবাদর্শই ঘুমিয়ে থাকা বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে তুলতে পারে। আমার প্রিয় ছাত্রটি আমার কাছে সবিনয়ে জানতে চাইল, ‘ফাদার লঙ, ভারত আত্মার স্পর্শ পাচ্ছেন তো?’ আমি ওকে কী জবাব দেব, মূক হয়ে নির্নিমেষ চাহনিতে তাকিয়ে রইলাম। মনে হলো দ্রষ্টা এক মানুষ কোনো এক স্বপ্ন নিয়ে ভবিষ্যত বাংলার ছবি আঁকছে। মরণপণ করে মরা গাঙে নাও ভাসাতে চাইছে। আমার ছাত্র আবারও গোড়ার প্রশ্নটাই তুলল, ‘আপনি কি সেই নাওয়ের যাত্রী হবেন?’ ও কি আমাকে যাচাই করে নিতে চাইছে একজন পাদ্রী হয়ে আমার চিন্তা চেতনাকে মূল লক্ষ্য থেকে ভিন্ন খাতে চালনা করতে পারি কিনা। তিনি তো শুধু বক্তব্য রাখেন নি, আসলে নিজেকে উজাড় করে শ্রোতাদের সামনে মেলে ধরলেন। বুঝিয়ে দিলেন কি আছে, আর কি নেই, কতদূর যেতে হবে, কেমন করে শূন্যস্থান পূরণ করতে হবে। অবাক হয়ে দেখলাম নিজেকে কি করে আড়াল করে রাখতে হয়। শ্রোতারা সকলে আসন ছেড়ে চলে গেল, আমি যেন কীসের টানে বসে রইলাম জানি না। বিদ্যাসাগরের নজর এড়ায়নি, মঞ্চ থেকে নেমে এসে আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন, বললেন, ‘আপনিই কী রেভারেন্ড লঙ?’ দাঁড়িয়ে উঠে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, হ্যাঁ। তিনি এই দেশকে নিজের দেশ হিসেবে ভাবার অনুরোধ করে বললেন, ‘ইংরেজরা আমাদের দেশ শাসন করছে বটে, কিন্তু শিক্ষিত করতে পারে নি, চাইলে আপনি এই অন্ধকার মুছে দিয়ে আলোর দিশারী হতে পারেন।’ বিদ্যাসাগর মহাশয় পা বাড়ালেন, আমি মানুষটার পথের দিকে চেয়ে থাকলাম। কথাটা আমার কানে অনুরণন তৈরি করল, আমার চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে দিল, ভাবলাম কেমন করে আমি এই দায়ভার বহন করতে পারি।
এখন অনেক রাত। এত গভীর অন্ধকার, তবুও দিনের আলোর মতো চিন্তাগুলো আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। কী দেব, আর কীভাবে দেব এই ভেবেই তো মনে জাগছে নানা পরিকল্পনা। একটু আগেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছিল। এতক্ষণে বোধ হয় রাস্তাঘাট জলে জলময়। ব্যাঙের ডাকাডাকিও মন্দ লাগছে না। জলের মধ্যেও জেগে আছে কত অচেনা শব্দ, পাখিদের ডাকাডাকিও মনে করিয়ে দেয় কলকাতা শহরটা লন্ডন হয়ে যায়নি। বিছানা ছেড়ে উঠে বসলেও বিদ্যাসাগরের প্রতিটি শব্দ মনে হচ্ছে যেন বজ্রের মতো বাগ্ময় আবার সন্তানস্নেহের মতোই কোমল আর মধুর। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম মানুষটাকে বুঝতে হবে আরও অন্তর দিয়ে, শুধু অক্ষরের জাদু দিয়ে বোঝা যাবে না। নারী শিক্ষায় এইদেশের মেয়েদের এগিয়ে আসতে হবে, না হলে সংষ্কারের বেড়াজাল থেকে মুক্তি দেওয়া যাবে না। এমিলির চোখেও বোধ হয় ঘুম নেই, এক ঝাঁক স্বপ্ন এসে ওকে জড়িয়ে ধরেছে। ছটফটানি দেখে বুঝতে পারলাম ও আমাকে এক্ষুনি প্রশ্নের পর প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবে। যা ভাবছিলাম ঠিক তাই। বলল, ‘তুমি বোধ হয় দেশটাকে বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছ, না?’ কী যে জবাব দেব। তার আগে আমাকে ভালো করে বুঝে নিতে হবে ব্রিটিশরা এই দেশকে কেমনভাবে দেখতে চাইছে, কেবলই করদ রাজ্য, না এই দেশের মানুষদের মানুষ করে তোলার অভিপ্রায়, কোনটা? তাহলে আমার লড়াইয়ের ধরনটাও তেমন করে পাল্টাতে হবে। এমিলিকে বললাম, তুমি দেশে ফিরে যাও, এই কষ্ট এখানে তোমার সহ্য হবে না, আমি বরঞ্চ তোমাকে মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসব। এমিলি জানিয়ে দিল, ‘আমি আমার উত্তর পেতে গেছি।’ আমি জানি না ও কী বুঝল কিন্তু এটা বুঝলাম ও নিজে নিজেই ওর চেনাজানা পৃথিবীটাকে পাল্টে দেবে বলে মনস্থির করে ফেলেছে। বলল, ‘তোমার হাত যখন ধরেছি, এত সহজে তোমার হাত ছাড়ব না, যুদ্ধে যখন নেমেছি তখন ষোল আনাই লড়াই করে দেখব, জীবনের মাখামাখিতে আনন্দ, না মুখ ফিরিয়ে নেওয়াতেই জটিল উত্তরগুলো সহজ হবে।’ এমিলিকে জীবনসঙ্গীনী করেছি বটে, কিন্তু পুরোপুরি চিনতে পারিনি এখনও। ওর শান্ত উদাস ভঙ্গি আমার মধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। শহর ছেড়ে কত মেঠোপথ ধরে যেতে হবে তো অনেক দূর, এমনও অনেক জলা-জঙ্গল আছে, যার ছোঁয়া ও কোনোকালেই অনুভব করেনি। ও আমাকে জবাব দিল, ‘কত প্রাচীন সংস্কৃতির দেশ এই বঙ্গদেশ, একবার নিজের সঙ্গে মিলিয়ে দেখব না, এই দেশের মায়েরা মেয়েরা কেমন করে কথা বলে, কোথায় তাঁদের অপূর্ণতা, কোন পথে হাঁটলে ওঁরা মনের কথা খুলে বলবে, আমার বন্ধু হয়ে যাবে।’ আমি রীতিমত স্তম্ভিত হয়ে গেলাম বিদ্যাসাগরের ইচ্ছাগুলো এমিলির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে দেখে। দূর এমনি করেই বোধ হয় দূর থাকে না, কল্পনার জাল বুনতে বুনতে এক সময় হাজার হাজার মাইল পথ পার হয়ে চলে আসে। বুঝলাম এমিলি কত তাড়াতাড়ি এই দেশের নাড়ী স্পর্শ করে ফেলেছে। আমি নিশ্চিত হলাম এবার আর আমার কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়তে কোনো বাধা রইল না।
কী মনে হলো আপনমনেই হেঁটে হেঁটে ‘সংস্কৃত বুক ডিপজিটারি’-তে পৌঁছে গেলাম। মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের হৃদ্যতার কথা কে না জানে। খানিকটা ইতস্তত হয়ে চৌকাঠে পা রাখতে না রাখতেই দেখলাম এক কোনায় কে যেন চুপটি করে বসে রয়েছেন আর মনোযোগ সহকারে পাতার পর পাতা উল্টাচ্ছেন। আমার উপস্থিতি টের পেয়েছেন কিনা জানিনা, কিন্তু ওঁর দৃষ্টি স্থির ছিল, আর কলম দোয়াত আর খাতাপত্র হাতের কাছেই পড়েছিল, সুযোগ পেলেই কিছু নোট করে নেবেন এমনভাবেই কি বইয়ের পাঠ নিচ্ছেন। কে এলো গেলো কোনো কিছুই তাঁকে তেমনভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে না। তবুও খানিকটা সংকোচের সঙ্গেই কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। বললাম, কী বই পড়ছেন? উত্তর এল, ‘চার্লস ডিকেন্স’-এর ‘অলিভার টুইস্ট’, চমৎকার উপন্যাস, মনের গভীরে গিয়ে ধাক্কা মারছে। আমাদের দেশেও অলিভারের মতো চরিত্ররা পথেঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কে তাদের খুঁজে আনবে। লেখকের এলেম আছে। ওনার মতো লেখক আমাদের দেশে কবে জন্মাবে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে নবজোয়ার আসছে তার ফল ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিশ্চয়ই পাবে। আর একটা বই আমার হাতে এসেছে ‘আ ক্রিসমাস ক্যারল’। পড়ার আগ্ৰহ নিয়ে অপেক্ষায় আছি।’ জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এত সময় পান কেমন করে? তিনি মৃদু হাসলেন। আপনার ‘শিশুশিক্ষা’ বাংলা ভাষা ও বর্ণমালা শেখানোর ক্ষেত্রে অতি প্রয়োজনীয় বই। বললেন, ‘আপনি বাংলা ভাষা সাহিত্য নিয়ে এত খবর রাখেন?’ বললাম, ভাষা আমার এক প্রিয় সাবজেক্ট। ‘ দ্বিতীয় ভাগও শীঘ্রই প্রকাশ পাবে। আমিও আপনার বিষয়ে অনেক খবর রাখি। ‘আপনারও তো হিব্রু, গ্ৰীক, লাতিন, ইংরাজী ও নানা ভাষায় অগাধ পাণ্ডিত্য।’ কী যে বলেন, আপনার কর্মকাণ্ডের কাছে এসব তুচ্ছ। আপনার শৈশবের ‘বাসবদত্ত, ‘রসতরঙ্গিণী’ এই দুটি বইয়ের কথা কে না জানে। ‘আপনি এই বই দুটিরও খোঁজ রেখেছেন!’ আরও অনেক খবর রাখি। ‘পাখী সব করে রব, রাতি পোহাইল।’ ‘সকলে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি’ পঙক্তিগুলি তো সকলের মুখে মুখে ফেরে। কথায় কথায় বলেই ফেললেন, ‘এই দেশের মেয়েদের নিয়ে আমার চিন্তার অন্ত নেই, যদি সম্ভব হয় মা-বোনদের কথা আপনার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার মধ্যে জুড়ে দেবেন। কীভাবে করবেন আমি জানি না, তবে একটা তো ঠিক পৃথিবীর অন্য প্রান্তের মেয়েরা যে আলোর দিশা পেয়েছে, এই হতভাগীরা তার বিন্দু বিসর্গ পায়নি।’ আমার কোনভাবেই চোখ এড়ায় নি ওর চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। বড় বেদনার সেই অশ্রু, কে কবে মুছিয়ে দেবে, সে কী আমি আর জানি। তবে ওর আত্মবিশ্বাসের ছোঁয়ায় আবিষ্কার করলাম, পথটা এখনও অবরূদ্ধ হয়ে যায় নি। তিনি চেয়ারটাকে একটু ঘুরিয়ে গালে হাত দিয়ে বসলেন। বইয়ের পাতা থেকে তিনি সরিয়ে নিচ্ছেন তাঁর দৃষ্টি, হয়তো অন্য কোথাও ডুব দিতে চাইছেন কিন্তু কোন কুলকিনারা খুঁজে পাচ্ছেন না। এমনও হয়তো ভাবছেন জীবন তাঁকে আর সেই সময় দেবে না। সত্যিই তো জীবন মানুষের বাসনাকে পরিপূর্ণতার সুযোগ সব সময় দেয় না, অন্যরা কি তাহলে হাত পেতে বসে থাকে! আমিও যেই সময় আমার অন্তরাত্মার কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছিলাম ঠিক ওই সময়েই উনি বলে বসলেন, ‘এই দেশে সবকিছু আছে, নেই শুধু আত্মবিশ্বাস। এখন নতুন ভোরে ওই বিশ্বাসটুকু বন্ধ দরজার বাইরে অপেক্ষা করে আছে গভীর প্রত্যাশা নিয়ে কে এসে খুলে দেবে।’
কথপোকথনের রস নিংড়ে নিয়ে বাইরে পা রাখলাম। মনে হলো ওই দুটি চোখ আমার দিকে চেয়ে আছে। কত কথা এসে একে একে ভিড় জমাতে লাগল। এই যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে কত ভাঙচুর হয়ে চলেছে প্রতি মুহূর্তে, কত নতুন কথার জন্ম হচ্ছে, কত সৃষ্টির আনন্দধারা বয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত তার হিসেব আমরা কয়জনইবা রাখছি। কেই-বা ভাবছে পৃথিবীর কোনে কোনে তার সুফল পৌঁছে দেবে। কেবলই শুধু ঘৃণা, আত্মশ্লাঘা আর অনধিকার চর্চা। কথা বলছে, আবার বলছেও না, ক্ষুদ্রতর গণ্ডির মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে চিন্তার সংকীর্ণতা এর থেকে মুক্তি বড় প্রয়োজন। সামনের স্বচ্ছ আকাশে কত চিলেদের আনাগোনা, দু-চারটে কৃষ্ণচূড়া গাছ বাড়ির আনাচে কানাচে ডালপালা ছড়িয়ে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। ধুলোয় ধুলোময় কলিকাতার অলিগলি। রৌদ্রের তাপে আমার শরীর দগ্ধ হলেও এই শহরের কিছু মানুষের উদ্ভাসিত মনন আমাকে কোথায় যেন অশান্ত করে তুলল। সামনে এখনও অনেকটা পথ আমাকে মাড়িয়ে মাড়িয়ে যেতে হবে। কত কথা যেন গুমড়ে পড়ে আছে আমাকে খুঁড়ে খুঁড়ে বের করে আনতে হবে, না হয় শুধু ধর্মকথা বিলোলে শুধুই হবে অরণ্য রোদন। হঠাৎই যেন শুনতে পেলাম কে যেন কেঁদে ভাসাচ্ছে, এক ভদ্রজনের ঘরের বউ রাস্তায় এসে নেমেছে। সাদা থান পরা, চুলগুলো ছাঁটা, অল্প বয়সে বিধবা হয়ে যাওয়া এক কিশোরী। ঘরে ঠাঁই হয়নি, তাই তার এত দূর্দশা। পরদেশী হয়ে ওর চোখের জল মোছাব এমন উপায় তো নেই। মানুষের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করবে এমন মনের জোর কি আমার আছে? মদনমোহন মহাশয়ের মনে হিন্দু বিধবাদের নিয়ে যে চিন্তার উদ্রেক হয়েছে তার যথার্থতা এই দৃশ্যের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ বুঝতে অসুবিধা হলো না। এও বুঝলাম আমার ভূমিকা এখানে গৌণ, বরঞ্চ সমাজের অন্দরমহল থেকে উঠে আসা প্রতিবাদী কন্ঠস্বরেই এর জবাব মিলতে পারে। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কথার ফাঁকফোকরে আমি কিছুটা আঁচ যে পাইনি, এমন নয়। নানা প্রশ্নেরও জন্ম হচ্ছিল অন্তরে কিন্তু কোথায় গিয়ে থামব জানি না। ওদের মুখগুলো দেখে মনে হচ্ছিল, অনেক ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে ইতিউতি সঠিক সময়ে বর্ষণের অপেক্ষায়, হবেও হয়তোবা, শক্ত ভিতের উপর দাঁড়াতে হবে বই কি। যাক সামনের পথটা যে এঁকেবেঁকে গেছে, তারই কোনো একটা পথ বেছে নিয়ে আমাকে অভিনন্দন জানাতে হবে। হ্যাঁ কত কাঁকড় আয়ারল্যান্ডের মাটিতেও দেখেছি, অনেক রক্তপাত, অসামাজিক কার্যকলাপে টইটম্বুর ছিল, এই উপলব্ধি আমার চেতনাকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই স্বদেশের যন্ত্রণার ছায়াকে সঙ্গী করেই বাংলার মাটিকে আঁকড়ে ধরা।
জীবন কি জীবনকে চেনে না, চেনে, তার মতো করেই চেনে। অন্তরের বেদনাকে জাপটে ধরে আলোর পৃথিবীটাকে চেয়ে দেখার বাসনা আমার আনন্দকে চতুর্গুণ বাড়িয়ে দেয়। মানুষের কল্যাণ কামনার আগ্ৰহ চারপাশকে এমন করে জাগিয়ে রাখতে পারে এমন উপলব্ধি বোধ হয় কদাচিৎ আসে। আমার বোধে আসে না আমি কেন নিজেকে চিনতে পারি না, হাঁসফাঁস করি যখন ভাবি মানুষের দূর্মতি মানুষকেই কেন গ্ৰাস করে, তা কি অন্য কোনো পৃথিবীতে বিচরণ করতে পারে না! ভাবছি এই উত্তরটা মানুষের কাছ থেকেই সুযোগ সুবিধা মতো চেয়ে নেব। কিন্তু তারপরও তো অনেক কথা থেকে যায়, যায় তো, কোনোটা দৃশ্যমান, কোনোটা আড়াল আবডালে থাকতেই পছন্দ করে। আমার শিক্ষিদিক্ষা আমাকে কখনও তেমন করে শেখায় নি কোন নির্দিষ্ট পথেই গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যেতে হবে, অসংখ্য পথের মাঝেই টুকরো টুকরো উপায়গুলো ঘুমিয়ে আছে বলেই বোধ হয়। ওরা আমাকে ডাকে, ডেকে ডেকে কত কথা বলে, যা আমি শুনবো বলে কখনও ভাবিওনি। বিশ্বাস করা বা না করা সে দায় আমি কেন নেব, সে দায় নেবে বলে কেউ না কেউ তো প্রস্তুত হচ্ছে। মহাত্মা ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুনকে এডুকেশন কাউন্সিলে এক গভীর আলোচনায় মগ্ন দেখে বড় চিন্তিত হলাম। ভাবলাম এই মানুষটা তো এসেছেন গভর্ণর জেনারেলের ব্যবস্থা-সচিব হয়ে, কিন্তু তিনি স্ত্রী জাতির কল্যাণ কামনায় নিজেকে সমর্পণ করে বসবেন, কে আর জানত। বিদ্যাসাগর মহাশয় আর মদনমোহন তর্কালঙ্কার মহাশয় দুজনেই যেদিন বললেন ‘বুঝলেন জেমস্ লঙ সাহেব, মানুষের তৃতীয় নয়ন দিয়ে দেখলে স্বদেশ বিদেশের অন্তরটা যে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া যায়, বীটন্ সাহেব তার জলজ্যান্ত উদাহরণ না হলে পরের দেশের মেয়েদের পড়ালেখা নিয়ে পুরুষমানুষ হয়ে এত নিজেকে বিলিয়ে দেবেন কেন, নমস্য মানুষ, এমন মানুষ সহজে মিলবে না। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংলারের সম্মানিত পদ অধিকার করেও বাংলার বালিকাদের শিক্ষা নিয়ে এত ভাবেন, হেয়ার সাহেব ছাড়া এমন তো কাউকে দেখি নি।’ তর্কালঙ্কার মহাশয় তো আরও উচ্ছসিত ‘বিদ্যাসাগর বুঝলে না, তিনি কর্ণেল জন ড্রিঙ্কওয়াটার সাহেবের সন্তান যিনি জিব্রাল্টার দুর্গের অবরোধের ইতিবৃত্ত লেখে বিখ্যাত হয়েছিলেন।’ বাঙালি দুজন শিক্ষাবিদকে শাসক দেশের গুণীজনদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে দেখে আমি খানিকটা অবাকই হচ্ছিলাম। তবুও বলেই ফেললাম, সাদা চামড়ার লোক দেখে আপনাদের কারোই কোন সন্দেহ জাগছে না? বিদ্যাসাগর মহাশয় মৃদু হাসলেন। তর্কালঙ্কার মহাশয় এক কদম এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘জ্ঞানীর আবার স্বদেশ বিদেশ কী! সীমানাটা মুছে দিন, তাহলেই সাদা কালোর তফাৎটা ঘুচে যাবে,।’ বিদ্যাসাগর মহাশয় মুখ খুললেন, ‘মদনমোহন, যত তাড়াতাড়ি মুছবে তত মঙ্গল, ইংরেজদের জন্য যতটা, ভারতবাসীর জন্যও ঠিক ততটা, বাকিটা ভবিষ্যতের গর্ভে তোলা রইল।’
কথাটার অর্থ যে সুদূরপ্রসারী, আগামীর দিনগুলির প্রতি এক অর্থময় ইশারা। যে মাটিতে বিদ্যাসাগর, তর্কালঙ্কাররা জন্মায় তা যে সরস মাটি এই নিয়ে কি কোনো সন্দেহ থাকতে পারে? বীজ ছড়ালে যে ফসল ফলবেই মই দিয়ে বীজতলা তৈরি করে জল সারও দিতে হবে, সোনার বাংলায় সোনার ফসল ফলবে না, তা কখনও হয়! কোন পথ নির্বাচন করব, কেমন করে করব সেই বিদ্যাটা না জানলে গোড়াতেই সব মাটি হয়ে যাবে যে, তাই অতি সাবধানে পা ফেলতে হবে। সামনে অনেক ঘরেই যে আলো বাতাস খেলে না, নিজেরাই কী জানে! ইংরেজ বণিকদের ব্যবসার ফাঁদে কত বাবুলোক তো জড়িয়ে পড়ছে, সুযোগ বুঝে অন্যের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে ফায়দাও লুটছে, বাকিরা ব্যাঙাচি হয়ে কিলবিল করছে খানাখন্দে, কারোই যে সেই দিকে নজর যায় না, নিজেদের লালসায় নিজেরাই মজে। বৃত্ত ভেঙে যে বেরুতে হবে, এমন চিন্তার উদয় যে হয় নি, ঘুটঘুটে অন্ধকার তার ইঙ্গিত তো দিয়ে চলেছে অহরহ। আমার ইচ্ছা অনিচ্ছার গল্পগুলো শোনাতে গেলেই বড় বিপদ। ইংরেজ সাহেবদের বাঁকা চোখে মেকি ভালোবাসা যদি চিহ্নিত হয়ে যায়, আর কি সহজে মনের কোনে জায়গা দিতে পারে? তাই তো আমাকে কোন জায়গায় ফেলবে পাদ্রী সাহেবরা আগাম আঁচ করতে না পেরে হাত কচলায়। বেঙ্গল লেডীস্ সোসাইটি স্ত্রীশিক্ষার জন্য অনেক বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিল, রাজা বৈদ্যনাথ ও ভদ্রলোকেরাও কম উৎসাহ দেখান নি। বিটন সাহেব ছাড়া খ্রীষ্টীয় মহিলারা নারী শিক্ষার প্রসারে ধর্মকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিল। বঙ্গের রসিক কবি ঈশ্বর গুপ্তও মেয়েদের পড়ালেখা নিয়ে রসিকতা করতেও নাকি ছাড়েন নি। নাটুকে রামনারায়ণ কম যান নি “ … এ “আন” শিখাইয়াই রক্ষা নাই! চাল আন, ডাল আন, কাপড় আন করিয়া অস্থির করে, অন্য অক্ষরগুলো শেখালে কি আর রক্ষা আছে!” এই তো গেল সমাজের মাথাদের ব্যঙ্গ বিদ্রুপের হাল হকিকত। ইংরেজদের অত্যাচারের খড়গও কম নামে নি। মফস্বলবাসী ইংরেজগণকে ফৌজদারি আদালতের অধীন করা না হওয়ায় প্রজারা স্বস্তিতে ছিল না। গ্ৰামবাংলাতেও ক্রমে ক্রমে আগুনের ফুলকি বের হলো, কেউ কেউ দেখল, আবার কেউ দেখেও না দেখার ভান করল। শহর গ্ৰামের পথের দূরত্ব কমানোর জন্য রাজপুরুষগণের তেমন নজর নাই কত দিন, মনের দূরত্বও তাই সমানতালে ততোদিনে কয়েকগুণ বেড়েছে।
কলিকাতা শহরের গায়ে কত যে রঙ লাগছে, কত যে বাহার, তাকে ছুঁতে গেলে কখন যে নানা রঙের মিশেল ঘটে যায় তা আন্দাজ করা কঠিন। আমার চোখে ধাঁধা লেগেছে, হবে হয়ত বা। কখনও মনে হচ্ছে মুহূর্তে অচেনা হয়ে যাবে, আবার হাজির হচ্ছে শূন্যস্থান ভরাট করে। মানুষের আকর্ষণ বিকর্ষণ উজাড় করে দেয় সকল শূন্যতা। ভরাট করার মন্ত্র কেউ কেউ তো জানে, তবে কিনা যার যার নিজের মতো করে জানে। গোটা শহরের অন্দরে কে আর ঝাঁকিয়ে দেখে। মনে তো হয় দেখে নিতে কোথায় আছে নাড়ির টান। ওরা হাঁসে ওরা কাঁদে, নিজের মতো করে পোঁটলাপুটলি বাঁধে, কোথায় ঘর বাঁধবে কেউ জানে না, আবার কেউ কেউ জানে। টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনাম নিলেও তাঁর প্যারীচাঁদ মিত্র নামটা জ্বলজ্বল করে না, এই কথা কে আর বলবে। কলিকাতা পাবলিক লাইব্রেরীতে পা রাখতেই চেয়ার ছেড়ে লাইব্রেরিয়ান মহাশয় আমার হাত দুটো ধরে টেনে নিয়ে গেলেন। মেটকাফ হল, স্যার চার্লস মেটক্যাফের স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই সেই মানুষ যিনি জ্ঞানান্বেষণ সভার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছেন। ‘বুঝলেন লঙ্ সাহেব, পরাধীনতার অভিশাপ কুড়িয়ে আমরা বেঁচে আছি। এই যন্ত্রণা আপনাকে বুঝাই কেমন করে।’ আমি ওঁর কথার বাঁধুনি লক্ষ্য করলাম মগ্ন হয়ে। ‘দেখছেন কী? সামনে এখন অনেক কাজ, দেখলে হবে না, করে দেখাতে হবে। সমাজের খোলনলচে পাল্টে দিতে হবে। যার যতটুকু দেবার আছে, সবটুকু নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, না হলে এই জাতি কোনদিনও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।’ আপনি কি মনে করেন এই কাজ এত সহজে সম্ভব! তিনি ক্ষণেক চুপ করে গেলেন। জানালার পাশ দিয়ে দেখা যায় কলিকাতা শহরটাকে তখন অন্ধকার এসে ঘিরে ধরেছে। গ্যাস বাতিগুলো জ্বলছে এধার ওধার। কে একজন এসে কোণে কোণে চারকোনা আকারের কাঁচের লন্ঠন রেখে গেল। ‘গর্ভনর জেনারেল লর্ড মেটক্যাফ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ লাইব্রেরির বই দান করেছেন বলেই না এই গ্ৰন্থাগার গড়া সম্ভব হয়েছে।’ এই মানুষটিই বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটির অন্যতম উদ্যোক্তা, আরও কত কী যে ওর ভবিষ্যৎ কর্মসূচিতে লেখা আছে কে জানে। ব্রিটিশ শাসনকর্তারা এই বাঙালি পন্ডিত ও সমাজ হিতৈষীদের জন্যই শত চেষ্টাতেও ভারতীয়দের আর বেশিদিন করতলগত করে রাখতে পারবে না। আমি জানি না আমার দেশ কবে জাগবে। দুঃখের বিষয় বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত টেঁকচাঁদ ঠাকুরদের কাজ নিয়েও তো ইংরেজি শিক্ষিত লোকজনদের মধ্যে কম হাসাহাসি হয় না। ‘ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘সংবাদপ্রভাকর’ উপহাস বিদ্রুপের দৌড়ে কম যায় কীসে!
দ্য কোর্স বরাবর জুড়িগাড়ি ছুটিয়ে কোন ইংরেজ সাহেব ও মেম গোধূলির শেষ বেলায় গঙ্গার দৃশ্যে তন মন জুড়াবে বলে বেরিয়েছে। একসময় রামমোহন রায়ের বন্ধু উইলিয়াম আডাম এই পথে বৈকালিক ভ্রমণে বেরোতেন। সাহেব আমার আসার আগেই ভারত ছেড়েছেন কিন্তু এই দেশের মানুষদের সুখ দুঃখ ও সংস্কৃতিকে ইংল্যান্ডের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরার জন্য ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি নামে সভা স্থাপন করে বক্তৃতার ব্যবস্থা করেছিলেন। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এডভোকেট নাম দিয়ে একটা পত্রিকাও প্রকাশ করেন। মানুষের কল্যাণ কামনায় প্রাচ্য প্রতীচ্যের ব্যবধানেই ঘুচিয়ে দেওয়া সম্ভব এমন উপলব্ধি আমার চিন্তাকে নানা সূত্রে গেঁথে দেয়। আজ গঙ্গার দুপাড়ে দৃষ্টি দিতে গিয়ে কত কল্পনাই ভেসে ভেসে আসে। আহা! গোটা পৃথিবীটাই যদি একটাই দেশ হতো, ভালো কি মন্দ হতো জানি না, এত যে বিভেদের দেয়াল তৈরি হচ্ছে দেশে দেশে তা ভেঙে চুরমার হয়ে যেত। তা কীভাবে সম্ভব আমি জানি না, তবে অন্যের দেশ কব্জা করার আকাঙ্খা সমূলে বিনাশ হতো। এই দেশ নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকত নিজেদের সংস্কৃতি ও ভাবধারার অন্তঃস্বরকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়ে। লর্ড উইলিয়াম বেন্টিক টমাস ব্যারিংটন মেকলে সাহেবকে দক্ষিণ হস্ত হিসেবে পেয়ে গদগদ হয়েছিলেন বটে কিন্তু ওনার এদেশীয় সংস্কৃতিকে ছোট করে দেখানোর মনোবৃত্তি আজও আমাকে বিচলিত করে। এদেশীয় পন্ডিত ব্যক্তিদের ইংরেজি প্রীতি অশ্রদ্ধার নয় কিন্তু নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষার প্রতি অনাস্থা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে কোনো সুখকর বিষয় নয়। ডেবিড হেয়ার, ডিরোজিওর শিষ্য রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রামগোপাল ঘোষ, প্যারীচাঁদ মিত্র, রামতনু লাহিড়ীর মতো হিন্দু কলেজের নব্য যুবকরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় মেকলে সাহেবকে এই মর্মে সমর্থন জানিয়েছিলেন বটে – ‘এক সেল্ফ ইংরাজী গ্ৰন্থে যে জ্ঞানের কথা আছে, সমগ্ৰ ভারতবর্ষ বা আরবদেশের সাহিত্যে তা নেই। সেক্সপিয়ারকে গ্ৰহণ করাতে আপত্তি নেই তাই বলে কালিদাসকে অস্বীকার করে কেমন করে! মহাভারত রামায়ণাদির জায়গা হবে না, Edgeworth’s Tales তার অভাব পূরণ করবে, আমি এই ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করি, আমি বিশ্বাস করি এই প্রকার চিন্তা জাতীয় সভ্যতা অপমানের সামিল। তবে ভালো হলো এই প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে আমার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিরূপণ করা আমার পক্ষে সহজ হয়ে যাবে। আজ কেন জানি না ইচ্ছে হলো ভারতবর্ষের মা গঙ্গাকে নতমস্তকে প্রণাম করি। প্রতিভাস ম্যাগাজিন
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)