বিদিশা বসু
হিমাচলের এক শান্ত রাজমহলে দিনযাপনের কথা
সিমলা – মানালি ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে প্রায় সবারই থাকে। প্রকৃতি দুহাত ভরে সাজিয়েছে হিমাচল প্রদেশের আনাচ কানাচ। সেই হিমাচলেই আছে সুসজ্জিত এক রাজকীয় ব্যবস্হাপনা। সিমলার বদলে যদি সেখানে দুটো দিন কাটানো যায়,তবে কিন্তু মন্দ হয় না!! সিমলার মত জনপ্রিয় শহরের কোলাহল থেকে একটু দূরে, পাইন দেবদারু মোড়া এক রাজপ্রাসাদে থাকার অভিজ্ঞতা কিন্তু অতুলনীয়।

চণ্ডিগড় থেকে ৩ ঘন্টা যাত্রা শুরু করে, সিমলা যাওয়ার পথে একটি রাস্তা বেঁকে যায় চেইল এর দিকে। সিমলা থেকে ৪৪ কিমি দূরে এই ” চেইল প্যালেস”। প্রায় ৭৫ একর জমি নিয়ে তৈরি পাতিয়ালার মহারাজার এই সাম্রাজ্য। সে সময়ে ব্রিটিশ দের গ্রীষ্ম কালীন রাজধানী ছিল সিমলা শহর। সুন্দর সাজানো গোছানো সিমলার স্থাপত্য জুড়ে ব্রিটিশ কলোনিয়াল সংস্কৃতির ছাপ স্পষ্ট। সেই সিমলা থেকে কিছুটা উপরে অবস্থিত চেইল নামক জায়গায় পাতিয়ালার মহারাজা ১৮৯১ সালে তাঁর রাজপ্রাসাদ তৈরি করেন। পরবর্তীতে সিমলা শহরে মহারাজা ভুপিন্দর সিংহের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেন যখন ব্রিটিশ শাষক,তখন পাতিয়ালার মহারাজাও নিজের আত্মগরিমা বজায় রেখে সিমলা থেকে উচ্চ স্হানে অবস্হিত এই ছোট্ট জায়গা চেইল কে নিজের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসেবে বেছে নিয়ে রাজপ্রাসাদের আশপাশকে সুসজ্জিত করেন। পাহাড়ি দেওদর গাছে ঘেরা এই জায়গা থেকে সিমলা সহ আশপাশের স্হানও খুব সুন্দর দেখা যায়। স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে,হিমাচল প্রদেশের সরকার সরকারি ভাবে এই প্যালেসকে অধিগ্রহণ করেন এবং এখন বর্তমানে এটি হিমাচল প্রদেশ টুরিজম ডিপার্টমেন্টের একটি হেরিটেজ হোটেল।
এই বিশাল জায়গা ‘ চেইল প্যালেস ‘ হিসেবে পর্যটকদের কাছে পরিচিত। সিমলা থেকে ১-১.৫ ঘন্টা দূরত্বে অবস্হিত এই প্যালেস দেখতে সকাল ১০ টা থেকে ভীড় লেগে থাকে পর্যটকদের। গেটের বাইরে ১০০ টাকা প্রতি জন টিকিট ক্রয় করে দর্শনার্থীরা ঘুরে দেখতে পারেন এই রাজপ্রাসাদ এবং তার চারপাশের নানা জায়গা।
আমরা একটু অন্যভাবে এই জায়গা উপভোগ করলাম। সিমলা শহরে না থেকে হিমাচল টুরিজমের এই হেরিটেজ হোটেলে দুটো দিন থেকে অপার সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। এখানে নানা রকম দামের রুম পাওয়া যায়।প্রধান যে রাজপ্রাসাদ আছে, সেই প্যালেসে মহারাজা, মহারাণীর স্যুট রুম সহ রাজকুমার, রাজকুমারীর রুম,উজির এবং দেওয়ানের রুম নামে সব ঘর আছে। এক এক রুমের এক রাতের খরচ এক একরকম। ৫৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ১২০০০ টাকার রুমও এই প্যালেসের মেইন বিল্ডিংয়ে আছে। এছাড়া অ্যানেক্স বিল্ডিং এবং জঙ্গলের মধ্যে কটেজেও থাকার ব্যবস্হাপনা করা আছে।
আমরা প্যালেসের মেইন বিল্ডিংয়ে থাকার জন্য এক দারুণ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। প্যালেসের নীচের তলায় সাধারণ দর্শকদের জন্য সকাল থেকে খোলা থাকে। সেখানেই হোটেলের রিসেপশন কাউন্টার এবং খাবার জায়গা। সেই ডাইনিং হলের পাশে বিলিয়ার্ড রুম সহ রাজাদের ব্যবহৃত নানা জিনিস দিয়ে সাজানো মিউজিয়াম। ঠান্ডা পানীয় দিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে ওখানের স্টাফরা আমাদের উপরের দোতলায় নিয়ে যান,যেখানে সাধারণ ভিজিটার্সদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। শুধু মাত্র ঐ বিল্ডিংয়ে যাদের বুকিং থাকে,তারাই উপরের ঐ অপূর্ব সুন্দর ফ্লোরে যেতে পারেন। ঝাড়বাতি লন্ঠন দিয়ে সাজানো টানা বড় বারান্দার কোণে কোণে রাজকীয়তার ছোঁয়া। বিশাল বড় বড় ঘরের বাইরে রাজকুমার, রাজকুমারী, মহারাজ, মহারাণী লেখা আর দেওয়ালে দারুণ সব হাতে আঁকা ছবির বাহার।
দুপুরে খাবার জায়গায় ভীড় নজরে এলো। কাছাকাছি পাঞ্জাব হরিয়ানার মানুষজন ডে আউটিং হিসেবে এই জায়গাকে বেশ পছন্দ করেন,দেখে বোঝা যায়। সারাদিন ঘুরে ফিরে বিকেল বা সন্ধ্যায় ফিরে যাচ্ছিলেন অনেকে। সামনের মাঠ জুড়ে বসার জায়গা, বাচ্চাদের খেলার জায়গা,ছোট্ট ঝর্ণা আর ফুলের বাহার। এখানে ব্যাডমিন্টন এবং লন টেনিসের আলাদা কোর্ট আছে। সামনের মাঠে বড় বড় কোম্পানির মিটিং কিংবা বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্যও ভাড়া দেওয়া হয়। তেমনই কোন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছিল,তাই মাঠ জুড়ে প্যান্ডেল হওয়ার দরুণ প্যালেসের সামনের সৌন্দর্য একটু কম উপভোগ করলাম।

তবে প্রকৃতির নিস্তব্ধ রূপ এবং কোলাহল মুক্ত পরিবেশ এর আশেপাশের দৃশ্যকে ছবির মত সাজিয়ে রেখেছে। দুপুরে লাঞ্চ করে আমরা পায়ে হেঁটে প্রাসাদের চারপাশ ঘুরে দেখতে লাগলাম। ৩ কিমি দূরে একটি মন্দির আছে,সেটিও শান্ত সুন্দর। এছাড়া চিলড্রেন পার্ক,গাড়ি রাখার জায়গা সব সুন্দর আয়োজন আছে। আর আছে পাইন রডোডেনড্রন দেওদর গাছে ঘেরা ছোট ছোট গলির মত পথ। আর তার ফাঁকে ফাঁকে পাহাড়ের কোণে কটেজ। পাহাড়ি ডেইজি ফুলে মুড়ে আছে ফাঁকা জায়গা। এত রঙ বাহারি ফুল,নাম না জানা পাখি আর ফুল… এ জায়গাকে করেছে আলাদা। প্রকৃতির কোলে নিরিবিলিতে ঘুরে প্রাকৃতিক পাহাড়ি সৌন্দর্য উপভোগ করার যথাযোগ্য জায়গা চেইল।
রাতের পরিবেশ আবার সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে সন্ধ্যা নামে অনেক পরে। ৭ টার সময়ে হালকা আলোর ছোঁয়ায় প্যালেসের পরিবেশ মায়াবি হয়ে যায়। সকাল থেকে নানা জায়গা থেকে আসা পর্যটকের ভীড় লেগে থাকে প্যালেসের সংগ্রহশালা দেখতে। সেই কলরবে মুখরিত প্যালেস ৭ টার পরে নির্ঝুম শান্ত হয়ে যায়। কয়েকজন ওখানে রাত্রি বাস করা আমাদের মত পর্যটক ছাড়া অন্য কারোর অস্তিত্ব থাকে না। আর মহলের দোতলা তো রাতে আরও নিঃশব্দ,নিজের পায়ের আওয়াজেও বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ার জোগার। ওত বড় ফ্লোরে রাতে আমরা কয়েকজন ঘুরে,সামনের মাঠের অন্ধকার উপভোগ করার অভিজ্ঞতাও বেশ রোমহষর্ক।
এখান থেকে পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে সিমলার আসেপাশ ঘুরে দেখে দুপুরে সিমলা মলের কোলাহল মুখরিত পরিবেশ বেশ ভালো লাগলো। সিমলা কালিবাড়িতে গিয়ে নিজস্ব সংস্কৃতির স্পর্শ বেশ উপভোগ্য। সিমলামলে পায়ে হেঁটে,বসে,সেখানের কালচারকে চাক্ষুষ করতে বেশ লাগে। সন্ধ্যা নামার পরে আবারও ফিরে এসেছিলাম সেই মায়াবি স্বপ্নপুরীতে। সন্ধ্যায় সেই নিস্তব্ধ ফাঁকা রাস্তা ধরে ফিরতে ফিরতে মনের মধ্যে শান্তি অনুভব হচ্ছিল।
প্রকৃতির মাঝে দুটো দিন শান্তিতে নিরিবিলিতে কাটানোর জন্য “চেইল প্যালেস” খুব ভালো একটা জায়গা। এখানে রাত্রিবাস করার জন্য হবে হিমাচল প্রদেশ টুরিজম থেকে রুম বুকিং করতে হবে। চন্ডীগড় থেকে প্রায় ১০৫ কিমি দূরে, পৌঁছাতে ৩.৫ ঘন্টা মত সময় লাগে এবং সিমলা শহর থেকে ৪৫ কিমি দূরে অবস্হিত এই প্যালেস একবার ঘুরে দেখে আসতেই পারেন… আশা করি নিরাশ হবেন না।