অমিতাভ সরকার

এক ব্যক্তিত্বময়ী বিদুষী শিল্পী

গীতা ঘটক

রবীন্দ্র সদনে গান গাইবেন বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী মান্না দে। উপলক্ষ্য কাকা বিখ্যাত সুরকার গায়ক অভিনেতা কৃষ্ণচন্দ্র দের জন্মদিন। হলে তিল ধরনের স্থান নেই। বোম্বে, কলকাতাসহ সারা দেশজুড়ে সে সময় থেকেই মান্না দের বিশাল নাম। আবার আয়োজকদের মধ্যেও তিনি আছেন। প্রিয় বাবু কাকার কাছেই যে তাঁর গানের হাতেখড়ি, এবং কাকার প্রদর্শিত পথ ধরেই বড়ো হওয়া। অন্তরের এই অমোঘ টান উপেক্ষা করা যায় কখনো? 

যাই হোক, আসল ঘটনায় ফিরে আসি। মান্না দের অনুরোধে একজন গুণী শিল্পী স্টেজে উঠলেন। তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতই গাইবেন। শ্রোতারা মান্না দের গান শুনতে এসেছে। কিন্তু মান্না দে স্বয়ং যে ওঁর গান শুনতে চাইছেন। তিনি শিল্পীর বহুবিধ প্রতিভার সঙ্গে আগে থেকেই পরিচিত। তাছাড়া রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া সবকিছুই যে অসম্পূর্ণ। কিংবদন্তী কৃষ্ণচন্দ্র দে নিজেও রবীন্দ্রসঙ্গীত খুবই ভালোবাসতেন, কিছু রেকর্ডও করেছিলেন। তাঁর স্মরণ অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রগান হবে না, তাও কি হয়?

অবশেষে গান ধরলেন শিল্পী । একটু অন্য ধরনের গলা, স্পষ্ট উচ্চারণ, খাদসপ্তক থেকে তারাসপ্তকে অনায়াসে উঠে যায়, তেমনি গলার কাজ- যেন রাগরাগিণীর সুরসাধনায় এক্কেবারে দারুণভাবে রেওয়াজ করা, পাকাপোক্ত করে বানানো। একের পরে এক রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে চলেছেন। শ্রোতারাও মন দিয়ে গান শুনছেন, সমাহিত হচ্ছেন। কিন্তু একে একে তিনটে গান গাওয়ার পর চতুর্থ গানের সময় শ্রোতারা আর শুনতে চাইছে না৷ ‘গুরুদেব মান্না দে মান্না দে’ বলে চিৎকার শুরু হয়ে গেছে। নাহ, আর তো ধৈর্য রাখা যাচ্ছে না। কিছু তো বলা দরকার। যেখানে শিল্পেরই সম্মান নেই, সেখানে নিজেকে সামলে চলারও কোনো মানে হয় না। তাছাড়া সব সময় চুপ থাকা মানে নিজের আত্মাকেই অসম্মান করা। সেদিনের অপমানিত শিল্পীটি হারমোনিয়াম দূরে রেখে ক্ষুব্ধ হৃদয়ে শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,’এখানে গানের শ্রোতাও যেমন নেই, তেমনি সৌজন্যতাটুকুও নেই।’ এই ব্যক্তিত্বময়ী বিদুষী শিল্পীর নাম গীতা ঘটক। 

রবীন্দ্রসঙ্গীতের কিংবদন্তী হিসাবে আজও তিনি বিপুল সমাদৃত। এক অপূর্ব কণ্ঠ গুণে তিনি সমকালীন শিল্পীদের চেয়ে আলাদা। তাঁর গান শুনলে মনে এক অপূর্ব আবেশের ঘোর লেগে যায়, যা আর মন থেকে ছাড়ে না- থেকেই যায়।      

সারাটা জীবন সোজা কথা সোজা ভাবে বলার সৎসাহস সবার মধ্যে থাকে না। তাঁর ছিল। রবীন্দ্রসঙ্গীতের অপমান উনি কোনোদিন সহ্য করেননি। কিন্তু বহুমুখী প্রতিভার অধিকারিণী এই সাধিকা সংস্কৃতিপ্রেমী বাঙালি শ্রোতাদের কাছে অনেকটা অবহেলিতই রয়ে গেছেন। 

মাতৃভাষা বাংলা হলেও মুখে প্রথম বোল ফোটে কিন্তু জার্মান ভাষায়। জন্ম ২৩ শে জানুয়ারি, ১৯৩১ সালে রাজশাহীতে জন্ম। জন্মের পরেই বার্লিনে চলে যেতে হয়, (জাপানেও ছিলেন) সেখানে শৈশব অতিবাহিত করে তারপর লখনউতে ফিরে আসা। মাতাপিতা দু’জনেই ছিলেন বিদগ্ধ মানুষ।   

পিতা বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. কানাইলাল গঙ্গোপাধ্যায়, মা ব্রাহ্ম স্কুলের ছাত্রী হওয়ার সুবাদে চমৎকার ব্রহ্মসঙ্গীত গাইতেন, মাতামহ ছিলেন কান্তকবি রজনীকান্ত সেনের পরম সুহৃদ, নিজেও ভালো পাখোয়াজ বাজাতেন। ফলে গীতা ঘটক পারিবারিক উত্তরাধিকার সূত্রেই সাঙ্গীতিক গুণগুলো লাভ করেছিলেন। ছোটোবেলাটা বাংলার বাইরে কাটলেও মায়ের কণ্ঠে প্রতিদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতেন। পিতা কানাইলাল গ্যোটের ‘ফাউস্ট’-র বাংলায় অনুবাদ করে জার্মানিতে সম্বর্ধিত হন। পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুর সঙ্গে ওঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। পণ্ডিতজির অনুরোধেই ন্যাশনাল হেরাল পত্রিকা জেনারেল ম্যানেজার হয়ে সপরিবারে লখনউতে চলে আসেন। সঙ্গীতজ্ঞ ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রত্যহ ওঁদের বাড়িতে আসতেন। এই বিদগ্ধ মানুষটি বুঝতে পেরেছিলেন শান্তিনিকেতনে না গেলে ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে যেমন ভালোভাবে তার পরিচিতিটা ঘটবে না, আবার সেই সঙ্গে কিশোর গীতা বাংলাটাও ভালোভাবে শিখবে না। 

এইভাবে ধূর্জটিপ্রসাদের ইচ্ছাতেই কিশোরী গীতার শান্তিনিকেতনের পাঠভবন ও সঙ্গীতভবনে পড়াশোনা করতে আসা। এই দু’বছর শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে গুরু হিসেবে লাভ করেন। শান্তিনিকেতনে গানের অনুষ্ঠানেও অংশ নিচ্ছেন। এদিকে পিতাও কন্যা বিরহে কাতর। ফলে কিশোরী গীতাকে আবার লখনউ ফিরে আসতে হলো। নাচে প্রতিষ্ঠিত হবেন বলে লখনউয়ের মরিস কলেজে ভর্তি হন। আশা ওঝার কাছে কত্থক শেখার পাশাপাশি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শেখার পাশাপাশি অল ইন্ডিয়া রেডিওতেও গান গাওয়া চলছে পুরোদমে । কর্তৃপক্ষ গীতার পরিণত কণ্ঠশৈলীর জন্য তাকে কিশোরী বয়সেই বড়দের বিভাগে উন্নীত করলেন। ছোটোর থেকেই পড়াশোনাতেও খুব ভালো ছিলেন। ক্লাসে প্রতিবারই প্রথম হতেন। ইসাবেলা বোয়ান কলেজ থেকে ইংরেজি সাম্মানিক বিষয় নিয়ে স্নাতক হন। একটা সময়ে নাচ না গান কোন দিকে যাবেন তা নিয়েও ধন্দে পড়ে গেছিলেন। শান্তিনিকেতনে ফিরে আসা কিন্তু কথাকলি নাচ শেখার উদ্দেশ্য নিয়েই। নাচের শিক্ষক চাইতেন, গানের জন্য সময় না দিয়ে নাচটা ভালো করে করুক, আর গীতার প্রিয় ‘শৈলজাদা’ বলতেন, বেশি নাচ করলে গলার সূক্ষ্মতা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু কার গলা নষ্ট হবে? ছোটো বয়স থেকেই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তালিম নিয়ে তালিম নিয়ে গীতার গলা যে তৈরি! ইতিহাসে স্নাতকোত্তর পড়ার পাশাপাশি ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, প্রিয় ‘শৈলজাদা’ (শৈলজারঞ্জন), কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গান শেখা চলতে থাকলো। বিবিদির(ইন্দিরা দেবী) কাছে শিখেছিলেন- ‘চিরসখা হে’,’আজি যে রজনী যায়’-এর মতো রবীন্দ্রসঙ্গীত। আগেই রেডিওতে গান গাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল, মুখ্যত গুরু শৈলজারঞ্জনের কথাতেই ১৯৫২ সালে আবার বেতারে গান গাওয়া শুরু। তারপর কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে গ্রামোফোনে রেকর্ড বেরোলো-’দুজনে দেখা হলো’, ‘সখী বহে গেল বেলা’। ভীষণ জনপ্রিয় হয় রেকর্ড দুটো। পড়াশোনা চলাকালীনই সাহিত্যিক মনীষ ঘটকের পুত্র অনীশ ঘটককে বিবাহ করেন (অনীশ ঘটক মহাশ্বেতা দেবীর ভাই ছিলেন) এবং সেইসূত্রেই বোম্বে চলে আসা। তবে গান ছাড়া একদমই ভালো লাগছিল না। অনীশ ঘটক মানুষ ভালো ছিলেন, কিন্তু বংশপরম্পরায় সুরাসক্ত হয়ে পড়েন, ফলে গীতা ঘটকের বিবাহিত জীবন তেমন ভাল ছিল না।   

১৯৬১ সাল। কবিগুরুর জন্মশতবর্ষ। কন্যা পরমাকে নিয়ে আবার কলকাতায় চলে এলেন৷ শৈলজারঞ্জন ‘বর্ষামঙ্গল’ অনুষ্ঠানে গীতা ঘটককে দিয়ে গান গাওয়াতেন। ১৯৭২ সালে ‘কী ধ্বনি বাজে’,’গেল গো, ফিরিলো না’ রেকর্ডটা খুব বিখ্যাত হলো। ‘তুমি যেওনা এখনি’ এবং ‘যা হবার তাই হবে’ গানদুটো বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে আবারও জনপ্রিয়তার শিখরে। গীতা ঘটকের মতো ব্যতিক্রমী শিল্পী খুব কমই দেখা যায়, যিনি কোনো রাবীন্দ্রিক ছক বাঁধা গৎ-য়ে আটকে থাকেননি।

অন্তর দিয়ে গাইতেন, শ্রোতাদের বিমোহিত করতেন, গানের গায়কি, টেকনিক ওসব নিয়ে অযথা ভেবে গানটার মাধুর্য রসহীন করা থেকে বিরত থেকেছেন। চাটুকারিতা, ফাঁকিবাজি, আত্মপ্রচার কোনোদিনই পছন্দ করেননি। তবে আত্মপ্রত্যয় যথেষ্টই ছিল, রবীন্দ্রসঙ্গীতটা যেমন সুন্দরভাবে গেয়ে গেছেন, তেমন এই গানের বিষয়ে যথেষ্ট ব্যক্তিত্বপূর্ণ মতামতও দিয়েছেন- তা সে গৃহীত হোক বা না হোক। পরবর্তীকালে বিশ্বভারতীর দলের সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাতে চীন, রাশিয়া ওয়ারশও গিয়েছেন। পেশায় কলকাতা সাউথ পয়েন্ট স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন, এখানে ইংরেজি অংকের পাশাপাশি মিউজিক ছাড়াও অন্যান্য সাবজেক্টেও পড়াতেন। সহজ সরল মনের, স্টাইলিশ, সুন্দরী এই মানুষটি দীর্ঘকাল অল ইন্ডিয়া রেডিওর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অনেক কঠিন কঠিন রবীন্দ্রসঙ্গীত অবলীলায় যেতে পারতেন। গীতবিতানের সমস্ত গান ওঁর কণ্ঠস্থ ছিল। পরিণত বয়সেও বই বা খাতা না দেখে বিশুদ্ধ স্বরলিপি সহযোগে কী অসাধারণভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলো পরিবেশন করতেন, তা ওঁর রেকর্ড বা লাইভ অনুষ্ঠান দেখলেই বোঝা যায়। শ্রোতাদের দিকে সোজাসুজি চোখে চোখ রেখে, সোজা হয়ে বসে একমুখ হাসি নিয়ে হাসতে হাসতে গাইতেন। কখনো গানের ভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নাচের মুদ্রাতেও শরীর হাত, পা আন্দোলিত হতো। শ্রোতাদের যে কোনো ধরনের অনুরোধের গান শোনাতেও কোনোরূপ কুণ্ঠাবোধ করতেন না, তা সে যেকোনো ধরনের যত কঠিন রবীন্দ্রসঙ্গীতই হোক না কেন। সঙ্গীত পরিবেশনকালে যেমন হাই পীচে সাবলীলভাবে গলা চলে যেত, তেমনি গানের ভাবে শ্রোতারাও মুগ্ধ, আবিষ্ট হয়ে পড়তেন। এক অনিন্দ্যসুন্দর আনন্দময় পরিবেশ সৃষ্টি হতো। গীতা ঘটকের চোখ-মুখে ফুটে উঠতো সেই আনন্দঘন প্রতিচ্ছবি।   

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একনিষ্ঠ অনুধ্যান ছিল বলে কোনো ধরনের গান গাইতেই ওঁর কোনোরকম অসুবিধা হতো না। সে যুগে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনাতেও কিছু আধুনিকতার নজির রেখে ছিলেন। 

মায়া সেন, নীলিমা সেন, সুচিত্রা মিত্র, রাজেশ্বরী দত্ত প্রভৃতি খ্যাতনামা শিল্পীদের পাশাপাশি গীতা ঘটক নিজেই হয়ে উঠেছিলেন এক স্বতন্ত্র নাম। ’প্রভু তোমা লাগি’,’সখী আঁধারে একেলা ঘরে’,‘যেদিন ফুটলো কমল’,’কী রাগিনী বাজালে’, ‘এখনো গেল না আঁধার’,’ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা’,’শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা’- ওঁর কণ্ঠে গানগুলো কি ভোলা যায়?

গানটা ভালো বুঝতেন, সঙ্গীতে যথেষ্ট গভীরতা ছিল বলেই তা নিয়ে কোনোপ্রকার ভুল, অন্যায়ের কাছে কোনোদিন আপোষ করেননি। নিজের নীতি নিয়ে চলেছেন আজীবন, কষ্ট পেয়েছেন, মানুষের ব্যবহারে মর্মাহতও হয়েছেন, কিন্তু আদর্শচ্যুত হননি একটি বারের জন্যেও।

এমনও হয়েছে, দেবব্রত বিশ্বাসকে যখন শান্তিনিকেতনে গান গাইতে দেওয়া হতো না, এই দৃঢ়হৃদয় শ্রদ্ধেয়া শান্তিনিকেতনে ওঁর নিজের বাড়িতে ডেকে এনেও গানের আসর বসিয়েছেন- ভয় পাননি, বা কোনো প্ররোচনায় প্রভাবিত হননি।  

উনি নিজেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানবাড়ি, দুর্গাপুজো, কালীপুজো, জলসা সব জায়গায় রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করতেন। সেটা অর্থের বিনিময়েই। (তবে এটা রোজকারের জন্য নয়। কারণ শিক্ষিকা হিসাবে পাওয়া মাইনেই তো তাঁর রোজগার। উনি মনে করতেন, শিল্পীর শিল্পসত্ত্বা, তাঁর পরিশ্রম -এগুলোর মূল্য আছে। জগতে যা সহজে পাওয়া যায়, মানুষ তার যথোপযুক্ত মূল্য দিতে ভুলে যায়।) হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পরে কবিগুরুর গানকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার এ এক প্রশংসনীয় প্রচেষ্টা। মহানায়ক উত্তমকুমারও গীতা ঘটকের গান শুনতে খুব পছন্দ করতেন।  

নাচ, গানের প্রতিভা তো ছিলোই, তাছাড়া নিজেও ভালো অভিনয় করতে পারতেন। স্বামী অনীশ ঘটকের ছোটোকাকা ঋত্বিক ঘটক পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে পড়াতেন। আইপিটিএর ‘বিসর্জন’ নাটক ঋত্বিক ঘটক গীতাকে ‘অপর্ণা’-র চরিত্রে অভিনয় করিয়েছিলেন। তাছাড়া খুড়োশ্বশুর ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’-য় সুপ্রিয়া দেবীর ছোট বোনের ভূমিকায় গীতা ঘটক অভিনয় করিয়েছিলেন।(এই সিনেমায় মহিলা কণ্ঠের সবকটি গানও গেয়েছিলেন। দেবব্রত বিশ্বাসের সঙ্গে একসঙ্গে গাওয়া ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’ আজও বিখ্যাত।’) 

অভিনয়ের জন্য প্রচুর আমন্ত্রণ এলেও স্বামীর আপত্তি থাকায় কয়েকটি সিনেমা ছাড়া আর অভিনয় করেননি। ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’,’তিতাস একটি নদীর নাম’,’সীমানা ছাড়িয়ে’-ইত্যাদি চলচ্চিত্রে গীতা ঘটককে অভিনয় করতে দেখা গেছে। বোম্বে থাকাকালীন ‘আমরা’ নামের একটা দল তৈরি করেন(পরে যার নাম হয় ইউথ কয়ার)। 

ছোটো থেকেই বিভিন্ন রকম পরিবেশে ওঁকে থাকতে হয়েছে। সব রকম পরিবেশেই মানিয়ে নিয়ে চলার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর। পরবর্তীকালে তিনি কেন জানি না সবার কাছ থেকেই উপেক্ষিত হয়ে পড়েন। কিংবদন্তী দেবব্রত বিশ্বাসের জীবনের সঙ্গে গীতা ঘটকের শেষ জীবনের অনেকটা মিল পাওয়া যায়। শেষের দিকে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি অনুষ্ঠানে ওঁকে সম্মান জানানো দূরে থাক, গান গাওয়াটাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। গুণমুগ্ধ প্রিয়জন, এমনকি পরিচিত নিকট গুণীজনরাও সেসময় কেউ তাঁর খোঁজ নেননি। কেবল উত্তমকুমারের শিল্পী সংসদ থেকে মাসিক এক হাজার টাকা করে ভাতাপ্রদান করা হতো। কোনো পুরস্কারও এই বঞ্চিত অবহেলিত শিল্পীকে দেওয়া হয়নি। এইসব যন্ত্রণা, কষ্ট নিয়েই ১৭ই নভেম্বর ২০০৯ সালে ৭৮ বছর বয়সে গীতা ঘটক রবীন্দ্রলোকে পাড়ি দেন। রেখে যান কিছু স্মৃতি, তাঁর অনবদ্য সব গান, আর ভাবীকালের কাছে কিছু প্রশ্ন: ভবিষ্যতে রবীন্দ্রসঙ্গীত কি মানুষ অন্তর থেকে গ্রহণ করবে, নাকি তাঁর মতো সুধাকণ্ঠী রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলে আবারও তাঁকে স্টেজ থেকে নামিয়ে দেওয়া হবে- বিভিন্ন চটকদার গানের বাহ্যিক আড়ম্বরে রবীন্দ্রনাথ আর তাঁর সৃষ্টি কলুষিত হবে- শিল্পী শিল্পভাবনা থেকে সরে গিয়ে বাণিজ্যিক প্রচারেই নিজেদের ব্যস্ত রাখবেন- দেবব্রত বিশ্বাস, গীতা ঘটক, মায়া সেনের মতো শিল্পীদের যথাযথ কদর করতে বাঙালিরা বারবার ভুলে যাবে, সুরবিকৃতির আসুরিক তাণ্ডবে যান্ত্রিকভাবেই রবীন্দ্রসঙ্গীতকে কি রবীন্দ্রনাথের নিজের রচনা-সুরকৃত সৃষ্টি বলে মনে হবে, সত্য সুন্দরের নীরব সাধনা কি সত্যিই ব্রাত্য থেকে যাবে আপামর বাঙালি শ্রোতাদের সুকুমার মন থেকে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *