প্রীতন্বিতা
সুপারনোভা
যিশুখ্রিস্ট জন্ম নেওয়ার কয়েক শতাব্দী আগের ঘটনা হবে। ১০৫৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ চৈনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আকাশে আবিষ্কার করলেন এক উজ্জ্বল তারা। পরে তারিখটাও জানা গেছে, চৌঠা জুলাই। ওই তারা দেখা গিয়েছিল টরাস নক্ষত্রমন্ডলীতে, এখন যেখানে আছে কর্কট নীহারিকা। হঠাৎই এসে যেন হাজির হয়েছিল সে। তাই চৈনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তার নাম দিয়েছিলেন অতিথি তারা। শোনা যায়, তার এমনই ঔজ্জ্বল্য ছিল যে রাতের আকাশে মনে হতো আরেকটি চাঁদ, আর দিনের বেলাতেও দেখা যেত। প্রায় বছরখানেক পর সেটি ক্রমশ আকাশ থেকে মুছে গেল।
আকাশের এমনই বিরল ঘটনার আরেকটি নজির দেখা গিয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ১০০৬ সালে যার উল্লেখ করে গেছেন জাপানি ও চৈনিক পর্যবেক্ষকরা। জ্যোতির্বিজ্ঞানী টাইকো ব্রাহে ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দে এবং জোহানেস্ কেপলার ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দে আকাশে এমনই বিরল ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন বলে উল্লেখ করে গেছেন। খুব সম্প্রতি আমাদের এই মিল্কি ওয়ে বা ছায়াপথ গ্যালাক্সি থেকে এক লক্ষ ৭০ হাজার আলোকবর্ষ দূরের উপগ্যালাক্সি লার্জ ম্যাগেলানিক ক্লাউডেও নাকি এমন ঘটনা ঘটেছে। আকাশের এই বিরল ঘটনার নাম সুপারনোভা।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এর চেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা বোধহয় আর কিছু নেই। সাধারণ মানুষ এই বিষয়ে তত বেশি ওয়াকিবহাল না হলেও বিজ্ঞানীমহলে, বিশেষ করে মহাকাশবিজ্ঞানীদের কাছে সুপারনোভা এক বড় ঘটনা।
সুপারনোভা আসলে অতিকায় তারকার মৃত্যু যা ঘটে এক মহাবিস্ফোরণের আকারে। এই বিস্ফোরণের প্রচন্ডতা এমনই ভীষণ যে লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে যদি ঘটনাটি ঘটে তো তার উজ্জ্বল আলোর হদিশ চোখে এসে পড়বে। তারকা জীবনের উজ্জ্বলতম অবস্থা সুপারনোভা। আমাদের ছায়াপথ বা প্রতিবেশী গ্যালাক্সিগুলিতে এই ঘটনা আকছার ঘটতে দেখা না গেলেও সুবিশাল মহাবিশ্বের কোনো না কোনো প্রান্তে প্রতিবছর দু’-তিনটি এমন ঘটনা বিজ্ঞানীদের নজরে আসে। কোন একটি গ্যালাক্সিতে থাকে কয়েকশো কোটি তারা। এইসব তারার সম্মিলিত আলো খুব একটা কম নয়। কিন্তু গ্যালাক্সিটির কোন তারা যদি সুপারনোভা হয়ে যায় তো তার একার আলোই গ্যালাক্সির মোট আলোর সমান হয়ে পড়ে। দৃশ্যমান আলো বা ঔজ্জ্বল্যের পাশাপাশি সুপারনোভা থেকে বিপুল পরিমাণ এক্স রশ্মি, গামা রশ্মি ইত্যাদিও নির্গত হয়।

সুপারনোভা বিস্ফোরণের পর পরই কিন্তু তারকাটি মুছে যায় না আকাশ থেকে। তার ধ্বংসাবশেষ যুগের পর যুগ নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখে। যেমন ১০৫৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পৃথিবী থেকে দেখা গিয়েছিল যে সুপারনোভাকে তার ধ্বংসাবশেষ এখনও আকাশে ক্র্যাব নেবুলা হিসেবে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। এই ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এমনই উত্তাপ আর চাপের পরিবেশ বর্তমান যে শক্তি ও বস্তুকণিকার মধ্যে অনবরত ঘটে চলেছে ক্রীয়া-প্রতিক্রিয়া। সম্প্রতি এরকম ধ্বংসাবশেষ-এর মধ্যে খুঁজে পাওয়া গেছে এক অদ্ভুত বস্তুকে যার নাম দেওয়া হয়েছে পালসার বা পাল সেটিংস স্টার। এসব পালসার নিয়মিত এক নির্দিষ্ট বিরতির পর পর ক্ষুদ্র ও তীক্ষ্ণ মাপের বিকিরণের স্পন্দন উদগীরণ করে যায়। এক একটি স্পন্দনের মধ্যে বিরতিরকাল এত নির্দিষ্ট আর মাপা যে অবাক হয়ে যেতে হয়। এসব পালসার-এর স্পন্দন আর বিকিরণের চরিত্র বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা এক অস্বাভাবিক বস্তুর উপস্থিতি সম্পর্কে অনুমান করেছেন যা হলো প্রচন্ড ঘন ও তীব্র বেগে ঘূর্ণমান কোন অভাবনীয় বস্তু। তত্ত্বগতভাবে এমনই এক বস্তুর কথা বিজ্ঞানীরা অনেকদিন ধরে ভেবে আসছেন যার নাম নিউট্রন তারকা।
এসব পালসার, নিউট্রন স্টার ইত্যাদির চরিত্র ঠিক ঠিক ভাবে জানা গেলে সুপারনোভা সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু মুশকিল হলো এই যে পার্থিব বিজ্ঞানের গবেষণা তেমন পরিস্থিতির ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেনি। সুপারনোভা ধ্বংসাবশেষে এই যে সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে সেসব সূর্যের ঘটা ঘটনাগুলির চেয়েও কয়েকশো কোটি গুণ বেশি শক্তিশালী। সূর্যে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১০ কোটি টন হাইড্রোজেন পরিণত হচ্ছে হিলিয়ামে আর আইনস্টাইনের দেখানো পথ অনুযায়ী জানা যায় যে বস্তু এভাবে বিকিরণগত শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু সূর্যে ভরের এই শক্তিতে পরিণত হওয়ার পরিমাণ তুলনায় খুবই নগণ্য। সূর্যের কেন্দ্রস্থলের তাপমাত্রা প্রায় ১৪০ কোটি ডিগ্রি, সেখানে সুপার নোভার তাপমাত্রা অন্তত কয়েকশো গুণ বেশি। কোন তারকা সুপারনোভা হলেই তবে তার কথা আমরা জানতে পারি, কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় সে সুপারনোভা হল সেই প্রক্রিয়ার আদ্যোপান্ত বিবরণ এখনও আমাদের প্রায় অজানা।
তবুও মানবীয় বিজ্ঞানের অন্তর্গত পদার্থবিদ্যার নিয়ম-কানুন মেনে বিজ্ঞানীরা সুপারনোভা হওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে কিছুটা অনুমান করতে পেরেছেন। মহাকাশে কোন তারকার জন্ম ও তার বিবর্তনের মধ্যেই এই রহস্যের সন্ধান পাওয়া যায়। তারকা জগৎগুলির মধ্যে বিশাল বিশাল গ্যাস ও ধূলিকণার মেঘ বিদ্যমান যারা আয়তনে সমগ্র সৌরমন্ডলের চেয়ে হাজার হাজার কোটি গুণ বড়। এসব মেঘ থেকেই জন্ম হয় কোন তারকার। মহাজাগতিক কারণে একেকটি মেঘ ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকে আর এর ফলে তাদের অভ্যন্তরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। তাপমাত্রা ১০ কোটি ডিগ্রিতে পৌঁছে গেলে হাইড্রোজেন পরিণত হতে থাকে হিলিয়ামে আর এই ঘটনার ফলে ঘনীভূত মেঘটি থেকে যে বিকিরণজাত শক্তি নির্গত হয় তা মেঘপিণ্ডটির আরও সংকোচনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এভাবেই জন্ম হয় কোন তারকার। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায়, সমগ্র জীবনকালের প্রায় ৯০ শতাংশ পেরিয়ে এভাবে মেইন সিকোয়েন্স তারা হয়ে ওঠে সেই মেঘপিণ্ড। এরপর কেন্দ্রস্থলের সমস্ত হাইড্রোজেন জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে বিকিরণজাত শক্তি আর না নির্গত হতে থাকায় তারকাটির মধ্যে আবার সংকোচন দেখা যায় ফলে কেন্দ্রস্থলের তাপমাত্রা আবার বাড়তে থাকে এবং কুড়ি কোটি ডিগ্রিতে পৌঁছলে হিলিয়াম আরও ভারী মৌল কার্বন, নাইট্রোজেন বা অক্সিজেনে পরিণত হতে শুরু করে। আবার দেখা যায় শক্তির নিঃসরণ ও তারকাটির সংকোচন আরও একবার থেমে যায়। তারকার বহির্বৃত্তে জমে থাকা হাইড্রোজেন জ্বালানিতেও শুরু হয় দহন। সব মিলিয়ে নিট ফল হয় এই যে শক্তি নির্গমন ভীষণভাবে বেড়ে যাওয়ায় তারকাটির বাইরের খোল আয়তনে বাড়তে থাকে। বিবর্তন প্রক্রিয়ায় তারকাটি এখন রক্তিম দৈত্য অবস্থায় উপনীত হয়। সূর্য একদিন এমনই এক রক্তিম দানব তারায় পরিণত হবে আর তার আয়তন বেড়ে যাবে অন্তত দশগুণ। এই অভূতপূর্ব মহাজাগতিক দৃশ্য দেখার জন্য কোন মানুষ তখন পৃথিবীতে বসে থাকবে না, কারণ পৃথিবীর আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে সেই রক্তবর্ণ সূর্যের বর্ধিত রূপ আর পৃথিবী থেকে জল ও প্রাণের যে রূপ আমরা দেখি সব জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাবে। এভাবে একসময় আয়তনবৃদ্ধি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছলে আবার শুরু হবে সংকোচন। তারাটির তাপমাত্রাও তাতে বাড়তে থাকবে এবং সেটি খুব দ্রুত সংকুচিত হয়ে যাবে। এভাবে তারকাটি শেষ দশা শ্বেত বামন রূপ প্রাপ্ত হবে যা একটি শীতল ঘনীভূত ও অন্ধকার বস্তুপিণ্ড হিসেবে মহাশুন্যে কোথাও কোন কোণে তার জায়গা খুঁজে নেবে।
সূর্যের চেয়ে অনেক বড় তারা যেগুলি তাদের মধ্যে হাইড্রোজেন জ্বালানি অত্যধিক বেশি পরিমাণে থাকায় তারা তাদের মেইন সিকোয়েন্স স্তরটি খুব দ্রুত পেরিয়ে যায়। তাদের মধ্যে যে সংকোচন দেখা দেয় তা কেন্দ্রে হিলিয়াম দহন ও খোলে হাইড্রোজেন দহনের ফলে উদ্ভূত বিকিরণজাত শক্তি নির্গমনের মাধ্যমে থামে না, কারণ কেন্দ্রস্থলের অভিকর্ষজ শক্তি তাদের অনেক বেশি হয়। এভাবে তাদের কেন্দ্রের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেতে থাকলে একসময় এমন এক অবস্থা আসে যে তারকাটি ভয়ংকর এক বিস্ফোরণে ফেটে যায়। এই ঘটনাকেই বলা হয় সুপারনোভা। ফেটে যাওয়ার পর তারকাটি শেষ পর্যন্ত ঘনীভূত নিউট্রন তারকায় পরিণত হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখরের তত্ত্ব অনুযায়ী নিউট্রন তারকার কেন্দ্র আরো সংকুচিত হয়ে সব শেষে মহাকাশের অকল্পনীয় রহস্য কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাক হোলের জন্ম দিতে পারে যা তার চারপাশের সমস্ত বস্তু, এমনকি আলোকে পর্যন্ত গ্রাস করে নেয়। এই কৃষ্ণ গহ্বর এখনোও পার্থিব বিজ্ঞানের ধরাছোঁয়ার বাইরে, কেবল বিজ্ঞানীদের তত্ত্বে তাদের অবস্থান। কিছু কিছু দৃষ্টান্ত সম্প্রতি মিললেও একেবারেই সন্দেহমুক্ত নয়।
সুপারনোভা আসলে অতিকায় কোন তারকার মৃত্যু। সূর্য কখনও সুপারনোভা হবে না, কারণ সে তুলনায় অনেক ছোট।