সুতপন চট্টোপাধ্যায়
জবা
কী নাম তোর?
জবা।
কে আছে বাড়িতে?
মা, বাবা আর ভাই।
এই দুপুরে তুই এখানে কী করিস?
শামুক কুড়ুই।
শামুক নিয়ে কী করিস?
দ্বারবাসিনির হাটে বিক্রি করি। বলে জবা হরিণের মত ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল, তা তোমার এত জানার কী আছে? তুমি কে?
আমি কে সেটা তোর না জানলেও চলবে। তুই একা একা দুপুর রোদে ক্যানেলের পাড়ে শামুক খুঁজে বেড়াস, বাড়িতে কিছু বলে না?
সে জেনে তোমার কী?
এবার উঠে দাঁড়াল জবা। গাছ কোমর করে আঁচলটা বেঁধে এগিয়ে এল মনিকান্তর দিকে। হাতে হেঁসোর মত একটা যন্ত্র। সেই দিয়ে সে ক্যানেলের গায়ে আঁচড় কেটে শামুক খোঁজে।
শামুকের গায়ে লাগলে টক করে শব্দ হয়। তারপর শামুকের চারপাশের মাটি সরিয়ে আস্ত শামুককে বের করে জবা। বড় শামুক তিন চারটে হলেই সপ্তাহের হাটের খরচাটা উঠে আসে। তাই এখানে সে কাউকে ঢুকতে দেয় না। গ্রামের উত্তর দিকের ক্যানেলের পাড় তার। এখানে কাউকে দেখলে রক্তে আগুন নেচে ওঠে। বর্ষার পর ক্যানেল শুকিয়ে গেলে শামুকরা পাড়ের মাটিতে লুকিয়ে পড়ে। জবা শীত কাল অব্দি শামুক খোঁড়ে। এবার জিজ্ঞেস করল, কী নাম তোমার?
-রাজীব।
-কোন বাড়ি?
-মুকুজ্জে বাড়ি।
-বেড়াতে এয়েছো?
-না। আমি কলকাতায় থাকি। ছুটিতে এসেছি। আমাদের জমি দেখতে এসেছি।
-হুম। তুমাদের তো অনেক জমি?
-ক্যানেলের যেখানে তুমি শামুক খুঁড়ছো তার পারেই তো আমাদের টানা পাঁচটা কলমা ধানের জমি।
-জানি। এত জমি কি করবে?
-মানে? মানে আর কী? বলছি এত জমি নিয়ে কী করবে? চাষ তো ঠিক থাক করতি পার না।
প্রসঙ্গ বদলে রাজীব জিজ্ঞেস করে, তুমি ইস্কুল যাও না কেন?
-যেতে তো চাই। কিন্তু সেটা অনেক দূরে। রাস্তার দু’পাশে ঘন জঙ্গল, বাঁশ বন, বিলের ধারের খাড়ি। যাওয়া খুব সুবিধের নয়। ভয় হয়।
ধীরে ধীরে ক্যানালের রাস্তা ধরে এগিয়ে যায় রাজীব। এখানে কথা না বাড়ানো ভাল। কী কথা থেকে কী কথা বেড়িয়ে পড়বে। কে জানে? গ্রামের হাওয়াতেও প্রতি নিয়ত কথা চালচালি হয়।
পরের দু দিন রাজীব আর ওই মাঠের দিকে পা বাড়াল না। জবা লক্ষ রেখেছে। দেখা হলেই কথা সে বলবেই। ক্যানেলের জল কম। বর্ষায় জল থাকে কানায় কানায়। বাঁধ থেকে জল ছেড়ে দু কুল ভাসিয়ে দেয়। তখন এই উত্তরের মাঠ জলে তক তক করে। মাঠে মঠে চাষের সময়। জলের ভিতর গাছের চারা বসিয়ে দিয়ে কোমড় ফেটে যায় দিনের শেষে। বুড়ো মা কে সে বলে কোমড়ে মালিশ করে দে মা। ব্যাথা টা চাগাড় দিছে ।
কদিন পর রাজীব কে দেখতে পেল জবা। মাঠের পারে এসে অনেকক্ষণ তাকিয়ে আছে । একবার জবার দিকে তাকাতেই জবা বলল, এত দিন কোথায় ছিলে?
রাজীবের মনে হল মেয়েটা কী বেহায়া, যেচে যেচে কথা বলছে। আবার বোধ হয় কিছু একটা বলে বসবে । ভালো লাগবে না তার। সে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রইল। জবা এবার বলল, তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা ছিল। শুনবে?
রাজীব মুখ ঘুড়িয়ে বলল, কী?
তুমাদের জায়গাটায় আমাদের মেয়েদের একটা ইস্কুল করে দাও না। তুমাদের তো অনেক জমি। এ গায়ে মেয়েদের ইস্কুল লাই।
অবাক হয়ে তাকাল রাজীব। বলল, কী আবল তাবল বলছ?
আবল তাবল বলব কেন গো? আমাদের গায়ে মেয়েদের ইস্কুল লাই তুমি জান না? অনেকে ইস্কুলে যেতে চায় কিন্তু অনেক বিপদ।
এখানে ইস্কুল করলে কী সুবিধা শুনি।
জবা যেন আশ্বাসের সুর শুনতে পেল । উৎসাহিত হয়ে বলল, এই দেখ ক্যানেল চলে গেছে উত্তরে, দক্ষিনে, পুবে। প্রতিটি গ্রামের পাশ দিয়ে গেছে এই ক্যানেল। ক্যানেলের পার দিয়ে পায়ে হাঁটা রাস্তা সারা বছর ঠিক থাকে। চারিদিকের গ্রামের মেয়েরা এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসবে। কিছু হলে কেউ না কেউ দেখতে পাবে। কোথাও কোন আড়াল নেই। কেউ আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে না। আমার খুব ইস্কুলে যেতে ইচ্ছে করে।
বলে ক্যানেলের পাড়ের মাটিতে সে কোপ বসায়। কোথায় যেন কট করে শব্দ হয়। মনে হয় আছে শামুক আছে। তার চার পাশ থেকে চাগাড় দিলে ঠিক বেরিয়ে আসবে। আসলে খোঁজাটাই আসল। তার পর খোলা থেকে শামুক এমনি বেড়িয়ে আসবে। পড়ে থাকবে খোলা।
রাজীব তাকিয়ে থাকে জবার দিকে। মেয়েদের জন্য এমনি উন্মুক্ত ইস্কুলের রাস্তা যদি সারা পৃথিবী তে হতো তাহলে মেয়েরা কত নিরাপদ থাকত । প্রতিদিন মেয়েদের উপর নানা নির্যাতন হয়ত জবা জানে না, সে খবরের কাগজ পড়তে পারে না, তাদের বাড়িতে টেলিভিসন নেই। রেডিও হয়ত গ্রামে কদাচিত বাজে। লোক মুখের কথাতেই তাদের ভরসা। তার বাড়িতে কে আছে রাজীব জানে না তবে জবা যে সাহসী, প্রান্তিক গ্রামের দরিদ্র পরিবারের এক কায়িক শ্রমিক, তাতে তার সন্ধেহ নেই । এমন একজন শামুক কুড়ানীর মাথায় একটি উন্মুক্ত ইস্কুলের পরিকল্পনা কী ভাবে আসে তাই সে নির্ণয় করতে পারে না। জবাকে দেবার মত কোন উত্তর মাথায় আসে না রাজীবের।