শরদিন্দু সাহা
লেখক পরিচিতি
বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।
বিষয় পরিচিতি
(রেভারেন্ড জেমস্ লঙ যে লক্ষ্য স্থির রেখে জীবনকে চালনা করেছেন তা শুধুমাত্র ঘটনাক্রম দিয়ে ধরা যায় না। তাঁর কর্মজীবনের পরিক্রমায় যে অন্তর্নিহিত শক্তি ও প্রভাব রয়েছে তাকে কোনও এক শিল্প মাধ্যম দিয়ে উপলব্ধি করা যায় না। কারণ কোনো সরলরেখায় তিনি তাঁর কাজকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, নানা উত্থান পতন ঘাত প্রতিঘাত তাকে পীড়িত করেছিল, বিপর্যস্ত করেছিল। তিনি প্রবল আত্মশক্তিতে তার মোকাবেলা করেছিলেন এবং কর্তব্যকর্মে অটুট ছিলেন। তাঁর কাজের পরিধি ও ব্যাপ্তি একজন শিক্ষকের, সমাজসেবকের, মানবপ্রেমির যা মূলত শাসক ও শোষিতর মাঝখানে একজন প্রতিবাদীর, সত্যবাদীর, বলা যায় একজন দ্বান্দ্বিক ব্যক্তিত্বের। যার না-বলা কথা, জানা-অজানার কল্পনা ও বাস্তবের মিলন নিয়ে উপন্যাস লেখা সম্ভব অসম্ভবের দোলাচল মাত্র, তবুও শব্দের মায়ায় ধরার সামান্য প্রচেষ্টা। কোথায় তার অন্ত হবে প্রকৃত অর্থে বলা খুব কঠিন। এই মহান মানুষটির শৈল্পিক জীবনকে ছুঁয়ে যাওয়া আর কি।)
পথের আবার কত রঙ
উইলিয়াম কেরি, জোশুয়া মার্শ ম্যান, উইলিয়াম ওয়ার্ড শ্রীরামপুর ত্রয়ীর কর্মযজ্ঞ নিয়ে আমাকে প্রভাবিত করে রাখে সারাক্ষণ। সমাজ সংস্কার, গদ্য পাঠ্য পুস্তকের প্রবর্তকের ভূমিকা, সাপ্তাহিক সংবাদ পত্রিকা ‘সমাচার দর্পণ’ প্রকাশ সমাজের ভীতকে নাড়িয়ে দিয়েছে, অভিমুখকে ঘুরিয়ে দিয়েছে ভিন্ন খাতে এবং আমার ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নির্ধারণের পথে ওদের চিন্তা চেতনা স্ফূলিঙ্গের মতো হাজির হয়েছে। ভেবে ভেবে অস্থির হই কত কিছুই করা বাকি। কত বাধা বিপত্তি মাকড়সার জালের মতো জড়িয়ে রেখেছে। কাকে জানাবো সেসব কথা। এগিয়ে যাওয়ার দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়ার লোকের তো অভাব নেই। সকলে যেন খড়্গ হস্ত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কীভাবে দমিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু আমার শিক্ষা আমাকে কিছুতেই পিছিয়ে দিতে দেয় না, কানে কানে বলে অপূর্ণকে পূর্ণ করাই তো প্রজন্মকে উদ্দীপিত করবে, থেমে থাকলে চলবে কেন। কিছু শব্দবন্ধ আমাকে ভাবিয়ে তোলে – ‘হোয়াইট টাউন’ আর ‘ব্ল্যাক টাউন’। আমি নিজেকে নিজে প্রশ্ন করি কথাগুলো কি নিছক বলার জন্যই বলা, নাকি অনেক সময়ের জমে থাকা ঘৃণা বিদ্বেষ, অপমান এই দেয়ালকে মজবুত করেছে। একে ভেঙে চুরমার করে ফেলা এত সহজ কাজ নয়। এমন ভাবনাও মনের মধ্যে উঁকি মারে – সভ্যতাই কি তাহলে সভ্যতার শত্রু!
সাদা শহরের চারদিকে এত কথা, এত যত্ন, এত জিজ্ঞাসা, এত আলোর ছটা। ওরা কি প্রমাণ করতে চায় ওরা কতটা উঁচু, কতটা ভিন্ন, কতটা জ্ঞানী, ওদের রক্তের স্রোত কত দ্রুত বয়ে চলে। হবে হয়তো অন্যকে পেছনে ঠেলে এগিয়ে যাওয়ার অভ্যাস তো আয়ারল্যান্ডেই দেখেছি, শিখিনি, আত্মস্থও করিনি, শুনেছি কত শব্দের নানা তরঙ্গ, নানা স্বর, নানা অনুভব। কোনটা গ্ৰহণ করব, কোনটা বর্জন করব, এই বোঝার মধ্যে কোনো ফারাক ছিল, না হলে আজও এত দ্বিধা দ্বন্দ্ব কেন? সময় কি সত্যিই মানুষকে কিছু শেখায়, না সংশোধন করে আপন নিয়মে, এই প্রশ্ন আমি করতে চেয়েছি, পারি নি, সংকোচ কাজ করেছে যদি আসল কথাটা চাপা পড়ে যায়। ওরা টগবগ করে ঘোড়া ছুটিয়ে যায়, দাপিয়ে বেড়ায় নিজের সাম্রাজ্যে। এমন দাম্ভিকতা ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে যেন মিলিয়ে যায়। বুঝতে পারি নি আসলে কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যার আড়াল। সাদা শহরের এমন কীর্তি চাক্ষুষ করে বিস্মিত কী হই নি, হয়েছি, চলে এসেছি গলি পথ দিয়ে মোড়ে মোড়ে, এখনও জানতে পারি নি আমি কোন পথ দিয়ে হেঁটে গেলে সকল ধোঁয়াশা কাটিয়ে উঠতে পারবো।
কালো শহরের মানুষগুলোর মুখ যেন আমি ঘুমের মধ্যে দেখতে পাই। কী যন্ত্রণা নিয়ে ওরা বেঁচে আছে। বাঁচার আনন্দ আছে কিনা জানিনা তবে কখন কবে এসে মৃত্যুর কালো ছায়া ওদের গ্ৰাস করবে কী জানি। কারা যেন ওদের পিছু পিছু হেঁটে বেড়ায়, টের পায় না এমন নয়, কুঁকড়ে যায়, ভবিতব্য মনে করে কিছু ঘটনা ঘটার আগেই ছায়াকে মাড়িয়ে দিয়ে চলে যায়। নিজের কাছে নিজের পরাজয় হবে জেনেও নিজেদের ভুবনের ভিন্নতা নিয়ে দেখতে পায় দক্ষিণের মানুষগুলোর ছলচাতুরি কলাকৌশল। বাগবাজার স্ট্রিট, মাছুয়াবাজার স্ট্রিট, বউবাজার স্ট্রিটের হুঁকাবরদার, খানসামা, গোমস্তারা চেয়ে চেয়ে দেখে – ওরা ওদের মতো, ওদের কথা কেন আমাদের কথা হতে যাবে। দিনে দিনে দূরত্বটা বেড়েই চলেছে, তাই তো কথার পিঠে কথা সাজাতে এত অস্থিরতা, এত গোলমাল। কেউ কেউ সীমানা পার করে যেতে চায় না এমন নয়, চোখে সর্ষে ফুল দেখে, মাথা বনবন করে ঘোরে, ভাবে এই আবার কী আজব জগত, ঝাঁ চকচকে বাড়ি ঘর, ঘরের মধ্যে আরও কত ঘর, আসবাবপত্র সাজিয়ে গুছিয়ে দিব্যি আরাম আয়েশে হাত পা ছড়িয়ে আদুরে জীবন। ফিরে যে তাকাবে, এমন কথা উঠছে কেন! বলে তো কত কথা – চুপ মেরে যাও, চোখ তুলে তাকাবার দুঃসাহসটা করো না। ধরতে চাইলেও ধরা যায় না, পিছল খেয়ে হাত ফসকে চলে যায়। এত রঙ চঙ মেখে থাকলে কেই বা কাকে চিনতে পারে! তাই বলে হোয়াইট টাউনে ঢুকে পড়ে না এমন তো নয়। ধমক খেয়ে সুড়সুড় করে পালিয়ে বাঁচে। ওদের খিদমদগারি খাটবে বলেই না মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা। কোথায় যাবে, কেন যাবে এই প্রশ্নগুলো ঠোঁটের কোণে এসে আটকে যায়। বাবুলোকদের সেই বালাই নেই, পাখির চোখ করে রেখেছে বলেই না এত সুখ, এত মজা, চুলোয় যাক ওই হাভাতের দল। শিঙ ভেঙে বাছুরের দলে নাম লিখিয়েছে বলেই না এত জৌলুস, না হলে কে আর বেজাতের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে আরাম কেদারায় শরীর দোলায়। ‘ জেলে, দুলে, বাগাদী অজাত কুজাতদের গায়ে গন্ধ, চুলে চুলে জট পাকানো, মুখ ভর্তি দাড়ি গোঁফ, যদি ঢুকে পড়ে, কুকুর লেলিয়ে দিয়ে ব্ল্যাক টাউনের শেষ সীমানায় ঢুকিয়ে দে। থাকুক না আমাদের তোষামোদি করে, এঁটোকাঁটা খাক, না হলে আমাদের কী তৃপ্তি হয়!’ কথাগুলো গড়গড়িয়ে বলে গেল নব্য বাবুটি।
‘এত আনমনা হয়ে পথ চললে কাজের কাজ কিছু হবে সাহেব-বাবা? আমাদের এখানে এত অন্ধকার, আলোর ছিঁটেফোঁটাও পড়ে না। হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়বেন যে।’ ছাতা-সারাইওয়ালা সুঁচে সুতো ঢোকাতে গিয়েই আমাকে একপ্রকার সাবধান করে দিল। ভাবলাম,কত কিসিমের মানুষ আছে দুনিয়ায়। আমি অনাত্মীয় বিধর্মী বই তো নয় কিন্তু তবুও যেন কতকালের চেনা, না-হলে কোনো হিসেব নিকেশ না করেই কথাগুলো বলে ফেলতে পারল চোখের পলকে। জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি এই শহরের মানুষ? মানুষটা হেসে বলল, ‘আমি এই শহরের মানুষ নই, আপনাকে কে বলল! এতদিন ধরে এই শহরে আছি, এইটুকু বুঝব না।’ পাশাপাশি বসার ইচ্ছাটা দমন করতে পারলাম না। জানতে চাইলাম কেন শব্দগুলো এমন অগোছালো আর টেনে টেনে বলছ, ষোলো আনা বাঙালি। হয়তো আমাকে খুশি করার অদম্য ইচ্ছা পেয়ে বসেছে। নিজের জায়গা থেকে সরে এসে একটু পিছলে গেলে টের পাওয়া যাবে না, এমন একদিন আসবে নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। আমার নীরবতা ওর অস্বস্তির কারণ হলো। ছাতা সারাইয়ের সুঁচ সুতো একপাশে সরিয়ে রেখে ও এবার আলাপ জমাবার চেষ্টা করতে লাগল। কী জানি হয়তো মনে করেছে সাহেব সুবোদের সঙ্গে কথা চালাচালি করলে লোকজন একটু সম্ভ্রমের চোখে দেখবে। ওমা ও তো সম্পর্ক পাতাবে বলে ওর বসার কাঠের পিঁড়িটা আমাকে দিয়ে নিজে পা ছড়িয়ে মাটিতেই বসে পড়ল। এখানে কোথায় যে যান চলাচলের রাস্তা আর কোথায় যে ফুটপাত বোঝা মুশকিল। কী জানি আমার ইচ্ছা হলো আর একটু ওকে ভেতর থেকে জানতে। নিজের কথাগুলো ও যে আমাকে গড়গড় করে বলবে, তার তো কোনো গ্যারান্টি নেই কিন্তু আমার যে না জানলেই নয়। একজন ঝালমুড়ি বিক্রেতা নিজে থেকে নাম ধরে ডাকল, ‘ও সুবোধ খাবে নাকি এক ঠোঙা? আরে খাও খাও, আপনি বাঁচলে বাপের নাম। খুব যে পাদ্রী বাবাজির লেজুর ধরেছ, মতলব খানা কী? যতই তোষামোদি করে, ওদের পাড়ায় গেলে কিন্তু দূর দূর করে তাড়াবে।’ শুনে তো আমি থ বনে গেলাম। তাহলে এই দেশের সাধারণ মানুষরা আমাদের নিয়ে এমন ধারণাই পোষণ করে! কিন্তু এ-ও আমি জানি উচ্চ শিক্ষিত বাঙালি বিদ্যাসাগর আর কেশব সেন বাবুদের মন পেলে তো হবে না আমার, এদেরও মনের হদিস আমাকে জানতে হবে। কথা তো ওরা বলে, কেমন ঢঙে ওরা বলে, চলাফেরা করে নিজের মতো, গটগট করে চলে যায়, বিড়বিড় করে আপন মনে ধাপে ধাপে চলে, লাফিয়ে লাফিয়ে এমন করে চলে যেন একজন অন্যজনের ঘাড় মটকে দেবে।
দূরে, ওই তো আরও দূরে, আমার দৃষ্টি পৌঁছচ্ছে এমন এক স্থানে, উঁচু নিচু আঁকাবাঁকা। কোন পথ দিয়ে এসে আস্তানা গেড়েছে কি জানি। কেন এই জায়গাকেই বেছে নিল, ওরা নিজেরাও কী জানে। অদ্ভুত লাগল আমার, ইচ্ছে হলো কোথায় যেন নিজেকে মিশিয়ে দিতে পারলে প্রাণ বাঁচে। দেখতে দেখতেই প্রশ্ন জাগছে, কোন পথ দিয়ে হাঁটব, কেমন করে হাঁটব, এই পথ তো আমার চেনা নয়, এই স্থান তো ভিন্ন স্থান, কিন্তু অদ্ভুত সব গন্ধ নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে। এই গন্ধের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে বই কি। হাজার হাজার মাইল দূর থেকে ভেসে আসছে যেন এক ভারী বাতাস আমাকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে, নিজেকে সামলাতে পারছি না। কিন্তু এই দৃশ্য আমি দেখিনি। মানুষের বাসের ঘর এরকম হতে পারে! হয়তো পারে, জীবনভর চলতে চলতে ওরা শিখে ফেলেছে। দারিদ্র দেখেছি, বাস্তুচ্যুতও হতে দেখেছি, অত্যাচারীদের নৃশংস রূপও দেখেছি কিন্তু এমন দৃশ্য কদাপি দেখিনি কিন্তু দিনের গনগনে রোদের হলকায় কাউকে ভ্যান রিক্সার উপরে পড়ে পড়ে ঘুমোতে দেখিনি। হাঁড় সর্বস্ব রোগা প্যাটকা কালচে শরীরটা নিয়ে দলা মোচড়া হয়ে মশারীর ভেতরে ভোঁস ভোঁস করে পড়ে থাকতে মানুষ পারে! কুকুর যখন রোদের জ্বালায় লকলক করে জিভ নাড়ে, মানুষ কী করে না-মানুষ হয়ে যায়! যত কাছে যাই, মানুষটার চেহারার এক একটা অংশ প্রকট হতে থাকে। কত ফুসকুড়ি খোস প্যাঁচড়া উদোম গায়ের বুকে পিঠে দগদগে ঘা নিয়ে গোটা শরীর। পথচারীদের বয়েই গেছে ফিরে তাকাতে। একবার দুবার দেখে নিয়ে রাস্তার উল্টো দিকে থু থু করে ঘাড় ঘুরিয়ে মাথার চুল ঝাঁকিয়ে জোরে পা চালিয়ে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। লোকটা আমায় দেখে পিটপিট করে আবার পাশ ফিরে শুলো। আমি মশারিটা উল্টিয়ে কথা যেই না বলতে যাবো, রে রে করে কোথা থেকে ছুটে এল মাঝবয়সী এক মহিলা। ও যেন আমায় দেখে ভুত দেখল। ‘কী কর কী কর সাহেব বাবা, ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না, ওর ওলাওঠা হয়েছে।’ হতভম্ব হওয়া ছাড়া আর কি কোনো উপায় ছিল! এমন করে রাস্তায় রোগের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, লোকটা মাঝে মাঝে জিভ বের করলে মেয়েটি দোমড়ানো গ্লাস থেকে একটু একটু করে জল মুখে দেয়, ভাবখানা এমন করে প্রাণটুকু বের হতে গিয়ে বোধ হয় থমকে গেল, জীবন থেকে আর একটু সময় কিনে নিল যেন। মেয়েটি থেকে থেকে মশারিটা এমন করে গুঁজে দেয় যেন মশা মাছি গলতে না পারে। দু’একটা বেড়াল ফাঁকতালে মশারির চারপাশে মিঁউ মিঁউ করে। ওর হয়তো কত কিছুই না বলার আছে। দু’একটা ধেঁড়ে ইঁদুর কী মনে করে ফুরুত করে ওপাশের রাধাচূড়া গাছের গোড়া থেকে ভ্যান গাড়ির পেছনে এসে লুকিয়ে পড়ে।
মানুষদের কেন যে ওদের এত ভয়! টানা রিকশাটা ঠনঠন আওয়াজ করে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে গেল। মানুষটাকে চেনা চেনা লাগছে, কোথায় যেন দেখেছি, মনে করার চেষ্টা তো করলাম। তবে কিনা পোশাক আশাকে এইটুকু নিশ্চিত হলাম উনি ব্ল্যাক টাউনেরই বাসিন্দা। আগ বাড়িয়েই বলল, ‘ চিনতে পারলেন না বুঝি। তা পারবেনই বা কেন? আমি তো আর আপনার মতো গড়গড় করে বাইবেলের পাতার পর পাতা মুখস্ত বলতে পারব না। কোনও সভা সমিতিতে চেয়ার দখল করা লোকও নই, নেহাতই ছাপোষা গাঁ গঞ্জের লোক, কলিকাতা শহরে উড়ে এসে জুড়ে বসেছি।’ নিজেকে অপরাধীই মনে হলো। আসলে নিত্য এত লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, অনেক মুখই মন থেকে মুছে যায়। আমি মানুষটা যে এতটা অধম আগে কখনও ভাবিনি। মাথা ডানে বাঁয়ে ঘোরাতে ঘোরাতেই মনে পড়ল। ছি ছি, নিজেকে নিজে দুষেও নিস্তার পেলাম না। বললাম, গঙ্গার ঘাট থেকে ফিরলেন বুঝি। উনি মুচকি হেসে বললেন, ‘আমার পাপের বোঝাটা এতটা ভারি হয়ে যায় নি যে, গঙ্গায় ডুব দিয়ে হালকা করতে হবে। আপনারা ধর্মযাজক মানুষ, বরঞ্চ আপনাদের মতো মানুষদের সঙ্গে দুদণ্ড কথা কথা বললে মনের তৃপ্তিটা দ্বিগুণ বাড়ে।’ নামটা মনে না পড়লেও উনি যে কৃষ্ণনগরের পাঠশালার হেডমাস্টার মশাই, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আপনার সংস্কৃতের উপর ব্যুৎপত্তি দেখে আমার চক্ষু তো চড়কগাছ। ‘ আপনিই বা কম যান কীসে! কোনও সাহেবকে তো দেখলাম না আমাদের ভাষাটাকে এত চটজলদি রপ্ত করতে। লোকে বলে আপনি তো আর সাদা চামড়ার মানুষ নন, বাঙালিরা সাহেব হওয়ার জন্য হাঁকপাক করলেও আপনি কত সহজে বাঙালিদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন।’ কী যে বলেন, বিদ্যাসাগর মশাই যেভাবে সমাজসেবা করছেন, আমি তার এক ফোঁটাও করতে পারি নি। তবে হ্যাঁ, এখানকার মানুষের বড় একটা গুণ আছে, কত সহজে মানুষকে আপন করে নেয়। ‘এই কথাখান আপনি একটুও বাড়িয়ে বলেন নি কিন্তু জানেন সাহেব-বাবা, এরা বড় দুঃখি, এদের কষ্টের কথা বোঝার মতো লোক এই বঙ্গদেশে কজনই বা আছে।’ আমি স্তম্ভিত হয়ে ওনার কথা শুনলাম। কী এর জবাব দেব বুঝে উঠতে পারলাম না। কত কিছুই তো এদের পাওয়ার আছে, কিন্তু মিলে কই! কত পুরুষ ধরে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। অথচ দুনিয়াটা পাল্টে যাচ্ছে দ্রুত, এদের কোনো হেলদোল নেই। কেউ বুঝতে পারে তো বাকিরা মুখ ফিরিয়ে নেয়। চড়া রোদের জ্বালায় একটুখানি ছায়া খুঁজছিলাম। ছায়াটা এতক্ষণ বেশ দলা পাকিয়ে ছিল, মুহূর্তেই যেন ভেঙেচুরে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি মেঘেরা কেমন ছেঁড়া ছেঁড়া, পাগল হয়ে ঢেকে দিচ্ছে কারও বাড়ির ছাদ, গলির মুখে কৃষ্ণচূড়া, চামেলী আর জুঁই গাছের ছায়া। মনে হলো, এই আকাশটা কত চেনা, চুপ মেরে থেকে ভেলকি দেখায়। হেডমাস্টার মশাই যাবার সময় কত কী যে বলে গটগট করে চলে গেলেন। বোধ হয় আর এক প্রস্ত আমন্ত্রণ জানালেন। মনে মনে ভাবলাম আহুত কী অনাহুত কিছুতেই কিছু আসে যায় না। যেতে আমাকে হবেই। পৃথিবীটাকে ছোট করে দেখলে চলবে না, এক জায়গার গরিমা অন্য জায়গায় না ছড়াতে পারলে সকল রূপ রস গন্ধ যে বৃথা হয়ে যাবে, পর পরই থাকবে, আপন হয়ে অন্য কারও বাড়ির দরজায় কড়া নাড়বে না কোনদিন। বুঝতে পারছি ক্রমশ আমার মনটা ছুটে বেড়াতে চাইছে, দু’হাতে জড়িয়ে ধরতে চাইছে সামনে যতদূর চোখ যায়। রাস্তার ধারে ঝুপড়িটা ডান দিকে একটু হেলেই ছিল, কিশোর কিশোরীরা কড়ি খেলছে। ওদের মুখ চোখ শুকনো হলেও হাসি ঠাট্টা তামাশার অভাব নেই। কে এল, কে গেল, ওদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। জিজ্ঞেস করলাম আমাকে তোমরা খেলায় নেবে। ‘ধ্যাৎ, তুমি হলে কত্ত বড় মানুষ, তুমি খেলবে আমাদের সঙ্গে?’ ওদের বাবা কাঠের গোলায় কাঠ চেড়াইয়ের কাজ করে, মা বাবুদের বাড়িতে ঝিগিরি করে। কেউ এমন নেই যে দেখভাল করে। জানতে চাইলাম তোমরা লেখাপড়া শিখবে? ওরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। আমার ঝোলা থেকে একটা বই বের করে ওদের সামনে রাখলাম। ওরা কিছুক্ষণ পাতা উল্টিয়ে গিলে খেল যেন এমন জিনিষ বাপের জন্মে দেখে নি। বললাম, তোমরা আমার পাঠশালায় পড়বে? এক প্রস্ত হেসে নিয়ে বলল, ‘বড্ড খিদে পেয়েছে, চারটি মুড়ি দেবে গো, সেই রাত্তিরে খেয়েছি।’ কষ্টে বুকটা আমার ফেটে গেল। দুই একজন পথচারী যেতে যেতে বলে গেল, ‘ওই দেখ পাদ্রীটা কেমন ছেলেমেয়ে দুটোর মাথা খাচ্ছে। খেষ্টান বানাবার ধান্দা। কাগজে তো পড়লুম, হিন্দুদের ভুজুং ভাজুং দিয়ে পাদ্রীরা ধরে ধরে নাকি যিশুর চেলা বানাচ্ছে।’ কথাটা শুনে ক্ষণেক থম মেরে রইলাম। কথা তো নয়, মনের ভেতরে কারা যেন ভারী ভারী পাথর চাপিয়ে দিয়ে চলে গেল।
ব্ল্যাক টাউনে যে পুকুর আছে তা তো জানতাম না। পুকুরের জলে কচুরিপানায় ঢেকে গেলেও দু’চার জন ছেলে এপার ওপার করে জলে ডুব মারে। কচুরিপানা দু’হাতে সরিয়ে সরিয়ে ওদের দামালপনা চলতেই থাকে। শহরের এমন রূপ আমি আগে কখনও দেখিনি। পাড়ের সিঁড়িটায় বসে বসে ভাবলাম কিশোর কিশোরীর রঙ ঢঙ সব দেশেই সমান, আলাদা করতে চাইলেও কী আলাদা করা যায়? পাড় থেকে সামান্য দূরের রাস্তায় লোকজন ইতঃস্তত চলাফেরা করছে। আহা! কত মানুষ আসে, কত মানুষ চলে যায়। ঐ তো একবার মুখখানি দেখা, আর তো কোনদিন হয়তো দেখা হবে না, হারিয়ে যাবে নিজের মতো করে জনসমুদ্রে। মনে হলো হাজার বছর ধরে মানুষ হাঁটছে, হাঁটার কোনো বিরাম নেই। কত গল্প, কত শব্দ মনে আওড়াতে আওড়াতে সময়কে পেছনে ফেলা। দুই একজন আমার বসার ভঙ্গি দেখে টিপ্পনী কাটে। জানতে চাই তো কত কথা, ওদের সুখ দুঃখগুলো, সবই দলা পাকিয়ে চোখমুখে অজানা আতঙ্কের রেখাগুলো ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে শহরের অলিগলিতে। হাঁটা ছাড়া বিকল্প কোনো পথই তো কারো সামনে খোলা নেই। কারা ওই মানুষগুলোর জীবনের অঙ্কগুলো হিসেবের খাতায় তুলে রাখে, এর উত্তর আমাকে জানতেই হবে। ব্ল্যাক টাউনের ঘর গেরস্থালির খোঁজ রাখার ইচ্ছা সত্যি কী কারও আছে? অথচ ওরা কী ভাবে, কেমন করে ভাবে, আদৌ ওদের ভাবনার কোনো সারবত্তা আছে কিনা তাই বা কে জানে। যে নতুন ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে তাতে ওদের মনে কোন বুদ্বুদ তৈরি হচ্ছে কিনা আমি তো জানতেই পারি না। জানার কিন্তু সময় হয়েছে। ওদেরকে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে না পারলে সবটাই কেমন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
কে এই মানুষরা? দেখার আগ্ৰহে সকল অনুভবকে ভেঙেচুরে এক পা দু’পা করে এগিয়ে গেলাম। বুঝতে গেলেই কত ভাবনারা এসে জাঁকিয়ে বসে। রামতনু লাহিড়ী, রামগোপাল ঘোষ ও কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়রা গল্পগুজবে মাতোয়ারা হয়ে দু’পাশের ঘরবাড়ির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে একে অপরকে এই শহরের হাল হকিকত বোঝাচ্ছেন। নতুন করে আছড়ে পড়া ঢেউগুলোকে কী করে সামাল দেওয়া যায়, তাই নিয়ে ওদের কথা চালাচালি। কী করে শূন্যস্থানগুলো পূরণ করা যায় সেই নিয়ে তো যত মাথাব্যথা। তা তো বটেই। কত কাজই তো অসম্পূর্ণ অথচ সময়ের অপূর্ণতা প্রতি মুহূর্তে বুঝিয়ে দিচ্ছে – চলো, চলো, চলো, আরও জোরে পা চালাও। ঘরের দরজা জানালাগুলো ওরা বন্ধ করে রেখেছে, জোরে ধাক্কা মারতে হবে, ওদের টেনেটুনে বের করে আনতে হবে। কী অসম্ভব প্রতিজ্ঞা নিয়ে ওরা ময়দানে নেমে পড়েছে। যত ভাবি ওদের কাছে গিয়ে মনের কথা জানি। এই ভাগাভাগির শহরটাকে জোড়া লাগাই। হাত ধরাধরি করতে চাইলেও করা যায় না, ওরা দু’পা এগিয়ে যায় তো আমি থমকে দাঁড়িয়ে যাই। খালি মনে মনে ভাবি আর একটু সময় নিয়ে এই জগৎটাকে দেখি – কী রহস্য লুকিয়ে রয়েছে এই মাটির গর্ভে, খুঁড়ে খুঁড়ে দেখতে দোষ কী! ওরা পিলপিল করে এগিয়ে আসে, নিজেদের অবস্থানকে চিহ্নিত করে চলে, কতটুকু ধরার চেষ্টা করে, নাকি ধরতেই চায় না। না তা হবে কেন? কতজন তো মুখিয়ে রয়েছে নিজের কথাগুলো বলবে বলে। কেউ অর্ধসত্য বলছে, কেউ বলে বেড়াচ্ছে ছাপোষা মানুষগুলোর মনের কথা, কিন্তু জোড়া তো লাগছে না। ওই তো যে মানুষটা ঘরের এক কোনায় বসে রয়েছে, সাইকেলের টায়ার নিয়ে যত কাজ কারবার, ওখানে মাঠের পর মাঠ ছিল, ফসল তোলার মোচ্ছব লেগে যেত চারপাশে, সারি সারি কলাবাগানের পাতার পত পত শব্দ আর দিঘির জলে নেচে বেড়াত মাছ, সাপ ব্যাঙ আর জলপোকারা। এই সবই চোখের দেখা দেখিনি, এই কর্মভূমিতে আসার আগে বিলেতের মাটিতে লোকমুখে ও বইয়ের পাতা উল্টিয়ে ঢুলুঢুলু হয়ে বুঝতে চেয়েছি কারা এরা? ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোকেরা কেনইবা এখানে দাপিয়ে বেড়ায় যাচ্ছেতাই ভাবে। কীসের এত লোভ? মশলাপাতির ব্যবসা, না বস্ত্র নিয়ে কারবারে এঁটেল মাটির মতো চিপকে দিয়েছে। তাই যদি হবে, সম্পর্কের ধরণটা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। ওরা কী নিজদেশে পরবাসী? গরুর গাড়ির চাকা মাটি ঘসটাতে ঘসটাতে থকথকে কাদায় আটকেই গেল। কার যেন ডাক শুনে এতক্ষণের তাল জ্ঞানের সংযোগটা আগের মতো রইল না। বললাম, কে আপনি? উত্তর এলো ‘রামগোপাল ঘোষ। পাদ্রী সাহেবের ব্ল্যাক টাউনের মানুষদের জন্য মন কেমন করছে? সাহেব, এখন এশীয়দের বড় দুর্দিন, ইংরাজের অত্যাচার হতে রক্ষা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনও রাস্তা যে আর খোলা নেই। আমি গভর্ণর জেনারেলের ব্যবস্থাপক সভাতে কয়েকখানা আইনের পাণ্ডুলিপি উপস্থিত করেছি। ভারতবাসী ইংরাজদিগকে এদেশীয়দের বিরোধস্থলে কোম্পানির ফৌজদারি দণ্ডবিধির অধীন করাই ঐ সকল পাণ্ডুলিপির উদ্দেশ্য ছিল। ইংরাজরা তাকে ‘কালা আইন’ নাম দিয়ে আন্দোলন শুরু করেছে। এটা কী যুক্তিসঙ্গত কাজ?’ রামগোপাল বাবু এর জবাব আমার কাছে নেই। ইংরাজরা গভর্নমেন্টকে গালাগালও কম করছে না। আমি তো জানি আপনি এক মাসের আয় দিয়েছেন, আপনার অনুরোধে হেয়ারের শিষ্যগণের এক মাসের আয় দিয়ে ডেভিড হেয়ারের প্রস্তর-মূর্তি নির্মিত হয়েছে। এটা কী কম বড় কথা! সম্পর্কে যদি শত্রুতার গন্ধ থাকে, দেশ শাসন করবে কেমন করে!
কথাগুলো ছুরির বলার মতো বিঁধল গায়ে। নিজেকে আলাদা করে প্রমাণ করা কী যে কষ্টকর তা প্রতি পলে পলে টের পাচ্ছি। বুঝলাম মন খুলে কিছু না বললেও ওরা আমাকে একই গোত্রের মধ্যে ফেলে ভালো মন্দের বিচার করছে। সাদা চামড়ার মানুষ হলেও আমার চিন্তা চেতনা যে অন্য খাতে বইছে এ আর কে বিচার করবে। চারপাশে এখন একটা পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। কে কাকে মুঠো করে ধরবে, আবার ধরতে গেলে ফুরুত করে যে উড়ে বেড়িয়ে যাবে কোন আকাশে, কে বলবে। এমন আজব দেশ কস্মিনকালেও দেখি নি, ওরা অন্য জাতের মানুষ, নিজেদের হাঁটি হাঁটি পা পা করে আলাদা করতে না পারলে যে সাহেব সুবোদের দলে নাম লেখানো যাবে না, সে-ও আর এক বিপদ। গায়ের গন্ধে যে ভুত পালায়, তেলে জলে মিশ খাবে কেন! তাই তো বাবু লোকরা ততক্ষণ-ই সহ্য করে যতক্ষণ নিজেদের ঘরে ওরা এসে হু হু করে ঢুকে না পড়ে। শুনেছি রামমোহন রায় এর ব্যতিক্রম, এত খেতাব টেতাবের উনি তোয়াক্কা করতেন না। যখন যেমন চাইতেন, যা মনে করতেন মানুষের পক্ষে হিতকর, তা দু চোখ বুজেও সগর্বে ঘোষণা দিতে পিছপা হতেন না। লোকটার বুকের পাটা ছিল, না হলে হিন্দু সমাজের নেতা রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুরের সঙ্গে বুক চিতিয়ে লড়তে পারতেন! সমাজটা রসাতলে যেতে বসেছিল বই তো নয় , জোরে হ্যাঁচকা টানে তুলেছেন বলেই না বেঁচে গেল। না হলে শুনেছি এই দেশে হরেক কিসিমের লোক আছে, একজনকে দেখে অন্য কাউকে বোঝার উপায় নেই। সাবধানে পা না ফেললে হোঁচট খেতেই হবে। বিধির বিধান কে আর খন্ডাবে বলুন। এই জগতে মানুষের ছোঁয়া লেগেছে বলেই না এতটা বৈচিত্র, কত কী যে ঘটে গেছে, আবার কত কী যে ঘটার অপেক্ষায় দিন গুনছে, সে কী আর আমি থোরাই জানি। মাঝে মাঝে আমার নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করতে সাধ জাগে – যা জেনেছি ঠিক জেনেছি তো আর যা জেনে ফেলেছি তাই কি ভুল করে জেনেছি! এই দেশীয়দের কাছে একটা কথা প্রায়ই শুনি, ‘নাড়ীর টান’। দোকানিটা আমাকে দেখেই দু’হাত জড় করে প্রণাম করে বলে, ‘বাবু, অপরাধ নেবেন না, একটা প্রশ্ন করতে পারি, ছোট্ট প্রশ্ন – আপনারা আমাদের দেশের মানুষদের ভালোবাসেন তো, না কি সবটাই ভান, লোক দেখানো? আমাদের নিন্দা করলে আপনাদের গায়ে লাগে না? মানুষ বই তো নয় । তবে আমাদের দেশের বাবু লোকদের সঙ্গে ইংরাজদের একটাই মিল, সকলেই আমাদের ছোট লোক, বজ্জাত বলে গাল দেয়। আমরা পিঠ পেতে দিই, আপনারা মাড়িয়ে চলে যান। বড্ড খড়খড়ে কিনা, পিছল খাওয়ার ভয় নাই।’
ঘোড়ায় চড়ে হোয়াইট টাউনে বিলেতের লোকেরা ইংলিশ উচ্চারণে এমন হম্বিতম্বি করে, জমিদার আর সরকারি বাবুদের থরহরি কম্পন শুরু হয়ে যায়। ভাত দেবার মুরোদ নাই, কিল মারার গোঁসাই। কথাগুলো এমন করে টানে, কে বলল, কাকে বলল, বোঝা দায় হয়ে পড়ে। হোয়াইট টাউনের সাহেবরা এই দেশীয়দের নিয়ম কানুনের বেড়াজালে জড়িয়ে দিয়েছেন আড়াআড়িভাবে। না হলে এই নিয়ম কী চালু করা আদপে সম্ভব! সকল ভেদাভেদে আমরা ওরার দলে গা ভাসালে চলবে কেন? বোঝা গেল নিয়মটা সাহেবরা বুঝে-সুঝেই বানিয়েছে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে বলে। ভাবলেই তো গা ঘিনঘিন করে। সান্ত্বনা দেওয়া দূরে থাক, ঘৃণায় মনটাই ভার হয়ে যায় । নিয়মের বলিহারি। ডিরোজিও শিষ্য রসিককৃষ্ণের সাহস ছিল বটে, না হলে ভরা এজলাসে বিচারপতির সামনে তামা তুলসী গঙ্গাজল তো স্পর্শ করলেনই না, বরঞ্চ বলে বসলেন ‘আমি গঙ্গা মানি না।’ এই নিয়ে হাঙ্গামা তো কম হয় নি, সকলে বলাবলি করল, ‘মল্লিকদের বাটীর ছেলের এই দশা! বলে কিনা গঙ্গা মানি না, ঘোর কলি উপস্থিত, দেখ কালেজের শিক্ষার কি ফল!’ ডান দিকে মাঠের পর মাঠ, আগাছার ছড়াছড়ি, তুলসী বন ছড়িয়ে ছিটিয়ে দুপাশে। এমন প্রকৃতিকে ইংরাজরা যত তাড়াতাড়ি বোঝে ততই মঙ্গল। নেটিভরা যে ফেলনার নয়, দিন আসছে এবার বুঝিয়ে দেবে, তাই একটু বুঝে শুনে পা ফেললেই ভালো। যে বীজ ডিরোজিও আর ডেভিড হেয়াররা পুঁতে দিয়ে গেছেন তাতে যে ফল ফলতে আরম্ভ করেছে, পাকতে আর সময় নেবে না, এটা ইংরাজরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। ছাপিয়ে যাওয়ার লক্ষণে যে ওরা খুব একটা স্বস্তিতে নেই তা বলাই বাহুল্য। এর ছিঁটেফোঁটা যে গরীব গুরবোদের দরজায় এসে থমকে আছে কিন্তু প্রবেশাধিকার নেই, এটা বেশ বোঝা যায় ওদের খামখেয়ালিপনা আর খেয়ালখুশিতে। কিন্তু ধাক্কা তো মারতেই হবে। দিনের আলো ফুরাতেই গোধূলির মায়া এসে জড়িয়ে ধরে, আমি তখনও চেনা অচেনার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকি, আরও দূরে যেতে হবে তো! প্রতিভাস ম্যাগাজিন
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)