শিশির আজম

Rome, Open City (1945)

কোন কোন কবিতা বারবার পড়া যায়, কোন কোন সিনেমা বারবার দেখা যায়। সংগীত, নৃত্য, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, স্থাপত্যকলা অর্থাৎ সবগুলো শিল্পমাধ্যমের ক্ষেত্রেই হয় তো এরকমটা হয়ে থাকে। রেনেসাঁপর্বে মাইকেলাঞ্জেলোর হাতে যে সুবিশাল পাথরটা ডেভিডের প্রাণ ধারণ করে ভাস্কর্যরূপে আমাদের সামনে দাঁড়িয়েছিল সে কি মারা গেছে? না। আজও সে সমান জীবন্ত। অজন্তা-ইলোরা-খাজুরাহের মন্দিরগাত্রের নগ্ন নারী-পুরুষের সুষম শারীরিক গঠন আর তাদের বিচিত্র ভঙ্গী আজও আমাদের সমানভাবে বিস্মিত করে। সেই সময়, সেই সময়ের আগুন আমাদেরকে নতুনভাবে স্পর্শ করে। Rome, Open City (১৯৪৫) দেখার পর এরকম অনুভূতিতে আক্রান্ত হওয়া স্বাভাবিক। ক্রিটিকরা এটাকে War-drama film হিসেবে বিবেচনা করেন। কি আশ্চর্য, কতোবার দেখেছি এই সিনেমা, এখানে আমি war পাইনি। drama তো পাইইনি। আর ডকুমেন্টারির সব আলামতই এর ভিতর বিরাজমান। হ্যা, সেনা আছে, অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প আছে, নির্যাতন শিবির আছে, নির্জন রাস্তায় টহল জিপ আছে, বাড়ি বাড়ি ঢুকে সন্দেহভাজন লোকজনকে তুলে নিয়ে যাওয়া বা ফাঁকা রাস্তায় ঠান্ডা মাথায় গুলি করে মারা, সবই আছে। কিন্তু এই ফিল্মকে হলিউডের মারমার কাটকাট সিনেমার সঙ্গে একদমই মেলানো যাবে না। এখানে প্রযুক্তি আর অস্ত্রের ঝনঝনানি নেই। ল্যাতিন আমেরিকা বা বলিউডের সিনেমার সঙ্গেও মিল নেই। আরেকটা ব্যাপার, এর ক্লোজ শটগুলো যেন ফ্রিদা কালোর আতংকিত ব্যথাদীর্ণ তুলিতে আঁকা একেকটা প্রতিকৃতি। মিড শটগুলো ফ্যাসিবাদের ভয়ংকর থাবার নিচে সাধারণ জনগণের প্রতি মুহূর্তে বেঁচে থাকবার আপ্রাণ চেষ্টা। আবার লং শটগুলোতে দেখা যায় তথাকথিত ওপেন সিটি রোম কীরকম থমকে আছে, থমথমে নিঃশব্দ রাস্তা, পথচলতি মানুষের আতংকিত চোখ, ফিসফাস। 

মার্কিনি সিনেমার সঙ্গে বরাবরই ইউরোপীয় সিনেমা একটা দূরত্ব রেখে চলেছে। মুনাফা অর্জনকে মাথায় রেখেও শুরুতে মার্কিনি সিনেমায় শিল্প (art)কে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তারপর মার্কিনি সিনেমা হলিউডের খপ্পরে পড়ে যাওয়ার পর শিল্প (art) শিল্প (industry)-র কাছে পরাভূত হলো। আর ইন্ডাস্ট্রি মানেই পুঁজির হাঙরের হা। এই হাঙর শিল্প-ভাষা-রুচি-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য কোন কিছু গিলতেই দ্বিধা করে না। তার দরকার মুনাফা। এই চক্র থেকে ইউরোপ বরাবর নিজেকে অনেকটা রক্ষা করে আসতে পেরেছে, এখন অব্দি, অনেকটা। সিনেমায় নিওরিয়ালিজমের সূত্রপাত যে মাস্টার ফিল্মমেকারদের হাত ধরে তার ভিতর রবার্তো রোসেলিনি একজন। অন্যদের ভিতর রয়েছেন সত্যজিৎ রায়, আকিরা কুরোসাওয়া, ভিত্তরিও ডি সিকা, পিয়্যের পাওলো পাসোলিনিসহ আরও কেউ কেউ। তবে এই ফিল্মমেকারদের ভাবনা-অভিজ্ঞতা-পরিপ্রেক্ষিতে ভিন্নতা তো ছিল। তাদের কাজের ধরণও আলাদা। যা হোক ‘রোম, ওপেন সিটি’র মানবিক দিকটাই দর্শককে টাচ্ করবে বেশি, যদিও এর রাজনৈতিক দিকটাকে উপেক্ষা করবার জো নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির কাছে ইতালির হারের ক্ষত তো ছিলই। সেটা ছিল প্রথম পরাজয়। দ্বিতীয়বার আবার পরাজিত হতে হয় ফ্যাসিবাদের দোসর জার্মানির কাছে। এই ইতিহাস অনেকেই সামনে আনতে চান না। কিন্তু রোসেলিনি ভোলেননি, আমাদেরকে ভুলতে দেননি। এই ক্ষত উনি ক্যামেরায় ধরে রেখেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীতে ইতালি যে পরাজয়ের গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছিল, তার ওপর মড়ার পর খাড়ার ঘা জার্মানির অবরোধ–এই প্রেক্ষাপটে রোসেলিনির ফিল্মত্রয়ীর প্রথমটি হলো ‘রোম, ওপেন সিটি’। দ্বিতীয়টি ‘পাইসা’ (১৯৪৬), তৃতীয়টি ‘জার্মানি, ইয়ার জিরো’ (১৯৪৮)। উল্লেখ্য, ১৯৪৩ সালের ১৪ আগস্ট রোমকে ‘উম্মুক্ত শহর’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সাধারণ মানুষের সঙ্গে  যুদ্ধবাজ শাসকদের কি ভয়ানক প্রতারণা! সেই তেতাল্লিশ সালেই রোসেলিনি এই সিনেমার কাজ শুরু করেন। নামকরণ করেণ ‘রোম, ওপেন সিটি। ফ্যাসিবাদ নামক ভয়ানক দানবের বিরুদ্ধে উনি ক্যামেরাকে দাঁড় করিয়েছেন। সত্যিকার ফিল্মমেকারের ক্যামেরা এরকমই হয়। এই সিনেমায় স্ক্রিপ্টে উনাকে সহযোগিতা করেছেন বিশ্বসিনেমার আরেক দিকপাল ফেদেরিকো ফেলিনি। যদিও ফেলিনির কাজের প্রভাব এই সিনেমায় তেমন নেই। ‘রোম, ওপেন সিটি’র ভেতরকার যে স্পিরিট তা ঋত্বিক ঘটককে হয় তো মনে করিয়ে দেবে, বা সত্যজিৎ বা মৃণাল সেনকে। রোসেলিনি প্রচলিত অর্থে ধার্মীক ছিলেন না কিন্তু খ্রিস্টীয় আধ্যাত্মবাদে এক ধরণের শ্রদ্ধা ছিল তার। সেই সঙ্গে বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীর সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর ভিতরকার নগ্ন খেয়োখেয়ি আর সাধারণ মানুষের অসহনীয় ভোগান্তি তাকে তাকে বিমুঢ় করে তুলেছিল। বলা যায় তারকোভস্কির মনোজগতের সঙ্গে এর সামঞ্জস্য রয়েছে। রাষ্ট্র এবং সহকর্মী বন্ধুদের সঙ্গে বিরোধও এই জায়গায়। এটা যেন নিয়তি। ঋত্বিককে এই নিয়তি ভোগ করতে হয়েছিল। সেসময় ইতালি আর জার্মানি দুটো দেশের ঘাড়েই চেপে বসে ছিল ফ্যাসিবাদ। এরা পুরো পৃথিবীটাকেই অপমান করছিল, বিপর্যস্ত করে তুলছিল। শেষে এক রাক্ষস আরেক রাক্ষসের ঘাড় কামড়ে ধরে। এ এক মারাত্মক পরিণতি!  আমরা জানি, ইতালিয়ানরা কম পয়সায় সিনেমা করতে ওস্তাদ। আর সহজভাবে যেটা সাধারণ মানুষের চোখে সহনীয় তেমনভাবে ক্যামেরা ধরতে ওরা পছন্দ করে। ফরাসি আর জার্মানরা এক্ষেত্রে একটু খাপছাড়া। ওরা ঋদ্ধ দর্শককে আগ্রহী করতে, নাড়া দিতে বা খ্যাপাতে পছন্দ করে। গঁদার বা ক্রুফোর কথা তো বলাই যায়। ফরাসিদের ভেতর জঁ রেনোয়াকে রোসেলিনির অনেকটা কাছের মনে হবে। কেন? অনেক প্রস্ন আর হতাশার পরও এদের ক্যামেরা জ্বলে ওঠে মানবিকতার আলোয়। একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে ‘রোম, ওপেন সিটি’র আঁচ এভাবেই আমি পেয়েছি আমার অনুভূতিতে। প্রতিভাস ম্যাগাজিন

আন্দ্রেই রুবলভ (১৯৬৬)

‘আন্দ্রেই রুবলভ’ দেখতে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে আমি কবিতা পড়ছি। তারকোভস্কির সিনেমা তো আসলে কবিতাই। ‘ইভান’স চাইল্ডহুড’-এর পর ‘আন্দ্রেই রুবলভ’ তারকোভস্কির দ্বিতীয় ফিচার ফিল্ম। ‘ইভান’স চাইল্ডহুড’ মুক্তি পায় ১৯৬২ সালে আর ‘আন্দ্রেই রুবলভ ১৯৬৬ সালে। প্রথম মুভিতেই কবিতা ছিল। আর দ্বিতীয় মুভি সুবিশাল সময় পরিসরের ‘আন্দ্রেই রুবলভ’ তো ১০ লাইনের ছোট্ট একটা কবিতা যার অনুরণন দর্শকের চেতনায় সর্বগ্রাসী। তারকোভস্কিকে বলা হয় ‘সিনেমার কবি’। আবার কেউ কেউ বলেন ‘সিনেমার বুদ্ধ’। হ্যা, আমরা জানি, তারকোভস্কির পিতা ইউক্রেন বংশোদ্ভূত আর্সেনি তারকোভস্কি ছিলেন রাশিয়ার একজন জনপ্রিয় কবি। এই কবি পিতার প্রভাব তারকোভস্কিকে জীবনভর আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। এই পারস্পর্য থেকেই হয়তো রাশিয়ায় ১৫ শতকের আইকন পেইন্টার ও কবি আন্দ্রেই রুবলেভকে নিয়ে তারকোভস্কি নির্মাণ করেন ‘আন্দ্রেই রুবলভ’। তারকোভস্কির সেই আইকনিক দীর্ঘ দীর্ঘ শটের সমষ্টি এই সিনেমা যা চিত্রশিল্পী রুবলভের দুর্বিনীত সময়ের দাসত্বের মধ্যে লড়াই আর আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলা যায়। রুবলভের ছিল শিশুর নিষ্কলুষ দৃষ্টি অথচ তার সামনে ঘটে চলছিল একের পর এক পাশবিক হিংস্রতা ও নারকীয় ভয়াবহতা। রুবলভ চেয়েছিলেন শুভচেতনা দিয়ে মানবিক পৃথিবী গড়তে। এর জন্য পঙ্কিল ও ব্যধিগ্রস্ত পৃথিবীকে পরিবর্তন করা দরকার। একাজে মানুষের ভিতর সহমর্মীতার উন্মেষ দরকার। এই আকুতিই রুবলভকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। তাড়িত হয়েছেন তারকোভস্কি। এই সিনেমায় প্রথমেই আমরা গরম বায়ুচালিত একটি বেলুন ওড়ানোর কশরত দেখি। ইয়েফিম নামে একজন বেলুনের নিচের দড়িকে বর্ম হিসেবে ব্যাহার করে উড়তে চেয়েছিল। কিন্ত তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় কিছু অজ্ঞ মানুষের নিষ্ঠুরতায়। এখানে আমরা দেখি একটি বিষন্ন ঘোড়ার গড়াগড়ি। ঘোড়া প্রতীক তারকোভস্কির সিনেমায় আমরা বারবার দেখি। কিন্তু তা বাকুড়ার ঘোড়া বা ফিদা হুসেনের ঘোড়া থেকে অবশ্যই পৃথক। যদিও ট্র্যাডিশনের দিক থেকে রুশ আর ভারতের ঘোড়ায় মিল আছে। জয়নুলের চিত্রে যেমন কাক, দালির চিত্রে ঘড়ি বা পিঁপড়ে, তেমনি তারকোভস্কির ক্যামেরায় ঘোড়া। ঘোড়া মারাত্মক সব ইমেজ নিয়ে ওর সিনেমায় হাজির থাকে। বলে রাখা ভাল, ‘আন্দ্রেই রুবলভ’র অনেকগুলো ভার্সন বাজারে আছে। এটা হয়েছে রাষ্ট্র কর্তৃক শিল্পীর স্বাধিনতায় পরিপূর্ণ শ্রদ্ধাবোধ না থাকার কারণে। একটানা সতেরো বছর তারকোকস্কিকে সিনেমার বাইরেও থাকতে হয়েছে। সশরীরে উনি ইউরোপকে কাজের ক্ষেত্র করেছেন জীবনের শেষ দিকে। যদিও ওর ডায়েরিতে আমরা উল্লেখ পাই, ওটা ছিল রাজনৈতিক উৎপাত থেকে মুক্তি পেতে উত্তপ্ত কড়াইতে ঝাঁপিয়ে পড়বার মতো অবস্থা অনেকটা। আমরা জানি তারকোভস্কি একাধারে ফিল্মমেকার, লেখক, ফিল্ম এডিটর ও ফিল্ম থিওরিস্ট। অনেক সিনেমাবোদ্ধার মতে আইজেনস্টাইনের পর তারকোভস্কিই রাশিয়ার সবচে বিখ্যাত ফিল্মমেকার। যা হোক, তারকোভস্কির অন্যান্য সিনেমার মতো এই সিনেমায়ও যে এতো এতো লং শট  আর মন্থর গতির স্বতস্ফূর্ত সিনেমাটোগ্রাফির ব্যবহার তা কি কেবলই কবি পিতা আর ধ্রুপদী চিত্রশিল্পী আন্দ্রেই রুবলভের আধ্যাত্মকতা থেকে প্রাপ্ত? আর লং শটের তাৎপর্যপূর্ণ ব্যবহার? আর অপ্রচলিত প্লট কাঠামোয় ক্যামেরার মন্থর চলন? এটার কারণ সম্ভবত সময়ের অনুভূতিতে দর্শকের মনোনিবেশ নিবদ্ধ করা। সাধারণত আমরা দেখি, পরবর্তীতে কী ঘটবে এই উত্তেজনায় দর্শক আবদ্ধ থাকে। তারকোভস্কির অভীষ্ট লক্ষ্য আলাদা। উনি চান বর্তমান সময়ের অনুভূতিতে স্ফূরিত হয়ে দর্শক কালের অচলায়তন ভাংতে অনুপ্রাণিত হবেন। দর্শক ঐ সময়ের ল্যান্ডস্কেপ বা পোর্ট্রেটের কালহীন অনুভূতিতে জারিত হবেন। এমন কি শূন্য ফ্রেমও হয়ে উঠবে অপ্রচলিত ও নিজস্বতায় তাৎপর্যপূণ। আমরা জানি, তারকোভস্কি অল্প সময়ের জন্য মিউজিক স্কুলে পড়েছেন,  ড্রইংয়ে হাত পাকিয়েছেন, গোপনে কবিতাও লিখেছেন। কবিতার প্রতি এই আগ্রহই তারকোভস্কিকে দিয়ে ক্যামেরার মাধ্যমে লিখিয়ে নিয়েছে ‘ইভান’স চাইল্ডহুড’, ‘আন্দ্রেই রুবলভ’, ‘মিরর’, বা ‘স্টকার’র মতো একটার পর একটা কবিতা। অবশ্য ওর ফিল্মের সংখ্যা হাতেগোনা। ৭ টি ফিচার ফিল্ম, ১ টি প্রামাণ্যচিত্র। সবগুলোই কবিতা। হ্যা, ছোট্ট একটা কবিতা এইমাত্র আমি পড়ে শেষ করলাম, ২২৫ মিনিট সময়পর্বের। কবিতার নাম ‘আন্দ্রেই রুবলভ’। প্রতিভাস ম্যাগাজিন

The Seventh Seal (1957)

বায়োলোজিক্যাল স্ট্র্যাকচার ছাড়াও মানুষ এমন এক সত্তা যার খোঁজে কবি, লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী সবাই হন্যে হয়েছেন। গ্রিক দার্শনিক বলছেন, Know Thyself আর কিয়ারোস্তামির এক চরিত্র (Test of Cherry) নিজের মৃত্যুর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে স্বস্তিমতো একটা জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছেন তেহরানের রাস্তায় রাস্তায়। বরাবর আমরা দেখেছি, কবি-শিল্পীরা মৃত্যুকে হয় মহিমান্বিত করছেন অথরা তাকে উপস্থাপন করছেন বিভৎসরূপে। কিন্তু মৃত্যু তো মৃত্যুই আর মানুষ শেষ অব্দি মানুষ। যা হোক ইঙ্গমার বার্গম্যানের The Seventh Seal মৃত্যু বিষয়ক কোন প্রতিবেদন আমাদের দেয় না। সাহসী মানুষেরা জীবনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়। গল্প-উপন্যাসেও এমনটা আমরা দেখি। মার্কসীয় সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা তো এটাকে সমর্থন করেই, নারীবাদেও ওটাকে বড় পরিসরে আমরা দেখতে পাই। বার্গম্যানের এই চরিত্র কিন্তু জীবনকে না, মৃত্যুকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। এটা আমাদের ভাবনার বৈচিত্রময় পরিসরে পূর্বে কখনও জায়গা পায়নি। জীবদ্দশায় বার্গম্যান নির্মাণ করেছেন ৪৯ টি চলচিত্র যার মধ্যে ৪৫ টি ফিচার ফিল্ম আর ৪ টি ডকুমেন্টারি। এই বিপুল সৃষ্টির ফ্রেমিং ও লেন্সিংয়ে নিজেকে কখনও তিনি অস্বস্তিতে পড়তে দেননি। তার দার্শনিক সত্তাকে নিজের মতো তিনি চলতে দিয়েছেন, গভীর জটিল সত্যের সঙ্গে অসততা করেননি। বলে নেওয়া ভাল, বাবা ধর্মজাজক হওয়ায় ছোটবেরা থেকেই ধর্মীয় আবহে বড় হয়েছেন বার্গম্যান। তাই ধর্ম ও ঈশ্বরের প্রভাব তার চলচিত্রে লক্ষ্ণণীয়ভাবে অনুভব করা যায়। বার্গম্যান অবশ্য সামগ্রিকভাবে তার কাজকে আত্মজৈবনিক বলেই মনে করেছেন। অর্থাৎ নিজেকে দেখা আর নিজের ইতি-নেতির ব্যাপারে নিজে বিচারকের আসন নেওয়া, এটা পরবর্তীতে ভর করেছিল তারকোভস্কি, কুরোসাওয়া বা কিয়ারোস্তামির কাজেও। বার্গম্যানের এই প্রভাবকে এরা অকুন্ঠচিত্তে স্বীকারও করেছেন। এদের এই খ্রীস্টীয় নৈতিকতা অবশ্য ঋত্বিক ঘটকের কাছে আদৌ ভাল লাগেনি। কেন ভাল লাগেনি সেই আলোচনায় গেলে যে আদর্শিক ও দার্শনিক পরিসরে সিনেমার এই মহাপরিচালকদের বিচরণ সেখানে অনেক দ্বন্দ্বসংঘাতে আমাদের জড়িয়ে পড়তে হবে। আমরা সেদিকে যাব না। তাহলে কি আমরা The Seventh Seal দেখার সময় খ্রিস্টিয়ো নৈতিকতায় নিজেদেরকে জারিত করে নেবো? না, এর দরকার হবে না। ভাটিক্যানের সিসটিন চ্যাপেলের নিচে দাঁড়িয়ে খ্রিস্টিয়ো নৈতিকতায় আমাদেরকে দীক্ষা নিতে হয় না। মাইকেলাঞ্জেলোর ‘ডেভিড’ বা লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ‘দ্য লাস্ট সাপার’-এর সামনে কোন শিল্পগ্রাহী নিজেকে ঈশ্বরের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সেবক মনে করেন না। শিল্পই বরং ঈশ্বরকে সৃষ্টি করে। সে ঈশ্বর অবশ্য মানুষের ভিতরই বাস করে। আসলে বার্গম্যান কি জীবন বা মৃত্যুকেন্দ্রিক কোন দার্শনিক পরিক্রমায় নেমেছেন? না। মৃত্যদূত যখন সমুদ্রতীরে লোকটার সামনে এসে দাঁড়ায় লোকটার ভিতর দ্বিধা বা ভীতি আমরা দেখতে পাইনি। বরং সে যেন মৃত্যুদূতকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিতে চায়। সে চায় মৃত্যুর আগে মৃত্যুদূত তার সঙ্গে দাবা খেলায় বসুক। সে জানে মৃত্যুদূত দাবাখেলা পছন্দ করে। তার সামর্থ্য থাকলে সে তাকে হারিয়ে দিক। এরপর সিনেমাটা যেভাবে এগোয় তাতে মানবসত্তার যে অজ্ঞেয় ল্যান্ডস্কেপ সেখানে আমরা প্রবেশ করি। আমাদের প্রচলিত যে জীবনবাস্তবতা  সেটা থেকে আমরা নিজেদেরকে আলাদাভাবে উপলব্ধি করি। এটাকে বলা যেতে পারে নিজের দিকে ফিরে তাকানো। নিজেকে দেখা। নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া। এখন আপনারা বলতে পারেন এই কাজটা কে করেননি? এই খোঁজা বা বোঝাপড়া শ্রীচৈতন্য তার ভক্তিবাদে চারিয়ে দিয়েছেন। যদিও তা একসময যুক্তিহীনতার অকৃতিতে পানসে হয়ে গেছে তা। ভারতবর্ষে চার্বাকরা এই বোঝাপড়ার ক্ষেত্রটাকে অনেক বড় করতে পেরেছেন, স্থবির সমাজবাস্তবতায় ঢেউ তুলেছেন, আঘাত করেছেন। রেনেসাঁশিল্পীরা যে দেবতাদের দিক থেকে মানুষের দিকে ফিরতে পারলেন এটাও তো নিজের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারার কারণেই। রদাঁ যে ‘নরকের দরজা’ (১৮৮০-১৯১৭) আমাদের সামনে উম্মোচন করলেন সেখানে কি কেবলই অপরাধীদেরকে আমরা পাই? না, জগতের সব মানুষকেই আমরা দেখি। এমন কি সেখানে আমিও আছি। পূর্বে এমনটা দেখা যায়নি। সেভেন্থ সিলে বার্গম্যান এভাবে জীবন যাপনের বিভিন্ন প্রক্ষিতে নিজেকে দেখতে চেয়েছেন। প্রতি মুহূর্তে নিজের সঙ্গে চলেছে তার বোঝাপড়া। এই বোঝাপড়া যে সব সময় ব্যাক্তির জন্য সুখকর-স্বস্তিকর-আরামদায়ক হবে এমনটাও তো না! ফ্রিদা কালো যেভাবে The Two Fridas আত্মপ্রতিকৃতিতে নিজের মুখোমুখি হয়েছেন, ব্যাপারটা তো একই। গ্রেকোরোমান ভাস্কর্যে ও স্থাপত্যকর্মে  মহত্ম আছে, জিজ্ঞাসা নেই। শিল্পীরা যে এতো এতো প্রতিকৃতি এঁকেছেন, এগুলো কেন? আর জিয়াকোমেত্তির কঙ্কালসার ফিগার? এসব হলো নিজের সঙ্গে কথা বলতে পারা, আপন সত্তার মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস বা আকাঙ্ক্ষা। শিল্পীরা বরাবরই এটা করে এসেছেন। এঁকেছেন আত্মপ্রতিকৃতি। এমন কি এদের স্টিল লাইফগুলোতেও আপন আপন সত্তার অনুরণন-সংশ্লেষণ-বীজারণ। তারপর ধরো হোকুসাই (১৭৬০-১৮৪৯) যে মাউন্ট ফুজিকে ছত্রিশটি কোণ (Thirty Six Views of Mount Fuji / 1830-1832) থেকে দেখেছেন, সেটা কী? এই দেখার ভিতর কি জাপানি মনন নেই? নেই দ্রোহ, বিষাদ, হতাশা, পরাজয়? The Seventh Seal সিনেমায় এই আত্মজিজ্ঞাসা শুরু থেকে শেষ অব্দি জারি রয়েছে। আসলে এখানে বার্গম্যান জীবন বা মৃত্যুকে নিয়ে কাহিনী রচনা করেননি। একই মানুষের দুটি সত্তা। এদেরকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া মানে মারাত্মক পরিস্থিতির সম্মুখিন হওয়া। হ্যা, বার্গম্যানের সবগুলো সিনেমাতেই পাওয়া যায় এক ধরণের সুইডিশ নির্জনতা ও সান্ত্রিতিকতা। এর কেন্দ্রে আছে মানুষ। মানুষের ভিতরকার দ্বন্দ্ব-আহ্বান বরাবর ছুঁতে চেয়েছেন বার্গম্যান। আর এটা সেই কোথায়? Wild Strawberries (1957), The Virgin Spring (1960), Through a Glass Darkly (1961), Winter Light (1963), The Silence (1963), Persona (1966) সহ সবগুলো সিনেমায়ই আমরা দেখি বার্গম্যানের চরিত্ররা ওদের নিজস্ব দ্বন্দ্ব নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতে উপস্থিত হয়। বার্গম্যানের ক্যামেরা আমাদেরকে দেখায় মানবিক অনুভূতির দ্বন্দ্ব-বিকাশ-বিচ্যূরণ। আর উনি যেহেতু মূলত নাটকের মানুষ (নিজের ব্যাপারে ওনার মূল্যায়ন এমনই। উনি বলতেন যে সিনেমা ওনার স্ত্রী আর নাটক ওনার প্রেমিকা।) তাই  ব্যাক্তির ভেতরকার দ্বন্দ্ব-সংঘাতের প্রতি উনার মনযোগী হওয়াটা বেশ স্বাভাবিক। দাবা খেলাটা কেবল উছলত। বলা যায়, মৃত্যুদূতের সামনে বার্গম্যান স্বাভাবিক একজন মানুষকেই উপস্থাপন করেছেন। মানুষের বেঁচে থাকা, সংগ্রাম, প্রেম, স্নেহমমতা, অপরাধপ্রবণতা সবকিছুই একজন মৃত্যুদূতের সামনে উঠে আসে। সবকিছুর সঙ্গেই সে নিজেকে মিলিয়ে দেখতে পারে। হ্যা, মৃত্যুদূত আর মৃত্যুপথযাত্রী লোক কি আলাদা না একই ব্যাক্তি,  দর্শকের মনে এই প্রশ্নও তো আসতে পারে এক সময়। এই খেলাটাই বার্গম্যান খেলেছেন তার দর্শকের সঙ্গে। এটাই তার নিজস্ব খেলা, নিজের সঙ্গে, একই সঙ্গে দর্শককে নিয়েও। তার খেলার ভিতর ফেলিনির নাটকীয়তা নেই, মৃণাল সেনের মার্কসীয় দ্বন্দ্ব নেই। তারকোভস্কির কাব্যময়তার স্ফূরণ কিছুটা আছে অবশ্যই, এটা না মেনে উপায় নেই। আর আছে সাদা-কালোয় ফরাসি ইম্প্রেশনিস্টদের মতো বস্তুকে দেখার, অনুভব করবার আলাদা চোখ। এটা আমরা ‘ওয়াইল্ড স্ট্রবেরি’তে দেখি, ‘পারছোনা’তেও দেখি। তবে এভাবে দেখতে গিয়ে বস্তুর সামগ্রিক সার্বভৌম অস্তিত্বকে বার্গম্যান কখনো অস্বীকার করেননি। বরং পিকাসো, ব্র্যাক বা আইনস্টাইনের সঙ্গে বার্গম্যান নিজেকে একাত্ম করতে পেরেছেন, বস্তুকে বিভিন্ন দিক থেকে দেখতে পারার আলাদা চোখ নিয়েও। বার্গম্যানের সঙ্গে নরকের একটার পর একটা দরজা আমরা পার হই, সেজানের রেখা ও রঙের ঋজুতায়। কোথাও তুলি টলে যাবার আশঙ্কা নেই। শেষ অব্দি বার্গম্যান তার ‘দ্য সেভেন্থ সিল’-য়ে এই রিদম ও ঋজুতা ধরে রাখতে কোন খামতি রাখেননি, সিনেমা প্রেমিদের জন্য এটা বাড়তি পাওয়া। বলার অপেক্ষা রাখে না, বার্গম্যানের কাছে এই প্রত্যাশা খুব স্বাভাবিক। প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine

An Andalusian Dog

আর্টের বিভিন্ন মিডিয়ামের ভিতর মিথষ্ক্রিয়া, সংশ্লেষণ, বিচ্যূরণ বা স্ফূরণ বরাবর ঘটে এসেছে। কিন্তু সেটা ফরাসি দেশে যতটা ঘটেছে, যে বিষম মাত্রায় ঘটেছে এমনটা ভূ বিশ্বের অন্যত্র দেখা যায়নি। কথাটা কেন বলছি? কারণ এখন আমরা কথা বলবো সিনেমা নিয়ে। আর সিনেমাটা এমন সময়কার যখন সিনেমা কথা বলতে শেখেনি, রং আসেনি সিনেমায়। তারপরও এই সিনেমা আজও আমাদের অনুভূতিকে সমানভাবে নাড়া দেয়। আমাদের বিস্মিত করে। অল্প কয়েকটি শটে এই সিনেমার এডিটিং শেষ করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিটি শট যেন দর্শকের অনুভূতির আঙিনায় সমানভাবে প্রজ্জ্বলিত। ১ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডের সময়ে ধারালো রেজরে তরুনির চোখ কেটে ফেলার কোলাজটা তো সিনেমার ইতিহাসে মাস্টারক্লাস হিসেবে পরিগণিত। লং শট, মিড শট, ক্লোজ শটসহ বিভিন্ন মিশ্র শটে এরকম মনে রাখবার মতো বেশ কিছু কোলাজ বুনুয়েল আমাদের দিয়েছেন তার চেতন-অবচেতনের যুক্তিনিষ্ঠ-বুদ্ধিদীপ্ত এই ছবিতে। সালভাদর দালির প্রত্যক্ষ প্ররোচনায় ১৯২৯ সালে স্বল্প বাজেটের An Andalusian Dog নির্মাণ করেন লুই বুনুয়েল। উল্লেখ্য, দালি আর বুনুয়েল এই দুই স্প্যানিশ মাতাদরই মারাত্মক জিনিয়াস আর পাগলাটে স্বভাবের ছিলেন। বুনুয়েল স্বপ্নে দেখলেন ধারালো ছুরিতে তরুণীর চোখ কেটে ফেলার দৃশ্য, আর দালি স্বপ্ন দেখলেন হাতের তালু ফুড়ে এক ঝাঁক পিঁপড়ের চলাফেরা। তারপর এই দুই স্বপ্ন এরা আছড়ে ফেললেন প্যারির ক্যাফের টেবিলে, তারপর তা ফুটে উঠলো সেলুলয়েডের পর্দায়। নির্মিত হলো মাত্র ১৬ মিনিটের ‘আন চিয়েন আন্দালু’ বা ‘এক আন্দালুসীয় কুকুর’। এটা কোন গতানুগতিক সিনেমা ছিল না, আজও নেই। প্যারিতে প্রথম প্রদর্শনীর সময় বুনুয়েল তো আতঙ্কে ছিলেন দর্শক ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠেন কি না। প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন পিকাসো, জ্যা কঁকতো আর আদ্রে ব্রেতোসহ প্যারির বহু রথি মহারথি। বুনুয়েলকে বিস্মিত করে সিনেমাটা দর্শকের ভিতর ব্যাপক সাড়া ফেলে। প্রদর্শনী হলগুলোতে উপচে পড়া ভীড়। বলা যায়, এই ক্ষুদ্রায়তনের সিনেমাটি সিনেমার ইতিহাসকে নতুনভাবে লিখতে বাধ্য করেছিল। এটা ছিল প্রথম স্যুরিয়ালিস্ট ফিল্ম যেটা বিশেষত বুর্জোয়া মনোভাবাপন্ন মধ্যবিত্ত ফরাসি তরুনদেরকে খেপিয়ে তুলেছিল। আপাত ঝকঝকে তকতকে ইউরোপের ভিতরটা যে পচে গিয়েছে, ভিতরটা ফাঁপা, দুর্গন্ধযুক্ত এটা মেনে নেওয়া বেশ কঠিনই ছিল।  হ্যা, ১৯৩০ সালে নির্মিত পরবর্তী ছবি The Golden Age ও বুর্জোয়া সমাজের উম্মত্ততা, যৌনবিকৃতি আর প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়ে মস্করা করে। স্মরণ করা যায়, ভাটিকান থেকে সেসময় বুনুয়েলকে হুমকি দেয়া হয়েছিল। ছবি দেখতে গিয়ে আমরা যে চোখ আর প্রথাবদ্ধ পরিশীলিত ভাবনাকাঠামো নিয়ে পর্দার সামনে বসি সেই চোখ আর ভাবনাকাঠামোর প্রতি বুনুয়েল বিদ্রুপ ছুঁড়ে দিয়েছেন। এতে নির্দিষ্ট প্লট নেই, কাহিনীর ধারাবাহিকতা নেই। এই সিনেমাটা যতবার আমি দেখেছি নতুন একটা কবিতা পড়বার মতো অনুভূতি আমার হয়েছে। যে কবিতার মাথামুন্ডু কিছু নেই। আছে কিছু ইমেজের সহিংস অভ্যর্থনা। অথবা যেন দাঁড়িয়ে আছি দালির স্টুডিওতে। ছড়ানো ছিটানো রং, প্যালেট আর অসম্পূর্ণ ক্যানভাস আমাদের দিকে আক্রমণের ভঙ্গিতে। যেন এস এম সুলতান বিশাল ক্যানভাসে রং ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছেন। যদিও ‘এ্যান আন্দালুসিয়ান ডগ’ সাদাকালোয় নির্মিত, কিন্তু এতে রঙের কি কমতি আছে? আমরা টের পাই, প্যারিতে স্যুরিয়ালিস্ট পান্ডাদের যে মজলিশ বসেছিল সেখানে কেন সগর্বে নিজের অস্তিত্ব জাহির করেছিল এই ‘আন্দালুসীয় কুকুর’। সে সময় ধ্রূপদী শব্দের পরিমন্ডলে রীতিমতো নাশকতা চালিয়ে আদ্রে ব্রেতো, লুই আরাগঁ, পল এল্যুয়ার আর কঁকতো কবিতায় পরাবাস্তববাদের জোয়ার বইয়ে দিচ্ছেন। পিকাসো, দালি, ম্যাগরিত্তের মতো চিত্রযজ্ঞভূমির চাঁড়ালেরা ক্যানভাস ভরিয়ে তুলছেন পরাবাস্তববাদের হিংস্র ও অরমণীয় রঙে। তো কঁকতো-বুনুয়েল বসে থাকবেন কেন? ওরাও নেমে পড়লেন ক্যামেরা হাতে পরাবাস্তববাদের যজ্ঞভূমিতে। যে চোখে আমরা বরাবর সিনেমা দেখে থাকি সেভাবে স্ক্রিনের সামনে বসলে আমাদের ধাক্কা না খেয়ে উপায় নেই। দর্শক এখানে কাহিনীর পারস্পর্য তেমন খুঁজে পাবেন না। দর্শকের মনে হতে পারে এখানে সেজান ছোঁপ ছোঁপ রঙের খেলা খেলে গেছেন বুনুয়েলের নামে। আর দালি তো আছেনই। দালির টেবিল থেকে আর সুপরিসর দেয়াল থেকে যেমন সময় চুঁয়ে চুঁয়ে গড়িয়ে মেঝেয় পড়ে তেমনি এখানে রয়েছে ওর অদ্ভুত স্বপ্নের জগৎ  আর ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণের ক্যারিকেচার। গল্পটা শুরু হয়েছে ‘একদা এক সময়’ থেকে। কিছুক্ষণ পর কাহিনী বদলে তা এক লাফে হয়ে যায় ‘আট বছর পরে’। অথচ এই কালপর্বে গল্পের চরিত্রগুলোর বিকাশ তেমন আমাদের চোখে পরিলক্ষিত হয় না। আমরা দেখি ধারাবাহিকতাহীন উল্লম্ফন। যেটা পরবর্তীতে গদারের সিনেমার অন্যতম আর্কিটেকচার হয়ে দাঁড়াবে। শুরুতে দেখি বুনুয়েল স্বয়ং বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রেজরে ধার দিচ্ছেন আর বুড়ো আঙুলে পরীক্ষা করে নিচ্ছেন সেই ধার। এরপর মেঘে ঢাকা আবছা চাঁদ আর ক্লোজআপে এক তরুণীকে দেখা যায়, শান্ত। এরপরই দেখা যায় ধারালো রেজরে বুনুয়েল কাটছেন তরুনীটির চোখ। এরপর দালির কম্পোজিশানের মতো একটার পর একটা দৃশ্য আমরা দেখি। যেগুলোর ভিতর আপাত কোন পারস্পর্য নেই। কিন্তু এগুলো দর্শক-অনুভূতিতে টংকার তোলে, রেনেসাঁ যুক্তিবিচার আর ফরাসি নান্দনিকতায় প্রশ্নবোধক চিহ্ন রেখে। কেন তোলে, এই প্রশ্ন আর্টক্রিটিকরা তুলতে পারেন না। কেন না ব্র্যাক-পিকাসো-দালি-ম্যাগরিত্তের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্ন তো কেউ তোলেননি পূর্বে। তো সিনেমায় এটা নতুন। দর্শকের অনভ্যস্ত চোখে মানিয়ে নেয়াটা সহজ না। একটার পর একটা অসংলগ্ন ইমেজের খেলা দর্শকের উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়। বিভ্রান্তও কি করে? সব ঘটনাই দ্রুত ঘটে। এই যেমন দেখা যায় হাতের তালুতে গর্ত, সেখান থেকে পিঁপড়ে বেরুচ্ছে। তরুনিটির বগলের লোম থেকে সমুদ্রসৈকত, পিয়ানোর সঙ্গে মৃত পঁচা গাধার শরীর, বইয়ের পিস্তলে রূপান্তর, আবার রাস্তার সমুদ্র হয়ে যাওয়া। এমনই সব দৃশ্যকল্প নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘একটি আন্দালুসীয় কুকুর’র শরীর। গাধার চিত্রকল্পটি সম্ভবত দালি পেয়েছেন স্প্যানিশ কবিতার অন্যতম মহিরুহ হুয়ান রামন হিমেনেথের সৃষ্ট ‘প্লাতেরো’ থেকে। উল্লেখ্য, দালি-বুনুয়েল দুজনই আন্দালুসীয় স্প্যানিশ। আর আন্দালুসীয় রূপকথা-উপকথা-লোকগাথা-সাহিত্যে ঘোড়া-গাধা-ষাড় বড় এক অংশ দখল করে আছে। তার স্পিরিট ১৬ মিনিটের এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিদ্ঘুটে সব দৃশ্যের পরতে পরতে আমরা দেখতে পাই। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই পারস্পর্যহীনতা যেমন দর্শকের প্রথাগত গ্রকো-রোমার রুচি ও ভাবনাকাঠামোয় আঘাত করে তেমনি দর্শককে উৎসাহিতও করে নতুন দৃশ্যকল্পে ঢুকে যেতে। পুরো ব্যাপারটাই চলচ্চিত্রকার হিসেবে বুনুয়েলের জন্য ছিল মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। প্রথম থেকে এক দৃশ্যকল্প পার হয়ে আমরা আরেক দৃশ্যকল্পে প্রবেশ করি, তারপর আরেকটা, তারপর আরেকটা…। এক দৃশ্যের সঙ্গে আরেক দৃশ্যের কোন মিল নেই। কিন্তু গল্পের শেষে (গল্পের কি শেষ আছে এই সিনেমায়?) কি এক ধরণের গথিক স্থৈর্য আমরা অনুভব করিনে, এক অসহনীয়তা সত্তেও? এটাই দালি, এটাই বুনুয়েল। বুনুয়েল নিজে অবশ্য এই সিনেমাকে সে সময়ের আঁভাগার্ড আন্দোলনের হিংসাত্মক প্রতিক্রিয়া হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর এটা ছিল দর্শকের প্রতি তার সর্বাত্মক শৈল্পীক সংবেদনশীলতা! আজ ‘একটি আন্দালুসীয় কুকুর’কেবল একটি সিনেমা আর নেই। কবিতা, চিত্রকলা, ভাস্কর্য এমন কি পরবর্তীকালের সিনেমাও আক্রান্ত হয়েছে ইউরোপকে গিলে খেতে উদ্যত ফ্যাসিবাদের ঊষামুহূর্তে প্যারিতে থিতু হওয়া পরাবাস্তবতার আঁচ সত্তায় বয়ে বেড়ানো দুই পাগলাটে বন্ধু দালি-বুনুয়েল নির্মিত সংক্ষিপ্ত রানিং-টাইমের ‘ঐতিহ্যবিদ্বেষী’ গৎবাঁধা প্রকরণের বাইরের এই সিনেমা দ্বারা। হ্যা, ঐতিহ্যবিদ্বেষ কিন্তু নতুন ঐতিহ্যের উস্কানিদাতা!

প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine

Nanook of the North (1922)

সংগ্রাম করেই মানুষকে বেঁচে থাকতে হয়। জয়নুল আবদিন বা সুলতানের যে মানবমানবীকে আমরা প্রতিনিয়ত লড়াই করে বাংলা ব-দ্বীপের প্রতিকূল পরিবেশে  টিকে থাকতে দেখি, সেই তারাই তো বেঁচে থাকবার লড়াইয়ে নিমগ্ন আফ্রিকায়, ওশেনিয়ায় অথবা উত্তর মহাসাগরের রুক্ষ বরফাচ্ছন্ন দ্বীপে। হয় তো জীবনধারা, সংস্কৃতি, ভৌগলিক অবস্থান আলাদা। কিন্তু ক্ষুধা, যৌনতা আর রক্তের স্ফূরণ তো এক। এটা জয়নুল-সুলতান যেমন জানেন, ফ্লাহার্টিও জানেন। সোমনাথ হোরের চাষীরা যখন ঘরের আলোআঁধারিতে রুদ্ধদ্বার আলোচনায় নিমগ্ন,  ভ্যান গঘের চাষীপরিবারের অস্বচ্ছল টেবিলের প্লেটে যখন আমরা কেবল কয়েকটা সেদ্দ আলু দেখি, অথবা বেলা তার (Bela Taar) তার The Turin Horse (২০১১) চলচ্চিত্রে পিতা-কন্যার ছোট্ট পরিবারের খাবারের টেবিলে যখন কয়েকটা মাত্র আলুসেদ্দই প্রতাদিনের খাদ্যতালিকায় দেখান, সেটা সাধারণ মানুষের প্রতিনিয়ত লড়াই করে বেঁচে থাকবারই প্রয়াস হিসেবে দেখা যায়। পিট সিগার যখন গেয়ে ওঠেন, ‘ফুলেরা সব কোথায় গেল?’ –এই হাহাকার তখন আমাদের সবার ভিতরেই জারিত হয়। কেন না পশ্চিমের অপরাসীম লোভ আর হিংস্রতায় এই ফুলেরা আমেরিকার দক্ষিণসহ ফাঁপা-জৌলুসময় ঝা-চকচকে নাগরিক সভ্যতা থেকেই হারিয়ে গেছে। সব ফুলই কি হারিয়ে গেছে। যায়নি হয় তো।  সেই ফুলগুলোকেই খুঁজে পেতে হবে আমাদের। এটাই আমাদের লড়াই। চলচ্চিত্রের ভিতর প্রচুর চিত্র থাকবে, সুসমন্বিতভাবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই চিত্রসমূহ কত দ্রুততম সময়ে দর্শকের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারবে, দর্শকের ভাবনা, চেতনা, অভিজ্ঞতায় নিজেকে যাচাই করে নেবে, সেটা বড় এক ব্যাপার। কথাগুলো বলছি যখন Nanook of the North (1922) আবার আমি দেখছি আর অনুভব করছি নিজস্ব বিশেষ প্রতিবেশ-পরিবেশে মানুষের জীবন যাপনের নিত্য লড়াই আর সংগ্রাম কীভাবে সেলুলয়েডের পর্দায় উঠে আসতে পারে, ভিন্নতর রূপবিন্যাস আর জ্যামিতিক শৃঙ্খলায়! হ্যা, এই ডকুমেন্টারিটা দেখতে গিয়ে আমার মনে পড়ে গেছে পল গগাঁর তাহিতি দ্বীপের কথা। কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ তাহিতি আর কানাডা অধ্যুষিত আর্কটিক কিউবেকের হাডসন বের নিকটবর্তী ইনুকজুয়াক তো ভৌগলিক ও জলবায়ুগত দিক থেকে একেবারেই আলাদা। শিল্প নির্মাণের দিক থেকে গগাঁ আর ফ্লাহার্টির এ্যাটিচ্যুডও আলাদা। কিন্তু সংগ্রাম তো একই। একই মানুষ, যারা আমাদের তথাকথিত সভ্যতা থেকে অনেক দূরে। রবার্ট জে ফ্লাহার্টি (১৮৮৪-১৯৫১) মূলত আমাদের দেখান ইনউইট উপজাতির জীবন সংগ্রাম। আর্কটিক অঞ্চলে ১৯২০ সালের আগস্ট থেকে ১৯২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত ফ্লাহার্টি শুটিং করেন। এই কাজে উনি সঙ্গে নিয়েছিলেন ৭৫ হাজার ফুট র’ ফিল্ম, হলবার্গের ইলেকট্রিক লাইট, একটা প্রজেক্টর, দুটো একলে ক্যামেরা আর একটা প্রিন্টার। সিনেমাটা শুরু হয়েছে সিন্ধুঘোটক শিকার উৎসবের মধ্য দিয়ে। তারপর সিল মাছ শিকার, উত্তর মহাসাগরের প্রবল শীতে এস্কিমোদের বেঁচে থাকার একমাত্র আশ্রয় ইগলু (বরফের ঘর) তৈরি। এ ছবির নায়ক নানুক। ইনউইট মিথ অনুযায়ী নানুক হলেন মেরুভল্লুকদের প্রভু। শিকারীদের সাফল্য-ব্যার্থতা তারই ইচ্ছাধীন। সেখান থেকে নামটি নেওয়া। নানুক চরিত্রে ফ্লাহার্টি পছন্দ করেছেন আল্লাকারিয়াল্লাককে। নাইলা আর কুনাইউ নানুকের দুই স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন। বাকিরা সবাই স্থানীয় ইনউইট। অনেক সমালোচক অভিযোগ করেছেন ফ্লাহার্টি প্রামাণ্যচিত্রের চিরাচরিত মূল্যবোধকে অবহেলা করেছেন। নাটকীয় মুহূর্ত তৈরি করতে বাস্তবচ্যূত হয়ে ইনউইটদের জীবনের রোমাঞ্চকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন। তাই এই সিনেমাকে ডকুমেন্টারি বলা যাবে কি না তা নিয়ে তারা সন্দিহান। এ কথা সত্যি, সাধারণ মানুষের জীবনের সত্য গল্পগুলো বলার ক্ষেত্রে যে অসাধারণ ন্যারেটিভ স্কিল  ফ্লাহার্টি দেখিয়েছেন তা বোদ্ধা দর্শককে বিস্মিত না করে পারে না। পরিচালক কিছু স্বাধীনতা নিয়েছেন। উনি দেখলেন ছবিটা অনেকটা ট্রাভেলগ ফিল্মের আবেশ ধরে আছে। তাই উনি চাইলেন এস্কিমো পুরুষ আর তার পরিবারের গল্প বলতে, গভীর ব্যাঞ্জনায়, মাল্টি-পার্সপেকটিভ বর্ণনারীতিতে। একাজে তাকে নানুক আর তার পরিবারকে দিয়ে কখনো কখনো অভিনয় করিয়ে নিতে হয়েছে যেটা ফিচার ফিল্মের চরিত্রের সঙ্গে মেলে। কিন্তু নানুকের পরিবারের যে সংগ্রাম ফ্লাহার্টি দেখাতে চেয়েছেন সেটাতে তো কোন মিথ্যে নেই। মিথ্যে ছিল না গগাঁর তাহিতি পিরিয়ডের চিত্রমালাতেও। সেটাও এক মহাকাব্যিক পরিভ্রমণ। প্যারির নাগরিক সভ্যতার প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়ে গগাঁ অনেকটা পালিয়ে গিয়েছিলেন ফরাসিদেরই কলোনি সুদূর তাহিতি দ্বীপে। আর সেখানে থেকে গিয়েছিলেন। বিয়ে করেছিলেন তাহিতি কন্যাকে আর তাহিতি কন্যার পিতাও হয়েছিলেন। বিনা চিকিৎসায় সেখানে মারাও গিয়েছিলেন। ফ্লাহার্টির ব্যাপারটা আলাদা। উনি ফরাসি অর্থ সহায়তায় রুক্ষ বরফাচ্ছন্ন আর্কটিক অঞ্চলে গিয়েছেন, ইনউইট উপজাতির বেঁচে থাকা আর লড়াইয়ে বিস্মিত হয়েছেন, বিশাল ক্যামেরা দিয়ে শুটিং করেছেন, আমেরিকায় ফিরে এসেছেন। বলা যায় পুরোটাই প্রফেশনাল ব্যাপার। ১৯২২ সালে সিনেমাটা রিলিজ হলে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। বিপুল পয়সা আয় করে সিনেমাটা। সেসময় অনেকে অভিযোগ করেন ফ্লাহার্টি দারিদ্র্য বিক্রি করে সফলতা অর্জন করেছেন। অবশ্য এ অভিযোগও তো নতুন না। ‘পথের পাঁচালী’র সফলতার পর সত্যজিৎকেও এমনটা শুনতে হয়েছে। এতোকিছুর পর শিল্পের ইতিহাস আলাদা। সেখানে ফ্লাহার্টি মায়েস্ত্রো। Nanook of the North সিনেমার ইতিহাসে নিঃসন্দেহে প্রথম বিখ্যাত ডকুমেন্টারি।  এর পূর্বে আর কোন ডকুমেন্টারি সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও নন্দনতাত্বিক দিক থেকে দর্শকের চিত্তে এতোটা নাড়া দেয়নি। এমন কি পরবর্তীতে মোয়ানা (১৯২৬), ‘ম্যান অব এ্যারন’ (১৯৩৪), ‘টুয়েন্টি ফোর ডলার আইল্যান্ড’ (১৯২৭) বা ‘ল্যুজিয়ানা স্টোরি’ (১৯৪৮)-র মতো মাস্টারক্লাস ফিল্ম তৈরি করলেও তা কোনভাবেই ‘নানুক অব দ্য নর্থ’র সফলতাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। অবশ্য ডকুমেন্টারির কথা বলতে গিয়ে সোভিয়েত ফিল্ম মায়েস্ত্রো ঝিগা ভের্তভের ‘Man with a Zmovie Camera (১৯২৯)-র কথা উল্লেখ না করলে সিনেমার ইতিহাসই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সোভিয়েত চলচিত্রকরগণ সিনেমাকে মানুষের বেঁচে থাকা আর সংগ্রামের সঙ্গে যেভাবে মিলিয়ে নিতে পেরেছেন সেটা পৃথিবীর সব চলচ্চিত্রকর্মীকেই অনুপ্রেরণা দিয়েছে। ‘ম্যান উইথ আ মুভি ক্যামরা’ এর একটা উদাহরণ কেবল। এমন কি আইজেনস্টাইন যে Battleship Potemkin (১৯২৫) বা October (1928) নির্মাণ করলেন তাও কি প্রামাণ্যচিত্রের চিরাচরিত চলন থেকে খুব আলাদা? আসলে ডকুমেন্টারিতে জীবনের স্পন্দন প্রত্যক্ষভাবে যেমনটা পাওয়া যায় তেমনটা ফিচার ফিল্মের কাছ থেকে হয় তো আমরা আকাঙ্ক্ষা করিনে। হ্যা, তাজা জীবনবাস্তবতা ছাড়া কোন আর্টই যথাযথ রূপবিন্যাসে জ্যামিতিক শৃঙ্খলা পায় না। ফিচার ফিল্মও তাই। তবে কাহিনীচিত্রে চলচিত্রকারগণ সম্ভবত শিল্পের টেকনিক্যাল ও নন্দনতাত্বিক জ্বরগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। যেটা ডকুমেন্টারিতে করতে গিয়ে দ্বিধান্বিত হতে হয়, হয় তো। ডকুমেন্টারিতে জীবনের উত্তাপ পাওয়া যায় সরাসরি। একারণে জহির রায়হান ক্যামেরায় তুলে আনেন Stop Zenocide আর জাফর পানাহিকে সৃষ্টি করতে হয় This is not a Film (2011)। ঋত্বিক ঘটকের ‘আমার লেনিন (১৯৭০) বা ‘দুর্বার গতি পদ্মা, (১৯৭১) বা ‘রামকিঙ্কর’-র কথা উল্লেখ করা দরকার। ল্যাতিন আমেরিকাকে ডকুমেন্টারির সূতিকাগার বলা যেতে পারে। এখনও ল্যাতিন আমেরিকা সম্ভবত সিনেমার সেই জোন যেখানে ফিচার ফিল্মের চেয়ে প্রতি বছর ডকুমেন্টারি তৈরি হয় দ্বিগুণ সংখ্যায়। শতাব্দীর পর শতাব্দী যে সাম্রাজ্যবাদের থাবা দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার ওপর চেপে বসেছিল সেটাকে আক্রমণ করতে চাওয়া বা বুঝে নিতে পারাই কি এর কারণ? এখনও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কি সাম্রাজ্যবাদের শকুনছায়া দক্ষিণে পড়ে নেই? বিপ্লব পরবর্তী কিউবাতে এই প্রক্রিয়ার শুরু। তারপর তা ছড়িয়ে পড়ে পরো ল্যাতিন আমেরিকাতে, বিশেষত আর্জেন্টিনায়, ব্রাজিলে, নিকারাগুয়ায়, ভেনেজুয়েলায় ও বলিভিয়ায়। The Hour of Funnaces (1968) যেন রক্ত দিয়ে লিখেছেন দুই আর্জেন্টাইন অক্তাভিও গেতিনো আর ফারনান্দো সোলানাস। এভাবে আমরা পেয়ে যায় The Motorcycle Diaries (২০০৪), The Edge of Democracy (২০১৯)সহ গণমানুষের তাজা রক্ত দিয়ে লেখা অসংখ্য তথচিত্র। এইসব প্রামাণ্যচিত্র কেন আমাদের এতো টানে? এর প্রধান কারণ সম্ভবত সত্যনিষ্ঠতা। ‘নানুক অব দ্য নর্থ’-য়ে এই সততা, নিষ্ঠা ও দায়িত্ববোধ আমরা পাই ফ্লাহার্টির কাছ থেকে। কি নিবিড় শ্রদ্ধায়-ভালবাসায় উনি এঁকে চলেছেন নানুক পরিবারের জীবনছবি! এই ছবি কি আমাদের নাগরিক সভ্যতার ফাঁপা জৌলুসকে প্রশ্ন করে না? এই মুভি দেখতে গিয়ে দর্শকের চেতনায় এই প্রশ্ন উঁকি দেওয়া স্বাভাবিক।

প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine

গদারের আত্মজীবনী না নন্দনতত্ত্বের টেবিলে বিষ্ঠা

ফরাসি নিউ ওয়েভের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড গদারের শেষ সিনেমা The Image Book (Le Livre d Image) কি আসলেই সিনেমা? গদার নিজে কি এটাকে সিনেমা মনে করেন, না দর্শন ও শিল্পের গবেষণাগার? প্রচলিত যে চলচ্চিত্র কাঠামোর সঙ্গে আমরা পরিচিত তার কোন ছকেই একে ফেলা যাবে না। হতে পারে এটা আত্মজীবনী অথবা ওর সমগ্র সৃষ্টিকর্মের এক দার্শনিক সারাৎসার? তার প্রথম চলচ্চিত্র Breathless (1960) থেকে শুরু করে  Contempt (1963), Pierrot Le Fou (1965), Weekend (1967) সহ সবগুলো কাজেই এই আলামত আমরা পেয়েছি। স্বীকার করা ভাল, গদারের প্রথম সিনেমা ‘ব্রেথলেস’ই ফরাসি সিনেমাকে নতুনভাবে দর্শকের সামনে দাঁড় করিয়েছে, বিশেষত জাম্প-কাটের সাহসী ব্যাবহারের কারণে। সেইসঙ্গে ফরাসি সিনেমার নতুন পথের কান্ডারি হিসেবে তার জায়গাও মজবুত হয়েছে। যে কারনে পরবর্তীতে সিনেমা করতে গিয়ে তাকে আর প্রযোজকের পেছনে ঘুরতে হয়নি। কেন না সিনেমা এমন এক শিল্পমাধ্যম যার সফলতার জন্য অনেকগুলো উপাদানের ওপর নির্ভর করতে হয়। অনেকের ওপর নির্ভর করতে হয়। আর্থিক পুঁজি এখানে বড় এক ফ্যাক্টর।

যা হোক, ‘দ্য ইমেজ বুক’ দেখতে গিয়ে বাঙালি চলচ্চিত্রনির্মাতা ঋত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’র কথা দর্শকের চোখে ভেসে ওঠাটা স্বাভাবিক। কাকতালীয় হলেও সত্যি, ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ ঋত্বিকের শেষ ছবি। হ্যা, এই সিনেমায় ঋত্বিক নিজেকে দিয়ে পুরোটাই বলিয়ে নিয়েছেন, তার একান্ত নিজস্ব চলচ্চিত্র ভাষায়। আর্ট তো আমাদের আনন্দ দেয়। আমাদেরও তো উচিত আর্টের ভালমন্দ একটু দেখা, উৎসাহ দেওয়া, উশকানি দেওয়া। হাসিঠাট্টা-চড়থাপ্পড় মন্দ কি! কবি নিকানোর পাররা যেমন কবিতাকে মাউস্ট অলিম্পাস থেকে মাটিতে নামিয়ে এনেছিলেন তেমনি গদার আর্টের গজদন্তমিনার থেকে সিনেমাকে নামিয়ে এনে বসিয়েছেন পাড়ার চায়ের দোকানে। সিনেমা মুক্তি পেয়েছে নন্দনতত্ত্বের বন্দিশালা থেকে। এতোদিন আমরা জানতে চেয়েছি কীভাবে সিনেমা হয়? এখন আমরা প্রশ্ন করতে পারছি কীভাবে সিনেমা হয় না? ক্যামেরা তোমার হাতে। তুমি যা ইচ্ছে যখন ইচ্ছে দর্শককে দেখাও। এমন কি দর্শকের হাতেও ক্যামেরা ছেড়ে দিতে পারো। কাঁধে ক্যামেরা হাঁটতে হাঁটতে নিয়ে শ্যুট করছো। ক্যামেরা কাঁপছে? কাঁপুক। ওটাই ফিল্ম। ঘরে পর্যাপ্ত আলো নেই। জানালা দিয়ে যেটুকু আসছে ওতেই সই! ওটাই ফিল্ম।  দর্শক এই জায়গাটাই এই দুই ছকভাঙা ফিল্মমায়েস্ত্রো মিলিয়ে নিতে চাইবেন হয় তো। ঋত্বিক ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ নির্মান করেন ১৯৭৭ সালে আর গদার The Image Book নির্মাণ করেন ২০১৮ সালে। আর এই দুজনের চলচ্চিত্রভাষা আপাদমস্তক আলাদা। তবে ঋত্বিক সুসমন্বিত কাহিনীর গুরুত্বকে অস্বীকার করেননি। আর গদার গল্পকে পরিত্যাজ্য মনে করেছেন। গল্প বাদে চিত্র, শব্দ, কাট, নীরবতা — কোন কিছুতেই তার অনীহা নেই। গদার প্রশ্ন করেন, ক্রমাগত প্রশ্ন করেন, উত্তরের অপেক্ষা না করে। আর এই প্রবণতা কি ভয়ংকররূপে ছড়িয়ে পড়েছে ফিল্মপাড়ায় তা তারান্তিনো, স্করসেজি বা নোলানের মতো ফিল্মমাস্টারদের সাম্প্রতিক কাজ দেখলে সহজেই টের পাওয়া যাবে।  যা হোক গদার তার এই শেষ কাজে নিজেকে সম্পূর্ণ উজাড় করে দিয়েছেন, তার আপাত বিদ্ঘুটে চলচ্চিত্রকাঠামোসহ। একে সিনেমার প্রবন্ধ বলা যেতে পারে। এই সিনেমা যতটা না সাধারণ দর্শকের জন্য, তার চেয়ে বেশি নিরীক্ষাপ্রেমী পরিবর্তন-উম্মুখ, বোদ্ধা সাহসী দর্শকের জন্য। অজস্র কোলাজ আর প্রতিকৃতি দিয়ে ভর্তি এই সিনেমা। দর্শক দ্বিধায় পড়ে যাবেন, তারা কি চলচ্চিত্র না চিত্রকলা দেখছেন? জীবনের শেষাংশে অঁরি মাতিসের যে অজস্র কোলাজের কাজ তা যেন গদার তার দুর্বিনীত ক্যামেরা দিয়ে এঁকে চলেছেন নিরবিচ্ছিন্নভাবে, যথেষ্ট অপরিশীলিত প্রক্রিয়ায়। আর রঙের কম্পোজিশানে বাড়াবাড়ি রকমের বিচ্যূতি। এই বিচ্যূতি উপভোগ করেন গদার। যেন দর্শককে বিরক্ত করতে পারা বা ক্ষেপিয়ে তুলতে পারাটা তৃপ্তিজনক। কয়েকবার দেখা গেছে স্ক্রিন ঝিরঝির করে কাঁপছে। যেন ঝড় আসছে। যেন আমাদের নিম্নবিত্ত পরিবারের সবেধন নীলমনি টিভির সামনে আমরা হা করে বসে আছি। ওটা যথেষ্ট পুরোনো হয়ে গেছে। প্রায়ই বিগড়ে যায়। তখন ওটাকে ম্যাকানিকের  বাড়ি থেকে ঘুরিয়ে আনা হয়। কিন্তু ওটা বদলিয়ে নতুন টিভি কেনার সামর্থ্য নেই আমাদের। পরিস্থিতিটা এমন। 

সিনেমার চিরাচরিত নন্দনতাত্ত্বিক ধারণার ওপর বলা যায় বিষ্ঠা লেপে দেওয়া হয়েছে। কাহিনীর পারষ্পরিকতা নেই, বুনট অসংলগ্ন, আছে যথেচ্ছ হিংসাত্মক ক্র্যাক আর রাজনৈতিক-সামাজিক প্রোপাগান্ডা। তাহলে, এতো কিছুর পর শেষ অব্দি স্থাপত্যসুলভ এক ধরণের স্থৈর্য্য কি এই চলচ্চিত্রকাঠামোর ভিতর রয়ে গেল? কীভাবে এটা সম্ভব? অথবা একে কবিতা বলাই শ্রেয়। রাজনৈতিক কবিতা। কী নেই এই ছবিতে? বিভিন্ন মুভমেন্ট বা সংবাদ ফুটেজ, বিখ্যাত ব্যক্তির ফটোগ্রাফ, ভিঞ্চি বা গগাঁর পেইন্টিং  ইত্যাদি ইত্যাদি। হ্যা, ভ্যান গগের হলুদ রঙের বাড়িটিও যেন দেখতে পাই আমরা। এই সিনেমায় কাহিনীর ধারাবাহিকতা নেই। কাহিনীই নেই। আছে টুকরো টুকরো কোলাজ আর অজস্র বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের প্রতিকৃতি। আর রঙের কথা কী বলবো। রং নিয়ে রীতিমতো তাচ্ছিল্য করেছেন গদার। মানে সিনেমায় রং কতোটা বাজেভাবে ব্যবহার করা যায় তা এই সিনেমা না দেখলে বোদ্ধা দর্শকগণ অনুভব করতে পারতেন না! একক মানুষের জীবনও তো বাজে সব রঙের সমাহার, না কি! রং আর আলোছায়ার মুন্সিয়ানা তো বিশ্বচলচ্চিত্রের দিকপালদের কাজে কম আমরা দেখিনি। গদার গোটা ব্যাপারটাকেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন। আর্টের ওসব ক্লাসিক ফাংশনাল ব্যাপারগুলো থেকে নিজেকে সদম্ভে সরিয়ে নিয়েছেন। আর্টকে পারফেক্ট হবার দরকার নেই। পবিত্র হয়ে উঠবার প্রবণতা আর্টের এ্যাটিচুডের সঙ্গে যায় না। এই জায়গাটায় ঋত্বিক এসে যান।

রামকিঙ্কর বা অগুস্ত রোঁদা হাজির হন দর্শকের মনোজগতে। কীভাবে আর্ট বা সিনেমার মুখোমুখি সচরাচার আমরা দাঁড়াই? বিশেষত সিনেমা নিয়ে ট্রাডিশনাল এক ধরণের প্রতিমুর্তি তো গড় দর্শকের চেতনায় জারিত আছেই। এমন কি তথাকথিত বোদ্ধা দর্শকও চলচ্চিত্রের ফর্ম ও টেক্সচারের ধারাবাহিক বিবর্তনের বাইরে ভিন্নতর চলচ্চিত্রভাষাকে ন্যায্যতা দিতে দ্বিধান্বিত, বিব্রত, বিরক্ত। আর্টের বিষয়ে একটা কথা তথাকথিত নন্দনতাত্বিকদের কাছ থেকে শোনা যায়, আর্টে শ্লোগান থাকে না। অর্থাৎ শিল্প সরাসরি কিছু বলে না। শিল্পের কোন উদ্দেশ্য নেই। শিল্প চেঁচামেচি করে না, শ্ল্যাং বলে না। শিল্প নিষ্কলঙ্ক। কিন্তু এই মাস্টারদেরকে দৃঢ়চেতা,  সাহসী ও নিবেদিত শিল্পীরা কখনো মেনেছে? ‘বালজাক’কে রঁদা বেঢপ আকৃতিতে তৈরি করেননি, তৎকালীন প্যারির রুচির গালে থাপ্পড় মেরে? ব্রেখট তার মঞ্চকে বুর্জোয়ার ভাগাড় বানিয়ে ফেলেননি? আর বাংলার সুবিমল মিশ্র? ওর গল্প তো মাতিসের কোলাজ, সিনেসাপ্তাহিকে জনপ্রিয় নায়িকার অর্ধনগ্ন শরীর আর দিনদুপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত যুবকের তাজা লাশের সহনশীল টেক্সচার। ব্রেখট যেমন বলেন, মঞ্চে আমার চরিত্ররা আরও বেশি শ্ল্যাং বলতে চায়, আয়ত্ব করতে চায়, হয়ে উঠতে চায় আরও আরও আরও বেপরোয়া। শিল্পকে থোড়াই কেয়ার করে ব্রেখট চেয়েছেন মঞ্চের উচ্ছেদ। দর্শক আর আর্টিস্টের মধ্যে কোন দেয়াল থাকবে না। ভারতবর্ষে এটা পেরেছেন বিজন ভট্টাচার্য –গিরিশ ঘোষ, শিশির ভাদুড়ী, শম্বু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, উৎপল দত্তের উত্তরসুরী হয়ে, ‘নবান্ন’ নাটকের মাধ্যমে। হ্যা, গদার কয়েকটা ম্যাসেজ বেশ কড়াকড়িভাবেই দিয়েছেন এই সিনেমায়। যেমন আর্টের গতানুগতিক ফর্মের বিনাশ, টেক্সচারের নতুন উপাদান বা যা কিছু অছ্যূত-পরিত্যাক্ত তাকে অগ্রাধিকার। আরব সংস্কৃতির প্রতি পশ্চিমাদের উন্নাসিকতা। যেন আরব বলতেই বর্বর। ব্যাপারটা যে অতি সরলীকরণ আর উদ্দেশ্য প্রণোদিত তা গোদার দেখিয়েছেন, তার নিজস্ব শিল্পভঙ্গিতে। বলা যায়, চলচ্চিত্রে গল্প বলার যে মোহ সেটা থেকে বেরিয়ে এসেছেন গদার। বরাবরই তার কাজে করণকৌশলের নিজস্বতা রয়েছে। রয়েছে অস্বীকারের প্রবণতা। দর্শকের জন্য এ বড় অস্বস্তি। আর এটা গদারের কাছে গ্রাহ্য করবার মতো কোন ব্যাপার না। গদার নিজেকে চলচ্চিত্রকার হিসেবে দেখতে চান না, চান না তার কাজ নিছক সিনেমা হয়ে উঠুক। সিনেমা না হয়ে উঠতে চাওয়াটাই যেন এর প্রতিজ্ঞা। এটা দর্শকের জন্য চ্যালেঞ্জ। প্রতিভাস ম্যাগাজিন | Prativas Magazine

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *