অরিত্রী দে

পর্ব – ২

পরিবেশবাদী ভারতীয় কথাসাহিত্য ধারা

আঠারো ও উনিশ শতক জুড়ে পাশ্চাত্যের সাহিত্যে পরিবেশভাবনা এসেছে কখনও ভ্রমণকাহিনীতে, কখনও বা স্থানীয় প্রাকৃতিক বিবৃতির প্রসঙ্গে। যেমন ১৭৫৯ সালে গিলবার্ট হোয়াইট ‘ন্যাচারাল হিস্ট্রি অফ সেলবোর্নে’ ইংল্যান্ডের একটি গ্রামের গাছ, পাখিদের জীবনচক্র, ঋতুভেদে ও জলবায়ুর প্রভাবে তার পরিবর্তন নিয়ে লেখেন। আবার প্রকৃতিবিদ বার্টরাম তাঁর ভ্রমণকাহিনীতে (বার্টরাম’স ট্রাভেলস’,১৭৯১) গাছ, পাখি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের নিখুঁত বিবরণ দেন। জেমস ফেনিমোর কুপার রচিত ‘দ্য পাইওনিয়রস’ (১৮২৩) সম্ভবত প্রথম উপন্যাস যাতে প্রকৃতি প্রাধান্য পায়। লেখক নিউইয়র্কের অটসিগো লেকের বিপর্যস্ত বাস্তুতন্ত্র, টেম্পলটন শহরের প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ও তার যথাযথ ব্যবহার প্রসঙ্গ ছাড়াও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, প্রকৃতির চূড়ান্ত বিপজ্জনক দিকগুলিও রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলেন। হেনরি ডেভিড থর‍্যেউ তাঁর ‘ওয়াল্ডেন অর লাইফ ইন দ্য উডস’ (১৮৫৪)-এ দেখান যে বাঁচার উপযোগী যৎকিঞ্চিৎটুকু নিয়েই জীবনধারণ করা যায়, কিন্তু প্রকৃতির সান্নিধ্য আবশ্যকীয় শর্ত। মধ্য ক্যালিফোর্নিয়ার সিয়েরা পর্বতমালার জীববৈচিত্র্য, ইয়োসমাইট উপত্যকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে জন ম্যুর ১৯১১ সালে লেখেন ‘মাই সামার ইন সিয়েরা’। ১৯৫৭ সালে রচিত ‘অন দি বিচ’ উপন্যাসে নিল শ্যুট পরমাণু যুদ্ধ পরবর্তী তেজস্ক্রিয় মেঘ ও তা থেকে হওয়া বৃষ্টিতে মানুষের অবধারিত মৃত্যু ও পলায়নের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন।

রাসায়নিক শিল্পের বিস্তার ও কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহারে পরিবেশের ওপর তার কুপ্রভাব নিয়ে বিংশ শতাব্দীতে র‍্যাচেল কারসন ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ (১৯৬২) লেখেন। ‘আ ফেবেল ফর টুমরো’ অধ্যায়ে দেখানো হয় আমেরিকার প্রকৃতিলগ্ন জীবনের প্রতিমা-প্রতীকগুলি ছিন্নভিন্ন, সমৃদ্ধ খামার, সবুজ ও প্রাণীরা ব্যাধিতে আক্রান্ত। ডেল স্মিথ রচিত ‘হোয়াট দ্য ওরাংওটাং টোল্ড এলিস’ (২০১১) এবং জে.ও ক্যালহানের ‘দ্য স্পিরিট অফ দ্য গ্রেট ওক’ উপন্যাস একবিংশ শতাব্দীতে পরিবেশ বিপন্নতায় লুপ্তপ্রায় প্রাণী ও বৃক্ষ প্রজাতি নিয়ে সচেতনতাকে সূচিত করে। মার্সেল থিরোর ‘ফার নর্থ’ উপন্যাসে (২০১০) সাইবেরিয়ান নন্দনকাননের ধ্বংস ও তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বায়ুর ঘনত্ব কমে যাওয়ার মত পরিবেশগত সমস্যাগুলি এসেছে। ‘ফ্লাইট বিহেভিয়ারে’ (২০১২) বারবারা কিংসলভার বিশ্ব-উষ্ণায়নের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনে বিরল প্রজাতির প্রজাপতিদের আবাসস্থল বদল এবং ঝাঁকে ঝাঁকে মৃত্যুর সংবাদ দেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত, খরাবিধ্বস্ত দুনিয়ায় জলের অভাব, তার সংরক্ষণকে কেন্দ্র করে রচিত ‘মেমরি অফ ওয়াটার’ (২০১৪)। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যের সমাহারে পূর্ণ নাইজেরিয়ান ডেল্টা প্রাকৃতিক তেলেরও ভান্ডার। ফলে তেলের খনি আবিষ্কার ও তার পণ্যায়ন সমুদ্রের জলকে, ডেল্টার ইকোসিস্টেমকে কিভাবে নষ্ট করে, তার আখ্যান ‘অয়েল অন ওয়াটার’ (২০১৪)। উক্ত শতকের গোড়া থেকেই আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে নানা ভাবে পরিবেশমূলক চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছিল জোনাথান স্কিনারের ইকোপোয়েটিকস পত্রিকায় (২০০১-০৫) কাব্যচর্চার মাধ্যমে। ক্রমে পরিবেশকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। 

গত ত্রিশ বছরের কিছু বেশি সময় ধরে ভারতীয় সাহিত্যের ‘ইকো টেক্সট’গুলি আলাদা করে জায়গা করে নিয়েছে। হিন্দি ও অসমিয়া সাহিত্যে পঞ্চাশের দশক থেকেই পরিবেশবাদী সাহিত্য রচনা শুরু হলেও ভারতে প্রাতিষ্ঠানিভাবে তা শুরু হয় ১৯৮০তে নির্মল সালভামনির ‘তামিল ইকো পোয়েটিক্সে’র মাধ্যমে (thinai/thinnai), ১৯৯৬ সালে তিনটি বুকলেট প্রকাশ করে তিনি ‘ইকোলিটারেচার’ চর্চা শুরু করেন। ২০০৫ সাল থেকে ‘অরগ্যানাইজেশন ফর দি স্টাডি অফ লিটারেচার এন্ড এনভায়রনমেন্ট (OSLE) প্রতিষ্ঠানটি ভারতীয় পরিসরে পরিবেশবাদী সভা, সেমিনারের আয়োজন ও লেখাপত্র প্রকাশ করতে থাকে। ক্রমে ভারতীয় পরিসরে বিবিধ ভাষার সাহিত্যে তার জোয়ার ছড়িয়ে পড়ে। বোড়ো লেখক নীলকমল ব্রহ্মের (১৯৪৪-১৯৯৯) ‘ভোঁতা তলোয়ার’ গল্পে অরণ্যসম্পদ ও প্রাণীরক্ষার দায়িত্বে থাকা বনমন্ত্রীকে খুশি করতে তারই খাবার পাতে শিকার করা গর্ভবতী হরিণের মাংস পরিবেশনের কথা পাই। পরিবেশ সঙ্কটের সঙ্গে বোড়োদের নিজস্ব অস্তিত্ব ও সংস্কৃতির সঙ্কট একত্রিত হয়ে এই গল্প আমাদের শেখায় পশুপাখি, গাছপালা, ঝড়-জঙ্গল, নুড়িপাথর ইত্যাদি সবকিছুই একসময়ে শেষ হবে ধরে নিয়ে আগে থেকেই তার ভোগলীলায় মেতে ওঠার জীবনচর্যা কখনোই কাঙ্খিত নয়। হিন্দি গল্পকার রামকুমারের ‘চেরী গাছ’ গল্পে ঠিকেদারেরা যখন একটি চেরী গাছকে ব্যবসায়িক প্রয়োজনে লাগায় তখন গাছের শূন্য শাখা কাঁপিয়ে নিঃশ্বাস নেওয়া যন্ত্রণায় সঙ্গ দিতে দেখা যায় একটি মেয়েকে, যে গাছ থেকে ফুল ফল না ছেঁড়ার শিক্ষায় বিশ্বাস করে) কৈলাস বনবাসীর (১৯৬৫) ‘এই সময়টা পাখিদের জন্য’ গল্পে (বহুপণ্যের বাজারে একজন ধানের ছড়া বিক্রেতা (নারী) কথককে জানায় যে ছড়াটি কিনলে পাখিরা ধান খেতে আসবে আর ক্রেতার পুণ্য হবে। পণ্যায়ন ও বিজ্ঞাপনের ভিড়ে নিমেষেই মাঙ্গলিক একটি ছবি নির্মিত হয় ও নারীটি প্রকৃতির প্রতিনিধি হয়ে ওঠে। পরমুহূর্তে একদল তোলাবাজদের বাহুবলে তার মত মাটির হাঁড়ি ইত্যাদি পসার নিয়ে বসা অন্য নারীদেরও পিষ্ট হতে দেখে কখকের মনে হয় এই সময়ে পাখিদের জন্য কেউ ভাবছেনা, তারা ভয়ে লুকিয়ে পড়ছে। সিন্ধী গল্পকার ঈশ্বর ভারতীর (১৯৪২) ‘পাখিরা’ গল্পে পাখিদের বাসা বানানোর কথা, সে বসতি তৈরিতে মানুষের সাহায্য করার প্রয়োজনীয়তা ও পশুপাখিদের প্রতি দয়া-মায়ার মত সুকুমার বৃত্তিকে জীবনচর্যার অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা আছে। 

ইন্দ্রা বাসওয়ানীর (১৯৩৬) ‘শুধুই জল’ গল্পে মহানগরের জনবিস্ফোরণ, তাদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে জলস্তরের ওপর বাড়তি চাপ ও অর্থের বিনিময়ে এই অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানা এক শ্রেণির মুষ্টিবদ্ধ হওয়ায় ঘরে ঘরে জলবন্টনে অসমতার কথা পাই। হিন্দি লেখক ফণীশ্বরনাথ রেণুর ‘পরতি পরিকথা’ (১৯৫৭) উপন্যাসে কোশী নদীর বন্যাকে সম্বল করে পতিত অনুর্বর গ্রামের উর্বরায়ণ ও বনায়নের প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে সেই জমি গ্রামের গরীব মানুষদের মধ্যে বন্টন করার প্রসঙ্গ আছে। কেন্দ্রীয় চরিত্র জিতেন এহেন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে গ্রামের বাস্তুতন্ত্র রক্ষার পাশাপাশি প্রকৃতিনির্ভর মানুষের উন্নতি নিশ্চিত করতে চেয়েছে, পরিবেশ ও উন্নয়ন যে পরস্পরবিরোধী না সেটা প্রমাণ করতে পেরেছে। রামদর্শ মিশ্রের ‘সুখতা হুয়া তালাব’ (২০১৬) উপন্যাসে দীঘি-পুকুরের ওপর নির্ভর করে থাকা গ্রামের ‘ইকোসিস্টেম’ ভেঙে পড়ার কথা আছে ভারতে জল সংরক্ষণের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী কৌশলগুলির অন্যতম স্থানীয় পুকুর শুকিয়ে যাওয়ার ফলে। গ্রামের আঞ্চলিক জল সমস্যার পাশাপাশি আগামী ভবিষ্যতে মহানগরীর জন্যেও যে জলসঙ্কট একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হয়ে উঠবে, সে সতর্ক বার্তাও এই আখ্যান দেয়) অসমিয়া লেখক মহিম বড়ুয়ার ‘এখন নদীর মৃত্যু’ গল্পে নওগাঁর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কলঙ্গ নদীর বক্ষে স্বার্থান্বেষী মানুষদের জন্য বাঁধ নির্মাণে নদীর ক্ষতি হওয়ার প্রসঙ্গ আছে। অপূর্ব কুমার শর্মার ‘বাঘে তাপুর রাতি গল্পে বাঘ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা, সচেতনতা প্রসঙ্গের পাশাপাশি প্রাণীবৈচিত্র্য বিলুপ্তিতে মানুষের ভূমিকা নিয়ে বলা হয়েছো গোবিন কুমার খাউন্ডের ‘রুময়াং’ (২০১৬) উপন্যাসে ভারতের ‘বনমানুষ’ খ্যাত যাদব পায়েং এর কথা আছে, যিনি কয়েক দশক ধরে ব্রহ্মপুত্র নদীর বালুকাময় তীরে গাছ লাগিয়ে তার যত্ন করে প্রায় একটি সংরক্ষিত অরণ্য গড়ে তোলে। 

অনুরাধা শর্মা পূজারীর ‘ইয়াত এখন অরণ্য আছিল’ (২০১৬) উপন্যাসটি গুয়াহাটির আমচাং রিজার্ভ ফরেস্ট উচ্ছেদের পটভূমিতে লেখা, এখানে মানুষ, প্রকৃতি ও নগর জীবনের দ্বন্দ্বের কথা আছে। এছাড়া প্রভাত গোস্বামীর ‘শুকুলা হাতির খোঁজ’ (২০১২) উপন্যাসে হাতি ও অসমের খিলঞ্জীয়া জনগোষ্ঠীর বর্তমান সঙ্কটাপন্ন পরিস্থিতি ফুটে উঠেছে। আধুনিক সভ্যতায় হাতি-মানুষ সম্পর্কে সংঘাতের মাঝে তাদের সহাবস্থানের দৃষ্টান্ত খাঁড়া করে হাতি সংরক্ষণের দায়িত্ব নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা আছে। পংকজ গোবিন্দের ‘চরাই চুবুরি’ (২০১৬) অরণ্য সংরক্ষণ ও ইকোট্যুরিজম নিয়ে লেখা। ইন্দ্র সিনহার ‘এনিমেলস পিউপল’ (২০০৭ সাল) উপন্যাস ১৯৮৪ সালে ভূপালের গ্যাস দুর্ঘটনা ও পরিবেশে তার ভয়ানক প্রভাবকে কেন্দ্র করে লেখা। বিদেশী পুঁজিতে নির্মিত কীটনাশক তৈরির কারখানা (ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেড) থেকে নির্গত ক্ষতিকর গ্যাস পরবর্তী কয়েক প্রজন্ম পর্যন্তও মানবশরীরে তার প্রভাবের চিহ্ন রেখেছিল। আখ্যানের কথক উল্লেখিত দুর্ঘটনায় কোনোক্রমে বেঁচে গেলেও বিষাক্ত পরিবেশের শিকার হয়, মেরুদণ্ড বেঁকে গিয়ে তার শরীরের সাধারণ স্বাভাবিক গঠনটি চারপায়ে চলা পশুর মত হয়। প্রকৃতি ও তার খেয়ালখুশিকে প্রযুক্তি কিভাবে হাতের মুঠোয় নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে, তারই দলিল বন্দনা শিবার ‘স্টোলেন হার্ভেস্ট’ (২০০০সাল) উপন্যাস। 

যে বীজ, ফসল, গাছ, জীববৈচিত্র্যের দায়িত্ব প্রকৃতির নিজের হাতে ও কিছুটা চাষী, অরণ্যচারী গোষ্ঠীর হাতে রক্ষিত হত, পুঁজিবাদ এবং কর্পোরেট মস্তিষ্ক সেসব চুরি করতে উদ্যত। সে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে বীজের পেটেন্ট প্রাপ্ত, ফলনশীলতা বৃদ্ধি করা ও সংরক্ষণের নামে প্রযুক্ত মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক, রাসায়নিক পদার্থ খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে পৃথিবীব্যাপী সব পরিবেশের সব ধরনের জীবজন্তুর উপর তীব্র প্রতিক্রিয়া ঘটাচ্ছে। অরণ্যের বৈচিত্র্য, তার মাটি- জল- বায়ুর স্বাস্থ্য সংরক্ষণের বিরুদ্ধে কাঁচামালের জন্য গাছ কেটে পাইন, ইউক্যালিপটাস জাতীয় গাছ রোপণে বনমহোৎসব পালন তার বিনোদন যাপন। গত একশো বছরে প্রকৃতির সঙ্গে পারস্পরিকতাহীনতায় জলের মত প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব ও বিপন্নতা তামিল লেখক চো ধরমনের (১৯৯২সাল) ‘সুল’ উপন্যাসে এসেছে। জল ও জলাশয়ের সংরক্ষণ, সঞ্চিত জলভান্ডারের যথাযথ ব্যবহারের দিকে নজর দেওয়া এ উপন্যাসের বিষয়। লক্ষ্মী কান্নানের (২০১১সাল) ‘মুনিয়াক্কা’ গল্পে সন্তানপরিত্যক্ত বিধবা এক নারী চরিত্রকে পাই, যে মালিকের বাগানের গাছগুলোকে শোভাবর্ধক সৌন্দর্য্যমাত্র মনে করেনা, বরং তারা সন্তানের প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠে। মালিকের দেওয়া ঘরের বদলে বাগানে কুঁড়ে ঘর তৈরি করে থাকে যাতে রাতের অন্ধকারে প্রকৃতির কালোর সঙ্গে মিলিত হওয়া যায়, গাছগুলোর মাথা হাওয়ায় উড়তে শুরু করলে তাদের জীবন্ত সত্তা বলে মনে হয় মুনিয়াক্কার। ‘নন্দনবন’ গল্পের বৃদ্ধ চরিত্রটি ঘন স্বাস্থ্যকর গাছপালা ও বিচিত্র ফুলের সামঞ্জস্যে তার বাগানকে নন্দন বনের মত সাজিয়ে তোলেন। সেখানে আসা চড়াই, কোকিল, ক্যানারি পাখির যত্ন ও ভরনপোষণও তিনি করে থাকেন। প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ এই বৃদ্ধের মৃত্যু হলে সন্তানেরা যখন সম্পত্তি নিয়ে ভাগবাটোয়ারাতে ব্যস্ত থাকে তখন ঐ পাখিরাই তার মৃতদেহ বহন করে নিয়ে যায় এবং লিলি, সালভিয়া, হিবিস্কাস ফুলেরা তার মৃত্যুর শোকসঙ্গীতে গলা মিলিয়ে স্বার্থপর সন্তানদের নীতিগত আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়।

বলা যায়, আজকের সময়ে এসে সচেতনভাবে নির্মিত পরিবেশবাদী কথাসাহিত্যের একটি বিস্তৃত ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। পরিবেশভাবনাকে কেন্দ্রে রেখে প্রকৃতি, সমাজ ও ব্যক্তি মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের সমগ্রতা নিয়ে বাংলায় এই ধরনের গল্পোপন্যাস রচনা শুরু হয়েছে গত ত্রিশ বছর ধরে। পরিবেশগত ভাবনাচিন্তার মূল কিছু প্রবণতায় নিম্নলিখিত উপবিভাগে ভাগ করা যায়-

  • পরিবেশের বহুমাত্রিক দূষণ, প্রজাতির বিলুপ্তি ও বাস্তুতন্ত্রীয় ভারসাম্য বিনষ্টির ভয়াবহ বর্ণনা পাই—ক. কিন্নর রায়ের (১৯৫৬—) ‘অনন্তের পাখি’, ‘মেঘচোর’ (২০০৬); স্ব

খ.  স্বপ্নময় চক্রবর্তীর (১৯৫১—) ‘শনি’, ‘ফুল ছোঁয়ানো’; 

গ.  অমিতাভ সমাজপতির ‘জলঙ্গি’ (২০১২); 

ঘ.  অমর মিত্রের ‘কলসপুর যাইনি’ (২০২০), ‘বিভূতিবাবুর দেশ’ (২০১১) ;

ঙ.  অশোক তাঁতীর ‘ফুলেরা যেভাবে ফোটে’ (২০১০); 

চ.  জয়া মিত্রের (১৯৫০—) ‘দুই উদয়ের গল্প’; 

ছ.  সুকান্তি দত্তের ‘লেবুপাতার ঘ্রাণ’ (১৯৯৮); 

জ.  গৌর কারকের ‘ময়ূরের ডিম’; 

ঝ.  শুভংকর গুহর (১৯৫৬—) ‘ঋতুবদলের মরশুমে’, ‘পাখিরঙের বিশ্রামখানা’র (২০২০) মতো গল্পে। শত রোগের জীবাণু দেহে ধারণ করে সুকান্তি দত্তের (১৯৬৫—) ‘বিষমানব’ বিদ্রূপ করে তৃতীয় বিশ্বের পরিবেশ দূষণ, সচেতনতা-স্বাস্থ্যবিধি ও পরিচ্ছন্নতা নিয়ে আয়োজিত শৌখিন পরিবেশ সভাকে।

  • প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস ও অপচয়ের বিরোধিতায় ভোগের চরিত্র পরিবর্তনের প্রয়াস পরিলক্ষিত হয় ক. কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘তেষ্টা’ (২০১৯); 

খ.  অরিন্দম বসুর ‘শীতকাল আসবেনা’; 

গ.   সুকান্তি দত্তের ‘অযৌক্তিক আগাছা’ (২০০৮); 

ঘ.   শেখর বসুর ‘গাছ-মানুষ’ (১৯৮৬) গল্পে। 

  • প্রতিবেশ সংরক্ষণে বিকল্প ব্যবস্থা অনুসন্ধানের সুর আছে 

ক. অরিন্দম বসুর (১৯৬৭—) ‘পাখি সব’; 

খ.  চিরঞ্জয় চক্রবর্তীর ‘জটায়ু’ (২০১৯) গল্পে। 

গ. সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের (১৯৬৭—) ‘পবিত্র বাগান’ গল্পে বটানির প্রফেসর সরস্বতী নদীর পলি পড়া উর্বর জমিতে কীটনাশক বা রাসায়নিক সারহীন ঔষধি গাছ ফলাতে গিয়ে দাবি করেন, যথার্থ অর্থে মানবসভ্যতার উন্নয়ন নতুন করে তার নার্সারি থেকেই শুরু হবে। 

ঘ. সোহারাব হোসেনের ‘হ্যাঁ মানুষ অথবা কাকতাড়ুয়া’ গল্পের (২০০৫) প্রধান চরিত্র ধন্বন্তরি কবিরাজ হতে গিয়ে ‘বাংলার গাছ’ হয়ে ওঠে। এ ধরনের জীবনদর্শনগত উত্তরণ পরিবেশবাদের আদর্শ প্রভাবিত।

  • উদ্ভিদ বা প্রাণীর সংরক্ষণে প্রকৃতির নিজস্ব অধিকারের দাবিতে 

ক. প্রতিভা সরকারের ‘প্রেম’ (২০২০) 

খ.  মাহবুব লীনেনের ‘বনমজুর’ (২০২১) গল্পদুটি সমৃদ্ধ। 

প্রাণী সংরক্ষণ আইনের ফাঁক গলে হাতি, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের শিকার আর ‘বডি পার্টস’ পাচার, ক্রমাগত হরিণেরও চোরাশিকারে বাঘেদের সঙ্কটমুখী ‘সার্ভাইভাল রেট’ প্রসঙ্গের পাশাপাশি ‘প্রেম’ গল্পে পারুলের মতো চরিত্রেরা শেখায় আলোয়-বাতাসে-অরণ্যে-শস্যে সকলের সমান অধিকারের স্বীকৃতি।

  • প্রকৃতিলগ্ন সংস্কৃতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ পুনরুদ্ধারের সুর প্রধান হয়ে ওঠে 

ক. মন্দাক্রান্তা সেনের (১৯৭২—) ‘মালী’; 

খ.  বরুণ মাইতির ‘অ’ (২০১৯); 

গ.  অসীম ত্রিবেদীর ‘সিদ্ধান্ত’; 

ঘ.  অনিন্দিতা মন্ডলের ‘হেরে যাওয়ার গল্পে’ (২০২১)। 

  • পুঁজিবাদী উন্নয়নের স্বার্থে প্রাকৃতিক উপাদানে সমৃদ্ধ এলাকার জলবায়ু-উদ্ভিদ-পশুপাখির জীবনকে নষ্ট না করে তাকে সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে কেন্দ্রীকৃত করা এবং মানুষকে তার প্রতিবেশের সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ায় বাস করতে প্রভাবিত করার পরিকাঠামো রয়েছে 

ক. সমরেশ মজুমদারের ‘হে বৃক্ষনাথ’ (২০১৬); 

খ.  সীমা রায়ের ‘গাছটা’ (২০১৬), 

গ.  তিলোত্তমা মজুমদারের ‘বিকেলের আলো’ (জন্ম ১৯৬৬), 

ঘ.  সমরেশ মজুমদারের ‘জলের প্রাণ’ (২০১৮) গল্পে। 

  • নিসর্গ-নারীবাদী ভাবনা প্রভাবিত গল্পগুলির মধ্যে 

ক.  রাধা ভটের ‘অন্নের ব্যবস্থা’, 

খ.  সরোজ দরবারের ‘কি ভুলেছি কেন ভুলেছি’,

গ.  জয়া মিত্র’র ‘উন্নয়ন ও ঘরের লক্ষ্মী’, 

ঘ.  হর্ষ দত্ত’র ‘শিবানীতলার নদীজীবন’, 

ঙ. ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়ের ‘তাতারসি’,

চ.  সাধন চট্টোপাধ্যায় ‘ভাদ্রের গোধূলি-লগন’ গল্পগুলি।

এছাড়া গৌর বৈরাগীর ‘জবরদখল’, সুবীর মজুমদারের ‘স্বজনে’র মত গল্পে প্রাকৃতিক উপাদানের গুরুত্ব পুঁজির নিরিখে নয়, বরং বাস্তুতন্ত্রীয় ভারসাম্য সংরক্ষণের ভূমিকায় নির্ধারিত।  প্রতিভাস ম্যাগাজিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *