পাঠক মিত্র

নির্দিষ্ট নিয়মে চলার ব্যতিক্রমী দুটি উপন্যাস 

‘উপন্যাস’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ উপযুক্ত বা বিশেষ রূপে স্থাপন । যেখানে একটি উপাদানকে কাহিনীরূপে বিবৃত করার বিশেষ কৌশল, পদ্ধতি বা রীতি প্রতিফলিত হয় । আবার অন্যভাবে উপন্যাসকে বলা হয় যে এটি গদ্যে লেখা দীর্ঘাবয়ব বর্ণনাত্মক কথাসাহিত্য । উপন্যাসের ইংরেজি ‘novel’ । ইংরেজি অভিধান পরিক্রমায় তার বর্ণনা এইরূপ– novel– a fictitious prose narrative or take presenting picture of real life of the men and woman portrayed. Oxford অভিধানের একটি বলছে, a story long enough to fill a complete book in which the characters of events are usually imaginary. আর একটিতে বলছে, fictitious prose story of book length.  

ব্যুৎপত্তিগত এবং আভিধানিক অর্থ বিশ্লেষণের মাধ্যমে বলতে হয়, মানুষের জীবনযাপনের বাস্তবতা অবলম্বন করে যে কল্পিত উপাখ্যান পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় করার জন্য বিশেষ বিন্যাসসহ গদ্যে লিপিবদ্ধ হয় তাই উপন্যাস । যেহেতু উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য মানুষের জীবন তাই উপন্যাসের কাহিনী হয় বিশ্লেষণাত্মক, দীর্ঘ ও সমগ্রতাসন্ধানী । উপন্যাসে পরিবেশ, বর্ণনা, রূপরেখা, চরিত্র সংলাপ ইত্যাদি যখন মানুষের জীবনের কাহিনীকে সুন্দর ও স্বার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলে তখন তার মধ্যে জীবনের কোন অর্থ বা ভাষ্য প্রকাশ করে । জীবনের এই রূপায়ণে উপন্যাসের রূপ অত্যন্ত নমনীয় ও মিশ্র রূপে ধরা পড়ে ।  

উপন্যাস সম্পর্কে উপরোক্ত কথাগুলো বলতে হল এই কারণে যে, দু’টি বইয়ের কথা বলার আগে এই কথাগুলো বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় । দু’টি বই রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা । একটি ‘ভবদীয় নঙ্গরচন্দ্র’ । আর একটি ‘দুখে কেওড়া’ ।  

প্রথম বইটির নামেই তার পরিচয় । বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নঙ্গরচন্দ্র পত্রে আলোকপাত করেছেন । তাই বইটি নঙ্গরচন্দ্রের পত্রাবলী হিসেবে বলা যেতে পারে । এই পত্রাবলী সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন সংবাদ সম্পর্কে মতামত দিয়ে নঙ্গরচন্দ্রের পত্র । প্রতিটি পত্রের পাশাপাশি আর এক পত্র, যাঁর উদ্দেশ্যে লেখা তাঁর কাছে তা পৌঁছে দেওয়ার আর্জি  জানিয়ে লেখা । এ লেখা কোন কল্পিত উপাখ্যান নয় যা উপন্যাস সম্পর্কে প্রথম দিকের আলোচনায় এসেছে । তার কাহিনী বা পত্রের চরিত্র বাস্তবের চেনা চরিত্র।  যদিও সে চরিত্রদের সংলাপ উপন্যাসের সংলাপ হয়ে ওঠেনি । বরং চরিত্রদের নিয়ে নঙ্গরচন্দ্র তার পত্রে এক নতুন সংলাপ তৈরি করেছে । কোন পত্রের এই চরিত্র সোনিয়া গান্ধী ও তার মেয়ে প্রিয়াঙ্কা থেকে জয়ললিতা, সুষমা, মেনকা গান্ধী, বাজপেয়ী, আদবানী. সুভাষ চক্রবর্তী, অসীম চক্রবর্তী থেকে সুব্রত মুখার্জী, মমতা, লালুপ্রসাদ, বাল ঠাকরে । এ ছাড়াও নাটা মল্লিক থেকে তদানীন্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার পর্যন্ত সকলেই তার পত্রের চরিত্র । এই  চরিত্রদের প্রায় সকলেই রাজনৈতিক চরিত্র, তবু এই পত্রাবলী রাজনৈতিক হয়ে ওঠেনি । কিন্তু এই চরিত্রদের সংস্পর্শে সমাজ পরিবেশের একটি রূপরেখা তৈরি হয় যার সাথে রাজনীতির স্পর্শ-যে থাকে না তা একেবারে বলা যায় না । আর এই স্পর্শ দিয়ে নঙ্গরচন্দ্রের মতো একজন অশীতিপর কৃষকের তার সময়কে পরিক্রমায় পত্রাবলী ‘ভবদীয় নঙ্গরচন্দ্র’ নামে হাজির হয়েছে রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের কলমে । ষোলোটি বিষয়ের ওপর ষোলোটি পত্র নিয়ে এই বইটি । প্রথম ও শেষ এই চিঠি দু’টি স্বাস্থ্য সংক্রান্ত।  প্রথমটি প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর মা হওয়ার খবর ও দ্বিতীয়টি বাংলার মন্ত্রীদের চিকিৎসার বিল সম্পর্কিত । এই চিঠি দুটি সাধারণ মানুষের চিকিৎসার গুরুত্ব উচ্চতর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যক্তিত্বের চিকিৎসার গুরুত্বের পার্থক্য অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরেছে । প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর মা হওয়ার জন্য চিকিৎসার খরচ দশ লাখ টাকা । অথচ নঙ্গরচন্দ্রের গাঁয়ের এক মেয়ের হার্টের চিকিৎসার জন্য দশ হাজার টাকা সাহায্য পাঠিয়েছিলেন প্রিয়াঙ্কার ঠাকুমা বেঁচে থাকতে । নঙ্গরচন্দ্রের সংসারে রোগে রোগে টাকা এত খরচ হয়েছে যে চাষের জন্য হ্যান্ড ট্রাক্টর কেনা সম্ভব হয়নি । তবু ইন্দিরা গান্ধীর নাতনির এই অবস্থার খবরে উদ্বিগ্ন যেমন সংবাদমাধ্যম তেমন কংগ্রেস দল । আবার নঙ্গরচন্দ্রও উদ্বিগ্ন । তবে তার উদ্বিগ্নের ভাষায় এক ব্যঙ্গাত্মক সুর আছে যা সমাজব্যবস্থার সেই স্তরকে ব্যঙ্গ করে যেখানে সাধারণ মানুষের একটি বাঁধা গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা ছাড়া আর অন্য উপায় থাকে না চলতি ব্যবস্থায় । নঙ্গরচন্দ্রের কথায়, ‘যাদের বছর বছর ভোট দিচ্ছি তাদের দরকারের দিনে কাছে থাকব নি ? খরা হলে, ঝরা হলে, সারের দাম বাড়লে যাদের কাছে বিপদের কথা জানিয়ে পাঁচ গাঁয়ের লোক সই করে চিঠি পাঠাই তাদের সংসারের কথা ভুলে থাকব ? ট্রেন ওল্টালে তারা ছুটে আসে, বান এলে আকাশে ওড়ে–তাদের আপদে-বিপদে আমাদেরও তো কিছু করা দরকার ।’ 

যাদের ভোট দেয় নঙ্গরচন্দ্র তাদের আপদে-বিপদে কিছু করার দরকার বলে মনে করে । কিন্তু নঙ্গরচন্দ্রের মতো চাষিদের কথা মনে পড়ে না তাদের । মন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের চিকিৎসার বিল পনের দিনের মধ্যে যাতে মিটিয়ে দেওয়া যায় তদানীন্তন রাজ্য সরকার তার জন্য আইন করার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তর নির্দেশ প্রসঙ্গে নঙ্গরচন্দ্রের পত্রের কয়েকটি লাইনে সাধারণ মানুষ আর পদাধিকার মানুষের জন্য ব্যবস্থার পার্থক্য ধরা পড়ে । ‘আশি বছর বয়সের পরে যতই খাওয়ান আর ছুঁচ ফুটোন, ছেঁড়া কাপড়া আর গোটা হবেনি । দু-দিন পরেপরেই এখানে ওখানে ফাটবে । টাকা খরচ করে কি লাভ ? লাভ-ক্ষতির হিসেবের দরকার নাই যদি সরকারের লোক হন । সরকার টাকা দিয়ে দেবে । কিন্তু আমরা সারা জীবন মাঠে চাষবাস করেই কাটালুম । সেখানে আর কোথায় সরকার ?’ আর একটি লাইনে বলছে, ‘ কিন্তু একটি ব্যাপারে আমার কেমন খটকা লাগছে । দেরী তো সবারই হচ্ছে, আপনি মন্ত্রীদের ব্যাপারটি আলাদা করে কি ভালো করলেন ? আসলে মন্ত্রীদের বিষয়গুলি বহুকালই আলাদা কিন্তু একেবারে কাগজে-কলমে দুটি ভাতের হাঁড়ি আলাদা করা কি ঠিক হবে ?’

মন্ত্রীদের বিষয় বহুকাল থেকেই আলাদা তা নঙ্গরচন্দ্র জানে । তাই তার জন্য আবার আলাদা সিদ্ধান্তের প্রয়োজন নেই বলে সে মনে করে । আলাদা হলে সাধারণ মানুষের মর্যাদার মূল্যায়ন সেভাবে হতে পারে না বলে তার নানা উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে চেয়েছে নঙ্গরচন্দ্র।  

রেলমন্ত্রী লালুপ্রসাদ আটদফা সিদ্ধান্তের কথার একটি ‘গোধরার রিপোর্ট প্রকাশ করার কথা বলেছেন ।’ সে প্রসঙ্গে নঙ্গরচন্দ্রের মতে তথাকথিত সমাজের আসল সুর ধরা পড়ে । ‘এত রিপোর্ট এতবার বেরিয়েছে যে কাগজের শ্রাদ্ধ হয়ে গেছে । আবার ঐ গোধরার পরেই গুজরাতে দাঙ্গা হল । কাগজে কত যে কষ্টের ছবি বেরিয়েছে । রিপোর্টের দরকার নাই , আপনারা দাঙ্গাটি বন্ধ করুন । জন্ম ও মৃত্যু বিষয়টি ভগবানের, ওর ভেতর পার্টি ঢুকে গেলে সব গোলমাল।’ মানুষ তার বিধ্বংসী অবস্থার জন্য সে দায়ী নয় । যে হিসেবে তার বিধ্বংসী অবস্থা সেই হিসেবে তার মর্যাদা মানুষ বলে দেখাই হয় না । আসলে মানুষের বিশেষত সাধারণ মানুষের মর্যাদা না থাকলে দেশ ও মানুষ পরস্পরের পরিপূরক হয়ে ওঠে না । রেলে মাল পরিবহণের ওপর রেলমন্ত্রীর বেশি গুরুত্ব দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নঙ্গরচন্দ্র বলছে, ‘রেলে..মানুষ পরিবহণের চেয়ে মাল পরিবহনে বেশি জোর দিচ্ছেন । মাল বড় হয়ে গেল মানুষের চেয়ে ? …মানুষের থেকে মালের মর্যাদা বেশি হলে দেশের মঙ্গল হবে কেমন করে ?’ 

মানুষের মর্যাদা বেশি হলে দেশের মঙ্গল । তবে মানুষের মর্যাদা বেশি হতে পারে তখনই, যখন সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশ সুস্থ থাকে । আর এই পরিবেশ অবশ্য কখনোই রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাইরে নয় । আদর্শের লড়াই ছাড়া আর কোন লড়াই রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে পারে না । কিন্তু সেই আদর্শের লড়াই যখন থাকে না, তখন সংস্কৃতি কলুষিত হতে বাধ্য । নঙ্গরচন্দ্র কোন আদর্শের কথা বলেনি । তবু একটি খবরের প্রেক্ষিতে নঙ্গরচন্দ্রের মতো চাষির মন্তব্য আদর্শচ্যুত সংস্কৃতির কথাই মনে করিয়ে দেয় । 

‘সুব্রতদের দিয়ে অটল-আদবানিকে আক্রমণ মমতার’- এই হেডলাইনের খবরে বাজপেয়ীর শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে সুব্রতবাবুর টিপ্পনী । আর এই টিপ্পনীর সাথে তিনি লালকৃষ্ণ আদবানিকে ধূর্ত শিয়াল, নীতিশ কুমার কে বিহারী ষাঁড় বলেছেন । রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সৌজন্য আর শ্রদ্ধাবোধ ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে সুব্রতবাবুকে সরাসরি নয়, নঙ্গরচন্দ্র তাঁকে পরামর্শ দিয়ে পত্র দিলেন । ‘ সব সময় সত্যি কথা বলবে । তাতে কপালে দুঃখ জুটতে পারে কিন্তু মনের সুখ থাকবে । মিথ্যে কোনোদিন চাপা থাকে না । পোয়াল ছাতুর মতন ফুটে বেরোয় ।…..গুরুজনদের  শ্রদ্ধাভক্তি করবে ।….তুমি ওপরের সঙ্গে যেমন ব্যবহার করবে তোমার নিচেরটি তোমার সঙ্গে তেমনই ব্যবহার করবে ।’ 

নঙ্গরচন্দ্র এভাবে তার সময় পরিক্রমায় ক্রম-পরিবর্তনের ছবিতে সাধারণ মানুষের মর্যাদা ক্রমশ-যে হীন হয়ে পড়ছে তা তুলে ধরেছে তার পত্রাবলীতে । সেই পরিবর্তনে তার একটি মোক্ষম কথার উদাহরণ বাস্তব আবহাওয়ায় যেন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে । নঙ্গরচন্দ্রের কথায়, ‘আগে ভোটপ্রার্থীরা ভোট ভিক্ষা করত, আর আজ তারা ভোট দাবি করে ।’ এই একটি কথাই বলে দেয় মানুষের মর্যাদা কোন পর্যায়ে ।

সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতির দৈনিক খবরের সূত্র ধরে অশীতিপর কৃষক নঙ্গরচন্দ্রের পত্রাবলীর মাধ্যমে তার চলমান জীবনের ছবি এঁকে লেখক শ্রী মুখোপাধ্যায় দেখিয়েছেন আসলে কাদের পরিবর্তন । আর লেখক তা দেখালেন এক নতুন আঙ্গিকে । যদিও উপন্যাসের নির্দিষ্ট নিয়ম বা আঙ্গিক হয় না । তবু তথাকথিত নিয়ম ধরে বলতে হয় এ লেখার আঙ্গিক অভিনব । 

আরো এক অভিনব আঙ্গিকে প্রান্তিক মানুষের মুখ নিঃসৃত ভাষায় ও ভাবনায় নানা বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে লেখকের ‘দুখে কেওড়া’ রচনায় । নঙ্গরচন্দ্রের মতোই দুখে এক বৃদ্ধ কৃষক । এখন আর সেও চাষবাস করে না । তবে ব্যবসা করে । ব্যবসা বলতে দেশি মদের ব্যবসা । দুখের বউ মদ তৈরি করে আর সে বেচে । মদ বেচলেও সমাজ-সংস্কৃতির বিষয় থেকে দেশ ও রাষ্ট্র নিয়েও সে মতামত ব্যক্ত করে । বারোটি বিষয়ের ওপর দুখে কেওড়ার মতামতে ‘দুখে কেওড়া’ । বারোটি বিষয়- পরিচয়, ক্ষুধা, বাস্তু, স্বাস্থ্য, শ্রম, নারী, রাজনীতি, সংস্কৃতি, বুদ্ধিজীবী, বিশ্ব, যুদ্ধ, মৃত্যু । এই বারোটি বিষয়ের অর্থ ও ব্যবহার হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ থেকে আলাদাভাবে উল্লেখ করেছেন লেখক । তারপর দুখের মতামত তার প্রান্তিক ভাষায় । অভিধানের শব্দার্থ দুখে জানে না । কিন্তু তার জীবন সিঁড়ির ধাপ থেকে ধাপে অর্থ খুঁজে পায় । তাই সে বলতে পারে, ‘পাটিয় পাটিয় আজকাল খুব মারামারি হচ্ছে । হুঁ বলতে হাত তুলে দেয় । বন্দুক-বোমার আমদানি বেড়ে গেছে ।’ পাঠশালায় গিয়ে সে বুঝেছিল,’..সবার কপালে বিদ্যে নাই। কিছু মানুষজন হল গিয়ে গোরু, ছাগল, হাঁস, মুরগির মতন । ঠকতে ঠকতে শেখা । পাঠশালে গেলে বিদ্যে হয়, ঠকার ভয় নাই। পারলে দু-চারজনকে ঠকিয়েও দিতে পারেন ।’ এ কথার পরেই পাল্টা প্রশ্নের উত্তরে বলে, ‘বিদ্যের সঙ্গে ঠকানোর কিছু নাই। তবে কিনা বিদ্যে আর অ-বিদ্যে দিয়ে ভাগা ফেললে গোলমাল ।’ কিন্তু গোলমাল নেই দুখের প্রশ্ন-উত্তরে । চালের সমস্যা কি করে মেটানো যায়– এ প্রশ্নের উত্তরে সে বলে, ‘..গোটা ব্যাপারটি হচ্ছে খেলা । দাবার ঘুটি এমন চেলে দিলেন যে যুধিষ্ঠিরের জমি, পুকুর, ঘরদুয়োর চলে গেল । বউ অবদি হাত ছাড়া । খেলাটি খেলল কে ? শুকনি । সে ঘুটি গড়াতে গড়াতে কুরুক্ষেত্র ।’ শ্রম সম্পর্কে মালিক-মজুরের সম্পর্ক এসে যায় । মালিক শোষণ করে, চোষণও করে । আর এই সম্পর্কে দুখের মতামতে আসে নানা কথা । সেই কথার একটিতে আসে ভোটের কথা । ভোটে সব বদলে গেলেও আসনটি থেকে যায় । এভাবে কথায় কথায় দুখের প্রশ্ন, যারা দেশ চালায় তারা মালিক না কর্মচারী ? এ প্রশ্নের উত্তরে দুখে দেশের মালিক কথাটা শুনে তার বউ হেসে ফেলবে, সে জানে । দেশের মালিকের বউ, অথচ দেশি মদ তৈরি করে । দেশের মানুষ দেশের মালিক হলে তাহলে দুখে ও দুখের বউ তা নয় । তবু তার মতে দেশের মাথা যেন সংসারের মাথার মত হয় । সংসারে সবাই সুখে থাকলে যেমন তার মতো সংসারের মাথার সুখ, তেমনই দেশের মাথা যেন হয় ।  নানা প্রশ্নে দুখের উত্তরে সমাজের চেহারা ধরা পড়ে । সেই চেহারায় মানুষের মরণ যে সব জিনিসে হয় সেগুলিকে ধ্বংস করার কথা বলেছে দুখে । বিনা ওষুধে মানুষের মরা চলবে না । লাঠি, বোমা, বন্দুক, ছোরা, বল্লম সব কিছুই পুঁতে ফেলার কথা বলে । পুলিশ ও ডাকাতের হাতে বন্দুক থাকা চলবে না । এমনকি জমির মালিক থেকে ভাগচাষীর ঘরেও কোন বন্দুক থাকবে না বলে দুখে মতামত দেয় । সমাজ-সংস্কৃতির কথা শুধু দুখের মুখে তার প্রান্তিক ভাষায় লেখক প্রকাশ করেছেন বলে এ লেখা অভিনব তা নয় । এমন সব বিষয়ের ওপর একজন দেশি-মদ ব্যবসায়ী দুখের মতামত তার একক সংলাপে এমনভাবে বিন্যস্ত করেছেন লেখক মুখোপাধ্যায় তা অভিনব । একক অভিনয়ে মঞ্চে অভিনেতাকে দর্শকের কাছে একক বলে যেমন মনে হয় না, তেমন দুখের একক সংলাপে পাঠকের কাছে নানা চরিত্র লেখক তুলে ধরেছেন । সত্যিই এ এক অভিনব আঙ্গিক । এক সমালোচকের মতে, ‘এই উপন্যাস দেখায় একবিংশ শতাব্দীর বাংলা উপন্যাস ভাঙতে চাইছে তার পরম্পরাকে–ইদানীং ইংরেজি ভাষায় লিখিত বাঙালি তথা ভারতীয়দের উপন্যাস নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয় । তার পাশে এ উপন্যাস অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ‘

উপন্যাসের পরম্পরা ভেঙেছে কিনা সে প্রসঙ্গ নিয়ে কথা হতে পারে অনেক । কিন্তু রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘ভবদীয় নঙ্গরচন্দ্র’ আর ‘দুখে কেওড়া’ প্রমাণ করে উপন্যাসের নির্দিষ্ট কোন নিয়ম বা কাঠামো নেই। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *