সৌমিতা রায় চৌধুরী
পর্ব – ১২
ভারতীয় চলচ্চিত্রে যে ক’জন চলচ্চিত্র পরিচালককে আইকন হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তাঁরা হলেন সত্যজিৎ রায়, তপন সিনহা এবং মৃণাল সেন। এদের পূর্বসূরী হিসেবে ভিন্ন ধারায় বাস্তববাদী চলচ্চিত্র নির্মাণে যে ব্যক্তির নাম অবশ্যম্ভাবী ভাবে উঠে আসে তিনি ঋত্বিক ঘটক। ক্ষণজন্মা এই ব্যক্তিত্ব চলচ্চিত্র পরিচালনার পাশাপাশি চিত্রনাট্যকার, অভিনেতা এবং নাট্যকার হিসেবেও স্বকীয়তার প্রমাণ রেখে গেছেন। তাঁর চলচ্চিত্রে দেশ ভাগের পরবর্তী সময়ে সামাজিক বাস্তবতা এবং নারীবাদের সূক্ষ্ম বিষয়গুলি চিত্রায়িত হয়েছে।
১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন ঋত্বিক ঘটক। রাজসাহী কলেজিয়েট স্কুল এবং বালীগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং উচ্চ শিক্ষায় প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে সসম্মানে উত্তীর্ণ হওয়ার পর চলচ্চিত্র নির্মাণকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯৫২ থেকে ১৯৭৬ সালের মধ্যে কালজয়ী বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তাঁর জীবন সঙ্গী ছিলেন সূরমা ঘটক।
১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে তাঁর জীবন স্তব্ধ হয়ে যায়। এই সীমিত সময়ের মধ্যে ১৯৭০ সালে পদ্মশ্রী পুরস্কার এবং ১৯৭৪ সালে শ্রেষ্ঠ গল্পের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
ঋত্বিক ঘটকের নির্মিত চলচ্চিত্র গুলি হল ‘অযান্ত্রিক’, ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’, ‘মধুমতি’, ‘কত অজানারে’, ‘মুসাফির’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘সুবর্ণ রেখা’, ‘যুক্তি তক্ক গপ্পো’, ‘ছিন্নমূল’, ‘রাজকন্যা’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ইত্যাদি এই চলচ্চিত্রগুলি নির্মাণ করেন। ‘উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’, ‘রামকিঙ্কর বেজ’ এবং ‘আমার লেনিন’ নামের জীবনীমূলক তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন।
ঋত্বিক ঘটক ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতা। সুবোধ ঘোষ রচিত বাংলা ছোট গল্প ‘অযান্ত্রিক’ অবলম্বনে ‘অযান্ত্রিক’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। এটি একটি কমেডি নাট্য চলচ্চিত্র। একটি জড় পদার্থকে গল্পের চরিত্র হিসেবে চিত্রিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি।
বিমল একজন মফস্বলে বসবাসকারী ট্যাক্সি ড্রাইভার। এই ট্যাক্সিটি হল ১৯২০ সার্ভোলেট জালোকি ট্যাক্সি। বিমল এই ট্যাক্সির নাম রেখেছেন জগদ্দল। একাকী বিমলের এই ট্যাক্সিই একমাত্র সঙ্গী। ভাঙাচোরা এই ট্যাক্সি বিমলের নয়নের মণি। একটি যন্ত্রশিল্প বিবর্জিত এলাকায় ট্যাক্সি চড়িয়ে মানুষকে একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পৌঁছে দেওয়াই ছিল বিমলের কাজ। এই ভাঙাচোরা ট্যাক্সির সঙ্গে বিমলের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। প্রতিদিনের যাত্রাপথে যেসব অনুভূতি বিমলের হত এবং দিন শেষে এই জড় বস্তুর সাথে তার রাত কাটত, তা ছবির বিভিন্ন পর্যায়ে চিত্রায়িত হয়েছে।

এই ছবিতে বিমলের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। শ্রীমান দীপক, কাজল গুপ্ত, অনিল চট্টোপাধ্যায়, তুলসী চক্রবর্তী, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, সীতা মুখোপাধ্যায় এবং কেষ্ট মুখোপাধ্যায়। এই ছবির সুরকার ছিলেন আলী আকবর খান। চিত্রগ্রাহক ছিলেন দীনেন গুপ্ত ও সম্পাদক রমেশ যোশী এবং প্রযোজনা কোম্পানির নাম এল বি ফিল্মস ইন্টারন্যাশনাল। একশো চার মিনিটের এই চলচ্চিত্রটি ১৯৫৮ সালের ২৩ মে মুক্তি পেয়েছিল।
বিশিষ্ট বাঙালি কবি ও জার্মান বিশেষজ্ঞ অলোক রঞ্জন দাশগুপ্তের মতে “বিবর্ণ প্রকৃতি ও যান্ত্রিক সভ্যতার নির্দয় বিরোধটি ট্যাক্সি ড্রাইভার বিমল ও তার করুণ যানটির সঙ্গে প্রেমের মধ্যে দিয়ে যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে, তাকে আধুনিকতার — একটি ব্যতিক্রমী উপহার মনে হয়”। প্রতিভাস ম্যাগাজিন
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)