শরদিন্দু সাহা
লেখক পরিচিতি
বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।
বিষয় পরিচিতি
(রেভারেন্ড জেমস্ লঙ যে লক্ষ্য স্থির রেখে জীবনকে চালনা করেছেন তা শুধুমাত্র ঘটনাক্রম দিয়ে ধরা যায় না। তাঁর কর্মজীবনের পরিক্রমায় যে অন্তর্নিহিত শক্তি ও প্রভাব রয়েছে তাকে কোনও এক শিল্প মাধ্যম দিয়ে উপলব্ধি করা যায় না। কারণ কোনো সরলরেখায় তিনি তাঁর কাজকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, নানা উত্থান পতন ঘাত প্রতিঘাত তাকে পীড়িত করেছিল, বিপর্যস্ত করেছিল। তিনি প্রবল আত্মশক্তিতে তার মোকাবেলা করেছিলেন এবং কর্তব্যকর্মে অটুট ছিলেন। তাঁর কাজের পরিধি ও ব্যাপ্তি একজন শিক্ষকের, সমাজসেবকের, মানবপ্রেমির যা মূলত শাসক ও শোষিতর মাঝখানে একজন প্রতিবাদীর, সত্যবাদীর, বলা যায় একজন দ্বান্দ্বিক ব্যক্তিত্বের। যার না-বলা কথা, জানা-অজানার কল্পনা ও বাস্তবের মিলন নিয়ে উপন্যাস লেখা সম্ভব অসম্ভবের দোলাচল মাত্র, তবুও শব্দের মায়ায় ধরার সামান্য প্রচেষ্টা। কোথায় তার অন্ত হবে প্রকৃত অর্থে বলা খুব কঠিন। এই মহান মানুষটির শৈল্পিক জীবনকে ছুঁয়ে যাওয়া আর কি।)
প্রথম অধ্যায়
স্বপ্নের অন্দরমহলে তখন কত বাজনার শব্দ আপন ঢঙে বেজে চলেছে, কেউ মগ্ন হয়ে শুনছে, কেউ বা উদাসীন – স্বদেশ না বিদেশ কে খোঁজ রাখে। পরাধীন না স্বাধীন এই উপলব্ধি নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়, ঘর না বাহির এমন তর্জমা করার অবসরও নেই। রোদ যেমন ঝলমল করছে, তেমন জলরাশি কখনও শান্ত, কখনও উচ্ছল হয়ে টলমল। কত মানুষ আসে, কত মানুষ যায়, কেউ স্বপ্ন দেখে, কারও বা স্বপ্নভঙ্গ হয়। জীবনকে কোথাও সঁপে দেওয়ার জন্য নতুন আকাশকে পরখ করতে না করতেই পথ পার হই, পথের ধুলা বাতাসে উড়ে বেড়ায়। এই ধুলোর রঙ আর চলন শরীরের পাশ ঘিরে যেতে যেতে কত কথাই না বলে। আমি আস্বস্ত হয়ে বসে রইলাম নদীর কিনারায়। সবুজ হলদে পাতারা মগডাল থেকে নাচতে নাচতে পায়ের কাছে এসে পড়ে। কত তো পাতা, কত তো গায়ের রঙ। রঙের ছটায় আমার দৃষ্টি পৌঁছে যায় গঙ্গার বুকে ভেসে বেড়ানো স্টীমারের দিকে। ভোঁ ভোঁ করে চলার শব্দ যেন আমার কানের কাছে এসে চুপি চুপি কথা বলে। এই কথা সেই কথা নয়। কত কথাই গুনগুন করে। আমাকে অস্থির করে তোলে। অস্থিরতার মাত্রায় এমন ছন্দপতন ঘটে, যা আমি আগে কখনও উপলব্ধি করি নি। প্রকৃতি কত ভাবেই না মানুষকে সাজিয়ে রাখে। কেমন হবে তার অবয়ব আগে থেকে অনুমান করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কাল চক্রকে অস্বীকার করি এমন উপায় আমার আছে কী! উদ্দেশ্য আর বিধেয় নিয়ে এমন করে জবাব দেয়, নিরুত্তর হতেই মন চায়। নিজের দেশ তো নয়, পরের দেশের মানুষগুলো যেন টু-শব্দটি করে না। ওরা নিজের মতো করেই শব্দবাণ ছোড়ে। বুঝি না বুঝি কীইবা আসে যায়। ঘাট থেকে উঠে পড়ে পায়ে পায়ে পাড় বরাবর হেঁটে চলা। হোঁচট খেয়ে ডান দিকে তাকালেই দেখলাম শহরটা নিজের মতো করে দাঁড়িয়ে আছে। কে একজন আলখাল্লা পরে এদিকেই তো আসছে। ধূপদানি থেকে ধূপের ধোঁয়া গলগল করে গাছে গাছে ছড়িয়ে গিয়ে দুই চার জন সাহেব মেমদের গায়ে জ্বলা ধরাচ্ছে। নাকে মুখে জ্বালা ধরালে ওরা বিরক্তিতে গজগজ করে। বিড়বিড় করে অনেক কথাই তো বলল, মানুষটা তার বিন্দু বিসর্গ বুঝল না। আপন ধর্মাচরণের কারিকুরি নিজেই রপ্ত করেছে, অন্যের কথায় ভ্রূক্ষেপ করার সময় কোথায়। নিজেকে আমি কোথায় গিয়ে দাঁড় করালে বুঝতে পারব, ওদের ওঠাপড়া, চালচলন আমার কল্পনার সঙ্গে মানানসই নাকি অন্য কোনো রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে নিজেকে। এই না-জানা না-বোঝা কতটা অস্বস্তিকর স্বদেশী আর পরদেশীর বিভাজনরেখা মনে পড়লেই ভেতরটা ধীরে সুস্থে গুলিয়ে যায়।
ভালোবাসা ও প্রেম আমাকে আচ্ছন্ন করে নি, কে বলবে। জীবন ও যৌবনের নিজস্ব একটা ধর্ম আছে। এর গূঢ় অর্থ ধর্মপুস্তকের পাতার পর পাতার শব্দের ফাঁকে ফাঁকে দেখেছি। এখানে সবটাই যেন অন্যরকম – ধোঁয়া ধোঁয়া, ফিসফিস, গোল গোল। গেল তো গেল, কেউ যে ধরে ফেলবে তার কোনো উপায় নেই। রাস্তাঘাটে মুটে-মজুর, ঠেলাওয়ালা, ভুজিওয়ালারা গিজগিজ করে মোড়ে মোড়ে কোনায় কোনায়। নতুন মানুষের অচেনা মুখ হেঁটে গেলেই বুঝে ফেলে নতুন কথার আমদানি শুরু হয়ে যাবে একটু পরেই যা ওদের বোধের বাইরে, কল্পনারও অতীত। আমি মুখগুলোকে দেখি আর ভাবি ওদের চাওয়া-পাওয়া দেনা-পাওনার রকমসকম ভিন্ন এক ধাতুতে গড়া। এই মানুষদের অন্দরমহলের খবর না জানলে কী করে বুঝব কোথায় হবে শুরু। তবে ওরা হাবভাব দেখে আন্দাজ করে ফেলে আমি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোক নই, নতুন কোনো নিয়মনীতি চাপিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র নিয়ে প্লানটাজেনেট জাহাজে চড়ে আমি এদেশে আসি নি। কোনো আগাম অভিসন্ধিও আমার নেই। ওরা আমাকে কীভাবে দেখছে সে নিয়ে ভাববার আমার অতটা প্রয়োজন নেই বরঞ্চ আমি নিত্যদিন বুঝতে পারছি আমার ভাবনাটা কেমন করে আমি ভাগাভাগি করে নিতে পারব। কত কথাই না আমার মাথায় এসে ভীড় করে কোন পথ দিয়ে হাঁটলে আমি ওদের ঘরের চৌকাঠে গিয়ে কড়া নাড়তে পারব। তবে একথা আমি হলফ করে বলতে পারি এই শহর আমার কাছে যে অচেনা ঠেকছে তা কিন্তু নয়। কোন ইমারত মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, কোনটা নতুন করে গড়ে উঠেছে তার উদ্দেশ্যটা এখনও আমার কাছে স্পষ্ট নয়। এটা বোধগম্য হচ্ছে আমাদের স্বদেশীদের চিন্তা চেতনায় কিছু গোলমাল আছে, এর রহস্যটা খুঁজে বের করে খোলনলচে পাল্টে ফেলতে হবে। মীর্জাপুর স্ট্রিটের ঠিকানা আমার চিন্তা ও মননে যে জায়গা জুড়ে আছে তার সঠিক ব্যবহার তো কোনো বিশেষ মুহূর্তের কাজ নয়, অনেক কাটাছেঁড়া আছে। প্রত্যেক শহরের মতো এই শহরের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে, এর ভালো মন্দ বোঝা এত সহজ নয়, বরঞ্চ সরল সূত্রে গাঁথতে গেলে বড় বিপদ। লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর শহরে ইয়ং বেঙ্গল নিয়ে নানা কানাঘুষা তো কম নয়। এই তো আমার লন্ডনে বসেই যেটুকু শোনার শুনেছি। কলকাতা শহরের রেস্তোরাঁয় কত নানা কিসিমের লোক আসে, কত কথা উগড়ে দেয়, কত কথা নিয়ে গোপনে চর্চা করে – কলকাতার ছেলেরা গোল্লায় যাচ্ছে, বাপ-মায়ের কথা আর কানে তুলছে না, না হলে এমন করে কেউ নিজেদের বাপ মায়ের শিক্ষা ছেড়ে ম্লেচ্ছদের আদব কায়দা গোগ্ৰাসে গেলে? কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, সে কথা না হয় থাক। হবে নাইবা কেন! চিল্লাচিল্লি করার নির্দিষ্ট কারণ তো রয়েছে। কারণটা কী আমাকে ভাবায় নি, ভাবিয়েছে। রাতভর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্নও দেখেছি। আয়ারল্যান্ডের কর্ক অঞ্চলের বানদন নদীতীরের সবুজ গাছগাছালির স্বপ্ন। কোথাও মিল, আবার কোথাও এতটাই অমিল, নিজেকে কতটা মেলে ধরবো আর কতটা গুটিয়ে রাখবো তার আগেই তো নিজের মনের সঙ্গে নিজের এতটা দ্বন্দ্ব।
মানুষগুলো শ্যামলা কালো মাঝারি গড়নের, এলোমেলো চুল, উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘোরাফেরা করে এই গলি থেকে ওই গলি, চিৎকার কোলাহলে মুখর আলো ফোটা আবার সূর্য অস্ত যাবার পর মুহূর্তেও। কোনো রাস্তায় মানুষের চলাচল কালেভদ্রে, পাড়াগাঁয়ের লোকালয়ের মানুষগুলোর মতোই চেনা আবার থেকে থেকে অচেনা। আমি তাকিয়ে থাকি আর দেখি ওদের চেহারাগুলো আর কথা বলার ঢঙ। অভাব অভিযোগ বাঁচার আকুতি নেই এই কথা অস্বীকার করবো এমন আস্পর্ধা আমার নেই। নিজেকে মানানসই করে তোলা যে কত কষ্টকর তাই প্রতি পদে পদে অনুভব করছি। এই গ্ৰাম-শহরকে যত দেখছি অবাক হচ্ছি, যেন সাপের খোলস পাল্টানোর মতো কিম্বা নববধূর ঘোমটা খোলার মতো করেই নিজেকে জানান দিচ্ছে। যে লজ্জা আমি অনুভব করছি, এই লজ্জা কলকাতা শহরের! পোশাক আশাকে আর অন্য আভরণে নিজেকে জানান দিলে অন্তরের পরিবর্তনে যে ছাপ পরে, না দেখে বোঝার উপায় নেই। যে পথিক আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেল, এনাকে জানার ইচ্ছেটা খুব হলো। পথচারী এগিয়ে এসে বলল, ‘এনাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে কি সাহেব? আলেকজান্ডার ডাফ, বাঙালিদের ধরে ধরে পড়ানোর ছলে খেষ্টান বানাচ্ছে। দেশীয় ভদ্দরলোকেরা মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে দেখে বলে বেড়াচ্ছে কেউ যেন ভুলেও ওঁর ছায়া না মাড়ায়।’ লোকটার কথার মধ্যে শ্লেষ ছিল তো বটেই যেন গায়ে হুল ফোটাচ্ছে। আরও কিছু জানতে চাইব কিনা ভাববার জন্য ঢোঁক গিলতেই হনহন করে ছুটে বেরিয়ে গেল। ডাফ সাহেবের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে ওনার দু-চারজন সঙ্গীরাও পায়ে পা মিলিয়ে চলে গেল বড় বাড়িটার দিকে। দেশের খবর তো পাই, কারা যেন বয়ে নিয়ে আসে। সাহেবরা কেউ কেউ আসে, আবার ফিরেও চলে যায়। এই দেশের মানুষদের নেটিভ সম্বোধনে কোথাও কোনো অবহেলা ঘৃণা প্রতি পদে পদে, বশে রাখতে চেয়ে কত না ফন্দি ফিকির। নিজেদের অস্তিত্বকে ওরা নিজেদের মতোই ধরে রাখে, ভাবখানা এমন যেন এদের দেবার মতো কিছু নেই। আমার কোথাও সব কিছু ধোঁয়াসা লাগে, আদপে কী তাই! সব জাতির মধ্যে এমন কিছু আছে, যা অন্যের মধ্যে নেই কিন্তু মনের কোনে জায়গা দেবার মতো অবশিষ্ট কিছুই নেই! ওরা আমাকে দেখেও দেখে না। আসলে আমাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য এই দেশের মানুষদের মনের মধ্যে এতটুকু জায়গা করে নিতে ক্রমশ পিছপা হয়েছে। যেচে কথার বিনিময় করতে গেলে মনে হয় কোনও আগন্তুক ঘাড়ে এসে চেপে বসেছে। স্বদেশী বাবুদের ভাবসাব চলন বলন একটু অন্যরকম। সাহেব সুবোদের তোষামোদি করে এটা ওটা বাগিয়ে নেওয়া ওদের স্বভাব চরিত্রে মিশে গেছে। আমি মুখগুলোকে জানতে বুঝতে চাই, ওরা নিজেদের লুকিয়ে রাখে, কিছুতেই মেলে ধরে না। আমার অন্তরাত্মা জেগে ওঠে, মানুষের এই হীনমন্যতা মেনে নিতে কষ্ট হয়, বুক ফেটে যায়। প্রশ্নের পর প্রশ্ন তো ভেসে আসে, কোনো উত্তর খুঁজে পাই না। মানুষরা কথা বলে, আবার বলেও না, ওরা আদৌ কী জানে কতটা পথ পাড়ি দিতে হবে। আমি দেখতে পাই ওরা রোজ আসে, রোজ চলে যায়, হোঁচট খায়, যন্ত্রণায় কোঁকিয়ে ওঠে। আমি কি কোনো মলম লাগাতে পারি ক্ষতস্থানে? এক পথচারী জানতে চায় – ‘আমরা আর আপনারা এক নয় কেন? রঙ ঢঙ জামা কাপড় কেন আলাদা?’ আমি প্রশ্নোত্তরের জন্য সময় নিলাম, বললাম, গড এর জন্য দায়ী হবে হয়তবা। কী জানি উত্তরটা সঠিক দিয়েছিলাম কিনা। কিন্তু আমাকে যে কত প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল, আমার চোখে ঘুম এলো না, কখন দিনের আলো দেখব। আলোর কাছে নতিস্বীকার করে জানতে চাইব কেমন করে আঁধারের রঙটা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যায়।
এই শহরকে যে যার মতো নাম দিয়ে যায়। তাতেই বা কী! কোথাও আলো, কোথাও অন্ধকার, কোথাও তুলসী তলা, কোথাও সারমেয়দের ঘেউ ঘেউ চিৎকারে পুরো এলাকা গমগম করে। কার এত সাধ্য আছে রাতারাতি ভোল পাল্টে দেয়। যে স্বাদ ওরা চেখে নিচ্ছে, টক-ঝাল-মিষ্টি, নোনতা তেতো। বাছবিচার করে যে পা রাখবে তার কী কোনো জো আছে! পণ্ডিতেরা মূর্খ হয়, মূর্খরা পণ্ডিত। কেন একথা বলছি, মন মানে না বলে। নিজের ঘরের দরজাটা বন্ধ করে জানালা খুলে দিলাম। কারা যেন ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি করে। ছুটে চলে যেতে মন চায়। কত তো দ্বিধা, কত তো দ্বন্দ্ব। কোন পথ দিয়ে হাঁটব। বাঙালি বাবুরা রাজা মহারাজা রায়বাহাদুর হয়ে চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছে। ফিটন গাড়িতে চড়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করার লিপ্সা বাড়িয়ে তুলেছে। জ্ঞানগম্মি চুলোয় যাক, নুন আনতে পান্তা ফুরায়। আমি কত তো পাখিদের আনাগোনা দেখি। পতপত শব্দে ডানা নাড়িয়ে আমাকে ছোঁবে বলে নিচে নেমে আসে ওরা, গুলগুল চোখে আমার চেহারা সুরত দেখে থমকে যায়। মানুষরা ঝগড়া করে, বেড়ালরাও গোঁফ উঁচিয়ে তেড়ে আসে। আমি কি এমনই অচ্ছুত এই দেশীয়রা মুখ ফিরিয়ে তাকায় না। ওরা বলে, ‘গায়ের গন্ধে ভূত পালায়।’ আমার বলা-কওয়ায় কীইবা আসে যায়। একটু একটু করে কলেবর বাড়লে চুপ করে কী থাকা যায়! এই শহরের আকাশ আমার সঙ্গে খেলা করে, আমিও নিশ্চিন্তে খেলতে খেলতে চলে যাই এই গলি থেকে ওগুলি। আমাদের সাহেবরা ঘোড়ার গাড়ি চড়ে মেমদের সঙ্গে নিয়ে গঙ্গার পাড়ের বিকেলের ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে মাখতে মাখতে দেখে সূর্যটা পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়ছে। শ্যানন নদীর অস্তিত্ব আজও মনের গভীরে বাসা বেঁধে আছে। উদাসী আবেগপ্রবণ মন হারিয়ে যেতে যেতে ফিরে এসে মোহাচ্ছন্ন করে দেয়। আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইলেও ফুরুত করে উড়ে চলে যায় আমার পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে। একলা মনের হিসেবটা ধরা দেয় ভিন্ন ঘরানায়। নিজের দেশের প্রতি প্রবল মায়া, মানুষের ধর্মাচরণ আমার কল্পনায় জন্ম দেয় এমন এক ভূমির যেখানে সব বোধ মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
আগুন দাউদাউ করে চলেছে। সেই আগুন নেভাতে গেলেও মুনশিয়ানা লাগে। মানব জমিনে বীজ বপন করতে চাইলে তো হবে না। ঘরের মানুষ হয়ে দরজায় কড়া নাড়তে হবে তো। আমি নিজেকে কোথায় গিয়ে দাঁড় করালে নাড়ী ধরে টান মারতে পারব। ভয় হয় না এই কথা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি। লাঠিসোঁটা নিয়ে কেউ কেউ তেড়ে আসবে না কে বলতে পারে। ঘরের কোনায় বসলে ঘুঘু পাখির ডাক শুনি। কোন গাছের কোন ডালে বসে ডাক ছাড়ছে বলা কঠিন। কতক্ষন ধরে এক নাগাড়ে কোকিলের ডাক ভেসে আসে। দুয়ের কন্ঠস্বর কত আলাদা, দুটো ভিন্ন রাস্তার পথ খুলে দেয়। আমি দেখতে চাই, দেখাতে চাই এক, কোন জাদুবলে হয়ে যায় আর এক। আমাকে দিয়ে বলিয়ে নিতে চায় এমন কথা, যা এর আগে কেউ কখনও এমন করে উপলব্ধি করে নি। ওরা সকলে নিজ নিজ আসনে বসেছে, নিজেরা যা শোনাতে চায় শুনিয়েছে নির্বিবাদে কিন্তু বাকিরা যা শুনতে চায়, শোনাবার ইচ্ছা কিংবা তাগিদ কোনোটাই ছিল না। বাংলার বিদ্যাসাগরকে তখনও আমি চোখে দেখি নি। কানে আসে আমার ইচ্ছা অনিচ্ছা ওঁকে নাকি ভাবিয়েছে। আমি পরদেশী, আমাকে নিয়ে কত কানাঘুষা, ভালো মন্দের অসুখগুলোর আক্রমণে কাউকে না কাউকে হুল ফুটিয়েছে, কেউ বা বলার কথাগুলো হজম করে নিজেদের বক্তব্যে অনড় থেকে আড়াল থেকে তীর ছুঁড়তে দ্বিধা করে নি। পরনিন্দা পরচর্চা কোন জাতির না অভ্যাসে পড়ে। নিজের মধ্যেই যে তোলপাড় শুরু হয়েছে তাকে সামাল দিতে গিয়ে আমি যে হিমসিম খাচ্ছি, সেই ছটফটানি কেবল আমিই টের পাচ্ছি। আমার দেশবাসীর আশা ভরসা সম্বল করে এই দেশের মাটির গন্ধ শুঁকে ছিলাম। চার্চ মিশনে ছাত্রদের খ্রিস্টান ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করেছিল ‘মানুষের জন্য ধর্ম না ধর্মের জন্য মানুষ।’ সোজাসাপটা উত্তরটা ছাত্রটিকে খুশি করতে পেরেছিল কিনা জানি না তবে ওর নীরবতা আমাকে যে নতুন করে ভাবিয়েছিল সেটা একশ ভাগ সত্যি। একজন মিশনারী সোসাইটির ধর্মযাজক হয়ে আমার মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল সেটাই ছিল অলিখিত পথনির্দেশ।
সময়টা ছিল বর্ষাকালের এক সকাল। কলিকাতার রাস্তায় জল থৈ থৈ। আমার পথচলা কী আর থামে। রাস্তার ধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবলাম এই সময় কলিকাতার ছাপোষা মানুষগুলো কেমন করে ছারপোকার মতো কিলবিল করে বেঁচে আছে না দেখলেই নয়। বৃষ্টিতে ভিজে যে মানুষটা ঠকঠক করে কাঁপছে, সদ্য গাঁ থেকে এসেছে রোজগারের আশায়। কথা বলে বুঝলাম ক অক্ষর গোমাংস, দুনিয়াদারি দেখে নি। রাজা রাজড়াদের দরজায় ঘুরে ঘুরে মরেছে, হাতে পায়ে ধরে বলেছে, ,’একটুখানি জায়গা হবে বাপ।’ চোখ দিয়ে ঝরে পড়ছে, ফোঁটা ফোঁটা জল। কী করে যে মুছিয়ে দি, প্রভু যিশু কি আমাকে এমন শক্তি দিয়েছেন? এতদিন ধরে অধ্যয়ন করে যা কিছু ধারণ করে চলেছি মনের গভীরে তার প্রকাশ কী চোখের সামনেই ঘটে যাবে, হয়ত সম্ভব। কোনো কিছুই এই পৃথিবীতে আশ্চর্যের কিছু নয়। আমি যা কিছু ভাবছি, কিংবা ভাবার আয়োজন করছি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তার সুফল কী অচিরেই মিলবে! প্রশ্নটা যেমন অবান্তর নয়, উত্তরটা তেমনি অপ্রাসঙ্গিক নয়। মানুষটার চোখের জল গড়াতে থাকে। ওকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললাম, আমাকে জাপটে ধর, আর মনে মনে প্রভু যীশুকে স্মরণ কর, দেখবে তোমার সকল দুঃখ নিরসনের একটা উপায় খুঁজে পাবে। কাঁধে ভর দিয়ে নিয়ে এলাম মির্জাপুরে। মানুষটা আপাতত কিছু স্বস্তি পেল। অনেকক্ষণ যীশুর ছবির দিকে তাকিয়ে রইলাম, মানুষটার অন্তরাত্মা যাতে জেগে ওঠে, আত্মশক্তিতে যাতে বলিয়ান হয় সেই প্রার্থনাই করলাম। মানুষটার জানতে চাইল এখানে কি হয়? মনের খোরাক মেলে। মানুষটার বড্ড ক্ষিদে লেগেছে। গোগ্ৰাসে খেল, ঢক ঢক করে জল খেয়ে ঢেঁকুর তুলল।
এবার বলুন তো বুঝিয়ে আমার এখানে কাজটা কী?
আমি যা বলি, তুমি মন দিয়ে শুনবে। আর যদি প্রশ্ন
জাগে, তৎক্ষণাৎ জানতে চাইবে উত্তর।
আর যদি মাথায় কিছু না আসে, গুলিয়ে যায় সব।
নিজের মনকে জোরে ঝাঁকিয়ে নেবে। এমন করে
ঝাঁকাবে, প্রশ্ন এসে যেন আপনা থেকেই ধাক্কা মারে।
আমার কাণ্ডকারখানা দেখে অন্য ছাত্ররা একটু অবাকই হলো। অপাঙক্তেয় লোকটাকে ওরা কীভাবে একই সারিতে এনে ফেলবে বুঝে উঠতে পারল না। আমি বুঝলাম কোথাও একটা গোলমাল আছে শিক্ষার সিলেবাসে না হলে এমনটা ঘটবে কেন! মানুষের সঙ্গে মানুষের দূরত্বের কারণটা আমাকে ভাবিয়ে তুললো। আমার অস্থিরতা আমার অর্জিত জ্ঞানের সঙ্গে অমিল হচ্ছে দেখে শিক্ষার পদ্ধতি নিয়ে চিন্তিত হলাম। তবে কী আমাদের ভারতের আত্মাকে বুঝতে কোথাও অসুবিধা হচ্ছে! এদের স্বর ও সুর আমাদের বলার কথার সঙ্গে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। ওদের কল্পনার জমিতে এইভাবে চাষ করলে চলবে না। এই দেশের জল হাওয়া চিন্তাসূত্র উচ্চারণ নিয়ে নিশ্চয়ই আরও ভাবনার অবকাশ রয়েছে। আমাদের লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য নিয়ে দিনরাত মনোযোগ দিলে কোথাও যেন ফাঁকি রয়ে যাবে। নেটিভদেরও একই পঙক্তিতে ফেলে বিচার করলে আসল সত্যে পৌঁছনো যাবে না।
তোমরা কী বলো, তোমাদের কথা শোনাই যে জরুরি।
আমরা তো ছাপোষা মানুষ, কী মূল্য আছে আমাদের কথায়। বাঙালি বাবুরা তো আমরা বেঁচে আছি না মরে আছি খবর রাখে না, আর রইল বাকি সাহেবরা, তারা তো শাসক হলেও পরদেশী, তারা তো শুনতেই এই দেশে এসেছে, তাই না।
লোকটি যে মুখের উপর মোক্ষম জবাব দিয়েছে, চাষাভূষা হলেও কথার সারবত্তা আছে এই কথা অস্বীকার করি কী করে। কানে তো আসছে আমার গালভরা কথা। হিন্দু কলেজ হয়েছে, স্কুল বুক সোসাইটি হয়েছে, ক্যালকাটা বুক সোসাইটি হয়েছে। কারা এসবের ফল ভোগ করছে। ওয়ারেন হেস্টিংস আর কর্ণওয়ালিশ সাহেব বাংলায় কোম্পানির ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেছিল। নেটিভদের পড়ালেখা নিয়ে কোনও মাথাই ঘামায় নি। সরকারের এখন সুমতি হয়েছে, শিক্ষার জন্য ব্যয় বরাদ্দ করেছে ভালো কথা।
কাদের ভালো হয়েছে সাহেব, সেই কি আমরা বুঝি না। বুঝি, আমরা সব বুঝি। পেটে ভাত নাই তো কী হয়েছে, মাথার ঘিলুটা তো আছে।
ওদের কথাগুলো যে একেবারে ফেলনার নয়, সে কথা বলার কী কোনও জায়গা আছে। বুঝলাম এই দেশের মানুষদের আমাদের শাসকরা যতই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করুক, সুযোগ পেলে ওদের হীরে হতে সময় লাগবে না, এটাই হলো আসল কথা। ইংল্যান্ডে যে পাঠ্যপুস্তক আমি অধ্যয়ন করেছিলাম, তা শুধুমাত্র আমার অন্তরে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এমন নয়, জীবনের কোন কোন অধ্যায়কে প্রভাবিত করতে পারে তা সচক্ষে দেখার তাগিদও অনুভব করেছিলাম। ছটফট করে উঠেছিল বৈশ্বিক চিন্তায়। কিন্তু তাই বলে হাজার হাজার মাইল দূরের মানুষের মুখগুলো যে এইভাবে সামনে এসে হাজির হবে, আমাকে বুঝিয়ে দেবে পুঁথিগত জ্ঞান আর জ্ঞানের প্রকাশ এই দূয়ের মধ্যে মিলন ঘটানো কঠিন তো বটেই, কঠিনতম, হয়তো সমুদ্রের উত্তাল জলরাশির মতোই গর্জে উঠে মিলিয়ে যাওয়া। জীবনের সঙ্গে আমি জড়াতে চেয়েছিলাম, ভেবেছিলাম আমার চিন্তার বাঁধনে বেঁধে ফেলে একই অঙ্গনে এসে হাজির করবো। ওরা আসে, পাতার পর পাতা ওল্টায়, প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে, একসময় সূর্য যখন পশ্চিম দিগন্তে অস্ত যায়, বুঝে যাই আমি একা, আমার বোধের আলাদা কোনও অস্তিত্ব নেই, ওরা আছে বলেই আমি আছি, ওদের অনুভবে সলতে পাকানোর আমার কাজ। ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজে, অনেক পণ্ডিতেরা সব অধ্যায়গুলো ধরে ধরে নিজের মতো ব্যখ্যা করে। জানতে চায় – ‘ রেভারেন্ড লং কেমন বুঝছেন? বেয়ারা ছাত্ররা জ্বালাতন করছে না তো, বুঝলে উচিত শিক্ষা দিতে ইতস্তত করবেন না।’ উত্তরে কিছু বলার আগেই হাসির দমকে অস্থির হয়ে যাই। একটা সীমাবদ্ধ গণ্ডির মধ্যে নিজেকে আটকে রাখলে কাজের কাজ কিছুই হবে না, আখেরে নিট ফল হবে শূন্য। যে চোখের আলোয় সমগ্ৰ ব্রিটিশদের দেখেছিলাম এই পথে হাঁটলে প্রতি পদে পদে হোঁচট খেতেই হবে। চিন্তার বৃত্তের এই অনুর্বরতা ক্রমশ যে পিছু টানবে, এই ব্যাপারে আমি ষোলো আনা নিশ্চিত। এখানে সবকিছু ঘুরপাক খাচ্ছে নিজের মতো। নিজস্ব জ্ঞানের পরিধিতে বিচার করার প্রক্রিয়া যে আসল প্রক্রিয়া নয়, এই দেশের মানুষ কবে বুঝবে। যাঁরা বুঝবে এবং বোঝাবে বলে ঠিক করেছিল তাতেও তো হাজারো গলদ। হ্যাঁ আমি পাদ্রী লং, দরিদ্র রোগাগ্ৰস্ত লোকগুলো আমাকে যে নিজের লোক বলে ভাবতে শুরু করবে, তারও তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমি হেড মাস্টার মিঃ ম্যাকলিনসের কাছ থেকে মীরজাপুর স্কুলের দায়িত্ব বুঝে নেবার পরে পরেই বুঝলাম অনেক অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে হবে। স্থানীয় মিশনারী পাদরীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন। আমার বিশ্বাস দেশীয় ভাষায় ব্যুৎপত্তি জন্মালে দেশীয় পুস্তক ও পত্র-পত্রিকায় মিশনারী, ইউরোপীয় ও সরকারের সম্পর্কে কি সব লেখা হচ্ছে তার ও দেশীয় সাধারণের অভাব-অভিযোগের কথা সংগ্ৰহ করে সরকার, পাদ্রী ও অন্যান্যদের গোচরে আনা সম্ভব হবে। বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সোসাইটির সভাপতি হয়েছেন জর্জ টমসন এবং প্যারীচাঁদ মিত্র হয়েছেন সম্পাদক। সমস্যায় জর্জরিত এই দেশীয়দের অনেক না-বলা কথাই তুলে ধরতে হবে বই কী, প্যারীচাঁদ বললেন, এই বিষয়ে সোসাইটিতে গভীর আলোচনা জরুরি। রাজনৈতিক পরিস্থিতিও ব্রিটিশ সরকারের নজরে আনা উচিত এবং কোম্পানির আসন্ন সনদেও সংস্কারের পরামর্শ দেওয়া আশু কর্তব্য।
আঁধারে যে স্বপ্নগুলো কিলবিল করে, আলোতে সকল ভেদরেখা মুছে গিয়ে আমাকে কখনও জাগিয়ে দেয়, পথের সন্ধানে তাড়িত করে, এদের যা পাবার কথা ছিল, পাওনাগণ্ডা বুঝে নিয়েছে তো। কেমন যেন মনে হতে লাগল কারা জেগে উঠেছে, কারা নিজের শিকড়কে উপড়ে ফেলে ধেই নেই করে নেচে চলেছে অন্য কিছুকে আঁকড়ে ধরবে বলে। তাতে তো সমূহ বিপদ, বাইরের আদলটাও পাল্টে গেল, ভেতরটা হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে ফোঁপরা, না চিনছে নিজেকে, পরের সঙ্গে আত্মীয়তা পাতানো সহজ কথা তো নয়। ভরাট করতে গেলে শরীর ও মন দুটোই সমান তালে না চললে চলবে কেন! মানুষের মহৌৎসবে এই আমন্ত্রণ আমি আমার স্বদেশেও দেখেছি পলে পলে। কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যা, মরণপণ লড়াইয়েও কি জানা যায় ? কত কিছুই তো বাকি রয়ে গেছে, যা হারিয়ে গেছে, খুঁজে পেতে কেউ না কেউ ত এনে দেবে, না হলে বাহিরের রঙটা যে কখন ফিকে হয়ে যাবে, কেউ টেরও পাবে না। আমার এমন দশা দেখে কেউ না কেউ তো ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে, এমন কথা অস্বীকার করি কী করে। আমি নিজেকে মনে করি বিজাতীয়, স্বজাতির বৈঠকখানায় এসে নাম লিখেয়েছি। বুঝতে আমার দেরি হলো না, ওদের কথাই আমার কথার রসে মিলে গিয়ে এমন এক ভাবের জন্ম দিয়েছে, যা ফেলনারও নয়, গ্ৰহণেরও নয়, এই এক বিরাট দ্বন্দ্ব। কেউ কেউ এগিয়ে এসেছে বটে, কেউ পিছপা হতে গিয়ে হোঁচটও খেয়েছে। জীবনটা কী এইরকমই না কোনোও অন্য ধাতুতে গড়া কোনো এক অজানা অদেখা স্রোত, যার টানে আমি ভেসে চলেছি, কোথাও না কোথাও নোঙর করতে হবে। এটা বুঝেছি আমাকে পাড়ে উঠতে হবে।
কলিকাতার খোলনলচে কীভাবে সেজেগুজে আছে যত মাটির উপরে চড়ে বেড়াচ্ছি, মনে হয়েছে এ-ও প্রাচ্যের আর এক অন্দরমহল, কে বা কারা এসে নাড়িয়ে দিচ্ছে তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। পথটাও আলাদা, পথের নিশানাও আলাদা, পাঁচ হাজার বছরের সময় গ্ৰন্থিরা এসে কাবু করে ফেলছে। আমি নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে লাগলাম, বুঝতে লাগলাম আমি আর আমার আমিতে নেই, এই যেন অন্য বাতাস, বাতাসে বয়ে চলেছে অন্য ঘ্রাণ, একে জাপটে ধরতে হবে, অন্য রসের সাগরে সাঁতার কাটতে হবে, বড় দূর্গম এই পথ, হোঁচট খেতে হয় খাবো। কীসের এক অমোঘ টান, উপেক্ষা করবো এমন সাধ্য আমার নেই। ভাষার সঙ্গে আমার আত্মীয়তা আমার যেন জন্ম জন্মান্তরের, শব্দরা আমার সঙ্গে সম্পর্ক পাতায়, আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চায় ওরাই জানে। আমি দেখতে পাই কেউ ডুব সাঁতার কাটছে, কেউবা পিছমোড়া হয়ে, কেউবা ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে আপন নিয়মে। আমার জমানো কথাগুলো আমাকেই বলতে হবে। রৌদ্রজ্জ্বল দুপুরের প্রবল তেজে মনে হলো এই তো সময় – প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিলনের সন্ধিক্ষণ, গ্ৰিক ল্যাটিন পার্সিয়ান রাশিয়ান, সেল্টিক লিথুয়ানিয়া জার্মান হিব্রু অ্যাংলো সেক্সন সংস্কৃতের সঙ্গে ইংরেজির সংযোগ সকলের অভিমুখ মিলতে চাইছে কোথাও কী? মানুষ যে এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাবে কে জানত। দরজাগুলো এক এক করে খুলে যাচ্ছে, আর এক নিঃশ্বাসে ভিন্ন এক ঘ্রাণ নিয়ে পুষ্ট হলো। এমনটা কি কোনোকালে ভেবেছি। এশিয়াটিক সোসাইটির এসোসিয়েটস সভ্য হয়ে জার্নালে লিখলাম মনের কথাগুলো। এইভাবে কথা চালাচালি করতেই কোনোদিন পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে যাবো সবটাই ছিল ধ্যান ধারণার অনেক দূরে। দূর কী এত সহজে নিকট হয়! কত তো পথ, কোন পথে গেলে সকলের ডাক এসে কানে বাজবে কে বলতে পারে। তাই তো গলির পরে গলি, মানুষের পর আরও মানুষের কথা কাহিনী আমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগলাম। কোনটা যে আসল স্বদেশ আর কোনটা যে বিদেশ, কারা যে শত্রু কারা যে মিত্র, এই দুয়ের তফাতটা বুঝতে সময়ের ঝুলিটাকে বেশ করে ঝাঁকিয়ে নিলাম।
ভার্নাকুলার লিটারেচার সোসাইটি, ক্যালকাটা বুক সোসাইটি, বেঙ্গল সোস্যাল সাইন্স এসোসিয়েশন, সোসাইটি ফর প্রমোশন অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট, ফেমিলি লিটারারি ক্লাব, বুক সোসাইটি, ফোকলোর সোসাইটির কর্মসূচির সঙ্গে আমার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যেন কোথাও মিলে গেল। আমি ক্রমশই যেন অনুভব করতে লাগলাম দরজা জানালাগুলো এই যে খুলতে শুরু করেছে আর বোধ হয় সহজে বন্ধ হবে না। কাজের যে অসংগতি ছিল না, তাই বা বলি কী করে। পরিচালক মণ্ডলীদের নজরে তড়িঘড়ি আনলেও কোথাও কিন্তু অসহিষ্ণুতা ও অসহযোগিতা বিভেদের দেয়ালকে আরও চওড়া করে দেয়। এই দূরত্ব যে কোন পথে ঘুচে যাবে তারও কোনও দিশা দেখা যাচ্ছিল না। যে উদ্দেশ্য নিয়ে সুদূর ইংল্যান্ড ছেড়ে কলিকাতা এলাম তার কী হবে? ডাফের স্কটিশ মিশন ও অন্যান্য মিশন যখন পুরোদমে দীক্ষা দিয়ে চলেছে তখন চার্চ মিশন ১৮২২ থেকে ১৮৪০ এর মধ্যে মাত্র দুই জনকে দীক্ষা দিতে পেরেছে। দীক্ষা দেওয়া যদিও মিশনের লক্ষ্য ঠিক কিন্তু ছাত্রদের মানসিক উন্নতির অন্য মাধ্যম গুলো গৌণ করে দিলে তো অভিষ্ট পূর্ণ হবে না। কোথাও যেন একটা দ্বন্দ্ব কাজ করছিল। অন্য পাদ্রীরা এই নিয়ে আমার জম্পেশ সমালোচনা করলো। নিজের মনকে প্রবোধ দিলাম এই বলে কিছু একটা রাস্তা তো খুলে যাবে আজ না হয় কাল। এদিকে কেউ কতৃপক্ষ চাইল ফাণ্ডের অভাবের জন্য উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তই উচ্চ শিক্ষার অঙ্গনে থাকবে, সাধারণের জন্য কোনও বরাদ্দ থাকবে না। এরাই শিক্ষক হয়ে সাধারণকে শিক্ষা দিবে। অকল্যান্ড ও হার্ডিঞ্জের আমলে এই পদ্ধতিই মান্যতা পেল। আমার যেন মনে হলো যেন কোথাও বঞ্চিত হচ্ছে ছাপোষা মানুষরা। তবুও দেখা যাক সরকারের কোনোভাবে দৃষ্টি আকর্ষন করা যায় কিনা।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)