আশিস ভৌমিক
লেখক পরিচিতি
(জন্ম 5 ই এপ্রিল 1974, গ্রাম -বৃন্দাবনচক , পাঁশকুড়া , পূর্ব মেদিনীপুর ।প্রাথমিক পড়াশোনা গ্রামে ।উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতায় ।সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে রসায়ন শাস্ত্রে স্নাতক ।গৃহ শিক্ষকতার ফাঁকে ফাঁকে সাহিত্য চর্চা । বিভিন্ন লিট্ল ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন । প্রথম কাব্যগ্রন্থ “”হিরণ্ময়ী ” । দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ” কালবেলা “।
দ্বিতীয় পর্ব
মানুষের জন্ম
এনকি পরামর্শ দিলেন, দেবতাদের দাস হিসেবে তাদের আকার-আকৃতিতে একটা কিছু সৃষ্টি করবার। যে-ই কথা, সে-ই কাজ। আনুর অনুমতি পেয়ে তিনি এক দেবতাকে হত্যা করলেন। মৃত দেবতার রক্ত-মাংস কাদামাটির ছাঁচে ফেলে এনকি তৈরি করলেন প্রথম মানুষ। এদের পাঠালেন তিনি কাজ করতে, আর দেবতারা মনের আনন্দে আমোদ-প্রমোদে মেতে উঠলেন। মানুষ তাদের সেবা করতে লাগল। বলা হয়, প্রথম মানুষ যেখানে সৃষ্টি হয়েছিল, তার নাম ইডেন- দেবতাদের বাগান। বাগানটির অবস্থান ছিল টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিসের মাঝে কোনো এক জায়গাতে।বাইবেলে বর্ণিত স্বর্গের এডাম আর ইভের কাহিনীর সাথে এই সুমেরীয়’দের মনুষ্য সৃষ্টির গল্পের কিছু সাদৃশ্য পাওয়া যায় ।
মানুষ সৃষ্টির পর কাজ করতে হবে না- এ খুশিতে সব দেবতারা ভোজসভায় মিলিত হলেন। এখানে নেশার ঘোরে এনকি আর প্রজননের দেবী নিন্মাহের মধ্যে তর্ক বেঁধে যায়। এনকি বড়াই করলেন, নিন্মাহ যেভাবেই মানব বানান না কেন, তিনি তার জন্য সমাজে কোনো না কোনো স্থান খুঁজে দিতে পারবেন। নিন্মাহ একে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলেন। তিনি প্রথমে বানালেন এমন এক মানুষ, যার হাত সারাক্ষণ কাঁপতে থাকে। এনকি তাকে রাজদরবারের সভাসদ করে দিলেন। এবার নিন্মাহ সৃষ্টি করলেন এক অন্ধ ব্যক্তির, এনকি তাকে পরিণত করলেন সুকণ্ঠী গায়কে। নিন্মাহ খুঁড়িয়ে চলা এক লোক তৈরি করলে এনকি তাকে কামারের কাজ দিলেন।
নিন্মাহের রোখ চেপে গেল। তিনি পর্যায়ক্রমে বন্ধ্যা এক মানবী এবং না-পুরুষ, না-নারী এক অস্তিত্বের সৃষ্টি করলেন। প্রতিবারই এনকি তাদের কাজের জন্য কোনো না কোনো উপায় বের করে ফেলেন। হতাশ হয়ে নিন্মাহ চলে যান। এনকি এবার নিজেই এক মানুষ সৃষ্টি করেন, যার শরীর ছিল চরমভাবে বিকৃত। তার কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গই সঠিকভাবে গঠিত ছিল না। নিন্মাহ তাকে দেখে প্রচুর রেগে গেলেন। এনকি স্বীকার করলেন, সৃষ্টির ব্যাপারে নিন্মাহ তার থেকে অনেক ভালো। তারা বুঝতে পারলেন, মানুষকে সঠিক আকারে না বানালে তারা দেবতাদের উপাসনা করবে না।
আরেক বর্ণনায় আছে, দেবতারা ভোজসভাতেই মানব সৃষ্টি করেছিলেন। কি কাদামাটি দিয়ে যাদের বানালেন, তারা কেউ সন্তান জন্মদানে সমর্থ ছিল না। ফলে এনকি নতুন করে আরো কিছু মানুষ সৃষ্টি করলেন। কিন্তু তারা ছিল বেশ দুর্বল। সুমেরিয়ানরা বলত, মানুষের দুর্বলতা আর রোগবালাই দেবতাদের নেশার ঘোরে সৃষ্টি করার ফল।
আডাপার আখ্যান
প্রথমদিকে মানুষ শিশু জন্মদানে অক্ষম হলেও শীঘ্রই দেবতারা বুঝতে পারেন, মানবসংখ্যা বৃদ্ধি করতে হলে প্রজননের ক্ষমতা দিতে হবে। ফলে প্রথম সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে তারা অ্যাডাপাকে সৃষ্টি করলেন। সে কাজ করত এরিদু নগরীতে। মাছ ধরে দেবতাদের মন্দিরে নিয়ে আসত। দখিনা হাওয়ার দাপটে একবার মাছ ধরতে গিয়ে সে দুর্বিপাকের শিকার হয়। তিক্ত-বিরক্ত অ্যাডাপা বায়ুকে অভিশাপ দিলে তার ডানা ভেঙে যায়। এতে করে দক্ষিণ বাতাসের উপকারিতা থেকে এরিদুর লোকেরা বঞ্চিত হতে থাকে। আনু অ্যাডাপাকে জবাবদিহিতার জন্য ডেকে পাঠালে এনকি তার প্রিয় সন্তানকে কিছু বুদ্ধি শিখিয়ে দিলেন।
সেই মোতাবেক অ্যাডাপা শোকের পোশাকে আনুর সামনে হাজির হলেন, যাতে দেবতাদের দেবতা তার প্রতি নমনীয় হন। আনু খুশি হয়ে তাকে স্বর্গীয় রুটি আর পানি দিতে চাইলে আডাপা এনকির পরামর্শমতো তা গ্রহণে অপারগতা জানিয়ে আনুর কাছে তেল চেয়ে নিলেন। আনু কৌতুক বোধ করলেন, তবে তিনি সেই প্রার্থনা মঞ্জুর করেন।
স্বর্গীয় পানি আর রুটি গ্রহণ করে দেবতারা অমর থাকতেন। তাই তা খেয়ে আডাপাও হয়ত অমর হয়ে যেতেন। এর বিশ্লেষণে বেশ কয়েকটি মতের একটি হলো, এনকি চাননি মানবজাতি দেবতাদের মতো অমর হয়ে উঠুক। আবার অনেকে বলেন, দেবতাদের খাদ্য নশ্বর মানবের জন্য নয়। যে রুটি আর পানি দেবতাদের চিরদিন বাঁচিয়ে রাখবে, সেই খাদ্যই মানব শরীরকে নিমেষে হত্যা করবে। যা-ই হোক না কেন, স্বর্গ থেকে অ্যাডাপা নেমে এলেন সুস্থভাবে। মানুষকে শোনালেন আনু আর এনকির মহিমার কথা।
সুমেরীয় পুরাণে পাতাল লোক
ব্যাবিলনীয়রা সুমেরীয় পাতালপুরীকে তাদের পুরাণে ইরকাল্লা নামক একটি নরকীয় স্থান হিসাবে বর্ণনা করেছিল । মেসিডোনিয়ান (গ্রীক) এবং পরে রোমানরা, ইরকাল্লাকে হেডিস ( গ্রীক আন্ডারওয়ার্ল্ড ) হিসাবে চিহ্নিত করে; খ্রিস্টান মূর্তিতত্ত্বে, নরক/হাডেস
এই ইরকাল্লা হল সুমেরীয় পাতাল। এর প্রবেশদ্বারটি সুদূর পূর্বে জাগ্রোস পর্বতমালায় বলে বিশ্বাস করা হয়। এর সাতটি দরজা রয়েছে, যার মধ্য দিয়ে একজন আত্মাকে যেতে হয়।ইরেশকিগাল (ইরকাল্লা এবং আল্লাতু নামেও পরিচিত) হলেন মৃতদের মেসোপটেমিয়ার রানী যিনি পাতাল শাসন করেন। তার নাম ‘গ্রেট নিচের রানী’ বা ‘লেডি অফ দ্য গ্রেট প্লেস’ হিসেবে পরিচিত। তিনি মৃতদেরকে তার রাজ্যের মধ্যে রাখা এবং জীবিতদের প্রবেশ এবং পরকালের সত্য শিখতে বাধা দেওয়ার জন্য দায়ী ছিলেন। দেবতা নেতি হলেন তার দারোয়ান।
এরেশকিগাল তার স্বামী নেরগালের সাথে ইরকাল্লা শাসন করতেন। এরেশকিগালই একমাত্র যিনি তার রাজ্যে রায় দিতে এবং আইন দিতে পারতেন। তাকে উৎসর্গ করা মূল মন্দিরটি কুথায় অবস্থিত ছিল। প্রাচীন সুমেরীয় কবিতায় Inanna’s Descent to the Underworld এ এরেশকিগালকে ইনানার বড় বোন হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ইরেশকিগালের সাথে জড়িত দুটি প্রধান পৌরাণিক কাহিনী হল আন্ডারওয়ার্ল্ডে ইনানার উত্তরণের গল্প এবং দেবতা নেরগালের সাথে এরেশকিগালের বিয়ের গল্প।
পাতালপুরীর ফলের বাগান
সুমেরীয় পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে , সূর্য-দেবতা উতু রাতে পাতালের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করেন, এবং তিনি সূর্যোদয়ের প্রস্তুতিতে পূর্ব দিকে যাত্রা করেন। একটি সুমেরীয় পুরানে উতু আন্ডারওয়ার্ল্ডকে আলোকিত করে এবং সেখানে রায় প্রদান করে। শামাশ স্তবক 31 (BWL 126) বলে যে উতু মালকু , কুসু এবং আনুন্নাকির পাশাপাশি পাতাল জগতে মৃতদের বিচারক হিসাবে কাজ করে । পাতালপুরীর মধ্য দিয়ে যাওয়ার পথে, উতু অর্থাৎ সূর্যদেবতা একটি বাগানের মধ্য দিয়ে যায় বলে বিশ্বাস করা হয় , যেখানে গাছ রয়েছে যা ফল হিসাবে মূল্যবান রত্ন বহন করে। সুমেরীয় স্তোত্র ইনানা এবং উতুকে নিয়ে একটি মিথ রয়েছে যেখানে উতুর বোন ইনানা তার ভাই উতুকে তাকে এই পাতালপুরীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে, যাতে সে সেখানে জন্মানো একটি গাছের ফলের স্বাদ নিতে পারে, যা তার কাছে সমস্ত গোপনীয়তা প্রকাশ করবে। উতু মেনে নেয় এবং, ইনানা এই ফলের স্বাদ গ্রহণ করে এবং যৌনতা সম্পর্কে জ্ঞানী হয়।
পরকাল এবং জীবনতত্ত্ব
প্রাচীন মেসোপটেমীয়রা একটি পরকাল বিশ্বাস করত যা আমাদের পৃথিবীর নীচের একটি ভূমি। এটি ছিল এই ভূমি, যা পর্যায়ক্রমে Arallû , Ganzer বা Irkallu নামে পরিচিত , যার শেষেরটির অর্থ ছিল “গ্রেট নীচে”, যেটি বিশ্বাস করা হত যে প্রত্যেকেই মৃত্যুর পরে যায়, সামাজিক অবস্থান বা জীবনের সময় সম্পাদিত কর্ম নির্বিশেষে। খ্রিস্টান নরকের বিপরীতে, মেসোপটেমীয়রা পাতাল লোককে শাস্তির স্থান বা পুরষ্কার বলে মনে করত না। তবুও, মৃতদের অবস্থা পৃথিবীতে পূর্বে যে জীবন উপভোগ করা হয়েছিল তার মতো কমই বিবেচনা করা হয়েছিল: তাদের নিছক দুর্বল এবং শক্তিহীন ভূত হিসাবে বিবেচনা করা হত।
পাতালে ইশতারের বংশধরের পৌরাণিক কাহিনীটি বলে যে “ধুলো তাদের খাদ্য এবং কাদামাটি তাদের পুষ্টি, তারা কোন আলো দেখতে পায় না, যেখানে তারা অন্ধকারে বাস করে।” আডাপা পৌরাণিক কাহিনীর মতো গল্পগুলি বলে যে, একটি ভুলের কারণে, সমস্ত মানুষকে অবশ্যই মরতে হবে এবং সত্য অনন্ত জীবন দেবতাদের একমাত্র সম্পত্তি। যাইহোক, কিছু গল্প ইঙ্গিত করে যে নির্দিষ্ট কিছু দেবতা পরবর্তী জীবনে কিছুটা ভাল দিতে পারে যদি তাদের অনুগ্রহ পাওয়া যায়। অনেক দেবতা যারা তিয়ামাতকে হস্তগত করার সময় তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিল তাদের একইভাবে আন্ডারওয়ার্ল্ডে নির্বাসিত করা হয়েছিল, মেগাটেনের সাথে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন উচ্ছৃঙ্খল দেবতাদের পরে দানব করা হয়েছিল।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)