তপোপ্রিয়
ফেলে আসা সরণিতে
‘ওই দেখো চাঁদ, ওই যে সমুদ্র।’
আমাকে কোলে নিয়ে মা প্রথম সমুদ্র দেখিয়েছিল সেই কোন ছোট্টবেলায়। কোন এক উঁচু অবস্থান থেকে। অনেক অনেক দূরের এক ফালি সমুদ্র দেখা যাচ্ছিল, আলো ঠিকরে বেরোচ্ছিল স্পন্দনশীল গা থেকে।
আজ আবার নিস্তরঙ্গ এক সমুদ্রের মুখোমুখি আমি দাঁড়িয়ে আছি। একা। মা আমার সঙ্গে নেই। থাকবে না আর।
রাতের আকাশে ওই যে নদীর আলোকরেখা, এখানে অনেক স্পষ্ট। যেহেতু নাগরিক উৎসবের বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছি। মাথার ওপরে ওই নদীকেই কি সবাই বলে আকাশগঙ্গা ? ওখানে সূর্য আছে কোথাও জানি, আমি তাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি। ওই আকাশগঙ্গা গ্যালাক্সিটার কেন্দ্রবিন্দুকে যে পথে প্রদক্ষিণ করে চলেছে সূর্য আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি। যদি এমন কোন সুপরিচিত তারকার সন্ধান পাওয়া যায় যাকে দেখে মায়ের মুখের মিল খুঁজে পাবো। শুনেছি সবাই বলে, পৃথিবীর কাজ ফুরোলে মানুষ নাকি তারা হয়ে যায়।

বলেছিল প্রথম আমাকে তন্ময়। খুব প্রিয় বন্ধু আমার, অথচ বড় তার দুঃখ। মা ছিলনা ছোট্ট বয়সে থেকে। বাবা কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। থাকতো মামাবাড়িতে। বেশ প্রিয় ছিল তার গল্পের বই। আমরা দুই বন্ধু মিলে চেনা লোকেদের বাড়ি ঘুরে ঘুরে বই সংগ্রহ করতাম আর গোগ্রাসে গিলতাম। স্কুলের লাইব্রেরি থেকে বই পাওয়া যেত না ঠিকমতো। বই কেনার ক্ষমতা ছিল না তন্ময়ের বা আমার। বাবা মারা যাওয়ার পর মাকে বড় কষ্ট করে সংসার চালাতে হত। তার ওপর ছিল আমাদের পড়াশোনার খরচ। জমির ধান আর আম-কাঁঠাল-বাঁশ বিক্রি করে টাকা যোগাড় করতে প্রাণান্ত হয়ে যেত মায়ের। ওদিকে মামাবাড়িতে আশ্রিত তন্ময় দু’বেলা দু’মুঠো খাবার পেত, কোনক্রমে পড়াশোনাটা চালাতে পারত।
আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যেত গোমতী নদী। আমি আর তন্ময় প্রায়ই বিকেল থেকে সন্ধে পর্যন্ত নদীর নিরিবিলি তীর ধরে হাঁটতাম আর পৃথিবীর বিজ্ঞান-সাহিত্য-সংগীত নিয়ে সহস্র কথা বলতাম। আমি তখন সদ্য ভিক্টর হুগোর লা মিজারেবল পড়েছি, স্বপ্ন দেখছি এমন এক মহান উপন্যাস লিখে ফেলব যে মানুষ পড়ে স্তম্ভিত হয়ে যাবে। তন্ময় স্বপ্ন দেখত খুব বড় চিত্রশিল্পী হবে।
সেদিনও আমরা নদীর তীর ধরে হাঁটছি। বসন্তের শেষ। নদীর নিঃশ্বাস বয়ে আনছে যে হাওয়া তাতে তপ্ত আমেজ। তন্ময়ের বেশ মন খারাপ। মামীমার হাতে অকারণে তাকে সেদিন হেনস্থা হতে হয়েছে অনেক। অন্য দিনের মতো সে তেমন সরব ছিল না। আমারও কথা হারিয়ে গিয়েছিল। হাঁটছিলাম চুপচাপ। আসন্ন সন্ধের মিহি অন্ধকারে আচ্ছন্ন পাহাড়ি নদীর বুকে ছলাৎ-ছলাৎ অস্পষ্ট আওয়াজ। আকাশে ফুটে উঠেছে অজস্র তারার মুখ। তন্ময় হঠাৎ গাঢ় গলায় বলল,
‘জানিস, ওখানে কোন একটি তারা আমার মা। আমি রোজ মাকে খুঁজি। কোন্ টি যে মা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। ‘
স্কুল থেকে ফেরার পথে একদিন দেখি রাস্তার পাশের সেই চির পরিচিত জাম গাছটাকে পি ডব্লিউ ডি-র লোকরা কেটে ফেলছে, নাকি রাস্তা চওড়া করতে হবে। তন্ময় বড় ভেঙ্গে পড়েছিল। আমাকে কাঁদো কাঁদো গলায় সে বলেছিল,
‘জানিস, গাছ কাটা হলে আর কোন মেয়ে মারা গেলে আমি বড় দুঃখ পাই।’
নবম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষার মাসখানেক আগে একদিন স্কুলে গিয়ে খবরটা পেলাম। সেদিনই ভোরবেলায় তন্ময়কে তার ঘরের পাশে পেয়ারা গাছে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। স্কুল আর হয়নি সেদিন।
আকাশগঙ্গার কোটি কোটি তারার ভিড়ে আমিও এখন প্রতিনিয়ত খুঁজে বেড়াবো আমার মাকে। ছিল যখন অনেক কিছুই দিতে পারিনি, অনেক কিছু করতে পারিনি মায়ের জন্য। মা একদিন লাজুক-লাজুক হাসি মুখে এনে বলেছিল,
‘বাবা, আমাকে একবার তাজমহলটা দেখিয়ে আনিস।’
পারিনি দেখাতে। দেখাবো দেখাবো করে কেটে গেছে সময়। আমার অবস্থা ওই রাবণরাজার মত। পৃথিবী থেকে স্বর্গে যাওয়ার সিঁড়ি বানাবার পরিকল্পনা ছিল তার। আজ বানাবো কাল বানাবো করে করে বানাতে পারেনি কোনদিন। গল্পটা একাধিকবার মা-ই আমাকে শুনিয়েছিল। মা বলত,
‘কাল করব বলে কোন কাজ ফেলে রাখিস না বাবা। কাল করবো কাল করবো করে যে তাকে কালে খায়।’
আজ বড় নির্মমভাবে বুঝতে পারছি মায়ের কথা। সময় চলে গেলে কাজ করার সুযোগ আর থাকে না। সেই কাজ মহাকালের গর্ভে হারিয়ে যায়।
চড়াই বেয়ে উঠছিল মা। কঠিন রোদে গলদঘর্ম। জীবনের শখ-আহ্লাদগুলি সযত্নে চাপা দিয়ে সরিয়ে রেখেছিল অন্তরের কোন গোপন কোণায়। অকাল বৈধব্যের পর তখন মায়ের লক্ষ্য ছিল কেবলই আমাদের দাঁড় করানো। দুই নির্ভয় ডানার আশ্রয়ে ছিলাম আমরা ভীরু শাবকগুলি, কখনো বুঝতে পারতাম না আঘাতে-আঘাতে পাখাগুলি ক্ষতবিক্ষত হয় কিনা। সত্যি জানলাম বড় হওয়ার পর। দেখলাম, ডানাগুলি ঝড়ে-বৃষ্টিতে জর্জরিত, পালকগুলির খসে পড়ে গেছে। আমরা হয়তো দাঁড়িয়েছি, কিন্তু এই দাঁড়ানোর পরিকাঠামো কী আত্মবঞ্চনার বিনিময়ে রচনা করেছে কোন স্থপতি তার হিসেব কে রেখেছি ?
মায়ের শখ ছিল কাশী-বৃন্দাবন তীর্থগুলি ঘুরে বেড়াবার। পারিনি নিয়ে যেতে। ক্ষমতা হল যখন মায়ের আর সামর্থ্য নেই। ভাগ্যকে হয়ত মানতেই হয়।
কয়েক বছর আগের কথা। মা তখনও এমন অচল হয়ে পড়েনি। হাঁটাচলায় অসুবিধে নেই। আমাকে একদিন ডেকে বলেছিল,
‘প্ল্যানেটোরিয়াম দেখতে কেমন রে বাবা ? দেখিনি কোনদিন।’
সামর্থ্য আর আগের মতো ছিল না মায়ের। তবুও অনেক চেষ্টাচরিত্র করে মাকে প্ল্যানেটোরিয়াম দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু গিয়ে দেখি, সেদিনই প্ল্যানেটোরিয়ামের শো কী কারণে বন্ধ আছে। ভাগ্য ছাড়া কী ? সেই প্ল্যানেটোরিয়াম দেখতে গিয়ে অনেকটা হাঁটতে হয়েছিল মাকে। জানি না তার জন্যই কিনা দু’দিন পর থেকে মায়ের কোমরে আর পায়ে অকথ্য যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণারই পরিণতি সেরিব্রাল অ্যাটাক। হাসপাতাল থেকে যদিও সুস্থভাবেই বেঁচে ফিরল, শরীরের সামর্থ আর কিছুই রইল না তার। তিন-চার বছর পরে স্মৃতিবিভ্রমের নিষ্ঠুর আক্রমণ। মাকে আমি আর প্ল্যানেটোরিয়াম দেখাতে পারলাম না। দেখলোনা মা তাজমহল, কাশী-বৃন্দাবন বা মথুরা।
আজ আমি মায়ের স্মৃতিতে কিছু লিখে হয়তো সান্ত্বনা খুঁজে পাব। তাকে স্মরণ করে মূর্তি বানাতে পারি, মন্দির বানাতে পারি আর ভাবতে পারি, মা কোন অদেখা পুরী থেকে আমার কীর্তি দেখে শান্তিসুখে আপ্লুত হয়ে গেল। সবই অবুঝ সান্ত্বনা। মাকে আর কিছুতেই বাস্তবে ফিরে পেতে ফিরে পেতে পারি না। একটা ছোট্ট সেফটিপিন এনে দিলেও মায়ের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত যে খুশির হাসিতে তাকে আর ফিরে দেখতে পাবো কোনদিন কোন মূল্যে ?
আমি তারপর এলিয়ে পড়ি কোন নিস্তব্ধ শালবনের ভিজে মাটির বুকে আচ্ছন্নভাবে। ঘুমিয়ে পড়ার আগে দেখতে পেলাম নিথর ভঙ্গিতে বয়ে চলা সুবর্ণরেখাকে। আমার অন্তস্থলে এক এক করে ভেসে উঠল আরও অনেক অনেক নদীর মুখ। কংসাবতী, ময়ূরাক্ষী, রূপনারায়ণ, বুড়িগঙ্গা। এমনি করে আমার বুকের খাঁচায় হাজার হাজার পথের ছবি দেখতে পাই। আমাকে নিয়ে মা দেখি অন্তহীন হেঁটে চলেছে ওইসব পথ ধরে। নদী আর পথের মতো কত কত মানুষের মুখও ভেসে উঠতে থাকে অন্তরের আয়নায়। তারপর আমি বুঝতে পারি না অন্তরে যাদের মুখ তারা নদী না পথ নাকি মানুষ। সবই অস্পষ্টতায় আবছা হয়ে যেতে থাকে।
আমি কেবল ধূসর পাহাড় হয়ে যাই। আমার অন্তরের জলধারা নদী হয়ে বয়ে চলে সমতল প্রদেশের দিকে, যেখানে অনবরত গান হয়ে বাজতে থাকে পাওয়া না-পাওয়ার অন্তহীন বিবরণী।