শরদিন্দু সাহা

লেখক পরিচিতি

বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই  বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।

বিষয় পরিচিতি

(রেভারেন্ড জেমস্‌ লঙ  যে লক্ষ্য স্থির রেখে জীবনকে চালনা করেছেন তা শুধুমাত্র ঘটনাক্রম দিয়ে ধরা যায় না। তাঁর কর্মজীবনের পরিক্রমায় যে অন্তর্নিহিত শক্তি ও প্রভাব রয়েছে তাকে কোনও এক শিল্প মাধ্যম দিয়ে উপলব্ধি করা যায় না। কারণ কোনো সরলরেখায় তিনি তাঁর কাজকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, নানা উত্থান পতন ঘাত প্রতিঘাত তাকে পীড়িত করেছিল, বিপর্যস্ত করেছিল। তিনি প্রবল আত্মশক্তিতে তার মোকাবেলা করেছিলেন এবং কর্তব্যকর্মে অটুট ছিলেন। তাঁর কাজের পরিধি ও ব্যাপ্তি একজন শিক্ষকের, সমাজসেবকের, মানবপ্রেমির যা মূলত শাসক ও শোষিতর মাঝখানে একজন প্রতিবাদীর, সত্যবাদীর, বলা যায় একজন দ্বান্দ্বিক ব্যক্তিত্বের। যার না-বলা কথা, জানা-অজানার কল্পনা ও বাস্তবের মিলন নিয়ে উপন্যাস লেখা সম্ভব অসম্ভবের দোলাচল মাত্র, তবুও শব্দের মায়ায় ধরার সামান্য প্রচেষ্টা। কোথায় তার অন্ত হবে প্রকৃত অর্থে বলা খুব কঠিন। এই মহান মানুষটির শৈল্পিক জীবনকে ছুঁয়ে যাওয়া আর কি।)

মনের আলোয় জগৎ চেনা 

স্বপ্নের অন্দরমহলে তখন কত বাজনার শব্দ আপন ঢঙে বেজে চলেছে, কেউ মগ্ন হয়ে শুনছে, কেউ বা উদাসীন – স্বদেশ না বিদেশ কে খোঁজ রাখে। পরাধীন না স্বাধীন এই উপলব্ধি নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়, ঘর না বাহির এমন তর্জমা করার অবসরও নেই। রোদ যেমন ঝলমল করছে, তেমন জলরাশি কখনও শান্ত, কখনও উচ্ছল হয়ে টলমল। কত মানুষ আসে, কত মানুষ যায়, কেউ স্বপ্ন দেখে, কারও বা স্বপ্নভঙ্গ হয়। জীবনকে কোথাও সঁপে দেওয়ার জন্য নতুন আকাশকে পরখ করতে না করতেই পথ পার হই, পথের ধুলা বাতাসে উড়ে বেড়ায়। এই ধুলোর রঙ আর চলন শরীরের পাশ ঘিরে যেতে যেতে কত কথাই না বলে। আমি আস্বস্ত হয়ে বসে রইলাম নদীর কিনারায়। সবুজ হলদে পাতারা মগডাল থেকে নাচতে নাচতে পায়ের কাছে এসে পড়ে। কত তো পাতা, কত তো গায়ের রঙ। রঙের ছটায় আমার দৃষ্টি পৌঁছে যায় গঙ্গার বুকে ভেসে বেড়ানো স্টীমারের দিকে। ভোঁ ভোঁ করে চলার শব্দ যেন আমার কানের কাছে এসে চুপি চুপি কথা বলে। এই কথা সেই কথা নয়। কত কথাই গুনগুন করে। আমাকে অস্থির করে তোলে। অস্থিরতার মাত্রায় এমন ছন্দপতন ঘটে, যা আমি আগে কখনও উপলব্ধি করি নি।  প্রকৃতি কত ভাবেই না মানুষকে সাজিয়ে রাখে। কেমন হবে তার অবয়ব আগে থেকে অনুমান করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কাল চক্রকে অস্বীকার করি এমন উপায় আমার আছে কী! উদ্দেশ্য আর বিধেয় নিয়ে এমন করে জবাব দেয়, নিরুত্তর হতেই মন চায়। নিজের দেশ তো নয়, পরের দেশের মানুষগুলো যেন টু-শব্দটি করে না। ওরা নিজের মতো করেই শব্দবাণ ছোড়ে। বুঝি না বুঝি কীইবা আসে যায়। ঘাট থেকে উঠে পড়ে পায়ে পায়ে পাড় বরাবর হেঁটে চলা। হোঁচট খেয়ে ডান দিকে তাকালেই দেখলাম শহরটা নিজের মতো করে দাঁড়িয়ে আছে। কে একজন আলখাল্লা পরে এদিকেই তো আসছে। ধূপদানি থেকে ধূপের ধোঁয়া গলগল করে গাছে গাছে ছড়িয়ে গিয়ে দুই চার জন সাহেব মেমদের গায়ে জ্বলা ধরাচ্ছে। নাকে মুখে জ্বালা ধরালে ওরা বিরক্তিতে গজগজ করে। বিড়বিড় করে অনেক কথাই তো বলল, মানুষটা তার বিন্দু বিসর্গ বুঝল না। আপন ধর্মাচরণের কারিকুরি নিজেই রপ্ত করেছে, অন্যের কথায় ভ্রূক্ষেপ করার সময় কোথায়। নিজেকে আমি কোথায় গিয়ে দাঁড় করালে বুঝতে পারব, ওদের ওঠাপড়া, চালচলন আমার কল্পনার সঙ্গে মানানসই নাকি অন্য কোনো রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে নিজেকে। এই না-জানা না-বোঝা কতটা অস্বস্তিকর স্বদেশী আর পরদেশীর বিভাজনরেখা মনে পড়লেই ভেতরটা ধীরে সুস্থে গুলিয়ে যায়।

   ভালোবাসা ও প্রেম আমাকে আচ্ছন্ন করে নি, কে বলবে। জীবন ও যৌবনের নিজস্ব একটা ধর্ম আছে। এর গূঢ় অর্থ ধর্মপুস্তকের পাতার পর পাতার শব্দের  ফাঁকে ফাঁকে দেখেছি। এখানে সবটাই যেন অন্যরকম – ধোঁয়া ধোঁয়া, ফিসফিস, গোল গোল। গেল তো গেল, কেউ যে ধরে ফেলবে তার কোনো উপায় নেই। রাস্তাঘাটে মুটে-মজুর, ঠেলাওয়ালা, ভুজিওয়ালারা গিজগিজ করে মোড়ে মোড়ে কোনায় কোনায়।  নতুন মানুষের অচেনা মুখ হেঁটে গেলেই বুঝে ফেলে নতুন কথার আমদানি শুরু হয়ে যাবে একটু পরেই যা ওদের বোধের বাইরে, কল্পনারও অতীত। আমি মুখগুলোকে দেখি আর ভাবি ওদের চাওয়া-পাওয়া দেনা-পাওনার রকমসকম ভিন্ন এক ধাতুতে গড়া। এই মানুষদের অন্দরমহলের খবর না জানলে কী করে বুঝব কোথায় হবে শুরু। তবে ওরা হাবভাব দেখে আন্দাজ করে ফেলে আমি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোক নই, নতুন কোনো নিয়মনীতি চাপিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র নিয়ে প্লানটাজেনেট জাহাজে চড়ে আমি এদেশে আসি নি। কোনো আগাম অভিসন্ধিও আমার নেই। ওরা আমাকে কীভাবে দেখছে সে নিয়ে ভাববার আমার অতটা প্রয়োজন নেই বরঞ্চ আমি নিত্যদিন বুঝতে পারছি আমার ভাবনাটা কেমন করে আমি ভাগাভাগি করে নিতে পারব। কত কথাই না আমার মাথায় এসে ভীড় করে কোন পথ দিয়ে হাঁটলে আমি ওদের ঘরের চৌকাঠে গিয়ে কড়া নাড়তে পারব। তবে একথা আমি হলফ করে বলতে পারি এই শহর আমার কাছে যে অচেনা ঠেকছে তা কিন্তু নয়। কোন ইমারত মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, কোনটা নতুন করে গড়ে উঠেছে তার উদ্দেশ্যটা এখনও আমার কাছে স্পষ্ট নয়। এটা বোধগম্য হচ্ছে আমাদের স্বদেশীদের চিন্তা চেতনায় কিছু গোলমাল আছে, এর রহস্যটা খুঁজে বের করে খোলনলচে পাল্টে ফেলতে হবে। মীর্জাপুর স্ট্রিটের  ঠিকানা আমার চিন্তা ও মননে যে জায়গা জুড়ে আছে তার সঠিক ব্যবহার তো কোনো বিশেষ মুহূর্তের কাজ নয়, অনেক কাটাছেঁড়া আছে। প্রত্যেক শহরের মতো এই শহরের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে, এর ভালো মন্দ বোঝা এত সহজ নয়, বরঞ্চ সরল সূত্রে গাঁথতে গেলে বড় বিপদ। লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর শহরে  ইয়ং বেঙ্গল নিয়ে নানা কানাঘুষা তো কম নয়। এই তো আমার লন্ডনে বসেই যেটুকু শোনার শুনেছি। কলকাতা শহরের রেস্তোরাঁয় কত নানা কিসিমের লোক আসে, কত কথা উগড়ে দেয়, কত কথা নিয়ে গোপনে চর্চা করে – কলকাতার ছেলেরা  গোল্লায় যাচ্ছে, বাপ-মায়ের কথা আর কানে তুলছে না, না হলে এমন করে কেউ নিজেদের বাপ মায়ের শিক্ষা ছেড়ে ম্লেচ্ছদের আদব কায়দা গোগ্ৰাসে গেলে? কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, সে কথা না হয় থাক। হবে নাইবা কেন! চিল্লাচিল্লি করার নির্দিষ্ট কারণ তো রয়েছে। কারণটা কী আমাকে ভাবায় নি, ভাবিয়েছে। রাতভর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্নও দেখেছি। আয়ারল্যান্ডের কর্ক অঞ্চলের বানদন নদীতীরের সবুজ গাছগাছালির স্বপ্ন। কোথাও মিল, আবার কোথাও এতটাই অমিল, নিজেকে কতটা মেলে ধরবো আর কতটা গুটিয়ে রাখবো তার আগেই তো নিজের মনের সঙ্গে নিজের এতটা দ্বন্দ্ব।

   মানুষগুলো শ্যামলা কালো মাঝারি গড়নের, এলোমেলো চুল, উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘোরাফেরা করে এই গলি থেকে ওই গলি, চিৎকার কোলাহলে মুখর আলো ফোটা আবার সূর্য অস্ত যাবার পর মুহূর্তেও। কোনো রাস্তায় মানুষের চলাচল কালেভদ্রে, পাড়াগাঁয়ের লোকালয়ের মানুষগুলোর মতোই চেনা আবার থেকে থেকে অচেনা। আমি তাকিয়ে থাকি আর দেখি ওদের চেহারাগুলো আর কথা বলার ঢঙ। অভাব অভিযোগ বাঁচার আকুতি নেই এই কথা অস্বীকার করবো এমন আস্পর্ধা আমার নেই। নিজেকে মানানসই করে তোলা যে কত কষ্টকর তাই প্রতি পদে পদে অনুভব করছি। এই গ্ৰাম-শহরকে যত দেখছি অবাক হচ্ছি, যেন সাপের খোলস পাল্টানোর মতো কিম্বা নববধূর ঘোমটা খোলার মতো করেই নিজেকে জানান দিচ্ছে। যে লজ্জা আমি অনুভব করছি, এই লজ্জা কলকাতা শহরের! পোশাক আশাকে আর অন্য আভরণে নিজেকে জানান দিলে অন্তরের পরিবর্তনে যে ছাপ পরে, না দেখে বোঝার উপায় নেই। যে পথিক আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেল, এনাকে জানার ইচ্ছেটা খুব হলো। পথচারী এগিয়ে এসে বলল, ‘এনাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে কি সাহেব? আলেকজান্ডার ডাফ, বাঙালিদের ধরে ধরে পড়ানোর ছলে খেষ্টান বানাচ্ছে। দেশীয় ভদ্দরলোকেরা মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে দেখে বলে বেড়াচ্ছে কেউ যেন ভুলেও ওঁর ছায়া না মাড়ায়।’ লোকটার কথার মধ্যে শ্লেষ ছিল তো বটেই যেন গায়ে হুল ফোটাচ্ছে। আরও কিছু জানতে চাইব কিনা ভাববার জন্য ঢোঁক গিলতেই হনহন করে ছুটে বেরিয়ে গেল। ডাফ সাহেবের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে ওনার দু-চারজন সঙ্গীরাও পায়ে পা মিলিয়ে চলে গেল বড় বাড়িটার দিকে। দেশের খবর তো পাই, কারা যেন বয়ে নিয়ে আসে। সাহেবরা কেউ কেউ আসে, আবার ফিরেও চলে যায়। এই দেশের মানুষদের নেটিভ সম্বোধনে কোথাও কোনো অবহেলা ঘৃণা প্রতি পদে পদে, বশে রাখতে চেয়ে কত না ফন্দি ফিকির। নিজেদের অস্তিত্বকে ওরা নিজেদের মতোই ধরে রাখে, ভাবখানা এমন যেন এদের দেবার মতো কিছু নেই। আমার কোথাও সব কিছু ধোঁয়াসা লাগে, আদপে কী তাই! সব জাতির মধ্যে এমন কিছু আছে, যা অন্যের মধ্যে নেই কিন্তু মনের কোনে জায়গা দেবার মতো অবশিষ্ট কিছুই নেই! ওরা আমাকে দেখেও দেখে না। আসলে আমাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য এই দেশের মানুষদের মনের মধ্যে এতটুকু জায়গা করে নিতে ক্রমশ পিছপা হয়েছে। যেচে কথার বিনিময় করতে গেলে মনে হয় কোনও আগন্তুক ঘাড়ে এসে চেপে বসেছে। স্বদেশী বাবুদের ভাবসাব চলন বলন একটু অন্যরকম। সাহেব সুবোদের তোষামোদি করে এটা ওটা বাগিয়ে নেওয়া ওদের স্বভাব চরিত্রে মিশে গেছে। আমি মুখগুলোকে জানতে বুঝতে চাই, ওরা নিজেদের লুকিয়ে রাখে, কিছুতেই মেলে ধরে না। আমার অন্তরাত্মা জেগে ওঠে, মানুষের এই হীনমন্যতা মেনে নিতে কষ্ট হয়, বুক ফেটে যায়। প্রশ্নের পর প্রশ্ন তো ভেসে আসে, কোনো উত্তর খুঁজে পাই না। মানুষরা কথা বলে, আবার বলেও না, ওরা আদৌ কী জানে কতটা পথ পাড়ি দিতে হবে।  আমি দেখতে পাই ওরা রোজ আসে, রোজ চলে যায়, হোঁচট খায়, যন্ত্রণায় কোঁকিয়ে ওঠে। আমি কি কোনো মলম লাগাতে পারি ক্ষতস্থানে? এক পথচারী জানতে চায় – ‘আমরা আর আপনারা এক নয় কেন? রঙ ঢঙ জামা কাপড় কেন আলাদা?’ আমি প্রশ্নোত্তরের জন্য সময় নিলাম, বললাম, গড এর জন্য দায়ী হবে হয়তবা। কী জানি উত্তরটা সঠিক দিয়েছিলাম কিনা। কিন্তু আমাকে যে কত প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল, আমার চোখে ঘুম এলো না, কখন দিনের আলো দেখব। আলোর কাছে নতিস্বীকার করে জানতে চাইব কেমন করে আঁধারের রঙটা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যায়।

   এই শহরকে যে যার মতো নাম দিয়ে যায়। তাতেই বা কী! কোথাও আলো, কোথাও অন্ধকার, কোথাও তুলসী তলা, কোথাও সারমেয়দের ঘেউ ঘেউ চিৎকারে পুরো এলাকা গমগম করে। কার এত সাধ্য আছে রাতারাতি ভোল পাল্টে দেয়। যে স্বাদ ওরা চেখে নিচ্ছে, টক-ঝাল-মিষ্টি, নোনতা তেতো। বাছবিচার করে যে পা রাখবে তার কী কোনো জো আছে! পণ্ডিতেরা মূর্খ হয়, মূর্খরা পণ্ডিত। কেন একথা বলছি, মন মানে না বলে। নিজের ঘরের দরজাটা বন্ধ করে জানালা খুলে দিলাম। কারা যেন ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি করে। ছুটে চলে যেতে মন চায়। কত তো দ্বিধা, কত তো দ্বন্দ্ব। কোন পথ দিয়ে হাঁটব। বাঙালি বাবুরা রাজা মহারাজা রায়বাহাদুর হয়ে চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছে। ফিটন গাড়িতে চড়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করার লিপ্সা বাড়িয়ে তুলেছে। জ্ঞানগম্মি চুলোয় যাক, নুন আনতে পান্তা ফুরায়। আমি কত তো পাখিদের আনাগোনা দেখি। পতপত শব্দে ডানা নাড়িয়ে আমাকে ছোঁবে বলে নিচে নেমে আসে ওরা, গুলগুল চোখে আমার চেহারা সুরত দেখে থমকে যায়। মানুষরা ঝগড়া করে, বেড়ালরাও গোঁফ উঁচিয়ে তেড়ে আসে। আমি কি এমনই অচ্ছুত এই দেশীয়রা মুখ ফিরিয়ে তাকায় না। ওরা বলে, ‘গায়ের গন্ধে ভূত পালায়।’ আমার বলা-কওয়ায় কীইবা আসে যায়। একটু একটু করে কলেবর বাড়লে চুপ করে কী থাকা যায়! এই শহরের আকাশ আমার সঙ্গে খেলা করে, আমিও নিশ্চিন্তে খেলতে খেলতে চলে যাই এই গলি থেকে ওগুলি। আমাদের সাহেবরা ঘোড়ার গাড়ি চড়ে মেমদের সঙ্গে নিয়ে গঙ্গার পাড়ের বিকেলের ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে মাখতে মাখতে দেখে সূর্যটা পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়ছে। শ্যানন নদীর অস্তিত্ব আজও মনের গভীরে বাসা বেঁধে আছে। উদাসী আবেগপ্রবণ মন হারিয়ে যেতে যেতে ফিরে এসে মোহাচ্ছন্ন করে দেয়। আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইলেও ফুরুত করে উড়ে চলে যায় আমার পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে। একলা মনের হিসেবটা ধরা দেয় ভিন্ন ঘরানায়। নিজের দেশের প্রতি প্রবল মায়া, মানুষের ধর্মাচরণ আমার কল্পনায় জন্ম দেয় এমন এক ভূমির যেখানে সব বোধ মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।

   আগুন দাউদাউ করে চলেছে। সেই আগুন নেভাতে গেলেও মুনশিয়ানা লাগে।  মানব জমিনে বীজ বপন করতে চাইলে তো হবে না। ঘরের মানুষ হয়ে দরজায় কড়া নাড়তে হবে তো। আমি নিজেকে কোথায় গিয়ে দাঁড় করালে নাড়ী ধরে টান মারতে পারব। ভয় হয় না এই কথা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি। লাঠিসোঁটা নিয়ে কেউ কেউ তেড়ে আসবে না কে বলতে পারে। ঘরের কোনায় বসলে ঘুঘু পাখির ডাক শুনি। কোন গাছের কোন ডালে বসে ডাক ছাড়ছে বলা কঠিন। কতক্ষন ধরে এক নাগাড়ে কোকিলের ডাক ভেসে আসে। দুয়ের কন্ঠস্বর কত আলাদা, দুটো ভিন্ন রাস্তার পথ খুলে দেয়। আমি দেখতে চাই, দেখাতে চাই এক, কোন জাদুবলে হয়ে যায় আর এক।  আমাকে দিয়ে বলিয়ে নিতে চায় এমন কথা, যা এর আগে কেউ কখনও এমন করে উপলব্ধি করে নি। ওরা সকলে নিজ নিজ আসনে বসেছে, নিজেরা যা শোনাতে চায় শুনিয়েছে নির্বিবাদে কিন্তু বাকিরা যা শুনতে চায়, শোনাবার ইচ্ছা কিংবা তাগিদ কোনোটাই ছিল না। বাংলার বিদ্যাসাগরকে তখনও আমি চোখে দেখি নি। কানে আসে আমার ইচ্ছা অনিচ্ছা ওঁকে নাকি ভাবিয়েছে। আমি পরদেশী, আমাকে নিয়ে কত কানাঘুষা, ভালো মন্দের অসুখগুলোর আক্রমণে কাউকে না কাউকে হুল ফুটিয়েছে, কেউ বা বলার কথাগুলো হজম করে নিজেদের বক্তব্যে অনড় থেকে আড়াল থেকে তীর ছুঁড়তে দ্বিধা করে নি। পরনিন্দা পরচর্চা কোন জাতির না অভ্যাসে পড়ে। নিজের মধ্যেই যে তোলপাড় শুরু হয়েছে তাকে সামাল দিতে গিয়ে আমি যে হিমসিম খাচ্ছি, সেই ছটফটানি কেবল আমিই টের পাচ্ছি। আমার দেশবাসীর আশা ভরসা সম্বল করে এই দেশের মাটির গন্ধ শুঁকে ছিলাম। চার্চ মিশনে ছাত্রদের খ্রিস্টান ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করেছিল ‘মানুষের জন্য ধর্ম না ধর্মের জন্য মানুষ।’ সোজাসাপটা উত্তরটা ছাত্রটিকে খুশি করতে পেরেছিল কিনা জানি না তবে ওর নীরবতা আমাকে যে নতুন করে ভাবিয়েছিল সেটা একশ ভাগ সত্যি। একজন মিশনারী সোসাইটির ধর্মযাজক হয়ে আমার মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল সেটাই ছিল অলিখিত পথনির্দেশ। 

সময়টা ছিল বর্ষাকালের এক সকাল। কলিকাতার রাস্তায় জল থৈ থৈ।  আমার পথচলা কী আর থামে। রাস্তার ধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবলাম এই সময় কলিকাতার ছাপোষা মানুষগুলো কেমন করে ছারপোকার মতো কিলবিল করে বেঁচে আছে না দেখলেই নয়। বৃষ্টিতে ভিজে যে মানুষটা ঠকঠক করে কাঁপছে, সদ্য গাঁ  থেকে এসেছে রোজগারের আশায়। কথা বলে বুঝলাম ক অক্ষর গোমাংস, দুনিয়াদারি দেখে নি। রাজা রাজড়াদের দরজায় ঘুরে ঘুরে মরেছে, হাতে পায়ে ধরে বলেছে, ,’একটুখানি জায়গা হবে বাপ।’ চোখ দিয়ে ঝরে পড়ছে, ফোঁটা ফোঁটা জল। কী করে যে মুছিয়ে দি, প্রভু যিশু কি আমাকে এমন শক্তি দিয়েছেন? এতদিন ধরে অধ্যয়ন করে যা কিছু ধারণ করে চলেছি মনের গভীরে তার প্রকাশ কী চোখের সামনেই ঘটে যাবে, হয়ত সম্ভব। কোনো কিছুই এই পৃথিবীতে আশ্চর্যের কিছু নয়। আমি যা কিছু ভাবছি, কিংবা ভাবার আয়োজন করছি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তার  সুফল কী অচিরেই মিলবে! প্রশ্নটা যেমন অবান্তর নয়, উত্তরটা তেমনি অপ্রাসঙ্গিক নয়। মানুষটার চোখের জল গড়াতে থাকে। ওকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললাম, আমাকে জাপটে ধর, আর মনে মনে প্রভু যীশুকে স্মরণ কর, দেখবে তোমার সকল দুঃখ নিরসনের একটা উপায় খুঁজে পাবে। কাঁধে ভর দিয়ে নিয়ে এলাম মির্জাপুরে। মানুষটা আপাতত কিছু স্বস্তি পেল। অনেকক্ষণ যীশুর ছবির দিকে তাকিয়ে রইলাম, মানুষটার অন্তরাত্মা যাতে জেগে ওঠে, আত্মশক্তিতে যাতে বলিয়ান হয় সেই প্রার্থনাই করলাম। মানুষটার জানতে চাইল এখানে কি হয়? মনের খোরাক মেলে। মানুষটার বড্ড ক্ষিদে লেগেছে।‌ গোগ্ৰাসে খেল, ঢক ঢক করে জল খেয়ে ঢেঁকুর তুলল।

 এবার বলুন তো বুঝিয়ে আমার এখানে কাজটা কী?

 আমি যা বলি, তুমি মন দিয়ে শুনবে। আর যদি প্রশ্ন 

 জাগে, তৎক্ষণাৎ জানতে চাইবে উত্তর।

 আর যদি মাথায় কিছু না আসে, গুলিয়ে যায় সব।

 নিজের মনকে জোরে ঝাঁকিয়ে নেবে। এমন করে

 ঝাঁকাবে, প্রশ্ন এসে যেন আপনা থেকেই ধাক্কা মারে।

আমার কাণ্ডকারখানা দেখে অন্য ছাত্ররা একটু অবাকই হলো। অপাঙক্তেয় লোকটাকে ওরা কীভাবে একই সারিতে এনে ফেলবে বুঝে উঠতে পারল না। আমি বুঝলাম কোথাও একটা গোলমাল আছে শিক্ষার সিলেবাসে না হলে এমনটা ঘটবে কেন! মানুষের সঙ্গে মানুষের দূরত্বের কারণটা আমাকে ভাবিয়ে তুললো। আমার অস্থিরতা আমার অর্জিত জ্ঞানের সঙ্গে অমিল হচ্ছে দেখে শিক্ষার পদ্ধতি নিয়ে চিন্তিত হলাম। তবে কী আমাদের ভারতের আত্মাকে বুঝতে কোথাও অসুবিধা হচ্ছে! এদের স্বর ও সুর আমাদের বলার কথার সঙ্গে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। ওদের কল্পনার জমিতে এইভাবে চাষ করলে চলবে না। এই দেশের জল হাওয়া চিন্তাসূত্র উচ্চারণ নিয়ে নিশ্চয়ই আরও ভাবনার অবকাশ রয়েছে। আমাদের লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য নিয়ে দিনরাত মনোযোগ দিলে কোথাও যেন ফাঁকি রয়ে যাবে। নেটিভদেরও একই পঙক্তিতে ফেলে বিচার করলে আসল সত্যে পৌঁছনো যাবে না। 

তোমরা কী বলো, তোমাদের কথা শোনাই যে জরুরি।

আমরা তো ছাপোষা মানুষ, কী মূল্য আছে আমাদের কথায়। বাঙালি বাবুরা তো আমরা বেঁচে আছি না মরে আছি খবর রাখে না, আর রইল বাকি সাহেবরা, তারা তো শাসক হলেও পরদেশী, তারা তো শুনতেই এই দেশে এসেছে, তাই না।

লোকটি যে মুখের উপর মোক্ষম জবাব দিয়েছে, চাষাভূষা হলেও কথার সারবত্তা আছে এই কথা অস্বীকার করি কী করে। কানে তো আসছে আমার গালভরা কথা। হিন্দু কলেজ হয়েছে, স্কুল বুক সোসাইটি হয়েছে, ক্যালকাটা বুক সোসাইটি হয়েছে। কারা এসবের ফল ভোগ করছে। ওয়ারেন হেস্টিংস আর কর্ণওয়ালিশ সাহেব বাংলায় কোম্পানির ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেছিল। নেটিভদের পড়ালেখা নিয়ে কোনও মাথাই ঘামায় নি। সরকারের এখন সুমতি হয়েছে, শিক্ষার জন্য ব্যয় বরাদ্দ করেছে ভালো কথা।

কাদের ভালো হয়েছে সাহেব, সেই কি আমরা বুঝি না। বুঝি, আমরা সব বুঝি। পেটে ভাত নাই তো কী হয়েছে, মাথার ঘিলুটা তো আছে।

ওদের কথাগুলো যে একেবারে ফেলনার নয়, সে কথা বলার কী কোনও জায়গা আছে। বুঝলাম এই দেশের মানুষদের আমাদের শাসকরা যতই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করুক, সুযোগ পেলে ওদের হীরে হতে সময় লাগবে না, এটাই হলো আসল কথা। ইংল্যান্ডে যে পাঠ্যপুস্তক আমি অধ্যয়ন করেছিলাম, তা শুধুমাত্র আমার অন্তরে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এমন নয়, জীবনের কোন কোন অধ্যায়কে প্রভাবিত করতে পারে তা সচক্ষে দেখার তাগিদও অনুভব করেছিলাম। ছটফট করে উঠেছিল বৈশ্বিক চিন্তায়। কিন্তু তাই বলে হাজার হাজার মাইল দূরের মানুষের মুখগুলো যে এইভাবে সামনে এসে হাজির হবে, আমাকে বুঝিয়ে দেবে পুঁথিগত জ্ঞান আর জ্ঞানের প্রকাশ এই দূয়ের মধ্যে মিলন ঘটানো কঠিন তো বটেই, কঠিনতম, হয়তো সমুদ্রের উত্তাল জলরাশির মতোই গর্জে উঠে মিলিয়ে যাওয়া। জীবনের সঙ্গে আমি জড়াতে চেয়েছিলাম, ভেবেছিলাম আমার চিন্তার বাঁধনে বেঁধে ফেলে একই অঙ্গনে এসে হাজির করবো। ওরা আসে, পাতার পর পাতা ওল্টায়, প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে, একসময় সূর্য যখন পশ্চিম দিগন্তে অস্ত যায়, বুঝে যাই আমি একা, আমার বোধের আলাদা কোনও অস্তিত্ব নেই, ওরা আছে বলেই আমি আছি, ওদের অনুভবে সলতে পাকানোর আমার কাজ। ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজে, অনেক পণ্ডিতেরা সব অধ্যায়গুলো ধরে ধরে নিজের মতো ব্যখ্যা করে। জানতে চায় – ‘ রেভারেন্ড লং কেমন বুঝছেন? বেয়ারা ছাত্ররা জ্বালাতন করছে না তো, বুঝলে উচিত শিক্ষা দিতে ইতস্তত করবেন না।’ উত্তরে কিছু বলার আগেই হাসির দমকে অস্থির হয়ে যাই। একটা সীমাবদ্ধ গণ্ডির মধ্যে নিজেকে আটকে রাখলে কাজের কাজ কিছুই হবে না, আখেরে নিট ফল হবে শূন্য। যে চোখের আলোয় সমগ্ৰ ব্রিটিশদের দেখেছিলাম এই পথে হাঁটলে প্রতি পদে পদে হোঁচট খেতেই হবে। চিন্তার বৃত্তের এই অনুর্বরতা ক্রমশ যে পিছু টানবে, এই ব্যাপারে আমি ষোলো আনা নিশ্চিত। এখানে সবকিছু ঘুরপাক খাচ্ছে নিজের মতো। নিজস্ব জ্ঞানের পরিধিতে বিচার করার প্রক্রিয়া যে আসল প্রক্রিয়া নয়, এই দেশের মানুষ কবে বুঝবে। যাঁরা বুঝবে এবং বোঝাবে বলে ঠিক করেছিল তাতেও তো হাজারো গলদ। হ্যাঁ আমি পাদ্রী লং, দরিদ্র রোগাগ্ৰস্ত লোকগুলো আমাকে যে নিজের লোক বলে ভাবতে শুরু করবে, তারও তো কোনো নিশ্চয়তা নেই।  আমি হেড মাস্টার মিঃ ম্যাকলিনসের কাছ থেকে মীরজাপুর স্কুলের দায়িত্ব বুঝে নেবার পরে পরেই বুঝলাম অনেক অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে হবে। স্থানীয় মিশনারী পাদরীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন। আমার বিশ্বাস দেশীয় ভাষায় ব্যুৎপত্তি জন্মালে দেশীয় পুস্তক ও পত্র-পত্রিকায় মিশনারী, ইউরোপীয় ও সরকারের সম্পর্কে কি সব লেখা হচ্ছে তার ও দেশীয় সাধারণের অভাব-অভিযোগের কথা সংগ্ৰহ করে সরকার, পাদ্রী ও অন্যান্যদের গোচরে আনা সম্ভব হবে। বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সোসাইটির সভাপতি হয়েছেন জর্জ টমসন এবং প্যারীচাঁদ মিত্র হয়েছেন সম্পাদক। সমস্যায় জর্জরিত এই দেশীয়দের অনেক না-বলা কথাই তুলে ধরতে হবে  বই কী, প্যারীচাঁদ বললেন, এই বিষয়ে সোসাইটিতে গভীর আলোচনা জরুরি। রাজনৈতিক পরিস্থিতিও ব্রিটিশ সরকারের নজরে আনা উচিত এবং কোম্পানির আসন্ন সনদেও সংস্কারের পরামর্শ দেওয়া আশু কর্তব্য। 

আঁধারে যে স্বপ্নগুলো কিলবিল করে, আলোতে সকল ভেদরেখা মুছে গিয়ে আমাকে কখনও জাগিয়ে দেয়, পথের সন্ধানে তাড়িত করে, এদের যা পাবার কথা ছিল, পাওনাগণ্ডা বুঝে নিয়েছে তো। কেমন যেন মনে হতে লাগল কারা জেগে উঠেছে, কারা নিজের শিকড়কে উপড়ে ফেলে ধেই নেই করে নেচে চলেছে অন্য কিছুকে আঁকড়ে ধরবে বলে। তাতে তো সমূহ বিপদ, বাইরের আদলটাও পাল্টে গেল, ভেতরটা হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে ফোঁপরা, না চিনছে নিজেকে, পরের সঙ্গে আত্মীয়তা পাতানো সহজ কথা তো নয়। ভরাট করতে গেলে শরীর ও মন দুটোই সমান তালে না চললে চলবে কেন! মানুষের মহৌৎসবে এই আমন্ত্রণ আমি আমার স্বদেশেও দেখেছি পলে পলে। কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যা, মরণপণ লড়াইয়েও কি জানা যায় ? কত কিছুই তো বাকি রয়ে গেছে, যা হারিয়ে গেছে, খুঁজে পেতে কেউ না কেউ ত এনে দেবে, না হলে বাহিরের রঙটা যে কখন ফিকে হয়ে যাবে, কেউ টেরও পাবে না। আমার এমন দশা দেখে কেউ না কেউ তো ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে, এমন কথা অস্বীকার করি কী করে। আমি নিজেকে মনে করি বিজাতীয়, স্বজাতির বৈঠকখানায় এসে নাম লিখেয়েছি। বুঝতে আমার দেরি হলো না, ওদের কথাই আমার কথার রসে মিলে গিয়ে এমন এক ভাবের জন্ম দিয়েছে, যা ফেলনারও নয়, গ্ৰহণেরও নয়, এই এক বিরাট দ্বন্দ্ব। কেউ কেউ এগিয়ে এসেছে বটে, কেউ পিছপা হতে গিয়ে হোঁচটও খেয়েছে। জীবনটা কী এইরকমই না কোনোও অন্য ধাতুতে গড়া কোনো এক অজানা অদেখা স্রোত, যার টানে আমি ভেসে চলেছি, কোথাও না কোথাও নোঙর করতে হবে। এটা বুঝেছি আমাকে পাড়ে উঠতে হবে।

কলিকাতার খোলনলচে কীভাবে সেজেগুজে আছে যত মাটির উপরে চড়ে বেড়াচ্ছি, মনে হয়েছে এ-ও প্রাচ্যের আর এক অন্দরমহল, কে বা কারা এসে নাড়িয়ে দিচ্ছে তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। পথটাও আলাদা, পথের নিশানাও আলাদা, পাঁচ হাজার বছরের সময় গ্ৰন্থিরা এসে কাবু করে ফেলছে। আমি নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে লাগলাম, বুঝতে লাগলাম আমি আর আমার আমিতে নেই, এই যেন অন্য বাতাস, বাতাসে বয়ে চলেছে অন্য ঘ্রাণ, একে জাপটে ধরতে হবে, অন্য রসের সাগরে সাঁতার কাটতে হবে, বড় দূর্গম এই পথ, হোঁচট খেতে হয় খাবো। কীসের এক অমোঘ টান, উপেক্ষা করবো এমন সাধ্য আমার নেই। ভাষার সঙ্গে আমার আত্মীয়তা আমার যেন জন্ম জন্মান্তরের, শব্দরা আমার সঙ্গে সম্পর্ক পাতায়, আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চায় ওরাই জানে। আমি দেখতে পাই কেউ ডুব সাঁতার কাটছে, কেউবা পিছমোড়া হয়ে, কেউবা ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে আপন নিয়মে। আমার জমানো কথাগুলো আমাকেই বলতে হবে। রৌদ্রজ্জ্বল দুপুরের প্রবল তেজে মনে হলো এই তো সময় – প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিলনের সন্ধিক্ষণ, গ্ৰিক ল্যাটিন পার্সিয়ান রাশিয়ান, সেল্টিক লিথুয়ানিয়া জার্মান হিব্রু অ্যাংলো সেক্সন সংস্কৃতের সঙ্গে ইংরেজির সংযোগ সকলের অভিমুখ মিলতে চাইছে কোথাও কী? মানুষ যে এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাবে কে জানত। দরজাগুলো এক এক করে খুলে যাচ্ছে, আর এক নিঃশ্বাসে ভিন্ন এক ঘ্রাণ নিয়ে পুষ্ট হলো। এমনটা কি কোনোকালে ভেবেছি। এশিয়াটিক সোসাইটির এসোসিয়েটস সভ্য হয়ে জার্নালে লিখলাম মনের কথাগুলো। এইভাবে কথা চালাচালি করতেই কোনোদিন পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে যাবো সবটাই ছিল ধ্যান ধারণার অনেক দূরে। দূর কী এত সহজে নিকট হয়! কত তো পথ, কোন পথে গেলে সকলের ডাক এসে কানে বাজবে কে বলতে পারে। তাই তো গলির পরে গলি, মানুষের পর আরও মানুষের কথা কাহিনী আমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগলাম। কোনটা যে আসল স্বদেশ আর কোনটা যে বিদেশ, কারা যে শত্রু কারা যে মিত্র, এই দুয়ের তফাতটা বুঝতে সময়ের ঝুলিটাকে বেশ করে ঝাঁকিয়ে নিলাম।  

ভার্নাকুলার লিটারেচার সোসাইটি, ক্যালকাটা বুক সোসাইটি, বেঙ্গল সোস্যাল সাইন্স এসোসিয়েশন, সোসাইটি ফর প্রমোশন অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট, ফেমিলি লিটারারি ক্লাব, বুক সোসাইটি, ফোকলোর সোসাইটির কর্মসূচির সঙ্গে আমার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যেন কোথাও মিলে গেল। আমি ক্রমশই যেন অনুভব করতে লাগলাম দরজা জানালাগুলো এই যে খুলতে শুরু করেছে আর বোধ হয় সহজে বন্ধ হবে না। কাজের যে অসংগতি ছিল না, তাই বা বলি কী করে। পরিচালক মণ্ডলীদের নজরে তড়িঘড়ি আনলেও কোথাও কিন্তু অসহিষ্ণুতা ও অসহযোগিতা বিভেদের দেয়ালকে আরও চওড়া করে দেয়। এই দূরত্ব যে কোন পথে ঘুচে যাবে তারও কোনও দিশা দেখা যাচ্ছিল না। যে উদ্দেশ্য নিয়ে সুদূর ইংল্যান্ড ছেড়ে কলিকাতা এলাম তার কী হবে? ডাফের স্কটিশ মিশন ও অন্যান্য মিশন যখন পুরোদমে দীক্ষা দিয়ে চলেছে তখন চার্চ মিশন ১৮২২ থেকে ১৮৪০ এর মধ্যে মাত্র দুই জনকে দীক্ষা দিতে পেরেছে। দীক্ষা দেওয়া যদিও মিশনের লক্ষ্য ঠিক কিন্তু ছাত্রদের মানসিক উন্নতির অন্য মাধ্যম গুলো গৌণ করে দিলে তো অভিষ্ট পূর্ণ হবে না। কোথাও যেন একটা দ্বন্দ্ব কাজ করছিল। অন্য পাদ্রীরা এই নিয়ে আমার জম্পেশ সমালোচনা করলো। নিজের মনকে প্রবোধ দিলাম এই বলে কিছু একটা রাস্তা তো খুলে যাবে আজ না হয় কাল। এদিকে কেউ কতৃপক্ষ চাইল ফাণ্ডের অভাবের জন্য উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তই উচ্চ শিক্ষার অঙ্গনে থাকবে, সাধারণের জন্য কোনও বরাদ্দ থাকবে না। এরাই শিক্ষক হয়ে সাধারণকে শিক্ষা দিবে। অকল্যান্ড ও হার্ডিঞ্জের আমলে এই পদ্ধতিই মান্যতা পেল। আমার যেন মনে হলো যেন কোথাও বঞ্চিত হচ্ছে ছাপোষা মানুষরা। তবুও দেখা যাক সরকারের কোনোভাবে দৃষ্টি আকর্ষন করা যায় কিনা।

ঘরকে বলি বেঘর হতে

চার্চ মিশনারি সোসাইটি, লন্ডনের ইসলিঙটন কলেজের ছবিটা দিনে দিনে ছায়া হয়ে আমার সঙ্গেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাশিয়া যাত্রার যৌবনের মুহূর্ত গুলো আমাকে মাঝে মাঝেই ধাক্কা মারে। এ যেন অন্য একটা আমি আমার উপর চেপে বসেছে। এমন অবস্থা হয়েছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে কল্পনাপ্রসূত পদক্ষেপ গুলো। কিন্তু প্রতিদিনের ভাবনা চিন্তাগুলো পাশাপাশি যেন সমানতালে চলছে। কোন কথাটা আগে বলবো। কৃষ্ণমোহন বলে চলে, ‘সব কিছুরই একটা ধারাবাহিকতা আছে, তবুও বলছি যা কিছু মনের ঘরে বাসা বেঁধে আছে, লাটাইয়ের সুতো ছাড়ার মতোই আকাশে উড়িয়ে দাও। পতপত করে যখন উড়বে, রংটা চিনে নিয়ে ঠিক সময়ে সুতো ছাড়ো, তাহলেই কাজের কাজ হবে।’ বুঝলাম ওর হিসেবটা একান্তই নিজের মতো, এর সঙ্গে অন্য কিছুর মিল অমিল দুটোই হতে পারে। তবুও ও তো নিজের মতো করেই গায়ে ধুলো মুখে নিজেই শুষে নেয়। শুরুতে আশ্চর্য মনে হলেও উদ্বিগ্ন হই নি। মানুষের অহরহ পরিবর্তন হয়, কখনও নিজেকে চেনে, কখনও চিনেও যেন ভুল করে চেনে। মানুষের এই জয়যাত্রা চিরকালের, একে উষ্কে দিতে পারলেই কার্যসিদ্ধি হয়। এই শহরটা নিজস্ব ঢঙে ডানা মেলছে, যা এখানে, কাল একটু দূরে, পরশু আর একটু দূরে, আরও দূরে পা বাড়াতে গেলে একটু একটু করে মিলিয়ে যেতে চায় কখনও ঘন আঁধারে, কখনও আলোর রোশনাইয়ে। এতদিন যাবৎ যা কিছু শিখেছি জীবন আমার হলেও নিজের নয়, অন্যের, এক সময় নিজের করে নিতে চাইলেও পর হয়ে যায়।  জীবনের এই হিসেব কষার আমি কে! সকলকে জড়িয়ে নিয়েই তো অন্য অর্থ দাঁড়ায়। মানুষ বড় কাঁদছে, কেন কাঁদছে, কাঁদার রকম-সকম কী! মানুষকে নিয়ে মানুষের কাড়াকাড়ি টানাটানি ফেলে আসা দিনগুলোর, চলমান হা-হুতাশের, না-পাওয়ার যন্ত্রণার। মানুষের দরবারে হাজির করতেই হবে, তাইতো আমার অন্তরাত্মা জেগে ওঠে। প্রাচীনতা, পুরাতত্ত্ব, ভাষা আমার চিন্তার খোরাক জোগায়, প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে। কলকাতার মানুষ ও ঘরবাড়ি, ত্রিপুরার ঐতিহাসিক বিবরণ, প্রাচীন সময়ের কাশ্মীর, ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম ও আরও নানা বিষয় নিয়ে এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল, ক্যালকাটা রিভিউতে আমি নিবন্ধে উল্লেখ করেছি আমার চিন্তা ও চেতনা। বলার কথা তো এত তাড়াতাড়ি ফুরোয় না। কত কথাই না আমার বলতে হবে, বলাতে হবে। নতুন কথা না শোনালে বুঝবে কেমন করে খ্রীষ্ট ধর্মের খুঁটিনাটি। আমার মনে হলো একটা বাঙলা মাসিক পত্রিকা জরুরি। মাতৃভাষা ছাড়া আর কোন ভাষায় সারমর্ম বুঝে উঠতে পারবে?  আর জ্ঞানের আলো না ছড়ালে যে অন্ধকারে ওরা পড়েছিল, অন্ধকারেই ডুবে যাবে। ‘সত্যার্ণব’ আত্মপ্রকাশ করে – মানুষের কথা বলতে হবে, মানুষের কথা মানুষকেই শোনাতে হবে, এখানে কোনো আপোষ আমি পছন্দ করি না। জাতিভেদ ভুলতে হবে, মানুষের কথা বলতে হবে।

    আমি ক্রমশ বুঝতে পারছি   মিশনারি হলেও, আমার নিজের পথ নিজেকেই বেছে নিতে হবে। আমি কী চাক্ষুষ করছি ওরা আমাকে ফাদার লঙ ও পুরোহিত লঙ এর থেকেও সাহেব-ভাই, সাহেব-বাবা সম্বোধন করতে বেশি পছন্দ করে। পুঁথিগত বিদ্যা মিশনারি কাজে জাহির করা অনুচিত কাজ হবে। দ্বন্দ্ব-জিজ্ঞাসা নিরসনের জন্য, মনকে শান্ত ও স্থিতধীর জন্য পুঁথিগত বিদ্যা কাজে আসতে পারে কিন্তু মিশনারি হওয়ার কাজে জীবনের শিক্ষাই কাজে আসে। প্রাতিষ্ঠানিক রীতি ও প্রথা নয়, মানুষকে শর্ত নিরপেক্ষ ভালোবাসাই আসল কথা। প্রথমদিকে আমার এই বিশ্বাসও জন্মেছিল এবং চার্চ মিশনারি সোসাইটির সেক্রেটারিকে লিখেছিলাম – ইংরেজি শিক্ষার আলোয় এ দেশ থেকে  হিন্দুধর্মের কুসংস্কারগুলি ঝেঁটিয়ে বিদায় করা যাবে। হিন্দুধর্মের সঙ্গে লড়াইয়ে খ্রিস্টধর্মের জয় হবে। কলকাতা হবে ইংরেজদের দ্বিতীয় ওয়াটারলু যেখানে খ্রিস্টধর্মের জয় ঘোষিত হবে। হয়তো আমার এই ধারণা কোনও কার্যকরি ধারণা ছিল না কিম্বা কোনও সমাজের খোলস দেখে মন্তব্য সঠিক ছিল না, এর অন্তর্জগৎকেও বুঝে নেওয়া জরুরি হয়ে পড়ে। এতদিনের তিল তিল করা গড়ে তোলা এই প্রাচীন সভ্যতার অন্তরালে ফল্গুধারার মতো বয়ে চলেছে নির্জন স্রোত, তাকে জানা বোঝা জরুরি। আমাদের দেশের লোকেরা ব্যবসায় হাত পাকিয়ে বাহুবলে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে তৎপর হয়েছে বটে কিন্তু একদিন জবাবদিহি করতে হবে বইকি। দেশ শাসনে  ধর্মবিস্তার শেষ কথা নয়, মানুষের প্রতিদিনের যাপন, দুঃখ কষ্টের হিসাব রাখতে হবে। দেশের আপামর জনসাধারণ কোন পথ দিয়ে হাঁটছে, আসলে কী চায় ওরা, শরীর ও মনের খোরাক ওদের একজন হয়ে বুঝতে হবে। এমনিতেই ইংরেজদের চালচলন, ভাবভঙ্গি ও শিক্ষদিক্ষা গাঁ-গঞ্জের গরীব মানুষ থেকে শত যোজন দূরে, কবে ঘুচবে কে আর জানে। টেকচাঁদ ঠাকুর, অর্থাৎ প্যারীচাঁদ মিত্রকে কথায় কথায় বললাম, মিত্র মশাই আপনার ‘আলালের ঘরের দুলাল’ পড়লাম। কী লিখেছেন মশাই, বাংলার মানুষকে এমন করে আগে তো দেখিনি, দিনরাত হরেক মানুষের সঙ্গে মিশি, আপনার চোখ দুটো আমায় ধার দেবেন তো কিছুদিনের জন্য। আপনি তো ‘বাংলার ডিকেন্স’। ঠাকুর কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, ‘এটা কী সঠিক মূল্যায়ন হলো, কোথায় বটবৃক্ষ আর কোথায় লতানো পত্রী, বাংলার সামান্য একজন লেখককে বিব্রত না করলেই চলছিল না।’ ঠিক আছে  নিজেকে আর ছোটো করবেন না, বাংলার মানুষ জানে আপনি একটা রত্ন। কৃষ্ণনগর যাচ্ছি মিশনের কাজে, চলুন ঘুরে আসি। ‘শুনুন লঙ সাহেব, আপনি তো এত লোকের প্রশংসা করে বেড়ান। নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখেছেন। এই কয় বছরের মধ্যেই কেমন ঝরঝরে বাংলা শিখে ফেলেছেন, বলতে পারেন, লিখতে পারেন। এত বিদ্যা রপ্ত করলেন কেমন করে!’ উত্তরটা আমার জানাই ছিল, কিন্তু দিতে পারলাম আর কই। কত কাজের পাহাড়, কোনটা ফেলে কোনটা রাখি।

    সমস্যা তো একরকমের নয়, নানারকমের। মনটাকে আমি কিছুতেই নিজের বশে আনতে পারছি না কলকাতায় আসার আগে আলেকজান্ডার ডাফ সাহেবের ‘ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইন্ডিয়া মিশন’ বইটা খুব মনোযোগ দিয়েই পড়েছিলাম। কিন্তু এখানে এসে যত দেখছি কিছুতেই যেন কিছুই মিল খুঁজে পাচ্ছি না। তবে কি ডাফ্‌ সাহেবের দেখাটা সঠিক ছিল না? কত কিছুই তো এই দুনিয়াতে ভুল ব্যাখ্যা হয়। ভুলের উপর আর এক ভুল চেপে বসে, দুনিয়াটা এইভাবেই চলে, তারপরে একদিন ভেঙেচুরে সব শেষ হয়ে যায়। দেশ আর দেশ থাকে না। শাসক আর জনগণের মাঝখানে একটা ফাটল ধরে। রিখটার স্কেলে যেমন ভূমিকম্পের পরিমাপ হয়, দেশের সীমানায় তো সেই সুযোগ থাকে না। কত তো তার অভিমুখ, একদিকে মেরামত করলেও অন্যদিকে হেলতে থাকে। এই হেলে যাওয়াটা বড় আজব বস্তু, মানুষের মনের সঙ্গে সংযোগ থাকে কিনা।  উশৃঙ্খলতা আবার নানা ভাষায় কথা বলে, নানা রূপে এসে বিস্ফোরণ ঘটায়, ঘটা করে তার আড়ম্বরপূর্ণতা প্রদর্শন করে। কেউই এগিয়ে আসে না তার সমাধান করতে। সময়টা বড় বেসামাল, অন্যদিকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন গোঁড়া অন্ধ হিন্দু সমাজ, দুয়ের সাঁড়াশি আক্রমণে সমাজের বাইরের চেহারা যেমন ভেঙে চুরে চুর হয়েছে, অন্তরের কোনো সৌন্দর্যই অবশিষ্ট নেই। এই অবস্থায় আমার মনে হয়েছে ধর্ম ধর্ম না করে মানুষ করার হাতিয়ার হতে পারে শিক্ষা। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দের ১১ ডিসেম্বর মেডিক্যাল কলেজ থিয়েটারে প্রতিষ্ঠিত ‘বেথুন সোসাইটি’র প্রথম সভাতেই সদস্য হলাম। সাহিত্য ও বিজ্ঞান সেখানে মুখ্য বিষয় হয়েছিল, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্যারীচাঁদ মিত্রও ছিলেন, ডাফ্‌ সাহেব ধর্ম আলোচনা নিষেধ থাকায় সভ্য ছিলেন না। কৃষ্ণমোহন বন্ধ্যেপাধ্যায় বললেন, ‘ রেভারেন্ড ডাফ্ -এর শিক্ষার উপরে ধর্মকে প্রাধান্য দেওয়া আমি মানতে পারব না।’ আমি এখানে আট বছর মিশনারি হিসাবে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। এখন মনে হচ্ছে ইউরোপীয়ানরা এই দেশের ভাষা সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকায় এমন ধারণা পোষণ করেছে তাঁরাই একমাত্র সভ‌্যতার উত্তরাধিকারী। কিন্তু আমি যত হিন্দুদের সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হচ্ছি, আমার সেই ভুল ভেঙে যাচ্ছে।

    এক ছাত্র বলল, ‘ফাদার, ইদানীং আপনাকে একটু অন্যমনস্ক দেখছি, একটু আনমনা হয়ে থাকেন, কোনো বিষয় নিয়ে ভাবছেন বুঝি।’

বললাম, না না, কোন নতুন বিষয় নিয়ে কাজ করতে গেলে একটু দ্বন্দ্ব তো আসবেই, তাছাড়া সময় কি সবসময় একরকম চলে, নানা পরিবর্তনের ঢেউ এসে ধাক্কা তো মারবেই, মেনে নিতে হবে। এইটাই জীবনের ধর্ম, অত ভাবলে চলে না। শুধু পড়াশোনা করলে চলবে না, সমাজকে শোধন করার চেষ্টা করতে হবে। বিজ্ঞান ভাবনা আর যুক্তিবাদী মন তৈরি না হলে সমাজের ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করা তো যাবে না। শুধু সাফাই অভিযান করা তো কাজের কথা নয়, ঝকঝকে তকতকে না হলে লোকের কাছে মুখ দেখাবে কেমন করে। আবার আলো ছড়ানোর কায়দাটা তো জানা চাই।  আলোর তেজে ঝলসে যাবে না, একথা তো হলফ করে বলা যায় না। কত ভাবনাই তো মনের কোনায় উঁকি মারে। ধর্ম ধর্ম করে গোটা সমাজটাই না উচ্ছন্নে চলে যায়। পাড়ায় পাড়ায় মানুষের সংশ্রবে আসার আগে এই দেশ নিয়ে আমার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আবেগ আর পুঁথিগত বিদ্যা  একটা নির্দিষ্ট গণ্ডিতে বেঁধে রেখে ভেবেছিলাম আমার চোখের আলোয় জগৎ দেখব কিন্তু এতগুলো চোখের নিষ্পলক দৃষ্টি আমার জীবন ও যৌবনকে অন্য খাতে বইয়ে দিতে শুরু করল। ওদের কথাগুলো তো ফেলনার নয় – ‘ ফাদার, ক্ষিদের জ্বালায় পেট চোঁ চোঁ করে, ধর্মের বুলি বড় তেতো লাগে। ধর্ম পাল্টালেও দেশটা তো পাল্টে যাবে না, ঘরও পাল্টাবে না। বরঞ্চ যার জায়গায় সেই থাকুক, এমন কথা বলুন, যা আমরা আগে কখনও শুনিনি।’ এরা তো মন্দ কথা বলে নি, ধন্দেই পড়ে গেলাম, এদের মনের ভেতরের কথা উদ্ধার করব, এমন সাধ্য কী আমার আছে! ওরা আমাকে ভালো করেই বুঝিয়ে দিল, ওদের মন বুঝতে হবে, ওদের জীবন চর্চাকে বুঝতে হবে, না হয় সময়টা ফুরিয়ে যাবে, ফুটো কলসিতে জল ঢেলে কোনও লাভ হবে না, কলসি কোনোদিন আর ভরাট হবে না। ফাদার ডাফ্‌ আর পাদ্রীরা গোড়াতেই এই ভুলটা করে বসেন নি তো? এর জবাব তো আমার কাছে নেই, নাকি অন্য এমন কোনো রাস্তা খোলা আছে, যার হদিস আমি পাচ্ছি না। আমার সতীর্থরা আমার কথাগুলো হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছে, ‘নেটিভরা এসবের কি বোঝে, বেশির ভাগই তো পড়ালেখা কিছুই জানে না। দেখবেন শেষে আমাদের শেখানো বিদ্যায় আমাদেরই না খেয়ে ফেলে, মূর্খ মূর্খই থাক, আমাদের দলে ভিড়বে ঠিক কথা, বিশেষ কিছু সুবিধা করতে পারবে না।’ ওদের কথায় আমার খটকা লাগল, আয়ারল্যান্ডের আর্থিক দূর্দশার  সঙ্গে একই সারিতে ফেলে কিছুক্ষণ মাপজোক করে বুঝলাম আসলে তফাৎটা কোথায়। পরক্ষণেই মনে হলো মানুষের অধিকার কতটা তা মানুষকে জানিয়ে দিতে হবে, না হলে কাজের কাজ কিছুই হবে না, ওরা যেই তিমিরেই আছে, চিরকাল সেই তিমিরেই থেকে যাবে।

    এই মানসিক টানাপোড়েনে ডেভিড হেয়ারকে মাথায় তুলে নিলাম। ইংরেজিতে শিক্ষা দিলেও মাতৃভাষায় শিক্ষাদানে আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতাম। যেই দুবছর আমি হেয়ার সাহেবের সান্নিধ্য পেয়েছি মনে হয়েছে এই মানুষটির নির্দেশিত পথেই রয়েছে সমাজের খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার চাবিকাঠি। প্রয়োজন হলেই নির্দ্বিধায় কাউকে তোয়াক্কা না করে যে কোনো দরজায় কড়া নেড়েছেন। আমি প্রখ্যাত চিকিৎসক সূর্যকুমার গুডিভ চক্রবর্তীকে চিঠিতে লিখেছি – এদেশের দরিদ্র মানুষ যে কজন শিশুসন্তানকে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয় বা যে কজন বিধবাকে স্বামীর চিতার আগুনে পুড়িয়ে মারে তার থেকে অনেক অনেক গুণ অসহায় দরিদ্র মানুষ বাংলার গ্রামে গঞ্জে কোনো চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে কুসংস্কার আর অশিক্ষার বলি হচ্ছে। আমি মনে করি সমাজ পুনর্গঠনের কাজকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ঊর্ধ্বে প্রাধান্য দিয়ে মানবকল্যাণকেই নিজের ধর্ম বলে বেছে নেওয়া উচিত। আমি চাই মাতৃভাষায় শিক্ষাবিস্তার, স্ত্রী-শিক্ষার প্রসার, সংস্কৃত পাঠের গুরুত্ব, বাংলাভাষার উন্নতিসাধন, চাষের উন্নতি এসব সামাজিক কাজই হওয়া উচিত প্রধান কর্তব্য। আমি এও জানি অন্যান্য আমার সতীর্থ মিশনারিরা আমাকে মিশনারি হিসেবে অনুপযুক্ত মনে করেন, আমার আচরণকে মিশনারি স্বার্থের পরিপন্থী বলেন। তাতে আর যাই হোক আমার লক্ষ্য থেকে আমাকে বিচ্যুত করতে কেউ পারবে না। আমি গ্রামের মানুষের কাছ থেকে আপনজনের মতো ব্যবহার পেয়েছি। তাঁরা বিধর্মী বলে আমাকে অপমান করেনি। ওরা যখন আমাকে বঙ্গবান্ধব বলে সম্বোধন করে তখন মনে হয় দেশ থেকে অত দূরে থেকেও আমি নিজেকে কখনোই একলা মনে করি না।  মেকলে সাহেবের বক্তব্য আমি স্বীকার করতে পারিনি। কারন তিনি বিশ্বাস করতেন ‘মূর্তি পূজার অবসানের অর্থ হিন্দু ধর্মের বিলুপ্তি অর্থাৎ শিক্ষাবিস্তারের পশ্চাৎ-উদ্দেশ্য খ্রিস্টধর্মের প্রতিষ্ঠা; আর ফিল্ট্রেশন পদ্ধতিতে শিক্ষার বিস্তার।’ আমি মনে করি কবে এক শ্রেণি শিক্ষিত হয়ে নিচুস্তরে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেবে, এভাবে অপেক্ষা করে থাকলে শিক্ষার প্রসার হবে না। এ যেন নদী তীরে গালে হাত দিয়ে বসে অপেক্ষা করা কবে নদীর জল শুকোবে তবে নদী পার হব। আমি আ্যডমস্ রিপোর্ট অন্‌ ভার্নাকুলার এডুকেশনকে সম্পূর্ণ সমর্থন করে দেশজ বিদ্যালয়গুলির উন্নতির জন্য এবং মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। আমি গ্রামে গ্রামে স্কুলে ঘুরে ঘুরে দেখেছি কিভাবে ওখানকার গুরু মশাইরা দরিদ্র মানুষদের পড়তে লিখতে সুযোগ করে দিচ্ছেন আর এটাই হল দরিদ্র দেশের শিক্ষাবিস্তারের স্তম্ভ।  পাঁচ বৎসরের চেষ্টায় প্রকাশিত হয়েছে ‘এ হেন্ড বুক অফ বেঙ্গল মিশন’ আমার দেওয়া তথ্যাদি সরকার ও অন্যান্যদের কাজে আসে। দেশীয় সমাজ জীবন ও সাহিত্য ব্যাপারে এশিয়াটিক সোসাইটি আমাকে জে.পি.ওয়াইজ সংগৃহীত ‘রাজমালা’ সম্পাদনা করার দায়িত্ব অর্পণ করেন। সোসাইটি জার্নালে’এনালাইসিস অফ দ্য বেঙ্গলি পয়েম ‘রাজমালা’ অর দ্য ক্রনিকল ‘ প্রকাশিত হয়।  

    আমি হাঁটছি তো হাঁটছি। হাঁটার কোনও বিরাম নেই। স্কুলের জীর্ণদশা দেখে আমার অন্তরটা কেঁদে ওঠে। স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে ছাত্রদের পড়াশোনার মান আমাকে ব্যথিত করে। শিক্ষার প্রসারে আরও অনেক স্কুল স্থাপন যে জরুরি কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন না হলে সাধারণরা অশিক্ষার ফলে জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত হবে। ওরা হাত জোড় করে প্রার্থনা করে – ফাদার, আমাদের বই পুস্তক নেই, কালি কলম নেই, ঘরের চাল নেই, পেটে ভাত জোটে না। সরকার কৃষি খাতে আর স্কুলের জন্য যা বরাদ্দ করে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। যদি আমার কাছে সম্পদ থাকতো এঁদের সকল দুঃখ দুর্দশার একটা না একটা সুরাহা করতাম, এমন যে অবস্থা আর চোখে দেখা যায় না। এমন সরকারের থাকার প্রয়োজন কী যারা চাষী মুটে মজুরদের দুঃখ দুর্দশার অবসান ঘটাতে পারে না। শহরের বাবুরা যারা ইংরেজ সাহেবদের তাবেদারি করে তাদের এই নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। সকল সুখ স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে ওরা তো দুধে ভাতে আছে। আমি রোজ আমার ঘরে ফিরে আসি আর মানসিক যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাই। ঘরের পাশের গাছটার মিষ্টি বাতাস এসে আমার সারা শরীরকে জুড়িয়ে দেয়। এই দেশ, এই দেশের মানুষের অভাব অনটন কেমন করে মিটানো যাবে, ভেবে কোনো কুল পাই না। শরীর ও মনের অস্বস্তি আমাকে কলম ধরতে বাধ্য করে। প্রশ্ন জাগে তবে কী অত্যাচারী ও টাকাসর্বস্ব বণিক ইংরেজরা আলাদা কোনও  জাতের মানুষ যারা মানুষের দুঃখ কষ্ট দেখেও মুখ ফিরিয়ে নেয়, কেবল শোষণ করতেই যারা আনন্দে ডগমগ হয়। গ্ৰামের মানুষদের তাই তো অভিযোগের অন্ত নেই।

    সঙ্কট যখন চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে যেন টুকরো টুকরো অন্ধকার নিজের মতোই জমাট বাঁধছে, একসময় সকল আলোকে শুষে নিয়ে চম্পট দেবে। যত কিছুই পরিকল্পনা মগজে ঘোরাফেরা করে, কোথাও ফুটো কলসীর মতো শূন্য হয়ে যাচ্ছে। মির্জাপুর ইংরেজি স্কুলটার বাঁধন আলগা হচ্ছে। মতিলাল শীল ও জেসুইটরা দুইটি স্কুল স্থাপন করলে এই স্কুলটির ভবিষ্যত নড়বড়ে হয়ে যায়। কেরানিগিরি তো শিক্ষার মূল লক্ষ্য হতে পারে না। সার্বিক মঙ্গল সাধন করতে হলে দরিদ্র জনগনের মানসিক উন্নতির বিধান আবশ্যক।  দিনরাত শুধু এই ভাবনাই চেপে বসে এই দেশীয়দের মগজ কীভাবে আধুনিক শিক্ষার মোড়কে মুড়িয়ে দেওয়া যায়, হোক না আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান, হোক না আধ্যাত্মিকতা, কোনোটাকে বাদ দিয়ে কোনোটা নয়। প্রথম শ্রেণিতে নল দময়ন্তী ও বেতাল পঞ্চবিংশতি, দ্বিতীয় শ্রেণীতে স্ত্রী শিক্ষা। বাঙালি যদি বাঙলা ভাষার উৎপত্তি ও প্রাকৃতিক ইতিহাস নিয়ে না জানলো, শিক্ষা তো তাহলে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এই কথা ভুলি কেমন করে ছাত্র শিক্ষকদের ভালোবাসা আমার মানসিক জগতকেই পাল্টে দিয়েছে একটু একটু করে। ১৮৪২ সালে ইউরোপ যাত্রা করার সময় ওরা দেশীয় কারিগরের তৈরি দোয়াত ও মানপত্র দিয়েছিল, সঙ্গে দুর্ভিক্ষ কবলিত আয়ারল্যান্ডবাসীদের সাহায্যের জন্য এই স্কুল, আলিপুর ও আগরপাড়ার চার্চের পক্ষ থেকে ১১০ টাকা চাঁদা তুলে দিয়েছিল। কোথায় যাবো, কেমন করে যাবো ভাবতে গিয়েই কে যেন আমাকে বারবার ভেতরে নাড়িয়ে দিয়ে বলছে, আগে তো সকল মানুষ নিজেকে জানতে বুঝতে শিখুক, তফাত যত খুঁজবে, তত বেড়ে যাবে দূরত্ব।  আমাকে অনেকদূর যেতে হবে, মানুষের ভিড়ে মিশে যেতে হবে। মানুষের কান্নার শব্দ আমার বুকে বড় বাজে। পরাধীনতার শিকল আমার দেশের মানুষও গলায় পড়ে আছে। সেই শেকল ভাঙার গান ওরাও মনে মনে গাইছে। দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে আমেরিকায়। এই যন্ত্রণা গেঁথে আছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নিজেকে তাই কি  উজাড় করে দিতে চাই, খুঁজে পেতে চাই এই হতদরিদ্র মানুষের দুঃখ কষ্ট বেদনায়। এমিলি ওরমেকে হারাই আমি ত্রিশ বৎসর বয়সে ১৮৪৭ সনে, লন্ডন থেকে কলকাতা ফেরার পথে সামুদ্রিক রোগে সে মারা গেছে শুনে আমার মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ল। বুঝলাম, নিয়তি যতই আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে খেলা করুক, তাকে জবাব দেবার মতো নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হবে। জমি জলা বুজিয়ে মাটির বাড়ি থেকেই চলবে আমি যা কিছু করা জরুরি মনে করছি। আমি যখন পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে বেড়াই কে কোথায় কেমন আছে, কী কী আমাকে করে ফেলতে হবে, কত প্রশ্নই তো মনের ভেতর উড়ে এসে জুড়ে বসে।  তবে এটা বুঝলাম মানুষের অজ্ঞতাই মানুষকে কুসংস্কারের বন্ধনে জড়িয়ে রেখেছে। তবে কিনা ওদের অভিজ্ঞতার বহর আর অর্জিত জ্ঞানের মধ্যেই রয়েছে এমন মণিমুক্তা যা ইউরোপীয়দের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় শুধু নিয়ম নিষ্ঠার মধ্যে মিশিয়ে দিতে হবে। কতটুকু প্রাপ্তি কতটুকু অপ্রাপ্তি সে কথা না হয় পরে ভাবা যাবে। এখানে এসে যখন দেখলাম মহামারি গ্ৰাম থেকে গ্ৰাম উজাড় করে দিচ্ছে, চিকিৎসক নেই, ঔষধ নেই, উপায় জানানোর মানুষ নেই। মনে হলো মানুষ গুলোর কী হবে। সরকার তো চোখে পট্টি পড়ে আছে। এদের চেনা বিষয়ই জানার দরজাগুলো এক এক করে খুলে দেবে।  মানুষগুলোকে আত্মীয়তার বন্ধনে জড়িয়ে ফেলতে হবে, না হলে এক এক করে রাস্তাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে, অন্ধকারে পথ চলতে চলতে কখন যে হোঁচট খাবে কে জানে। নতুন কিছু গ্ৰহণের মধ্যে বাহাদুরি আছে, সমঝোতা চলে না। সরকারের বাহাদুরের ইচ্ছে আছে কিন্তু অভিসন্ধি কম আছে, একথা কেমন করে বলি। এদেশীয়দের সাধারণেরা গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে, ঢাকঢোল পিটিয়ে জাগিয়ে তুলতে হবে। আমার ভাবনা চিন্তাগুলো আসে আর যায়, কিন্তু কেমন ভাবে ধরলে এরা কমপক্ষে এটা ভাববে না, আমি ওদের শত্রুপক্ষের লোক নই। ঝড়ঝঞ্জায় মাথার উপর টালির ছাদখানা ভেঙেচুরে যায়, দুবেলা দুমুঠো ভাত জোটে না, মহাজনের কাছে দেনার দায়ে গলা পর্যন্ত ডুবে আছে, কন্যাদায়গ্ৰস্ত পিতার যে জ্বালা, সমাজ কর্তাদের সমূহ নিদানে মাথা তুলে দাঁড়ানোর মাটি আলগা হয়ে আছে, ওদের কেমন করে বলি আমার ডাকে সাড়া দাও। নিজেকে ভিন্ন সারিতে বসালে মনে হয় ফাঁকিটা এড়ানো তো যাবেই না, বরঞ্চ দিনে দিনে ওরা আরও দূরে সরে যাবে। 

    মির্জাপুর স্কুল নিয়ে জড়িয়ে থাকলে এই দেশের মানুষদের খোঁজ পাওয়া সহজ হবে না। মানুষের মুখগুলো যেখানে আড়ালে পড়ে আছে, তাঁদের খুঁজে পেতে সামনে এনে হাজির করতে হবে। ওদের কুড়েঘরের অন্দরে ঢুকে জানতে হবে মনের কথা। আমি এটা বুঝতে পারি কী সাহেবসুবোরা কী এদেশীয় বাবুরা নিজেদের মৌজমস্তিতেই এমন মেতে আছে, ফিরে যে তাকাবে সেই দায় দায়িত্ব কোনোটাই নেই। অথচ আমার যে প্রাণ কাঁদে এটা কিন্তু মিথ্যা নয়। দু-একজন যারা খ্রিস্টান হয়েছে চাষাভুষা লোক ওরা মনের আনন্দে আমার কাজ করে দেয়, সুখঃদুখের অংশীদার হয় আত্মীয়র মতো। ওদের  কোন ঘরদোরে আমার পা পড়লে ধন্য ধন্য করে। বলে, ‘বাবু গরীবের ঘরে আপনার মতো গুণী লোকের পা পড়েছে, আমাদের জাতের বড়বাবুরা তো ফিরেও তাকায় না, উঁচু জাতের মানুষরা ছুঁয়ে ফেললে বলে, ‘তোদের শরীরে ছোটো জাতের গায়ের গন্ধ, তফাত যা।’ কথাটা যে ফেলনার নয়, নিজের দেশের লোকেদের জীবন থেকেই টের পাই। ওদের কথার ভঙ্গিতে কত যে চালচলনের ভাবসাব ফুটে বের হয়, বলার কেউ নেই, ধরার কেউ নেই, খালি নিন্দে মন্দ, খুঁত খুঁজে বেড়ানো, সময় সুযোগ পেলে গাঁ ছাড়া করে জমিজমা কেড়ে নিতে পারলে মনের সুখ। ওদের ফাটাফুটা শুকনো মুখগুলো কবে তরতাজা হবে, কেউ জানে না, অস্তিত্ব আছে কি নেই, চিন্তাতেও ঠাঁই হয় না। ওরা মাথা নিচু করে দয়ার পাত্র হয়ে দোরে দোরে ঘুরে মরে। ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দুমুঠো জোগাড় করতে পারলে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়, আর না হয় আধপেটা খেয়ে অপেক্ষায় থাকে কখন সকাল হবে, সকলের লাথিঝাঁটা কপালে জুটবে। আমি ভাবি, ওরা কি নিজেকেও নিজে একবারের জন্য প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে না, কেন ওদের এমন দশা হলো, কেমন করে হলো, কাদের জন্য এমন পরিণতি  – কে দেবে এর উত্তর? আমি পাদ্রী লঙ এদেশের মাটিতে পা রেখেছি, এখানকার ধুলো-বালি-ছাই গায়ে মাখছি, এই সবের পেছনে আছে কোনও ইঙ্গিত না কি সবটাই  নিছক ঘটনাক্রম? প্রশ্ন আমার আছে, হাজারো প্রশ্ন। প্রশ্ন জাগে আমার এখন কি করা কর্তব্য, মানুষগুলোর ধর্মবিশ্বাস ও আচার নিষ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করব, নাকি ওদের ইচ্ছা অনিচ্ছা গুলো নিয়ে কাটাছেঁড়া করব। এই এক অদ্ভুত পৃথিবী! বিচ্ছিন্ন দ্বীপে কারা যেন ঘুমিয়ে আছে, চোখের কোলে শত শত বছরের ঘুমের ঘোরে অল্পস্বল্প আলোর মায়া এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে এক এক করে, হয়তো কোনোদিন মিলে যাবে, না হয় নিজের কথাগুলো নিজেরাই বলে থেমে যাবে, কেউ শুনলো কি শুনলো না কী আসবে যাবে! 

    কথা আসবে, কথা থেমে যাবে, কথার প্রতিধ্বনি হয়ে ভেসে বেড়াবে দূর থেকে আরও দূরে, একদিন পৌঁছে যাবে অন্য কারও কানে, নিজেরা পুষ্ট হবে, অন্যদেরও চিনিয়ে দেবে কেমন করে পৃথিবীর দায়ভার বয়ে বেড়াতে হয়। আমার কাছে ওরা যখন জানতে চাইল, আমার পথ কী? কোন পথ দিয়ে হাঁটলে আমরা আমাদের বাড়ির দরজায় পৌঁছে যাব, বলতে পারবেন কী? নিশ্চুপ ছিলাম, নিশ্চিন্ত হয়ে বলতে চাইলাম আমিও এই পথ খুঁজব বলেই অত সমুদ্রের জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেছি। ওরা আমার কথা বিশ্বাস করলে কি করল না, এই দায়ভার আমার নয়, শুধু উচ্চারণই করতে পারি আমি।  রোগা, শুকনো, প্যাকাটে মানুষগুলো ইতস্তত এপাশ থেকে ওপাশে ঘুরে বেড়ায়, মাঝে মাঝে এসে চণ্ডীমন্ডপের দাওয়ায় এসে খোশ গপ্প করে। এরা আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকায়, টিপ্পনী কাটে, যা মনে খুশি পায়, তাই বলে – কী সাহেব-বাবা, আমাদের দেখে কেমন লাগছে? তোমার দেশের লোক আর আমাদের লোকের তফাতটা কী কিছু বুঝতে পারলে? বললাম, এ-ও বুঝলে না, এত সহজে কী কেউ ধরা দেয়! ‘আচ্ছা, আমাদেরকে জানা-বোঝার তোমাদের এত সাধ কেন? কালাপানি পার করে এয়েছ দেশের লোকের ধম্ম পাল্টাতে। ধন্য বাপু তোমাদেরকে, চেষ্টা-চরিত্র করে দেখ দলে ভেড়াতে পার কিনা।’ এটা বুঝতে অসুবিধে হলো না, মানুষগুলোর কথাগুলো ফেলনার নয়, একটা গভীর মর্মকথা আর ব্যথা দুটোই যেন গুমড়ে মরছে। কলিকাতার শহরের বাবুলোকেরা শেকস্‌পিয়র ও বেকন নিয়ে তর্জমা করে বটে, কিন্তু এদের অস্থিমজ্জায় বয়ে চলেছে কথার পরে কথায় হাজার হাজার বছরের অভিজ্ঞতার ফসল। এদেরকে এইভাবে মেলাতে চাইলে সে-ও এক বড় রকমের মূর্খামি, বরঞ্চ বেশি ভালো হয় যদি কোনও কারিকুরিতে এদের ভাব-ভাবনাগুলো নিজেদের সঙ্গে একই পাল্লায় দাঁড় করানো যায়। ওরা কী বুঝল না, বুঝলাম না। ওদের অট্টহাসিতে ঘরবাড়ি গাছপালা সবকিছু যেন কথা বলে উঠল – সাহেব-বাবা কেমন জব্দ হলো! নিজেকে এমন দশায় দেখব কস্মিনকালেও তো ভাবিনি। এই দেশটাকে আমি আজব দেশ বলি কী করে, তবে এমন এক অদ্ভুত দেশ, যে দেশের মানুষ নিজেকে নিয়ে কেমন উদাসীন থেকেছে, কে এল আর কে গেল এই নিয়েই মাথা গলায় নি। কেউ এদেরকে চিনেও নি, চিনতেও চায় নি। ওই মুহূর্তে আমার এতকালের শিক্ষা বিদ্যে বুদ্ধি যেন ধুলোয় মিশে যেতে চাইল।  বুঝতে চেষ্টা করলাম এই বঙ্গদেশের আকাশে বাতাসে এমন কী জাদু আছে, যেই এই দেশে আসে, খালি মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে দেখে কোথাও সোনা হিরে জহরত মিলে কিনা। ওরা তো বলেই খালাস ‘কী সাহেব-বাবা পেলে কিছু, পাবেও না, কোনও কালেও পাবে না, এমনিতে পাওয়া যায় না, আর একটু ডুব দাও, তাল পুকুরের জল গায়ে লাগুক, সব কালিঝুলি ধুয়ে মুছে যাবে, তবে যদি দেখা মেলে।’

মানুষ হওয়া কি মুখের কথা

নিজের ছায়াটা আজকাল কেমন অগোছালো হয়ে মাঝে মাঝেই এসে হাজির হয়। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করি ভুল দেখছি না তো! না কোনো অন্য অনেকের ছায়া আমার ছায়ায় জড়িয়ে গিয়ে আমাকে পাল্টে দিচ্ছে। এখানে কত পুকুর, পাড়ে বাঁধানো ঘাট, জল টলমল করে এসে মিলে যায়। আমি আমার ভাবনাগুলো যেমন ছুঁতে পারি না, ধরে রাখতে পারি না। ছোট ছোট ঢেউগুলো নিজের মতোই আমার সঙ্গে মিশে যায়। অনেক কিছুই আমাকে গ্ৰাস করে কখনও দূরে ঠেলে দেয়, নিজের খুশিমতো কাছে টেনে নেয়। নিজের ঘর, জানালা, দরজায়  ঠকঠক করে , কখনও ঝাঁকুনি দেয়, কখনও থরথর করে কাঁপে। সেই ঝাঁকুনির আবার রকমফের আছে। কখনও এত জোরে যার ধাক্কায় আমি অস্থির হয়ে পড়ি, বিপন্ন হয়ে পায়চারি করি। হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা যে নেই একথা কি কেউ বলতে পারে? শিক্ষার বীজ পুঁতে দিলে আজ না হয় কাল চেতনা জাগবে,  হলফ করে বলা যায়। মার্শম্যানের বাংলার ইতিহাস ও পাঠশালা, লঙ লসনের প্রাণীবৃত্তান্ত এবং শ্যামাচরণের বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে ছাত্রদের আগ্ৰহ যেন আপনা আপনিই কয়েক গুণ বেড়েই চলে। প্রশ্নের পর প্রশ্নের উত্তরগুলো ঠোঁটের ডগায় লেগে থাকে –  ‘ফাদার, ইতিহাসের জীবন আর জীবনের ইতিহাস এই দুয়ের মধ্যে কোনো তফাত আছে কি?’ প্রশ্নটা শুনে ঘাবড়ে তো গেলাম, আবার খানিকটা বিস্মিতও হলাম। বললাম,  সহজ উত্তর হলো জীবনের মাঝে ইতিহাস খুঁজতে যেওনা, ইতিহাসের জীবনে পূর্ণতা নেই, যা কিছু শুনছ, বুঝছ সবটাই আংশিক। ওরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। ‘তবে আর একটা প্রশ্ন করি ফাদার?’ প্রশ্নের উৎপত্তির খেলায় নিজেকে খুঁজে পাওয়া সোজা খেলা নয়। ওদের মুখগুলো দেখি আর ভাবি আমার শৈশবের নদীর শোভা আর গঙ্গার মোহময়ী রূপ দুটোই আলাদা আলাদা ঢঙে কথা বলে। এই বুঝি ধরে ফেলি, আবার এলোমেলো হয়ে হারিয়ে যায় কোন গর্ভে কী জানি। কত যে মানুষ আসে, কত যে মানুষ যায়, মনের কথা বলে সময়মতো আবার অসময়ে জানান দিলে বুঝে ফেলি – অন্ধকারটা যতটা কাছের ভেবেছিলাম, ততটা নয়। দিনের আলো যখন মাটির ধুলিকণায় এসে আত্মীয়তা পাতায়। আমি গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলে, অনেকেই পেছনে এসে পায়ে পা মেলায়। আমি থেমে গেলে ভাবে এই বুঝি কাদা মাখানো আঙুলগুলোর ফাঁক দিয়ে ফুরুত করে ছড়িয়ে পড়ে থকথকে ধুলিকণা। ঘরের মাঝে মেয়েরা ঘরের জানালা দরজা বন্ধ করে পড়ে থাকে, আঁচল টেনে ঘোমটা মাথায় দিয়ে পর-পুরুষের সামনে আসে। ওরা কী এঁদো পুকুরের কচুরিপানার মতো ভেসে ভেসে বেড়ায়, বিন্দু বিন্দু সময়ের ফাঁকতালে ঘুরে ঘুরে মরে। ওরা বলে, এমন আজব দুনিয়া জন্মে দেখে নি। যদিওবা কালেভদ্রে কোনো মানুষ এলো আর গেলো ওদের এত মাথাব্যথা নেই। ছায়ারা যখন বসে বসে খেলা করে, একদল জিপসি মেয়েরা ছুটে ছুটে আসে।  ওরা স্কুলবাড়ির জানালার দিকে হাত নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘সাহেব- বাবা আপনার কিছু দরকার নেই?’ আছে মা আছে, যত পথ পার হবো, তত পথে আছে। ‘এত রঙ বেরঙের পাথর, গয়নাগাটি, কোনটা চাই।’ এত বাছবিচারে কাজ নেই, যাতে তোমাদের মন ভরে, তাই দাও। ‘বারে বা, তুমি হলে খরিদ্দার, আমরা হলাম দোকানদার, তোমার পছন্দ অপছন্দ থাকবে না!’ বাছাবাছিতে কাজ নেই, না হয় পরে ঘষে মেজে নেব। হারজিৎ-এর কথা বলছ, সে ভাবনা আমার নয়, অন্যজনের। ‘তোমার কথায় আমরা কোনো কুলকিনারা পাই না গো।’ কত তো শনের ঘর, গোবর লেপানো পাটকাঠির বেড়া। মাথা নিচু করে ডানে বাঁয়ে উপরনিচ করে ছায়াগুলো মাথা খুঁড়ে মরছে – কে আর কাকে দেখে। আমার দেখার ফাঁকফোকরে রয়েছে কত অকল্পনীয় কথা চালাচালি, কে কার কথা শোনে! শোনাবো বলেই তো এত ব্যস্ততা, এত আকুতি। এত বলার কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেশুনে নেওয়া।  

    শ্রেণীকক্ষে এদেশীয় ছাত্ররা বাইবেলের গসপেলের কিয়দংশ মুখস্ত বলা দেখে আমি যেন দিবাস্বপ্ন দেখি। কল্পনার জাল বুনতে বুনতে চলি। চারপাশে কিছু পাঠশালার পণ্ডিতেরা জ্ঞানের আলো ছড়ানোকে শুধুমাত্র ধর্মীয় শৃঙ্খলায় বেঁধে ফেলছে দেখে মনে হয় এই সীমাবদ্ধতা অপূরণীয় ক্ষতি। মুক্ত বাতাস চাই, খোলা বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়া চাই, না হলে সমাজের অন্দরে যেই বিষবাষ্প ছড়িয়ে রয়েছে, তার থেকে বের করে আনবে কার সাধ্য। তাহলে কী ধরে নেব, কোথাও না কোথাও ছড়িয়ে রয়েছে যেখানে নিজেকে অতিক্রম না করার স্পৃহা প্রবল হয়ে ওঠে। কত বিষয় না ভাবিয়ে তোলে, মনে হয় সব কিছু উজার করে দিয়ে পুষ্ট করে তুলি, ওদের চিন্তাগুলো এলোমেলো হয়ে যখন ঘোরাফেরা করে এবার বোধ হয় আর নিশ্চুপ থাকা চলে না, ওদের পরিতৃপ্ত না করলেই যে নয়। ঘুরপথে পাক খেতে খেতে যদি কোথাও ঢুঁ মারে তখন তো ঘোর বিপদ। দূর গ্ৰাম থেকে এক ঘরামি ছুটে ছুটে আসে। প্রাণ আকুল করা চোখের জলে ইনিয়ে বিনিয়ে বলেই চলে নানা কথা। বলে ‘বলতে পারেন সাহেব-বাবা সংসারে মাঠে ঘাটে কাম করা লোকের কোনো মান-সম্মান কেন  নাই?’ কেন কে তোমায় অপমান করল? ‘বাবুর বাড়ির গোমস্তা এসে যা নয় তাই বলে গেল। বলল, শালার বেটা শালা বাবুর বাড়ির কাজের চেয়ে তোর কোন কাজটা বড় হলো। বড্ড লেজ গজিয়েছে, দেখাচ্ছি মজা।’ ধনীদের এমন লাথি ঝাঁটা মারা কম তো দেখি নি। ‘সাহেব-বাবা ওরা আমার ঘরবাড়ি তছনচ করে দিয়ে চলে গেল।’ কী আর করব, হাতে দু-আনা পয়সা দিয়ে বললাম এই নিয়ে কাজ চালিয়ে নিও। মামলা লড়তে গেলে সর্বস্বান্ত হবে, এবারের মতো মানিয়ে গুছিয়ে নাও। এমন দিন আসবে, তোমার মনের কথাগুলো অনেকের মনের কথা হয়ে যাবে। মানুষটা কী যে বুঝল কি জানি কিন্তু এক আত্মবিশ্বাস ওর চোখেমুখের আদলটাকে এমন ভাবে পাল্টে দিল, একটু আগের দেখা জুবুথুবু হওয়া মানুষটা এখন ভিন্ন মানুষ। যে সময়টা ওকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল কোথায় যেন নিমেষে উবে গেছে। আমি নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওর নিজের জায়গায় বসালাম।

    বিদ্যাসাগর ও কেশব সেনদের চিন্তার শরিক হয়ে আমি একসময় বুঝলাম আমার এদেশে আগমনের হেতুটা গৌণ হয়ে যাচ্ছে, আরও কত যে ফুটিফাটা আছে, যে জানবার সেই জানে। । এই নিয়ে অন্যান্য পাদ্রীদের কটুক্তি যে আমার কানে আসে না এমন নয়। রাজার নিয়ম রাজা মেনে চলে তাতে করে কত মানুষের কত কিছু বাড়ে, আবার পিছল খেতেও সময় লাগে না। উলুখাগড়ারা নিজেরা বুঝতেও পারে না কে কোথায় দাঁড়িয়ে। না, সমাজের চোখে কালি পড়েছে, এমন সহজ সিন্ধান্তে কেই-বা আসা যাওয়া করে। ইংরেজদের কাছে জবাবদিহি করতে হয় না, এটা কেমন করে বলি। ওদের ঘর-দূয়ারে আমাকে আসন পেতে বসতে বলে। অভাব-অভিযোগের পাহাড় জমেছে, সকল কিছু জানা-বোঝার বাইরে। কম বয়সী বৌঝিরা শুধু হুকুম তামিল করে, নিজের মতো করে পা ফেলতে ওদের যত সংকোচ। মন দিয়ে ঘর সংসার করে ছেলেপুলে পালতেই ওদের দিন যায়, রাত ফুরায়। পুরুষদের অনুমতি নিয়ে কথা চালাচালিতে কখন যে আপন পরের সীমানা ঘুচে যায়, সে আর কে বলবে। ওরা নিজেদের মধ্যেই বলাবলি করে – মানুষটাকে দেখলে দেবদূত মনে হয়। মানুষ যে দেবতার আসনে বসতে পারে ওদের মনের হদিস না পেলে আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব হতো না। ওরা কত সহজেই না পর্দা সরিয়ে ঘোমটার আড়াল থেকে আকার ইঙ্গিতে বোঝাতে চায় – পৃথিবীর সব দেশের মেয়েরা অন্দরমহল ছেড়ে সংসারের বাঁধাধরা কাজের বাইরে হাত বাড়ায় কিনা। ওরা ঘরের কাজে সিদ্ধহস্ত, যাবতীয় পুণ্য অর্জনের দায়ভার নিজের কাঁধে নিয়ে বিনা শর্তে ওরা পুরুষদের নিষ্কৃতি দেয়। আমার কথার জবাবে ওরা অবলীলায় বলে ফেলে, ‘এতো সহজ সরল প্রশ্নের উত্তর এত কঠিন করে বললে ধাঁধার মতো মনে হয়।’ কথায় কথায় ওরা ‘জয় নিতাই’, ‘জয় গুরু’ বলে নিজেদের আত্মার ও মনের শান্তি কামনা করে। জীবনের হিসেবটা এভাবে করলে কেমন হয়, মাঝে মাঝেই আমি নিজের কাছে রাখি, জবাব পাই না। জবাব দেবেই বা কে? জবাব দেবার মতো উপযুক্ত মানুষ কোথায়? ওরা অনেক দূরের মানুষ, ধরাছোঁয়ার বাইরে। কেমন করে থাকে, কেমন করে শোয়, কেমন করে কথার পিঠে কথা বলে, এই কল্পনা স্বপ্নেও আসে না। ‘সাহেব-বাবা, আপনি এমন করে পথেঘাটে ঘুরে ঘুরে কীসের নেশায় মেতে থাকেন?’ বললাম, নিজেকে খুঁজি। নিজেকে মিলিয়ে দেখি, আর কতদূর এগোলে এই দেশের মানুষরা অপর দেশের মানুষের ছুঁয়ে ফেলবে। ‘ছুঁলেই-বা কী হবে, না ছুঁলেই বা কোন মহাভারত অশুদ্ধ হবে!’ সত্যি বলতে কি এই-প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। তবে এমন প্রশ্নের উত্তর জানা আছে, যা তোমার কোনও কাজে লাগবে না। এই পৃথিবীতে এমন অনেক জায়গা আছে, অন্ধকাররা সেখানে জাঁকিয়ে বসে আছে। ‘আমাকে দেখাতে পারেন সেই জায়গা?’ অবশ্যই পারি। দিনের আলোতেই সেইসব স্বচ্ছন্দে ঘোরাফেরা করে। ‘সাহেব-বাবা, আপনি তো সহজ মানুষ নয়!’ লোকে তাই তো আমাকে বলে, সুযোগ পেলেই  তাড়া করে বেড়ায়।

হ্যালহেডের কথা ভোলা যাবে না, আমি ‘এ গ্ৰামার অফ দ্যা বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’ পড়েছি – ‘বাংলা ভাষার শব্দ গৌরব অসীম। বাংলা ভাষায় সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাসাদি যে কোন বিষয় রচিত হতে পারে। কিন্তু বাঙালিরা এ বিষয়ে যত্নশীল নন।’ নতুন উদ্যমে কাজ করতে হবে, নতুন বাতাস ছড়িয়ে দিতে হবে। কোন নির্দিষ্ট গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ করে রাখা সমীচিন হবে না, প্রত্যেকের ভালো লাগাকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। বাঙালির রীতিপ্রকৃতি ও ভাষাজ্ঞানও প্রশংসনীয়। নতুন নতুন উপায়ে আরও ছাত্রদের আকৃষ্ট করতে হবে। কথাটা যে ফেলনার নয়, বলেছিল, ‘সাহেব-বাবা তোমাদের আগ্ৰহের কারণটা তো বুঝলাম না, আমাদের মূর্খ বানিয়ে রাখলেই তো তোমাদের লাভ, নাকি গোপন কোনও বাসনা আছে?’ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আমি প্রস্তুত ছিলাম না। তবে একথা ঠিক যারা জবরদখল করার ইচ্ছা নিয়ে পরের দেশ দখল করে রাখে সে দেশের মানুষের মঙ্গল কামনা করবে এই কথাটা মানতে প্রথমেই রাজি হবে না, প্রয়োজনে শূলে ছড়াবে, গাছে তুলে মই কাড়বে, এর বেশি এক পা-ও এগোবে না। কিন্তু গোড়ায় গলদ থাকলে মানুষ চেনা সহজ হবে না।  এত সময় তো পার হয়ে গেল, মানুষগুলো যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেল। অচেনা মুখগুলো চেনা তো হলোই না, ওদের কথা তো ভাবলই না, আরও দূরে ঠেলে দিল। কাকগুলো যেমন ডালে বসে কা কা করে ডাকে, কেন ডাকে নিজেও জানে না, এই দেশের মানুষরা দিনরাত শুধু ডেকেই চলে, কেমন করে ডাকলে অন্যরা সাড়া দেবে কে জানে। আমার জানা যে ছিল কী করে বলি, তবুও মনে হলো, ওদের কথাগুলো আমার নিজের কথা, ওদের মনের কথা, আমার নিজের কথা। ওরা কেউ আমার ধর্মকে আপন ধর্ম হিসেবে মানলো কিনা, আমি ধর্তব্যের মধ্যে নিলাম না। দুচোখ ভরে দেখতে চাইলাম, কেমন করে ওরা হাঁটে, কেমন করে ওরা থালায় ভাত মেখে মুখে পোরে, কেমন ভঙ্গিতে শব্দগুলো একের মুখ থেকে অন্যের মুখে বসিয়ে দেয়, কেমন সুরে সুর মেলায়।  আমি যখন ওদের ডেকে বলি, দরজা জানালাগুলো খুলে দাও, সূর্যের আলো থমকে দাঁড়িয়ে আছে, আর হাতে একটুও সময় নেই, সকলে কয়েক কদম এগিয়ে গেছে, তোমরা পিছিয়ে পড়েছ, এবার কিন্তু নদীতে ডুবে মরবে। ওরা ঘাড় মটকে ধরলে আর রক্ষা থাকবে না। ওরা আমার কথা গায়ে তো মাখলোই না, ফুৎকারে উড়িয়ে দিল। আসলে এসব কথা আবার কোনো কথার কথা! ওরা বুঝলই না, যেমন চলতে পছন্দ করছিল, তেমনই চলল। ওরা দল বেঁধে এসে কত যে গল্প শোনাল, সেই গল্পে পিতামহ প্রপিতামহের উপদেশ আদেশ নির্দেশ সব ছিল, যে গল্পে ওদের এখনের গল্পগুলো অন্য খাতে বইল, বিল থেকে খালে গেল, কত খাল নদীতে গেল, নদী থেকে সাগরে গেল।

শামুকের খোলস দেখে তার গোটা আকার আকৃতি অনুমান করলে যে কল্পনার জন্ম নেয়, মানুষের ভেতরের মানুষটার রঙ ঢঙ খুঁজে পাওয়াও শরীরের কাঠামো দেখে বুঝে নেওয়া এমনই ভাবের সঞ্চার করে। আমার ভাবনার জগৎ গোড়ায় আমাকে তাড়িয়ে বেড়াত এমন করে এই বুঝি ওদের ধরে ফেলি। চাওয়া আর পাওয়ার মাঝে কত তো ফারাক, জায়গা পাল্টাতে হবে, অনির্দিষ্ট পথের খোঁজে বেরিয়ে পড়তে হবে, সবুজের মেলা বসুক কিংবা নদীতে জোয়ার আসুক, পাড়ে পাড়ে বালির স্তুপে বোঝাই হোক, মানুষের বিষন্নতাকে উপলব্ধিতে চিনে নিতে হবে। কে বা কারা কখন কীভাবে তা দখলে নেবে কে জানে। চেনার মতো করে চিনে নিতে হবে। আমি জানাতে চেয়েছিলাম যে মানুষগুলো ঘুমিয়ে আছে, ওদের ধাক্কা মারতে হবে আরও জোরে। ওরা ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে হাঁটছিল, ভাবছিল এমন অভিভাবকহীন ব্যবস্থায় কেউ কারও সঙ্গে কথা বলবে না, নির্জীব হয়ে ভাববে যে যার মতো খেলছে খেলুক, তাতে কার কী আসে যায়। কথাটা যে ষোলো আনা ভুল এই কথাটা মর্মে মর্মে জেনে নিতে একটু সময় নিয়েছিলাম। ওরাও সময় চেয়েছিল, আমিও সময় চেয়েছিলাম। ওদের তুলসী মণ্ডপ, মন্দিরের চারপাশে হরি সংকীর্তনে বুঁদ হয়ে গেলে ওরা আসন পেতে বসাল, ওদের চোখ দিয়ে জল গড়াল, আমার চোখও ভিজে উঠল। কেন ভিজে উঠল, এর জবাব দেবার মতো লোক আমার স্বজাতিতে জন্ম হয় নি। নিজেরা জ্ঞানী পুরুষ বলে গর্ব করে, সারা পৃথিবীতে আলো ছড়াবার ঠিকাদারি যেন ওদের একার। ‘জানার কথাগুলো বাবা ছড়ানো রয়েছে, এত উন্নাসিকতা থাকলে আধপেটা খাওয়া মানুষগুলোর চাওয়া-পাওয়াকে হজম করা যাবে না।’ গুরুমশাইর পাঠক্রম বুঝতে সময় লেগেছিল, পরে বুঝলাম যতটা সহজে নিয়েছিলাম, ততটা সহজপাচ্য নয়। এঁদের জ্ঞান বিলোবার নির্দিষ্ট একটা পদ্ধতি আছে, ওদের ভাবভঙ্গি রপ্ত করতে হলে সময়কে কাটাছেঁড়া করতে হবে। প্রবেশদ্বার এর খোঁজ পেলে শুধু চলবে না, নির্গমনের পথটাও আগেভাগেই জেনে নিতে হবে। ঝরের তাণ্ডবে যেদিন সবকিছু ভেঙে চুরমার হলো, আমার ঘরটাও উল্টে পড়ল। তড়িঘড়ি ওরা আমার ঘরটাকে দাঁড় করিয়ে দিল, নিজের ঘরের খুঁটি ভেঙেচুরে পড়ে আছে। শিক্ষা কাকে বলে এই সংজ্ঞাটা একসূত্রে গেঁথে দিলে চলে না বোধহয় তাই।

এটা এমন এক অদ্ভুত সময় যখন ডঃ আলেকজান্ডার ডাভ নির্দেশিত পথই চোখ খুলে দিল। ওরিয়েন্টালিস্ট দলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জেনারেল এসেম্বলি ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠা করলেন যাতে দেশীয়রা ইউরোপীয় জ্ঞান ও বিজ্ঞান শিখতে পারে, মিশনারীদের বললেন  খ্রীষ্টের বাণী ছড়িয়ে দিতে। চার্চ মিশনের অন্যান্যদের মতো হেয়ার সাহেবকে সমালোচনা করতে আমার মন চাইল না। আমার মনে হলো তাঁর কথার সারবত্তা আছে। মানুষের চাহিদার সঙ্গে কোথাও যেন সামঞ্জস্য ছিল। ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, ‘মানুষকে ভালোবাসতে হবে, দ্বন্দ্ব ও জড়তা থেকে মুক্তির একমাত্র সোপান হলো যুক্তিবাদকে প্রতিষ্ঠা করা।’ ইউরোপীয় জ্ঞান বিজ্ঞানের নির্যাস বিদ্যাসাগরের চিন্তা ও চেতনায় ঢেউ খেলে গেল। অক্ষয়কুমার দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র. রামতনু লাহিড়ী, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শিবনাথ শাস্ত্রীরা চাইলেন মরা গাঙে বান আসুক, না হলে সমূহ সর্বনাশ। কথায় ও কাজে বুঝলাম সময় এসেছে, এখন শুধুমাত্র ইংরেজদের রীতি রেওয়াজ আর ইচ্ছেগুলো সমাজের উপর চাপিয়ে দিলে চলবে না, একটা বিপরীত ধারা বইতে শুরু করেছে। এঁদের মতো আরও  সমাজের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপচারিতায়,সভা সমিতিতে ও ঘরোয়া আড্ডায় নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ত্রুটি বিচ্যুতির কথা জোর গলায় আমি শুনতে লাগলাম। মতের বেমিলের চেয়েও মিলটা আমি খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছি। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর কাব্যে জায়গা দিলেন এমন সব চরিত্রকে, যা আম মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। একটা আশঙ্কা যে ছিল না সেটা কেমন করে বলবো। একটা নির্দিষ্ট গণ্ডিতেই সবকিছু যেন ঘোরাফেরা করছে অবলীলাক্রমে। বুঝলাম এমন হাঁসফাঁস অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, না হলে কাজের কাজ কিছুই হবে না, সব নিয়মকানুন এক সময় মুখ থুবড়ে পড়বে। এক পাঠশালার হেডমাস্টার মশাই আমাকে রীতিমত গালমন্দ করেন। আমি তাঁকে বললাম, শুনুন ছাত্রদের মধ্যে যাবতীয় অলসতা যাতে জন্ম না নেয়, সেই দিকে নজর দিতে হবে, উগ্ৰ চিন্তাকে প্রশ্রয় দেয়া চলবে না। তিনি স্বীকার করলেন আমার যুক্তির কাছে হার মেনে আবার খানিকটা নিমরাজিও হলেন। আমি মাথা নত করে বললাম, ছাত্ররাই সমাজকে ধরে রাখে, এগিয়ে যাওয়ার দরজাগুলো খুলতে খুলতে যায়। কেবল পাঠ করবে, বিচার করবে না, বিতর্ক করবে না, তার কখনও হয়! বিদ্যাসাগর মশাই আমার ভাবনাচিন্তাকে সাধুবাদ জানালেন। বাঙলা গদ্যের ধারক বাহক তো বটেই, মেয়েদের পড়াশোনার কথা প্রসঙ্গে বলতেন, ‘মেয়েরাই আলো ছড়াবে, নিজেরা আলোকিত না হলে আলো ছড়ানো যায়।’ আমার উপলব্ধিতে তিনি হিউম্যানিস্ট তো বটেই, প্রেম ও মননের আকর্ষন-বিকর্ষণে ব্যাকুল মানুষ। তিনি আমাকে ষোলো বোঝেন ঠিক হয়তো , আমিও কিন্তু তাঁকে ষোলো আনা না হলেও বারো আনা তো বুঝি। এই দেশের কৃষ্টিকে বিশ্বের দরবারে মেলে ধরতে হলে আমার মনে হয়, এই দেশ সম্পর্কে বিদেশিদের ভুলভ্রান্তিকে দূর করা জরুরি। মানুষের অন্তরাত্মাকে চেনাতে হবে, ঘুমিয়ে পড়া মানুষের জাগাতে হবে, তবেই না ভুল ভাঙবে। অভুক্ত হয়ে এইভাবে কী বাঁচা যায়, না বাঁচা সম্ভব। এই পথে আলো না জ্বালালে তো আর চলছে না।

মাঠের কাজ ছেড়ে, পুকুরে জাল না ফেলে, মুটে মজুরের কাজ ফেলে, মাঝি মাল্লারের কাজে না গিয়ে ওরা যে পাঠশালার দিকে ছুটবে, এই কথা কেউ কি কখনও ভেবেছিল! আমার দেশের মাটি আমাকে শিখিয়েছে এই পৃথিবীতে যা কিছু ঘটেছে, ঘটে চলেছে কিংবা ঘটবে, এর কোনোটাই কাকতালীয় নয়, একটা কার্যকারণ সম্পর্ক তো আছে। এই সম্পর্কের গভীরতা না জানলে কোনো কাজই সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করা যাবে না, শুধুই পথ হাতড়ে মরতে হবে, নিট ফল হবে শূন্য। ছাপোষা মানুষগুলোর দিকে শহরের বাবুরা, সাহেবসুবোরা যখন ফিরেও তাকায় না, কেউ এসে একবার জানতেও চায় না ওদের বাঁচতে গেলে কী প্রয়োজন কিম্বা ওরা নিজেরাও জানে না, তা কীভাবে পাওয়া সম্ভব, কার কাছে গিয়ে ওরা ওদের মনের কথা বলবে, নতুবা ভেবে নিয়েছে এটাই পিতৃপুরুষের দেওয়া জীবন, একে বয়ে নিয়ে যেতে হবে শেষের দিকে।  একদিন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম এক চাষীকে তুমি কি জীবনের অর্থ জান? সে তো হেসেই খুন যেন এমন এক আজব কথা শুনল, যা আগে কখনও শোনে নি, শুনবে বলে আশাও করে নি। ওরা যেমন করে চলাফেরায় অভ্যস্ত হয়েছে তেমন করে চলছে। ওদের ভাব ভঙ্গিমায় চরম এক উদাসীনতা আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি ওদের এই পিছিয়ে থাকা নতুন কোনও প্রশ্নের জন্ম দেয় নি। ওদের বলার কথাগুলো গ্ৰামে গ্ৰামে, রাস্তায় রাস্তায় কেবল পিচ্ছিল নরম মাটির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে, হড়কে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রতি পদে পদে। বুঝতে চাইলে তো হলো না, জানা দরকার কোথাকার মাটি ফুঁড়ে কথাগুলো বেরিয়ে আসছে। চাপা পড়ে থেকে কিছু কথা এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় নি তো। আমার অর্জিত বিদ্যার রসে ডুবিয়ে দিলে অর্থটা অন্য কোনো পথ দিয়ে ছুটবে না এরও কী কোনো নিশ্চয়তা আছে?  ধরা ছোঁয়ার বাইরে গেলে ভিন্ন অর্থে যদি বুমেরাং হয়ে ফেরত আসে, তখন কী হবে! মনের অন্দরে চলতে থাকে নানা কাটাকুটি।

ওদের যাওয়া-আসার পথের গরিমা তো বাড়ছে দিনে দিনে।  যে বইগুলো পড়ালেখার জন্য পাঠশালায় পাঠ্য করা হয়েছে, তার সঙ্গে ইতিহাস ভূগোল যোগ হওয়াতে শিক্ষার মান বাড়ে । শহরের ছাত্রদের মনে বিজ্ঞান ভাবনার জোয়ার আসায় ওরা বেজায় খুশি, আশংকার কারণও কম নয়, সব কিছুতেই প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে বসে, গডের অস্তিত্বের কথা উঠে আসলেও কিন্তু কিন্তু করে।  ওদের কথা বলার ঢঙে আত্মবিশ্বাস ছুঁলে চেহারাটা পাল্টে যায়। মিশনারীদের ধর্ম প্রচারের আসল উদ্দেশ্য পিছিয়ে পড়ে। এই নিয়ে একজন অন্যজনকে আড়ালে দোষারোপও করে, পত্র পত্রিকাতে শিরোনামে আসলে ইংল্যান্ডের ধর্মগুরুদের মনেও অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্বের জন্ম দেয়।  কত কথাই না আলোচনার বিষয়বস্তু হয়। আলেকজান্ডার ডাভ অখুশি হয়ে বেছে বেছে সভা সমিতিতে পা রাখেন। ব্যাপারটা যে বাংলার শাসকরা ভালো চোখে দেখছেন না,কথাটা চাউর হয়ে যায়। মোক্ষম প্রশ্নটা হলো বিদেশি শাসকরা এই দেশের মানুষদের শিক্ষিত করবেন কেন, এর কোনো সদুত্তর কেউ দিতে পারে না। কেউ আবার বুঝে শুনেও রাজরোষে পড়ার ভয়ে চুপ মেরে থাকে। মোদ্দা কথা হলো আমাদের দেশের বণিকেরা ব্যবসা আর লাভের অঙ্কের জন্যই এই দেশে এসেছিল। কিন্তু দেশ শাসনের ভূত মাথায় চাপলো বলেই না যত গোলমাল।  মুখের কথায় তো চিড়া ভেজে না। তাই বলে  নিজের ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখবো তা তো হতে পারে না। কথার বিনিময় করার সময় বুঝলাম ওরা তৃষ্ণার্ত পথিকের মতোই অপেক্ষায় ছিল কখন কেউ আসবে আর ওদের প্রশ্নের সঠিক জবাব দিয়ে যাবে। আমাকে পেয়ে ওরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল। এমন মানুষদের যে হাতের কাছে পেয়ে যাব আমার কল্পনাতেও কী ছিল! জীবন কোন পথে যে কখন বাঁক নিয়ে নেয় আগে থেকে অনুমান করা কঠিন হয়। ভাগ্যিস এই দেশের ভাষাকে আপন করে নিতে পেরেছিলাম, তাই তো গ্ৰামে গঞ্জের কোনায় বসবাস করা লোকগুলো আমার এত কাছের হয়ে গেল, এত ভিন্নতা নিয়ে গড়া মানুষটা ওদের বসার ঘরে আসন পেতে বসলাম। এমন তো কখনও ভাবিনি এই আলো বাতাস ধুলোমাটি জল গায়ে মেখে, এত কথার অংশীদার হয়ে ভিন্ন মানুষ হয়ে যাবো।

  পথের আবার কত রঙ

উইলিয়াম কেরি, জোশুয়া মার্শ ম্যান, উইলিয়াম ওয়ার্ড শ্রীরামপুর ত্রয়ীর কর্মযজ্ঞ নিয়ে আমাকে প্রভাবিত করে রাখে সারাক্ষণ। সমাজ সংস্কার, গদ্য পাঠ্য পুস্তকের প্রবর্তকের ভূমিকা, সাপ্তাহিক সংবাদ পত্রিকা ‘সমাচার দর্পণ’ প্রকাশ  সমাজের ভীতকে নাড়িয়ে দিয়েছে, অভিমুখকে ঘুরিয়ে দিয়েছে ভিন্ন খাতে এবং আমার ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নির্ধারণের পথে ওদের চিন্তা চেতনা স্ফূলিঙ্গের মতো হাজির হয়েছে। ভেবে ভেবে অস্থির হই কত কিছুই করা বাকি। কত বাধা বিপত্তি মাকড়সার জালের মতো জড়িয়ে রেখেছে। কাকে জানাবো সেসব কথা।  এগিয়ে যাওয়ার দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়ার লোকের তো অভাব নেই। সকলে যেন খড়্গ হস্ত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কীভাবে দমিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু আমার শিক্ষা আমাকে কিছুতেই পিছিয়ে দিতে দেয় না, কানে কানে বলে অপূর্ণকে পূর্ণ করাই তো প্রজন্মকে উদ্দীপিত করবে, থেমে থাকলে চলবে কেন। কিছু শব্দবন্ধ আমাকে ভাবিয়ে তোলে – ‘হোয়াইট টাউন’ আর ‘ব্ল্যাক টাউন’। আমি নিজেকে নিজে প্রশ্ন করি কথাগুলো কি নিছক বলার জন্যই বলা, নাকি অনেক সময়ের জমে থাকা ঘৃণা বিদ্বেষ, অপমান এই দেয়ালকে মজবুত করেছে। একে ভেঙে চুরমার করে ফেলা এত সহজ কাজ নয়। এমন ভাবনাও মনের মধ্যে উঁকি মারে – সভ্যতাই কি তাহলে সভ্যতার শত্রু!

সাদা শহরের চারদিকে এত কথা, এত যত্ন, এত জিজ্ঞাসা, এত আলোর ছটা। ওরা কি প্রমাণ করতে চায় ওরা কতটা উঁচু, কতটা ভিন্ন, কতটা জ্ঞানী, ওদের রক্তের স্রোত কত দ্রুত বয়ে চলে। হবে হয়তো অন্যকে পেছনে ঠেলে এগিয়ে যাওয়ার অভ্যাস তো  আয়ারল্যান্ডেই দেখেছি, শিখিনি, আত্মস্থও করিনি, শুনেছি কত শব্দের নানা তরঙ্গ, নানা স্বর, নানা অনুভব। কোনটা গ্ৰহণ করব, কোনটা বর্জন করব, এই বোঝার মধ্যে কোনো ফারাক ছিল, না হলে আজও এত দ্বিধা দ্বন্দ্ব কেন? সময় কি সত্যিই মানুষকে কিছু শেখায়, না সংশোধন করে আপন নিয়মে, এই প্রশ্ন আমি করতে চেয়েছি, পারি নি, সংকোচ কাজ করেছে যদি আসল কথাটা চাপা পড়ে যায়। ওরা টগবগ করে ঘোড়া ছুটিয়ে যায়, দাপিয়ে বেড়ায় নিজের সাম্রাজ্যে। এমন দাম্ভিকতা ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে যেন মিলিয়ে যায়। বুঝতে পারি নি আসলে কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যার আড়াল। সাদা শহরের এমন কীর্তি চাক্ষুষ করে বিস্মিত কী হই নি, হয়েছি, চলে এসেছি গলি পথ দিয়ে মোড়ে মোড়ে, এখনও জানতে পারি নি আমি কোন পথ দিয়ে হেঁটে গেলে সকল ধোঁয়াশা কাটিয়ে উঠতে পারবো।

কালো শহরের মানুষগুলোর মুখ যেন আমি ঘুমের মধ্যে দেখতে পাই। কী যন্ত্রণা নিয়ে ওরা বেঁচে আছে। বাঁচার আনন্দ আছে কিনা জানিনা তবে কখন কবে এসে মৃত্যুর কালো ছায়া ওদের গ্ৰাস করবে কী জানি। কারা যেন ওদের পিছু পিছু হেঁটে বেড়ায়, টের পায় না এমন নয়, কুঁকড়ে যায়, ভবিতব্য মনে করে কিছু ঘটনা ঘটার আগেই ছায়াকে মাড়িয়ে দিয়ে চলে যায়। নিজের কাছে নিজের পরাজয় হবে জেনেও নিজেদের ভুবনের ভিন্নতা নিয়ে দেখতে পায় দক্ষিণের মানুষগুলোর ছলচাতুরি কলাকৌশল। বাগবাজার স্ট্রিট, মাছুয়াবাজার স্ট্রিট, বউবাজার স্ট্রিটের হুঁকাবরদার, খানসামা, গোমস্তারা চেয়ে চেয়ে দেখে – ওরা ওদের মতো, ওদের কথা কেন আমাদের কথা হতে যাবে। দিনে দিনে দূরত্বটা বেড়েই চলেছে, তাই তো কথার পিঠে কথা সাজাতে এত অস্থিরতা, এত গোলমাল। কেউ কেউ সীমানা পার করে যেতে চায় না এমন নয়, চোখে সর্ষে ফুল দেখে, মাথা বনবন করে ঘোরে, ভাবে এই আবার কী আজব জগত, ঝাঁ চকচকে বাড়ি ঘর, ঘরের মধ্যে আরও কত ঘর, আসবাবপত্র সাজিয়ে গুছিয়ে দিব্যি আরাম আয়েশে হাত পা ছড়িয়ে আদুরে জীবন। ফিরে যে তাকাবে, এমন কথা উঠছে কেন! বলে তো কত কথা – চুপ মেরে যাও, চোখ তুলে তাকাবার দুঃসাহসটা করো না। ধরতে চাইলেও ধরা যায় না, পিছল খেয়ে হাত ফসকে চলে যায়। এত রঙ চঙ মেখে থাকলে কেই বা কাকে চিনতে পারে! তাই বলে হোয়াইট টাউনে ঢুকে পড়ে না এমন তো নয়। ধমক খেয়ে সুড়সুড় করে পালিয়ে বাঁচে। ওদের খিদমদগারি খাটবে বলেই না মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা।  কোথায় যাবে, কেন যাবে এই প্রশ্নগুলো ঠোঁটের কোণে এসে আটকে যায়।  বাবুলোকদের সেই বালাই নেই, পাখির চোখ করে রেখেছে বলেই না এত সুখ, এত মজা, চুলোয় যাক ওই হাভাতের দল। শিঙ ভেঙে বাছুরের দলে নাম লিখিয়েছে বলেই না এত জৌলুস, না হলে কে আর বেজাতের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে আরাম কেদারায় শরীর দোলায়। ‘ জেলে, দুলে, বাগাদী অজাত কুজাতদের গায়ে গন্ধ, চুলে চুলে জট পাকানো, মুখ ভর্তি দাড়ি গোঁফ, যদি ঢুকে পড়ে, কুকুর লেলিয়ে দিয়ে ব্ল্যাক টাউনের শেষ সীমানায় ঢুকিয়ে দে। থাকুক  না আমাদের তোষামোদি করে, এঁটোকাঁটা খাক, না হলে আমাদের কী তৃপ্তি হয়!’ কথাগুলো গড়গড়িয়ে বলে গেল নব্য বাবুটি।

‘এত আনমনা হয়ে পথ চললে কাজের কাজ কিছু হবে সাহেব-বাবা? আমাদের এখানে এত অন্ধকার, আলোর ছিঁটেফোঁটাও পড়ে না। হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়বেন যে।’ ছাতা-সারাইওয়ালা সুঁচে সুতো ঢোকাতে গিয়েই আমাকে একপ্রকার সাবধান করে দিল। ভাবলাম,কত কিসিমের মানুষ আছে দুনিয়ায়। আমি অনাত্মীয় বিধর্মী বই তো নয় কিন্তু তবুও যেন কতকালের চেনা, না-হলে কোনো হিসেব নিকেশ না করেই কথাগুলো বলে ফেলতে পারল চোখের পলকে। জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি এই শহরের মানুষ? মানুষটা হেসে বলল, ‘আমি এই শহরের মানুষ নই, আপনাকে কে বলল! এতদিন ধরে এই শহরে আছি, এইটুকু বুঝব না।’ পাশাপাশি বসার ইচ্ছাটা দমন করতে পারলাম না। জানতে চাইলাম কেন শব্দগুলো এমন অগোছালো আর টেনে টেনে বলছ, ষোলো আনা বাঙালি। হয়তো আমাকে খুশি করার অদম্য ইচ্ছা পেয়ে বসেছে। নিজের জায়গা থেকে সরে এসে একটু পিছলে গেলে টের পাওয়া যাবে না, এমন একদিন আসবে নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। আমার নীরবতা ওর অস্বস্তির কারণ হলো। ছাতা সারাইয়ের সুঁচ সুতো একপাশে সরিয়ে রেখে ও এবার আলাপ জমাবার চেষ্টা করতে লাগল। কী জানি হয়তো মনে করেছে সাহেব সুবোদের সঙ্গে কথা চালাচালি করলে লোকজন একটু সম্ভ্রমের চোখে দেখবে। ওমা ও তো সম্পর্ক পাতাবে বলে ওর বসার কাঠের পিঁড়িটা আমাকে দিয়ে নিজে পা ছড়িয়ে মাটিতেই বসে পড়ল। এখানে কোথায় যে যান চলাচলের রাস্তা আর কোথায় যে ফুটপাত বোঝা মুশকিল। কী জানি আমার ইচ্ছা হলো আর একটু ওকে ভেতর থেকে জানতে। নিজের কথাগুলো ও যে আমাকে গড়গড় করে বলবে, তার তো কোনো গ্যারান্টি নেই কিন্তু আমার যে না জানলেই নয়। একজন ঝালমুড়ি বিক্রেতা নিজে থেকে নাম ধরে ডাকল, ‘ও সুবোধ খাবে নাকি এক ঠোঙা?  আরে খাও খাও, আপনি বাঁচলে বাপের নাম। খুব যে পাদ্রী বাবাজির লেজুর ধরেছ, মতলব খানা কী? যতই তোষামোদি করে, ওদের পাড়ায় গেলে কিন্তু দূর দূর করে তাড়াবে।’ শুনে তো আমি থ বনে গেলাম। তাহলে এই দেশের সাধারণ মানুষরা আমাদের নিয়ে এমন ধারণাই পোষণ করে! কিন্তু এ-ও আমি জানি  উচ্চ শিক্ষিত বাঙালি বিদ্যাসাগর আর কেশব সেন বাবুদের মন পেলে তো হবে না আমার, এদেরও মনের হদিস আমাকে জানতে হবে। কথা তো ওরা বলে, কেমন ঢঙে ওরা বলে, চলাফেরা করে নিজের মতো, গটগট করে চলে যায়, বিড়বিড় করে আপন মনে ধাপে ধাপে চলে, লাফিয়ে লাফিয়ে এমন করে চলে যেন একজন অন্যজনের ঘাড় মটকে দেবে। 

দূরে, ওই তো আরও দূরে, আমার দৃষ্টি পৌঁছচ্ছে এমন এক স্থানে, উঁচু নিচু আঁকাবাঁকা। কোন পথ দিয়ে এসে আস্তানা গেড়েছে কি জানি।  কেন এই জায়গাকেই বেছে নিল, ওরা নিজেরাও কী জানে। অদ্ভুত লাগল আমার, ইচ্ছে হলো কোথায় যেন নিজেকে মিশিয়ে দিতে পারলে প্রাণ বাঁচে। দেখতে দেখতেই প্রশ্ন জাগছে, কোন পথ দিয়ে হাঁটব, কেমন করে হাঁটব, এই পথ তো আমার চেনা নয়, এই স্থান তো ভিন্ন স্থান, কিন্তু অদ্ভুত সব গন্ধ নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে। এই গন্ধের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে বই কি। হাজার হাজার মাইল দূর থেকে ভেসে আসছে যেন এক ভারী বাতাস আমাকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে, নিজেকে সামলাতে পারছি না। কিন্তু এই দৃশ্য আমি দেখিনি। মানুষের বাসের ঘর  এরকম হতে পারে! হয়তো পারে, জীবনভর চলতে চলতে ওরা শিখে ফেলেছে। দারিদ্র দেখেছি, বাস্তুচ্যুতও হতে দেখেছি, অত্যাচারীদের নৃশংস রূপও দেখেছি কিন্তু এমন দৃশ্য কদাপি দেখিনি কিন্তু দিনের গনগনে রোদের হলকায় কাউকে ভ্যান রিক্সার উপরে পড়ে পড়ে ঘুমোতে দেখিনি। হাঁড় সর্বস্ব রোগা প্যাটকা কালচে শরীরটা নিয়ে দলা মোচড়া হয়ে মশারীর ভেতরে ভোঁস ভোঁস করে পড়ে থাকতে মানুষ পারে! কুকুর যখন রোদের জ্বালায় লকলক করে জিভ নাড়ে, মানুষ কী করে না-মানুষ হয়ে যায়! যত কাছে যাই, মানুষটার চেহারার এক একটা অংশ প্রকট হতে থাকে।  কত ফুসকুড়ি খোস প্যাঁচড়া উদোম গায়ের বুকে পিঠে দগদগে ঘা নিয়ে গোটা শরীর। পথচারীদের বয়েই গেছে ফিরে তাকাতে। একবার দুবার দেখে নিয়ে রাস্তার উল্টো দিকে থু থু করে ঘাড় ঘুরিয়ে মাথার চুল ঝাঁকিয়ে জোরে পা চালিয়ে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।  লোকটা আমায় দেখে পিটপিট করে আবার পাশ ফিরে শুলো। আমি মশারিটা উল্টিয়ে কথা যেই না বলতে যাবো, রে রে করে কোথা থেকে ছুটে এল মাঝবয়সী এক মহিলা। ও যেন আমায় দেখে ভুত দেখল। ‘কী কর কী কর সাহেব বাবা, ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না, ওর ওলাওঠা হয়েছে।’ হতভম্ব হওয়া ছাড়া আর কি কোনো উপায় ছিল! এমন করে রাস্তায় রোগের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, লোকটা মাঝে মাঝে জিভ বের করলে মেয়েটি দোমড়ানো গ্লাস থেকে একটু একটু করে জল মুখে দেয়, ভাবখানা এমন করে প্রাণটুকু বের হতে গিয়ে বোধ হয় থমকে গেল, জীবন থেকে আর একটু সময় কিনে নিল যেন। মেয়েটি থেকে থেকে মশারিটা এমন করে গুঁজে দেয় যেন মশা মাছি গলতে না পারে। দু’একটা বেড়াল ফাঁকতালে মশারির চারপাশে মিঁউ মিঁউ করে। ওর হয়তো কত কিছুই না বলার আছে। দু’একটা ধেঁড়ে ইঁদুর কী মনে করে ফুরুত করে ওপাশের রাধাচূড়া গাছের গোড়া থেকে ভ্যান গাড়ির পেছনে এসে লুকিয়ে পড়ে। 

মানুষদের কেন যে ওদের এত ভয়! টানা রিকশাটা ঠনঠন আওয়াজ করে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে গেল। মানুষটাকে চেনা চেনা লাগছে, কোথায় যেন দেখেছি, মনে করার চেষ্টা তো করলাম। তবে কিনা পোশাক আশাকে এইটুকু নিশ্চিত হলাম উনি ব্ল্যাক টাউনেরই বাসিন্দা। আগ বাড়িয়েই বলল, ‘ চিনতে পারলেন না বুঝি। তা পারবেনই বা কেন? আমি তো আর আপনার মতো গড়গড় করে বাইবেলের পাতার পর পাতা মুখস্ত বলতে পারব না। কোনও সভা সমিতিতে চেয়ার দখল করা লোকও নই, নেহাতই ছাপোষা গাঁ গঞ্জের লোক, কলিকাতা শহরে উড়ে এসে জুড়ে বসেছি।’ নিজেকে অপরাধীই মনে হলো। আসলে নিত্য এত লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, অনেক মুখই মন থেকে মুছে যায়। আমি মানুষটা যে এতটা অধম আগে কখনও ভাবিনি। মাথা ডানে বাঁয়ে ঘোরাতে ঘোরাতেই মনে পড়ল। ছি ছি, নিজেকে নিজে দুষেও নিস্তার পেলাম না। বললাম, গঙ্গার ঘাট থেকে ফিরলেন বুঝি। উনি মুচকি হেসে বললেন, ‘আমার পাপের বোঝাটা এতটা ভারি হয়ে যায় নি যে, গঙ্গায় ডুব দিয়ে হালকা করতে হবে। আপনারা ধর্মযাজক মানুষ, বরঞ্চ আপনাদের মতো মানুষদের সঙ্গে দুদণ্ড কথা কথা বললে মনের তৃপ্তিটা দ্বিগুণ বাড়ে।’ নামটা মনে না পড়লেও উনি যে কৃষ্ণনগরের পাঠশালার হেডমাস্টার মশাই, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আপনার সংস্কৃতের উপর ব্যুৎপত্তি দেখে  আমার চক্ষু তো চড়কগাছ। ‘ আপনিই বা কম যান কীসে! কোনও সাহেবকে তো দেখলাম না আমাদের ভাষাটাকে এত চটজলদি রপ্ত করতে। লোকে বলে আপনি তো আর সাদা চামড়ার মানুষ নন, বাঙালিরা সাহেব হওয়ার জন্য হাঁকপাক করলেও আপনি কত সহজে বাঙালিদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন।’ কী যে বলেন,  বিদ্যাসাগর মশাই যেভাবে সমাজসেবা করছেন, আমি তার এক ফোঁটাও করতে পারি নি। তবে হ্যাঁ, এখানকার মানুষের বড় একটা গুণ আছে, কত সহজে মানুষকে আপন করে নেয়। ‘এই কথাখান আপনি একটুও বাড়িয়ে বলেন নি কিন্তু জানেন সাহেব-বাবা, এরা বড় দুঃখি, এদের কষ্টের কথা বোঝার মতো লোক এই বঙ্গদেশে কজনই বা আছে।’ আমি স্তম্ভিত হয়ে ওনার কথা শুনলাম। কী এর জবাব দেব বুঝে উঠতে পারলাম না। কত কিছুই তো এদের পাওয়ার আছে, কিন্তু মিলে কই! কত পুরুষ ধরে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।  অথচ দুনিয়াটা পাল্টে যাচ্ছে দ্রুত, এদের কোনো হেলদোল নেই। কেউ বুঝতে পারে তো বাকিরা মুখ ফিরিয়ে নেয়। চড়া রোদের জ্বালায় একটুখানি ছায়া খুঁজছিলাম। ছায়াটা এতক্ষণ বেশ দলা পাকিয়ে ছিল, মুহূর্তেই যেন ভেঙেচুরে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি মেঘেরা কেমন ছেঁড়া ছেঁড়া, পাগল হয়ে ঢেকে দিচ্ছে কারও বাড়ির ছাদ, গলির মুখে কৃষ্ণচূড়া, চামেলী আর জুঁই গাছের ছায়া।  মনে হলো, এই আকাশটা কত চেনা, চুপ মেরে থেকে ভেলকি দেখায়। হেডমাস্টার মশাই যাবার সময় কত কী যে বলে গটগট করে চলে গেলেন। বোধ হয় আর এক প্রস্ত আমন্ত্রণ জানালেন। মনে মনে ভাবলাম আহুত কী অনাহুত কিছুতেই কিছু আসে যায় না। যেতে আমাকে হবেই। পৃথিবীটাকে ছোট করে দেখলে চলবে না, এক জায়গার গরিমা অন্য জায়গায় না ছড়াতে পারলে সকল রূপ রস গন্ধ যে বৃথা হয়ে যাবে, পর পরই থাকবে, আপন হয়ে অন্য কারও বাড়ির দরজায় কড়া নাড়বে না কোনদিন। বুঝতে পারছি ক্রমশ আমার মনটা ছুটে বেড়াতে চাইছে, দু’হাতে জড়িয়ে ধরতে চাইছে সামনে যতদূর চোখ যায়। রাস্তার ধারে ঝুপড়িটা ডান দিকে একটু হেলেই ছিল, কিশোর কিশোরীরা কড়ি খেলছে। ওদের মুখ চোখ শুকনো হলেও হাসি ঠাট্টা তামাশার অভাব নেই। কে এল, কে গেল, ওদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। জিজ্ঞেস করলাম আমাকে তোমরা খেলায় নেবে। ‘ধ্যাৎ, তুমি হলে কত্ত বড় মানুষ, তুমি খেলবে আমাদের সঙ্গে?’ ওদের বাবা কাঠের গোলায় কাঠ চেড়াইয়ের কাজ করে, মা বাবুদের বাড়িতে ঝিগিরি  করে। কেউ এমন নেই যে দেখভাল করে। জানতে চাইলাম তোমরা লেখাপড়া শিখবে? ওরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। আমার ঝোলা থেকে একটা বই বের করে ওদের সামনে রাখলাম। ওরা কিছুক্ষণ পাতা উল্টিয়ে গিলে খেল যেন এমন জিনিষ বাপের জন্মে দেখে নি। বললাম, তোমরা আমার পাঠশালায় পড়বে? এক প্রস্ত হেসে নিয়ে বলল, ‘বড্ড খিদে পেয়েছে, চারটি মুড়ি দেবে গো, সেই রাত্তিরে খেয়েছি।’  কষ্টে বুকটা আমার ফেটে গেল।  দুই একজন পথচারী যেতে যেতে বলে গেল, ‘ওই দেখ পাদ্রীটা কেমন ছেলেমেয়ে দুটোর মাথা খাচ্ছে। খেষ্টান বানাবার ধান্দা। কাগজে তো পড়লুম, হিন্দুদের ভুজুং ভাজুং দিয়ে পাদ্রীরা ধরে ধরে নাকি যিশুর চেলা বানাচ্ছে।’ কথাটা শুনে ক্ষণেক থম মেরে রইলাম। কথা তো নয়, মনের ভেতরে কারা যেন ভারী ভারী পাথর চাপিয়ে দিয়ে চলে গেল।

ব্ল্যাক টাউনে যে পুকুর আছে তা তো জানতাম না। পুকুরের জলে কচুরিপানায় ঢেকে গেলেও দু’চার জন ছেলে এপার ওপার করে জলে ডুব মারে। কচুরিপানা দু’হাতে সরিয়ে সরিয়ে ওদের দামালপনা চলতেই থাকে। শহরের এমন রূপ আমি আগে কখনও দেখিনি। পাড়ের সিঁড়িটায় বসে বসে ভাবলাম কিশোর কিশোরীর রঙ ঢঙ সব দেশেই সমান, আলাদা করতে চাইলেও কী আলাদা করা যায়? পাড় থেকে সামান্য দূরের রাস্তায় লোকজন ইতঃস্তত চলাফেরা করছে। আহা! কত মানুষ আসে, কত মানুষ চলে যায়। ঐ তো একবার মুখখানি দেখা, আর তো কোনদিন হয়তো দেখা হবে না, হারিয়ে যাবে নিজের মতো করে জনসমুদ্রে। মনে হলো হাজার বছর ধরে মানুষ হাঁটছে, হাঁটার কোনো বিরাম নেই। কত গল্প, কত শব্দ মনে আওড়াতে আওড়াতে সময়কে পেছনে ফেলা। দুই একজন আমার বসার ভঙ্গি দেখে টিপ্পনী কাটে। জানতে চাই তো কত কথা, ওদের সুখ দুঃখগুলো, সবই দলা পাকিয়ে চোখমুখে অজানা আতঙ্কের রেখাগুলো ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে শহরের  অলিগলিতে। হাঁটা ছাড়া বিকল্প কোনো পথই তো কারো সামনে খোলা নেই। কারা ওই মানুষগুলোর জীবনের অঙ্কগুলো হিসেবের খাতায় তুলে রাখে, এর উত্তর আমাকে জানতেই হবে। ব্ল্যাক টাউনের ঘর গেরস্থালির খোঁজ রাখার ইচ্ছা সত্যি কী কারও আছে? অথচ ওরা কী ভাবে, কেমন করে ভাবে, আদৌ ওদের ভাবনার কোনো সারবত্তা আছে কিনা তাই বা কে জানে। যে নতুন ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে তাতে ওদের মনে কোন বুদ্বুদ তৈরি হচ্ছে কিনা আমি তো জানতেই পারি না। জানার কিন্তু সময় হয়েছে। ওদেরকে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে না পারলে সবটাই কেমন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। 

কে এই মানুষরা? দেখার আগ্ৰহে সকল অনুভবকে ভেঙেচুরে এক পা দু’পা করে এগিয়ে গেলাম। বুঝতে গেলেই কত ভাবনারা এসে জাঁকিয়ে বসে। রামতনু লাহিড়ী, রামগোপাল ঘোষ ও কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়রা গল্পগুজবে মাতোয়ারা হয়ে দু’পাশের ঘরবাড়ির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে একে অপরকে এই শহরের হাল হকিকত বোঝাচ্ছেন। নতুন করে আছড়ে পড়া ঢেউগুলোকে কী করে সামাল দেওয়া যায়, তাই নিয়ে ওদের কথা চালাচালি। কী করে শূন্যস্থানগুলো পূরণ করা যায় সেই নিয়ে তো যত মাথাব্যথা। তা তো বটেই। কত কাজই তো অসম্পূর্ণ অথচ সময়ের অপূর্ণতা প্রতি মুহূর্তে বুঝিয়ে দিচ্ছে – চলো, চলো, চলো, আরও জোরে পা চালাও। ঘরের দরজা জানালাগুলো ওরা বন্ধ করে রেখেছে, জোরে ধাক্কা মারতে হবে, ওদের টেনেটুনে বের করে আনতে হবে। কী অসম্ভব প্রতিজ্ঞা নিয়ে ওরা ময়দানে নেমে পড়েছে। যত ভাবি ওদের কাছে গিয়ে মনের কথা জানি। এই ভাগাভাগির শহরটাকে জোড়া লাগাই। হাত ধরাধরি করতে চাইলেও করা যায় না, ওরা দু’পা এগিয়ে যায় তো আমি থমকে দাঁড়িয়ে যাই। খালি মনে মনে ভাবি আর একটু সময় নিয়ে এই জগৎটাকে দেখি – কী রহস্য লুকিয়ে রয়েছে এই মাটির গর্ভে, খুঁড়ে খুঁড়ে দেখতে দোষ কী! ওরা পিলপিল করে এগিয়ে আসে, নিজেদের অবস্থানকে চিহ্নিত করে চলে, কতটুকু ধরার চেষ্টা করে, নাকি ধরতেই চায় না। না তা হবে কেন? কতজন তো মুখিয়ে রয়েছে নিজের কথাগুলো বলবে বলে। কেউ অর্ধসত্য বলছে, কেউ বলে বেড়াচ্ছে ছাপোষা মানুষগুলোর মনের কথা, কিন্তু জোড়া তো লাগছে না। ওই তো যে মানুষটা ঘরের এক কোনায় বসে রয়েছে, সাইকেলের টায়ার নিয়ে যত কাজ কারবার, ওখানে মাঠের পর মাঠ ছিল, ফসল তোলার মোচ্ছব লেগে যেত চারপাশে, সারি সারি কলাবাগানের পাতার পত পত শব্দ আর দিঘির জলে নেচে বেড়াত মাছ, সাপ ব্যাঙ আর জলপোকারা। এই সবই চোখের দেখা দেখিনি, এই কর্মভূমিতে আসার আগে বিলেতের মাটিতে লোকমুখে ও বইয়ের পাতা উল্টিয়ে ঢুলুঢুলু হয়ে বুঝতে চেয়েছি কারা এরা? ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোকেরা কেনইবা এখানে দাপিয়ে বেড়ায় যাচ্ছেতাই ভাবে। কীসের এত লোভ? মশলাপাতির ব্যবসা, না বস্ত্র নিয়ে কারবারে  এঁটেল মাটির মতো চিপকে দিয়েছে। তাই যদি হবে, সম্পর্কের ধরণটা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। ওরা কী নিজদেশে পরবাসী? গরুর গাড়ির চাকা মাটি ঘসটাতে ঘসটাতে থকথকে কাদায় আটকেই গেল। কার যেন ডাক শুনে এতক্ষণের তাল জ্ঞানের সংযোগটা আগের মতো রইল না। বললাম, কে আপনি? উত্তর এলো ‘রামগোপাল ঘোষ। পাদ্রী সাহেবের ব্ল্যাক টাউনের মানুষদের জন্য মন কেমন করছে? সাহেব, এখন এশীয়দের বড় দুর্দিন, ইংরাজের অত্যাচার হতে রক্ষা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনও রাস্তা যে আর খোলা নেই। আমি গভর্ণর জেনারেলের ব্যবস্থাপক সভাতে কয়েকখানা আইনের পাণ্ডুলিপি উপস্থিত করেছি। ভারতবাসী ইংরাজদিগকে এদেশীয়দের বিরোধস্থলে কোম্পানির ফৌজদারি দণ্ডবিধির অধীন করাই ঐ সকল পাণ্ডুলিপির উদ্দেশ্য ছিল। ইংরাজরা তাকে ‘কালা আইন’ নাম দিয়ে আন্দোলন শুরু করেছে। এটা কী যুক্তিসঙ্গত কাজ?’ রামগোপাল বাবু এর জবাব আমার কাছে নেই। ইংরাজরা গভর্নমেন্টকে গালাগালও কম করছে না। আমি তো জানি আপনি এক মাসের আয় দিয়েছেন, আপনার অনুরোধে হেয়ারের শিষ্যগণের এক মাসের আয় দিয়ে ডেভিড হেয়ারের প্রস্তর-মূর্তি নির্মিত হয়েছে। এটা কী কম বড় কথা! সম্পর্কে যদি শত্রুতার গন্ধ থাকে, দেশ শাসন করবে কেমন করে!

কথাগুলো ছুরির বলার মতো বিঁধল গায়ে। নিজেকে আলাদা করে প্রমাণ করা কী যে কষ্টকর তা প্রতি পলে পলে টের পাচ্ছি। বুঝলাম মন খুলে কিছু না বললেও ওরা আমাকে একই গোত্রের মধ্যে ফেলে ভালো মন্দের বিচার করছে। সাদা চামড়ার মানুষ হলেও আমার চিন্তা চেতনা যে অন্য খাতে বইছে এ আর কে বিচার করবে। চারপাশে এখন একটা পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। কে কাকে মুঠো করে ধরবে, আবার ধরতে গেলে  ফুরুত করে যে উড়ে বেড়িয়ে যাবে কোন আকাশে, কে বলবে। এমন আজব দেশ কস্মিনকালেও দেখি নি, ওরা অন্য জাতের মানুষ, নিজেদের হাঁটি হাঁটি পা পা করে আলাদা করতে না পারলে যে সাহেব সুবোদের দলে নাম লেখানো যাবে না, সে-ও আর এক বিপদ। গায়ের গন্ধে যে ভুত পালায়, তেলে জলে মিশ খাবে কেন! তাই তো বাবু লোকরা ততক্ষণ-ই সহ্য করে যতক্ষণ নিজেদের ঘরে ওরা এসে হু হু করে ঢুকে না পড়ে। শুনেছি রামমোহন রায় এর ব্যতিক্রম, এত খেতাব টেতাবের উনি তোয়াক্কা করতেন না। যখন যেমন চাইতেন, যা মনে করতেন মানুষের পক্ষে হিতকর, তা দু চোখ বুজেও সগর্বে ঘোষণা দিতে পিছপা হতেন না। লোকটার বুকের পাটা ছিল, না হলে হিন্দু সমাজের নেতা রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুরের সঙ্গে বুক চিতিয়ে লড়তে পারতেন! সমাজটা রসাতলে যেতে বসেছিল বই তো নয় , জোরে হ্যাঁচকা টানে তুলেছেন বলেই না বেঁচে গেল। না হলে শুনেছি এই দেশে হরেক কিসিমের লোক আছে, একজনকে দেখে অন্য কাউকে বোঝার উপায় নেই। সাবধানে পা না ফেললে হোঁচট খেতেই হবে। বিধির বিধান কে আর খন্ডাবে বলুন। এই জগতে মানুষের ছোঁয়া লেগেছে বলেই না এতটা বৈচিত্র, কত কী যে ঘটে গেছে, আবার কত কী যে ঘটার অপেক্ষায় দিন গুনছে, সে কী আর আমি থোরাই জানি। মাঝে মাঝে আমার নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করতে সাধ জাগে – যা জেনেছি ঠিক জেনেছি তো আর যা জেনে ফেলেছি তাই কি ভুল করে জেনেছি! এই দেশীয়দের কাছে একটা কথা প্রায়ই শুনি, ‘নাড়ীর টান’।  দোকানিটা আমাকে দেখেই দু’হাত জড় করে প্রণাম করে বলে, ‘বাবু, অপরাধ নেবেন না, একটা প্রশ্ন করতে পারি, ছোট্ট প্রশ্ন – আপনারা আমাদের দেশের মানুষদের ভালোবাসেন তো, না কি সবটাই ভান, লোক দেখানো? আমাদের নিন্দা করলে আপনাদের গায়ে লাগে না? মানুষ বই তো নয় । তবে আমাদের দেশের বাবু লোকদের সঙ্গে ইংরাজদের একটাই মিল, সকলেই আমাদের ছোট লোক, বজ্জাত বলে গাল দেয়। আমরা পিঠ পেতে দিই, আপনারা মাড়িয়ে চলে যান। বড্ড খড়খড়ে কিনা, পিছল খাওয়ার ভয় নাই।’

ঘোড়ায় চড়ে হোয়াইট টাউনে বিলেতের লোকেরা ইংলিশ উচ্চারণে এমন হম্বিতম্বি করে, জমিদার আর সরকারি বাবুদের থরহরি কম্পন শুরু হয়ে যায়। ভাত দেবার মুরোদ নাই, কিল মারার গোঁসাই। কথাগুলো এমন করে টানে, কে বলল, কাকে বলল, বোঝা দায় হয়ে পড়ে। হোয়াইট টাউনের সাহেবরা এই দেশীয়দের নিয়ম কানুনের বেড়াজালে জড়িয়ে দিয়েছেন আড়াআড়িভাবে। না হলে এই নিয়ম কী চালু করা আদপে সম্ভব! সকল ভেদাভেদে আমরা ওরার দলে গা ভাসালে চলবে কেন? বোঝা গেল নিয়মটা সাহেবরা বুঝে-সুঝেই বানিয়েছে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে বলে। ভাবলেই তো গা ঘিনঘিন করে। সান্ত্বনা দেওয়া দূরে থাক, ঘৃণায় মনটাই ভার হয়ে যায় । নিয়মের বলিহারি। ডিরোজিও শিষ্য রসিককৃষ্ণের সাহস ছিল বটে, না হলে ভরা এজলাসে বিচারপতির সামনে তামা তুলসী গঙ্গাজল তো স্পর্শ করলেনই না, বরঞ্চ বলে বসলেন ‘আমি গঙ্গা মানি না।’ এই নিয়ে হাঙ্গামা তো কম হয় নি, সকলে বলাবলি করল, ‘মল্লিকদের বাটীর ছেলের এই দশা! বলে কিনা গঙ্গা মানি না, ঘোর কলি উপস্থিত, দেখ কালেজের শিক্ষার কি ফল!’ ডান দিকে মাঠের পর মাঠ, আগাছার ছড়াছড়ি, তুলসী বন ছড়িয়ে ছিটিয়ে দুপাশে। এমন প্রকৃতিকে ইংরাজরা যত তাড়াতাড়ি বোঝে ততই মঙ্গল। নেটিভরা যে ফেলনার নয়, দিন আসছে এবার বুঝিয়ে দেবে, তাই একটু বুঝে শুনে পা ফেললেই ভালো। যে বীজ ডিরোজিও আর ডেভিড হেয়াররা পুঁতে দিয়ে গেছেন তাতে যে ফল ফলতে আরম্ভ করেছে, পাকতে আর সময় নেবে না, এটা ইংরাজরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। ছাপিয়ে যাওয়ার লক্ষণে যে ওরা খুব একটা স্বস্তিতে নেই তা বলাই বাহুল্য। এর ছিঁটেফোঁটা যে গরীব গুরবোদের দরজায় এসে থমকে আছে কিন্তু প্রবেশাধিকার নেই, এটা বেশ বোঝা যায় ওদের খামখেয়ালিপনা আর খেয়ালখুশিতে। কিন্তু ধাক্কা তো মারতেই হবে। দিনের আলো ফুরাতেই গোধূলির মায়া এসে জড়িয়ে ধরে, আমি তখনও চেনা অচেনার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকি, আরও দূরে যেতে হবে তো!

চলো মন নিজ নিকেতনে

কত কথাই তো শুনেছি। গা শিউরে উঠে, জিহ্বা শুকিয়ে যায়।  ‘লোনা-লাগা’ যুগ থেকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে কয়েক কদম এগিয়ে। অজীর্ণ রোগ থেকে রেহাই পেতে ঘরে গিয়ে কাঁচা থোড় খেত এদেশের মানুষ,ঘোল ও কল্মির ঝোল পান করত, গায়ে কাঁচা হলুদ মাখত। স্কুল ছাত্রদের এমন দুর্দশার কথা যত কম বলা যায় তত ভালো। শহরের যৌবনের তরঙ্গ এসে উথাল পাথাল করেছে বটে, তা কিন্তু একতরফা। এই তরঙ্গের গায়ে লেগে থাকে কত দাগ, আমার দৃষ্টির আড়ালে গেলেও মনের মাঝে বাজতে থাকে তানপুরার মতো। সুর আসে সুর যায় কিন্তু আমার ভেতরটা খান খান হয়ে যায়। মনে করিয়ে দেয় বারে বারে আমার দেশের মানুষের পরাধীন জীবন যাপনের কথা। তাই তো মাঝে মাঝে বলে ফেলি এই কী আমার নতুন কোনো স্বদেশ? যে যন্ত্রণা ওরা ভোগ করে চলেছে তার হদিস মেলা ভার। হ্যাঁ বলতে পারেন আমি শাদা চামড়ার মানুষ, এই দেশের মানুষদের সঙ্গে কেমন করে হিসেব মিলবে! মিলবে গো মিলবে, মেলাতে হবে। এদের অব্যক্ত ক্রন্দনের হিসাব কষতে হবে জোরকদমে। আহা! কত কিছুই তো করতে চাই। কোনটা ছেড়ে কোনটা করব, এই ধাপগুলো ছুঁয়ে ফেলা খুবই জরুরি। এটা বুঝতে পারি ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্তাব্যক্তিরা আমাকে সেই সুযোগ দেবে না। ব্যবসায়িক ফায়দা লাভের চেষ্টায় ওরা মতিচ্ছন্ন হয়েছে, এই প্রান্তিক ছাপোষা মানুষগুলোর দিকে তাকাবার ওদের অবসর কোথায়? চারপাশে গভীর আঁধার, এই আঁধার পার করে আলোর খোঁজে বেরিয়ে পড়তে হবেই হবে, না হলে আমার যে নিস্তার নেই। তাই তো আমাকে নাড়া দেয় ফেলে আসা দিনের প্রতিক্ষণ।

কাঠ চেড়াইয়ের কল থেকে এক কর্মচারী হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এসে আমার পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলল, ‘সাহেব-বাবা আপনি এই অসময়ে আমাদের এলাকায়!’ কথাটা হজম করতে সময় নিলাম। বুঝলাম বিনা মেঘে  বজ্রপাত হয় তো, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু আছে নাকি! সে তো বলেই চলল, ‘ওই যে কৃষ্ণনগরের পাঠশালায় আমার ছেলেকে পড়ালেখা শেখার সুযোগ করে দিয়েছিলেন, আমি সেই অমলের বাপ। হেডমাস্টারকে বলেছিলেন, ছেলেটার দিকে নজর রাখবেন মাস্টার। আপনার অসীম কৃপা না হলে ছুতোরের ছেলে কোনদিন পড়ালেখার মুখ দেখত, বলুন। সেই থেকে ভাবছি, আবার কোনোদিন যদি দেখা হয়, জিজ্ঞাসা করবো, পরদেশী মানুষদের জন্য আপনার এত দরদ কীভাবে হলো যখন কোম্পানির কর্তারা আমাদের মাড়িয়ে দিয়ে চলে যায়, কুকুর বেড়ালের মতো মনে করে, আমাদের ইজ্জতের কোনো দাম দেয় না।’ কাঠমিস্ত্রি কথাগুলো বলেই ঢোঁক গেলে। হাত পা কাঁপতে থাকে। ‘সাহেব-বাবা, ভুল কিছু বললাম?’ ও আমাকে একখানা কাঠের চেয়ার টেনে বসতে দেয়। ওর চোখ দুটো ভিজে যায়। কেন যে ওর চোখ দিয়ে জল গড়ালো আমি বোঝার চেষ্টা করলাম। এই দেশের ছাপোষা মানুষগুলোর মন এত নরম, এত অল্পতেই মাথা নত করে, ভাবলাম পরম শক্তিশালী ব্রিটিশদের সামনে এরা মুখোমুখি হবে কেমন করে? তবে একটা কথা বলতেই হবে, এদের আত্মবিশ্বাসের তুলনা হয় না। কিন্তু শুধু আত্মশক্তিতে তো চিড়ে ভিজবে না। নবজাগরণের উন্মেষ ঘটেছে বটে, কিন্তু কামার কুমোর ছুতোররা রয়ে গেছে ঘোর অন্ধকারে, শত যোজন দূরে। এই দেশের উচ্চবর্গীয়রা নিম্নশ্রেণীর মানুষদের হিসাবেই ধরে না। এরা বেঁচে আছে কি মরে গেছে তারও খোঁজ রাখে না। সাহেব সুবোরা দিনরাত ধরে শুধু এই মন্ত্রই জপে – ‘চাষার বেটা চাষা না হলে আমাদের খাবারের যোগান দেবে কে?’ এই মনের দূরত্ব আর চিন্তার দৈন্যতা ঘুচবে কেমন করে আমার জানা নেই। এই মুহূর্তে জোড়া লাগানোর চেষ্টা যে বৃথা এই শহরের পন্ডিত ব্যক্তিগণের সঙ্গে কথা বলে বুঝে নিতে আমার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় নি। ওরা শুধু নিজেদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আর বড় সাহেবদের তাবেদারী করতেই ব্যস্ত। এত সহজে শহরের এক কোণে পড়ে থাকা প্রান্তিক মানুষদের অভাব অভিযোগের কথা ওদের মস্তিষ্কে ঢুকবে না। অশিক্ষা কুশিক্ষায় জর্জরিত বঙ্গদেশের এই মানুষগুলো জানেই না কোন পথ দিয়ে হাঁটলে ওদের পায়ে কাঁটা ঢুকবে না অথচ কার্যসিদ্ধি হতেও বিলম্ব হবে না। ও আমার মনের কথা বুঝতে পেরে চোখ তুলে তাকালো। সেই দৃষ্টিতে হয়ত অনেক দূর চিনে নিতে পারত কিন্তু কোথায় যেন নিজের মধ্যে গুটিয়ে গেছে, দরদর করে ঘাম ঝরছে আর বলছে, ‘সাহেব-বাবা, আমাদের কথা কেউ আর ভাবে না, আর কোনকালে ভাববেও না, আপনি আর ভেবে মরেন কেন! আপনার এখন কত কাজ বাকি।’ আমি অবাক হয়ে গেলাম সামান্য মিস্ত্রী হয়ে আমার কাজের হদিস ও পেল কেমন করে? এই মানুষগুলোকে যত দেখছি আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, এত পিছিয়ে থেকেও এত চিন্তার স্ফুলিঙ্গ জন্ম নিয়েছে কেমন করে! নিশ্চয়ই আছে কোনো রহস্য। এই দেশের মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে আমাকে যেই করে হোক দেখতে হবে, বুঝতে হবে কেমন করে ওরা যন্ত্রণার সঙ্গে ভালোবাসাকে  মিশিয়ে দেয়। 

কথায় কথায় আকাশে মেঘ জমলো। আঁধার নামলে দূরে সরে গেল কাছের মানুষ। দৃষ্টি যেন পৌঁছতেই চায় না, আমি যেখানে পৌঁছতে চাই, দেখে ফেলতে চাই অনায়াসে আমার আগত ভবিষ্যৎ। এত মায়াও জমা ছিল আমার অন্তরে! মায়ার গভীরে জীবনের অর্থই তো আমি খুঁজে চলেছি। নানা জিজ্ঞাসা যেন নিজের মতো জাল বিছিয়ে রেখেছে। একে অতিক্রম করে যে যাবো সে সাধ্য কোথায় আমার। প্রতিদিন প্রতিরাত আলো আঁধারিতে কত শত প্রশ্ন এসে জমা হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। কোনটা ছেড়ে কোনটা যে ধরব তার হিসেব কষতে বসে আমি নাজেহাল। আমি এগোব না পিছোব এর জবাবই বা কে দেবে। এখানে অনেক কর্দমাক্ত রাস্তা, কত জলাভূমি, ডোবা নালায় ভরপুর অঞ্চলের চারপাশে কত তরুলতা, কত ছায়াপথের লুকোচুরি খেলা, গাছে গাছে বসন্তের কোকিলেরা ডাক দিয়ে চলে যায়। কত কথাই তো ওরা বলে। মানুষের অন্তরে সেঁধিয়ে যেতে চায় বলেই তো ওদের এত ডাকাডাকি। আমি বুঁদ হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখি ওদের মিলিয়ে যাওয়া। শহরের অলিগলিতে অচেনা মানুষের ঠিকানারা উড়ে উড়ে বেড়ায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রতি মুহূর্তে ওরা পাল্টাচ্ছে নিজের মতো। বেঁচে থাকার যন্ত্রণা ওদের অতিষ্ঠ করে ফেলে। কোন পথে গেলে কার হাতে পায়ে ধরলে উপরে ওঠার সিঁড়ি গুলো পার করা সহজ হয়ে যাবে, ওরা তো জানে না। ফিরে যাবে না এমন সাধ্য কী আছে ! ওদের চলার পথে কত অবজ্ঞা, কত অবহেলা, কত মাথা নীচু হয়ে থাকা, কত বলার কথাগুলো দমবন্ধ হয়ে দলা পাকিয়ে যাওয়া। ওরা কথা চালাচালি করে বটে, সে বড় দূরের, নিকটের আর হলো কই। পথই যে কত সময়ের বলি চড়ায়, ভেবে ভেবে আমি অস্থির হয়ে উঠি, সে কথা কি জানে আনজনে? মনে পড়ে তো জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে শীতল বাতাসের শিরশিরানিতে দু’পাড়ের ঘরবাড়ির প্রতি চোরাটান, ওদের চঞ্চলতা, উদোম গায়ে মাঠ-জঙ্গলের মধ্যে আনাগোনা মনের কোথায় জায়গা করে নিয়েছিল ভাবখানা ওরা আমারই লোক। পাড়ে এসে পা ছোঁয়াতেই মনে হয়েছিল এই অজানা ভূখণ্ডটি আমার কর্মভূমি হয়ে উঠবে তো। আমি নিজেকে পারব তো মানানসই করে তুলতে! সেদিনের সেই কল্পনারা আজও আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। আমি আগন্তুক হয়ে আসলেও এদের চেনাজানা হতেই হবে আজ না হয় কাল, কাল না হয় পরশু, না হয় কোনো অনাগত দিনে।  

গুপ্ত কবির আগমনের কথা শুনে আমি খানিকটা উৎসাহিত হয়েছিলাম। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এসে তাঁর আসন গ্ৰহন করেছেন। ওই সভায় আমাকে দেখে অনেক কবিতা প্রেমীরা ফুসুর ফাসুর শুরু করে দিয়েছেন, এমন রসিকতা জন্মে দেখি নি। কারও ধারণা ছিল বাংলা কবিতার রসকস এই ম্লেচ্ছ আর কী বুঝিবে। তাও আবার যেই সেই কবি নন, স্বয়ং ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর সম্পাদক বলে কথা। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেই গেলাম। আশ্চর্য তো হতেই হয়, প্রথম বাংলা দৈনিক পত্রিকার সম্পাদনায় শক্ত হাতে হাল ধরেছেন, তাঁর রসবোধ ও পান্ডিত্য আমার স্বদেশীরাও ধারে কাছে নেই। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে এল। তিনি ব্রাক্ষসমাজের সদস্যদের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার কথাও উল্লেখ করেছেন তাঁর বক্তৃতায় বারে বারে। বাঙালি বাবুদের হাততালি তো আর থামতেই চায় না। তোষামোদি করার বদভ্যাসটা ভালোই রপ্ত করেছে। এঁরাই আবার এদের স্বজাতিদের ছায়া মাড়ায় না, ব্রাক্ষণত্বের বড়াই করে, ইংরেজদের তোষামোদি করে পঞ্চমুখে, জাল, জুয়াচুরি, উৎকোচ, প্রবঞ্চনা, মিথ্যার বেসাতি করে ধনী সাজতে লজ্জা করে না। ঝোলেও আছে, অম্বলেও আছে। প্রসিদ্ধ বাঈজীর জন্য অনায়াসে টাকা ছড়াতে বাঁধে না, হাত খুলে খরচা করে আর সেকথা বৈঠকে বৈঠকে ফলাও করে জাহিরও করে। এই নিয়ে আবার কেউ দোষের কিছু দেখেন না। আমি জানি না এটা কোনও মানসিক বিকার কিনা, সমাজটাই হয়তো রসাতলে বসেছে। এরা এসবের থোড়াই তোয়াক্কা করে – সকলে উচ্ছন্নে যাক, নিজেদের ঠাঁটবাট যেন ষোলো আনা বজায় থাকে। এমন উদাসীন ভদ্র শিক্ষিত সন্তান কেই বা কবে দেখেছে। কলকাতাকে নরক বানিয়ে রেখেছে।না হলে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে লিখতে হয়  – “রেতে মশা দিনে মাছি,/ দুই নিয়ে কল্‌কেতায় আছি।” 

গাড়োয়ান বলল, ‘সাহেব-বাবা মোরা দিন আনি দিন খাই। আদার ব্যাপারি জাহাজের খোঁজে কাজ কী। বাবুদের সঙ্গে আমরা কেন মিলতে যাব? তেনারা কী আমাদের সমাজের মানুষ।’ ওর কথার সারবত্তা আছে। বাবু সমাজের ঘর গেরস্থালি দিয়ে গোটা সমাজকে বুঝতে গেলে ভুলের বোঝা বাড়বে বই কমবে না। অভাব অনটনের দিন রাতের জ্বালা একেক জনকে এক এক রকমের ছুঁয়ে যায়। সকলের নাড়ির খবর না জানলে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে বই কী। কে জানে বাবু লোকদের গা থেকে কেমন দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে, ওদের ছায়া মাড়ালেই সারা শরীর রি রি করে উঠবে। ভোস্‌ ভোস্ করে দিন দুপুরে ঘুমায়, ঘুড়ি ওড়ায়, বুলবুলির লড়াই দেখে,  ফুর্তির কি শেষ আছে। সেতার, এসরাজ বীণ বাজায়, হাপ আকড়াই, পাঁচালি শোনে। তাতেই কি দিনের আলোতে সকল কিছুর আশ মেটে। রাত যত বাড়ে বারাঙ্গনাদিগের আলয়ে আলয়ে গীতবাদ্য করে, খড়দহের মেলা ও মাহেশের স্নানযাত্রায় কলিকাতা হতে বারাঙ্গনাদের নিয়ে দলে দলে নৌকাযোগে আমোদ আহ্লাদের ফোয়ারা ছোটায়। পোশাক-আশাকে কেটো ধূতি আর ফতুয়া পরা মানুষগুলোর সঙ্গে মিলবে কেন। ভিন্ন দুনিয়ার ভিন্ন মানুষ – বাউরি চুল, দাঁতে মিশি, ফিনফিনে কালাপেড়ে ধূতি, অঙ্গে মসলিন বা কেমরিকের বেনিয়ান, গলদেশে চুনট করা উড়ানী ও পায়ে বগ্‌লস দেয়া চিনের বাড়ির জুতা আরও যে কত রকমারি সাজ। সময় যত যায়, ইংরেজদের সঙ্গে তালে তাল মেলাতে গিয়ে নিজেদের ঘরানাকে এমনি করে জলাঞ্জলি দেয় বাবুলোকরা। এদেরকে দেশের মানুষ হিসেবে বেছে নিলে দেশীয়দের অপমান করা হয়। এক বাংলাতে কত পৃথিবী, গোটা ভারতবর্ষে জাপটে ধরলে না জানি কত অনৈক্যের সুর বাজতে থাকবে, তার কুল কিনারা খুঁজে পাওয়া যাবে না। ‘সাহেব এসব গল্প আমায় শুনিয়ে কী লাভ?’ লাভ লোকশান কি এত সহজে বিচার করা যায়। গাড়োয়ান বলে, ‘আপনি কোন ধরনের মানুষ, জেতা হারার বিচার করেন না!’ জিতব বলে তো তোমাদের দেশের মাটি মাড়ায়নি। ‘তবে এলেন কেন এই পোড়া দেশে মরতে?’ বাঁচব আর বাঁচাব বলেই তো এসেছি। এই দেশের বাবুলোকদের কীসে যে আনন্দ হয়, আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। দাশরথি রায়ের নাম শুনেছ? তা তুমি শুনবে কেমন করে। ওখানে তো তোমাদের জায়গা হবে না। কবির দলের বাঁধনদার ছিল। পরে পাঁচালি গানের পথ ধরেছে। এত অশ্লীল উপমার ছড়াছড়ি কর্তব্য নয়। ‘ওসব রসের অংশীদার হবো, এমন মানুষ আমি নই। নুন আনতে যার পান্তা ফুরায়, তার কি এসবের দোকানদারি সাজে। আমরা হলাম গিয়ে মেঠো লোক, আদারে-বাদারে ঘুরে বেড়াই, শিবের গাজন, চড়ক, পালাগান শুনেই মনের আবদার মিঠাই। আপনারা হলেন গিয়ে জ্ঞানী গুণী মানুষ, আপনাদের মনের ভাব বুঝব, সেই সাধ্যি কী আমাদের আছে, সাহেব-বাবা।’ তুমি তো বেশ বেড়ে কথা বল। কে বলে তোমাদের বুদ্ধি নেই। তোমরাই পার শাসকের কাছ থেকে সব অধিকার আদায় করে নিতে, বাকিরা তো মোসাহেবি করেই আখের গোছায়। ওরা কী করে বুঝবে তোমাদের কষ্টের কথা, যন্ত্রণার কথা, অভাব অভিযোগের কথা। আমি এক নতুন স্কুল খুলেছি, তোমার ছেলেকে পাঠিও, পড়ালেখা শিখবে। তুমি চাও তো তোমার ছেলে দশের একজন হোক, মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। ‘চাই সাহেব-বাবা চাই। আমরা সমাজের এক কোণে পড়ে থাকি। কে আমাদের কথা ভাবে বলুন। বাপ ঠাকুরদারা মাথা নুইয়ে থেকেছে, মাথাওয়ালাদের পায়ের নীচে থেকেছে, তাই আমরাও থাকি। আমাদের কী ভুত আর কী ভবিষ্যৎ।’

অদূরে শশ্মানে চিতা জ্বলছে। জীবনের সকল গন্ধ উবে যাচ্ছে নিমেষে। এখানে কেউ কারও আছে কোন হিসাব চায় না, শুধু শোকে বিহ্বল হয়ে মরার গন্ধ শোঁকে। গলগল করে ওঠা ধোঁয়ায় দমকা হাওয়ার ধাক্কা লেগে বুঝিয়ে দেয় – জীবনকে আগলে রাখ। অস্থি পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে উন্মুক্ত আকাশে বিলিন হয়। আমি নিজেকে বার বার ছুঁয়ে দেখি আর উপলব্ধি করি নিজের ভেতরের মানুষটা এই মুহূর্তে কোন চেতনায় ঘর করছে। অনেক প্রশ্ন এসে ধাঁধার সৃষ্টি করে চলে যায় কোনো উত্তর খুঁজে পাই না। কে আমি, কেন আমি, কীসের জন্য আমি? বাংলার মাটি  এখন আমার শরীর ছুঁয়ে আছে, আমার অস্তিত্বের সবটুকু নিয়ে আমার দৃষ্টি আমাকে প্রশ্ন করছে ‘পাখির ডানার শব্দ শুনতে পাচ্ছ? নদীর ডাকাডাকি তোমার কল্পনাতে মিশে যাচ্ছে না তো ? দেখতে পাচ্ছ কি এই পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ।’ চিতার আগুন আমার চারদিকে কি বৃত্তাকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে, নাকি ঘুরবে বলে সকল আয়োজনে মেতে উঠেছে? নিজেকে বড় অসহায় লাগে। তবুও যেন সত্য মনে হলো কতগুলো মানুষের মুখ, ওরা হাঁ করে আছে, ওরা নির্বিকার, ওরা মুখ ঘুরিয়ে নেয়, নিঃশ্বাসের বাতাসকে উপেক্ষা করে পৌঁছে যাচ্ছে নিজস্ব গন্তব্যে। কোনো সাড়া নেই, সকল শব্দরা থেমে গেছে। আমি আরও একটু এগিয়ে গিয়ে কথা চালাচালির সঙ্গে মিশে যেতে চাই যেখানে বাঁচার চিহ্নগুলো রমরম করছে। কথার মারপ্যাঁচে গুলিয়ে দিচ্ছে সব হিসেব। মরণপণ করে জীবনের কাছে এই যে স্বীকারোক্তি এর মূল্য তো কম নয়। জগৎ সত্য বলেই না মৃত্যুর ছায়ারা ওদের গিলে নিতে গিয়েও ভয় পাচ্ছে। তাই কি জীবনকে অর্থময় করে তোলার মধ্যেই রয়েছে সকল পরিপূর্ণতা। ভাবলাম এরা তো প্রকৃত অর্থে আমার অনাত্মীয়, গড়নে চলন বলনে ভিন্ন মেরুর। তবুও কেন বলতে পারছি না, না না এটা সত্য নয়, আরও এমন কিছু আছে যা আমাকে ইঙ্গিত দিচ্ছে ‘এরাই সব’।  

শিক্ষা না হলে মানুষ চোখ থেকেও অন্ধ। এমন দিনও ছিল কেউ কেউ কেবল ব্যাকরণ স্মৃতি ন্যায় শাস্ত্র পড়ত। বেদ, বেদান্ত, গীতা, পুরাণ, ইতিহাস বিষয়ে অজ্ঞ ছিল।  শ্রীরামপুরের মিশনারিরা দেশীয় ভাষাতে বাইবেল প্রভৃতি গ্ৰন্থ অনুবাদের জন্য বাংলা ভাষার অনুশীলন করাতেন। পরবর্তীতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ রচনা করেন। কলিকাতা শহরের বাবুরা জোর কদমে সন্তানদের ইংরেজি শেখাতে শুরু করলেন। শোনা কথা নবীন বাবু নামে এক কর্মচারী ঘোড়ার দানায় টিফিন করার জবাবে বলেন, “ইয়েশ্‌ শার্‌ মাই হাউস মার্নিং এণ্ড ইবনিং টুয়েন্টি লীভস্‌ ফল, লিটিল লিটিল পে, হাউ ম্যানেজ?” এই তো ছিল শিক্ষার ধরণ।  ‘আত্মীয় -সভা’ শেষে হেয়ার সাহেব বললেন, “রামমোহন বাবু, ‘এই দেশীয়দের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করা গুরুত্ব সহকারে ভাবা উচিত। এই বিষয়ে আপনার মত কী’? রামমোহন বাবু বললেন, ‘এই বিষয়ে আমার কোনো দ্বিমত নেই।” আমি দুটি ভিন্ন চিত্রের মুখোমুখি হই যখন কচি কচি মুখগুলো হাঁড় ভাঙা খাটুনি খাটে মাঠে ময়দানে, দরদর করে ঘাম ঝরে গোটা শরীর নিংড়িয়ে, আর এক দল শৈশবের দিন কাটায় বই বগলে। কাদের ভবিষ্যৎ কেমন হবে কে বলতে পারে। কী জানি হয়তো কারও জীবন হবে জানার লিপ্সায় ভরপুর আবার কেউ কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে চুল ছিঁড়ে এক গোপন আঁধারে হাতড়াতে থাকবে আর জানতে চাইবে ‘এই জীবন নিয়ে লোফালুফি খেললে হিসাব মিলাবে কেমন করে!’ আমি চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে দুপক্ষকেই দেখি আর ভাবি এই গুরু দায়িত্বের ভার বহন করার ক্ষমতা আমার আছে কী?

এমন ঘরের আচার বিচার জীবনে দেখি নি। আমি নিজেও জানিনা কেমন করে এর অন্দরমহলে প্রবেশ করব। ঘরের বউ ঘোমটা টেনে কাঠের পিঁড়িতে এক গ্লাস জল নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। মুখটা ঢাকাই ছিল। বাড়ির কর্তার কথা চালাচালিতে শুনলাম পূজা দেবী এই বাড়িতে ঘরকন্না করছেন বছর দশেক হলো। নামটা যেমন মিষ্টি, কথার উচ্চারণও কম মধুর নয়। আন্তরিকতা টের পাচ্ছি ধাপে ধাপে। আমার জানার খুব ইচ্ছা ছিল বঙ্গ ললনারা কেমন ঢঙে গৃহকর্ম সামলায়। এই যে বিদ্যাসাগর মশাই মেয়েদের পড়ালেখা নিয়ে এত দিনরাত মাথা ঘামান, আসলে তার হেতুটা কী! উনি কী সত্যি সত্যি সঠিক জায়গায় ঘা মারছেন। না, এই বধূটি এর বিন্দু বিসর্গ জানেন না। অনেক চেষ্টা চরিত্র করেও ওর মনের কথা জানা সহজ হলো না। বুঝলাম ওর অন্তরের পৃথিবীটা এতই গোপনীয়, জানতে বুঝতে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে বই কী।  গণ্ডিটা যে নারীদের সীমানাতেই বাঁধা পড়ে আছে, এর বাইরে যে আসতে মানা, ওরা নিজেরা এই সত্যি কথাটা আর কবে বুঝবে। বাড়ির কর্তা কত কথাই তো গড়গড় করে বলে গেলেন। আমিও প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে জানতে চাইলাম কোথায় এত শক্তপোক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে ওদের মনটাকে। একটি শিশু এসে মায়ের আঁচল ধরে কেমন নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে রইল। ওই শিশুটি আর ওর মায়ের না-বলা কথার মধ্যে আমি কোনো তফাৎই খুঁজে পেলাম না। পুরুষটি একটু আধটু বর্ণপরিচয়ের সুযোগ সুবিধা পেলেও তেমন কিছু মনোযোগ দেবার উৎসাহ দেখান নি। নিজের গিন্নীর দিকে তাকিয়ে বললেন ‘ও একটু এইরকমই। তাতে তেমন কিছু অসুবিধা নেই, কাজ চলে যায়। মেয়েমানুষ এর চেয়ে বেশি পা ফেললেই হোঁচট খাবে যে।’ এরপর আর কি কোনো কথা বাড়ানো যায়। একটু পরেই অনেকটা দূর থেকেই যে শব্দগুলো ভেসে এলো – ‘উলু উলু ধ্বনি’। এমন ধ্বনিতে বুঁদ হওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোনো রাস্তা খোলা থাকে না।  বউটি স্বামীকে ডেকে ছোট্ট একটা কাঁসার থালায় দু-চারটে গোল গোল সাদা রঙের কী দিয়ে হাতটা আমার দিকে তাক করে বলল, ‘সাহেব-বাবাকে দিন।’ হিন্দু ঘরের বৌ স্বামীকে ‘আপনি’ বলেই সম্বোধন করে। আমাকে অবাক হতে দেখে কর্তা বললেন ‘ নারকেলের নাড়ু, ভয়ের কিছু নেই, নিশ্চিন্তে খান।’ এত মমতা ভরা অদেখা দৃষ্টি আমি জীবনেও কল্পনা করি নি এমনিতে কিন্তু বুঝলাম এদেশের মেয়েদের মনের জমিটা বড় উর্বর, ঠিকঠাক চাষ করলে উৎকৃষ্ট ফসল ফলবেই। বন্ধ ঘরের দরজা জানালাগুলো খুলে দিতে হবে। বললাম, আমার গিন্নীর ঘরোয়া পাঠশালায় পাঠাতে আপনার আপত্তি আছে?  কথাটা শুনেই ক্ষণেক থমকে গেল ওনার স্বামী। আমার ভাবনাটা জোর পেল উঠোনে রোদে শুকাতে দেয়া কাঁথায় অপূর্ব সুন্দর কাজ দেখে। চোখ জুড়িয়ে গেল মুহূর্তে। কী শৈল্পিক নৈপুণ্যে প্রকৃতিকে  সাজিয়ে তুলেছে । বাংলার মায়েদের এত ঘুমন্ত প্রতিভা দেখে প্রশ্ন না করে পারলাম না। আপনি মা কেমন করে ফুটিয়ে তুলেছেন?  এমন উত্তর আসবে আশা করিনি। কথাটা মুখে যেন বসানোই ছিল – ‘এই আর এমন কী,  আমাদের ঘরে ঘরে মেয়েরা এর চেয়ে ভালো কাজ করে।’ আরও কত প্রতিভা না জানি এরা লালন করে! এত দৃঢ়তার সঙ্গে জবাব শুনে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে মেয়েরা দিনরাত সংসারের জোয়াল কাঁধে নিয়ে নিজেকে এমন করে উজাড় করে দিতে পারে আর যাই হোক এদের উপেক্ষা করা যাবে না, এখানে আলো ফেলতেই হবে, যেভাবেই হোক। শুধু আমি নই, আমার স্ত্রীও সায় দিয়ে বলল, ‘এদেশের শাসক কী করবে জানি না, গোটা পৃথিবীর নারীদের গল্প আমাকে এদের শোনাতেই হবে।’ 

এই দেশের আলো বাতাসে হেনরী ভিভিয়ান ডিরোজিওর আত্মা ঘুরে বেড়ায়। ওই তো গঙ্গার পাড়ের মুক্ত বাতাসের ছোঁয়ায় তাঁর কবিতার পঙক্তিগুলো সকলে কেমন মুগ্ধ হয়ে আজও যেন শুনছে, দোলা দিয়ে চলেছে কত না গভীরে, আমার ভাবনাকেও চঞ্চল করে তুলে ধাক্কা মারছে সজোরে। আমি তাঁর সঙ্গে করমর্দন করতে চাই। কেন মনে  হচ্ছে এই তো সেদিন আমিও ছিলাম, একই শ্রেণীকক্ষে বসে পাঠ শুনেছি আর শব্দের মায়ায় জড়িয়ে গিয়ে শৈশবকে খুঁজে বেড়াচ্ছি,যৌবনের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে এমন এক পাড়ে এসে উপনীত হয়েছি যেদিকে তাকাই শুধুই প্রকৃতির ডাকাডাকি, সবুজের সমারোহ, এই পৃথিবীটাকে বুকে করে বাংলার মাটির গন্ধ শুঁকছি। ছাত্রশিক্ষকের এমন সমধুর সম্পর্কের ছবি কে কবে দেখেছে, এমন কথা কে আর কবে শুনেছে। আহাঃ একবার যদি তাঁর বাগ্মীতার ছোঁয়া পেতাম। রামতনু লাহিড়ী, রামগোপাল ঘোষ, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়রা কতই না ভাগ্যবান হিন্দু কলেজে এমন শিক্ষকের সংস্পর্শে আসতে পেরেছিলেন। না হলে কে এমন করে গভর্ণর জেনারেল লর্ড আমহাষ্টকে পত্র লিখতে পারেন ‘…অঙ্কশাস্ত্র, রসায়নবিদ্যা, দর্শনশাস্ত্র, শারীরবিদ্যাকে অন্য বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত করা উচিত যদি প্রকৃতই ব্রিটিশ আইনসভা এদেশীয়দের উদার ও আলোকিত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চায়…।’  লর্ড ওয়েলেস্‌লির উৎসাহ ও উদ্দীপনায় মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার বাঙ্গালা গ্ৰন্থ রচনা করেছিলেন “বত্রিশ সিংহাসন” ও “রাজাবলী”, রাজীবলোচন প্রণীত “কৃষ্ণচন্দ্র চরিত”, চণ্ডীচরণ মুন্সীর “তোতার ইতিহাস”। এইসব গ্ৰন্থ কয়জন দেশীয়দের বইয়ের টেবিলেই বা জায়গা পেয়েছে। বাঙলা গ্ৰন্থে পারসী শব্দের ছড়াছড়ি, বোধগম্য নয়, এখনকার বাংলা ভাষা ধীরে ধীরে পাল্টাচ্ছে। এক মাষ্টার মশাই তো বলেই ফেললেন, ‘ আপনি যাই বলুন, তাই বলুন আমরা কিন্তু নিজেকে এখানে খুঁজে পাই না, ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো তো দূরের কথা। বিদেশের ভাব দিয়ে তো স্বদেশকে চেনা যায় না। আমাদের কত অভাব, কত অভিযোগ, এইসব পড়ে তো ওরা কি করে বুঝবে, আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, আমাদের শিকড়ই বা কোথায়?’ কথাটা আমার কানে লেগে গেল। সত্যিই তো সবার আগে তো নিজেকে জানতে হবে, না হয় এই শিক্ষার মূল্য কী! সব যে বদহজম হবে। ইংরেজদের কার্যসিদ্ধি হবে বটে, বাবুদের অতৃপ্ত মনের খোরাকও জোগান দেবে কিন্তু দেশীয়রা থেকে যাবে যেই তিমিরে সেই তিমিরেই। ডাক্তার ফ্রান্সিস্‌ বুকানান হামিল্টন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন ‘কেবল ব্যকরণ স্মৃতি ও ন্যায়শাস্ত্র পড়ে তো আর মন সমুন্নত, জগত ও মানবকে বুঝিবার সহায়তা হয় না। …তাছাড়া এদেশের পণ্ডিতদের বেদ, বেদান্ত, গীতা, পুরাণ, ইতিহাসের জ্ঞানগম্যেরও অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।’ একথাটা তো ঠিক কতিপয় কলিকাতার মধ্যবিত্ত গৃহস্থের ইংরেজি শিক্ষা দিয়ে গোটা সমাজকে চেনা যায় না, খোলনলচে পাল্টে ফেলার জরুরি, যত তাড়াতাড়ি এই সত্য ভারতবর্ষের মানুষ বুঝতে পারবে, ততই মঙ্গল। সময় মানুষকে কতটা শেখায়, অনুমান করা কঠিন কিন্তু মানুষ সময়ের থেকে রোজ অল্পবিস্তর অনেক মূল্যবান সম্পদ খুঁজে নিয়ে ভবিষ্যতকে মনের মতো গড়ে নিতে পারে, এটা ধ্রুব সত্যি। এমন আলোর উৎসের কথা মনে নিয়ে আমি এমন আলপথ ধরে হাঁটা শুরু করলাম যেখানে পিছপা হওয়া যায় না, অথচ সামনের পথটা কম পিচ্ছিল নয়। প্রতিভাস ম্যাগাজিন

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *