সৌমিতা রায় চৌধুরী

পর্ব – ৮

বিশ্ববন্দিত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের বাস্তববাদী ত্রয়ী যদি ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ ও ‘অপুর সংসার’ হয়, তবে বাংলা ভাষার প্রথম সুপার হিরো সৃষ্টির গৌরবও তাঁর। শিশু সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ রূপকথার গল্প অবলম্বনে ১৯৬৯ সালে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। সত্যজিৎ রায় নিজেই এই ছবির চিত্রনাট্য রচনা ও সংগীত পরিচালনা করেছেন। 

দুই উচ্চাকাঙ্ক্ষী সংগীতশিল্পী গুপী এবং বাঘার যাত্রা অনুসরণ করে এই চিত্রনাট্যের শুরু। যাদের ভূতের রাজা তিনটি যাদুকরী বর প্রদান করে। গুপী তার গানের মাধ্যমে যেকোনো ব্যক্তিকে মন্ত্রমুগ্ধ করার ক্ষমতা অর্জন করে অন্যদিকে বাঘা তার বাজনার মাধ্যমে মানুষকে গতিহীন করে দিতে পারে। 

‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সিনেমায় তপেন চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, সন্তোষ দত্ত, হরিন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, জহর রায় ও শান্তি চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করেন। চিত্রগ্রাহক ছিলেন সৌমেন্দু রায়। সম্পাদক ছিলেন দুলাল দত্ত। 

গল্পের দুই নায়ক গুপী এবং বাঘা সংগীতের প্রতি অনুরক্ত হলেও সাঙ্গীতিক প্রতিভা তাদের মধ্যে ছিল না। এই কারণে গুপীর গ্রাম আমলকি ও বাঘার গ্রাম হরিতকী থেকে তারা বিতাড়িত হয়। পথে বনের মধ্যে দুই সরল একনিষ্ঠ মানুষের সাক্ষাত হয়। সেখানে ভূতের রাজার বরে তারা সুপার হিরো হয়ে ওঠে। প্রথম বরে তারা যখন ইচ্ছে তখনই মনের মত খাবার পেতে পারে এবং দ্বিতীয় বরে দু’জোড়া বিশেষ জুতো ও দু’জনের হাতে হাতে তালি দিয়ে দেশবিদেশ ঘোরার ক্ষমতা পায় এবং তৃতীয় বরে সংগীত এবং বাদনের মাধ্যমে মানুষকে গানবাজনা শুনিয়ে অবশ করে দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করে। 

এরপর শুন্ডীর রাজাকে গান শুনিয়ে তাঁর সভা গায়ক হয়ে তারা সেখানে থেকে যায়। শুন্ডীর প্রতিবেশী রাজা হাল্লা শুন্ডীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে গুপী এবং বাঘা হাল্লায় গুপ্তচরের বেশে যায় এবং সেখানে ভূতের রাজার বরে পাওয়া সংগীত প্রতিভা দিয়ে যুদ্ধ থামিয়ে দেয়। এরপর শুন্ডীর রাজকন্যা মণিমালার সাথে গুপীর এবং হাল্লার রাজকন্যা মুক্তামালার সাথে বাঘার বিয়ে হয়ে যায়। 

মূলত ছোটদের জন্য নির্মিত হলেও ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সব বয়সের দর্শকদের কাছে সমান উপভোগ্য। ছবির মূল আকর্ষণ সত্যজিৎ রায় রচিত গানগুলি। সাড়ে ছ’মিনিটের ভূতের নৃত্যের একটি দৃশ্য ভারতীয় ঘরানায় নির্মিত একটি স্পেশাল এফেক্ট। ভূতের রাজার দেওয়া বর সত্যজিৎ রায় নিজের গলায় উপস্থাপন করেছেন। এই ছবির গানগুলি গেয়েছেন অনুপ ঘোষাল, রবি ঘোষ এবং কানু মুখার্জী। 

এই ছবিটি অনেকগুলি পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছে। রাষ্ট্রপতি স্বর্ণ ও রৌপ্য পদক ১৯৭০। শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে ১৯৬৯ সালে অকল্যান্ড থেকে পুরস্কার অর্জন করে। ১৯৭০ সালে টোকিও থেকে ‘মেধা’ পুরস্কার এবং মেলবোর্ন থেকে শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার অর্জন করে। আকাদেমি ফিল্ম আর্কাইভ ২০০৩ সালে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সিনেমাটি সংরক্ষণ করে। 

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *